1 of 2

অমিতাভ, আপনাকে নিয়ে – শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়

অমিতাভ, আপনাকে নিয়ে – শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়

অমিতাভ, আপনি তো বলেছিলেন, আপনিই তো একদিন আপনার প্রাণের বন্ধু নিরঞ্জনকে তার বসার ঘরে বসে চা খেতে খেতে বলেছিলেন, “একটা ছোট মতন মেয়ে পেলে বিয়ে করি। এই বাউণ্ডুলেপনা আর ভালো লাগে না।”

‘ছোট মতন মেয়ে’ কথাটা বলে আপনি নিরঞ্জনের স্ত্রী মৃদুলার দিকে চেয়েছিলেন। না, আমি বলছি না, আপনি অন্যায় করেছিলেন বা আপনার দৃষ্টিতে লালসা ছিল। আসলে, আপনি জানতেন মৃদুলার দুটি ছোট বোন আছে, তারা অবিবাহিত। মনে মনে হয়তো ক্ষীণ প্রত্যাশা ছিল, মৃদুলা বলবে, সত্যি আপনি সংসারী হতে চান? আমরা সম্বন্ধ করবো?

কিন্তু আপনি জানতেন না, বাঙালী মেয়ে যত অসহায়, যত অরক্ষণীয়া হোক, স্বেচ্ছায় একজন মাতাল মানে মদ্যপ—এবং চরিত্রহীন মানে নারী-সংসর্গে অভ্যস্ত—ছেলেকে বিয়ে করবে না, তার গলায় মালা দেবে না। তার চেয়ে বরং একজন সাধারণ কেরানী-টাইপের বর অনেক বেশি অভীষ্ট।আমাদের দেশে কৌমার্য এখনও, এই বাজারে, বহু শত গ্রাম সোনার দামে বিক্রি হয়।

আহা, ভুল বুঝবো কেন? আমি জানি, আপনি যা বলেছিলেন, তাই চেয়েছিলেন আন্তরিকভাবে। একটি মেয়ের ভালোবাসা পেলে আপনি জীবনটা বদলে ফেলবেন, এই তো? কিন্তু কে ঝুঁকি নেবে বলুন? কেন নেবে? আপনি অনেক টাকা রোজগার করেন, আপনি একা একটা ম্যাঙ্গানিজ রপ্তানি প্রতিষ্ঠান চালান, সেই কারণে কি? কখ্খনো না। আপনার একাকিত্ব, ভৌতিক নির্জনতা, সঙ্গহীনতা,—সে আপনার নিজের সমস্যা।

অমিতাভ, আপনার ছ’ফুট লম্বা চেহারা, আপনার এগারো ইঞ্চি হাতের পাঞ্জা, ভিক্ষের হাত সেদিন আপনাকে মানায় নি।

নিরঞ্জনের স্ত্রী মৃদুলা আপনাকে না দিক, শেষ পর্যন্ত আপনি তো পেয়েছেন। রেখাকে পেয়েছেন। সেইখানে আপনার জিত জানবেন।

রেখাও আপনার হিসেবে ‘ছোট মতন মেয়ে’। কিন্তু ও বিধবা। ওর স্বামী—ভাস্কর ত্রিশ বছর বয়সে হার্ট-অ্যাটাকে মারা যায় ক্যানাডা নামক অন্য এক দেশে, ওটাওয়া নামক অন্য এক শহরে। সে-মৃত্যুর ব্যাপারে, অমিতাভ আপনার কোনো দায়িত্ব ছিল না। আমি জানি।

এবং রেখা বলেছিল, “দেখ, বিয়ে জিনিসটা কী, তা তো আমি একবার দেখলাম, আবার এ-সবের মধ্যে গিয়ে কাজ কী?”

ইডেন গার্ডেনের উত্তরদিকের কোণটায় বসে আপনি বলেন নি? বলেছিলেন, “রেখা, আমাকে একটা চান্স দাও। জীবনে আমি একটি মেয়েরও ভালোবাসা পাইনি। অন্তত আমার নিজের বুক-ভরতি ভালোবাসা জমে জমে পাথর হয়ে যাচ্ছে, তাকে একটা বহিষ্কারের সুযোগ দাও। আমায় করুণা করে ফিরিয়ে দিও না।” প্রেমে পড়লে অল্পবয়সী ছেলেরা এই ধরনের কথা বলে শুনেছি। কিন্তু। আপনিও?

রেখা আপনাকে শুধু করুণা করে গ্রহণ করেছে, একথা আমি বলবো না। ভাস্করের সঙ্গে তার মাত্র তিন বছরের দাম্পত্যজীবন হলেও সে যে কী বস্তু, তার স্বাদ সে পেয়েছে। তার সামনে অনন্তকাল পড়ে আছে, কমপক্ষে আরো কুড়িটা উত্তেজিত বছর। নিশ্চিত সে ভেবেছে, এই কুড়ি বছর, এক হাজার সপ্তাহ, সাত হাজার দিন সে ভাস্করের ছবির দিকে চেয়ে বসে থাকবে, না জীবনটাকে অন্যভাবে তৈরি করে নেবার সুযোগ নেবে?

সুযোগ নিয়েছে এবং দিয়েছে—দুই-ই। আপনাকে শুধু একটি ছোট প্রশ্ন করেছে, “অমিতাভ, দেখ, তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি তো? আমার সর্বনাশের শেষ সম্বল যদি তোমাকে দিই, তুমি তার অসম্মান করবে না?”

রেখা বলেছে, “আমি যেমন আছি, তেমনি বাকি জীবনটাও থাকতে পারবো। তাতে কষ্ট আছে, দুঃখ আছে, জীবনের অপচয় আছে, কিন্তু হতাশা নেই।”

আপনি, অমিতাভ, ইডেন গার্ডেনের উত্তর কোণে বসে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, মনে আছে, “বিশ্বাস করে মানুষ ঠকে না?”

অথচ আজ আপনি ডাক্তার বোস, গাইনোকলজিস্ট-এর চেম্বারে বসে অপেক্ষা করতে করতে ভাবছেন অন্য কথা।

ঘরটার চারদিকে সার-সার চেয়ার পাতা, মাঝখানে একটা নিচুমতো লম্বা টেবিল। তার ওপর দু’পাশে দুটো ছাইদান আর মাঝখানে একরাশ সাময়িকপত্র। ইংরেজি, বাংলা—বেশিরভাগই পুরনো। ঘরটার দেয়ালে ডাক্তার বোসের ছাত্র-বয়সের একটা ছবি, সম্ভবত বিলেত যাবার সময়ে তোলা। আর ফ্রেমে বাঁধানো তাঁর এডিনবরা থেকে পাওয়া ডিগ্রি, ডিগ্রিটার নিচে বিভিন্ন কালিতে সই করা সাহেবদের নাম।

আপনাকে নিয়ে তিনজন পুরুষ এই ঘরটায় অপেক্ষমাণ। আর বাকি সবাই মহিলা। অর্থাৎ, অনেকেই একা এসেছে, কেউ কেউ দিদি বউদি মা মাসির সঙ্গে। হয়তো তাদের স্বামীদের সময় নেই বা আগ্রহ নেই। হয়তো বা নেহাতই রুটিন চেক-আপ—স্বামীদের আসার প্রয়োজন ছিল না।

কারা রোগিণী, দেখে আপনি মোটামুটি বুঝতে পারলেন। গর্ভের মধ্যে অর্ধস্ফুট সন্তান নিয়ে যারা এসেছে তাদের তো স্পষ্টই চেনা যায়। উদাসীন বিষন্ন মুখ, ক্লান্ত চোখ, চোখের নিচে কালি। সিঁথিতে অল্প সিঁদুরের আভাস। প্রেমিকা ছিল এরা, আবার কখনো প্রেমিকা হয়ে যাবে, মাঝখানে একটা আবোপিত অসুস্থতা এদের কাতর করে রেখেছে। নারী নর্ম-সহচরী, কিন্তু এই নর্মকাণ্ডের মধ্যে ঢের বেদনা লুকোনো থাকে। কেন থাকে, কেন নারীই কেবল সে-বেদনা বহন করবে—প্রকৃতির এ পক্ষপাতিত্বে আপনার মন সায় দেয় না।

অন্য দু’জন পুরুষের একজন একটু বয়স্ক। হয়তো অভিজ্ঞ বলেই নির্বিকার; চুপচাপ বসে সিগারেট খাচ্ছিলেন—এইমাত্র পার্শ্ববর্তিনীর উদ্দেশে কোনো রুঢ় মন্তব্য করলেন। কোনো মৃদু অনুযোগের উত্তরে সম্ভবত বলে উঠলেন, ন্যাকামি কোরো না। পার্শ্ববর্তিনীর দু হাতের কব্জিতে অনেকগুলি সোনার চুড়ি ঢলঢল করছিল।

অন্যজন নব্যযুবক। মুখের অপরাধীভাব গোপন করার জন্যে দ্রুত পা নাচাচ্ছে, এদিক-ওদিক চাইছে আর মাঝে মাঝে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করছে—সোডা খাবে? কোকোলা খাবে? এক খিলি পান খাও না! আবার ঘন-ঘন কব্জি উলটে ঘড়ি দেখছে আর নিজের মনে বলছে, এত দেরি হয় কেন বুঝি না!

“ভালোবাসার সন্তান সব!” কথাটা আপনার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল হঠাৎ। শব্দটা কানে যেতে নিজেই চমকে উঠলেন।

রেখা আপনার ডানদিকে বসে নখ খুঁটছিল। হাতের চাপ দিয়ে প্রশ্ন করলো চাপা গলায়, “বলছো কিছু?”

আপনি বললেন, “ডাকই পড়ে না। কখন থেকে এসে বসে আছি আমরা।”

“আমাদের পরের লোকেরা ঢুকে পড়ছে না তো?”

“না, না। আপনি স্তোক দিলেন রেখাকে। “বারোমাস তিরিশ দিন এই চেম্বারে এমন ভিড়, তুমি তো আগেও দেখেছ। মানুষের তো কোনো মেটিং সিজন নেই!”

বলে অমিতাভ আপনি ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একটু হাসতে চেষ্টা করলেন। আর তখনই যেন একেবারে নতুন করে দেখলেন রেখাকে।

কী ফর্সা টুকটুকে রঙ ছিল ওর। এখন ধোয়া মাছের মতো সাদা।

কী পাতলা গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট ছিল। এখন শুকনো কাগজ।

চোখদুটো তেমন বড় ছিল না কিন্তু কেমন একটু লজ্জা ও ভয়-মাখানো, বেনেবউ পাখির মতো ছলছলিয়ে থাকত। আর এখন?

এখন সিঁথিতে সিঁদুর ওর জ্বলজ্বল করছে আর মুখটা মাটির প্রদীপের মতো ম্লান।

আপনার মনে আছে সেই এক শনিবারের বিকেলের কথা? রেখার শ্বশুর—কী যেন নাম ভদ্রলোকের? বিপিনবাবু না পুলিনবাবু গোছের—তাঁর কাছে আপনি সটান গিয়ে বলেছিলেন, “আমার নাম অমিতাভ দত্ত। আমি রেখাকে বিয়ে করতে চাই।”

“রেখাকে? মানে বউমাকে?” ভদ্রলোক যেন আঁতকে উঠেছিলেন।

তাঁর সামনে ছ’ফুট লম্বা একটা দৈত্যের মতো চেহারার মানুষ। এগারো ইঞ্চি হাতের পাঞ্জাদুটো জোড়া করে অনুরোধ করছে, “আপনি অনুমতি দিন।” একটু ভয় পাওয়ার কথা বইকি। ভাবটা, অনুমতি না দিলে মাথা ফাটিয়ে দেবো!

একটু আত্মস্থ হয়ে ছোটমতো টাকমাথা মানুষটি বলেছিলেন, “কিন্তু তা কী করে সম্ভব? সে আমার পুত্রবধূ, ছেলের বিয়ে দিয়ে তাকে আমাদের পরিবারে নিয়ে এসেছি—”

আপনি বলেছিলেন, “ভাস্কর। সে তো মারা গেছে।”

“হ্যাঁ, গত বছর মারা গেছে। হীরের টুকরো ছেলে ছিল আমার। হঠাৎ সব ভাসিয়ে এমন করে চলে যাবে, কে জানতো!” ভদ্রলোক চোখ মুছলেন।

সত্যি, খুব দুঃখের কথা, আপনি বলেছিলেন, “কিন্তু মৃত্যুর ওপর কি মানুষের হাত আছে? মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়। আপনি ভগবানে বিশ্বাস করেন তো?”

“করি। কিন্তু এ-শোকের কোনো সান্ত্বনা পাই না।”

“যতদিন বেঁচে আছে মানুষ, ততদিনই তার বেঁচে থাকার আনন্দ,” বৃদ্ধটিকে আপনি বুঝিয়েছিলেন, “সার্থকভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা, তাতে কোনো পাপ হয় না, আপনি স্বীকার করবেন? যদি করেন, তবে আপনার ভাস্করের মতো আপনাদের বউমা রেখাও হীরের টুকরো মেয়ে, ওকে বাঁচতে দিন। ওর সামনে বিশাল জীবন পড়ে রয়েছে, ও একা।”

রেখা আপনাকে বলেছিল, ওর শ্বশুর অনুমতি না দিলে ও আবার বিয়ে করবে না। আইনের বাধা নেই, তা সত্ত্বেও। এবং সেই ছোটমতো টাকমাথা মানুষটি শেষ পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে আনার সময়, বউমা, তোমায় কথা দিয়েছিলাম সুখে রাখবো। আমি সে কথা রাখতে পারি নি। আমার ছেলে বেইমানি করেছে।”

বিদায় নেবার দিন রেখার সমস্ত গহনাপত্র সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আমি আশীর্বাদ করছি, তোমরা সুখী হও।”

মনে আছে অমিতাভ?

মনে আছে, আপনার প্রাণের বন্ধু নিরঞ্জন ও তার স্ত্রী মৃদুলা বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে এসে একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিল?

মৃদুলা বলেছিল,”পরীটিকে কোথায় আবিষ্কার করলেন?”

আপনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “স্বর্গ থেকে নিয়ে এলাম।”

নিরঞ্জন আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে মুখখানা উঁচু করে আপনার কানে-কানে বলেছিল, “তোমাকে রেখার উপযুক্ত হতে হবে। কাজটা সহজ নয়।”

কাজটা কঠিনও নয়, তা আপনি প্রমাণ করেছেন।

বহু বছরের স্বেচ্ছাচারিতার অভ্যেস আপনি একদিনে পরিত্যাগ করেছেন। এবং তার জন্যে অনুশোচনা বোধ করেন নি। চ্যালেঞ্জ শুধু আপনার একার সামনে ছিল না, রেখার সামনেও ছিল। এবং আপনি ম্যাঙ্গানিজ-এক্সপোটার—চ্যালেঞ্জের সামনে কাবু হবার পাত্র নন।

প্রথম প্রথম আপনার দুঃখ হতো মৃত ভাস্করের জন্যে। মনে হতো, সে কি রেখার শরীরে শুধু চামর বুলিয়ে পুজো করেছে? কোণে-কোণে লুকোনো কত রত্নের ভাণ্ডার ছিল, খুঁজে দেখে নি? নাকি দাঁতনখহীন জরদ্‌গব ছিল লোকটা?

একদিন আপনি রেখাকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন কথাটা। অন্যভাবে।

“আমি যখন আদর করি, তুমি চোখ বুজে থাকো কেন?”

রেখা বলেছিল, “ধেৎ, কী যে বলো।”

“আমি লক্ষ করেছি। আমাকে তোমার ভয় করে না কি?”

“ভয় কেন করবে?” বলেছিল রেখা, “ভালোবাসলে কাউকে ভয় করে?”

আপনি বলেছিলেন, “দেখো, একদিন হাতেনাতে ধরিয়ে দেবো তোমায়।”

কিন্তু ধরিয়ে দিতে পারেন নি। কারণ রেখা ধরা দেয় নি। রেখা তারপর থেকে আর চোখ বুজে থাকতো না। চেয়ে থাকতো, আদর ফিরিয়ে দিতো আরো আদর করে। যে-রকমটি আপনি আর কারো কাছে পান নি।

তবু আপনার মনে হতো, ও এক-এক সময় অন্যমনস্ক হয়ে যায়। এক-এক সময় ওর চোখের কোণে জল উঠে আসে। কিন্তু আপনি আর প্রশ্ন করতেন না। আপনি জানতেন, আপনার জীবনের শেষ যুদ্ধটি লড়তে হবে, একজন মৃত ব্যক্তির সঙ্গে।

“মিসেস দত্ত।”

ডাক শুনে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন আপনি।

একজন শাড়ি-পরা নার্স আপনার পাশে বসা রেখাকে আঙুল হেলিয়ে ডাকলো। আপনাকে বললো, “আগের কিছু কাজ আছে, সেরে নিই, তারপর আপনিও আসবেন।”

আপনি আর বসলেন না। ঘরেই পায়চারি করতে লাগলেন। রেখা ধীরে-ধীরে হেঁটে চলে গেল ভেতরে। নার্সটির পিছু-পিছু। ঘরটার মধ্যে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন আপনি। কেউ-কেউ চলে গেছে। দু-একজন নতুন পেশেন্ট এসে বসেছে সে-জায়গায়। সস্ত্রীক বয়স্ক ভদ্রলোকটি নেই। তাঁদের চেয়ারে দু’জন মারোয়াড়ি রমণী। দু-জনেরই বিশাল বপু, একজনের পায়ের পাতা দুটো পাঁউরুটির মতো ফোলা।

রেখার ওজন, রক্তচাপ, ইউরিন এবং কিছু যন্ত্রণাদায়ক শারীরিক লক্ষণ পরীক্ষা করা হয়ে গেলে পর আপনাকে একেবারে ডাক্তার বোসের খাস কামরায় ডাকা হলো। আপনি গিয়ে দেখলেন, ও সবেমাত্র সরু বিছানাটা থেকে নেমে চেয়ারে বসেছে, ব্লটিং কাগজে কালি শোষার মতো করে কপালের ঘাম মুছছে। আপনি ওর পাশটিতে গিয়ে বসলেন। পিঠের ওপর আলতো হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “লেগেছে খুব?”

“একটু।”

ডাক্তার বোস হাসতে হাসতে বকুনি দিলেন রেখাকে। বললেন, “আপনার নিজের দোষ। একটু অন্যমনস্ক থাকবেন তো, তা না! আপনার সঙ্গে গল্প করার চেষ্টা করলাম কত, আপনি পাত্তাই দিলেন না।”

তারপর খসখস করে ডায়েরিতে নোট লিখতে লাগলেন। প্রেসক্রিপ্শন লিখলেন। কাগজের দিকে চোখ রেখে বললেন, “ওজন বাড়ছে না কেন? পেট ভরে খান না? এখন দু’জনের খাবার একজনকে খেতে হবে তো।”

তারপর আপনার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “দু বেলা একটু করে হাঁটা দরকার, তবেই খিদে হবে। আপনি সঙ্গে করে হাঁটাতে নিয়ে যান না?”

আপনি বললেন, “যাই।”

“আর মনটা প্রফুল্ল রাখার চেষ্টা করবেন। এই সময়ে মেয়েরা বড় ডেলিকেট স্টেট অফ মাইন্ড-এ থাকে।”

“যথাসাধ্য চেষ্টা করি আমি।” আপনি যেন আত্মপক্ষ সমর্থন করার চেষ্টা করলেন অমিতাভ। “কিন্তু ও কিছুতে কথা শোনে না। জোর করলে কাঁদে।”

“ঠিক আছে।” ডাক্তার কাজ শেষ করে বলে উঠলেন, “এগুলো চলুক। পনেরো দিন পর আবার দেখিয়ে যাবেন।”

রেখা ঘর থেকে বেরিয়ে এলে পর আপনি চুপিচুপি ডাক্তার বোসকে জিজ্ঞেস করলেন, “চিন্তার কারণ নেই তো?”

চিন্তিত মুখে ডাক্তার উত্তর দিলেন, “না, তেমন কিছু না। একটু রক্তাল্পতা ছাড়া অন্য কোনো উপসর্গ নেই। আর তার ব্যবস্থা তো আমি করছিই। বাচ্চার হার্টবিট স্বাভাবিক, পজিশনও ঠিক আছে, কিন্তু যথেষ্ট বাড়ছে না কেন? চব্বিশ সপ্তাহ হলো, এখনও এতটুকু থাকবে?”

শুনে আপনার বুকটা ছ্যঁত করে উঠলো।

বললেন, “আগে একটা মিস্‌ক্যারেজ হয়েছে, এটাকে বাঁচাতেই হবে যেমন করে হোক।”

ডাক্তার চোখ তুলে আপনার দিকে চেয়ে হাসছেন দেখেও আপনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলেন, “আচ্ছা, আমার নিজের কোনো চেক-আপ দরকার মনে করেন তো বলুন।”

“আরে না না। সে-সব আমি আগে দেখে নিয়েছি। আপনি ওঁর খাওয়া-দাওয়ার দিকে নজর দেবেন একটু। যথেষ্ট পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে মা আর বাচ্চা দু’জনেরই ক্ষতি হচ্ছে।”

অথচ তার কোনোই কারণ নেই। টাকার অভাব নেই আপনার, রেখার প্রতি মনোযোগের অভাব নেই। তবে কেন রেখা আপনার সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখতে দেবে না? সেটাকে বঞ্চিত করার জন্যে নিজে পর্যন্ত উপোস করে থাকে?

বাড়ি ফেরার পথে স্টিয়ারিং-এ বসে আপনার মনে হলো, চীনে রেস্তোরাঁয় খেয়ে গেলে হয়। রেখাকে সামনে বসিয়ে পেট পুরে খাওয়াবেন ওর যা ইচ্ছে। ও খেলে তবে তো ওর গর্ভের ভেতরের অবোধ প্রাণীটা কিছু ভাগ পাবে। লাল ট্রাফিক লাইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আপনার চোখে ভেসে উঠলো, শীর্ষাসনের ভঙ্গিতে একটা শিশু মুখটা হাঁ করে রয়েছে। অথচ বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে, অমিতাভ, আপনি টের পেতেন, গর্ভের ভেতরে অবস্থিত শিশুর খাদ্য শুধুমাত্র তার নাভির মধ্যে দিয়ে যায়। জন্মের আগে সে মুখ খোলে না।

রেখা বাদ সাধলো, “না, বাড়িতে রান্না করা আছে, নষ্ট হবে। আগে থেকে ব্যবস্থা করে আর একদিন আসা যাবে।”

‘ডেলিকেট স্টেট অফ মাইন্ড’ ভেবে আপনি আর জোর করলেন না।

বাড়ি ফিরলেন, তখন নটা বেজে গেছে। এসে শুনলেন, আপনার আগেকার প্রাণের বন্ধু নিরঞ্জন এসেছিল সস্ত্রীক, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেছে।

একটা ছোট্ট চিরকুটে লিখে রেখে গেছে, “আজ তোমাদের বিয়ের দিন। শুভকামনা জানাতে এসেছিলাম আমরা। তোমরা বাড়ি নেই, নিশ্চিত বাইরে কোথাও সেলিব্রেট করতে গেছ। একগুচ্ছ ফুল রইলো, যখনই ফেরো, আমাদের কথা মনে করে গ্রহণ কোরো। উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট। মৃদুলা/নিরঞ্জন।”

এবার ফুলগুলোর দিকে চোখ পড়লো আপনার। একগুচ্ছ গোলাপ। টকটকে লাল, অন্তত পঞ্চাশখানা। সমস্ত বসার ঘরটা আলো করে আছে।

রেখা বললো, “আর একটু আগে ফিরতে পারলে দেখা হয়ে যেত।”

আপনি বললেন, “আজ বিয়ের দিন ছিল আমাদের। একবারও মনে পড়েনি তোমার? সত্যিই তো, আজ আমাদের সেলিব্রেট করা উচিত ছিল।”

রেখা বললো, “প্রত্যেকটা দিনই তো আমাদের বিয়ের দিন, তাই না? একটা বিশেষ দিনে উৎসব করার কী মানে? তা ছাড়া, তোমারও তো মনে পড়ে নি!”।

গোলাপের গুচ্ছ আপনি দু’হাতে তুলে নিলেন অমিতাভ। তুলে নিতে গিয়ে দেখলেন, ফুলগুলো। আলাদা করে ছেড়া। গোলাপের পাতার সঙ্গে সরু কাঠি দিয়ে বাঁধা। আপনি বুঝতে পারলেন, নিরঞ্জন ওগুলো চৌরঙ্গি অঞ্চল থেকে কিনেছে।

পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে খুব সস্তায় বিশেষ বিশেষ সময়ে গোলাপ, স্বর্ণচাপা, সাদা লিলি বিক্রি করে কয়েকজন লোক। ট্রাফিক আলোয় গাড়ি দাঁড়ালে সামনে এনে মেলে ধরে।

আপনি জানেন, ও-সব কবরের ফুল। সাহেব-মেমদের কবরখানা থেকে চুরি করে আনা।

বিরাট গোলাপের গুচ্ছ নাকের কাছে এনে আপনি গন্ধ শুকলেন। জেনুইন। মনে মনে বললেন, “হোক না কবরের ফুল, হোক না সুতো দিয়ে বাঁধা, গোলাপ গোলাপই।”

তারপর রেখাকে ডেকে বললেন, “এই শুনছো, হোক আজ রান্না নষ্ট না হয়, ফ্রিজে রেখে দিতে বলল। আজ আমরা বাইরে খাবো।”

১৩৮১ (১৯৭৪)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *