অবসরের দিনলিপি
ভালই আছি।
ভেবেছিলাম খুব ছাড়া ছাড়া, নিঃসঙ্গ হয়ে যাব।
এক সঙ্গে দুটো বড় ব্যাপার ঘটে গেল। আমার মত ঘর-গৃহস্থী মানুষের পক্ষে দুটো বড় মাপের জবরদস্ত জীবন বিদারক ঘটনা।
এক নম্বর হল, চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করলাম। পঁয়ত্রিশ বছরের দশটা-পাঁচটা থেকে অব্যাহতি। অবসরগ্রহণ করলাম কথাটা যদিও সঠিক নয়। কথাটা অবশ্য সম্মানজনক, যেন আমি স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করেছি। কিন্তু সত্যি কথাটা হল বয়েস হয়ে যাওয়াতে অবসর নিতে বাধ্য হলাম।
দুনম্বর ব্যাপারটা হল আরও গুরুতর। পুরনো বাসস্থান ছেড়ে নতুন বাসায় চলে এলাম। সরকারি আবাস ছাড়তেই হত।
তবে এই শেষ বাসাবদল। খুব সম্ভব এর পরে আর বাসা বদলাতে হবে না। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে এই পোড়া শহরে বাক্স-বিছানা ঘাড়ে করে কত জায়গায় যে ছুটলাম। শুরু হয়েছিল সেই সাহেব পাড়ায় নাবালক বয়েসে এসপ্ল্যানেডের গলিতে, তারপর দক্ষিণ দিকে হটতে হটতে বিদায় নিলাম গড়িয়াহাটার কাছ থেকে।
শেষ দিকে নিকট বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যে খুব ঘন ঘন দেখাশোনা হত, আড্ডা হত তা তো নয়। কিন্তু মনে মনে স্বস্তি পেতাম এই ভেবে যে সবাই কাছাকাছি আছে। একটা কেমন নিরাপত্তাবোধ ছিল, এক ডাকে দশ-বিশটা চেনাজানা আপন লোক দৌড়ে আসবে।
তা নয়, এ যে কোথায় চলে এলাম। উড়ো উড়ো, কঁকা ফাঁকা নতুন গড়ে ওঠা এই শহরতলিতে আমি যেন কেমন বেমানান। যেন থাকতে আসিনি, বেড়াতে এসেছি।
তবুও মোটামুটি নতুন বাসায় এসে থিতু হয়ে বসেছি।
বাসা বদলের ঝামেলা অনেক। রেশন কার্ড, গ্যাস, ইলেকট্রিক মিটার, টেলিফোন এমনকী কাজের লোক, মুদির দোকান এই সব এক ধাক্কায় বদলানো সোজা কথা নয়। কত রকম দৌড়-ঝাঁপ, তদ্বির-তদারক। এই বয়েসের পক্ষে যথেষ্টই হ্যাঁপা।
তবু মাসদুয়েকের মধ্যে প্রায় সব কিছুই সড়গড় হয়ে এসেছে। মোটামুটিভাবে বলতে পারি, ভাল আছি, ভালই আছি। এতটা ভাল থাকব, ভাবিনি। একটা নতুন রুটিনে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। তেমন ধরাবাঁধা কিছু ব্যাপার নয়, ঢিলেঢালা একটা জীবন।
কিন্তু সম্পাদকমশায়, এ তো মোটেই গল্প হচ্ছে না। জনৈক অবসরপ্রাপ্ত প্রৌঢ়ের আত্মবিলাপ কিংবা বড় বাবুর পরিণাম নামে এরকম রচনা আপনার পত্রিকায় না হলেও ছোট-মাঝারি কাগজে প্রকাশিত হতে পারে।
কিন্তু সম্পাদকমশায়, আমি তো পাকা গল্প লিখিয়ে। আপনার কাগজেই এ যাবৎ অন্তত পঞ্চাশটা গল্প লিখেছি। এমন কোনও পুজোসংখ্যা আছে যেখানে আমি প্রত্যেক বছর গল্প লিখি না।
কিন্তু সম্পাদকমশায়, আপনি আমার সুহৃদ না হতে পারেন আপনি অবশ্যই আমার শুভানুধ্যায়ী। আপনি কত কিছু নিয়ে ভাবেন। আমাকে নিয়েও একটু ভাবুন। আমার এমন অবস্থা কেন হল? সে কি শুধু চাকরি খতম, বাসা বদল বলে?
সে যা হোক, এবার ধারাবিবরণীতে ফিরে যাই। আগে সকালবেলায় প্রথম কাজ ছিল হাঁটা। ভোরবেলায় উঠে হাতমুখ ধুয়ে হাঁটতে বেরোতাম। যখন যে পাড়ায় থেকেছি, সেই রকম হেঁটেছি। কখনও ফুটপাথ ধরে সকালবেলায় খালি রাস্তায় হেঁটেছি, কখনও বাড়ির কাছের পার্কে বা স্কোয়ারে। দশ-বারো বছর লেকের চারপাশে হেঁটেছি। কাছাকাছি থাকার সুবাদে বছর দশেক ময়দানেও হেঁটেছি।
মর্নিং ওয়াক কিন্তু শুধু ওয়াক নয়। এটা এক ধরনের মর্নিং ক্লাব। বহু লোকের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়, পরিচয় ঘঠে। নানা রকম যোগাযোগ, তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় হয়। একটু হাসি-ঠাট্টাও হয়।
এখানে এসেও, বাসা গুছিয়ে নেওয়ার পরে, দিন পনেরো বাদে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। পুরনো অভ্যাস যাবে কোথায়?
তা ছাড়া এই নতুন অঞ্চলটা হাঁটার পক্ষে অনুপম। রাস্তাঘাট ফাঁকা, মোটামুটি পরিষ্কার। আলো-বাতাস সুপ্রচুর। পরিবেশ দূষণ তুলনামূলকভাবে কম।
প্রথম দিন হাঁটতে বেরিয়েই যাঁদের সঙ্গে দেখা হল তাদের মধ্যে অনেকেই আমার পূর্ব-পরিচিত। তাদের সঙ্গে কখনও দেখা হবে ভাবিনি। কারও কারও সঙ্গে বা অধীনে আমি একসময় কাজ করেছি। তাদের কথা কবে ভুলে গিয়েছিলাম, এমনকী তারা যে এখনও আছেন তা পর্যন্ত কখনও ভাবিনি।
তাঁদের অনেককে এক সঙ্গে দেখে আমি সেই আলো-আঁধারি ভোরবেলায় কেমন বিচলিত হয়েছিলাম, তারাও তেমনই উল্লসিত হয়েছিলেন।
আদিত্যবাবু। এঁর সঙ্গে বছর তিনেক কাজ করেছিলাম, আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, এই তারাপদ, তুমিও তা হলে সল্ট লেকে এসে গেলে? আমি মৌনভাবে ব্যাপারটা স্বীকার করলাম।
আরেক ভদ্রলোক, ঠিক ভদ্রলোক নন একদা সাহেব ছিলেন, আমার চেয়ে তিন ধাপ ওপরে চাকরি করতেন যখন তিনি অবসর নেন বছর কুড়ি আগে, মুখের বাঁধানো দাঁতজোড়া জিব দিয়ে ভাল করে সেট করতে করতে বললেন, আরে মিস্টার রায়, আপনি দেখছি ভয়ংকর মোটা হয়ে গেছেন।
এরকম কথা সাতসকালে শুনতে আমার ভাল লাগে না। বলতে পারতাম, ভয়ংকর মোটা হয়েছি তো বেশ করেছি। তাতে কার কী? আপনার খেয়ে-পরে তো মোটা হইনি। তা না বলে অন্যভাবে বললাম, ভয়ংকর মোটা হইনি। কিছুটা মোটা হয়েছি। ভয়ংকর মোটা হলে কি আর এই পনেরো বছর বাদে চিনতে পারতেন?
আমার এই বোকা রসিকতায় ওঁরা সকলেই আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলেন। ঠিক এই সময়ে আমি চিরকাল যে রকম প্রগলভ আচরণ করেছি তাই করে ফেললাম, মুখ ফসকিয়ে বলে ফেললাম, স্যার আপনাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবিনি।
স্যার বললেন, কেন?
আমি বললাম, আমার কেমন একটা ধারণা ছিল আপনার কেউ নেই। এমনকী কেমন যেন মনে হচ্ছে আপনাদের কারও কারও মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অফিসে শোকসভা করেছি, ঘণ্টা দুয়েক আগে অফিস ছুটি দিয়েছি।
জারুল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নবোদিত সূর্যের রশ্মি রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে, শিশির-ভেজা ঘাসের ওপর শালিকেরা হুটোপুটি করছে, একটু উত্তুরে হাওয়া দিয়েছে, একটু শীত শীত ভাব। সমবেত ভদ্রমণ্ডলী আমার কথা শুনে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। সব নিস্তব্ধ, শুধু দূরে একটা ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে। একটু পরে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, অন্য এক স্যার বললেন, বুড়ো হয়ে তোমার একটুও লাভ হয়নি। তুমি সেই একই রকম ফাজিল রয়ে গেলে।
আমি রণে ভঙ্গ দিলাম। বাড়ি ফেরার পথে ভাবতে লাগলাম, বুড়ো হয়ে সত্যি কী লাভ হল। এবং ওঁরা সবাই সত্যি জীবিত কি না।
ফল হল, আমি প্রাতঃভ্রমণ করা ছেড়ে দিলাম। আরও দু-চারদিন যে চেষ্টা করিনি তা নয়। কিন্তু পরিণতি একই হয়েছে। যারা নেই বলে জানি, তাদের সঙ্গেই ক্রমাগতু দেখা।
কিন্তু আমি তো অসামাজিক জীব নই। চিরকাল সকলের সঙ্গে মেলামেশা করে চলতে ভালবাসি। সুতরাং নতুন পরিচয় হতে লাগল।
চিরঞ্জীববাবুর সঙ্গে পরিচয় হল। তাঁর কাছে আমি একটা নতুন হিসেব পেলাম। জীবনের এ হিসেবটা এর আগে ভাবিনি।
চিরঞ্জীববাবু থুরথুরে বুড়ো। বাইশ বছরের পেনশনার। চাকরিতে ঢুকেছিলেন অভঙ্গ বঙ্গের মুসলিম লিগ আমলে, ইংরেজের যুগে। পুলিশের দারোগা হয়ে ঢুকে ছোট সাহেব হয়ে বিদায় নিয়েছিলেন।
সাধারণত পুলিশের লোকেরা রিটায়ার করার পরে কখনও বলতে চান না পুলিশের চাকরি করতেন, বড় জোর বলেন, সরকারি কাজ করতাম। সেই জন্যে বাড়ির নেমপ্লেটে অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার থেকে মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন সার্জন, কৃষি বিভাগের উপ অধিকর্তা লেখা থাকে কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত আই পি এস বা পুলিশের ডেপুটি সুপার কিংবা দারোগা–এসব দেখতে পাওয়া যায় না।
চিরঞ্জীববাবু অবশ্য উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি নিজে যেচে এসে আলাপ করেছিলেন। একদিন কথাপ্রসঙ্গে তার প্রতিবেশিনী এক দুশ্চরিত্রা মহিলার উল্লেখ করে নিজের অক্ষমতার কথা বলে জানলেন, চাকরির প্রথম জীবনে বড়তলা থানার দারোগা ছিলাম, প্রচুর বেশ্যা পিটিয়েছি।
তাঁর কথা শুনে আমি আঁতকিয়ে উঠলাম, বললাম, নতুন যুগ। ভেবেচিন্তে ভালভাবে কথা বলুম। বলুন, প্রচুর যৌনকর্মীকে নিপীড়ন করেছি।
চিরঞ্জীববাবু মাথা নেড়ে বললেন, না মশায়। পুলিশে কাজ করলে কী হবে আমার স্বভাবচরিত্র খারাপ ছিল না। নিপীড়ন-টিপীড়ন নয়, কর্ম-কর্ম করিনি, স্রেফ পিটিয়েছি।
এই চিরঞ্জীববাবুই আমাকে বুঝিয়েছিলেন, আমি দুগ্ধপোষ্য, নাবালক। নিতান্তই জুনিয়র, এক বছরও হয়নি রিটায়ার করেছি। রিটায়ারদের মধ্যে পর্যন্ত সিনিয়ারিটি আছে। কী চাকরি ছিল, কত বড় চাকরি তা নয়। কতদিন হল রিটায়ারের পর সেটাই একমাত্র বিবেচ্য। এর পরে প্রমোশন পরলোকে। তবে যমরাজা এই সিনিয়রিটি খুব একটা মর্যাদা দেন বলে মনে হয় না।
আমি বললাম, যমরাজের কাছে এ বিষয়ে একটা ডেপুটেশন দিলে হয় না। তিনি আমার এই প্রস্তাবে খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না।
চিরঞ্জীববাবুর সঙ্গেই একদিন এসেছিলেন বনবিহারীবাবু। সার্থক নাম রেখেছিলেন তাঁর গুরুজনেরা। তিনি বনদপ্তরে দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর কাজ করেছিলেন।
বনবিহারীবাবু চিরঞ্জীববাবুর থেকে বছর পাঁচেকের জুনিয়র। তিনি কেমন থপথপ করে হাঁটেন। এমনিতে শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভাল। লাঠি ব্যবহার করেন না, আজকাল কেই বা করে। কিন্তু বনবিহারী যখন হেঁটে আসেন, দূর থেকে মনে হয় তিন পায়ে হেঁটে আসছেন। তার একটা বড় কারণ অবশ্য তার আভূমিলম্বিত দীর্ঘ কোঁচা। তিনি এখনও সামান্য সংখ্যক ধুতিপরিয়েদের দলে।
বনবিহারীবাবুর প্রধান গুণ কৌতূহল এবং অনুসন্ধিৎসা। এই বয়েসেও সব বিষয়ে, বিশেষ করে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় যেসব মোটা খবর বেরোয়, সেই সব নিয়ে তাঁর নানা প্রশ্ন।
সম্প্রতি গণেশ ঠাকুরের দুধ পানের সময় এবং এর পিঠোপিঠি পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় বনবিহারীবাবু আমাকে খুব অত্যাচার করেছেন। দুগ্ধ পানের মহাদিনের পরের দিন সকালে বনবিহারীবাবু এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি তো কিছুদিন এলগিন রোডে ছিলেন?
আমি বললাম, ঠিক এলগিন রোডে নয়, কাছেই গোখেল রোডে বছর দেড়েক ছিলাম এক সময়ে।
বনবিহারীবাবু প্রশ্ন করলেন, আপনি কি শুনেছেন ওই গোখেল রোডের মোড়ের লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরের গণেশ ঠাকুর ফার্স্ট হয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, ফার্স্ট হয়েছে? মানে?
বনবিহারীবাবু বললেন, লোকেরা বলছে ওই গণেশটাই সবচেয়ে বেশি দুধ খেয়েছে। ডানকুনি থেকে মাদার ডেয়ারি স্পেশ্যাল এক গাড়ি দুধ পাঠিয়েছিল।
আমি বললাম, তা কী করে হয়?
কিন্তু সূর্যগ্রহণের সময় এত সহজে পরিত্রাণ পাইনি। গ্রহণের আগের দিন এসে বললেন, জানেন গ্রহণের সময় ভেড়ারা ঘাস খায় না। কাগজে বেরিয়েছে।
আমি জানতাম না, চুপ করে রইলাম। কিন্তু বনবিহারীবাবু চুপ করে থাকার লোক নন। কিছুক্ষণ ধরে বার বার বলে যেতে লাগলেন, ভেড়ারা পর্যন্ত গ্রহণ চলাকালীন ঘাস মুখে দেয় না, আমাদের কি কিছু খাওয়া উচিত?
বনবিহারীবাবুর অবশ্য একটা গুণ অস্বীকার করা অনুচিত। তিনি শুধু প্রশ্নই করেন উত্তর আশা করেন না। আমি একটি কথা না বললেও চলে যাওয়ার সময়ে বলে যান, আপনার সঙ্গে আলোচনা করে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আপনার সঙ্গে কথা বলেও সুখ।
আমি বুঝতে পারছিলাম, এ সুখ আমার বেশিদিন সইবে না।
এ দিকে চিরঞ্জীববাবু বনবিহারীবাবুকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছেন। আজকাল কালেভদ্রে আসেন। সেও বনবিহারীবাবুকে দেখলে কোনও অজুহাতে কেটে পড়েন।
সে দিন হঠাৎ দুজনে আবার এক সঙ্গে এলেন। দেখলাম দুজনেই বেশ উত্তেজিত, বিষয় যুবরানি ডায়ানা। আমার ঘরে ঢুকেই চিরঞ্জীববাবু বললেন, তার যৌবন বয়সে ওই মহিলাকে বড়তলা থানা এলাকায় পেলে তিনি পিটিয়ে তক্তা করে দিতেন। বিপথগামিনী রমণীদের ওপর তার খুব রাগ; তদুপরি তিনি ইংরেজ আমলের রাজভক্ত পুলিশ, রাজ পরিবারের অবমাননা তিনি দেখতে পারেন না।
দুই বৃদ্ধের মধ্যে খটাখটি শুরু হয়ে গেল। চিরঞ্জীববাবু রাজপুত্রের পক্ষে আর বনবিহারীবাবু রাজবধূর পক্ষে। উৎকট চেঁচামেচি, প্রায় হাতাহাতি। বাড়িটা যে আমার, আমি যে ঘরের মধ্যে জলজ্যান্ত একজন তৃতীয় ব্যক্তি বসে আছি, সেটা কারও হুশ হল না। সুদূর ব্রিটেনের রাজ পরিবারের ঘরোয়া কলহে আমার বৈঠকখানা ঘর গমগম করতে লাগল।
ঘণ্টা খানেক পরে রাগে গরগর করতে করতে, আমার টেবিলের ওপরে রাখা শ্ৰীযুক্তেশ্বরী ডায়ানার আবক্ষ চিত্র-সম্বলিত সেদিনের দৈনিক পত্রিকাটি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে চিরঞ্জীববাবু নিষ্ক্রান্ত হলেন।
এর পরে আরও আধ ঘণ্টা বনবিহারীবাবু কোনও কথা না বলে মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। শুধু যাওয়ার আগে একবার ক্ষীণ প্রশ্ন করলেন, ডায়না কি দোষী? তিনি কি কুলটা?আমি কিছু বললাম না। কী বলব?
যাওয়ার সময়ে বনবিহারীবাবু বলে গেলেন, দেখুন আপনি সমস্ত বিষয়ে এত খবর রাখেন, আপনার সঙ্গে আলোচনা করে এত উপকার হয়, আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।
আমি কী আলোচনা করলাম, কখন করলাম, কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আবার জীবনে উত্তেজনা ফিরে আসছে।
সকালে হাঁটা আবার শুরু করেছি। টগবগ করতে করতে বাড়ি ফিরে আসি। ফিরে এসে কিংবা পরে দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায় কখনও বনবিহারীবাবু, কখনও চিরঞ্জীববাবু, কখনও বা দুজনেই একসঙ্গে আসেন। আমি কিছু বলি বা না বলি, যাওয়ার সময়ে আমার সুচিন্তিত মতামতের জন্যে তারা ধন্যবাদ জানাতে ভোলেন না।