চরিত্র

চরিত্র

যাঁহারা গল্প উপন্যাস লেখেন, চরিত্র সম্বন্ধে তাঁহাদের সর্বদাই সতর্ক থাকিতে হয়। তাঁহাদের নিজেদের চরিত্রের কথা বলিতেছি না, সে বিষয়ে তাঁহারা নিরঙ্কুশ, নেশা ভাঙ পঞ্চমকার সব কিছুই চলিতে পারে। কিন্তু তাঁহারা যে চরিত্র সৃষ্টি করিবেন সেগুলির সঙ্গতি থাকা দরকার, আত্মবিরোধী হইলে চলিবে না। যেমন ধরা যাক, চরিত্রহীন উপন্যাসে উপীনের চরিত্র। উপীন যদি সতীশের পকেট মারিত কিংবা কিরণময়ীর সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হইয়া পড়িত, তাহা হইলে সব মাটি হইয়া যাইত। সমালোচকেরা ভ্রূকুটি করিয়া বলিতেন, উপীনের চরিত্র অস্বাভাবিক। পাঠক সমাজ নাসিকা কুঞ্চিত করিতেন। শরৎচন্দ্র সাহিত্য সম্রাট হইতে পারিতেন না।

তাই ভাবিতেছি আমার বাল্যবন্ধু ভবেশের চরিত্রটা সত্যের প্রতি নিষ্ঠা রাখিয়া প্রকাশ করিলে সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হয় কি না। বোধহয় হয় না। কিন্তু না হোক, সত্য কথা বলিতে দোষ কি? সাহিত্য না হয় না-ই হইল। আমরা যাহা লিখি সবই কি সাহিত্য হয়?

আমি ও ভবেশ স্কুলের এক ক্লাসে পড়িতাম। ছোট শহরের হাই স্কুল, অনেক রকম ছাত্র তাহাতে পড়িত। উঁচু ক্লাসে এমন দুই চারিজন ছাত্র ছিল যাহারা গোঁফ কামাইয়া স্কুলে আসিত, বছরের পর বছর একই ক্লাসে মৌরসীপাট্টা লইয়া বসিয়া থাকিত। মাস্টারেরা তাহাদের সমীহ করিয়া চলিতেন। কিন্তু সে যাক।

ভবেশের চেহারা ছিল হাড়-চওড়া পেশীপ্রধান মজবুত গোছের। মুখের আকৃতি গোল কিন্তু মাংসল নয়; ভ্রূ যুগল বয়সের অনুপাতে রোমশ। ভ্রূর নীচে চোখের দৃষ্টি প্রখর, চোয়ালের হাড় চিবুকের কাছে আসিয়া চৌকশ হইয়া গিয়াছে।

আমার সহিত ভবেশের বেশী বন্ধুত্বের কারণ বোধ হয় এই যে, আমরা দু’জনেই স্কুলের ফুটবল টীমে খেলিতাম। তাছাড়া আর একটা মিল ছিল, দু’জনের স্কুল হইতে বাড়ি ফিরিবার পথ ছিল অনেকখানি একই দিকে। গল্প করিতে করিতে দু’জনে স্কুল হইতে ফিরিতাম, তাহার পর সে একটা মোড় ঘুরিয়া নিজের বাড়ির দিকে চলিয়া যাইত, আমি সোজা রাস্তা দিয়া আরও কিছু দূর গিয়া নিজের বাড়িতে পৌঁছিতাম। চৌদ্দ-পনের বছর বয়সে বন্ধুত্ব গাঢ় হইতে ইহার অধিক প্রয়োজন হয় না।

ভবেশের প্রকৃতির মধ্যে একটা প্রচণ্ডতা ছিল। সে যে স্বভাবতই রাগী ছিল তা নয়, কিন্তু একবার রাগিলে তাহার মুখ ফুটিবার আগেই হাত ছুটিত। মৌখিক ঝগড়া সে করিত না, সে করিত মারামারি। কিন্তু এ কথাও স্বীকার করিতে হয় যে, অন্যায়ভাবে সে কাহাকেও ঠেঙাইত না। তাহার মনে একটা কঠিন ন্যায়নিষ্ঠা ছিল, তাহাতে আঘাত লাগিলে সে আর ধৈর্য রাখিতে পারিত না, মারামারি বাধাইয়া দিত।

এই যুদ্ধ প্রবণতার জন্য শহরে তাহার অখ্যাতির অন্ত ছিল না। কিন্তু সেই অখ্যাতির সঙ্গে খানিকটা অনিচ্ছাদত্ত খাতিরও ছিল। ব্যাদড়া ছেলেরা তাহাকে ভয় করিত, আবার ভাল ছেলেরাও তাহার সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে মিশিতে পারিত না। তাই বোধহয় আমি ছাড়া তাহার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কেহ ছিল না।

একদিনের ঘটনা বলিতেছি, তাহা হইতে ভবেশের তৎকালিক কিছু পরিচয় পাওয়া যাইবে। স্কুলে টিফিনের ছুটি হইয়াছে, ভবেশ আমাকে আড়ালে লইয়া বলিল—‘আজ জগন্নাথকে ঠুকব।’

জগন্নাথ লম্বা সিড়িঙ্গে গোছের একটা ছেলে, বয়স কুড়ি-বাইশ, ক্রমাগত টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করিয়া পরিপক্ক হইয়াছিল। সে মাস্টারদের নল্‌চে আড়াল দিয়া স্কুলের প্রাঙ্গণেই সিগারেট টানিত এবং সমবয়স্ক কয়েকটা ছেলের সঙ্গে দল পাকাইয়া চাপা গলায় অশ্লীল গান গাহিত। কিন্তু সে আমাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখিত না, তাহাকে ঠুকিবার কী প্রয়োজন বুঝিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম—‘জগন্নাথকে ঠুকবি কেন?’

ভবেশের মুখ লাল হইয়াই ছিল, এখন তাহার গ্রীবা যেন ফুলিয়া স্থূল হইয়া উঠিল। সে বলিল—‘বেটা মেয়ে-স্কুলের ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, মেয়েরা যখন ছুটির পর স্কুল থেকে বেরোয় তখন তাদের পানে তাকিয়ে হাসে, শিস্‌ দেয়—’

প্রশ্ন করিলাম—‘তুই জানলি কি করে?’

ভবেশ বলিল—‘আমাদের পাশের বাড়ির একটি মেয়ে স্কুলে পড়ে, সে তার দিদিকে বলেছে, তার দিদি আমার দিদিকে বলেছে।’

যে সময়ের কথা সে-সময়ে মেয়েদের স্কুলে পড়া এমন সার্বজনিক হয় নাই, যাঁহারা স্কুলে মেয়ে পাঠাইতেন তাঁহারাও মেয়ের নৈতিক নিরাপত্তা সম্বন্ধে সর্বদা সশঙ্ক থাকিতেন। এরূপ ব্যাপার ঘটিতেছে জানিতে পারিলে অনেকেই বদনামের ভয়ে মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করিবেন। ইহার একটা বিহিত হওয়া দরকার। তবু দাঙ্গা-হাঙ্গামা না করিয়া যদি উপায় হয় এই উদ্দেশ্যে বলিলাম—‘তা ঠোকবার দরকার কি! আমাদের হেডমাস্টারের কানে তুলে দিলেই তো হয়—।’

কিন্তু অত বাঁকাচোরা পথে চলিতে ভবেশ অভ্যস্ত নয়, সে মাথা ঝাঁকাইয়া বলিল—‘না, ঠুকবো ব্যাটাকে। আজ ক্লাসের ছুটি হলেই যাব, যদি দেখি মেয়ে-স্কুলের ধারে কাছে আছে তাহলে ওরই একদিন কি আমারই একদিন।’

ভবেশ আমাকে মারামারিতে যোগ দিতে ডাকে নাই, আমি নিজেই বন্ধুত্বের খাতিরে গিয়াছিলাম। জগন্নাথ ভবেশের চেয়ে বয়সে অনেক বড়, গায়েও জোর বেশী, কিন্তু ভবেশ সেদিন তাহাকে দুর্দম ঠেঙাইয়াছিল, আমিও দুই চারিটা পদাঘাত মুষ্ট্যাঘাত যে করি নাই এমন নয়। জগন্নাথ মার খাইয়া পলায়ন করিয়াছিল এবং আর কখনও স্কুলের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে নাই।

তাহার পর ভবেশ যতদিন স্কুলে ছিল ততদিন আরও অনেক মারামারি করিয়াছিল। কিন্তু সে সব কাহিনী লিপিবদ্ধ করিবার প্রয়োজন নাই, তাহার চরিত্রের গতি ও প্রবৃত্তি নির্দেশ করাই আমার উদ্দেশ্য। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাহার চরিত্র পরিপুষ্ট হইয়া কিরূপ আকার ধারণ করিবে তাহা অনুধাবন করা মনস্তত্ত্বনিপুণ ব্যক্তির পক্ষে কঠিন নয়। উঠন্তি মুলো পত্তনেই চেনা যায়।

ম্যাট্রিক পাস করার পর আমাদের ছাড়াছাড়ি হইল; ভবেশ কলিকাতায় পড়িতে গেল, আমি মফঃস্বলের এক কলেজে ভর্তি হইলাম। ছুটিছাটায় দেখা হইত, কলিকাতায় গিয়া তাহার মনে নারীর মর্যাদা এবং মারামারির উপকারিতা সম্বন্ধে কোনও ভাবান্তর হয় নাই। তারপর যখন আই. এ. পাস করিলাম তখন তাহার সহিত দেখা-সাক্ষাতের সূত্র একেবারে ছিন্ন হইয়া গেল। তাহার বাবা বদলি হইয়া অন্য জেলায় গেলেন।

প্রথম কিছুদিন চিঠিপত্র লেখালেখি চলিল, তাহার পর তাহাও বন্ধ হইয়া গেল। বি.এ. পরীক্ষার পর কাগজে দেখিলাম ভবেশ পাস করিয়াছে। অভিনন্দন জানাইয়া চিঠি লিখিব লিখিব করিয়া আর লেখা হইল না।

কয়েক মাস পরে ছাপা চিঠি আসিল—ভবেশের বিবাহ। চিঠির এক কোণে ভবেশ পেন্সিল দিয়া লিখিয়া দিয়াছে—নিশ্চয়ই আসিস।

আমার তখন বিলাতে যাইবার একটা সম্ভাবনা দানা বাঁধিতেছে। তাহার তদ্বির করিবার জন্য কলিকাতায় যাওয়া প্রয়োজন। এক ঢিলে দুই পাখি মারিলাম, ভবেশের বিবাহে যোগ দিলাম।

ভবেশ আমাকে দেখিয়া খুশি, আমি ভবেশের বৌ দেখিয়া খুশি। খাসা বৌ হইয়াছে, হাস্যমুখী স্বাস্থ্যবতী মেধাবিনী। ভবেশ চুপিচুপি জানাইল দুই পক্ষেই পূর্বরাগ হইয়াছিল। স্ত্রীজাতির সহিত তাহার গাঢ়ভাবে মেলামেশা এই প্রথম, দেখিলাম ভিতরে ভিতরে সে নার্ভাস হইয়া পড়িয়াছে।

যাহোক, ভবেশের ভয়ভঙ্গুর দাম্পত্য-জীবন আরম্ভ হইল, আমি বিলাত যাত্রা করিলাম।

তিন বছর পরে চাকরি লইয়া দেশে ফিরিলাম।

কলিকাতার কাছেই আমার আস্তানা পড়িয়াছে। প্রথম চাকরি-জীবনের উদ্যোগ উপক্রমের পালা শেষ করিয়া একদিন ভবেশের সঙ্গে দেখা করিতে গেলাম।

তাহার চেহারা খারাপ হইয়া গিয়াছে। শরীরের একপ্রকার পরিণতি আছে যাহার সহিত অকালপক্ক ফলের তুলনা করা চলে, ভবেশের দেহটা যেন ইঁচড়ে পাকিয়া গিয়াছে। বলিলাম—‘কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ নাকি?’

সে হাসিল। হাসিটা কিন্তু তাহার স্বাভাবিক হাসির মতো নয়, তাহাতে একটা বক্রতা রহিয়াছে। বলিল—‘শরীর ঠিক আছে। তোর খবর কি বল।’

তাহার বাবা বছর দুই আগে মারা গিয়াছেন, এখন সে অনেক টাকার মালিক। পাঁচ রকম কথাবার্তার মধ্যে এক সময় বলিল—‘তুই শুনিসনি বোধহয়, আমার বৌ মারা গেছে।’

অবাক হইয়া তাহার পানে চাহিয়া রহিলাম, দেখিলাম তাহার মুখে বেদনা বা শোকের চিহ্নমাত্র নেই। জিজ্ঞাসা করিলাম—‘কি হয়েছিল?’

‘হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেল।’

‘কদ্দিন হল?’

‘বছরখানেক।—এখন আমি স্বাধীন।’ বলিয়া দুই বাহু দুইদিকে প্রসারিত করিয়া আড়মোড়া ভাঙিল।

‘ছেলেপুলে?’

‘ছেলেপুলে হয়নি। অর্থাৎ হতে দিইনি।’

শুধু চেহারা নয়, তাহার মনের উপরও ভাঁটা পড়িয়া গিয়াছে। তাহার কথায় বার্তায় ভাবে ভঙ্গিতে এই সত্যটাই স্পষ্ট হইয়া উঠিল যে, সে ভদ্রলোক ছিল, এখন একেবারে চোয়াড় হইয়া গিয়াছে। কিন্তু ভবেশ—সেই ভবেশ কি করিয়া এমন হইয়া গেল।

সন্ধ্যার পর সে বলিল—‘আমার বাড়িতে ভাল খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বেশীর ভাগ হোটেলেই খাই। চল, আজ তোকে হোটেলে খাওয়াব।’

বলিলাম—‘চল।’

‘একটু বস্‌, আমি কাপড়-চোপড় বদলে আসি।’

মিনিট কয়েক পরে সে বিলাতি পোশাক পরিয়া আসিল। মোটরে চড়িয়া দু’জনে বাহির হইলাম। উচ্চ শ্রেণীর এক সাহেবী হোটেলে গিয়া ভবেশ ডিনার ফরমাশ করিল। প্রথমে কক্‌টেল আসিল। ভবেশ এক চুমুকে নিজের পাত্র নিঃশেষ করিয়া আবার কক্‌টেল হুকুম দিল। আমি নিজের পাত্রটি হাতে লইয়া অবাক হইয়া দেখিতে লাগিলাম। যাহারা মদ খায় তাহাদের প্রতি ভবেশের মনে তীব্র ঘৃণা ছিল। সেই ভবেশ।

আমাদের অদূরে একটি টেবিলে এক বঙ্গ-তরুণী আহারে বসিয়াছিলেন। আমি স্ত্রী-স্বাধীনতা বা আধুনিকতার নিন্দা করিতেছি না, কিন্তু এই তরুণীর বেশ-বাস এতই সংক্ষিপ্ত যে আমার মত বিলাত ফেরতের চক্ষুও লজ্জায় নত হইয়া পড়ে। ভবেশ তাঁহার দিকে নির্লজ্জভাবে চাহিয়া রহিল, যেন চক্ষু দিয়া তাঁহার কমনীয় দেহটি গিলিতে লাগিল, অতিবড় চাষাও বোধকরি ওভাবে স্ত্রীলোকের পানে তাকায় না। তাহার এই অসভ্যতা কিছুক্ষণ নীরবে সহ্য করিয়া হ্রস্বকণ্ঠে বলিলাম—‘এই ভবেশ, ও কি হচ্ছে!’

ভবেশ আমার দিকে ক্ষণেকের জন্য চোখ ফিরাইয়া বক্ৰমুখে হাসিল, বলিল—‘কি আর হবে, যা সবাই করে তাই করছি। তুই যে ভারি সাধুগিরি ফলাচ্ছিস। বলতে চাস কি? বিলেতে গিয়ে ফুর্তি করিসনি?’

‘না করিনি। কিন্তু তোর হল কি ভবেশ। তোর মন তো এমন নোংরা ছিল না।’

‘নে নে, আর ন্যাকামি করিসনি। সব মিঞাকে আমি চিনি, সবাই ডুবে ডুবে জল খায়।’

ভাগ্যক্রমে এই সময় ডিনার আসিয়া পড়িল। কোনও মতে আহার শেষ করিয়া বলিলাম—‘এবার আমি উঠব। বাসায় ফিরতে রাত হবে।’

ভবেশ বলিল—‘আরে এখনি কি! এই তো সবে কলির সন্ধ্যে।—কি খাবি বল্‌—পোর্ট না শেরি?’

‘কিছু খাব না ভাই, আমি এবার বাড়ি যাব।’

‘ভয় নেই, আমি তোকে মোটরে পৌঁছে দেব।—এক পেগ্‌ টানবি না? For old times sake?—বেশ, তবে চল।’

অনিচ্ছাভরে ভবেশ উঠিল, হ্রস্ববাস তরুণীর প্রতি নির্লজ্জ লোলুপ কটাক্ষপাত করিয়া বাহিরে আসিল।

মোটরে কিছুক্ষণ চলিবার পর মনে হইল সে অন্য দিকে চলিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম—‘কোথায় নিয়ে চললি?’

‘রেড রোডের দিকে। ডিনারের পর কিছুক্ষণ ওদিকে বেড়াতে বেশ লাগে।’ তাহার কণ্ঠস্বরে যেন একটু দুষ্টবুদ্ধির আভাস পাইলাম।

আলো ছায়ায় অস্পষ্ট রেড রোড। সেখানে পৌঁছিয়া ভবেশের দুষ্টবুদ্ধি প্রকাশ পাইল। আমি জানিতাম না যে এই সময় এখানে পণ্যরমণীদের বেসাতি হইয়া থাকে। ভবেশ মোটর থামাইয়া গাড়ি হইতে নামিল, শিস্ দিতে দিতে রাস্তায় পায়চারি করিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে কয়েকটি ছায়াময়ী নারীমূর্তির আবির্ভাব হইল।

‘হ্যালো ডিয়ার!’ ‘হ্যালো ডার্লিং!’ ‘গুড ইভ্‌নিং মাই ডিয়ার!’

ভবেশ দুইটি বাছিয়া লইয়া তাহাদের সহিত বাহু শৃঙ্খলিত করিয়া মোটরের দিকে ফিরিল।

আমি গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িলাম। বলিলাম—‘ভবেশ, তোমার সঙ্গে আমার এই শেষ। তুমি উচ্ছন্ন যেতে চাও একলা যাও, আমাকে সঙ্গী পাবে না।—চললাম।’

পাঁচ বছর কাটিয়া গিয়াছে, ভবেশের সঙ্গে আর দেখা হয় নাই। ইতিমধ্যে আমি বিবাহ করিয়াছি, সুখে দুঃখে জীবন চলিতেছে। ভবেশের কথা মনে হইলে বিরক্তি ও ঘৃণায় মন ভরিয়া ওঠে। সে নিজে লম্পট দুশ্চরিত্র হইয়া গিয়াছিল, সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও দলে টানিবার চেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু তাহার এই প্রবৃত্তি কোথা হইতে আসিল? তাহার ধাতুর মধ্যে কি এই অধঃপতনের বীজ নিহিত ছিল? গুটিপোকা হঠাৎ গুটি কাটিয়া প্রজাপতি রূপে বাহির হইয়া আসে। মানুষদের মধ্যেও কি এই রূপান্তরের সম্ভাবনা প্রচ্ছন্ন আছে?

কিন্তু ভবেশের রূপান্তরের পালা এখনও শেষ হয় নাই। অকস্মাৎ তাহার নিকট হইতে এক চিঠি পাইলাম। সে লিখিয়াছে—

ভাই অরুণ, আমি চললাম। কোথায় যাচ্ছি এখনও জানি না। ব্যাঙ্কে আমার কিছু টাকা আছে, তোমাকে দিয়ে গেলাম। তুমি খরচ করলে টাকাগুলোর সদ্‌গতি হবে। ব্যাঙ্কে আমি চিঠি লিখে দিয়েছি, তুমি গিয়ে খবর নিলেই সব ব্যবস্থা হবে।—তোমার ভবেশ।

তাহার কিছুদিন পরে ব্যাঙ্ক হইতেও চিঠি আসিল। ব্যাঙ্কে গিয়া জানিতে পারিলাম ভবেশ প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা রাখিয়া গিয়াছে, আমি তাহা যথেচ্ছা ব্যবহার করিতে পারি। আমি অবশ্য সে-টাকা স্পর্শ করি নাই, এখনও তাহা ব্যাঙ্কেই জমা আছে।

কিন্তু ভবেশ কোথায় গেল? এবং কেনই বা গেল? সে কি কোনও দুষ্কৃতি করিয়া ফেরারী হইয়াছে? সন্তর্পণে খোঁজ খবর লইলাম, কিন্তু তাহার নামে ওয়ারেন্ট আছে এমন কোনও খবর পাওয়া গেল না। অকারণেই সে সব ফেলিয়া নিরুদ্দেশ হইয়াছে।

আরও পাঁচ-ছয় বছর কাটিয়া গেল। তাহার পর একদিন কলিকাতা হইতে হাজার মাইল দূরে নর্মদার তীরে এক বটবৃক্ষতলে ভবেশকে দেখিতে পাইলাম। ঘাটের ধারে বেড়াইতে গিয়াছিলাম, ন্যাড়া মাথা ও আলখাল্লা পরা লোকটাকে প্রথমে গ্রাহ্য করি নাই, তাহার পর মনে হইল, ভাল করিয়া তাকাইয়া দেখি—ভবেশই বটে। দশ-বারো বছর দেখি নাই তবু চিনিতে পারিলাম। চেহারা তেমনি আছে, শুধু যেন একটু মোলায়েম হইয়াছে।

‘ভবেশ!’

সে সলজ্জভাবে চক্ষু মিটিমিটি করিল।

বলিলাম—‘এ আবার কী নতুন ঢং। সাধু হয়েছ দেখছি।’

সে বলিল—‘সাধু নয় ভাই, ভিখিরি হয়েছি।’ তাহার কণ্ঠস্বর কেন জানি না বড় মিষ্ট লাগিল।

‘ভিখিরি হয়েছ!’

ভবেশ আবার অপ্রস্তুতভাবে চক্ষু মিটিমিটি করিল।

পুনশ্চ প্রশ্ন করিলাম—‘ভিখিরি হয়ে কি লাভ হল?’

সে যেন কতকটা আত্মগতভাবেই বলিল—‘লাভ—লাভের আশায় তো ভিখিরি হইনি। তবে—লাভ হয়েছে। ভিক্ষায় চিত্তশুদ্ধি হয়, অহঙ্কার নাশ হয়—’

‘ছাই হয়। এটা তোমার একটা নতুন ধরনের বাঁদরামি।’

সে মৃদু হাসিল—‘তাও হতে পারে, কিন্তু কি করব ভাই, আমি নিজের ইচ্ছেয় কিছুই করিনি। একদিন কে যেন ঘাড় ধরে আমাকে সংসার থেকে বার করে দিলে। এখন বুঝতে পারছি আমি জীবনে কোনও দিন নিজের ইচ্ছেয় কিছু করিনি, সব প্রকৃতি করিয়েছে। প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি—’

‘ঢের হয়েছে, সংস্কৃত আউড়ে নিজের লজ্জা প্রকৃতির ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা কোরো না। এবার ভাল ছেলের মতো গুটিগুটি দেশে ফিরে চল। তোমার টাকা আমি এক পয়সা খরচ করিনি। সংসারে থেকেও ভদ্রভাবে জীবনযাপন করা যায়।’

সে চুপ করিয়া রহিল। আমি তখন গাছের একটা শিকড়ের উপর বসিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহাকে বুঝাইলাম। সে তর্ক করিল না। চুপ করিয়া শুনিল।

সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে দেখিয়া আমি উঠিলাম। ‘কাল আবার আসব’ বলিয়া চলিয়া আসিলাম। পরদিন সকালবেলা গাছতলায় গিয়া দেখি সে চলিয়া গিয়াছে।

আর তাহার দেখা পাই নাই। কে জানে ইহার পর তাহার অন্য কোনও রূপান্তর ঘটিয়াছে কি না।

৩ মাঘ ১৩৬১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *