অভিজ্ঞান

অভিজ্ঞান

বাড়ির পিছনে লম্বা খোলা চাতালের উপর ইজি-চেয়ারে বসিয়াছিলাম। ঠিক নীচে দিয়া ভাদ্রের গঙ্গা অধীর উন্মাদনায় ছুটিয়া চলিয়াছিল।

কিছুদূরে আর একটি চেয়ারে যে বসিয়াছিল, তাহার নাম সুনন্দা। সুনন্দার বয়স আঠারো-উনিশ; তাহাকে দেখিলে সম্মুখে ঐ ভরা গঙ্গার কথা মনে হয়, তেমনই অধীর উদ্বেল। প্রবল চুম্বকের মতো তাহার যৌবনোচ্ছল দেহের একটা অনিবার্য আকর্ষণ আছে; বুদ্ধি ও সংযমকে অতি সহজে বিপর্যস্ত করিয়া দিতে পারে।

সুনন্দার ঘন কালো চুলের মধ্যে সিঁদুর নাই; বোধ হয় সে অনূঢ়া। তাহার কানে সূক্ষ্ম তারের কাজ করা সোনার কানবালা, গলায় সরু একটি হার; পরিধানে মেঘলা রঙের শাড়ি। বর্তমানে সে সাগ্রহে আমার মুখের পানে চাহিয়া ছিল; তাহার ঘোর রক্তবর্ণ পুরন্ত অধরোষ্ঠ যেন অনুচ্চারিত প্রশ্নে ঈষৎ বিভক্ত হইয়া ছিল।

কিন্তু এই ভাদ্রের অপরাহ্নে সুনন্দার পাশে বসিয়াও আমার মনটা ছটফট করিতেছিল। একটা দুর্বোধ্য অশান্তি স্নায়ুর মধ্যে সঞ্চারিত হইয়া দেহটাকেও অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল।

সুনন্দা সহসা প্রশ্ন করিল, বলুন না, আপনার নাম কি?

একটু চিন্তা করিয়া বলিলাম, বলতে পারি না।

অধীর অসন্তোষে সুনন্দার অধর স্ফুরিত হইয়া উঠিল, সে কহিল, বলবেন না, তাই বলুন। কেন, নাম বললে কি আমরা আপনাকে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দেব? আর, এখন তো আপনি সেরে উঠেছেন, বিদেয় করলেই বা ক্ষতি কি?

আমি বলিলাম, সুনন্দা, আমি চলে যেতেই চাই।

সুনন্দা অধর দংশন করিল; একটু থামিয়া অনুতপ্ত স্বরে বলিল, রাগ করলেন? আমি অমন যা-তা বলি।

রাগ করিনি—সত্যি বলছি। যতদিন বিছানায় শুয়েছিলুম, কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এখন আর আমার মন টিক্‌ছে না, কেবলি মনে হচ্ছে কোথাও চলে যাই। আমার যেন কোথাও যাবার আছে।

কোথায় যাবার আছে?

তা জানি না।

ভর্ৎ সনার সুরে সুনন্দা বলিল, আচ্ছা, কেন মিছে কথা বললেন? বলুন না, কারুর জন্যে আপনার মন কেমন করছে তাই তাড়াতাড়ি চলে যেতে চান। হয়তো আপনার স্ত্রী।

চমকিয়া উঠিলাম, স্ত্রী? আমার কি বিয়ে হয়েছে?

সুনন্দা তীক্ষ্ণ চক্ষে চাহিয়া বলিল, হয়নি?

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলাম, না—বোধ হয়।

সুনন্দা বিদ্যুতের মতো প্রশ্ন করিল, তবে ও হীরের দুল কার?

হীরের দুল?

সুনন্দা হাসিয়া উঠিল। তাহার হাসিতে একটু তিক্ত-রস ছিল; বলিল, তাও অস্বীকার করবেন? আচ্ছা, আমাকে কি মনে করেন বলুন দেখি?

ধীরে ধীরে বলিলাম, মনে করি, আনন্দময়ী মুরতি তোমার, কোন দেব আজি আনিলে দিবা, তোমার পরশ অমৃত সরস তোমার নয়নে দিব্য বিভা। —কথাগুলা একরকম নিঃসাড়েই মুখ দিয়া বাহির হইয়া আসিল।

সুনন্দা গঙ্গার দিকে তাকাইল; তাহার চোখে ভরা-নদীর ছায়া পড়িল। গঙ্গার পরপারে মেঘলা আকাশ চিরিয়া এক ঝলক রক্তাভ সূর্য-রশ্মি তাহার কপালে, গালে, সুগোল সবল বাহুতে আসিয়া পড়িল।

কিয়ৎকাল পরে সে চটুল হাসিয়া মুখ ফিরাইল, আমার পরশ যে অমৃত সরস তা জানলেন কি করে?

জ্বরের ঘোরে যখন অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলুম, তখন কপালে তোমার ঠাণ্ডা হাত বড় মিষ্টি লাগত।

সুনন্দা শুন্যের দিকে তাকাইয়া মৃদুস্বরে বলিল, তিন দিন জ্বরে একেবারে অজ্ঞান হয়ে ছিলেন। উঃ—সে কি জ্বর! গায়ে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়। ডাক্তার বললেন, নিউমোনিয়ায় দাঁড়াতে পারে; আমরা তো ভেবেছিলুম—, কিন্তু কি ভাগ্যি চার দিনের দিন থেকে জ্বর কমতে আরম্ভ করল!

আমার কি হয়েছিল সুনন্দা? জ্বরই বা হল কেন আবার সেরেই বা উঠলুম কি করে?

সে একবার আমার দিকে তাকাইয়া পূর্ববৎ আকাশে দৃষ্টি স্থাপন করিয়া বলিল, আমি রোজ সকালে এইখানে স্নান করি। বারো দিন আগে সকালবেলা নাইতে এসে দেখি স্রোতে আপনি ভেসে যাচ্ছেন। সাঁতরে গিয়ে তুলে নিয়ে এলুম। অজ্ঞান অচৈতন্য, নিশ্বাস এত আস্তে পড়ছে যে ধরা যায় না। শুধু প্রাণপণে একটা ভাঙা গাছের ডাল আঁকড়ে আছেন।

ডাকাডাকি করাতে বাবা এলেন, চাকর-বাকরেরা এল। ধরাধরি করে আপনাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শোয়ালুম। তার আধঘন্টা পরেই তাড়স দিয়ে জ্বর এল।

গভীর মনঃসংযোগে শুনিয়া বলিলাম, তারপর?

সুনন্দা ঈষৎ হাসিল, তারপর আর কি! এখন সেরে উঠেছেন, তাই পরিচয় না দিয়েই পালাবার চেষ্টা করছেন।

আমি কাতরভাবে বলিলাম, সুনন্দা, আমার যদি উপায় থাকত—

ভ্রূভঙ্গি করিয়া সুনন্দা বলিল, উপায় নেই কেন? আপনার নামে কি পুলিসের ওয়ারেন্ট আছে?

এই সময় সুনন্দার বাবা আসিয়া একটা শূন্য চেয়ারে বসিলেন। তাঁহার নাম জানি না; সুনন্দা ‘বাবা’ বলে, চাকরেরা সসম্ভ্রমে ‘বাবুজী’ বলিয়া ডাকে; যে ডাক্তার আমার চিকিৎসা করিতেছিলেন তাঁহাকে একবার ‘রায় বাহাদুর’ বলিতে শুনিয়াছি। অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির লোক, বেশী কথা কহেন না; যে যা বলে তাহাতেই রাজী। তিনি নিঃশব্দে চেয়ারে আসিয়া বসিলে সুনন্দা বলিল, বাবা, উনি চলে যেতে চান। কিন্তু নাম ধাম ঠিকানা কিছুই বলবেন না।

কর্তা নিস্তেজভাবে বলিলেন, চলে যাবেন? কিন্তু এখনো ওঁর শরীর তেমন—আরো দু’দিন থেকে গেলে হয়তো—

সুনন্দা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলিয়া উঠিল, কিন্তু উনি নাম বলবেন না কেন? আমি ওঁর প্রাণ বাঁচিয়েছি, আমাকে বলতে বাধা কি?

অত্যন্ত কুণ্ঠিতভাবে কতা বলিলেন, উনি যখন বলতে চান না তখন আমাদের পীড়াপীড়ি করা উচিত নয়। হয়তো কোনও কারণ আছে।

সুনন্দা সহসা উঠিয়া দাঁড়াইল, ক্ষুব্ধ উজ্জ্বল চোখে আমাকে বিদ্ধ করিয়া বলিল, বেশ দরকার নেই বলবার, আমি চাই না শুনতে। বলিয়া দ্রুতপদে বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল।

কিছুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলাম, তারপর কর্তা মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কবে যেতে চান?

আমি সন্ধ্যা-ধূসর গঙ্গার দিকে চাহিয়া বলিলাম, আজ থাক। কাল সকালে।

আচ্ছা। আপনার যাতে সুবিধা হয়।

সে রাত্রে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। দুর্বলের গভীর নিদ্রা, কিন্তু ভাঙিয়া গেল। কপালে অতি শীতল মধুর স্পর্শ অনুভব করিয়া চোখ মেলিলাম। সুনন্দা শিয়রে দাঁড়াইয়া আছে। অপরিসীম তৃপ্তিতে মন ভরিয়া গেল; আবার চক্ষু মুদিলাম।

প্রভাতে বিদায় কালে বলিলাম, সুনন্দা, তাহলে এবার যাই।

সুনন্দা বলিল, এই নিন, এই মনিব্যাগটা আপনার পকেটে ছিল। ওর মধ্যে আড়াই শ’ টাকার নোট আছে। আর, দুটো হীরের দুল।

আচ্ছা, বলিয়া মনিব্যাগ পকেটে পুরিলাম।

সুনন্দার বাবা ঘরে ছিলেন না। সুনন্দা জিজ্ঞাসা করিল, আমাদের মনে থাকবে তো?

হ্যাঁ।

আবার আসবেন তো?

কি জানি—

তীব্র চাপা স্বরে সুনন্দা বলিল, আসবেন। আসতে হবে। আমি পথ চেয়ে থাকব।

দেখিলাম তাহার চোখ দুটি বাষ্পোজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। সে একবার দাঁত দিয়া ঠোঁট চাপিল, তারপর বিদায় হাসি হাসিল।

বাড়ির গাড়ি স্টেশনে পৌঁছাইয়া দিল।

স্টেশনটি মাঝারি, বেশী লোকজন নাই। টিকিট ঘরের খাঁচার মুখে গিয়া একটি দশ টাকার নোট ছিদ্রপথে বাড়াইয়া দিলাম, বলিলাম, টিকিট।

ঝিমানো স্বরে টিকিটবাবু বলিলেন, কোথায় যাবেন?

কোথায় যাইব? এদিক-ওদিক তাকাইয়া বলিলাম, দশ টাকায় কতদূর যাওয়া যায়?

টিকিটবাবু চক্ষু মেলিয়া পিঞ্জরের মধ্য হইতে চাহিলেন, শেষে বলিলেন, কোন দিকে যেতে চান?

তাচ্ছিল্যভরে কহিলাম, যে দিকে হয়।

টিকিটবাবু আর একবার আমাকে দৃষ্টি-প্রসাদে অভিষিক্ত করিয়া নীরবে একটি টিকিট কাটিয়া ছিদ্রপথে আগাইয়া দিলেন।

লাল টিকিট; রংটা কেমন যেন পছন্দ হইল না, অনভ্যস্ত ঠেকিল। বলিলাম, লাল টিকিট দিলেন কেন?

তবে কোন টিকিট দেব, হল্‌দে?

চিন্তা করিয়া বলিলাম, না থাক। এতেই হবে।

টিকিটবাবু পিঞ্জরাবদ্ধ ব্যাঘ্রের মতো আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছেন দেখিয়া আমি সে স্থান ছাড়িয়া প্ল্যাটফর্মে গিয়া দাঁড়াইলাম।

আধঘন্টা পরে ট্রেন আসিল। একটা খালি কামরা দেখিয়া উঠিয়া পড়িলাম।

ট্রেন চলিয়াছে। চারিদিকে জল-ভরা ধানের ক্ষেত। আকাশে কখনও মেঘ কখনও রৌদ্র। আমি কোথায় চলিয়াছি? এ পৃথিবীতে আমাকে চেনে এমন কেহ আছে কি? আমার কি গৃহ আছে? কোথায় কাহার কাছে যাইবার জন্য আমার মনে এই অধীর চঞ্চলতা?

ট্রেন চলিতেছে, থামিতেছে; যাত্রীরা উঠিতেছে নামিতেছে, চেঁচামেচি হট্টগোল করিতেছে। ইহাদের মুখে রাগ বিরাগ ক্রোধ আনন্দের প্রতিচ্ছবি পড়িতেছে, নির্লিপ্তভাবে দেখিতেছি। সুনন্দার বিদায়কালীন মুখ মাঝে মাঝে মনে পড়িতেছে।

সুনন্দা বোধ হয় আমাকে ভালবাসে। তাহার প্রকৃতি কূলপ্লাবী ভাদ্রের গঙ্গার মতো, আপন অপর্যাপ্ত প্রাচুর্যে অসম্বৃত। আমাকে সে গঙ্গা হইতে তুলিয়া আনিয়াছিল, আমি তাহার কুড়াইয়া পাওয়া জিনিস। গঙ্গায় ভাসিয়া যাইতেছিলাম কেন?

একটা বড় স্টেশনে গাড়ি থামিল। খবরের কাগজ বিক্রয় হইতেছিল; একটা কিনিলাম। গাড়ি আবার চলিতে লাগিল, নিরুৎসুকভাবে কাগজখানা চোখের সম্মুখে ধরিয়া রহিলাম।

কিছুদিন আগে ট্রেনে কলিশন হইয়াছিল, তাহারই বিবরণ, কত লোক মারা গিয়াছে, কত লোককে পাওয়া যাইতেছে না, তাহাদের নাম ধাম ঠিকানা। দেশ হইতে সোনা রপ্তানী হইতেছে। এবৎসর ধানের অবস্থা কিরূপ দাঁড়াইবে তাহার পূর্বাভাস। এসব খবর ছাপিয়া কি লাভ হয়? কাহার কাজে লাগে?

ক্রমে অপরাহ্ণ হইল। আমি যেন নিরুদ্দেশের যাত্রী, আমার যাত্রার শেষ নাই।

এ কি! রবি! তুমি!

একটা জনাকীর্ণ বড় স্টেশনে গাড়ি থামিয়াছিল। ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম, একজন লোক মুখ ব্যাদিত করিয়া আমার পানে তাকাইয়া আছে—তাহার চক্ষু যেন ঠিক্‌রাইয়া বাহিরে আসিবে।

আমিও তাহাকে ভাল করিয়া দেখিলাম। আমারই সমবয়সী—লম্বা হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, নাকের পাশে একটা পিঙ্গলবর্ণ মাষা, চোয়াল ভারী, নাক উঁচু। বলবান মজবুত গোছের লোক।

সে একলাফে গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া আমার কাঁধ ধরিয়া প্রবলবেগে ঝাঁকানি দিয়া বলিল, রবি, তুমি বেঁচে আছ! উঃ—আমরা ভেবেছিলুম—

আমি নিজেকে মুক্ত করিয়া লইয়া বলিলাম, আপনাকে আমি চিনি না।

চেন না? সে আবার ব্যাদিত মুখে চাহিয়া রহিল। তারপর আস্তে আস্তে মুখ বন্ধ করিল। তাহার চোখে সন্দেহের ছায়া পড়িল!

আমি ভদ্রতা করিয়া পাশে নির্দেশ করিয়া বলিলাম, বসুন। সে থপ করিয়া বসিয়া পড়িল; কিন্তু তাহার দৃষ্টি আমার মুখ হইতে নড়িল না।

আমাকে সত্যিই চিনতে পারছ না?

মৃদু হাসিয়া মাথা নাড়িলাম, না, আপনি কে?

সে বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো বলিল, আমি নীরোদ—ডাক্তার নীরোদ রায়, তোমার বাল্যবন্ধু; অরুণা সম্পর্কে আমার বোন হয়—, তারপর অধীর কণ্ঠে বলিল, কি আশ্চর্য রবি, আমাকে ভুলে গেলে! এই যে মাসখানেক আগে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে!

বলতে পারি না।

সে হঠাৎ বলিল, তুমি কোথায় যাচ্ছ? তাহার চোখে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হইয়াছে দেখিলাম।

বলিলাম, জানি না।

কোথা থেকে আসছ?

একটু ভাবিয়া বলিলাম, জানি না।

সে ব্যগ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, রবি, তোমার কি কিছু মনে নেই? ট্রেনের কলিশন—তুমি কলকাতা থেকে ফিরছিলে—রাত্রি তিনটের সময় কলিশন হয়—কিছু মনে করতে পারছ না?

না। —আমার নাম কি রবি?

এই সময় ট্রেনের ঘণ্টা বাজিল।

সে একটা সঙ্কল্প ঠিক করিয়া লইয়া বলিল, তুমি আমার সঙ্গে এস। এখানে আমার বাড়ি, আমার কাছেই থাকবে।

জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার কাছে থাকব কেন?

সে ছেলে-ভুলানো স্বরে বলিল, পরে বলব, তোমার সঙ্গে অনেক মজার কথা আছে। এখন এস। এবার গাড়ি ছাড়বে।

তাহার বালকোচিত প্রতারণার চেষ্টা দেখিয়া হাসি পাইল, বলিলাম, আপনার কি বিশ্বাস আমি পাগল?

না না—তা নয়, এস গাড়ি ছাড়ছে। বলিয়া আমার হাত ধরিয়া টানিয়া গাড়ি হইতে নামাইয়া লইল।

স্টেশনের ফটকে টিকিট বাহির করিলাম; সে হাত হইতে টিকিটখানা লুফিয়া লইল—টিকিট করেছ দেখছি। টিকিট পরীক্ষা করিয়া বলিল, রামপুর থেকে আসছ?

তা হবে।

কিন্তু যেখানে কলিশন হয়েছিল, সেখান থেকে রামপুর তো প্রায় সত্তর মাইল দূরে। যাহোক—এস।

আমি কহিলাম, আমি আবার কিন্তু কালই চলে যাব।

স্টেশনের বাইরে একখানা ছোট মোটর ছিল, তাহাতে উঠিয়া বসিলাম। ডাক্তার নীরোদ চালাইয়া লইয়া চলিল।

একটা লাল রঙের বাড়ির সম্মুখে আসিয়া গাড়ি থামিল। দেখিলাম লেখা আছে—‘টেলিগ্রাফ অফিস’। ডাক্তার বলিল, তুমি বোস, আমি এখনি আসছি। বলিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

মিনিট তিন চার পরে ফিরিয়া আসিয়া আবার নীরবে গাড়ি হাঁকাইয়া লইয়া চলিল।

নীরোদ ডাক্তারের বাড়ির একটা ঘরে বসিয়া ছিলাম। ডাক্তার আমার সম্মুখে উপবিষ্ট ছিল। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল।

ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিল, তুমি রামপুরে ক’দিন ছিলে?

শুনেছি বারো দিন।

কি করে সেখানে গেলে মনে আছে কি?

না। শুনেছি—গঙ্গায় ভেসে যাচ্ছিলুম, সুনন্দা তুলেছিল।

ও—ডাক্তার কিয়ৎকাল চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল, সুনন্দা কে?

একটি মেয়ে।

তোমার যা যা মনে আছে সব আমাকে বল।

সংক্ষেপে বলিলাম। শুনিয়া ডাক্তার বলিল, হুঁ—এখন সব বুঝতে পারছি।

কি বুঝতে পারছেন?

তোমার যা হয়েছিল।

কি হয়েছিল?

ডাক্তার ধীরে ধীরে প্রত্যেকটি কথা গুণিয়া গুণিয়া বলিতে লাগিল, তুমি রাত্রির ট্রেনে কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরছিলে, পথে কলিশন হয়, তুমি সম্ভবত সেই ধাক্কায় গাড়ি থেকে ছিটকে বাইরে পড়েছিলে। মাথায় চোট লেগেছিল; অন্ধকার রাত্রে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে গঙ্গায় পড়ে যাও। গঙ্গা সেখান থেকে মাইলখানেক দূরে। তারপর ভাসতে ভাসতে রামপুর পৌঁছেছিলে, কেমন—এখন মনে পড়ছে কি না?

আমি ক্লান্তভাবে বলিলাম, না। আমি কিন্তু কাল সকালেই চলে যেতে চাই।

কোথায় যাবে?

মনে মনে ঠিক করিয়া ফেলিয়াছিলাম, রামপুরে সুনন্দার কাছে ফিরিয়া যাইব। কিন্তু মুখে বলিলাম, জানি না।

আচ্ছা, সে দেখা যাবে—ডাক্তার উঠিয়া ভ্রূকুঞ্চিত মুখে ঘরময় পায়চারি করিতে লাগিল। তারপর আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া হঠাৎ বলিল, অরুণা কাল আসবে।

ঈষৎ বিস্ময়ে বলিলাম, অরুণা কে?

চেন না?

না। স্ত্রীলোক?

ডাক্তার হতাশাপূর্ণস্বরে বলিল, হ্যাঁ, স্ত্রীলোক।

আমি মাথা নাড়িলাম, সুনন্দা ছাড়া আমি আর কোনও স্ত্রীলোককে চিনি না।

আচ্ছা ও-কথা যাক্। এস, এখন অন্য গল্প করি।

কিছুক্ষণ ডাক্তার অন্য গল্প করিল। সে পাঁচ বছর এখানে ডাক্তারি করিতেছে, ইহারই মধ্যে বেশ পশার জমাইয়া তুলিয়াছে। তাহার স্ত্রীপুত্ৰাদি এখন দেশে আছে, পূজার সময় গিয়া তাহাদের লইয়া আসিবে ইত্যাদি। আমি চুপ করিয়া শুনিতে লাগিলাম!

শেষে ডাক্তার বলিল, আগে তুমি রবি ঠাকুরের কবিতা খুব আবৃত্তি করতে। এখন পার?

পারি।

বল তো একটা শুনি!

আমি বলিলাম—

‘দূরে দূরে আজ ভ্রমিতেছি আমি

ছুটিনে কাহারো পিছুতে

মন নাহি মোর কিছুতেই—নাই

কিছুতে!

সবলে কারেও ধরিনা বাসনা মুঠিতে

দিয়েছি সবারে আপন বৃন্তে ফুটিতে—’

ডাক্তার আশা-ব্যগ্র কণ্ঠস্বর যথাসাধ্য সংযত করিয়া যেন গল্পচ্ছলে বলিল, সেবার যখন তুমি আর আমি স্কটিশ চার্চ কলেজে আই. এস-সি পড়ি, তখন তুমি একবার এই কবিতাটা আমাদের সাহিত্য সভায় আবৃত্তি করেছিলে—

নিজের কথা আমার কিছু মনে পড়ে না।

ডাক্তার আবার গুম হইয়া গেল।

আমি বলিলাম, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা আপনি জিজ্ঞাসা করছেন। এতে কি লাভ জানি না, কিন্তু আমার বড় ক্লান্তি বোধ হচ্ছে।

না না, আর ও-কথা নয়। ডাক্তার ঘড়ি দেখিয়া বলিল, আটটা বেজে গেছে। চল, এবার দুটি খেয়ে শুয়ে পড়বে; কাল সকালে ঘুম ভেঙে হয়তো—

হ্যাঁ, কাল সকালেই আমি যাব।

সকাল ন’টার সময় বলিলাম, এবার তাহলে বিদায় হই।

গভীর উৎকণ্ঠায় ঘড়ির দিকে তাকাইয়া ডাক্তার বলিল, আর একটু। আধঘন্টা পরে যেও—এখন তো কোনও ট্রেন নেই। চল, ততক্ষণ ঐ ঘরে বসবে।

মনের সেই অস্থিরতা প্রবল হইয়া উঠিতেছিল—ডাক্তারের সাহচর্য ভাল লাগিতেছিল না। তবু ঘরে গিয়া বসিলাম, বলিলাম, ঠিক সাড়ে ন’টার সময় আমি উঠব।

ডাক্তার ‘আচ্ছা’ বলিয়া আমাকে ঘরে বসাইয়া বাহিরে বারান্দায় গিয়া দাঁড়াইল।

ডাক্তার লোক মন্দ নয়। সে আমাকে আপন করিয়া লইতে চায়, কিন্তু আমি আপন হইতে পারিতেছি না। সুনন্দাও কাছে টানিয়াছিল, আমি কাছে যাইতে পারি নাই।

দশ মিনিট; পনের মিনিট কাটিয়া গেল। বাহিরে মোটরের শব্দ শুনা গেল। ভালই হইল, ডাক্তারের মোটরেই স্টেশনে যাইব।

চাপাকণ্ঠের কথাবার্তা কানে আসিতে লাগিল। হঠাৎ একটা উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনধ্বনি অর্ধপথে রুদ্ধ হইয়া গেল। আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। এবার যাইতে হইবে।

দ্বারের দিকে পা বাড়াইয়াছি, একটি স্ত্রীলোক দ্বার ঠেলিয়া প্রবেশ করিল।

তাহার বয়স কুড়ি-একুশ; তন্বী, গৌরাঙ্গী—মুখখানি অতি সুন্দর। কিন্তু চোখের কোণে কালি পড়িয়াছে, রুক্ষ চুলের মাঝখানে খানিকটা অযত্নবিন্যস্ত সিঁদুর। চোখে পাগলের দৃষ্টি।

সে আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; তারপর একটা অর্ধোচ্চারিত—‘ওগো’ বলিয়া ছিন্নমূল লতার মতো আমার পায়ের কাছে পড়িয়া গেল।

আমি সরিয়া দাঁড়াইলাম, বলিলাম, আপনি কে?

সে মুখ তুলিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ওগো, তুমি আমায় চিনতে পারছ না?

স্বরটা মর্মভেদী। কিন্তু আমার প্রাণে কোনও সাড়া জাগিল না, কেবল অন্য কোথাও চলিয়া যাইবার অধীরতা দুর্নিবার হইয়া উঠিল।

বলিলাম, না। আমি এবার যাই।

সে আমার পা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, যেও না,—যেও না, আমি যে তোমার স্ত্রী—তোমার অরুণা—

তাহার হাত ধরিয়া তুলিলাম। স্পর্শটা অত্যন্ত পরিচিত। আমার অস্থিরতা আরও বাড়িয়া গেল, বুকের মধ্যে কেমন যন্ত্রণা হইতে লাগিল। বলিলাম, আপনার কান্না দেখে আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার আর সময় নেই—আমি যাই। বলিয়া তাহার হাত ছাড়াইয়া দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইলাম।

ডাক্তার বাহিরে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া ছিল; তাহাকে বলিলাম, চললুম তবে—বিদায়।

মোটর বারান্দার নীচেই ছিল; তাহাতে উঠিতে যাইব, স্মরণ হইল ডাক্তারকে কিছু দেওয়া হয় নাই।

টাকা বাহির করিবার জন্য মনিব্যাগ খুলিলাম। টাকা ছাড়া আরও দু’একটা জিনিস রহিয়াছে, এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই। একটা খোপের তলদেশে নীল কাগজে মোড়া কি একটা রহিয়াছে। দুই আঙ্গুল দিয়া সেটা বাহির করিলাম। মোড়ক খুলিয়া দেখিলাম—একজোড়া হীরার দুল।

পৃথিবী ও আকাশ, সমস্ত পরিদৃশ্যমান জগৎটাই যেন এতক্ষণ একটু হেলিয়া একটু বাঁকিয়া ছিল, এখন নড়িয়া-চড়িয়া নিজের অভ্যস্ত স্থানে বসিয়া গেল।

চারিদিকে চাহিলাম। পৃথিবীর চেহারা বদলাইয়া গিয়াছে। শকুন্তলার আঙটি দেখিয়া দুষ্মন্তেরও কি এমনি হইয়াছিল?

ফিরিয়া গেলাম।

ডাক্তারকে বলিলাম, নীরু, যাওয়া হল না। মোটর নিয়ে যেতে বল।

নীরোদ আমার কাঁধ চাপিয়া ধরিয়া উদ্দীপ্ত চক্ষে চাহিল, রবি! মনে পড়েছে?

পড়েছে! ছাড়, অরুণার কাছে যাই।

আর সুনন্দা?

‘সুনন্দা’ নামটা যেন কোথায় শুনিয়াছি—স্বপ্নের মতো মনে হইল, বলিলাম, সে আবার কে?

নীরোদ হাসিয়া উঠিল, কেউ না—এখন ঘরে যা।

ঘরে অরুণা মেঝের উপর মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া ছিল।

তাহার শিয়রে দাঁড়াইয়া কম্পিতস্বরে বলিলাম, অরুণা, তোমার হীরের দুল এনেছি—ওঠ।

২২ ভাদ্র ১৩৪২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *