1 of 2

অপরাজিতা – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

অপরাজিতা – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

মেয়েটি প্রায়ই আসে আমার বাড়িতে।

সবাই বলে সে খুব সুন্দরী।

কিন্তু সুন্দরী কাকে বলে, আমি ঠিক বুঝি না।

গায়ের রং ফর্সা হলেই তাকে সুন্দরী বলে না।

এমন মেয়েও আমি দেখেছি যার গায়ের রং ফর্সা। কিন্তু একবার তাকালে তাকে দেখা শেষ হয়ে যায়—দ্বিতীয়বার আর তাকাতে ইচ্ছা করে না।

কিন্তু সেই মেয়েকেই বোধহয় সুন্দরী বলে—যাকে বারংবার দেখেও দেখার সাধ মেটে না।

এ তো গেল বাইরের রূপ।

সেরকম রূপের অভাব ছিল না মেয়েটির।

কিন্তু মেয়েদের আর একটি রূপ আছে। সেটি তার অন্তরের রূপ। সে রূপ চোখে দেখা যায় না। কথা বললেই ধরা পড়ে।

অথচ কথা সে সহজে বলতে চায় না। চোখে চোখ পড়লেই টানা-টানা কাজলকালো চোখদুটি সে নামিয়ে নেয়।

মনে হয় যেন কী এক গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে সে দুটি চোখে।

বললাম, চুপ করে রয়েছে কেন, কথা বলো…।

চোখ দু’টি আবার সে তুললে। এবার তার চোখ ভরা জল। মনে হল বলতে তার কষ্ট হচ্ছে। তবু বললে—

—আপনার জানা কোনও ভাল জ্যোতিষী আছে?

ভেবে বললাম, —আছে একজন। তাকে খবর দিতে পারি।

চুপ করে রইল সে।

জিজ্ঞাসা করলাম, —কোথায় থাকো তুমি?

—শ্যামবাজারে।

—সঙ্গে আর কে আছেন?

মুখ নামিয়ে বললে, —সঙ্গে আর কে থাকতে পারে বলুন তো?

আমি বললাম, নিশ্চয়ই তোমার স্বামী।

—ঠিকই বলেছেন।

জিজ্ঞাসা করলাম, কত দিন বিয়ে হয়েছে?

মেয়েটি বলল, চার বছর হল।

—স্বামী কি করেন?

—কলেজে অধ্যাপনা করেন।

জিজ্ঞাসা করতে সংকোচ বোধ করছিলাম তবু জিজ্ঞাসা করলাম, সন্তানাদি হয়নি?

মাথা নিচু করে মেয়েটি জবাব দিলে, —না, এখনও হয়নি।

একটু ভেবে বললাম, —সেই জন্যই কি জ্যোতিষীর সন্ধান করেছিলে?

সলজ্জা ভঙ্গিতে মেয়েটি উত্তর দিল, —আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কোনও ওষুধপত্র খেয়েছিলে?

—কত বড় বড় ডাক্তারের কাছে গেলাম, কত ওষুধই তো খেলাম কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। জিজ্ঞাসা করলাম, —আগে কোনও জ্যোতিষীকে হাত দেখিয়েছ?

—না, তবে ছেলেপুলে হয়নি বলে আমার কাছ থেকে অনেক লোক টাকা ঠকিয়ে নিয়েছে।

—কিরকমভাবে ঠকালে আমাকে বলবে?

মেয়েটি হাসল। বললে, সে এক ভারি মজার ঘটনা। শুনবেন আপনি।

—বলো, শুনতেই তো চাচ্ছি।

মেয়েটি বললে, আগে যারা এসেছিল তাদের কথা আর বলব না। এবার যিনি এলেন তিনি আমার পরিচিত। রীতিমতো শিক্ষিত। মস্ত বড় ছাপাখানার মালিক। সব-কিছু শুনে তিনি বললেন, কাল আমি একজনকে নিয়ে আসব। দেখি তিনি কিছু করতে পারেন কিনা। তান্ত্রিক সাধু, কিন্তু দেখলে চেনা যায় না। বয়স খুব কম।

পরের দিন তিনি একাই এলেন। বললেন, তাঁকে আনতে পারলাম না। অনেক লোকের ভিড়। তাঁর সঙ্গে কথাই বলা যায় না। আপনাকেই তাঁর আশ্রমে যেতে হবে। আমি নিয়ে যাব। কাল ঠিক দশটার সময় তৈরি হয়ে থাকবেন।

দশটার সময় বিজনবাবু এলেন গাড়ি নিয়ে। তাঁরই সঙ্গে গেলাম। কলকাতা থেকে মাইল পাঁচ-ছয় দূরে ছোট্ট একখানি গ্রাম। সেই গ্রামের ভেতর আঁকা বাঁকা পথে যেতে যেতে গাড়িটা যেখানে গিয়ে থামল, দেখলাম গাছপালায় ঢাকা ছোট্ট একটি নাটমন্দির। সেখানে বিস্তর অচেনা লোক চাপাচাপি করে বসে আছে।

মাটির তৈরি খুব বড় একটি মনসার মূর্তি। সেই মূর্তির সামনে পিছন ফিরে বিড় বিড় করে আপনমনেই কি যেন বলছেন পুরোহিতের মতো একটা লোক। গলায় একটি ফুলের মালা। প্রিয়দর্শন যুবক বললেই ভাল হয়।

এক-একজনের নাম ধরে ডাকছেন আর সেই ভিড়ের মাঝখান থেকে সে এগিয়ে যাচ্ছে তাঁর কাছে। কি যে তাদের কথা হচ্ছে কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

শেষে আমার নাম ধরে ডাকতেই আমি চমকে উঠলাম। আমার নাম তিনি জানলেন কি করে?

তা তিনি যেমন করেই জানুন, এগিয়ে গেলাম। তার পাশে গিয়ে বসতেই তিনি বললেন, কি চাই তোর?

লজ্জায় আমার মুখ দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছিল না। তখন তিনি নিজেই বললেন, বুঝেছি, ছেলে চাই।

এই বলে তিনি চোখ বুজলেন। চোখ বুজে আবার সেই বিড় বিড় করে কথা। মিনিটখানেক পরে চোখ খুলে তাকিয়েই বললেন, ছেলে পাবি। কিন্তু তার জন্যে আমায় গজমতি ভাস্কররাজ এনে দিতে হবে।

বললাম, আমি তো কখনও ওর নামও শুনিনি। গজমতি ভাস্কররাজ কোথায় পাব বাবা?

তিনি বললেন, সোনার দোকানে খুঁজবি।

কলকাতা শহরে সোনার দোকান আর বাকি রাখলাম না খুঁজতে। কিন্তু এই অদ্ভুত নাম শুনে সবাই হাসতে লাগল।

শনিবার আর মঙ্গলবার তাঁর ‘ভর’ হয়। সপ্তাহের মধ্যে এই দু’ দিন তাঁর দেখা পাওয়া যায়।

শনিবার গিয়ে দেখি তেমনি লোকজনের ভিড়। তিনিও তেমনি বসে আছেন। গিয়ে বললাম, ‘গজমতি ভাস্কররাজ’ কোথাও পেলাম না বাবা।

তিনি বললেন, পাঁচশো এক টাকা দাম। দিতে যদি পারিস তো টাকা আনবি আমি দেব।

হাতে টাকা ছিল না, কিন্তু তখন আমার এমন বিশ্বাস হয়ে গেছে যে গলার সোনার হারটা বিক্রি করে পাঁচশো এক টাকা নিয়ে গিয়ে তাঁর হাতে দিলাম। তার বদলে একটি সোনার ছোট মাদুলি তিনি আমার হাতে দিয়ে বললেন, রবিবার সকালে স্নান করে বাঁহাতে নাহয় গলায় এটি ধারণ করবি। তাহলেই একমাসের ভেতর মনস্কামনা পূর্ণ হবে।

মেয়েটি হেসে তার হাতের মাদুলিটি আমাকে দেখালে। বললে, সাত মাস হয়ে গেল। কিছুই হয়নি। টাকাটা আমার গেল।

তারপর প্রায় বছর দেড়েক তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।

আমি চলে গিয়েছিলাম হিমাচল প্রদেশে।

ফিরে যখন এলাম, একদিন বাইরের ঘরে বসে আছি, দেখি না একটা মেয়ে আর একজন পুরুষ এসে দাঁড়াল। মেয়েটি হাসছে। তার কোলে সুন্দর একটি ফুটফুটে ছেলে।

বললাম, বসুন

—আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? বসুন বললেন যে!

তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাঃ, কিছুতেই চিনতে পারছি না।

মেয়েটি বললে, আমি অপরাজিতা।

বলেই সে হেঁট হয়ে আমাকে প্রণাম করলে। ছেলেটিকেও প্রণাম করালে।

তার স্বামীও প্রণাম করার জন্যে হাত বাড়িয়েছিল, আমি নিষেধ করলাম।

অপরাজিতা বললে, এখন চিনতে পেরেছেন?

বললাম, হ্যাঁ। আমি তোমাকে ওষুধ দিয়েছিলাম না?

—সেই কথাই বলতে এসেছি। ছেলেকেও প্রণাম করাবার জন্যে নিয়ে এলাম।

বলেই সে একটি কাগজ বের করে বললে, আর একটি অনুরোধ আছে। এই কাগজে ওষুধের নামটি লিখে দিন। আমার এক ননদ কান্নাকাটি করে চিঠি লিখেছে। তাকে সেই কাগজটি পাঠিয়ে দেব। ছেলে না হওয়ার জন্যে তার সংসারে যে অশান্তি হচ্ছে তা যদি আপনি জানতেন—

লিখে দিলাম, হোমিওপ্যাথির এই অসাধারণ ওষুধটির নাম।

ঋতু শেষে কলিফস এবং সিপিয়া ২০০ পালটাপালটিভাবে তিন দিন অন্তর ৩ মাস খেয়ে দেখবে।

খবর পেয়েছিলাম ওষুধ খেয়ে তার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছিল।

২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *