অভিশপ্তা
কাশীর মানমন্দির দেখিতে গিয়াছি। পূর্ণিমার সন্ধ্যা। নীলপদ্মের রং-মাখানো আকাশ, তার নীচে গঙ্গার ধবল লহরবীণায় তরল লীলা রাগিণী বাজিতেছে। এই রূপপুরীকে সম্পূর্ণতা দিবার জন্যই, যেন বসন্তের গুঞ্জরিত নবীন হাওয়া আজ প্রকৃতির মুঞ্জরিত কুঞ্জদুয়ারে অতিথি।
মানমন্দির দেখা শেষ হইয়া গিয়াছিল; অতএব বিশ্বের এই যৌবন-শ্রীকে অবহেলা করিতে পারিলাম না; আস্তে আস্তে ছাদের একপাশে গিয়া বসিয়া পড়িলাম। তখন চাঁদ উঠিতেছে।
আমি কবি নই; কিন্তু তবু যেন মনে হইল, গঙ্গার চপল জলে জ্যোৎস্না ওই যে রূপার ‘আখর’ লিখিয়া দিতেছে, চেষ্টা করিলে আজ যেন তাহার ভিতরে সৌন্দর্য-কাব্যের দু-একটা ইঙ্গিত জানিলেও জানিতে পারা যায় এবং মন-মাতানো সুগন্ধ মাখিয়া বসন্তবায়ু আজ যে সংগীত গাহিতেছে, তাহা যেন প্রকৃতির ফুলবাগানের কুঁড়ি ফোটার আনন্দোৎসব ভিন্ন আর কিছু নয়!
অনেকক্ষণ বসিয়া রহিলাম, কতক্ষণ, তা জানি না। হঠাৎ আমার চমক ভাঙিয়া গেল। ঘড়ি খুলিয়া দেখি, রাত্রি সাড়ে দশটা। তাইতো!
তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িলাম। অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়া দেয়াল ধরিয়া ধরিয়া কোনোরকমে আঙিনায় নামিয়া আসিলাম। দু-একবার হোঁচট খাইয়া সদর দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইলাম। দরজা ধরিয়া টানিলাম, কিন্তু দ্বার খুলিল না। দ্বার বাহির হইতে বন্ধ।
আমার মাথায় আকাশ ভাঙিয়া গেল। আমি যে ছাদের উপরে কবিত্বের স্বপ্ন দেখিতেছে, রক্ষক অত-শত খেয়াল করে নাই, সে দরজা বন্ধ করিয়া চলিয়া গিয়াছে।
এখন উপায়? একবার শেষ চেষ্টা করিলাম। দরজার উপরে সতেজে এক ধাক্কা মারিলাম— বহু যুগের প্রাচীন কবাট, ঝন-ঝন শব্দে বাজিয়া উঠিল; সেই বিশাল শূন্য পুরীর নৈশ মৌনব্রত ভঙ্গ করিয়া আর্তনাদের মতো একটা তীক্ষ্ন প্রতিধ্বনি সহসা জাগিয়া উঠিয়া আমার সর্বশরীর রোমাঞ্চিত করিয়া তুলিল।
ভয়ে ভয়ে আবার ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইলাম। প্রাঙ্গণের মধ্যে একটা বিপুলদেহ বৃক্ষ, আপনার বিস্তৃত শাখাপ্রশাখার ভিতরে খানিক আলো এবং খানিক অন্ধকার লইয়া দাঁড়াইয়া আছে! কী ভীষণ তাহার পত্রমর্মর! যেন সুদূর অতীতের দেহমুক্ত আত্মারা তাহার ডালে উপবিষ্ট হইয়া ঘন ঘন তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিতেছে! এবং ওই যে তিমির-গুপ্ত নিশাচর পক্ষীরা ঝটপট ডানা নাড়িয়া স্তম্ভিত স্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করিয়া দিতেছে, স্থান ও কাল-মাহাত্ম্যে বোধ হইল, তাহা যেন অপর জগৎচারী আত্মা সকলের অস্ফুট মধুর ধ্বনি! বুকটা কেমন দমিয়া গেল। আপনার কুবুদ্ধিকে শত শত ধিক্কার দিতে দিতে সচকিত চিত্তে সামনের একটা ঘরের দরজা খুলিয়া ভিতরে ঢুকিয়া পড়িলাম। চারিদিকে সূচীভেদ্য অন্ধকার। ভিতরটা একবার ভালো করিয়া দেখিয়া লইবার জন্য পকেট হইতে দেশলাই বাহির করিয়া জ্বালিলাম। দীপশলাকার ক্ষীণালোকে গৃহভিত্তির উপরে মোগল যুগের প্রাচীন কারুকার্য ঈষৎ স্পষ্ট হইয়া উঠিল। অন্ধকারকে আরও গাঢ় করিয়া শলাকা নিবিয়া গেল। কেন জানি না, গাটা কেমন ছম-ছম করিতে লাগিল। সেই বিস্তৃত কক্ষের নিবিড় তিমিররাশির ভিতরে যেন অপর জগতের কী-একটা বিষাদ-ম্রিয়মাণ রহস্য গুমরিয়া গুমরিয়া উঠিতেছিল।
অত্যন্ত অপ্রসন্ন চিত্তে ঘরের এক কোণে গিয়া শুইয়া পড়িলাম। আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়া ভাবিতে লাগিলাম, কোথায় আজ সে সকল শিল্পী, অলংকৃত গৃহভিত্তির উপরে যাহাদের নিপুণ হস্তের চিহ্নাবশেষ এখনও খোদিত হইয়া রহিয়াছে? কোথায় আজ সেই মানসিংহ, সেই জয়সিংহ, কক্ষমধ্যে যাঁহাদের অসামান্য সম্মান-স্মৃতি এখনও জাগ্রত হইয়া রহিয়াছে? কোথায় সেই উজ্জ্বল অতীত, কোথায় সে রাজ-ঐশ্বর্য?
সহসা একটা দমকা ঝটকার ঝাপটে বাহিরের বৃক্ষপত্রে কেমন যেন অনৈসর্গিক মর্মরধ্বনি বহিয়া গেল এবং সেইসঙ্গে ঘরের ভেজানো দরজাটাও সশব্দে খুলিয়া গেল এবং আমার তন্দ্রাবিষ্ট শ্রবণের উপরে কে যেন মুখ রাখিয়া অস্ফুটস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘কোথায়, ওগো কোথায়?’
একলাফে উঠিয়া বসিলাম এবং দেওয়ালের উপরে আড়ষ্টভাবে পৃষ্ঠ রাখিয়া দুই হাতে চোখ কচলাইয়া চাহিয়া দেখি, উন্মুক্ত দ্বারপথে চন্দ্রালোক আসিয়া ঘরের একাংশ উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছে।
চারিদিক কী স্তব্ধ! আর, আর— সেই জনশূন্য প্রাচীন অট্টালিকার মধ্যে সে স্তব্ধতা কী ভীষণ!
হঠাৎ মনে হইল, ঘরের অন্ধকার দিকটায় কে যেন নড়িয়া চড়িয়া বেড়াইতেছে! যেন কার বস্ত্রের অস্ফুট শব্দ হইতেছে, যেন মৃদু ভূষণ-শিঞ্জিত শুনা যাইতেছে। যেন কেহ ফুলিয়া ফুলিয়া চাপাগলায় কাঁদিয়া উঠিতেছে— যেন কেহ বুকভরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিতেছে! কে সে? কে সে?
আমার দেহে কাঁটা দিল, মাথার চুলগুলা খাড়া হইয়া উঠিল। আমি রুদ্ধশ্বাসে প্রায়বদ্ধকণ্ঠে পাগলের মতো বলিয়া উঠিলাম, ‘কে? কে? কে?’
সহসা, কাহার একটা অতি শীর্ণ ছায়া মুক্তদ্বার-মধ্যগত আলোকরেখার মাঝে আসিয়া দাঁড়াইল।
এ কে?
ভয়ে আমি চোখ বুজিতে গেলাম; কিন্তু পারিলাম না— আমার চক্ষুকোটরের মধ্যে নিষ্পলকদৃষ্টি কী এক কুহকমন্ত্রে বিস্ফারিত হইয়া রহিল! তদবস্থায় দেখিলাম, সম্মুখে নীরবে দাঁড়াইয়া মাংসমাত্রহীন সম্পূর্ণ কঙ্কালসার দেহ লইয়া আমার দিকে হেঁট হইয়া সে মূর্তি একদৃষ্টিতে আমাকেই নিরীক্ষণ করিতেছে! তাহার বিশীর্ণ বাহুযুগলে বলয়-কঙ্কন শ্লথ হইয়া হস্তাগ্রে ঝুলিয়া পড়িয়াছে। বস্ত্র, দেহের হাড়গুলিকে বেড়িয়া বেড়িয়া যেন লেপিয়া আছে। তাহার প্রকটাস্থি মুখ ও বুকের উপরে রাশীকৃত কেশদাম বিশৃঙ্খল হইয়া দোদুল্যমান এবং তাহার পলকহীন চক্ষুতে কী এক তীক্ষ্ন দীপ্তি!
ছায়ামূর্তির অধরোষ্ঠের আবরণশূন্য দন্তপংক্তি কাঁপিতে লাগিল এবং সেই দুঃসহ মৌন ভঙ্গ করিয়া কাতর, তৃষিতস্বরে সে বলিয়া উঠিল, ‘কোথায় ওগো কোথায়?’
আমি অসাড় হইয়া বসিয়া রহিলাম। তখন, ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে তাহার কৃশ অস্থিসার পা বাড়াইয়া আমার দিকে অগ্রসর হইল।
চকিতে আমার জড়তা ভাঙিয়া গেল। আমি প্রাণপণে চীৎকার করিয়া উঠিলাম, ‘চলিয়া যাও, চলিয়া যাও, আর এক পা আগাইলে তোমায় খুন করিব!’ আমার সে সাহস— মৃত্যুর সম্মুখস্থ কাপুরুষের অন্তিম সাহসমাত্র!’
ছায়ামূর্তি কহিল, ‘আগন্তুক, সে একদিন গিয়াছে, যে দিন মৃত্যুকে আমি তোমারই মতো ভয় করিতাম! এখন আমি জীবন-মৃত্যুর বাহিরে, সংসারের ভয়-ভাবনা আর আমাকে ব্যথা দিতে পারে না, কিন্তু পৃথিবীর যাতনা যে এখনও আমাকে শতপাকে ঘিরিয়া আছে, আমাকে পুড়াইয়া পুড়াইয়া মারিতেছে, আমাকে পিষিয়া পিষিয়া পীড়ন করিতেছে! আগন্তুক, তুমি আমাকে দেখিয়া ভয় পাইতেছ? কিন্তু, একদিন আমার এই তনু ছিল কোমল, সুন্দর, দেববাঞ্ছিত! আজ আমার এই বাহু কুৎসিত, অস্থিসার, কিন্তু এমন দিন ছিল, যখন আমার এ হাতদুটি গোলাপফুলের একজোড়া মোহনমালার মতো রাজকণ্ঠ বেষ্টন করিত! সেদিন গিয়াছে আগন্তুক, সেদিন গিয়াছে, যেদিন এ দুটি চোখের সামনে পড়িবার জন্য শত শত উন্মুখহৃদয় আবেগে ব্যাকুল হইয়া উঠিত! হায়, সে কত যুগ আগে, ওগো কত যুগ আগে!’
আমি কোনো উত্তর দিতে পারিলাম না; যেমন বসিয়াছিলাম, তেমনই কাঠ হইয়া বসিয়া রহিলাম।
ছায়ামূর্তি কহিল, ‘আগন্তুক, তুমি আমার কথা শুনিবে? আজ কয় শতাব্দী, আমার অভিশপ্ত দোসর-হারা আত্মা এইখানে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কাঁদিয়া মরিতেছে, দুটো দুঃখের কথা শুনাইবার জন্য আমার পিয়াসি-বুক ফাটিয়া যাইতেছে, কিন্তু শূন্যগৃহে কোনো দরদের দরদী তো পাইলাম না! তুমি শুনিবে আগন্তুক, তুমি শুনিবে?’
আমি কথা কহিবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু আমার মুখ দিয়া কোনো কথা বাহির হইল না। ছায়ামূর্তি তখন সেই দ্বারপথাগত পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নায় বসিয়া পড়িল। তাহার অস্থিদেহ হইতে বিকট একটা কড়কড় শব্দ উঠিল। তাহার কেশদামের প্রতি আমার দৃষ্টি পড়িল— রেশমের মতো চিকণ, কী সুন্দর সে কুন্তল!
আপনার বিগত যৌবনের, অতীত সৌন্দর্যের শেষ চিহ্নস্বরূপ সেই অলকমালা, ঈষৎ গর্বের সহিত মুখের উপর হইতে সরাইয়া দিয়া ম্লান হাসিয়া ছায়ামূর্তি কহিল, ‘এই চোখ, এই বুক, এই বাহু দেখিয়া একদিন কত মুগ্ধপ্রাণ আমার রূপের আগুনে ঝাঁপ দিয়াছে; আর আজ এই কেশ দেখিয়া আগন্তুক, তুমি কি আবার আমার সঙ্গে প্রেম করিবে? না বন্ধু না— অভাগির এ কঠিন কঙ্কালস্তূপকে বুকে চাপিয়া আর কোনো পাগল হৃদয় ধন্য হইবে না; আমি এখন ভোরের বাসি মালা, পথের ধুলায় এখন আমার শয়ন, প্রখর তপন তাপে শুকাইয়া যাওয়াতেই এখন আমার অবসান! কিন্তু কী বলিতে কী বলিতেছি!
আমার নাম ছিল, রাধা। রাজা জয়সিংহের অন্তঃপুরে রাজ-আদরে আদরিণী হইয়া বড়ো সুখে আমার দিন কাটিত। বলিয়াছি, আমি রূপবতী ছিলাম। সে রূপের বর্ণনায় আর কাজ নাই, কারণ, আজ তাহা কেহ বিশ্বাস করিবে না।
সেই রূপের মোহেই রাজা আমাকে ভালোবাসিতেন। সলিলচারী মৎস্য যেমন পাতালের আন্ধিয়ারে অন্ধ হইবার আশঙ্কায় উপরে আসিয়া ধরণীব্যাপী মুক্ত আলো এবং মুক্ত আকাশ দেখিয়া যায়, রাজকার্যের কাঠিন্যের মধ্য হইতেও তেমনই করিয়া রাজা, দিনে শতবার নানা অছিলায় আমার কাছে ছুটিয়া আসিতেন। আমাকে দেখিয়া দেখিয়া তাঁহার তৃপ্তি হইত না, আমাকে আদর করিয়া করিয়া তাঁহার আশ মিটিত না, আমার সঙ্গে কথা কহিয়া কহিয়া তাঁহার শ্রান্তি বোধ হইত না— আমি ছিলাম তাঁহার প্রাণাধিক।
একদিন শুনিলাম, রাজা কাশীধামে যাইতেছেন। বাবা বিশ্বনাথকে কখনো দেখি নাই, রাজা সেখানে যাইবেন শুনিয়া ভাবিলাম, এমন সুযোগ আর কখনো মিলিবে না।
রাজপদে আমার আরজি পেশ করিলাম। আমার সাধ অপূর্ণ রাখা, রাজার পক্ষে সাধ্যাতীত। একটু ইতস্তত করিয়া শেষটা তিনি মত দিলেন। তাঁহার সঙ্গে আমি কাশীধামে আসিলাম।
চারিদিকের ভিড় ঠেলিয়া, ভিখারি তাড়াইয়া, আমার প্রহরিবেষ্টিত শিবিকা বাবা বিশ্বনাথের মন্দির তোরণে আসিয়া স্থির হইল। প্রহরীরা মন্দিরের ভিতর হইতে লোক তাড়াইতে লাগিল, শিবিকামধ্যে বসিয়া সেই কোলাহল শুনিতে লাগিলাম। মন্দিরের ভিতর বীণা বাজিতেছিল এবং আলাপিনীর মধুর রাগিণীর সঙ্গে কাহার কণ্ঠ, ভজন গাহিতেছিল :
ভোলানাথ, দিগম্বর
এ দুঃখ মেরা হরো!
কী স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর!
হঠাৎ মাঝপথে গান থামিয়া গেল। বুঝিলাম, প্রহরীরা গায়ককে ভিতর হইতে তাড়াইয়া দিতেছে।
কেন জানি না, গায়ককে দেখিবার জন্য সহসা আমার মনে দুর্দম বাসনা বলবতী হইয়া উঠিল। আস্তে আস্তে শিবিকার আবরণ একটু সরাইয়া দিয়া আমি পথপানে চাহিলাম।
কী দেখিলাম! যাহা দেখিব বলিয়া আশা করি নাই, তাহাই দেখিলাম।
দেখিলাম, এক সুবেশ, গৌরতনু তরুণযুবক মন্দির মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিতেছে। শিরে তাহার কুঞ্চিতাগ্র দীর্ঘ কেশদাম গুচ্ছে গুচ্ছে স্কন্ধ চুম্বন করিতেছে, উন্নত ললাটে তাহার রক্তচন্দনের রেখা অগ্নিরেখার মতো জ্বলজ্বল, বিশালায়ত নয়নে তাহার দিবা-শান্ত দৃষ্টি, পুষ্ট অনাবৃত বাহুতে তাহার মৌন বীণা! যুবতীর পেলব-লাবণ্য এবং পুরুষের অটল সরলতা যেন তাহার প্রশস্ত দেহে একীভূত হইয়া মিশিয়া গিয়াছে। সে মূর্তি মানবের? না, দেবতার?
সহসা যুবকের দৃষ্টি বস্ত্রাবকাশ দিয়া আমার পিপাসী নেত্রের উপরে পড়িয়া সচকিত হইয়া উঠিল। কেন জানি না, আমি সে দৃষ্টিকে ব্যথিত করিয়া শিবিকার অন্ধকারে সরিয়া যাইতে পারিলাম না।
আমিও চাহিয়া রহিলাম, যুবকও চাহিয়া রহিল— ক্ষণিকের জন্য। প্রহরী আসিয়া যুবককে সরাইয়া দিল, যাইবার সময়ে যেন তাহার সমগ্র প্রাণ-মন নেত্রাগ্রে একাগ্র করিয়া যুবক, আমার দিকে আর একবার চাহিয়া গেল।
বাবা বিশ্বনাথের চরণে, চন্দনচর্চিত বিল্বদল অর্পণ করিয়া, তাঁহাকে প্রণামান্তে আবার শিবিকায় আসিয়া উঠিলাম। উঠিবার সময়ে চঞ্চলনেত্রে একবার চারিদিকে চাহিয়া দেখিলাম, কিন্তু আমার বুভুক্ষুহৃদয়, যে রত্নের সন্ধান করিতেছিল, তাহা তো মিলিল না!
জনতা মথিত এবং ভিখারিদলকে মুখর করিয়া শিবিকা অগ্রসর হইতেছিল। চারিদিকে বিশ্বনাথের মহান নামে ভক্তের হৃদয় ভক্তিস্তোত্রে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছিল; কিন্তু সে উচ্ছ্বাস আমার স্বপ্নাচ্ছন্ন চিত্তকে প্রীত ও স্পর্শ করিতে পারিল না। আমার অন্তর মধ্যে ভাবসাগরে তখন ঢেউ উঠয়াছে! এমন সময়ে আমার সজাগ শ্রবণে এক পরিচিত প্রিয়স্বর ধ্বনিয়া উঠিল—
তেরি নয়না জাদু ডারা!
* * *
মানমন্দিরেই মহারাজ, আমার জন্য বিস্তৃত কক্ষ সাজাইয়া দিয়াছিলেন। অভিভূত হৃদয়ে অসুস্থতার ভান করিয়া শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করিলাম। শুইয়া শুইয়া তাহারই কথা ভাবিতে লাগিলাম। মন, অন্যদিকে ফিরাইবার জন্য কত চেষ্টা করিলাম। কিন্তু আমার নিখিল চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া, নিভৃত মানস-নেপথ্যে মন্দিরপথদৃষ্ট সেই তরুণ সুন্দর মুখখানিই বারংবার জাগিয়া উঠিতে লাগিল।
পরদিন বৈকালে, দাসী আমার কবরী রচনা করিয়া দিতেছিল। আমি শূন্যদৃষ্টিতে ওপারে, যেখানে ধবল সিকতাশয়নের উপরে গঙ্গা আপন জলবেণী লুটাইয়া দিতেছিল, সেইদিকে চাহিয়াছিলাম; এমন সময়ে, আবার সেই কণ্ঠস্বর!
তাড়াতাড়ি উঠিয়া গবাক্ষ-সমীপে গিয়া দাঁড়াইলাম! দেখিলাম, নীচে গঙ্গাতরঙ্গচুম্বিত সোপান-চত্বরে বসিয়া বীণাহস্তে সেই যুবক!
যুবকও আমাকে দেখিল। তাহার আনন ঈষৎ আরক্ত, তাহার স্বর ঈষৎ কম্পিত হইয়া উঠিল। তারপর যে গান গাহিতেছিল, তাহা থামাইয়া সে ভিন্ন রাগিণী ধরিল।
সে গাহিতে লাগিল
‘আঁধারের ভিতরে দুটি আঁখি দেখিয়াছি। সে যুগল আঁখির দীপ্তি দেখিয়া মনে হইল, মেঘের কালো নিকষে বিজলীর সুবর্ণ-আলপনা ফুটিয়া উঠিয়াছে।
ফুলের রং যেমন ভিতর হতে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়, সে দুটি নয়নের উপরে হৃয়ের গোপন ভাষা তেমনই বিলিখিত হইয়াছিল।
বসন্তের নীরব ইঙ্গিত বুঝিয়া কোকিল যেমন পঞ্চমে সাড়া দেয়, ওগো কমলনয়না, তোমার আঁখিপটলিখিত হৃদয়ের মৌনভাষা বুঝিয়া আমার চিত্তসারং তেমনি করিয়াই সাড়া দিয়া উঠিতেছে।’
আমি দাসীর দিকে ফিরিলাম। আমার আকস্মিক আচরণ দেখিয়া সে বিস্মিত হইয়াছিল।
যুবকের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া তাহাকে নিম্নকণ্ঠে কহিলাম, ‘উহাকে সকলের চোখের আড়ালে এখানে আনিতে পারিস?’
দাসীর উপরে আমার যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল। কিন্তু আমার কথা শুনিয়া তাহার মুখ ভয়ে বিবর্ণ হইয়া গেল।
আমি তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া আবার কহিলাম, ‘কি বলিস? পারিবি?’
‘মহারাজ জানিলে আমার মাথা কোথায় থাকিবে ঠাকুরানি?’
‘তোর মাথা তোর কাঁধের উপরেই থাকিবে। মহারাজ এখন আসিবেন না। বল— পারিবি বাঁদী? হাজার আশরফি বকশিশ।’
খানিক ইতস্তত করিয়া সে স্বীকার পাইল।
* * *
অট্টালিকার গুপ্তদ্বার, আমাদের মিলনসাধন করিয়া দিল।
যুবক আমার সামনে, আমি তার সামনে। চারিদিক স্তব্ধ। শুধু ভাগীরথীর অবিরাম কলতানে আমাদের মিলনের উৎসব-সংগীত ধ্বনিত হইতেছিল।
যুবক আমার মুখ দেখিতেছিল— আমি তার মুখ দেখিতেছিলাম। উভয়ে নীরব। আকাশের বাতাস আসিয়া আমাদের প্রাণের সুপ্ত তন্ত্রীগুলিতে জাগরণের মধুর আভাস আনিয়া দিতেছিল।
যুবক কহিল, ‘আজ আমার জীবন সার্থক!’
আমি বলিলাম, ‘আজ আমার নারীজন্ম ধন্য!’
* * *
অকস্মাৎ ঘরের দরজা খুলিয়া গেল। বিবর্ণমুখে ছুটিয়া আসিয়া দাসী কহিল, ‘মহারাজ আসিতেছেন! মহারাজ আসিতেছেন!’
মহারাজ!
আমার পায়ের তলা হইতে মাটি যেন চকিতে সরিয়া গেল, আমার চোখের সুমুখ হইতে পৃথিবীর আলো যেন নিবিয়া গেল।
আমি কাঁপিতে কাঁপিতে গবাক্ষের পর্দার একদিকটা তুলিয়া, তাহার আড়ালে যুবককে ঠেলিয়া দিলাম। তারপর তাড়াতাড়ি বিছানার উপর গিয়া বসিয়া, কোনোরূপে একটু আত্মসংবরণ করিয়াছি মাত্র— এমন সময়ে হাস্যমুখে মহারাজ গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
আমার ডানহাতটি আপন মুষ্টিমধ্যে গ্রহণ করিয়া, মহারাজ স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, ‘পিয়ারি, তোমার কাছ থেকে দু-দণ্ড দূরে থাকিয়া আমার মনে হইতেছিল, আমি একযুগ তোমাকে ছাড়িয়া আছি।’
বিপদভীত দৃষ্টিকে যথাসম্ভব কোমল করিয়া আমি বলিলাম, ‘মহারাজ, দাসীর প্রতি আপনার করুণা।’
আমার অনাবৃত গণ্ডে সপ্রেমে একটি চুম্বন করিয়া মহারাজ বলিলেন, ‘তুমি আমার জাদু করিয়াছ।’
আমি মুখ নীচু করিয়া আঙুলে আঁচল জড়াইতে লাগিলাম। মহারাজ, কিছুক্ষণ আমাকে নিষ্পলকনেত্রে নিরীক্ষণ করিলেন। তাহার পর একটু চঞ্চলতা প্রকাশ করিয়া কহিলেন, ‘উঃ! ঘরের ভিতরে অসহ্য গরম! একলাটি এমন করিয়া, এখানে তুমি কীরূপে বসিয়া আছ?’ বলিয়া, তিনি গবাক্ষের দিকে অগ্রসর হইলেন।
আমার প্রাণ যেন, হৃদয়ের ভিতরে মূর্ছিত হইয়া পড়িল।
মহারাজ জানালার পর্দা সরাইয়া দিলেন। সেখানে, যুবক দাঁড়াইয়াছিল।
বিস্মিত হইয়া মহারাজ, পর্দা তুলিয়াই আবার ফেলিয়া দিলেন। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত এবং স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাহার পর আমার দিকে ফিরিয়া কহিলেন, ‘এ কে?’
দুই হাতে শয্যার আস্তরণ মুঠার ভিতরে চাপিয়া ধরিয়া আমি বজ্রাহতার মতো বসিয়া রহিলাম।
কর্কশকণ্ঠে মহারাজ কহিলেন, ‘বিশ্বাসঘাতিনী! এতদূর স্পর্দ্ধা তোর? আমার শয়নাগারে পরপুরুষ!’
বদ্ধ কণ্ঠকে প্রাণপণে মুক্ত করিয়া আমি কহিলাম, ‘দোহাই মহারাজের! উহাকে আমি চিনি না!’
‘চিনিস না? তবে কীরূপে ও এখানে আসিল?’
‘জানি না, মহরাজ! জানি না! ও চোর!’
বাঁ-হাতে আবার পর্দা তুলিয়া, মহারাজ ডান হাতে যুবককে ধরিয়া বাহিরে টানিয়া আনিলেন। তীক্ষ্নদৃষ্টিতে তাহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, ‘কে তুই?’
‘আমি চোর।’
‘কীরূপে এখানে আসিলি?’
‘বলিব না।’
‘কী!’
‘বলিব না।’
‘বলিবি না?’
‘না।’
মহারাজ হাত বাড়াইয়া ভিত্তিবিলম্বিত একখানি তরবারি গ্রহণ করিলেন। আমি ছুটিয়া গিয়া তাঁহার উদ্যত হস্ত ধারণ করিলাম। কাতরকণ্ঠে কহিলাম, ‘মহারাজ, মহারাজ, একটি চোরের রক্তে আপনার পবিত্র অস্ত্র কলঙ্কিত করিবেন না!’ তাহার পর যুবকের দিকে ফিরিয়া বলিলাম, ‘এখানে কীরূপে তুই আসিলি, খুলিয়া বল!’
বুকের উপরে দুই বাহু রাখিয়া, পাথরে-গড়া মূর্তির মতো যুবক এতক্ষণ নিথরভাবে দাঁড়াইয়া ছিল। আমার সম্বোধনে তাহার সর্বদেহের মধ্য দিয়া তড়িৎ ছুটিয়া গেল। আয়ত নেত্রের পূর্ণ দৃষ্টি আমার মুখের উপরে রাখিয়া যুবক অভিভূত কণ্ঠে কহিল, ‘আমি তুচ্ছ চোর নই, আমি তোমাকে চুরি করিয়া দেখিতে আসিয়াছি!’
প্রদীপ্ত অগ্নির মতো উগ্রমূর্তিতে মহারাজ বলিলেন, ‘কী!’
একটুও বিচলিত না হইয়া যুবক আনমনে বলিতে লাগিল, ‘হ্যাঁ, চুরি করিয়া তোমাকে দেখিতে আসিয়াছি— শুধু তোমাকে সখি, শুধু তোমাকে! দেবপূজায় তুমি যাইতেছিলে, পথ হইতে লুকাইয়া আমি তোমাকে দেখিতে পাইয়াছিলাম। তুমি জানো না দেখামাত্র আমার আত্মা তোমার পায়ে বিকাইয়া গিয়াছে। একবার দেখিয়া আমার তৃপ্তি হইল না, তাই সকলের অজ্ঞাতসারে কৌশলে আমি এখানে আসিয়া লুকাইয়া ছিলাম, আর একবার তোমাকে দেখিব বলিয়া! আমার দেখা হইয়াছে। এখন আমি মরিতে পারি। মহারাজ, আপনার প্রিয়তমার কোনো দোষ নাই।’
মহারাজ অগ্রসর হইয়া কঠিনস্বরে বলিলেন, ‘উত্তম! তোকে প্রাণে না মারিয়া, তোর প্রতি এক নূতন দণ্ড দিব। তোর যে পাপ-চক্ষু পরস্ত্রীর পবিত্রতার দিকে কুদৃষ্টিতে চাহিয়াছে, সেই চক্ষু আমি নষ্ট করিব। প্রহরী!’ আদেশমাত্র প্রহরী ঘরের ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইল।
যুবকের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া মহারাজ বলিলেন, ‘এই হতভাগাকে বাহিরে লইয়া গিয়া ইহাকে অন্ধ করিয়া ছাড়িয়া দে!’
যুবক নীরবে, হাস্যমুখে সেই ভীষণ দণ্ডাদেশ শ্রবণ করিল। বিনা বাধায় যুবক তাহার সঙ্গে চলিল। গমনকালে আমার দিকে একবার দীনদৃষ্টিতে চাহিয়া গেল। ভগবান, সে দৃষ্টিতে কী গভীর ভাব ফুটিয়া উঠিতেছিল!
* * *
পরদিন গভীর রাত্রিতে, নিদ্রাশূন্য গঙ্গার উচ্চ তরঙ্গকল্লোলের উপর দিয়া পাগল ঝটিকা বহিয়া বহিয়া যাইতেছিল।
সুষুপ্ত মহারাজের শিথিল বাহুপাশের ভিতরে সহসা আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল।
দুম করিয়া গবাক্ষ-কবাট খুলিয়া গেল এবং বহিঃপ্রকৃতির বিশ্বব্যাপী হাহাকার, বৃষ্টির ঝাপটা ও উদ্দাম বায়ুর সঙ্গে সে কাহার আকুলকণ্ঠ আমার ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিল? সে কে গো— সে কে?
তাড়াতাড়ি জানলাটা বন্ধ করিয়া দিতে উঠিলাম। হঠাৎ মেঘের কালো বুক চিরিয়া দেবতার অগ্নিময় ভ্রূকুটি ফুটিয়া উঠিল, সেই ক্ষণিক উজ্জ্বল আলোকে দেখিলাম, ঝড়-বৃষ্টির প্রতি একান্ত উদাসীন হইয়া সোপান চত্বরে বসিয়া সেই অন্ধ যুবক গাহিতেছে :
নয়না নহি নিদ গাই রে,
নিশিদিন মোরি ছাতিয়ান লাগেও অধীরকো।
একটা চীৎকার করিয়া তখনই মূর্চ্ছিত হইয়া ভূমিতলে পড়িয়া গেলাম।
* * *
তাহার পর প্রতি নিশায় তাহার হতাশ সংগীত, তীক্ষ্নধার অস্ত্রের মতো আমার বুকে আসিয়া বিঁধত। আমার সকল সুখ, শান্তি ও আনন্দ, জন্মের মতো ঘুচিয়া গেল। আহারে-বিহারে-শয়নে-স্বপনে সর্বদাই রহিয়া রহিয়া সেই যুবকের কথাই আমার মনে পড়িতে লাগিল। সেই কাতর মুখ— সেই অন্ধ নেত্র— সেই উদাস গীত! তাহার যাতনা ও হতাশার একমাত্র কারণই তো আমি! তাহাকে বিপদে ফেলিয়া আপনাকে বাঁচাইবার জন্য পাপিষ্ঠা আমি— অনায়াসে মিথ্যা কথা কহিয়াছি।
ভীষণ যন্ত্রণার ভিতরে অকস্মাৎ একদিন মৃত্যু আসিয়া আমার কমনীয় তনুকে চিতায় সমর্পণ করিল। মরণকালে তাহার গান শুনিয়াছি এবং মৃত্যুর পরেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া, প্রতি-নিশায় আমার অভিশপ্ত আত্মা সেই সকরুণ সংগীত শুনিয়া আসিতেছে। ওই শুনো, ওই শুনো গো! হে অন্ধ যুবক, আমার অপরাধ মার্জনা করো আর শুনিতে পারি না, ওগো, আর সহ্য করিতে পারি না!’
ছায়ামূর্তির কথা শেষ হইতে-না-হইতে হঠাৎ কাহার বিস্মিত কণ্ঠ শুনিলাম, ‘কোন হ্যায় রে!’
চকিতে আমার আচ্ছন্ন ভাব কাটিয়া গেল, ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া দেখি, পূর্ব চক্রবালে ঊষার ললাটিকা দুলিয়া উঠিয়াছে এবং একগোছা চাবি হাতে করিয়া মানমন্দিরের দরোয়ান সামনে দাঁড়াইয়া মূঢ়ের মতো আমার দিকে চাহিয়া আছে। কক্ষতলে কোথায় সেই ছায়ামূর্তি? আশ্চর্য স্বপ্ন!
মধুপর্ক, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স, আট আনা সংস্করণ গ্রন্থমালা, ২১তম গ্রন্থ