2 of 2

অভিনেত্রী – অভিজিৎ দত্ত

অভিনেত্রী – অভিজিৎ দত্ত

এক

যেন সাদা পাল তুলে দিল হাওয়া। যেন নীচে পাগলাঝোরার কালো জলে বর্শার ফলার মতো জ্বলে উঠল জ্যোৎস্না। যেন পাইনের সারিবাঁধা মঞ্জরি ভয়ে কেঁপে উঠল।

স্পিডোমিটারের কাঁটা থরথর করে কাঁপছিল। ক্যামেরা অনর্গল প্যান করে চলেছে টুকরো-টুকরো দৃশ্য। স্পিডোমিটারের কাঁটা, পাহাড়ি রাস্তা, পাইনের মঞ্জরি, পাগলাঝোরার জল। চোখে গো-গো গগলস, ডিমছাঁদ মুখ, ফাঁপানো চুল বারবার হাওয়ার ঝাপটে মুখের ওপরে এসে পড়ছে—কবিতা বোস মুক্তোর মতো দাঁতে পাতলা ঠোঁট টিপে বলে, ‘আস্তে চালাও। আমার ভয় করছে—।’

‘ভয়?’ উন্মাদের মতো হেসে ওঠে অনুপম। ক্যামেরা ট্র্যাক করে স্টিয়ারিং হুইল, অনুপমের হাসি, হাওয়ায় উড়ে-আসা ঝরা পাতা, পাহাড়ের বুকে শেষ বিকেলের রোদ।

‘হ্যাঁ, বাবা, আমারও ভয় করছে,’ মায়ের পাশে বসে ছোট্ট মেয়ে বান্টি, কপালে রিবন বাঁধা, ববছাঁট চুলের নীচে চোখের বাদামি তারাদুটো বিস্ফারিত, হলিডে-অন-আইস ফ্রকটা হাওয়ায় ফুলে উঠছে, উড়ে যেতে চাইছে।

‘গাড়ি চালাতে গেলেই তোমার বাবা নিজেকে ওয়েস্টার্ন ফিল্মের হিরো ভাবে, কবিতা বোসের শাড়ির শিফন ঝালরের মতো ঝাপট দেয়, মুখের রেখায় এমন কিছু একটা যা ঘৃণা নয়, ভালোবাসাও নয়।

পিছন ফিরে স্ত্রীর দিকে তাকায় অনুপম।

এবং ঠিক সেই তাকানোর মুহূর্তটাকে ফ্রিজ করে ক্যামেরা ফিরে যায় ফ্ল্যাশব্যাকে। সাত বছর আগের দৃশ্যে—ট্র্যাফিকের লাল আলোর নির্দেশে যখন গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, তখন।

‘কাংকোরিয়াসাহেব কিন্তু রাগ করতে পারেন,’ অনুপম ড্রাইভারের সিট থেকে পিছন ফিরে বলছে, ‘সিনহা এত বড় ডাইরেক্টর, বার্লিনে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, ওর সঙ্গে তোমার পরিচয় করাবে বলে কাংকোরিয়া পার্টি দিল, আর তুমি কিনা কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে এলে? তুমি ভীষণ দুষ্টু, কবিতা।’

জবাবে সদ্যফোটা ফুলের মতো মিষ্টি হাসছে কবিতা বোস, অনুপমের গালে টোকা দিয়ে বলছে, ‘আমি তো আর ফিল্মে নামব না।’

দুজনের বিয়ের দৃশ্য, কম্পোজিট শটে দুজনের দাম্পত্য জীবনের অন্তরঙ্গ আলাপ, বান্টির জন্মের পর বেবিকটের ওপর ঝুঁকে ওর মুখ দেখছে অনুপম, মায়ের কোল থেকে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বান্টি। হঠাৎ একটা কাচের জানলার ওপর দিয়ে দ্রুত ফ্লিক-প্যান, অুনপম-কবিতা-বান্টির মুখ বদলে যায়, ডায়ালগ কেমন যেন খাপছাড়া, কাটাকাটা, ‘এই মাইনেয় সংসার চলে না,’ কবিতা বলছে। বান্টির জন্মদিনে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে অনুপম, ওর হাতের কমদামি খেলনাটা একগাল হেসে হাতে তুলেছে বান্টি। দেখে উপেক্ষায় মুখ বাঁকায় কবিতা : ‘রাতে বাড়ি ফিরতে এত দেরি হয় কেন?’ অনুপম রুক্ষ গলায় বলছে, ‘বান্টি বেচারা এতক্ষণ জেগে থেকে এইমাত্র ঘুমোল।’ ‘আমি তোমার কেনা বাঁদী নই,’ আরও রুক্ষ গলায় কবিতা জবাব দেয়।

একটি প্রেমের মৃত্যু, মাঝে-মাঝে দু-তিনজনের এক-একটি গ্রুপ কম্পোজিশন, বান্টি এবং অনুপম, কবিতা ও প্রোডিউসার কাংকোরিয়া, কবিতা, ফিল্ম-প্রোডিউসার জালান এবং ন্যু-ওয়েভের উঠতি ডাইরেক্টর অরিজিৎ রায়। ক্যামেরা পিছোতে-পিছোতে হঠাৎ একটি দৃশ্যে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা। বান্টি নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমিয়ে আছে। বিছানায় শুয়ে সিগারেটের ধোঁয়ার রিং করছে অনুপম। কবিতা হ্যান্ডব্যাগটা দোলাতে-দোলাতে ঘরে ঢোকে, সাজপোশাক বিস্রস্ত, গলার স্বর ঈষৎ মাতাল : ‘ফিরতে দেরি হল বলে রাগ করেছ নাকি?’ অনুপম কথা বলছে না দেখে ড্রেসিং-টেবিলে বসে মেকআপ মোছে কবিতা : ‘এখন থেকে আরও দেরি হবে। আমি জালানসাহেবের নতুন ফিল্মে নামছি। অরিজিৎ ডাইরেক্ট করবে।’

সিনেমা-পত্রিকার কয়েকটা পাতা ক্যামেরার সামনে দ্রুত সরে যায়। ‘অভিনেত্রী কবিতা বোস আবার সিনেমায় নামছেন।’ ডাইরেক্টর অরিজিৎ রায় ও ফিল্মস্টার কবিতা বোসের একটি অন্তরঙ্গ ছবি। ‘কবিতা বোস কি ডিভোর্সের কথা ভাবছেন?’ ‘মিথ্যে গুজব, দু-সপ্তাহের জন্য সমস্ত শুটিং শিডিউল ক্যান্সেল করে কবিতা স্বামী ও মেয়ের সঙ্গে দার্জিলিং যাচ্ছেন।’ ক্যাপশন ও বিবৃতিগুলো দ্রুত সরে যায়।

তারপর আবার ক্লোজ শট। সিক্সটি নাইন মডেলের অ্যামবাসাডর দাঁড়িয়ে পড়েছে। গাড়ি থেকে নেমে এসেছে কবিতা, বলছে, ‘পাগলের সঙ্গে গাড়িতে যাওয়ার চেয়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো। তুইও নেমে আয়, বান্টি।’

অনুপমের চোখ জ্বলছে। পিছন থেকে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বান্টি : ‘না, আমি বাপির সঙ্গে যাব,’ ও আদুরে গলায় বলে।

বান্টির এই আচমকা গলা জড়িয়ে ধরার জন্য তৈরি ছিল না অনুপম। টুকরো ক্লোজ শটে দেখা গেল, চকিতে ওর পা-টা ব্রেক থেকে ফসকে যাওয়ায় গাড়িটা সামনের দিকে এগিয়ে চলল। তাড়াতাড়ি ব্রেকে পা দিতে গেল অনুপম, ব্রেকের বদলে অ্যাক্সিলারেটরে পা লাগল।

দ্রুতগতি ক্যামেরা। রুক্ষ পাহাড় হঠাৎ যেন ম্যাজিকে খুলে ধরে এক অতল গহ্বর, টায়ার স্কিড করার কর্কশ শব্দ, অদৃশ্য কণ্ঠে দুর্বোধ্য চিৎকার, খাদের ভেতরে আগুন ছিটোয়, আলো জ্বলে ওঠে, শিখার আরক্ত উল্লাসে জ্বলতে-জ্বলতে পুড়তে-পুড়তে গাড়িটা গড়িয়ে পড়ছে খাদের নীচে। রাশি-রাশি কুণ্ডলিত ধোঁয়ার মাঝখানে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছে কবিতা।

হঠাৎ শটটা ফ্রিজ হয়ে গেল। খাদ, আলো, জ্বলন্ত গাড়ি, কুণ্ডলিত ধোঁয়া। খাদের দিকে প্রসারিত হাত বাড়িয়েছিল কবিতা। ফ্রিজ যখন সচল হল, দেখা গেল, সে হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে দর্শকের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছে।

কাট শট। ‘অ্যাক্সিডেন্ট। হ্যাঁ, আমার কিছু করার ছিল না,’ প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের বলছে কবিতা বসু, পরনে বৈধব্যের সাদা থান। পজিটিভ ছবি এই মুহূর্তে হঠাৎ নেগেটিভ হয়ে যায়। আর-একটা নেগেটিভ ছায়া সিনেমা-নায়িকার কাছে আসে। আবার যখন ছবি পজিটিভ প্রিন্টে ফিরে আসে, তখন দেখা যায়, সিনেমার শুটিং-এ তরুণ নায়কের পাশে প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় করছে কবিতা। পার্টিতে তরুণ ডাইরেক্টর অরিজিৎ রায়ের পাশে ককটেলে চুমুক দিচ্ছে নায়িকা। লোকেশন শুটিং-এ অরিজিতের কাছে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে হিরোয়িন। সিনেমা তার আপন ভাষায় গল্প বলছে।

বেডরুমের দেওয়ালে বান্টির ছবিতে ধুলো জমেছে। বিছানায় গেঞ্জি ও শর্টস পরে আছে অরিজিৎ। আয়নার সামনে পোশাক খুলছে কবিতা। এবং তার পরনে যখন শুধু ব্রা ও পেটিকোট, তখন একটা সিগারেট ধরায় কবিতা। অরিজিতের ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি। আবহে ডেথ মার্চের বাজনা। দেওয়ালে বান্টির ছবি এবং আয়নার সামনে সিগারেট হাতে অন্তর্বাস পরা কবিতা নেগেটিভ হয়ে যায়। ছবি শেষ।

দুই

সম্মোহিতের মতো দেখছিল শোভন। ‘অভিনেত্রী’ ছবিটা বিতর্কের ঝড় তুলেছে নানা কারণে। কয়েক বছর আগে জোড়বাংলো ছাড়িয়ে তিন কিলোমিটার দূরে একটা প্রাইভেট গাড়ি স্কিড করে সোজা পড়ে গেল অতলান্ত খাদের গহ্বরে। গাড়িতে ছিলেন একজন নামজাদা ফিল্ম-স্টার, তার স্বামী ও সন্তান। গাড়ির আর সব যাত্রী সঙ্গে-সঙ্গেই মারা যায়। কিন্তু খুবই অদ্ভুত ব্যাপার, চিত্রতারকা বেঁচে গেলেন। বিয়ের পর যিনি সিনেমার পরদা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, স্বামী ও সন্তানের মৃত্যুর পর তিনি রুপোলি পরদায় ফিরে এলেন প্রেমিকার ভূমিকায়।

‘অভিনেত্রী’ ছবির সঙ্গে বাস্তবের এক সিনেমা অভিনেত্রীর জীবনের আশ্চর্য মিল। খসরু নোশান বাংলাদেশের তরুণ পরিচালক, টালিগঞ্জ ও ঢাকার এই যুক্ত প্রোডাকশনে ওঁকে পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে প্রোডিউসাররা বুদ্ধি ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। সিনেমা যে সাহিত্য থেকে আলাদা, তার নিজস্ব ভাষা আছে, আছে আত্মস্থ পরিণতি—খসরু নোশান প্রমাণ করেছেন। ছবিকে প্রয়োজনে ডিড্রামাটাইজ করেছেন, ফর্মকে দুমড়ে কনটেন্টের উপযোগী করেছেন। ‘পিকচারাইজড ড্রামা’ নয়, আলো-ছায়া লং শট, মিড শট, নেগেটিভ, ফ্রিজ-ট্র্যাকিং শটে চলচ্চিত্র তার আপন ভাষায় কথা বলেছে। সংলাপ এখানে গৌণ, আবহসঙ্গীত পরিমিত ও নিরলঙ্কার।

ছবিটা ওই দেশে ঠিক পপুলার হয়নি। যারা ছবির পরদায় গল্প এবং গান শুনতে অভ্যস্ত, দর্শক নামের সেই সুবোধ বালক এ-ছবি দেখে খুশি নয়।

ছবিটা ম্যানহাইম ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে। জুরির বিচারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন ‘অভিনেত্রী’র নায়িকা রঞ্জনা। ‘গ্রাঁ প্রি’ না পেলেও পরিচালক খসরু নোশান বিদেশি দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। বিদেশ থেকে ফিরেই তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশের অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং আগামী চার-পাঁচটা ভালো ফিল্ম পরিচালনার কনট্রাক্ট।

রঞ্জনার সঙ্গে ইংগমার বার্গম্যানের ‘সাইলেন্স’ ফিল্মের নায়িকা ইনগ্রিড থূলিনের তুলনা করেছিলেন ফেস্টিভ্যাল জুরির সদস্য ক্লদ লেলুশ। এদেশের কোটেশনবিদ সমালোচকদের কৃপায় কথাটা চাউর হয়ে গেছে। অচিরে ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব পেয়েছেন রঞ্জনা এবং বুদ্ধিমান পরিবেশক কলকাতার তিনটে সিনেমা হলে ছবিটা নতুন করে রিলিজ করেছেন।

সম্মোহিতের মতো ছবি দেখেছে শোভন। ওই ছবিতে রঞ্জনার অভিনয়ে যেন তৃতীয়মাত্রিক গতি—কোনও কথা না বলে শুধু মুখের রেখায়, চোখের তারার চকিত কাঁপনে, প্রসারিত হাতের ব্যঞ্জনায় কিংবা আয়নায় বিবস্ত্র ছায়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে ফুটিয়ে তুলেছে ভালোবাসা, অভিমান, অসহায়তা, বাঁচার তীব্র পিপাসা।

ছন্দপতনের মতো যখন পরদায় ‘জনগণমন’ বেজে উঠল, তখনও শোভন সিটে বসেছিল। ‘ট্যাশ ছবি’ তার সুন্দরী স্ত্রী রীনা হল থেকে বেরোবার মুখে বলছিল, ‘ফিল্ম-স্টাররা ভালোবাসতে জানে না। ওইরকম বস্তাপচা থিম নিয়ে সত্তরের দশকে কেউ ফিল্ম করতে পারে? ক্লদ লেলুশ কেন যে রঞ্জনার অ্যাক্টিং দেখে গদগদ হয়ে উঠলেন—।’

‘আঃ, থামো, রীনা,’ শোভন মুখে বলে। রীনার পেনসিলটানা ভুরুতে কাঁপন লাগে, চেরিলাল ঠোঁটদুটো কপাট বন্ধ করে, চোখের পাতায় তিরতির করে একফোঁটা জল। কভেন্যান্টেড অফিসারের চৌকস, সুন্দরী, ডলপুতুলের মতো বউ স্বামীর সঙ্গে সিনে-ক্লাবের ছবি দেখে সিনেমা নিয়ে দু-চারটে বুকনি ঝাড়তে শিখেছে। ফেদেরিকো ফেলিনির ‘ই ভিতেল্লোনি’র পুরুষ-মক্ষিকারা কেন প্রকাশ্য রাস্তায় ম্যাম্বো নাচ নাচে, ‘জ্যাবরিসকি পয়েন্ট’ ফিল্মে আন্তোনিওনি কেন ওয়ার্ডরোবের রঙিন বা ফ্রিজের জ্যাম-রুটির গলানো রং পরদায় ছড়িয়ে দেন, লুই বুনুয়েলের ‘নাজারিন’-এ ড্রামের আওয়াজ কোন লড়াইয়ের ইঙ্গিত দেয়, ত্রুফো-র ‘ফোর হানড্রেড ব্লোজ’-এ জনতা ও সমুদ্র কেন একই সঙ্গে একটি বাচ্চা ছেলেকে তাড়া করে, তাই নিয়ে ডলপুতুলদের স্বামীরা তর্ক করেন। এবং, যেহেতু ইবসেনের নাটক দেখে এদেশি ডলপুতুলরা ইদানীং দাবি করছে, তারা পুতুল নয়, মানুষ—পুরুষদের আলোচনায় তারাও ফুটকুড়ি কাটে—গ্লবার রচা, জাঁ লুক গদার, পোলানস্কি, সিনে ভেরিৎ, আভাঁ গার্দ ফিল্ম, ‘অশনিসংকেত’-এ ববিতার বোট-নেক ব্লাউজ দেখিয়ে সত্যজিৎ কীরকম গুবলেট করেছেন, ঋত্বিকের তিতাসের কতটা ফিল্ম, কতটা সাইথোপিয়া, মৃণাল সেন ব্রেশট বোঝেন, না বোঝেন না—এইসব ভারিক্কি ব্যাপারে তারা হামেশাই নাক গলায়।

আজ সামান্য একটা বাংলা ফিল্মের ব্যাপারে একটা উলটো-পালটা কথা বলেছে বলে শোভন ওকে ধমক দেবে—কল্পনাই করতে পারেনি রীনা। না হয় ফিল্মের ব্যাপার-ট্যাপারগুলো একটু বেশিই বোঝে শোভন, না হয় বিজনেস ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা নিতে স্টেটসে যাওয়ার আগে লোকটা চার-পাঁচ বছর ফিল্ম লাইনেই ছিল—তা বলে রীনাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়ার অধিকার ওকে কে দিয়েছে?

রেস্তোরাঁয় কফি-কাটলেট কিছু মুখে দিল না রীনা, ট্যাক্সিতে উলটোদিকের জানলার দিকে তাকিয়ে ঘাড় ব্যথা করে ফেলল, বাড়ি ফিরে ‘মাথা ধরেছে’ বলে দুটো অ্যাসপিরিন এবং দুটো সোনারিল ট্যাবলেট খেল, ‘শরীর ভালো নেই’ জানিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পড়ল।

যেন দেখেও দেখল না শোভন। তার শোওয়ার ঘরে নীল আলো। হাওয়া ঠান্ডা নয়, আবার গরমও নয়—অর্থাৎ এয়ারকন্ডিশনার আছে। দেওয়ালের গাঢ় সবুজ ও লেমন-ইয়েলো রং চোখে স্বপ্নের ঘোর লাগায়, মেঝের মোজেইক তার জীবনের মতোই মসৃণ।

অথচ এই ঘর, সিল্কের ট্যাপেস্ট্রি, ছড়ানো-ছিটোনো কিউরিও, ডানলোপিলোর ওপরে হাঁটু মুড়ে শোওয়া ডলপুতুল—ওই সবই তার অসহ্য লাগছে। এই সাজানো সংসারে যদি আগুন লাগে, যদি ডিনামাইটের বিস্ফোরণে টুকরো-টুকরো হয়ে উড়ে যায় ডলপুতুল, নবদম্পতির দেওয়ালজোড়া ফটো, মেঝের মোজেইক, মসৃণ জীবন—।

কিন্তু না, সেসব কিছুই হয় না। টেবিল ল্যাম্পের সামনে একটা চিঠি পড়ে শোভন সেন নামের এক দুঃখী মানুষ।

শোভন, আমার আগের চিঠিগুলোর মতো এইটারও জবাব পাব না জানি। তবু লিখছি। ‘অভিনেত্রী’ ফিল্মটা অনেকের ভালো লেগেছে। তুমি দেখবে না—আমি জানি। তোমার সঙ্গে একবার দেখা করার অনেক চেষ্টা করেছি। তুমি এড়িয়ে যাও। পরশু এয়ার টার্মিনাসের রেস্তোরাঁয় একঘণ্টা বসে থাকব, দুটো ফ্লাইটের মধ্যে এইটুকু অবসর। যদি আসো, দেখা হবে—।

‘দেখা হবে—’…লাইটারের আগুনে মেয়েলি হাতে লেখা অক্ষরগুলো পুড়ছিল।

তিন

লাইটস। আর্কল্যাম্পের তীব্র আলো জ্বলে ওঠে। সাইলেন্স প্লিজ, স্টুডিয়োর দর্শকদের সামনে লাল নিষেধ। সাউন্ড…ক্যামেরা রেডি, কনটিনিউটি…ও. কে. স্টার্ট!

‘ভুলিনি,’ ঝোলা পাঞ্জাবির নীচে নীরব পুরুষ…তার দিকে অপলক চেয়ে আছে স্থিরযৌবনা রমণী, ‘স্মৃতি কখনও শরৎ মেঘ কখনও শ্রাবণধারা…।’

শোভন সেন স্বপ্ন দ্যাখে। ক্যামেরার চোখ ঘুরছে, একটা হাত কর্ড্যুরয় ট্রাউজারের পকেটে, ভিউফাইন্ডারের জানলায় চোখ—দৃশ্যটা সিনেমার পরদায় কেমন দেখাবে অনুমানে জানতে চাইছে ডাইরেক্টর শোভন সেন।

স্বপ্ন স্বপ্নই, জীবন নয়…জীবনে শোভন কোনও ছবি ডাইরেক্ট করার সুযোগ পায়নি।

মুখে রুপোর চামচ নয়, স্টেইনলেস স্টিলের চামচ নিয়েই জন্মেছে শোভন। ওর বাবা নামজাদা মার্কেন্টাইল ফার্মের ওপরতলার অফিসার। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ায় বাবার আদর একটু বেশিমাত্রায় পেয়েছে সে। কলেজে পড়ার সময় সে সিনে-ক্লাবের মেম্বার হয়েছে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। এবং সেখানেই কোকেনের চেয়ে তীব্র ও আফিমের চেয়ে মিষ্টি একটা নেশা তার স্নায়ুতে প্রথম ঢুকে পড়েছিল। জন ফোর্ডের ‘গ্রেপস অফ রথ’ দেখে সে দু-রাত্রি ঘুমোতে পারেনি, ‘লা দোলচে ভিতা’র মার্চেল্লোর মতো সে ফ্রা এঞ্জেলিকো-র ছবির সামনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ‘লোলা মন্তাজ’ তাকে ভালোবাসতে শেখায়, বার্গমান শেখায় ঘৃণা ও যন্ত্রণা। শার্সির গায়ে হাওয়ার তাণ্ডব তাকে আবহসঙ্গীতের সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দেয়, বাসের জানলা থেকে চলমান ভিখিরির মুখ দেখে সিনেমার সম্ভাব্য দৃশ্য মনে উঁকি দেয়।

ভিনদেশে জন্মালে শোভন সেন কস্মিনকালে ফেলিনি, ভাইদা বা কুরোসোয়া হতে পারত কি না কে বলতে পারে! কিন্তু এদেশে জন্মে তার পক্ষে যেটা সম্ভব…হ্যাঁ, সিনে-ক্লাব থেকে টালিগঞ্জের স্টুডিয়োর রাস্তা খুব বেশি দূর নয়…বিনা পয়সায় ফাইফরমাশ খাটতে-খাটতে ক্যামেরা, কনটিনিউটি, এডিটিং-এর টুকরো-টুকরো কাজ শিখে নামি ডাইরেক্টরের অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়া। এম. এ. পাশ সিনেমা-পাগল এক যুবকের পক্ষে সেটাও বুঝি সম্ভব। অবশ্য ডাইরেক্টর দেবেশ রায় তাকে সত্যিই স্নেহের চোখে দেখতেন, ‘ছেলেটার ট্যালেন্ট আছে। যদি কোনওদিন ডাইরেকশানের চান্স পায়…’ উনি অনেকের কাছে নাকি বলতেন।

এবং ওই সবই সম্ভব হয়েছে, কেননা শোভন সেনের জীবিকার ভাবনা ছিল না। ছেলেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ডিপ্লোমা নিতে স্টেটসে পাঠাতে চেয়েছিলেন ওর বাবা। তার বদলে শোভন টালিগঞ্জের স্টুডিয়ো চত্বরে ঘোরাফেরা করে সময় নষ্ট করছে। বিরক্ত হলেও উনি ছেলের পকেট খরচার রেস্ত জোগাতে কার্পণ্য দেখাননি।

রঞ্জনার সঙ্গে ওর প্রথম আলাপ ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয়, শুটিং-এর অবসরে। ত্রিকোণ প্রেমের বস্তাপচা গল্প নিয়ে নতুন ফিল্ম করছেন ডাইরেক্টর দেবেশ রায়। ভূমিকায় যথারীতি লালমূলো হিরো, খুকি-নায়িকা, গুপীগায়েন-ক্লাউন, নতুন বলতে শুধু উপনায়িকার ভূমিকায় রঞ্জনা। ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা মারা যাওয়ার পরে অ্যামেচার থিয়েটারে ভাড়া করা হিরোয়িন সেজে শো পিছু চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা কামাত। এইরকম একটা অ্যামেচার ড্রামাটিক ক্লাবের থিয়েটার দেখতে গিয়ে বুড়ো দেবেশ রায়ের মনে হল, মেয়েটা অ্যাক্টিং জানে, সিনেমায় চান্স পেলে—।

দেবেশ রায় পাসোলিনি বা পোলানস্কি নন। কিন্তু লোকটা সহৃদয়। রঞ্জনাদের পরিবারের অবস্থা, বিধবা মা, অনাথ ভাইকে বাঁচাবার জন্য সতেরো বছরের মেয়ের প্রাণপাত চেষ্টা, ওইসব ওঁর চোখ এড়ায়নি। ফিল্মলাইনের নেকড়ে ও হায়নাদের মাঝখানে দেবেশ রায় এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তাঁর ইউনিটে মেয়েরা সম্মান ও ইজ্জৎ নিয়ে কাজ করতে পারে।

থিয়েটারে অভিনয় করেছে রঞ্জনা, কিন্তু ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম দিন ডায়ালগগুলো ওর গলায় জড়িয়ে যাচ্ছিল। দেবেশ রায় ধমক দিয়েছিলেন। শুটিং-এর অবসরে ওকে আশ্বাস দিয়েছে শোভন : ‘এরকম হয়। জানেন, অ্যানা ম্যাগনানি যখন প্রথম সিনে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান, উনিও কথা খুঁজে পাননি। অথচ ”মামা রোমা” কিংবা ”রোজ ট্যাটু” দেখলে কে বলবে, ম্যাগনানি অভিনয় জানেন না?’

কৃতজ্ঞ চোখে শোভনের দিকে তাকিয়েছে রঞ্জনা। একদিন শুটিং-এর পরে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছে শোভন। তালতলার ডক্টর লেনের ভাঙাচোরা বাড়ির দোতলা—এখানে কোনও ফিল্ম-স্টার থাকে, যেন কল্পনাই করা যায় না।

‘উনি অসময়ে চলে গেলেন’, মেয়েকে সিনেমায় নামতে দিয়েছেন বলে ওর মা যেন দারুণ কুণ্ঠিত ‘প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুয়িটির টাকায় কতদিন চলে, বলো? আগে মেয়ে থিয়েটারে পার্ট করতে চাইলে মানা করতাম। এখন নিজে উপাযাচক হয়ে দেবেশবাবুকে বলতে হল, সিনেমায় যদি একটা চান্স দেন…,’ ভদ্রমহিলা বুকের ভেতরে দীর্ঘশ্বাস চেপে বলেন। এসব বলেছে রঞ্জনা।

তারপর আরও অনেকবার ওদের ফ্ল্যাটে গেছে শোভন। উপনায়িকা থেকে যখন নায়িকার ভূমিকায় প্রমোশন পেল রঞ্জনা, ডাক্তার লেনের ভাঙাচোরা ঘর ছেড়ে ম্যান্ডেভিল গার্ডেনে নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া নিল—তখনও। আউটডোর শুটিং-এর লোকেশনে বাঁকা নদীর জল ছুঁয়ে, ভাঙা মন্দিরের ধারে ওদের দেখা যেত—কথার জাল বুনছে শোভন, রঞ্জনা হাসিমুখে শুনছে। ইউনিটের সবাই জানত, ওদের আলাপ-পরিচয় এখন ভালোবাসার বুড়ি ছুঁয়েছে।

পরপর তিনটে ফিল্ম হিট হওয়ার পরে রঞ্জনার জনপ্রিয়তা দারুণ বেড়েছিল। দেবেশ রায়ের একটা বাংলা ফিল্মের হিন্দি রিমেক করতে চাইলেন বোম্বের প্রোডিউসার সোহনলাল কানওয়ার। এই চান্সে রঞ্জনাকে হিন্দি ফিল্মের সোনার কেল্লায় ঢোকার সুযোগ করে দিলেন দেবেশবাবু। হিরো পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করা মারাঠি জোয়ান, হিরোয়িনের ব্যাপারে কানওয়ার নিজেই বলেছেন, মানসী ছাড়া অন্য কাউকে তিনি চান্স দেবেন না। মানসী সান্যাল বাংলা ফিল্মের হিরোয়িন, আগে হিন্দিতেও কাজ করেছে—বাংলা ফিল্মের এক নামজাদা হিরোর সঙ্গে ওর ফস্টিনস্টি এখন নাকি প্রায় বিয়ের পর্যায়ে এসেও অজ্ঞাত কারণে আটকে আছে। মানসী বছর-দুই আগে কানওয়ারসাহেবের প্রোডাকশনে কাজ করেছে। ওঁর পছন্দের কারণ বোঝা যায়। অগত্যা নাকের বদলে নরুন পেয়েছে রঞ্জনা, নায়িকার বদলে উপনায়িকার পার্ট!

দেবেশদার ইউনিটের সঙ্গে বোম্বেতে যাওয়ার কথা ছিল শোভনের। কিন্তু ততদিনে ফিল্ম লাইনের সম্বন্ধে ওর মোহ ভেঙেছে। ও রঞ্জনাকে একান্ত করে পেতে চায়, কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টরের মামুলি চাকরিটা কোনও জীবিকা নয় এবং রঞ্জনাদের পরিবারটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অভিনেত্রীর জীবন ছাড়া আর কোনও রাস্তা রঞ্জনার সামনে খোলা নেই। জীবনে প্রথম দারুণ একটা সাহসের কাজ করল শোভন। ফিল্ম লাইনে ঢোকার পর থেকে পারতপক্ষে সে বাবাকে এড়িয়ে চলত, এবার সে তার ব্যক্তিগত সমস্যাটা বাবাকে খুলে বলল।

বাবারা বোকা হয়, অনেকের মতো শোভনেরও ধারণা ছিল। কিন্তু শোভনের বাবা প্রিয়নাথবাবু নির্বোধ নন—ছেলের বিয়ের ব্যাপারে তাঁর কোনও আপত্তি নেই—তাঁর প্রস্তাব, ওদের দুজনকেই ফিল্ম লাইন ছাড়তে হবে। তারপর স্টেটসে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে যাবে শোভন—রঞ্জনা সঙ্গে যেতে পারে। রঞ্জনাদের পরিবারের দেখাশুনো ততদিন প্রিয়নাথবাবুই করবেন।

আসলে ছেলের সুমতির জন্য মনে-মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন প্রিয়নাথ। ছেলে ওর ইচ্ছেমতো পাত্রীকেই বিয়ে করুক, কিন্তু এই সুযোগে ওকে ফিল্ম লাইন ছাড়িয়ে ওর ভাঙা কেরিয়ারটা গড়ে দিতে পারলে প্রিয়নাথের জীবনের কাজ ফুরোবে।

অভিনেত্রী হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে রঞ্জনা, কিন্তু ফিল্ম লাইন ছাড়বার কথা শুনে সে ‘না’ বলেনি। এই লাইনে শোভনের কোনও উন্নতি হবে না, রঞ্জনাও যেন বুঝতে পেরেছিল। ওর চোখেও ওর কেরিয়ারের প্রশ্নটা সবচেয়ে বড়। মেয়ের সৌভাগ্যের কথা শুনে রঞ্জনার মায়ের বিষণ্ণ মুখেও হাসি ফুটেছে। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে মেয়েকে সিনেমা লাইনে ঢোকাতে হয়েছে বলে তাঁর মনের কোণে যে-কাঁটাটা বিঁধে ছিল, সেটা বুঝি তুলে ফেলতে পারবে শোভন।

বিয়ের উদ্যোগ, পাসপোর্ট-ভিসা-জব ভাউচারের তত্ত্ব-তল্লাশ—বোম্বে যাওয়ার প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করল শোভন। হিন্দি ফিল্মের কনট্র্যাক্টটাই নাকচ করতে চেয়েছিল রঞ্জনা, দেবেশ রায়ের উপরোধে শেষ পর্যন্ত ওকে একাই বোম্বে যেতে হল।

‘বিশ্রী লাগছে,’ এয়ারপোর্টের লবিতে রঞ্জনা মুখ কালো করে বলেছিল, ‘দু-হপ্তার বেশি একদিনও আমি ওখানে থাকব না, দেবেশদা যতই রাগ করুন—।’

চার

দু-হপ্তা নয়, মাত্র পাঁচদিন পরে কলকাতা-বোম্বাই-মাদ্রাজের ফিল্ম ম্যাগাজিন, কেচ্ছাপুরাণ ওরফে ইয়েলো ম্যাগাজিন, এমনকী দৈনিক সংবাদপত্রেও ছাপা হল সেই মুখরোচক সংবাদ!

দৈনিক সংবাদপত্রে এফ. এন. আই.-র রিপোর্টারের বয়ান একটু সংযত—তিনি ঘটনাটার ওপরে তত রং চড়াননি।

কাল বোম্বের তাজ হোটেলে ফিল্ম-ম্যাগনেট সোহনলাল কানওয়ারের মৃতদেহ এক রহস্যজনক পরিস্থিতিতে পাওয়া যায়। সংবাদে প্রকাশ, রাত্রি প্রায় একটার সময় তাজ হোটেলে শ্রীকানওয়ারের ঘর থেকে ফোন পেয়ে হোটেলের ম্যানেজার ওই ঘরে গিয়ে দেখেন, কানওয়ারের মৃতদেহের পাশে বসে আছেন তাঁর সর্বশেষ নির্মাণরত ফিল্ম ‘স্বয়ংবর’-এর উপনায়িকা শ্রীমতী রঞ্জনা রায়। হোটেলের জনৈক ওয়েটার সাক্ষ্য দেয়, সে মধ্যরাতের কিছু আগে রঞ্জনাকে শ্রীকানওয়ারের ঘরে ঢুকতে দেখে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শ্রীমতী রঞ্জনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পোস্টমর্টেমের পর মৃতদেহ শেষকৃত্যের জন্য তাঁর আত্মীয়দের হাতে দেওয়া হবে। শ্রীকানওয়ারের বয়স আটচল্লিশ। তিনি বিপত্নীক, এক পুত্র ও দুই কন্যার জনক। তাঁর প্রযোজিত ‘কলঙ্কিনী’ ফিল্মটি ১৯৭০-এ ‘ফিল্ম জার্নালিস্টস’ অ্যাওয়ার্ড পায়।

‘প্রোডিউসার ফলস ডেড ইন ফিল্ম হিরোয়িনস ল্যাপ’, ‘সেক্স এসকেপেড অফ বেঙ্গলি হিরোয়িন এন্ডস ইন ডেথ’, ‘কেচ্ছাপুরাণের নায়িকা রঞ্জনাদেবী’, ‘বাঙালি চিত্রতারকার মৃত্যু-আলিঙ্গনে অবাঙালি সিনেমা-প্রযোজক’, ‘স্বাভাবিক মৃত্যু না হত্যাকাণ্ড?’—সিনেমা-পত্রিকার ক্যাপশানগুলো আরও বিচিত্র।

সেই মুহূর্তে ছাপার অক্ষরে এই কালো ক্যাপশানগুলো কাঁটার মতো যার বুকে বিঁধেছে সে শোভন। আত্মীয়েরা ব্যঙ্গের হাসি হেসেছে, বন্ধুরা সান্ত্বনা দিতে গিয়েও আঘাত হেনেছে, ‘হাজার হোক ফিল্ম অ্যাকটেস—তুই ওইসব নিয়ে দুঃখ করিস না, শোভন…।’

শুধু একজন এমন একটা ক্রাইসিসের মুহূর্তে শক্ত হয়ে রইলেন। এমন একটা ভাব দেখালেন যেন খবরের কাগজের এসব আজেবাজে স্ক্যান্ডাল তাঁর চোখেই পড়েনি, যেন কিছুই হয়নি। প্রিয়নাথবাবু ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘স্টেটসে একজন বন্ধুকে চিঠি লিখেছিলাম, পাসপোর্টের ব্যাপারেও বন্ধুরা তদ্বির-তদারক করছে। এক সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট-ভিসা-জব ভাউচার সব পেয়ে যাবি।’

জীবনে বোধহয় প্রথম নিচু হয়ে বাবার পায়ের ধুলো নিয়েছিল শোভন। একটা দারুণ লজ্জা নিয়ে, হেরে যাওয়ার দারুণ গ্লানি নিয়ে দিন কাটানোর দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে ওকে মুক্তি দিলেন প্রিয়নাথ।

‘বাবা, আমার ফিলাডেলফিয়ার ঠিকানাটা তুমি কাউকে বোলো না,’ বি. ও. এ.সি.-র প্লেনে ওঠার আগে সে প্রিয়নাথকে বলেছে। বুদ্ধিমান প্রিয়নাথ নির্বিকার মুখে ঘাড় নেড়েছেন।

সেদিনই পুলিশের হেফাজত থেকে ছাড়া পেয়েছে রঞ্জনা। ইউ. পি. আই.-র সংবাদদাতা সব রহস্যের সহজ সমাধান জানিয়েছে :

পোস্টমর্টেম রিপোর্টে জানা যায়, স্বর্গত সোহনলাল কানওয়ার ইতিপূর্বে করোনারি থ্রম্বোসিসে ভুগেছেন, মৃত্যুর আগে তিনি প্রচুর মদ্যপান করেছিলেন। সম্ভবত, অ্যালকোহল ও উত্তেজনার প্রভাবে তাঁর দ্বিতীয়বার করোনারি অ্যাটাক হয়। চিত্রতারকা রঞ্জনা রায় স্বীকার করেছে, সোহনলাল ওকে তাঁর নিজস্ব প্রোডাকশনে ভবিষ্যতে নায়িকার ভূমিকা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়ায় বিপত্নীক প্রৌঢ় ফিল্ম-প্রোডিউসারের ব্যভিচারের প্রস্তাবে ও সম্মতি দেয় এবং সেদিন রাত বারোটার পর তাজ হোটেলে সোহনলালের স্যুটে যায়। রাত্রি সাড়ে বারোটা নাগাদ হঠাৎ বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন সোহনলাল, এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ওই অবস্থায় ভয় পেয়ে রঞ্জনা হোটেলের রুম সার্ভিসে ফোন করে ডাক্তার ডাকতে বলে। চিত্রতারকা রঞ্জনা রায়ের বয়ান সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়ায় তাকে পুলিশি হেফাজত থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে—।

ইউ. পি. আই.-র সংবাদদাতা যে-কথা জানায়নি, তা হল—যেদিন পুলিশি হেফাজত থেকে ছাড়া পেল রঞ্জনা, ঠিক সেদিনই ম্যান্ডেভিল গার্ডেনের ফ্ল্যাটের সামনে অনেক মানুষের ভিড় জমেছিল। কড়িকাঠ থেকে শাড়ির ফাঁসে ঝুলছিল থানপরা এক বিধবার একহারা শরীর—লজ্জাহীনা মেয়ের মুখ দেখার লজ্জা থেকে মুক্তি পেয়েছেন রঞ্জনার হতভাগিনী মা উমা দেবী।

‘স্বয়ংবর’ ফিল্ম এবং কানওয়ার প্রোডাকশনস পাততাড়ি গুটোল। দেবেশ রায় ইউনিটসমেত কলকাতায় ফিরে এলেন। রঞ্জনার ব্যবহারে ভদ্রলোক মর্মাহত হয়েছিলেন। ভবিষ্যতে আর-কোনও ফিল্মে তিনি রঞ্জনাকে নেবেন না—একরকম প্রতিজ্ঞাই করেছিলেন দেবেশবাবু।

কিন্তু স্ক্যান্ডাল শুধু কলঙ্কের কালি ছিটোয় না, ম্যাগাজিনে-ম্যাগাজিনে পাবলিসিটির ডঙ্কা বাজায়। বাংলা ফিল্মের উঠতি হিরোয়িন রঞ্জনা রায়—যার নাম বোম্বে, মাদ্রাজ, দিল্লিতে কেউ শোনেনি—স্ক্যান্ডালের কল্যাণে ওর ফটো, লাইফ-হিস্ট্রি, ওর শরীরের মাপ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত তাবৎ সিনেমা-দর্শকের নজরে এল। এবং মাসখানেক না যেতেই দেখা গেল, ও গোটা পাঁচেক হিন্দি ফিল্মে চান্স পেয়েছে। বেশিরভাগই ভ্যাম্প কিংবা সহনায়িকার ভূমিকায়।

রঞ্জনা অভিনয় জানত, ছবিগুলো রিলিজ হতে ওর অ্যাক্টিং দেখে বেশ কিছু প্রোডিউসারের টনক নড়ল।—এবার আর সাইড-রোল নয়, সরাসরি হিরোয়িনের রোলে ওকে চান্স দেওয়া হল।

পরবর্তী পাঁচবছর রঞ্জনার একটানা সাফল্যের ইতিহাস। হিন্দি সিনেমায় ওর সাফল্যের নজির টলিউডেও ঢেউ তুলেছে। বাংলা ফিল্মের নায়িকার ভূমিকায় ওকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রোডিউসারদের মধ্যে রীতিমতো কম্পিটিশন বেধেছে।

সাফল্য আরও সাফল্যের জন্ম দেয়, হিন্দি ফিল্মের জনপ্রিয় নায়িকা হয়েও অভিনয় ভোলেনি রঞ্জনা—বাংলা ও হিন্দি দু-ধরনের ছবিতেই ও সমান পপুলার। ‘আমারই বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া—’ রঞ্জনার কোনও বাংলা ফিল্মের সুবর্ণজয়ন্তী হবে শুনে দেবেশবাবু নাকি বলেছিলেন।

এবং এইসব—মহরত, সিলভার-গোল্ডেন-প্ল্যাটিন্যাম জুবিলি, ফিল্মফেয়ার-ফেস্টিভ্যাল নাইট, সিনেমা-জার্নালের চকচকে রগরগে বিজ্ঞাপন—নদীর ধারে পাহাড়ের কোলে লোকেশনে রঞ্জনা, শাড়িপরা-স্ল্যাকসপরা-বিকিনিপরা রঞ্জনা, ড্রয়িংরুমে-রান্নাঘরে-বাথটাবে রঞ্জনা—ওইসব যার রক্তে জ্বালা ধরিয়েছে, সে শোভন। ফিলাডেলফিয়ায় বিজনেস ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা নিয়েছে শোভন। ‘তুমি কোনও মেয়ের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারোনি’—তার বন্ধুরা অভিযোগ জানাত। ওরা জানত না, একটি মেয়ে তার বিশ্বাস ভেঙে তার ব্যক্তিত্বের ভিতে চিড় খাইয়েছে—সে সুপুরুষ, সে যুবক, সে প্রেমিক—কিন্তু তাকে ছেড়ে আঠেরো বছরের রঞ্জনা মাত্র পাঁচদিনের পরিচয়ে সোহনলাল কানওয়ার নামের এক প্রৌঢ় কামুকের কাছে ধরা দিয়েছিল—শুধুই কি টাকার লোভে সাফল্যের মরীচিকা খুঁজে?

অবশ্য বেশিরভাগ লোক তাই বলে। যেমন ‘স্বয়ংবরা’র হিরোয়িন মানসী সান্যাল। রঞ্জনার কেলেঙ্কারির পরে যখন কানওয়ার প্রোডাকশনস পাততাড়ি গুটোল, মানসী দস্তুরমতো কাগজে স্টেটমেন্ট দিয়ে ফিল্ম-লাইন ছাড়ল।

‘আর-একবার প্রমাণ হল, ফিল্ম-লাইন লোভ, লালসা ও নারীলোলুপতার লীলাভূমি,’ ভদ্রমহিলা নাকি বলেছিলেন, ‘আমি এই লাইন ছেড়ে দিতে চাই। হ্যাঁ, প্রসূনকুমারের সঙ্গে আমার বিয়ে আগামী মাসেই—হানিমুনে আমরা কন্টিনেন্টে যাব—।’

কিন্তু একটা প্রশ্ন শোভনকে বিষকাঁটার মতো বেঁধে। শুধুই কি টাকার লোভ, নাকি যুবক হলেও শোভনের মধ্যে এমন কিছুর অভাব ছিল—অভাব ছিল সেই কঠিন পৌরুষের, যা রমণীকে ধরে রাখে?

স্টেটস থেকে ফিরতেই ছেলের চাকরি ও বিয়ের ব্যবস্থা প্রায়ই একইসঙ্গে করেছেন শোভনের বাবা প্রিয়নাথবাবু। রীনা তার বাবার একমাত্র মেয়ে, বড়লোকের একমাত্র ওয়ারিশ, কনভেন্টে পড়েছে, ডলপুতুলের মতো সুন্দরী। শোভন বড় চাকরি করে, চেহারায় জেল্লা আছে, কথাবার্তা-চালচলন দারুণ স্মার্ট, একটু আঁতেল-আঁতেল মুড দেখায়, বিশেষত সিনেমা প্রসঙ্গে কথা উঠলে। শোভনকে নিয়ে ডলপুতুলের বেশ একটু গর্ব আছে। অথচ রীনাকে সন্দেহ করে শোভন। ওর কোনও বন্ধুর সঙ্গে রীনা হেসে কথা বললেও ওর বুকের ভেতরে সেই পুরোনো বিষকাঁটাটা যেন মোচড় দেয়। রীনাও কি কোনওদিন রঞ্জনার মতো হতে পারে না!

স্টেটসের ঠিকানাটা কেমন করে জোগাড় করেছিল রঞ্জনা? অনেকগুলো চিঠি এসেছে শোভনের কাছে—লাইটারের আগুনে এয়ার লেটারগুলো পোড়াতে অদ্ভুত একটা আনন্দ পেত শোভন—চিঠিতে কী লিখেছে রঞ্জনা নামের সেই নষ্টচরিত্র মেয়ে, যে শোভনের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, শোভন কখনও পড়ে দেখেনি। একসময় চিঠি আসা বন্ধ হয়েছে। বিয়ের সময় বুঝি কার মুখে খবর পেয়ে দামি উপহার পাঠিয়েছিল রঞ্জনা—গিফট পার্সেলটা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে শোভন।

তারপর এই চিঠি—মাঝরাতে এসে ছটফট করে শোভন—যে-অতীতকে সে ভুলতে চায়, সেই অতীত তাকে বারবার পায়ে-পায়ে জড়িয়ে ধরে কেন?

পাঁচ

এয়ার টার্মিনাসের রেস্তোরাঁয় ভিড় নেই। প্লাইউডের পা.শনের আড়ালে বসে আছে রঞ্জনা। এই ক’বছরে আর-একটু স্প্লিম হয়েছে, আর-একটু সুন্দরী। শিম্পাতা-রং শাড়ি, বুফাবাঁধা চুল, চোখে গগলস—এক হিসেবে ভালোই, রঞ্জনার চোখে চোখ মেলে তাকাতে হবে না শোভনকে।

”অভিনেত্রী” ফিল্মটা দেখলাম,’ যেন কিছুই হয়নি—কফির পেয়ালায় চামচ নাড়ছে শোভন : ‘কনগ্র্যাচুলেশনস। ক্লদ লেলুশ তোমার অ্যাক্টিং সম্বন্ধে যা বলেছেন, এতটুকু বাড়িয়ে বলেননি—।’

‘এখানকার পাবলিকের ছবিটা ভালো লাগেনি,’ ছোট্ট রুমালে মুখ মোছে রঞ্জনা, গালে লালচে আভা জাগে।

‘ঋত্বিকবাবু সাধে বলেছেন, শালার পাবলিক—,’ যেন অনেকদিন আগের শোভন, যে সিনেমা নিয়ে তর্কের ঝড় তুলত, হাসি-ঠাট্টা কথার ফুলঝুরি ঝরিয়ে আসর জমিয়ে রাখত।

‘না, শোভন, পাবলিকের দোষ নেই,’ গগলস খুলে শোভনের চোখের দিকে তাকায় রঞ্জনা, শোভন চোখ নামিয়ে নেয় : ‘একটা মেয়ে—সে তার কেরিয়ারের জন্যে স্বামীকে যন্ত্রণা দিল। স্বামীর মৃত্যুটা যদিও অ্যাক্সিডেন্ট, তবু এ-মৃত্যুর দায়িত্ব সে কি অস্বীকার করতে পারে? স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর পর তার নিজের বাঁচার প্রয়োজনটাই বড় হয়ে উঠল। সে ফিল্মে প্রেমিকার অভিনয় করে, তার মরা মেয়ের ছবিতে ধুলো জমে, সে নতুন প্রেমিকের সঙ্গে ফূর্তিতে মাতে—এই মেয়েটার জীবনযন্ত্রণা দু-চারজন আঁতেলের ভালো লাগতে পারে—কিন্তু পাবলিক তাকে সহ্য করতে পারবে কেন?’

‘অথচ এটাই স্বাভাবিক। একজন অভিনেত্রীর হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, ঘর বাঁধা, ঘর ভাঙা কোনওটাই জীবন নয়, জীবনের ছায়া। কেননা, রুপোলি পরদার বুকে সে কখনও প্রেমিকা, কখনও ঘরনী, কখনও সতী-সাধ্বী, কখনও অসতী, তার অভিনয় পরদা ছাপিয়ে জীবনকে ছুঁয়ে যায়—সে প্রেমিকের সঙ্গে, স্বামীর সঙ্গে, সন্তানের সঙ্গে অভিনয় করে—আমরা ছায়া দেখে ভাবি, এটাই অভিনেত্রীর জীবনের হাসি-কান্না, প্রেম বা বঞ্চনা কোনওটাই বাস্তব নয়, ফ্ল্যাশব্যাক, মিড শট, লং শট, ফ্রিজ, আলোছায়ার মন্তাজ—তার বেশি কিছু খুঁজতে গেলে—’ একসঙ্গে অনেকগুলো কথা বলে হঠাৎ থেমে যায় শোভন, তারপর : ‘কিছু মনে কোরো না, আমি ”অভিনেত্রী” ফিল্মের কথা বলছিলাম—।’

‘না, শোভন, তুমি আমার কথা বলছিলে,’ এখনও ভুবনভোলানো হাসি হাসতে পারে রঞ্জনা—নিপুণ অভিনেত্রী, কোনও কিছুই বুঝি ওর স্নায়ুতে দাগ কাটে না : ‘অথচ এমন তো হতে পারে, যে-ঘটনাটাকে বাস্তব ভেবে তুমি দুঃখ পেয়েছ, সেটাও ঘটনা নয়, ঘটনার ছায়া, শুধুই অভিনয়—।’

‘আমি—আমি শুধু একটা কথা তোমাকে বলতে পারি, রঞ্জনা—অভিনয়-জীবন ছেড়ে দিলে তুমি ভুল করতে—হ্যাঁ, সেদিন যদি ঝোঁকের মাথায় তুমি আমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে, ইনগ্রিড থুলিনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো এই অভিনয় দর্শক স্ক্রিনে দেখতে পেত না—।’

‘তাতে আমার কী এসে যায়?’ রঞ্জনার চোখের কোণে চিকচিক করছে—হ্যাঁ, জলের ফোঁটা—সত্যিকার ভালো অভিনেত্রী দুঃখ বোঝাতে চোখের কোণে গ্লিসারিন লাগায় না।

‘শুধু প্রতিভা দিয়ে দর্শককে জয় করতে নিশ্চয়ই সময় লাগত। কিন্তু তার বদলে যে-রাস্তা তুমি বেছে নিয়েছিলে, রঞ্জনা—সোহনলাল কানওয়ারের ফিল্মে চান্স পাবে বলে রঞ্জনা রায়ের মতো আর্টিস্ট—।’

‘না,’ জলের গ্লাসটা এত শক্ত মুঠোয় ধরেছে রঞ্জনা, কাচ যেন এখনই গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে যাবে ‘সোহনলাল আমার দিকে লোভের হাত বাড়ালে আমি তাকে খুন করতাম—।’

খুন! যেন হঠাৎ চমকে ওঠে শোভন। ‘স্বাভাবিক মৃত্যু না হত্যা?’ ইয়েলো ম্যাগাজিনের একটা কালো ক্যাপশন ওর মনে পড়ে। যদি তাই হয়—যদি ছল-ছুতোয় রঞ্জনাকে কাছে ডেকে থাকে সোহনলাল, যদি মন্দিরের মতো শরীরে দাগ রাখতে চায়, সেই কুৎসিত স্বভাবের মাঝবয়েসি লোকটা—রঞ্জনা কি তাকে খুন করতে পারে না? তারপর বিপদ বুঝে হোটেলের ম্যানেজারকে ফোন—সেটাও কি স্বাভাবিক নয়?

এবং স্বেচ্ছায় মোহনলাল কানওয়ার নামের এক কামুক মাঝবয়েসি ফিল্ম-প্রোডিউসারের কাছে ধরা দিয়েছে উঠতি ফিল্ম-স্টার রঞ্জনা—এই স্টেটমেন্ট দিয়ে মার্ডার চার্জের হাত থেকে রেহাই পাওয়া কি সম্ভব নয়? বাকি থাকে পোস্টমর্টেম—কিন্তু সোহনলালের আগে একবার করোনারি হয়েছিল—হয়তো ধস্তাধস্তির সময় তার সেকেন্ড অ্যাটাক হয়—হয়তো হঠাৎ চোট লেগে হার্টের কাজ বন্ধ হয়ে যায়—হয়তো—হয়তো—হয়তো—কিছুই বলা সম্ভব নয়, কেননা অভিনয় দিয়ে সত্যকে মানুষের চোখের আড়ালে রাখতে জানে রঞ্জনা।

‘সোহনলালের মৃত্যুর ব্যাপারে আমার জড়িয়ে পড়ার কোনও যুক্তি তোমাকে বোঝাতে পারব না, শোভন। ধরো, এমন একজনের জন্যে—যার সঙ্গে আমার মাত্র মাসখানেকের পরিচয়—তাকে বাঁচাব বলে—অথচ দেখো, সে কেমন মাথা উঁচু করে সিনেমা-লাইনের লোভ, লালসা, নোংরামি নিয়ে বড়-বড় কথা বলে অ্যাক্টিং ছেড়ে দিল। আসলে ওর বয়েস বাড়ছিল, বাজার পড়ে আসছিল—সোহনলাল ছাড়া আর কোনও প্রোডিউসার হিন্দি ফিল্মে ওকে চান্স দিত না—ওর লাভারেরও বয়স হয়েছিল, কিন্তু তখনও টলিউডের ম্যাটিনি-আইডল, কমবয়েসি মেয়েদের সঙ্গে পার্ট করছে, মানসীর সঙ্গে বিয়ের এনগেজমেন্টটা ভেঙে ফেলতে পারলে—।’

‘মানসী? তুমি মানসীর কথা বলছ?’ এতক্ষণে কথার খেই ধরতে পারে শোভন। প্রায় দুই দশক ধরে বাংলা ও হিন্দি ফিল্মের পরদায় যাকে দেখা গেছে, যার সঙ্গে রঞ্জনার প্রথম পরিচয় ‘স্বয়ংবরা’ ফিল্মের সেটে—সেদিনের সেই ঘটনায় তার কী ভূমিকা থাকতে পারে?

‘মানসীকে তোমার মনে পড়ে, শোভন? দু-গালে বয়সের ভাঁজ, কপালের কোঁচকানো দাগগুলো হেভি মেকআপে ঢাকা পড়ত। ডায়েটিং স্প্লিমিং রু ম্যাসর বডিশেপারের কোনও কারসাজি না মেনে শরীরে চর্বির ঢল নামছিল। ও সবসময় কর্সেট পরে থাকত। ওর পরপর তিনটে ফিল্ম ফ্লপ করেছে। সোহনলাল জেদ না ধরলে দেবেশদা ওকে কিছুতেই হিরোয়িন করতেন না—।’

‘প্রসূনকুমার শেষ পর্যন্ত ওকে বিয়ে করেছিল,’ শোভন ভাবলেশহীন মুখে বলে, ‘লোকে বলে, অনিচ্ছায়, দায়ে পড়ে, ওকে এড়াতে না পেরে—।’

‘প্রসূন যদি জানত—,’ প্লাইউডের পার্টিশন, সিলিং-এর ফ্যান প্যান করে অভিনেত্রীর চোখদুটো এখন গ্লাস-টপ টেবিলে আটকে আছে : ‘সেদিন রাতে আমার ঘরে টেলিফোন বেজে উঠল। যখন কানওয়ারের রুমে ঢুকলাম, সব শেষ—।’

‘সব শেষ,’ বিমূঢ় শোভনের দিকে তাকিয়ে অভিনেত্রীর আঁখিপল্লব কেঁপে ওঠে : ”সব শেষ—” ভাঙা গলায় বলছিল মানসী। কল্পনা করো, ওর মুখে মেকআপ নেই, চোখের কোণে কালি, গালের ঝুলে পড়া মাংস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, পাতলা একটা নাইটগাউন, ভেতরে ব্রা-করসেট-গাউন কিছু নেই। ওর ভাঙা বুক, ভারী কোমর ঝকঝকে আলোয় আরও বিশ্রী দেখাচ্ছে। বিছানার ওপরে শুধু একটা আন্ডারওয়ার পরে শুয়ে আছে সোহনলাল—লোকটার মুখ নীল, ঠোঁটের কোণে ফেনা, বুকটা নিশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে না। ”ও মরে গেছে”—আমার হাতদুটো ধরে হিস্টিরিয়ার রুগির মতো কাঁপছিল মানসী—”দ্যাখো রঞ্জনা, লোকটা মরল, আমাকেও মেরে গেল—”।’

‘তাহলে?’ শোভনের হাতদুটো টেবিলে রাখা, আঙুলগুলো তবুও একটু-একটু : কাঁপছে ‘তাহলে মানসীই কানওয়ারকে খুন করেছিল?’

‘না। বছর-কয়েক আগে মানসীকে নিজের প্রোডাকশনে চান্স দিয়েছিল কানওয়ার। তখন থেকেই ওদের মাখামাখি। ”স্বয়ংবরা”র শুটিং-এর সময় পুরোনো সম্পর্কটা ওরা ঝালিয়ে নিতে চেয়েছিল। আকণ্ঠ মদ গিলেছিল কানওয়ার। ওর হার্টের অসুখ ছিল, হয়তো এক্সসাইটমেন্টের ধকল সইতে পারেনি। এবার অবস্থাটা একবার ভেবে দ্যাখো। কানওয়ারের স্যুটে ওকে ঢুকতে দেখেছে হোটেলের ফ্লোর-ওয়েটার। এখন কানওয়ারের এই অপঘাত মুত্যু নিয়ে ঝামেলা বাধবে, সবাই জানবে, মাঝরাতে প্রোডিউসারের ঘরে গিয়েছিল মানসী।

‘পাপ কখনও ঢাকা থাকে না, থাকা উচিত নয়—তুমি হয়তো বলবে। কিন্তু তখন—”সব শেষ”—হাউহাউ করে পাগলের মতো কাঁদছে মানসী। বলছে, ”এমনিতেই প্রসূন বিয়েটা নাকচ করার চান্স খুঁজছে, ও যখন জানবে—” ওর গালের ঝোলা মাংস, বসা চোখ, থলথলে শরীর কেঁপে-কেঁপে উঠছিল। আমি—আমি সহ্য করতে পারিনি, শোভন। সোফার ওপরে ওর কমলা রঙের শাড়িটা লুটোচ্ছিল। শাড়িটা পরে নিয়ে আমার ছাড়া কাপড়টা ওকে পরতে বললাম, তারপর বাথরুমের দরজা খুলে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ও নীচে নেমে গেল। আমি টেলিফোন তুলে রুম-সার্ভিসে ডায়াল করলাম—।’

‘পাপ না করে তুমি পাপী সাজলে?’ দুটো হাত মুঠো করে আছে শোভন, বন্ধ হাতের তালু থেকে টেবিলে ঘাম গড়িয়ে পড়ে : ‘আমার কথা, তোমার মায়ের কথা, তোমার একবারও মনে এল না?’

‘এসেছিল,’ রঞ্জনার গালে জলের বিন্দুগুলো রুপো-রং সুতোর মতো আঁকাবাঁকা : ‘পাবলিক আমাকে ভুল বুঝবে, আমি জানতাম। মানসীকে বাঁচাতে গিয়ে আমি মিথ্যে বদনামের ঝুঁকি নিয়েছিলাম। কেননা আমার বিশ্বাস ছিল, আমাকে যারা চেনে—মা, তুমি, আমার ভাই রাজা, তোমরা আমার অভিনয় ধরে ফেলবে। কিন্তু না—মা আত্মহত্যা করলেন, রাজা বাড়ি থেকে পালিয়ে রেলের ওয়ার্কশপে চাকরি নিয়েছে, ও আমার মুখ পর্যন্ত দেখতে চায় না। আর তুমি—আমার অভিনয় এত ভালো হয়েছিল, তোমরা সবাই ভুল বুঝলে,’ ভ্যনিটি ব্যাগের ক্লাস্প খুলে হাতড়াচ্ছে রঞ্জনা। একসময় রুমালটা চোখের কোণে এসে লাগে। জল মুছে আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অভিনেত্রীর চোখ : ‘নিজের জীবন নিয়ে এমন অভিনয় কে কবে করেছে বলো তো? ইনগ্রিড থুলিন? অ্যানা ম্যাগনানি? ওরা কি অভিনয় করে মাকে, ভাইকে, ভালোবাসার মানুষকে ভুল বোঝাতে পেরেছে?’

‘এলে যদি, এতদিন পরে কেন এলে?’ অনেক, অনেকক্ষণ পরে শোভন কথা বলে। বোম্বের প্লেন আসছে—যাত্রীদের মাইকে ডাকা হচ্ছে। মাইকের স্বর ছাপিয়ে উঠল শোভনের ভাঙা গলার আর্তস্বর, ‘কেন এতদিন পরে আমার ভুল ভেঙে দিলে?’

গো-গো সানগ্লাস চোখে এঁটে নেয় রঞ্জনা। কালো কাচের বুকে শোভনের রুক্ষ মুখের ছায়া ভাসে : ‘তোমার জন্যে,’—মুক্তোর মতো সাদা দাঁতগুলো একবার ঝিলিক দেয়—’একটি মেয়ে তোমার ভালোবাসাকে অসম্মান করেছে ভেবে তুমি সব মেয়েকে সন্দেহ করবে, হয়তো তোমার স্ত্রীকেও—তোমার সুখের ঘরের চাবি আমি ফিরিয়ে দিয়ে গেলাম, শোভন।’

লং শটে রানওয়ে, যাত্রীরা সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, প্লেনের প্রপেলার ঘুরছে।

মিড শটে হেঁটে যাচ্ছে রঞ্জনা, হাওয়ায় উড়ছে শিমপাতা রং শাড়ির আঁচল। দুঃখ ওর একার, কালো কাচের আড়ালে ভেজা চোখের মতো ঢাকা থাকে। অভিনয় বুফাঁ-বাঁধা চুলের মতো, তন্বী শরীরের মতো, শাড়ির আঁচলের মতো—হাওয়ায় দোলে, চোখের সামনে আসে, কখনও বা দূরে সরে যায়।

সবার পিছনে ফ্রিজে জমা ছবির মতো শোভন—’আমি সুখি নই, সুখি নই, সুখি নই’—ওর শুকনো ঠোঁটদুটো না নড়েও বারবার বলছে।

অপরাধ

ডিসেম্বর, ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *