1 of 2

অন্য নকসি – আবুল বাশার

অন্য নকসি – আবুল বাশার

রুহুল ফকির পরম বিস্ময়ে মাথার আকাশে চেয়ে রইল কোন এক আশ্বিন মাসে। গতকাল আশ্বিনে-আঁধি শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, আকাশ থেকে এখনও একখানা চটা-মেঘ সরে যায়নি। থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিথর। ওপারে কুষ্টিয়ার মেলায় এপারের কীর্তনাঙ্গের দানাদার বাউল-গান শোনাতে গিয়েছিল সে। ওপারের গানে কীর্তনিয়ার চমক নেই, আছে ফকিরি সারল্যে সহজ গীতিময়তা। সেই মেলার সম্মিলনে এইসব কথা উঠেছিল। আরো অনেক কথাই উঠেছে, আসন-সংক্রান্ত সমালোচনা হয়েছে। আসুনে-ফকির কী প্রকার গোঁড়া, মতিচ্ছন্ন, শিষ্যশাবকদের প্রতি কী চাতুরী করে, সব কথাই হয়েছে। আসুনেদের সঙ্গে বিতণ্ডা হয়েছে প্রচুর। যেখানে আসন সেখানেই দুর্নীতি। রুহুলের মন ভাল নেই। এখন তার আঁধি-নিষিক্ত হাওয়ায় কড়িয়ে শীত ধরেছে। চরে হাওয়ার প্রহার খুব মারাত্মক। চেয়ে দেখল, মেঘের পেটে বাজ আর আগুন এখনও নিহিত, ক্রোধ যায়নি সবখানি। চমকাচ্ছে মৃদু মৃদু। চটা মেঘ উদাসীন। কিন্তু মনে তার আশ্চর্য গুমোর। ঢালবে মনে হচ্ছে।

রুহুল দাঁড়িয়েছে ভি-পয়েন্টের উপর। ঠিক তখনই এক মৌলবীসাহেব সাইকেল নিয়ে পূবমুখো দাঁড়িয়ে। ওপারে এক চাকা, এপারে আর এক চাকা। এক রিমে ভারতবর্ষের কাদা, অন্য চাকায় বাংলাদেশী কাদার ন্যাড় জড়িয়ে গিয়েছে। মনে মনে রুহুল ইংরাজদের শাসনপদ্ধতির অপূর্ব মহিমার তারিফ করে। তারপর মৌলবী মিজানজীর কালো কার্ল মার্ক্স-মার্কা ঝাঁকড়া খাটো সুন্নতের দিকে তাকায়। মাথায় জড়ানো কালো পশমী মাফলার, গায়ে হলুদরঙা খদ্দরের মোটা চাদর। কিছুটা কিম্ভুত দেখায়। পা খালি, হাঁটুর উপর এক পায়ের লুঙ্গি উঠে গিয়েছে। কাদায় খালি-পা ম্যাড়ম্যাড় করছে। সকাল থেকে বিকাল অবধি রোদে চরের এঁটেল কাদা পুরোপুরি শুকায়নি। মেঘের গলায় অকস্মাৎ ফাটা শব্দ হয়। জমিনের মাঝামাঝি ওরা দাঁড়িয়ে পড়েছে। মিজানজীর জমি এটা।জমির মাঝ বরাবর সীমান্তরেখা টেনে রাখা হয়েছে। অবশ্য তা চোখে দেখা যায় না। শুধু দু’একটি বিক্ষিপ্ত ছিটনো পিলার চোখে পড়ে। এটা একটা ভি। ইংরাজি V। ভি-এর এলাকা। সীমান্তরেখা সরল নয়। বক্র। এঁকেবেঁকে উঠে নেমে যায়। ফলে ইংরাজি V-আকৃতি গড়ে ওঠে। এই V-এর দুই বাহু, আর বাহুমূল আছে। বাহুমূলে দাঁড়ালে, এক চাকা বাংলাদেশ, অপর চাকা ভারতবর্ষ।

মৌলবী স্থির। মেঘের দিকে চাইলেন। বললেন—আছ ছালামো আলা মানিত্তা আবাল হুদা।

কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল রুহুল। এ কেমন সহবত দেখাচ্ছেন খোদার বান্দা। ছালাম দিচ্ছেন বুঝি? কিন্তু রকম যে অন্যধারা মনে হয়। কথার কী মানে খোদা মালুম। কিন্তু আলাপ মন্দ নয়। বেশ বেশ। রুহুল বলে—ছালাম মৌলবীসাহেব।

—জী। আছ ছালামো আলা মানিত্তা আবাল হুদা।

মৌলবী ফের গলায় সুর তোলেন। শুধিয়ে ওঠেন—গান গাইতে যাওয়া হয়েছিল বেশরা ফকিরের?

রুহুল নির্লিপ্ত উত্তর করে—আজ্ঞে! হয়েছিল। কিন্তু আপনার আরবীখানার অর্থ যে বোঝা যায় না মিজানজী।

মৌলবী বলেন—কিছু নয় ফকিরসাহেব। ছালামই দিলাম আপনাকে।

রুহুল কিঞ্চিৎ আহত গলায় বলে—এমন তো কখনও শুনিনি।

মৌলবী জবাব করেন—তা শুনবেন কেন? এ-ছালাম তো সচরাচর দেওয়া হয় না। সকলে জানেও না। বিধর্মীদের জন্য এটা স্পেশাল। এটাই বৈধ। ‘আছ ছালামো আলাইকুম’ দিতে নেই। ওটা মুসলমানদের নিজস্ব রীতি, নিজেদের মধ্যে। আপনাকে ওইটেই দিলাম।

যে ব্যক্তি হেদায়েতের পথে খানিকটা এসেছে, পুরোপুরি ইসলাম গ্রহণ করে, মুসলমান হয়নি বা হতে পারেনি, তার জন্য এই নমস্কার।

রুহুল বলে—বেশ করলেন! আমরা তো মুসলমান নই, এই ফকিররা। কিন্তু কোরান-হাদিসের মধ্যে এত বড় অপমানের ব্যবস্থা আছে, আমার জানা ছিল না। যাই হোক। ছালাম দিলেন, আপনার হাঁটুর উপরে কাপড়। সেটা কি ঠিক হল?

মৌলবী বললেন—গুমুত খাওয়া ফকিরের বেলা এইটেই জায়েজ মনে করি। তা এখন যাবেন কোন্ পানে? হারুডাঙ্গা তনুর ঘর? বিটির আমার কত প্রকৃতি। সেই প্রকৃতির কত ফের-ফাঁপর। সাত-ভাতারীর ষোলকলা, কিন্তু ‘আছে-কি-নেই-ভাতারীর’ চৌষট্টি। যান চলে যান। আসমানের মেঘখানার মতোই বিটি আমার হামলায়। এক আইলে ঢালে, অন্য আইল শুখা। খটখট করে। দ্যাখেন ক্যানে, কেমন ফুরফুরিয়ে নীলা করছে।

রুহুল চেয়ে দেখে, সত্যিই বড় অদ্ভুত দৃশ্য। বৃষ্টি হচ্ছে। পশ্চিম আকাশে সূর্য সুবর্ণ। পুব-আইল ভিজিয়ে দিচ্ছে মেঘ। পশ্চিম ভাগ শুকনো। বাংলাদেশ ভিজে যায়। একই মেঘ ভারতবর্ষে বৃষ্টিচ্ছায়া গুটিয়ে রেখে ঝরে যাচ্ছে ওপারে। নিয়ম উল্টোও হয়। দেখতে দেখতে রুহুল ফকির প্রকৃতির রকমারিতে দিশে হারিয়ে ফেলে। মৌলবীর ক্ষেতের এক ভাগ সিক্ত, অন্য ভাগ শুকনো বিস্ময়ে নিশ্চুপ। মৌলবীর গলা থেকে তপ্ত সীসে ফকিরকে মর্মে বিদ্ধ করে। ফকির হাঁটতে শুরু করে হারুডাঙ্গার বস্তির দিকে। মনে মনে বলে—কোরান-হাদিস, তোমার নিজস্ব সম্প্রদায়ের সম্পত্তি। সেখান থেকে তোমরা আমাদের উচ্ছেদ করতে চাও। তোমরা বল, বিসমিল্লা, আমরা বলি, বীজ মে আল্লা, মানুষ বীজরূপী। এই বিশ্ব বীর্যময়। সে মর্ম তুমি কখনও বুঝবে না শরার মৌলবী। চিরকাল আমাদের গুমুত খেতেই দেখলে।রূপরসবীজ-মাটির করণ বিষম করণ, কী করে বোঝাই তোমাকে? চলি, তোমাকেও সালাম দিই, আছ ছালামো আলা মানিত্তা আবাল হুদা। তুমিও আমার কাছে বিধর্মী বই নও। তবে তোমার জন্যে একখানা গান শুনিয়ে যাই, ওপার থেকে এনেছি।

রুহুল দোতারায় সুর টানে :

আহারে খোদার বান্দা

কার প্রেমে আছো বাঁধা?

একদিন তোর হবে আঁধার

ভাবে বোঝা যায়।

টাকা পয়সা জমিদারি

পাইয়া সুন্দর নারী

করিতেছ বাহাদুরি

এই দুনিয়ায়।

মৌলবী মিজানআলি পায়ের তলার জমিনে নিচু হয়ে ভুরভুরে মাটি তুলে তালুতে চট্কাচ্ছেন। ফকিরের জবাবী গানে অপমানের পাল্টা ধাক্কা এসে ওঁর মুখকে আরো কালো করে তোলে। ফকিরদের এই হচ্ছে স্টাইল। সুরে জবাব, সুরে বিদ্রুপ, সুরে ফরিয়াদ ও বিদ্রোহ। ভাবখানা যেন কেমন ধারা। তোমার আত্মার কালো দাগ তাদের নজর এড়ায় না। তনুর জীবন নিয়ে এত অপশ্রাদ্ধ কেন, রুহুল ফকির কী জানে না? সব জানে। আর এই যে বেহক ক্রোধী মৌলবী, তার নক্শা ফকিররা কম চেনে না। রুহুল তরুণ ও বি কম পাস ফকির। চক্ষুষ্মান দিনদারীতে। গাইছে :

আছে দুই কাঁধে দুই ফেরেস্তা

আইন মতন করেন ব্যবস্থা

কালি-কলম কাগজের বস্তা

সঙ্গে রাখো নাই।

উল্লাসে করিলি প্রেম

ভুলে গেলি খোদার নাম

না করিলি নিজ কাম

কী হবে উপায়?

গাইতে গাইতে ফকির হারুডাঙ্গার চরবস্তির দিকে এগিয়ে যায়। সন্ধ্যা নামে। চরের আকাশে নির্মেঘ সন্ধ্যা-তারকা টলটল করে।

চর-সীমান্তের জীবন খুবই অসম্ভব অদ্ভুত, বিশেষ এই চর-সীমান্ত-গ্রাম হারুডাঙ্গার বসতি ঘিরে জীবনের রূপ আরো উত্তেজক কটু। অস্থির চঞ্চলতায় পীড়িত সেই অস্তিত্ব। এবার সেই কথা।

তনু নকসি কাঁথাখানা সময়ের সঙ্গে পাল্লা ধরে বুনছে। ফকির পৌঁছনর আগেই কাঁথার শেষ ফোঁড় দেবে স্থির করেছে। ফকির তো এক রাতের বেশি হারুডাঙ্গায় বাস করবে না। তার নানা কারণ। লোকে ফকিরদের সয় না। রুহুল ফকির বেহক শরা মৌলবীদের চক্ষুশূল। নানা রকম গান বেঁধে শুধু যে সুন্নীদের তাতিয়ে রাখে, তাই নয়। সুন্নীদের বিচারে, ফকিরের নজর খারাপ। সেইখানেই মস্ত বিবাদ আছে। আর তনু সেই বিবাদের আড়ালে জীবনের অন্য মহিমা দেখেছে। অস্থির জীবন খানিকটা দড় ডাঙ্গাল জমি প্রত্যাশা করে। শেখপাড়ায়, বুধিভাঙ্গায়, কাহারপাড়ার কিংবা হারুডাঙ্গার চরে সেই ডাঙ্গাল সত্যিকার দড় জমিন কোথায়? তনু কুপির শিখা হাতের আড়াল করে ঘনিয়ে ওঠা সন্ধ্যার দিগন্তবিস্তৃত ধু-ধু চরের পুবপারে চোখ মেলে খানিক স্থির হয়ে দাঁড়ায়। শিরশিরানো হাওয়া দিচ্ছে চর। এই শীতে ফকির কেমন আছে কে জানে। আজ তার ফিরে আসার কথা।

দূরে একবার সন্ধ্যার মুখে দোতারা বেজে উঠে থেমে গেছে। সেটা বিভ্রম। মনেই বেজেছে দোতারা। এই হয়, এই দেহ-ই দোতারার মতন বাজে। লাউবাঁধা এই তনুর দোতারা প্রকৃতির রূপে অপরূপ। রমণী রূপের কূপ। বলতেন নীলরতন গোঁসাই। যেমন কিনা লাউয়ের নিতম্ব-মধ্যে সুর থাকে, এই বড় নৈরাকারের মাঝে থেকে সেই সুর উঠে আসে। কিন্তু এই দেহ কি কম কথা? আকারের মধ্যেই নিরাকারের বাস। তাই বা কেন? নিরাকারের ধন্দ কিছু নয়। ধন্দ এই দেহের। দেহ ছাড়া রূপও নেই, সুরও নেই। সেই তৃষ্ণাই বাউলের তৃষ্ণা। বাউল মানে পাগল। সেই পাগল কখন আসে, তনুর আজ সেই প্রতীক্ষা।

নকসির শেষ ফোঁড় হয়ে গেল। ফকিরের সুবেলা দোতারা দুয়ারে এসে থামল। আজ চরের অন্ধকার বড় নিবিড়। তনুর ভয় করছিল। শেখপাড়া, কাহারপাড়ার সুন্নীরা চায় না, হারুডাঙ্গার চরে রুহুল ফকির আশ্রয় নেয়। পনেরো দিন আগে দহ-র ডিঙ্গিতে করে বাউল যখন দহের ওপার যাচ্ছে, মাঝি কাদের মিঞা তনুকে চোখের ইশারায় অশুভ ইঙ্গিতে বুঝিয়েছিল, সময় খারাপ।

তনু জানে, সময় কীভাবে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কেন ঐধারা চোখে অশুভ ঘোর ফুটে ওঠে মাঝির। তথাপি তনুর মুক্তি ঐ পুব পারে উষার কুসুমে ঝলমল করে সেইদিন। কেন করে, সে-কথা কেউ জানে না। কারণ সেটা তনুর কল্পনা।

আজ বিকালে মিজান মৌলবী তনুকে শাসিয়ে গিয়েছে। জমি দেখতে এসেছিল সাইকেল হাঁকিয়ে। শাসিয়ে রেখে ভি-এর দিকে দাবড়ে গেল বাইক। কথা কী? না, তানজিয়া ওরফে তনু খাতুন হাজমত সেখের বউ। দ্বিতীয় পক্ষ। শেখপাড়ার সব গেরস্ত, ব্যবসায়ী, টাঙ্গাঅলা সবাই জানে সেকথা। ভুলে যেও না। মুসলমানের বউ হয়ে রাধিকেগিরি করে না। ফকিরের সঙ্গে মুসলমানের জল-চল থাকলেও, তারা আমাদের কৌমের (গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়) কেউ না। পার্থক্য ঘুচিয়ে দিও না বিটি। তুমি ওয়াক্তী নামাজ ছেড়ে দিয়েছো দেখতে পাই। এক ওয়াক্ত নামাজ ক্কাজ্বা হ’লে আশি হুগ্‌বা দোজখ মনে রেখো। এক হুগ্‌বায় আশি বছর। আশি হুগ্‌বায় কত? আশি গুণিতক আশি কত সন হয়?

শুনতে শুনতে তনুর মুখ বেঁকে গিয়েছিল। ঈষৎ হাসিতে ফুটে উঠেছিল অবাধ্যতার রেখায়ন। এই ধরনের চাপ কতদিন ধ’রে চলছে। স্বামী হাজমত সেখ এপারেরই লোক। তার প্রথম পক্ষ মৃত। কিছুদিন আগে বিষ খেয়ে মরেছে, স্বামীর বেবজ্ঞা আহ্লাদ সইতে পারেনি। কারণ হাজমত তৃতীয় পক্ষের ব্যবস্থা করছে ওপারে, রটনা হয়েছিল। প্রথম পক্ষের মৃত্যুর পরই ওপারে লেহেজানকে নিকে করল হাজমত। চর এলাকায় এসব কোন ব্যাপারই নয়, ডালভাত। দু’নম্বরী ব্যবসায় দু’পারে দু’টি বউ রাখা স্বাভাবিক সিদ্ধ কর্ম। চালাক লোকেরা তাই করে। জগৎ তাতে, বিস্মিত হয় না। প্রথম বউটির মাথায় পোকা হয়েছিল। তনু জানে, দু নম্বরী মাল-চালানি ব্যবসা চরের আসল জীবিকা। ভি-এর ওপাশে-এপাশে ঘর আছে একই লোকের। ওপারে চারচালাও যার, এপারের দালানও তারই। দালান আর কী, কাঁচা বাড়ির কোঠাপাড়া ঘর হলেই তাকে দালান বলতে হবে। ওপারে হাজমতের সেই দালানে লেহেজান শুয়ে থাকে। তনুও ওপারেরই মেয়ে। মাল বইবার সুবিধার জন্য এপারে এনে কাহারপাড়ায় হাজমত দালান তুলেছিল। তারপর ওপারে লেহেজানকে ফুঁসলাতে লাগল। যার বউ থাকে না, তার রাখনী থাকে। রাতের অন্ধকারে এই রাখনী বা বউরা কেউ কেউ অনেকেরই বস্তাভর্তি জামাকাপড়ের মালপত্তর কাঁধে করে পার করে দেওয়ার বেলা সাহায্য করে। তাছাড়া দু’পারে দু’খানা বউ থাকলে আর সেকথা বি এস এফ-দের কানে তুলে রাখলে সুবিধা। কোথা যাও হে হাজমত? ওপারে বউ আছে, বালবাচ্চা আছে, তাই যাচ্ছি। কোথা যাও তনু বিবি? ওপারে স্বামীর কাছে শুতে যাচ্ছি, স্বামী কয়দিন আমার সতীন ছেড়ে আসেনি।

মনে পড়ে একথা শুনে রুহুল ফকিরের চক্ষু স্থির হয়ে গিয়েছিল। কে এক নচ্ছার ছোকরা ফকিরের সামনে মস্করা করে সাজাল পোয়াতে পোয়াতে বেফাঁস করে বলেছিল গত সনে। কী বলেছিল? মনে পড়লে আজও তনুর মুখমণ্ডল শরমে রাঙিয়ে ওঠে তৎক্ষণাৎ। আসলে হাজমত আর এপারমুখো হত না সেই সময়। ছোকরা বলেছিল—ওপারে তনুর সোয়ামীর আর একপক্ষের গেরস্তি, জানলেন। ফকির! এপারে একলা ভোঁ-ভোঁ করে। জিন্দেগীর টানাটানি কী জিনিস তনুকে না দেখলে মালুম হয় না। রাতে শুতে যায় মেয়ে, বোঝেন রহস্য!

তারপর ছোকরা খিকখিক করে হেসে উঠে বলেছিল—দিনের বেলা এপারে দাসীগিরি, রাতে মাল বহে গিয়ে বা আনতে গিয়ে সোয়ামীর পাশে শুয়ে আসা, হেঃ হেঃ! জিন্দেগীর বাহার দেখেন জী! ভি-এর দু’খানা হাতে মরণ নিবাস করে। মিলিটারি গুলি ছুঁড়লেই সাধের বুকখানা এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে চলে যাবে। মুণ্ডু রইবে ইণ্ডেয়, ধড় থাকবে বাংলায়, কচুপাতার পানি ছলকে গেলেই, বাস! এই ভোজবাজির চরায় আপনি কেন এলেন জী! তনু হল গে চর-চরানী মেয়ে, আপনার গান শুনলেই চোখ বুজে কাঁদে!

কথা কয়টি বলেছিল সোভান, ছয় মাস আগে সেই তাজা ছেলেটা মিলিটারির গুলিতে নিকেশ হয়ে গিয়েছে। কারণ প্রতি বছরই দু’একটি লাশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী ভি-পয়েন্টে লুষ্ঠিত করে ফেলে রাখে, ওটা ওদের কড়া পাহারার দর্শনীয় নমুনা। কিন্তু তা বলে চরের বাসিন্দারা থেমে থাকে না। এপার ওপার এবেলা ওবেলার পথ, সীমান্তরেখায় জীবন আটকায় না, তার মান্যতাও কিছু নেই এদের কাছে। ভি-পয়েন্টের বাহুমূলে পথ সংক্ষিপ্ত, পাহারাও কড়াকড়ি, ফের সেখানে চোখে ধুলো বা পকেটে গোঁজা মেরে পথ খালাস রাখতে হয়। দুই বাহুর গায়ে বি-এস-এফ পাহারা মোতায়েন। বিশদ গাওনা আরো আছে, তবে ছোট কথায়, বাহুজুড়ে মৃত্যু ঘুরে বেড়ায়, চরে বেড়ায় ছায়ার মতন। এরা জানে না, কোন পারে জীবনটাকে খুঁটায় বাঁধা যায়। এপারে ওপারে শাদি হচ্ছে, যাত্রা আলকাপ বাউলগান শুনতে যাচ্ছে, আসছে, ওপারের একটা বাচ্চা ছেলে এপারে শেখপাড়ায় এসে হাটবাজার করে সন্ধ্যার মুখে ফিরে গেল, সবই চলছে। কিন্তু মৃত্যুও জীবনের মতোই চঞ্চল। পারাপার মানে না। কিন্তু তনুর জীবনে একখণ্ড ডাঙ্গাল দড় জমির বড় দরকার ছিল, খুব নিজস্ব সেই আবাদপাতি জমি-জিরাতের দেশ। জলা নয়, বানভাসি নয়। পদ্মার উথালিপাথালি চরের আতঙ্ক নয়। ফকিরের অচঞ্চল আত্মার মতন স্থির। আর যেন কী?

তনু মনে করতে পারল না, ফকির তাকে কত কথা শুনিয়েছে। বলেছে, হৃৎপিণ্ডের উপর কেমন করে নুরের বাতি জ্বলছে। সেই রৌশনীর বিশদ খবর তাকে শোনাতে চেয়েছে ফকির। সেই ফকির আজ ফিরে এল। একপক্ষকাল পর অমাবস্যার নিবিড় অন্ধকারে। তনুর হাতে কুপির শিখা কেঁপে কেঁপে ওঠে।

স্বাধীনতার সময় বাংলা যখন দু’ভাগ করে গেল ইংরাজ, তখনকার জমানায় একটা মজাদার কলের গান চালু হয়েছিল। দহ-র ডিঙ্গি বাইতে বাইতে কাদের মিঞা এখনও সেই গান গাইতে থাকে। ভুলে গিয়েছে অনেকখানি। ভুলে যাওয়া পয়ারে নিজের মতন করে সুর আর ছন্দ গুঁজে ভাষা তৈরি করেছে। সেই গানের মধ্যে জীবনের যে অস্থিরতা দুলে উঠেছিল তা আজও দোলায়মান :

ওরে বাবারে বাবারে বাবারে বাবা!

আচমকা গেয়ে ওঠে ধমকানির ত্রাসে কাদের মিঞা, যেন বাজ প’ড়ে গেল।

এবার স্বাধীনতা পেলি বাবা।

স্বাধীনতার গুতায় গরিবের প্রাণ যায়

এখন বল কোথা যাবা

কোথায় বল হাওয়া খাবা

হিন্দুস্থানে না পাকিস্তানে বাবা

বাসা এখন বাঁধিবা?

তনুর এই গানখানা শুনলে হাসি পায়, শুনতে শুনতে গা দুলে ওঠে, আঁচলের ফুঁপি মুখে গুঁজে ভাবতে হয় চরচরানী মেয়ের চরান্ধকার জীবনের থই কোথাও নেই, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্যুভয় জড়িত চোরা মাল বইবার প্রতি রাতের রহস্য তাকে হাজমতের যৌন-দাসী করেছে।

এরা সব চোর ছ্যাঁচোড়, দাগী আর খুনি। এপারে খুন করে ওপারে পালিয়ে গিয়ে কিছুকাল বসবাস করে, দেশের রাজা বদল হলে, এখানকার জোতদার মহাজন নেতার, দু’নম্বরী কারবারের নাফাদার মোড়লের মোড়লির ছত্রচ্ছায়ার রাজনৈতিক গ্যারান্টি পেলে ফিরে আসে। খুন করে মোড়লের মহাজনের ইশারায়। এখানে নানা রকম গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আছে। ফরাজী আর হানাফীদের বিবাদ আছে। মসজিদে শুক্রবার জুম্মাদিন এক আজান না দুই আজান, মাথার টুপি গোল না চৌকো, মুর্দা কবরে কাত না চিত হয়ে শোবে তা নিয়ে বিসংবাদ অন্তহীন। এইসব বিবাদ থেকেও কখনও বা ঘর পোড়ে, কারো মাথায় ঘোল ঢালা হয় বা মুণ্ডপাতও হতে পারে। তাছাড়া রাজনৈতিক গুপ্তিমার এখানকার একটা উৎসব। দু’নম্বরী টাকায় জুয়া খেলা চলে, সেখানেও মারপিট। অন্যের বউয়ের কাছে রাত্রে চলে যায় কালো লোভী ছায়া, হঠাৎ মাঝরাতে চোর পড়ার ভয়ার্ত নারীকন্ঠের চিৎকার, আসলে চোর নয়, লোভী একটা আদিম নগ্নছায়া, ধরা পড়ে গিয়েছে। ফলে একচোট মার হয়ে গেল। তনু এই জীবন কখনও চায়নি। পেটের দায়ে জীবনটা তার কেমন হয়ে গিয়েছে। ফাটা সেই রেকর্ডখানা ঘষটে ঘষটে বেজেই চলেছে:

হিন্দুস্থানে না পাকিস্তানে।

কাহারপাড়া নাকি হারুডাঙ্গায়

নাকি ওপারের লেহেজানের দালানে

জীবনটা স্থির হয়?

তনুর দীর্ঘশ্বাস পড়ে কুপির শিখার উপর। তখনই চোখে পড়ে উঠোনে বাউলের ছায়া।

বাউল বলে—তনু, আমি এলাম।

তনু বলেসে—সে-সুর আগেই শুনেছি ফকির ছায়েব। দাওয়ায় বসেন। চালজল সেবা করেন। আপনার সাথে ঢের কথা আছে। মানুষের সেবাধর্ম এখনও বুঝি না, আপনাদের মানুষ-পূজার পেন্নাম করা রীত আমায় শিখিয়ে দেবেন এইবেলা?

রুহুল বলল—সে হবে’খন। আস্তে আস্তে শেখো। চালজলের নিয়মটা কি তোমার খারাপ লাগে? তোমায় যাবার দিন বলে গিয়েছিলাম, আমার জন্য চালজল রেখো, পেট হচ্ছে চামড়ার মশক। যত বাড়াবে তত বাড়বে, কমালে কমে, মনে আছে তোমার?

—তা আর নেই? আপনার সব কথা আমি মুখস্থ করব। বলেই নিঃশব্দে মিঠে করে হেসে নেয় তানজিয়া। বাঁ হাতে কুপি ধরে ডান হাতে গুটানো ছোট মাদুরখানা দাওয়ায় মেলে দিয়ে বলে—একটু বাদে চা দেব। পরে সাঁজাল করে দেব, চরের ঠাণ্ডা আপনার সইবে না।

কাঁধের কাপড়ের ব্যাগ ঘাড় থেকে নামায় রুহুল, মাদুরে বসে, খুঁটিতে দোতারা হেলান দিয়ে রাখে। তনু খুব দ্রুত রুহুলের পায়ের কাছে টিনের বদনায় জল রেখে শুধায়—ঢেলে দিব?

রুহুল বলে—তুমি মুসলমানের বউ। পায়ে জল ঢেলে চুলের গোছায় মুছিয়ে দেবে যে বেচারিকে, সে তো তোমার পর হয়ে গিয়েছে, তোমার স্বামীধন? আমি তো ফকির। আমি চাই সত্যিকার একটা স্বাধীন মেয়ে আমার পায়ে জল ঢেলে সুখী হোক। তিন নোকতা কথা, তার একটা তানা ছিঁড়ে গিয়েছে। বাকি দু’নোকতা নিজেই তুমি ছেঁড়ো।

হাজমত ফরাজী। তিনমাসে তিন তালাক দেবে তনুকে। ফরাজীদের হাদিস হানাফীদের মতো হাল্কা নয়। একমুখে তিন মিনিটেই তো তালাক হয় না। তিন চাঁদ লাগে। অবিশ্যি এইসব কারণেই হয়ত ফরাজীদের মধ্যে তালাকের চল কম। কিন্তু অনুশাসনে ফরাজীরা হানাফীদের চেয়ে বেশি দড়। হাজমত তনুকে এক তালাক শুনিয়েছে, বউকে বশে আনবার জন্যে। তনু প্রথম থেকেই বাগে আসে না এমন নয়। আসলে এই ফকির আসার পর থেকেই কেমন একটা রোখ এসেছে মেয়েটার মধ্যে। কী সেটা, হাজমত বুঝতে পারে না। ওর চোখ সাদা। ওর যেন মনে হয়, লেহেজানকে নিকে করার পর তনুকে সে খানিকটা কাঙাল করে দিয়েছিল। চর পেরিয়ে শুতে যাওয়া, তারপর কত রাতে স্বামীর দেহ নাগালে পেত না তনু, লেহেজান দখলে রেখে দিত। সেইটে হিংসে বটে, অপমানও বটে। তারপরই তো রোখটা এল। কথাটা কারো কাছে ভাঙা যায় না। মিজান মৌলবীকেও বলা যায় না।

হাজমত বলেছে—পুরো তালাক তো দিব না মৌলবী ছায়েব। খানিক ডর ধরিয়ে সিধে করব। আজকাল আমাদেরও ডরপুক হয়, পাছে না মর্দানী করে মোকদ্দমা ঠুকে খোরপোশ চায়। চোখমুখঅলা তেজি মেয়েছেলে, পেটে বিদ্যেও আছে দু’ফোটা। তিরাইলে হাইস্কুলে পড়ত দু’কেলাস, খুব গরিব বুলে সতীন-ঘরে এস্যাছে। উর ভিতরির ছটফটানি যে কী সোয়াদে তৈয়ারি হল, শালা ফকিরই জানে। আজ রুহুল ফকির তনুকে বলল,—সত্যিকার একটা স্বাধীন মেয়ে আমার পায়ে জল ঢেলে সুখী হোক। তিন নোকতা কথা, তার একটা তানা ছিড়ে গিয়েছে। ফকিরের উচ্চারণ চিন্তার গভীর স্পর্শ থেকে আসে। অস্পষ্ট অনুভব করে তনু। স্বামীধন পর হয়ে গিয়েছে, খুব সত্য কথা। কাহারপাড়ার দালান ছেড়ে তনু হারুডাঙ্গায় একলা আছে বছরভর। স্বামীর ঘরে নেই। মাস তিন থেকে হাজমতও না-ছোড় হয়ে এপারে মিজান মৌলবীর লেজে খেলছে। কাহারপাড়ায় রেখে মাল বওয়াবে, অবুঝ মেয়ে রাতে কুকুরের মতন স্বামীর আলিঙ্গনে ধরা দিতে যাবে, সেটা রদ হলে পুরুষ তো ক্ষেপেই ওঠে। কামড়াবে, কিন্তু পথ পাচ্ছে না। নাগাল দিচ্ছে না তনু। তার মনের মধ্যে খুব পুরনো গোষ্ঠীযুগের মেয়ে, মাতৃতন্ত্রের সাহসিনী নারী, স্বতন্ত্র দাপুটে নারীবোধ ছটফট করে ওঠে ফকিরের কথায়। তনু জানে না, সে নিজেই বা কে? কিন্তু বুঝতে পারে, ফকির তাকে খুব সাহস দিয়েছে। গত বছর একবার ফকির এই পথে ওপারে গিয়েছিল।সেইবার ঈষৎ হলুদ জামা, সাদা ধুতি আর ঘাড়ের দু’পাশে বুকের মাঝভাগ অবধি ঝোলানো ফোতা কাচতে দিয়ে তনুকে বলেছিল—ধুয়ে দাও। এই নাও সোডা। ভাঁটার ক্ষার। দোকানে কিনিনি। ইট-ভাঁটার মধ্যে এই ক্ষার পাওয়া যায়, বিনে পয়সায় সাবানের কাজ হয়। তনু আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। তার বিস্ময়-মুগ্ধ চোখে চেয়ে বলেছিল রুহুল—গরিবের ধর্ম এই ফকিরের ধর্ম আয়োজন বেশি লাগে না। অল্পে বাঁচা যায়, খুব কমে সন্তুষ্ট আর পূর্ণ হওয়া যায়। কথাটা ফাঁকা কথা নয় তনু বিবি। গরিবরা, মার খাওয়া, একেবারে মাটির তলার, জীবনের চাপে পড়া অকুলীন বিবর্ণ আমরা, খুব নিজের মতন করে এই বাঁচার ধর্ম গড়েছি। ভোগ করব জীবনকে, দু’মুঠি খাব দশ মুঠি ছিটিয়ে ফেলব, তারপর হায় হায় করব, তেমন তো নয়। খোদা বলেছে, ইন্নাতায়না কাল কাওছার। আমি তোমাকে কাওছার দান করেছি। কোরানের কথা, সেটা কী?

তনু সাথে সাথে বলেছিল—আমার মা রাজশাহী জোয়ারীর মেয়ে, ফকির-সঙ্গ করত। তা নিয়ে বাপের সাথে বনল না, বাপ গো-মাংস খেয়ে মুসলমান হল। তারপরই মা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। তেমন মানুষ না পেলে, শরার ফাঁস গলায় পড়ে ফকির সাহেব, সেই থেকে আমিও পতিত হয়েছি। শুধু টলেটলে বেড়াচ্ছি। পেটের খিদে আর দেহের আশোকে জীবনটা দেখুন কেমন জব্দ হয়ে গিয়েছে। দু’মুঠো ভাতের জন্যে চোর হয়ে আছি।

রুহুল বলেছিল—কিন্তু খোদার বয়ান, আমি তোমাকে কাওছার দান করেছি। এমন এক বেহেশতী পানীয়, যা খেলে খিদে তেষ্টা কমে যায়। খিদেকে জব্দ করার স্ফূর্তি হল কাওছার। সেই আনন্দের পানীয় এই দেহেই আছে। ফকিররা সেই খোঁজ জানে তনু বিবি। সেই ফকিরের টানেই মা তোমার হারিয়ে গিয়েছে। মৌলবীরা পাঁচবেলা নামাজে দাঁড়িয়ে ইন্নাতায়না করছে। কিন্তু সেই কাওছার কোথায় জানে না। তোমার মাকে আমি খুঁজে দেখব।

আজ রুহুল ঝোলা থেকে কতকগুলো ফটো বার করল। বলল, দেখো তো ইনি তোমার মা কিনা। তোমার মাকে খুঁজে পেয়েছি মনে হচ্ছে।

হাতে একতারা। গান গাইছে। এক প্রৌঢ়া মহিলা। বাউলের পোশাকে সুসজ্জিতা। তনু ঝুঁকে পড়ে ফটোর মাকে চিনতে পারে। মেলার মঞ্চে মা গান গাইছে। পাশে গান গাওয়া রুহুলের যুগলবন্দী বেশ ।

প্রথম আলাপের দিন, যখন এই চরে ওপার যাওয়ার পয়লা খেপ দিচ্ছে ফকির সেইদিনই তনু মায়ের কথা তুলেছিল কথার পৃষ্ঠে। মায়ের নাম বলেছিল সে। বলেছিল—তাহলে মায়ের একটু খোঁজ সত্যিই করবেন ফকির ছায়েব?

সেই মা। তনু পরম আগ্রহে ফটোখানা হাতে তুলে নিয়ে দু-চোখ ভরে দেখতে দেখতে বলে—মায়ের উপর কত অত্যাচার হয়েছিল। আমাদের একঘরে করেছিল দেশের লোক। জল বন্ধ করে বাপকে বউ তালাক দেবার জন্যে চাপ দিয়ে একেবারে নাজেহাল করেছে। মা তবু মাথা নোয়ায়নি। ফকির-সঙ্গ ত্যাগ করেনি। বাপকেই ছেড়ে গিয়েছিল। বাপ-মায়ের ছাড়াছাড়ি তো চোখের জলেই হয়েছে সেদিন। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলেই দু’টি জীবন আলাদা হয়ে গিয়েছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তনু। ফকিরকে ফটোখানা ফেরত দিয়ে বলে—বাপ পরে শরিয়তীদের ঘরে নিকে করে মুসলমান হল। সত্য পরেজগার মেয়ে। পাঁচবেলা বেঁধে নামাজ করে। তারপরই আমার বিয়ে হল, একেবারে পাথারে পড়লাম। মায়ের জন্যে কষ্ট হয়। মা একবার বাপকে দেখতে এসেছিল, দেশের লোক দুর্ দুর্ কৰে খেদিয়ে দিয়েছে। মা বলেছিল, আমি থাকতে আসিনি। চলে যাচ্ছি। আমার ওপর জুলুম করবেন না। আমার ধর্ম আমার, তোমার ধর্ম তোমার। ধর্মে জুলুম নেই। কোরানে সেকথা আছে।

রুহুল বল,—হ্যাঁ, সুরা কাফেরুনে সে কথা আছে। ধর্মে জবরদস্তি কোরো না।

তনু শুধাল—তবু এরা অত্যাচার করে কেন, ফকিরদের হাত-পা অবধি কেটে দেয়? আপনি এসেছেন, আমার খুব ভয় করছে। অবিশ্যি খেতে না পেলে এ-সমাজ দেখে না, ধর্মের বেলা খুব হম্বিতম্বি।

ফকিব গত বছরই বলেছিল—তোতোপাখির ধর্ম তনু। কোরান মুখে পড়ার জন্যে, মান্যতার জন্যে নয়।

তনু শিউরে উঠেছিল—কী কথা বলছেন ফকির ছায়েব! লোকে শুনলে খুন করবে।

রুহুল বলেছিল—ফকির নিধন তো ইতিহাসে নতুন নয়। আমাদের খুন করেছে। মেরেছে। আমরা কখনও হাত তুলিনি। হাতে দোতারা কি একতারা। এই তো সম্বল। ছোরা ধরতে ফকির পারে না। গান গাইলে মনটা যে নরম হয়ে থাকে তনু, আর কাওছারের স্বাদ পেলে খুনের ইচ্ছে রক্তে আসে না।

আজ বলল রুহুল—হম্বিতম্বি কেন করবে না, ওরা যে দলে ভারী। আমরা সংখ্যালঘু। ওরাই বলে মুসলমানের ৭২ দল। বাহাত্তর ফেরকা। তা একটা গানে আছে, শোন বলি। সবখানি ভাল মনে নেই।

দম ধরে ফকির মনে করে কিছুক্ষণ। তারপর বলে:

৭২ ফেরকা ১ দল হল নাজিয়া।

সেই দলে নাই অধিক লোক

দেখো মনে ভাবিয়া।

নেক লোকের ছোট জামাত;

রসিদ কয় মনসুরকে আয়াত।

পড়ো আলহামদোল্লিল্লাহে—

আক্সা রুহুল নহুল সুরে।⋯

কোরানে নহুল সুরা আছে তনু। আমরা সেই নাজিয়ার দল। আমাদের তো মারবেই। আমি এসেছি, আমি আসব। তোমার মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? সেকথা বলতে এলে কি পাপ হয়?

তো ফকির আজ বলেছে, একটি স্বাধীন মেয়ে তার পায়ে পূজার জল ঢেলে সুখী হবে, শিবলিঙ্গে দুধ ঢেলে কোন কামনা নয়, মানুষের পায়ে মানুষের তর্পণ। এই ফকির এ-বছর ওপারে যাবার বেলা গাইতে গাইতে গিয়েছিল:

দেখবি যদি সোনার মানুষ

দেখে যারে মন পাগলা। (গানের উচ্চারণ পাগোলা। )

সেই সোনার মানুষ কি আজ চোখের সামনে বসে একটি স্বাধীন মেয়ের স্বপ্ন দেখছে? তনু বদনা ফেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বাইরে কার যেন গলা শোনা যায়—খালাগো? বাড়ি আছো! গেরস্ত এই তরকারিটুকুন তুমাকে পেঠিয়েছে, সরপোষ ঢেকে লিয়ে আনছি। লাও যতন করে তুলে রাকো, রেতে ভাত মেখে খেও।

বলতে বলতে বছর চৌদ্দর একটি ছেলে গায়ে পাতলা চাদর জড়িয়ে হাতে একখানা সাজানো থালা নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। তনু ঘর থেকে বাইরে এসে ছেলেটির মুখের কাছে কুপির আলো তুলে ধরে। হাত থেকে ঢাকা দেওয়া থালা নিয়ে ঘরে ঢুকে ঢাকনা তুলে দেখে কেমন চমকে ওঠে। দ্রুত ঢাকনা ফেলে ঢেকে দেয়। তারপর মুখে আঁচল তুলে চেপে ধরে নিজের মুখ, যেন সাংঘাতিক কিছু সে গোপন করতে চায়। ফের দুতপায়ে বাইরে এসে ডাকে—শুনে যা রছুল!

রছুল বাইরে চলে এসেছিল, তনুর ডাকে উঠোনে ফেরে। তনু শুধায়—গেরস্ত কী করছে?

রছুল উত্তর দেয়—মজলিস। তুমাকে লিয়ে কতা হচ্ছে! মিজান মৌলবী শুদ্দো। খানিক বাদে আসবে। আজ তুমার বিচির (বিচার) হবে। তুমাকে মাল আনতে দলের সাথে লিষেদ করেচে গেরস্ত। আরো একখান তালাক হবে খালা গো!

কথা শেষ করে ছেলেটি আর দাঁড়ায় না। তনু অস্ফুট বলে ওঠে—রছুল দেখে গেল ফকির এসেছে। ওদিকে মজলিস করছে ওরা। নসীবের ফেরে রছুল ওদের চর। চোখ দুটো ডাকরার মতন ভয়ে পাকানো। ছিঃ।

এই ছিঃ! শব্দটুকু রুহুলের কানে ছিটকে আসে। রুহুল হাত-পা ধুয়ে ফেলেছে। চালজল সেবা করতে গিয়ে মুখে চাট্টি ফেলে কপালে গেলাস ‘আলেক’ বলে (মুসলমানরা যেমন বিসমিল্লা বলে খেতে শুরু করে সেই রকম) ঠেকিয়ে নিয়ে জলে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেল। রছুলের কথা শুনতে শুনতে সে হাত-পা স্থালন করেছে। তারপর দাওয়ায় উঠে গামছায় হাত-পা মুছে মুখে চাল ফেলেছে। তারপর ছিঃ শুনে চমকে মুখ তুলল। জলের গেলাসে চোখ ফিরিয়ে জল দেখল। চুমুক দিল। কোন কথা বলল না। রছুল চর। তনু মনে করে হাজমতের। হাজমত মনে করে তনুর। মাঝখানে টানাভবনার মাকু এই ছেলেটা। গলার সুরে বড় মায়া। তনু প্রথম ইতস্তত করেছিল, তরকারি নেবে কিনা। নিতে গ্লানি হয়। যখনই এইধারা ভেট আসে, সেই রাতে হাজমত তনুর কুটিরে রাতবাস করে। তরকারি হতে পারে, একটা ক্রিম কি পাউডার কিংবা শাড়ি হতে পারে, নিদেন কিছুরেশমি চুড়িই বা। সবই গ্লানিময়। তথাপি এই জোরাজুরির নোংরা জীবন ছাড়ান পেল না। তা পেতে গেলেও কেন যেন বুক কাঁপে। ‘আরো একখান ত তালাক হবে খালা গো’ কথাটার মধ্যে কেমন বিষাদ জড়িয়ে গিয়েছে। এখানেও জীবনটা কুপির শিখার মতন কেঁপে কেঁপে মাটির দেওয়ালে কালি লেপন করে হিজিবিজি কী সব লিখে চলে যেন। তনু সেইদিকে চেয়ে ছিল। ওপার থেকে হারুডাঙ্গায় বস্তা চালানের তদারকি তনুর। বাকি পথ রছুল বহে নিয়ে পৌঁছে দেয় গেরস্তকে। ঘর ছেড়ে যাবার সময় রছুলকে ঘরে পাহারায় রেখে যায় তনু। স্বামীর সাথে রছুলের মাধ্যমে টাকাকড়ির হিসেব চলে। বস্তাপ্রতি চালানের একটা মজুরী তার পাওনা। সম্পর্ক মজুর-মালিকের। কেবল শরীরের বেলা স্বামী-স্ত্রী। মনেই হয় না দেহ কথা বলতে পারে। লাউয়ের তনুতে সুর থাকে। মেয়ের দেহ একখানা একতারার মতন। সেইটে ঐ ফকিরের পাগলামি। সুন্নীর চোখে এই দেহ উলঙ্গ ফল, যাতে মালদহৰ ফজলির মতন নীল মাছি বসে। ভাবতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তনু। সেই শব্দ শুনতে পায় রুহুল। আবার চোখ তোলে। বাকি ভালটুকু গলায় নিংড়ে নেয়। বলে—আমি কখনও একেবারে চোখের উপর বউ তালাক দেখিনি। আজ দেখতে পাব। সেই সময় তোমার মুখটা কেমন হবে, তাই ভাবছি। এমন আসর কৱে বউ তালাক এই দেশেই সম্ভব। ওরা কখন আসবে?

তনু গম্ভীর গলায় জবাব দিল—জানি না।

এবং ঘর ছেড়ে নিচে নেমে সাঁজাল তৈরির কাঠখড়ি যোগাড় করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। সাঁজাল জ্বেলে দিয়ে মাটির উনুনে অল্প দু’খানা রুটি সেঁকে নেবে আর খানিকটা ভাজা তরকারি করবে এবং ভাবছিল গেরস্তর প্রেরিত তরকারি অন্ধকারে কোথাও ফেলে দিয়ে আসবে কিনা। তনু ফকিরকে ডাক দেয়—সাঁজালে এসে বসবেন?

রুহুল শুধাল—তুমি তখন ছিঃ করলে কেন? রছুল যা বলে গেল, তাতে তোমার মন খারাপ করছে। নাকি? এক তানা ছিঁড়েছে, আর এক তানা ছিঁড়বে, ভয় পাও?

তনু বলল—পাই বইকি! আজ যদি আপনার চোখের সামনে ওরা খারাপ কিছু করে? আপনার অসম্মান আমার সইবে না।

রুহুল তনুর কথায় ম্লান হেসে বলল—ফকিরের সম্মান কবে ওরা করেছে? আমরা সম্মান চাইনি। ওদের হাত থেকে বরাবর আমরা নিস্তার চেয়েছি। দুনিয়ায় যত ধর্ম আছে, সবই হল কল্পনা। সব অন্ধ আবেগের ধোঁয়ায় তৈরি। যুক্তির ধর্ম একটাই। এক ফকিরের ধর্ম ছাড়া সব ধর্মই যুক্তিকে ভয় পায়। লালন যখন বলেছিলেন:

সুন্নত রাখলে হয় মুসলমান

নারী লোকের কী হয় বিধান

পৈতে দেখে বামুন চিনি।

বামনী চিনি কেমনে?

তখন তো সহ্য হয়নি সেই যুক্তির কথা। ওরা ভেবে দেখেনি, যেমন আৱো কথা। ‘নাই আল্লা লাইলাহাতে, আছে আল্লা ইলিল্লাহতে’। ভেবেছে, আমরা ওদের ঠাট্টা করছি। একটু থেমে ফকির বলল—ফলে হয়েছে কি, নারীর ধর্ম কিছু নয়, ধর্ম পুরুষের। তাই নারীকে ওরা এত খাটো করে দেখেছে। আর আমরা সেই নারীকেই করেছি ভজনার উপায়। প্রকৃতির সঙ্গ ছাড়া আমার ধর্ম বৃথা। প্রকৃতি-প্রাপ্তিই ধর্ম। ওদের মোসলেম কি দাউদ হাদিসে আছে। পুরুষের বাঁ পাঁজরের বাঁকা হাড়ে রমণী তৈরি। তাকে সোজা করতে চাওয়া নিষ্ফল। বাঁকা হাড় সোজা হয় না। বরং তাকে সোজা করতে না চেয়ে তালাক দেওয়া বুদ্ধির কাজ। হাদিসে নির্দেশ আছে, তা মানুষ কী করবে! তাবৎ হাদিস পুরুষের পক্ষে লেখা। কোথাও দু’এক ফোঁটা করুণার সন্ধান পাবে ঠিকই কিন্তু নারীর সত্যকার মর্যাদা কোথাও নেই। আমরা এই অপমান সইতে পারিনি বলেই লালন তাঁর গানে শুধিয়েছিলেন, নারীর বিধান তাহলে কী হবে? বুঝলে তনু, যুক্তির জোরেই মুক্তির আলো জ্বলে। সেই আলো মানুষকেই জ্বালতে হয়। চোরা জীবন ছেড়ে দাও তুমি, আগেই বলেছি!

অনেকক্ষণ কথা বলে রুহুল ফকির ঝোলা থেকে একখানা খাতা বার করে কলম ধরে কীসব কথা লিখতে লাগল কুপির আলোয়! ফটোগুলো ঝোলায় ঢুকিয়ে ফেলল। পাটকাঠি দিয়ে কুপি থেকে আগুন ধরিয়ে নিয়ে তনু সাঁজাল জ্বেলে দিল। উনানে মাটির খোলা চড়িয়ে ছেনে রাখা আটা নিয়ে বসবার আগে উপুড় হয়ে লেখায় ব্যস্ত ফকিরের গায়ে নকসি কাঁথাখানা চাপিয়ে দিল। বলল—সাঁজাল জ্বেলেছি। লেখা রেখে আগুনে এসে বসুন। দেখুন কাঁথাখানা কেমন হয়েছে। আমার বাচ্চাকে এই চরের ঠাণ্ডা মেরে ফেলেছে ফকির ছায়েব। ঠাণ্ডাকে আমার ভারি ভয়।

তনুর কথায় রুহুলের কলম সহসা চমকে উঠে স্তব্ধ হয়ে যায়। রুহুল তনুর মুখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। এই দৃশ্যের মাঝে চরের চোরা মাল বওয়া দলটি এসে উঠোনে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে। হইচই করে সাঁজালের চারপাশে গোল হয়ে বসে যায়। বেশিরভাগ আজ ছেলে-ছোকরা। সঙ্গে আরো দুটি মেয়ে। তারা কমবয়েসী কিশোরী। সব ওরা মাঝরাতে ভি পার হবে, সঙ্গে বস্তার বাণ্ডিল। সেই বাণ্ডিল পাছার তলায় ঠেস নিয়ে পিঁড়ি করে চেপে বসে গিয়েছে। ফকির কলমের খাপ বন্ধ করে উঠোনে নেমে আসে।

কাহারপাড়া থেকে হারুডাঙ্গার দূরত্ব এক মাইল। এক মাইল দূরে স্বামী মজলিস করছে। মিজান মৌলবী যুক্তিদাতা, হাদিস কুরানের ঠিকেদার। দু’নম্বরি মালের ব্যবসা করেন না বটে, কিন্তু দাদনের ব্যবসা করেন। ঘোড়াগাড়ি দু’খানা রোজে খাটান সহিস দিয়ে। মসজিদে ইমামতি করেন। এখন গ্রামসভার মেম্বার। ওরা এলে পর কী ঘটনা হতে পারে? মাল আনতে যেতে নিষেধ পাঠিয়েছে। তরকারি পাঠিয়েছে। কিসের যেন খারাপ গন্ধ পাচ্ছে তনু।

তনু এই জীবনখানার ছবি কথায় এঁকেছে। কাহারপাড়াব জীবনে চারপাশে জঙ্গল। ইটভাঁটা। লতানে সবজির মাচা। সব এঁকেছে তনু। কেন এঁকেছে স্পষ্ট জানে না। আসলে আঁকা তো নয়। বুনে ভোলা। একটি গাছের ছবি বুনেছে। একটি গো-সাপ। যাকে সোনাগোরী সাপ বলে। দেখলে গা সিরসির করে। ইটভাঁটার ধূসর বেজি-ও আছে। আছে কালো প্যাঁচা একটা। গাছের নাম কালনাগিনী। সেই কাঁথা গায়ে দিয়ে বসে আছে ফকির। কালনাগিনী গাছ আর সাপের ফণা একই দেখতে। ভয়ংকর। আরো ভয়ংকর এইজন্যে যে, ওটা সাপ নয়। গাছ। দু’নম্বরি দলের সবাই ফকিরকে দেখেছে। কাঁথা দেখছে। কেউ কেউ বেশ ভয় পায়। ফকির কিছুই বুঝতে পারে না।

তনু রুটি বেলে যাচ্ছে। চোখ তুলে তুলে সবার দিকে চায়। ওরা ফকিরকে এই কাঁথায় জড়িয়ে ফেলে দেখছে এখন। কথা যেন ফকিরের গায়ের চামড়া হয়ে গিয়েছে। ওদের চোখে বিদ্বেষ আর ঘৃণা। অথচ ওরা জানে না, ওটা কাঁথা। চামড়া নয়। ফকির শত্রু নয়। সাপখোপ নয়। অরণ্যের প্রাণী নয়। প্যাঁচা নয়। দিনের মানুষ। দিন আর দ্বীন একই কথা। নবীর দ্বীন আর ফকিরের দিন একই কথা। আমরা ফকিরের গায়ে যে কাঁথাখানা দিলাম তার কী অর্থ হয়? তনু ভাবছিল। আমার চারপাশের যে জীবন জড়িয়ে আছে, ফকির জানে না। আমি ফকিরের গায়ে কী জিনিস চাপিয়ে দিলাম ফকির জানতেও পারেনি। তনু ভাবছিল আর তার বুকের ভিতরটা কুলকুল করে কাঁদছিল। ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। রাত্রি বেড়ে যাচ্ছে দণ্ডে দণ্ডে। এক সময় দু’জন কড়কড়ে জোয়ান ছেলেকে সঙ্গে করে মিজান মৌলবী আর হাজমত প্রবেশ করে। ফকির এই জোয়ান দু’টিকে কখনও দেখেনি। কিন্তু দেখেই মনে হল, এবা মানুষ খুন করে। ফকির বুঝতে পারল একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছে। বুঝতে পারল তনুও। বাড়িতে ঢুকেই একটা হুকুম করে হাজমত সাঁজালে অংশীদার হয়। হুকুম করল দু’নম্ববিদের—তোরা চলে যা, আগুন পুইয়ে রাত সাফা করলে মাল আনবি কখন? তনু আজ যাবে না।

দলের একজন সঙ্গে সঙ্গে ছড়া কাটল:

বুক গরম পিঠ কাল্হা

আগুন পোয়ায় কোন শালা।

এ-ভুঁইয়ের বস্তা ও-ভুঁইয়ে ফেলা।

এ-ভুঁই ইণ্ডে, ও-ভুঁই বাংলা।

অতএব আলস্য নাস্তি। চলো হে ওঠা যাক। না। যাবার কথা কেউ বলছে না। একজন কেবল ছড়া কেটেছে। গায়ে তেজ ধরাচ্ছে ঐ ছড়ার মর্ম। উত্তেজনার পয়ার। গা গরমের পুথি বাক্। তনু শেষ রুটি মাটির খোলায় ফুলিয়ে নিতে নিতে বলে—তোরা কেউ যাস নে রে! ফকিরকে খাইয়ে আমি পা চালাব।

তনু ছেলেদের কাছে আবেদন করে ওঠে। ফকির একা। তনু একা। ফকিরের দোতারায় যে বারুদ আছে, তা দিয়ে পশুবধ করা যায় না। নাকি যায়? যদি সেই পশুতে দু’ফোঁটা মানুষ থাকে। সাঁজালের চারপাশে অন্ধকারের চর-বিস্তৃত পদা। সাঁজালের আলো উসকে উঠলে সেই অন্ধকার নড়ে স’রে দু’হাত তফাতে যাচ্ছে। আলো নিবুনিবু হলে সেই আঁধার ফের চেপে আসছে। অন্ধকার আলোর ছুঁই-ছুঁই কোমর জড়িয়ে নড়াচড়ার সাঁওতালী নাচ, তনু দেখলে, কী অদ্ভুত! একটু দূরে তনুর উনান নিবে গেল।

ফকিরের মুখের দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে মিজান মৌলবী বলে ওঠেন—যাবার আগে ছেলেরা একটু গান শুনে যাক, মনটা খানিক খোলতাই হবে। কী বলেন ফকির? একখানা গাইবেন না আপনি? গান হারাম জিনিস, কিন্তু দেহতত্ত্বের গানে আমি বেশ স্বাদ পাই। সেই গানখানা আপনার জানা আছে? ছেলেরা বুঝতে পারছে না, আপনি এখানে কেন আসেন। ওরা আমায় শুধোচ্ছিল দু’দিন আগে। আমি ওদের বলেছি ফকিরের গানেই সেকথা আছে। সেইটে আপনি শুনিয়ে দ্যান বাবাজী।

রুহুল কী করবে বুঝে পায় না। বলে, বলুন কোন্ সেই গান? কার গান? লালনের? মিজান বলেন—না হে বাবাজী! ওরে, কেরামত দাওয়া থেকে দুতারাখানা এনে দে ফকিরকে। উনি গাইবেন। বলছেন। না হে বাবাজী! লালনের নবী-গান নয়। ফটিক গোঁসাইয়ের নারীভজনার গান। রাজশাহীতে যখন ছিলাম, মেহেরপুরের এক ফকিরকে গাইতে শুনেছি। কী যেন সেই কথা! ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ‘সাধু হতে লয় কতজন প্রকৃতির আশ্রয়’।

ভারি সুন্দর কথা। চমৎকার কথা। একেবারে গৃঢ় কথা। গান দেখি, ছেলেরা শুনুক! রুহুল মিজানের আব্দারে রীতিমত গম্ভীর হয়ে গেল। বুঝতে পারছিল, মোড়লির কী অসাধারণ ক্ষমতা এই লোকের। কতদূর ভেবে এসেছে। কেরামত দোতারা এনে ফকিরের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ রুহুলের বুকের মধ্যে কে যেন ভালবাসার আর্তনাদ করে ওঠে। নিজেকে সে মনে মনে বলে—কেন এলে এখানে? তুমিও কি আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছ ফকির? প্রকৃতিকে পেতে গিয়ে কী মূল্য দেবে আজ? সবই কি তোমার ভেসে যাবে? তোমার ধর্ম কি এতই কাঙাল? দোতারা হাতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ফকির। সারা শরীর উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপে উঠল। দোতারা সহসা যেন কেমন আর্তনাদ করে কেঁদে উঠল আঙুলের ধাক্কায়। সবাই উৎসুক। তনু অন্ধকারে চোখ জ্বেলে বসে আছে। দুটি চোখ। তার জ্বলছে। ফকির গেয়ে ওঠে আত্মধিকারে:

“সাধু হতে লয় কতজন প্রকৃতির আশ্রয়।

সাধুর কাম সাগরে বান ডাকিয়ে

প্রেমের পসার ভেসে যায়।”

ফকিরের গায়ে কালনাগিনী কিলবিল করে ওঠে। পেঁচা চোখ বুজে গদগদ। সোনাগৌরী বিষন্ন। গায়ের দোলায় নড়ছে চড়ছে। ফকির গাইছে:

“প্রেমের ওঝা না সাজিয়ে কেন

তোর সাপ ধরা মতি হল?

মস্তকে দংশিলে ফণী

তাগা বাঁধবি কোন জায়গায়?

সাধু হতে লয় কতজন প্রকৃতির আশ্রয়।”

রুহুলের দোতারা আর্তনাদে ফেটে পড়ছে। বিনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। ফকিরের এই দুঃসহ ব্যাকুলতায় তনুর চোখে জল ভরে আসে। ফকির যে পাগল হয়ে গেছে। সাধু থামতেই মৌলবীর কড়া গলার প্রশ্ন—আপনার এই মতি হল কেন ফকির ছায়েব? কেন এলেন এখানে? যাও ছেলেরা, তোমরা উত্তর পেয়েছ, এখন আমাদের কাজ করতে দাও। বলুন ফকির, কার কাছে এলেন আপনি? এ যে মুসলমানের ঘরের বউ? কই হে কিসমত, এবার ওনাকে তাগা দিয়ে বাঁধতে হয় যে। ভেড়ার পশম আর ফকিরের গোঁফদাড়ি খুব মূল্যবান বস্তু। আগে ওনাকে গোস্তরুটি খাওয়াও ;মুসলমানের প্রিয় খাদ্য। সেইটে খেয়ে আপনার হাজামত হবে, কামান হবে। তনু বিটি, তরকারি এনে দাও মা! বাঁজী গাইয়ের গোস্ত। গেরস্ত আগেই পাঠিয়েছে। কই কোথায় রেখেছ?

রুহুল বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দেয়—আপনি দেহতত্ত্ব শুনেছেন মৌলবী সাহেব! জানেন, আমরা গো-মাংসই শুধু নয়, মাছ ডিম কোন আমিষই খাই না।

মৌলবীর প্রশ্ন—কেন খান না?

রুহুল উত্তর করে—শাস্ত্রে লিখেছে খেতে নেই, তাই খাই না এমন নয়। খাই না, শরীরের পক্ষে ওগুলোর দরকার নেই। রক্ত গরম রাখে। মন স্থির হতে দেয় না। তাছাড়া, এই গরু নিয়ে হিন্দু-মুসলমানে বিবাদ করে বলেও খেতে ঘেন্না হয়। গরুমাংস জোর করে খাইয়ে কারুকে মুসলমান করা যায় মনে করেন আপনারা, এই জন্যেই আরো খাই না। মুচিরা এত গরু খেয়ে বেড়াচ্ছে ভাগাড়ে ভাগাড়ে, তবু ওরা মুসলমান হতে পারল না। মুসলমানের সতর পেল না। দেখেছি আমার গাঁ স্বরূপপুরে কোরবানির সময় ওরা মুসলমানের দুয়ারে মাংস ভিক্ষেও করে বেড়ায় কেউ কেউ। তবু আপনারা দয়া করলেন না। হিন্দুরাও তাড়িয়ে দিল। এই জন্য খেতে গেলেই মন খারাপ করে। তাই খাই না। সুরা বাকারায় আছে⋯

মৌলবীর তপ্ত প্রশ্ন—কোথায় আছে?

উত্তর:কোরানে আছে। সুরা বাকারায় আছে। বাকারা মানে গাভী। কিন্তু আমরা বলি অন্য কথা। হিন্দু-মুসলমান বাকারা নিয়ে দ্বন্দ করে। আমরা বলি, গাভীর বর্ণ নানান কিন্তু বিচিত্রবর্ণ গাভী দুইলে দুধের বর্ণ এক।

মৌলভী বলেন—হ্যাঁ গাভী। কী আছে বাকারায়? নানাবর্ণ গাভী?

হাজমত এবার গর্জন করে ওঠে—রাখো তুমার বাকারা। যে মেয়ে গরু খায়, তার কাছে এলে গরু খেতে হবে এই আমার হাদিস, আমাদের হাদিস, মিজানজীর বাকারা। শালা সাধু কোন ডহরে এস্যাছে, তলব জানে না। কেরামত, ক্ষুরে শান দে বেটা। সাধুর সব পশম ঝুড়ে দে বাপ।

মিজানজী স্থির মানুষ। ওদের খানিক নিরস্ত করে বলেন—গোলমাল কোরো না। সব হচ্ছে। আগে শুনি বাকারায় কী বলছে। বলুন বাবাজী! আগুন উসকে দে ছেলেরা।

দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। তার আগেই অন্ধকারে চুপিচুপি তনু ঘরের দরজায় শেকল তুলে তালা এঁটে কোমরের ডোরে চাবি ঝুলিয়ে নেয়।

ফকির বলে—বাকারায় হজরত মুশাকে খোদা নির্দেশ দিয়ে বলছেন, গাভী বধ করো, কেমন গাভী জবাই দেবে তারও বর্ণনা আছে। মুশা সেই নির্দেশ দিচ্ছেন উন্মতকে গাভী বধ করতে হবে, খুব কড়া হুকুম। বোঝা যাচ্ছে, আগে গরু হত্যা হত না। একটা ইতিহাস আছে মিজানজী।

মৌলবী বললেন—ঠিকই বলেছেন, কড়া হুকুম। তাই গরু খেয়ে মুসলমান হলে খোদা খুশি হয়। আর মুচিরা তো মরা গরু খায় সাধুবাবা, সেইটে হালাল নয়। স্বাস্থ্যসম্মত নয়। না হলে বাকারায় বধ করার নির্দেশ হত না। সেটা কুরবানী।

ফকির বলব না ভেবেও বলে ফেলে—কিন্তু আপনারা কি জবাই করার পর তাজা গরু খান? হলই বা কুরবানী। জীবন্মুত গরুর মাংস মুচিরাও খায় না। ভাগাড়ের সব গরুই টানাটানি করে না। ওরাও দেখেশুনেই খায়। তা তাজা গরু খেলেই কি একটা মানুষ⋯

—এহ্ শালা!

দুই জোয়ানের একজন কেরামত। গর্জন করে ক্ষুর নিয়ে তেড়ে এসে সাঁজালে বসে থাকা ফকিরকে অকস্মাৎ পেছনে টেনে চিত করে বুকে চেপে বসে। জোয়ানের দ্বিতীয় জন কিসমত দড়ি দিয়ে ফকিরের দুই পা বেঁধে ফেলে। কেরামত গলায় ক্ষুর তাক করে থাকে। পেছনে দু হাত বাঁধা হয় তারপর। বুকে ওদের ফকিরের কথা ধক করে বিধেছে। কারণ মুচিরা তো চটে বসে পূজামণ্ডপের মাটিতে হরসন ঢোল কাঁসি বাজায়।

মৌলবী বলেন—বেশ তাগা বাঁধা হল। প্রকৃতি খায়, মরাই তোক আর তাজাই হোক, পুরুষও খাবে এবার। মা তনু বিটি নিয়ে এসো মা। নিজে হাতে মুখে তুলে একটু খাইয়ে যাও। আমরা ভিনজাতির মেয়ে শাদী করে ধর্ম শেখাই। আর এ-শালা ফকির ওর ধর্মে সেই মেয়েকে টেনে নিয়ে যাবে? নিয়ে এসো মা।

তনু জবাব দেয়—ঐ মাংস আমি ফেলে দিয়েছি।

হাজমতের মাথায় খুন চাপে। বলে—ফকির এস্যাছে শুনেই গরু জবাই হল তনু। তুই সেই গোস ফেলে দিলি?

তনুর দিকে এগিয়ে যায় হাজমত। হাতে গরুর গাড়ির ‘সিমলে’। (জোঁয়ালের ফুটোর মোটা পাকানো লাঠি, খাটো মতো।)

বসে থাকা তনুর পা দু’খানার একটি খপ করে চেপে ধরে আচমকা প্রহার করে তীব্র। তনু চিৎকার করে ওঠে। হাজমত বলে—চাবি ফেলে দে, ঘরে গোস আছে। দে হারামজাদী, আজ দুই তালাকের রাত। চাই কি, বাধা দিলে, এই রাতেই তিন তালাক হয়ে যাবে।

ফকিরের গোঁফদাড়ি দেখতে দেখতে কাটা হয়। মাথার চুল কেটে দেয়। তনু মার খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে যায়। ফকিরকে তাবত দল হইচই করে কোথায় তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে জ্ঞান হারাতে হারাতে তনু দেখতে পায়। তারপর সম্পূর্ণ চৈতন্য হারিয়ে ফেলে। অচৈতন্য দেহকে আঁধার দাওয়ায় তুলে সবাই চলে গেলে হাজমত ধর্ষণ করে। তারপর কানের কাছে মুখ রেখে বলে—তালাক!

জ্ঞান ফিরে পেতে পেতে সময় বহে গিয়েছে। মধ্যরাত্রি এসেছে উঠোনের আকাশে। কানের কাছে গুনগুনিয়ে বেজে চলেছে: ‘সাধু হতে লয় কতজন প্রকৃতির আশ্রয়’। সহসা অন্ধকারে তনুর মুখ কঠিন হয়ে ওঠে। আকাশে চায়। অজস্র নক্ষত্রখচিত আকাশ। অন্ধকার। বুঝতে পারে, সবাঙ্গ অবশ। পা। তুলতে পারে না। ফকিরের দাড়ি গোঁফ কামানো করুণ মুখ চোখে ভাসে। ফকির আশ্রয় চেয়েছিল। ফকির কি বেঁচে আছে? ফকির অত দৃঢ় হয়েও ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল। দুটি চোখ ছলছল করে উঠেছিল। সামান্য বাধা দিয়েছিল বলে এলোপাথাড়ি ঘুষি চালিয়ে যাচ্ছিল। কিসমত মাথার চুলকে খামচে ধরে ক্ষুর চালানোর সুবিধা করে নিতে টেনে সিধে করছিল বারবার। ফকির ডুকরে উঠেছিল। ফকিরকে ওরা নেড়া করে দিয়েছে, তখনও ওর চোখের জল সাঁজালের আলোয় চিকচিক করছে। দাড়ি গোঁফ সাফ হয়ে গেলে ফকির ঘাড় নিচু করে রইল। লজ্জায় বেদনায় চোখ তুলতে পারছে না। চোখ দিয়ে নিঃশব্দে টপটপ করে জল পড়ল চার ফোঁটা। কিসমত ফের চুল আঁকড়ে খামচালো। অস্ফুট ডুকরালো ফকির। চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। সেই চোখে চোখ পড়ল তনুর। হাজমত তনুর পায়ে গাঁটে সিমলের আঘাত করল আবার। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তনু যন্ত্রণা দমন করে। জানে, এরা কোন কথা শুনবে না। সাধ মিটিয়ে মারবে, অপমান করবে। হাজমত চাবি চাইছে। তনু বলল—চাবিখানা অন্ধকারে কোথায় পড়ে গিয়েছে। হাজমত বিশ্বাস করল না। গাঁটে তীব্র যন্ত্রণা দিতে লাগল। ফকিরের ঝাপসা দুই চোখ ক্রমশ দৃষ্টিক্ষমতার বাইরে হারিয়ে যেতে লাগল। চেতনা লুপ্ত হয়ে গেল। সবাই ফকিরকে চ্যাং করে তুলে নিয়ে বাইরে চলে গেল। দুটি অপমানিত অশ্রু-আছন্ন চোখ আশ্রয় চেয়ে অন্ধকারে চলে গেছে। মনে মনে বলল তনু——কখনও এভাবে এসো না ফকির। কখনও এভাবে মুচি মেথর করে কথা বোলো না। সোনার মানুষ তুমি কোথায় পাবে, মানবজমিন সব যে এই আঁধারে উরানবিবান হয়ে গিয়েছে, সাধু গো!

তনু উঠোনে বহুকষ্টে লেংচে নেমে আসে। উঠোন পেরিয়ে আসে। সহসা ‘খালা গো’ শুনে ভয়ে চমকে ওঠে। রছুল। রছুল বাড়িতে ঢোকার মুখে বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রছুল বলে—চরের উদিকে সাদু পড়ে আছে খালা! বাঁদন খুলা যায়নি। একখন অসতর লিয়ে যাও। আমি পালাই।

রছুল অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। তনু লেংচে লেংচে চরের অন্ধকারে নেমে পড়ে। ফকিরকে চরের অন্ধকারে খুঁজে পায় অনেক দূর এসে। ভি-পয়েন্টের উপর। ধড় এপারে মুণ্ডু ওপারে। ফকিবের কাছে এসে তনু হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। কতক্ষণ কথা বলতে পারে না। ফকির বলে—বাঁধন খোলো তনু। আমাকে মুক্ত করো। ওরা চিরকাল এম্নি করে মেরেছে আমাদের। ফেলে দিয়েছে। আমরা এইরকমই আঁধারে লুকিয়ে ফিরেছি তনু। চলে যাওয়া যাক।

—কোথায় যাব ফকির? তনু কাতর প্রশ্ন করে। বলে—আমি যে চলতে পারি না। ফকির তনুকে ঘাড়ে তুলে নেয়। বলে—দোতারা এনেছ?

—হ্যাঁ।

কাঁথা?

—ওটা বোধ হয় হাজমত গায় দিয়ে গেছে। পশুপাখির নকসি।

ফকির পুব-দিগন্তে সূর্যোদয়ের পথে হাঁটছে। তনুর রক্তমাখা পায়ে তার জামা ধুতি ঘষা লেগে ভিজে যাচ্ছে। বাঁ বুকের কাছে যেখানে কালেবুল মোমিনো আরশ্ইল্লাহে তালা, খোদাব সিংহাসন, সেখানে নূরের বাতি উদ্ভাসিত। টলতে টলতে ফকির এগিয়ে চলেছে। কাঁধে তার দোতারা ধরে আছে তারই প্রকৃতি। পুব-দিগন্তে ঊষার কুসুমে ভোর হয়ে আসছে।

১৩৯৩ (১৯৮৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *