1 of 2

অন্ধকার – কল্লোলকুমার দত্ত

অন্ধকার – কল্লোলকুমার দত্ত

এক

চাঁদমোহন চ্যাটার্জিকে কোনওদিনই প্রতুল সুনজরে দেখতে পারেনি।

পাশের বাড়িতেই লোকটা থাকে। রেসের বুকমেকারি বা বাড়ির দালালি—এইরকম একটা কিছু পেশা। পোশাক-পরিচ্ছদে অতি উগ্র আধুনিক, আহারে-বিহারে একেবারে ইংরাজ-ঘেঁষা। নিত্য রাতেই তার বাড়িতে হয় পার্টি, নয় জলসা লেগেই থাকত। হইচই এবং চিৎকারে কত বিনিদ্র রজনী যে প্রতুলকে বসেই কাটাতে হয়েছে!

সেগুলো চট করে ভোলবার নয়; এবং নয় বলেই লোকটাকে দরজা-গোড়ায় এসে দাঁড়াতে দেখে, সে সুস্পষ্ট বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল, এখন আমি খুব ব্যস্ত…অন্য সময় আসবেন।

চাঁদমোহন কিন্তু নাছোড়বান্দা। কাকুতির সঙ্গে বলল, বড্ড দরকার স্যার, বিশেষ জরুরি। পাঁচমিনিটও লাগবে না…।

তারচেয়েও অনেক বেশি সময় ব্যয় হবে লোকটাকে বিদায় করতে। সুতরাং রাজি হওয়াই প্রতুলের বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হল। তাকে ঘরে এনে বলল, কিন্তু যত সংক্ষেপে পারেন, শুধু বক্তব্যটুকুই বলে যান—কোনও গৌরচন্দ্রিকা নয়।

চাঁদমোহন কৃতার্থ হয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, যে আজ্ঞে। আপনি তো স্যার পুলিশে কাজ করেন, তাই না?

ভুল শুনেছেন আপনি। পুলিশে কেন, কোথাও কাজ করি না আমি। কিন্তু কী বলতে চান…?

বাধা দিয়ে চাঁদমোহন বলে উঠল, না-ই করুন, কিন্তু রোজই তো লালবাজারে যান?

তা যাই! কিন্তু কেন বলুন তো?

সেখানে কোনও বন্ধু বা বিশেষ জানাশোনা নিশ্চয়ই কেউ আছে?

জেনে আপনার লাভটা কী?

বলছি, স্যার, বলছি।

একটু থেমে বারকয়েক ঢোক গিলে চাঁদমোহন আবার বলল, আমার বাড়িতে কাল সিঁধ দিয়েছিল। পাশের বাড়িতে আমার এক বন্ধু থাকে বিক্রম বলে—বোধহয় তাকে দেখে থাকবেন, তার ঘরেও বাদ যায়নি, এমনকী আমার ভাই রাইমোহনের ঘরেও…।

তাকে শেষ করতে না দিয়ে প্রতুল কৌতুকের স্বরে বলে উঠল, পাইকারিভাবে তা হলে সিঁধ দেওয়া হয়েছে বলতে চান? তা আমাকে না বলে একটু দূরেই তো থানা আছে, সেখানে গিয়ে খবর দিন।

চাঁদমোহন অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল, কিন্তু আপনি ঠিক ব্যাপারটা বুঝছেন না, স্যার! মুশকিল হচ্ছে কি, খবর দেওয়ার মতো কিছু নেই কি না…।

মানে?

মানে কিছুই নিয়ে যায়নি। কাজেই নেয়নি যখন, তখন আর থানায় খবর দিয়ে কী হবে!

প্রতুল এবার সত্যিই বিস্ময় বোধ করল। বলল, কিছুই নেয়নি? আশ্চর্য!

চাঁদমোহন তার কথার প্রতিধ্বনি করে বলে উঠল, ঠিক বলেছেন, স্যার, আশ্চর্য! সেইজন্যেই তো বলছি, লালবাজারে গিয়ে যদি আপনার কোনও জানাশোনা লোককে বলে দেন…।

বলতে অবশ্য ইন্সপেক্টর আনন্দমোহনকে পারি। কিন্তু তাতে লাভ হবে কি কিছু? যদি কিছু চুরি যেত, তা হলে না হয়…।

চাঁদমোহন ক্ষোভের সুরে বলল, যদি কিছু চুরিই যেত, তা হলে আমি ভয় পেয়ে আপনার কাছে ছুটে আসতুম না! সমস্তটা কেমন যেন গোলমেলে। রহস্যটা কী, যদি আপনার বন্ধু আনন্দবাবু আবিষ্কার করতে পারেন! বুঝতেই তো পারছেন, শত্রুর আমার অভাব নেই…।

উঠে দাঁড়িয়ে প্রতুল তাকে বিদায় দেওয়ার জন্য বললে, বেশ, লালবাজারে গেলে আমি আনন্দবাবুকে বলব। যদি তাঁর কিছু করবার থাকে, করবেন!

অজস্র ধন্যবাদ জানিয়ে রেসের দু-একটা ‘শিয়োর টিপের’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাঁদমোহন অতঃপর বিদায় নিল।

ঘটনাটাকে কিন্তু প্রতুল অত সহজে মন থেকে ছেঁটে ফেলতে পারল না। ঘরে-ঘরে চোর সিঁধ দিল, অথচ কোনও জিনিসই অপহৃত হল না। এর কারণ কী? যে সিঁধ দিয়েছে, সে তা হলে কী চেয়েছিল? টাকা? কোনও দলিল? কিংবা…।

কতক্ষণ পর এই কথাগুলো ভাবতে-ভাবতে প্রতুল লালবাজারে এসে হাজির হল।

ইন্সপেক্টর আনন্দমোহন নিজের ঘরেই ছিলেন। দেখে মনে হল, খুব ব্যস্ত! তবু একফাঁকে প্রতুলের দিকে তাকিয়ে লঘুকণ্ঠেই প্রশ্ন করলেন, কী খবর? মেঘ না চাইতেই জল যে!

চেয়ারের ওপর চিন্তিত মুখে বসে পড়ে প্রতুল জবাব দিল, ব্যাপারটা গুরুতর নয়। তবু মনে হচ্ছে, আপনার কিছু কাজে লাগবে। আমার বাড়ির পাশেই চাঁদমোহন চ্যাটার্জি বলে এক ভদ্রলোক থাকেন। একটু আগেই এসে তিনি জানিয়ে গেলেন, কে বা কারা তাঁর ঘর, তাঁর ভাইয়ের ঘর, এমনকী তাঁর বন্ধুর বাড়িতেও সিঁধ দিয়ে তছনছ করে গেছে। অথচ মজা হচ্ছে, কোনও জিনিসই চুরি যায়নি।

আনন্দমোহনের মুখখানা অকস্মাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। ধীরে-ধীরে তিনি বললেন, আবার আপনিও এই খবর নিয়ে এসেছেন? শুধু আপনার প্রতিবেশীই নয়, প্রতুলবাবু, গত তিন-চার দিনে অন্তত বিশজন জানিয়ে গেছেন যে, তাঁদেরও ঘরে সিঁধ পড়েছে।

সংবাদটা চিত্তাকর্ষক সন্দেহ নেই। প্রতুল আগ্রহভরে জিগ্যেস করল, এসবের পেছনে রহস্যটা কী আপনি বলতে পারেন?

মাপ করতে হবে।

আপনার কি মনে হয়, কোনও জরুরি দলিল বা কাগজ বা নকশা…।

আনন্দমোহন কাঁধ দুলিয়ে বললেন, হতেও পারে, কে জানে! হয়তো সমস্তগুলোই একটা দলেরই কাজ।

আমারও তাই মনে হয়।

যাই হোক, চুপ করে থাকা আর চলবে না। একটু বেয়ে-চেয়ে দেখতে হবে। ইত্যবসরে…।

ফোন বেজে উঠে আনন্দমোহনের বক্তব্যে বাধা দিল। তিনি রিসিভারটা তুলে নিয়ে বললেন, হ্যালো…।

ধীরে-ধীরে তাঁর মুখখানা কালো হয়ে উঠল। কপালের শিরা দুটো হয়ে উঠল স্ফীত। উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বললেন, আচ্ছা, কিন্তু কেউ যেন কোনও জিনিস না ছোঁয়, কিংবা আমি না যাওয়া পর্যন্ত বাড়ি থেকে না বেরোয়।

সশব্দে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে তিনি প্রতুলের দিকে ফিরে তাকালেন। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যই বোধকরি প্রশ্ন করলেন, কী নাম আপনার প্রতিবেশীটির—যাঁর নাম এইমাত্র বলছিলেন?

চাঁদমোহন চ্যাটার্জি। কিন্তু কেন?

তিনি মারা গেছেন। বোধহয় খুনই।

দুই

অসহ্য বিস্ময়ে প্রতুল চমকে উঠল। তার হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা আর-একটু হলেই ফসকে পড়ে যেত। ভ্রু দুটো কুঁচকে কতকটা আপনমনেই সে বলল, এই কিছুক্ষণ আগেই—আধঘণ্টাও হয়নি, তার সঙ্গে আমি যে কথা বলেছি! কে…।

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আনন্দমোহন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসবেন নাকি, প্রতুলবাবু, আমার সঙ্গে?

গভীর আগ্রহভরে প্রতুল বলল, নিশ্চয়ই! চলুন—।

পথিমধ্যে আনন্দমোহন ফোনে-পাওয়া সংবাদটির বর্ণনা প্রসঙ্গে বলে চললেন, চাঁদমোহন তাঁর অফিসঘরে ঢোকার মিনিটদশেক পরেই নাকি দেখা যায়, তিনি টেবিলের ওপর ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন। ঘটনাটা ঘটবার একটু আগেই তাঁর ঘরে একটি লোক ঢোকে—অবশ্য তাঁরই কর্মচারী…।

সন্দেহসূচক কণ্ঠে প্রতুল বলে উঠল, আপনার কি মনে হয়, ওই লোকটিই…?

তাঁকে খুন করেছে!—বাধা দিয়ে আনন্দমোহন বললেন, তাও হতে পারে। তবে ওখানে না গিয়ে, কিছু না দেখার আগে তো আর কিছু বলতে পারি না…।

ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাঁরা দেখলেন, স্থানীয় একজন কনস্টেবল বাড়ির দরজায় পাহারায় নিযুক্ত। গম্ভীর স্বরে আনন্দমোহন তাকে জিগ্যেস করলেন, এখান থেকে কেউ পালায়নি, বা পালাতে চেষ্টাও করেনি?

নমস্কার জানিয়ে কনস্টেবলটি বললে, আজ্ঞে না, পালায়নি কেউই; তবে পালানোর চেষ্টা করেছিল—তাকে ধরে রাখা হয়েছে। আমি তার নাম-ঠিকানা লিখে রেখেছি।

কথাশেষে সে পকেট থেকে একখানা খাতা বের করে, বারকয়েক তার ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে মুরুব্বিয়ানা চালে বলল, লোকটার নাম ত্রিবান্দম ভাণ্ডারী; ঠিকানা ১৩ নম্বর কটু ঘোষাল স্ট্রিট।

বাড়ির ভেতর ঢুকতে-ঢুকতে আনন্দমোহন প্রতুলের পানে ফিরে বললেন, এ-নামটা আমার যথেষ্ট পরিচিত। যদ্দূর মনে হয়, এ-ই আমাকে ফোনে খবর দেয়।

একসঙ্গে তিন-চারটে সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে তাঁরা দ্বিতলে উঠে এলেন। দু-ধারে সারিবন্দি ঘরের একটাতে দেখা গেল, দরজায় পিতলের ফলকে লেখা :

চাঁদমোহন চ্যাটার্জি

সশব্দে দ্বারটা খুলে ফেলতেই প্রতুল দেখল, ঘরখানা বেশ বড়ই। তবে তিন পিস কাঠ দিয়ে সেখানাকে গোটাকয়েক ছোট-ছোট অংশে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। কোনওটায় লেখা ‘অফিস’, কোনওটায় বা ‘প্রাইভেট’।

দরজার সামনেই যে-অংশটা—সেখানে জনকয়েক লোক সগর্জনে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল। দেখে মনে হয়, মুহূর্তকয়েকের প্রতীক্ষায় যেন তাদের লক্ষ-লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।

প্রতুল আর আনন্দমোহনকে দেখে তারা সমস্বরে চিৎকার করে ছুটে এল : আমাদের এভাবে আটক রাখার মানে? আমরা কি বুনো জানোয়ার? না এটা মগের মুলুক যে, যা মনে করেন, তাই করবেন?

তাদের এই অভদ্রোচিত কথায় ক্রোধে আনন্দমোহন ফেটে পড়বার উপক্রম হলেও এগিয়ে যেতে-যেতে তিনি যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত করে নিয়েই বললেন, আপনাদের মধ্যে ত্রিবান্দম ভাণ্ডারী কার নাম?

ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি শীর্ণকায় লোক বেরিয়ে এসে বলল, আমার নাম। কিন্তু কেন বলুন তো?

তার আপাদমস্তক একবার তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে আনন্দমোহন বললেন, সামান্য দু-চারটে কথা আছে আপনার সঙ্গে। আশা করি…।

কোনও কৌতূহল প্রকাশ না করেই ত্রিবান্দম বলল, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই!

কিছুক্ষণের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে বলে আনন্দমোহন ‘প্রাইভেট’ চিহ্নিত অংশটায় প্রবেশ করলেন।

মেহগনি কাঠের তৈরি মসৃণ একখানা টেবিলের ওপর চাঁদমোহন মুখ গুঁজড়ে পড়ে ছিল। হাত দুখানা দৃঢ়ভাবে মুষ্টিবদ্ধ। তারই নীচে মেঝেয় কতকটা রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে।

ঘরের চারধারে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কাগজপত্র। কোনওটা ব্যবসা-সংক্রান্ত চিঠি, কোনওটা বিল, কোনওটা বা চালান।

মৃতদেহের পানে কতক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে একসময় আনন্দমোহন বললেন, পিছন থেকে তীক্ষ্নধার ছুরিখানা এমনভাবে ছোড়া হয়েছে যে, বুক ভেদ করে সেটা চলে গেছে।

প্রতুল কিন্তু তাঁর কথার কোনও প্রত্যুত্তর করল না। সে তখন চারদিকে ছড়ান কাগজপত্রগুলো বাছতে শুরু করে দিয়েছে—কোনও সূত্রের আশায়। অকস্মাৎ আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে একখানা কাগজ আনন্দমোহনের পানে এগিয়ে দিয়ে সে খুশিভরা কণ্ঠে বলে উঠল, এই দেখুন আনন্দবাবু…।

প্রতুলের হাত থেকে আনন্দমোহন কাগজখানা একরকম ছিনিয়েই নিলেন। দেখলেন, চাঁদমোহন তাঁর ভাই রাইমোহনের উদ্দেশে লিখেছে আমি ভয়ার্ত…।

কথাটা শেষ হয়নি! শুধু তলায় কতকগুলো কালির আঁচড়—শিশুর হাতে আঁকা ছবির মতো।

সন্দেহের সুরে প্রতুল বলল, আমার মনে হয়, চাঁদমোহন যখন লিখছিলেন, তখন তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

কথাশেষে সহসা টেবিলের তলায় লক্ষ্য পড়তেই সে দেখল, একটা কলম পড়ে। সেটা তুলে নিয়ে সে আবার বলল, এই দেখুন, আরও একটা মস্ত প্রমাণ। হাত থেকে খসে পড়ে কলমের নিবটা একেবারে ভোঁতা হয়ে গেছে।

আলোর সামনে হাতের কাগজখানা মেলে ধরে, সেটার ওপর একবার তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আনন্দমোহন বললেন, এই যে, কতকগুলো ফুটোও আছে এখানে। তা হলে আমাদের ধারণাটা…।

মুখখানা তাঁর গম্ভীর হয়ে গেল। মৃতদেহের পানে তাকিয়ে, কী একটা কথা মনে হতেই তিনি আবার বললেন, দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে ইনি তো বসেছিলেন; তবে ছুরিটা পিঠের ওপর বিদ্ধ হল কী করে…?

প্রতুল তাঁর কথা কেড়ে নিয়ে বলল, হয়তো হত্যাকারী এঁর সামনে দিয়েই ঘরে ঢোকে। তাকে দেখবামাত্র ভয় পেয়ে কাগজের ওপর কথাটা লিখতে গিয়ে মাঝপথে মারা পড়েন।

অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিটা একবার ঘরের চারপাশে বুলিয়ে নিয়ে আনন্দমোহন ত্রিবান্দমকে ডাক দিলেন।

ডাক শোনামাত্র কেন জানি না, ত্রিবান্দমের মুখখানা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল। তত্রাচ নিজেকে সংযত করে নেওয়ার জন্য গলাটা একবার ঝেড়ে নিয়ে, এগিয়ে এসে বললে, বলুন স্যার, যা বলবার…।

কঠিন কণ্ঠে আনন্দমোহন প্রশ্ন করলেন, চাঁদমোহনবাবুর মৃতদেহ কখন আপনার চোখে পড়ে?

ত্রিবান্দম চুপ করে রইল।

প্রবলভাবে কাঁধটা নাড়া দিয়ে আনন্দমোহন আবার বললেন, কই, বলুন?

বলছি, স্যার, বলছি। মিস্টার চ্যাটার্জি আজ দুটো বাজার পরে এসেছেন…।

অন্যদিন কখন আসেন?

অন্যান্য দিন আসেন ঠিক দশটায়। কোনওদিন বা দু-পাঁচমিনিট আগেও এসে পড়েন। তবে দেরি একদিনও হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

তা হলে হঠাৎ আজ ব্যতিক্রম ঘটল কেন?

সে সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। তবে আজ তাঁকে একটু বিরূপ দেখেছিলাম। তার খানিক বাদেই আমি এই অবস্থায় দেখি।

কথার ফাঁকে প্রতুল লক্ষ করছিল, ত্রিবান্দম কাঁপছে—বোধকরি বা ভয়ে। সে প্রশ্ন করল, তখন আন্দাজ ক’টা?

চাপা স্বরে ত্রিবান্দম বলল, আড়াইটে নাগাদ।

আপনি কী কারণে তাঁর ঘরে ঢুকছিলেন? তিনি কি ডেকে পাঠিয়েছিলেন, না অন্য কোনও কারণে…।

পরের রেসের জন্যে যে-টাকা সংগ্রহ হয়েছিল, আমি সেটা কোথায় রাখব, জিগ্যেস করতে গিয়েছিলাম।

আচ্ছা, এই আধঘণ্টার মধ্যে আর কেউ তাঁর ঘরে ঢুকেছিলেন?

নিশ্চয়ই! সবসময়েই তাঁর ঘরে লোক যাওয়া-আসা করে। মিস্টার চ্যাটার্জি অত্যন্ত সাদাসিধে, সরল মানুষ ছিলেন। তাই কারও সঙ্গেই গল্পগুজব করতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করতেন না। আজকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ লোককেই সুনজরে দেখতে পারা যায় না। তাঁরা এসেছিলেন টাকা ধার করতে।

পেয়েছিলেন কি?

মাথা নেড়ে ত্রিবান্দম বলল, কেউ পেয়েছেন, কেউ পাননি। আর কিছু আমি জানি না, আমি তখন বড্ড বেশি ব্যস্ত ছিলাম কাজে।

তার শেষের কথাগুলোতে আনন্দমোহন একটু রুষ্ট হলেন বলেই মনে হল। ক্রোধ-কম্পিত স্বরে তিনি বললেন, তবে আপনি এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কেন?

ত্রিবান্দমের মুখখানায় মৃত্যু-পাণ্ডুরতা ফুটে উঠল। আমতা-আমতা করে কোনওরকমে বললে, আমি—আমি—মানে আমার স্ত্রীকে ফোন করতে গিয়েছিলাম।

ছুরির তীক্ষ্ন ফলার মতোই ঠোঁটের ফাঁকে একটুকরো হাসি টেনে এনে আনন্দমোহন বললেন, স্ত্রীকে ফোন করতে চেয়েছিলেন, না সোজা লালবাজারে খবর দিয়েছিলেন? কোনটা?

শুকনো ঠোঁটটায় বারকয়েক জিভটা বুলিয়ে নিয়ে ত্রিবান্দম বলল, আমি—আমি—মানে—আমার…।

ধমক দিয়ে আনন্দমোহন বললেন, তা হলে আপনিই তাঁকে খুন করেছেন, কেমন?

বাঁশপাতার মতোই ত্রিবান্দমের দেহটা বারকয়েক কেঁপে উঠল। কপালে দেখা দিল বিন্দু-বিন্দু ঘাম। তত্রাচ প্রতিবাদ জানিয়ে সে বলল, আমি খুন করেছি, কে আপনাদের বলল? তাঁর ওপর আমার কোনও রাগ নেই, বা আমিও তাঁকে আর কোনওরকম ঘৃণা করি না…।

মৃদু হেসে প্রতুল কৌতুকের স্বরে বলল, আপনি তা হলে স্বীকার করছেন যে, আগে তাঁকে ঘৃণা করতেন?

কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান সাক্ষীর মতোই শুষ্ক কণ্ঠে ত্রিবান্দম বলল, আপনারা আমাকে এমন থতমত খাইয়ে দিচ্ছেন যে, আমি কী বলছি, তা আমি নিজেই জানি না…।

তা হলে আপনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কেন?

আমি—মানে—ভয় পেয়ে…।

হাতঘড়িটার পানে একবার তাকিয়ে আনন্দমোহন বললেন, তা হলে আপনাকে একটু কষ্ট করে যেতে হবে…।

কোথায়?

এই—একটু লালবাজারে।—পরক্ষণেই অপর লোকগুলিকে উদ্দেশ করে আনন্দমোহন বললেন, আপনাদেরও একটু কষ্ট করতে হবে। যতক্ষণ না এই ব্যাপারে কিছুটা নিশ্চিত হতে পারছি, ততক্ষণ আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে। কী করব বলুন, আমার করবার কিছু নেই।

তাঁর কথাই বহাল রইল। ত্রিবান্দমকে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হল। বাকি লোকগুলিকে ওই বাড়িরই একতলায় একখানা ঘরে পুরে কনস্টেবল-পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল।

প্রতুল বলল, আপনার কি মনে হয়, আনন্দবাবু যে, ত্রিবান্দম এ-খুনের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িত আছে?

ঠিক বলা যায় না। তবে লোকটা খুনির সম্বন্ধে যে কিছু জানে এবং সে-কথা আমাদের কাছে গোপন করেছে, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। আমার মনে হয়, চাঁদমোহন তাঁর ঘরে ঢোকার আগেই হত্যাকারী সেখানে কোথাও লুকিয়েছিল। আর সে-কাজে তাকে সাহায্য করেছে ত্রিবান্দমই।

লুকিয়েছিল? কোথায়?

ওই ঘরেই। আপনি অত লক্ষ করেননি। একপাশে একটা পরদার আড়ালে একখানা চাবি-দেওয়া ছোট ঘর আছে। সেখানেই সে লুকিয়েছিল। অবশ্য এটা আমার নিছক অনুমান।

পুনরায় মৃতদেহের ঘরে এসে আনন্দমোহন দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর শুরু করলেন তীক্ষ্ন অনুসন্ধান। মৃতের জামার পকেটগুলো হাতড়ে প্রথমে বের করলেন কিছু খুচরো টাকা-পয়সা, তারপর একখানা ডায়েরি, তারপর বের হল একথোলো চাবি।

তার মধ্যে থেকে একটা চাবি বেছে নিয়ে পরদার আড়ালের দরজাটা খুলে ফেলে বললেন, এই দেখুন, প্রতুলবাবু, এই ঘরখানার কথা বলছিলাম।

আসবাবহীন ঘরখানার চারদিক লক্ষ করতেই দেখা গেল, মেঝের ওপর দু-পাটি জুতোর দাগ। কাদাসমেত নিশ্চয়ই কেউ এখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিল।

উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আনন্দমোহন বলে উঠলেন, দেখুন, প্রতুলবাবু, যা ভেবেছিলাম, অক্ষরে-অক্ষরে ফলে গেছে। জুতোর ছাপ…।

বাধা দিয়ে প্রতুল বলল, কিন্তু চাবিবন্ধ ঘরে ঢুকল কী করে লোকটা?

হত্যা করার আগে যেমন করেই হোক, হত্যাকারী দরজাটা খোলে এবং সময়মতো এখান থেকে বেরিয়েই কাজ সেরে সে সরে পড়েছে। তবে এমনও হতে পারে যে, ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় এমনভাবে সেটা বন্ধ করেছে যে, ‘টেপা-কলটা’ আটকে গেছে।

ডায়েরি থেকে প্রতুল তেমন কিছুই পেল না। পাতার পর পাতা ওলটাতে-ওলটাতে একসময়ে রাইমোহনের ঠিকানাটা বের করে সে বলল, অতঃপর আমাদের এখানেই যেতে হবে। আমার মনে আছে, সিঁধ দেওয়ার ব্যাপারে চাঁদমোহন তাঁর ভাই রাইমোহনের নামটাও উল্লেখ করেছিলেন।

মৃতদেহ একজন পুলিশের হেফাজতে রেখে প্রতুল আনন্দমোহনকে সঙ্গে করে রাইমোহনের বাড়ির উদ্দেশে পথে নেমে পড়ল।

ডোভার লেনে আরও পাঁচখানা হালফ্যাশনের বাড়ির চেয়ে রাইমোহনের ফ্ল্যাট বাড়িখানা উচ্চতায় এবং দৈর্ঘ্যে বেশ বড়। ভিতরে ঢুকতেই সামনে লিফট। আর যাই হোক, ভাড়াটেদের সুবিধের জন্য বাড়ির মালিক যে দয়া করে এটা করে দিয়েছেন, এজন্য তাঁকে সত্যিই ধন্যবাদ জানাতে হয়।

বাড়িখানার চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে প্রতুল লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল। কিন্তু কাউকেই না দেখতে পেয়ে নিজেই লিফট চালিয়ে দ্বিতলে উঠে এল।

ঘরের পর ঘর দেখতে-দেখতে তারা দরজায় পিতলের ফলকে ‘রাইমোহন চ্যাটার্জি’ লেখা ঘরখানার সামনে এসে দাঁড়াল। কলিংবেলটা চোখে পড়তেই প্রতুল সেটা সজোরে টিপতে লাগল।

মিনিটপাঁচেক ক্রমাগত টেপবার পরেও যখন ভেতর থেকে কোনও সাড়া পাওয়া গেল না, তখন তারা ফিরে যাওয়ারই উপক্রম করল।

সিঁড়ির প্রথম ধাপে সবে পা দিয়েছে, এমনসময় সশব্দে দরজাটা খুলে গেল।

কতকটা চাঁদমোহনের মতোই দেখতে একজন লোক বেরিয়ে এল। কোনও কথা বলবার অবসর তাকে না দিয়ে আনন্দমোহন প্রশ্ন করলেন, আপনারই নাম কি রাইমোহন চ্যাটার্জি? চাঁদমোহনবাবু…।

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই অকস্মাৎ লোকটি অব্যক্ত এক আর্তনাদ করে মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল।

তিন

পুনরায় বিস্ময়ের পালা!

এক লহমার জন্য উভয়ে উভয়ের পানে বিস্ময়-বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। পরক্ষণেই আনন্দমোহন মৃতদেহের ওপর ঝুঁকে পড়ে, লক্ষ করে বললেন, এঁকেও ছুরি মারা হয়েছে। আমরা বড্ড দেরি করে ফেলেছি।

প্রতুল বলল, আপনি কি মনে করেন, খুনি এখনও এই বাড়িতে আছে?

ঘরের ভেতর এগিয়ে যেতে-যেতে আনন্দমোহন বললেন, আমরা লিফটে চড়ে ওপরে আসার সময়ই সে সরে পড়েছে। তবুও একবার…।

কথাটা অসমাপ্ত রেখেই তিনি শুরু করলেন অনুসন্ধান। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, কিন্তু না, কারও ছায়াটুকু পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হল না।

ঘরটা দেখে মনে হয়, কিছুক্ষণ আগেই সেখানে যেন একটা প্রবল ঝড় বয়ে গেছে। টেবিলের কাগজপত্র এধার-ওধারে ছড়ানো, হাতলবিহীন চেয়ারগুলো, পিতলের ফুলদানি দুটো স্থানভ্রষ্ট, আলমারির কাঁচগুলো শতফালি, এমনকী জানলার পরদাটাও শতটুকরো হয়ে একপাশে পড়ে রয়েছে। সকলের চেয়ে বিস্ময়কর—মেঝের ওপর কার্পেটটা রক্তে মাখামাখি। লোকটা যেখানে গিয়ে আছড়ে পড়ল, ঠিক ততদূর পর্যন্ত একটা গাঢ় রক্তের রেখা।

আনন্দমোহনের দৃষ্টিতে সেটুকু এড়াল না। উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বললেন, আমরা আসার দু-পাঁচ মিনিট আগেই যে এখানে একটা বড়রকমের দ্বন্দ্ব ঘটে গেছে, তার প্রমাণ দিচ্ছে এখানকার বিশৃঙ্খল অবস্থা।

প্রতুল বলল, আপনার কি মনে হয়, এটাও ওই একই লোকের কাজ?

ঠিক তাই।—পরক্ষণেই মৃতদেহের ওপর পুনরায় ঝুঁকে পড়ে আনন্দমোহন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লক্ষ করতে লাগলেন। ছুরি—হ্যাঁ, ছুরিই মারা হয়েছে লোকটিকে। তীক্ষ্নফলা একখানা ছুরি এমনভাবে ছোড়া হয়েছে যে, আয়তনে ক্ষতটা তেমন বেশি না হলেও, গভীরতাটা যেন তার একটু সীমা অতিক্রম করেছে। পরিশেষে হত্যাকারী ছুরিখানা সঙ্গেই নিয়ে গেছে।

প্রতুল দ্রুতপদে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে-আসতে বলল, আমি একবার সারা বাড়িখানা দেখে আসি। যদি কারও সন্ধান পাই, হয়তো তার কাছ থেকে আমরা কিছু জানতে পারব।

প্রথমে আশপাশের ঘরগুলো দেখে নিয়ে প্রতুল নীচে নেমে এল। দেখল, সামনে একজন ঝাঁকড়া চুলওলা লোক বসে-বসে ঢুলছে—বোধকরি সারা রাত্রি ঘুম না হওয়ার অবসাদে তন্দ্রাটা তার এসেছে গভীরভাবেই।

দেখলেই তাকে মনে সন্দেহ জাগে, বুদ্ধি বলতে কোনও পদার্থ সত্যই কোনওদিন তার মাথায় ছিল কি না! তত্রাচ প্রতুল তার সামনে গিয়ে চড়া গলায় তাকে ডাকল, ওহে, শুনছ?

আচমকা তন্দ্রাটা ভেঙে যেতে লোকটা কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধ থেকে বলল, আজ্ঞে, কী বলছেন?

গত দু-ঘণ্টার মধ্যে রাইমোহনবাবুর সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল কি না বলতে পারো?

হতভম্বের মতো লোকটা প্রতুলের কথার পুনরুক্তি করে বলল, রাইমোহনবাবু…।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, দোতলায় সামনের ঘরেই যিনি থাকেন…।

লোকটা যেন লুপ্ত চেতনা ফিরে পেয়ে বলে উঠল, ওঃ, তাঁকে!

হ্যাঁ, তাঁকে! ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে তাঁর সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল?

উত্তরে লোকটা যা বলল, তা শুনে প্রতুল আর বৃথা তার সঙ্গে বাক্যব্যয় করা সমীচীন বোধ করল না। দ্রুতপদে সে পুনরায় দ্বিতলে উঠে এল।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আনন্দমোহনকে তার পানে তাকাতে দেখে সে বলল, নীচে একজন লোক আছে, কিন্তু সে একেবারে খাজা আহম্মক ছাড়া আর কিছুই নয়।

গভীর বিরক্তিভরেই আনন্দমোহন বললেন, থাক। আমি ফোন করে দিয়েছি লালবাজারে। ডাক্তার সঙ্গে নিয়ে এখনই আমাদের লোক এসে পড়বে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার এলেন। এসেই শুরু করলেন পরীক্ষা। পরে বললেন, ছোরা যে মারা হয়েছে—সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ছোরাখানার মুখে কোনও তীব্র অ্যাসিড মাখানো ছিল কি না, সেটা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

আনন্দমোহন বললেন, বেশ, পরীক্ষা করে দেখুন। আমরা এখন চললুম। আপনার কাজ শেষ হলে আমাকে খবর দেবেন লালবাজারে।

বাকি লোকগুলোকে সারা বাড়িখানা পাহারা দেওয়ার আদেশ দিয়ে তিনি বেরিয়ে এলেন প্রতুলকে সঙ্গে নিয়ে।

সবেমাত্র পথে পা বাড়িয়েছেন, এমনসময় একখানা কালো রঙের মোটর এসে থামল সেখানে।

মোটর থেকে নামল একটি অল্পবয়েসী তরুণী। তার পানে চেয়ে আনন্দমোহন সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, কী, মা, তুমি হঠাৎ কী মনে করে?

প্রতুলও তাঁর সঙ্গে বলে উঠল, তটিনী, তুমি হঠাৎ কেন এলে, মা?

তটিনী আনন্দমোহনের মেয়ে। বয়েস বেশি না হলেও বাপের সঙ্গে থেকে-থেকে এরই মধ্যে সে গোয়েন্দাগিরিতে বেশ পটু হয়ে উঠেছে। শানিত দৃষ্টি মেলে সে বললে, একটা খবর আছে।

সেটা কী?

কিছুক্ষণ আগে আপনারা যাকে বন্দি করেছিলেন, সে পালিয়েছে…।

চার

আনন্দমোহনের বুকের রক্ত যেন চমক খেয়ে উঠল। দৃষ্টি হল বিস্ফারিত, কণ্ঠ বিস্ময়-বিমূঢ়। বললেন, পালিয়েছে মানে? ঠিক বলছ তো?

প্রতুলও তাঁর সঙ্গে স্বর মিলিয়ে বলে উঠল, ত্রিবান্দম ভাণ্ডারী নাম তো?

কণ্ঠে জোর দিয়ে তটিনী বলল, হ্যাঁ, ত্রিবান্দম ভাণ্ডারী, আপনারা যাকে একটু আগেই বন্দি হিসেবে লালবাজারে পাঠিয়েছিলেন…।

আপনমনেই আনন্দমোহন বিড়বিড় করতে লাগলেন, আচ্ছা বেকুবদের হাতে দিয়ে ভরসা করেছিলুম বটে!

প্রতুল ফস করে বলে উঠল, সে নিশ্চয়ই আমাদের আশেপাশে ঘুরছে সুযোগ খোঁজার আশায়। চলুন, লালবাজারে গিয়ে এখনই এর একটা কিছু…।

তাকে শেষ করতে না দিয়ে আনন্দমোহন বললেন, চলুন, আগে লালবাজারে তো যাই, তারপরে ভাবা যাবে কী করব না করব।

মুখে তিনি ও-কথা বললেও আসলে কিন্তু মনের মধ্যে তাঁর তখন ঝড় বইতে শুরু করেছে। ত্রিবান্দম পালিয়েছে? তবে কি সত্যিই সে খুনি?

জন-যান-পূর্ণ চৌরঙ্গীর ওপর দিয়ে তিনি গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে চললেন—গতি-সীমার বাঁধন ছাড়িয়ে। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে লাল আলোটা জ্বলে উঠল, তত্রাচ গতি তিনি স্তব্ধ করলেন না। বিপরীতমুখী দুখানা গাড়ির মাঝ দিয়ে হু-হু শব্দে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।

পথচারীর দল সবিস্ময়ে সরে দাঁড়াতে লাগল, ট্যাফিক পুলিশ গাড়ির নম্বর টুকে নিল, অন্যান্য যানবাহনগুলোও ফুট-ঘেঁষে থেমে পড়ল; কিন্তু কোনওদিকেই তখন আনন্দমোহনের লক্ষ ছিল না। রাগে ক্ষোভে অন্তরটা মনে হল যেন তাঁর জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। অনেক আশা নিয়ে ত্রিবান্দমকে তিনি বন্দি করেছিলেন, কিন্তু নিরাশ হতে হল সম্পূর্ণরূপে।

লালবাজারের ফটক দিয়ে গাড়িটা ঢুকতেই সামনে ইন্সপেক্টর কুঞ্জলালকে দেখা গেল। মনে হল, সে যেন দীর্ঘক্ষণ তাঁদেরই প্রতীক্ষায় উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে।

আনন্দমোহন নামতেই সে বলল, প্রকৃত খুনিকে আমরা বন্দি করেছি। সে নিজেই এসেছে তার দোষ স্বীকার করতে।

পদোচিত গাম্ভীর্য বজায় রেখে আনন্দমোহন কঠিন কণ্ঠে আদেশ করলেন, যাও, লোকটাকে আমার ঘরে নিয়ে এসো। পরক্ষণেই তিনি প্রতুল ও তটিনীকে সঙ্গে করে নিজের ঘরের দিকে চললেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্সপেক্টর কুঞ্জলাল একটা লোককে নিয়ে এসে হাজির হল।

লোকটার বয়েস যতই হোক, চুলগুলো সব পেকে গেছে। সারা মুখখানা অসম্ভবরকম ব্রণ ভর্তি, খোঁচা-খোঁচা ভ্রূ’র তলায় চোখ দুটো এত ছোট এবং সে-চোখের দৃষ্টি এতই বীভৎস যে, তার পানে লক্ষ করলেই অতি বড় সাহসীর বুকও ক্ষণেকের জন্য অন্তত কেঁপে উঠবে।

সহজ কণ্ঠেই আনন্দমোহন তাকে প্রশ্ন করলেন, তা হলে তুমিই খুনি?

লোকটা সবেগে মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই। আমিই তো তাকে খুন করেছি।

কথাশেষে সে এমন এক বিকৃত হাসি হাসল যে, তাতেই বেশ বোঝা যায়, বিকৃত হাসির মতো মাথাটাও তার বিকৃত।

সকৌতুকে আনন্দমোহন পুনরায় প্রশ্ন করলেন, কাকে খুন করেছ?

কেন, সেই যে…সেই বুকমেকারকে।

কারণ?

কারণ, সে আমাকে প্রতারিত করেছে।

একপাশে একখানা চেয়ারে প্রতুল এতক্ষণ গুম হয়ে বসেছিল। লোকটার কথা শেষ হতেই সে বলে উঠল, কিন্তু তোমার বন্দুকটা—বন্দুকটা কোথায়?

আমি সেটা মা পতিতপাবনীর কোলে তুলে দিয়েছি…।

প্রতুলের রসিকতাটা বুঝতে পেরে আনন্দমোহন ধমকের সুরে কুঞ্জলালের উদ্দেশে বলেন, কেন তোমরা আমায় বিরক্ত করবার জন্যে এই পাগলগুলোকে নিয়ে আস? যাও, বের করে দাও ওকে এখান থেকে।

প্রতুল কিন্তু স্বরে কোনওরকম উষ্মা প্রকাশ না করেই বলে চলল, এরা আছে বেশ! একটা লোককে খুনি হিসেবে দোষ স্বীকার করাতে এখানে পাঠিয়েছে। উদ্দেশ্য, আমরা যাতে ওকেই খুনি বলে ধরে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকি, আর ইতিমধ্যে বাবুরা নিজেদের কাজ গুছোতে থাকেন…।

টেবিলের ওপর টেলিফোনটা বেজে উঠতেই আনন্দমোহন রিসিভার কানে লাগালেন। পরক্ষণেই পকেট থেকে নোটবুক বের করে একটা ঠিকানা টুকে নিয়ে তিনি বললেন, বেশ, কাল সকালেই আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব বলে দিন…।

সশব্দে রিসিভারটা নামিয়ে রাখতেই প্রতুল জিগ্যেস করল, নতুন কিছু খবর পেলেন নাকি?

হ্যাঁ, আরও কয়েকটা বাড়িতে সিঁধ পড়েছে।

কথাগুলো শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই প্রতুলের ললাটে চিন্তার সুস্পষ্ট রেখা ফুটে উঠল। আপনমনেই কী খানিক বিড়বিড় করে একসময় সে প্রশ্ন করল, কাল সকালে যাঁর কাছে যাবেন—তিনি কে?

বিক্রম রায়, বোধহয় নামটা শুনে থাকবেন। মুহূর্তেই প্রতুলের চোখ দুটো বড়-বড় হয়ে উঠল। মনে পড়ল, চাঁদমোহন ওই নামটাও করেছিল। তা হলে…।

আনন্দমোহন বলে চললেন, আজও সকালে তাঁর বাড়িতে কে বা কারা ঘরের জিনিসপত্তর ভেঙেচুরে তছনছ করে গেছে। আমার মনে হয়, যারা করেছে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল কাকেও খুন করা। সেটা বুঝতে পেরেই ওঁরা আমাকে সেখানে প্রহরী মোতায়েন করার জন্যে অনুরোধ জানালেন।

প্রতুল ভেবে পেল না কীসের সন্ধানে লোকগুলো এ-বাড়ি ও-বাড়ি সিঁধ দিয়ে বেড়াচ্ছে এবং তারপরই একটা করে লোক খুন করছে। তবে কি নিহতেরা তাদের কাছে ঋণী ছিল? ঋণ পরিশোধ করতে অস্বীকৃত হওয়ায় কি তাদের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে?

কথাটা জিগ্যেস করতেই আনন্দমোহন বললেন, সেই খোঁজেই তো আমি কাল যাব। আচ্ছা, তা হলে চলি। আসছে কাল আমি আপনার সঙ্গে দেখা করব।

আনন্দমোহন বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরেই প্রতুল তটিনীকে বলল, আমাদের সঙ্গে এবারে তোমাকেও একটু কাজ করতে হবে।

আগ্রহভরা কণ্ঠে তটিনী বলল, বেশ, আমাকে কাজ দিন।

আজ পর্যন্ত যাদের-যাদের বাড়িতে সিঁধ পড়ার খবর আমরা পেয়েছি, তাদের বাড়িতে একবার করে তোমাকে যেতে হবে। আমার মনে হয়, সিঁধ যারা দিচ্ছে, তাদের একটা বড় দল আছে। যদি তাই হয়, তা হলে দেখতে পাওয়া যাবে, প্রত্যেকটা সিঁধ দেওয়ার প্রণালী একইরকম কি না।

আপনাদের তালিকার প্রথম বাড়ির ঠিকানাটা আমাকে দিন।

পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে সেটার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রতুল বলল, ৫৫/১ সি, ছাতাওয়ালা গলি, বৌবাজারে তিলাঞ্জলি বারুই-এর বাড়িতে তোমাকে প্রথমে যেতে হবে। মনে থাকে যেন, তুমি যাচ্ছ দৈনিক ‘বিশ্বদূতে’র একজন সাংবাদিক হিসেবে—গোয়েন্দা হিসেবে নয়…।

তটিনী তাড়াতাড়ি বলে উঠল, থাক, আপনাকে আর বলতে হবে না, আমি বুঝে নিয়েছি।

বাকি কয়েকটা ঠিকানা দিয়ে প্রতুল বলল, আর দেরি কোরো না, বেরিয়ে পড়ো এখুনি।

পথে নেমে পড়ে প্রতুল একখানা ট্যাক্সি ডেকে তটিনীকে বলল, যা-যা করতে বললাম, ভুলো না যেন!

কাজ শেষ করে তটিনী যখন ফিরে এল, রাত তখন ন’টা। বলল, আপনি যা ধারণা করেছিলেন, প্রতুলবাবু, তা ভুল। সিঁধ দেওয়ার প্রণালীটা তাদের এক নয়। তারা যে একটা দলভুক্ত এ-কথাটা কোনও কাজের মধ্যেই তেমন প্রকাশ করেনি। তবে একটা জিনিস লক্ষ করলাম, কোনও বাড়িতে সিঁধের কাজটা সারা হলে সেখানে লেখা থাকছে ‘ফিয়ার’। আমার যতদূর মনে হয়, ও-কথাটা লেখার মানে এই যে, তারপর ওই বাড়ির লোকটির খুন হওয়ার পালা।

তটিনীর দূরদর্শিতা দেখে প্রতুল তাকে সত্যই প্রশংসা না করে থাকতে পারল না। বলল, তোমার অনুমানটা ঠিক হয়েছে, মা। রাইমোহনের বাড়িতে এবং চাঁদমোহনের বাড়িতে ওই লেখাটা আমরা লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু তখন আর অত মাথা ঘামিয়ে দেখিনি।

আরও সামান্য দু-চারটে কথা আলোচনা হওয়ার পর তটিনী বাড়ি ফিরে গেল, প্রতুল চলে এল তার বাসায়।

খাওয়া-দাওয়া সেরে সবেমাত্র সে শুতে যাবে, এমনসময় ঝনঝন শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল।

রিসিভারটা তুলে কানে লাগাতেই বিস্ময়ে প্রতুলের চোখ দুটো অসম্ভব রকম বড় হয়ে উঠল। বলল, কে?…ত্রিবান্দম ভাণ্ডারী…হ্যাঁ, হ্যাঁ বলে যাও…।

ওধার থেকে স্বর ভেসে এল আমায় কোনও প্রশ্ন করবেন না, সময় আমার অল্প। আমি মিস্টার চাঁদমোহনকে খুন করিনি। তবে আমি জানি, কে করেছে। আমি পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, কেননা, শেষ পর্যন্ত হয়তো আমাকেই অপরাধী হতে হত। আর তখন নিজেকে নিরপরাধ বলে প্রমাণ করে রক্ষা পাওয়া আমার পক্ষে একটু কঠিন হয়ে দাঁড়াত। আমি এখন যাচ্ছি আসল অপরাধীর কাছে। কাল যদি আমার সঙ্গে একবার ৯৩সি, মাধব মণ্ডল লেনে দেখা করেন, তা হলে বড় ভালো হয়। একা আসবেন, সঙ্গে কেউ যেন না থাকে। মনে রাখবেন, যেখানে যাবেন, সেটা একটা গুদোমঘর। আর ঢুকবেন আপনি সেখানে পেছনের দরজা দিয়ে…।

পরক্ষণেই ওধার থেকে ভেসে এল রিসিভার রাখার শব্দ।

রিসিভার রাখার আংটাটা বারকয়েক নেড়েও প্রতুল কোনও সাড়া পেল না। পরক্ষণেই মনটা তার সন্দেহ-দোলায় দুলতে লাগল। একবার ভাবল, হয়তো এটাও একটা ফাঁদ; তাতে তাকে জড়ানোর জন্য হয়তো চেষ্টা চলছে। তারপর আবার ভাবল, হয়তো ত্রিবান্দম সত্যি কথাই বলছে। হয়তো পুলিশকে সে সত্যিই ভয় করে, তাই তার সামনে সে আসতে চায় না।

যাই হোক, ব্যাপারটা আনন্দমোহনকে জানিয়ে দেওয়া প্রতুল জরুরি মনে করল। তিনিই যখন এ-ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, তখন এগুলোও জানা তাঁর একান্ত প্রয়োজন।

পুনরায় প্রতুল আনন্দমোহনের উদ্দেশে রিসিভার তুলে নিল। কথা শেষ হওয়ার পর একসময় সে সেটা নামিয়ে রেখে বিছানার ওপর গা এলিয়ে দিল।

পরদিন সন্ধে নাগাদ প্রতুল আনন্দমোহনের কাছে গেল।

ঘটনাটা ক্রমেই জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সুতরাং আনন্দমোহনের মেজাজটা রুক্ষ থাকাই স্বাভাবিক। প্রতুল ঘরে ঢুকতেই তিনি একবার শুধু গম্ভীরভাবে তার পানে তাকালেন।

প্রতুল প্রশ্ন করল, আর কোনও খবর আছে নাকি, আনন্দবাবু?

গম্ভীর স্বরেই আনন্দমোহন জবাব দিলেন, আছে।

কারও খুনের খবর?

না।

তবে কী?

মিস্টার বিক্রম রায় নিরুদ্দেশ। তাঁকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।

পাঁচ

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আনন্দমোহন পুনরায় বলতে শুরু করলেন, আজই সকালে আমি তাঁর বাড়িতে গেছলাম। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আমার দেখা হল—কেমন যেন মনমরা-মনমরা ভাব। গত রাত্রে বিক্রম রায়কে কারা ফোন করেছিল। তারপরই তিনি ‘শিগগির ফিরব’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। বাড়ির লোক সেই তাঁকে শেষ দ্যাখে।

কোথা থেকে ফোন করা হয়েছিল, আন্দাজ করতে পারলেন কিছু?

হ্যাঁ, আমার মনে হয়, বেলগাছিয়ার আশপাশে কোনও জায়গা থেকে করা হয়েছিল।

বেলগাছিয়া! —গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে কথাটা উচ্চারণ করেই প্রতুল আক্ষেপের সুরে বলল, আমাকে আগে যদি একবার জানাতেন, তা হলে আমি সেই মুহূর্তে সেখানে পৌঁছতে পারতাম।

তার মানে?

সেই পাড়াতেই আমার এক জানাশোনা লোক আছে…।

পরক্ষণেই প্রতুল প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করে বলল, কিন্তু তিনি গেলেনই-বা কোথায়? কী-ই বা তাঁর পক্ষে ঘটতে পারে?

সেটাই তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না…।

সিঁধ দেওয়ার ব্যাপার আর কিছু আপনার কানে এল?

হ্যাঁ, আরও তিনটে বাড়ির খবর পেয়েছি। সবই রাত্রে ঘটেছে।

সেই আগেকার মতোই তো? মানে—কিছুই চুরি যায়নি, অথচ…।

ঠিক আগেরগুলোর মতোই এগুলো ঘটেছে।

কোনও সূত্রও পাওয়া যায়নি?

না।

ত্রিবান্দমের আর কোনও খবর পেলেন?

মাথা নেড়ে আনন্দমোহন জবাব দিলেন, না। তবে এবারে যে-ফাঁদ পাতার মতলব মনে-মনে এঁটে রেখেছি, তাতে আমি জোর করে বলতে পারি, আর সাতদিনের মধ্যে আমি এ-ব্যাপারের একটা কিছু কিনারা করতে পারব।

মতলবটা কী?

পরে শুনবেন।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতুল বলল, তা হলে আমি এখন চললুম। পরে দেখা করব আবার।

পথে নেমে আসতেই তটিনীর সঙ্গে তার দেখা হল।

তটিনী বলল, আমি মিস্টার বিক্রমের খোঁজ দিতে পারি আপনাকে। কাল তাঁর বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি বেরোতেই তাঁর মুখখানা দেখে আমার কেমন সন্দেহ হয়। তাই তাঁর পিছু নিয়েছিলাম।

কতদূর পর্যন্ত গিয়েছিলে?

গেলাম বেলগাছিয়া অবধি। খালের এপারে মাধব মণ্ডল লেন…।

বাধা দিয়ে প্রতুল বলল, ৯৩সি, মাধব মণ্ডল লেনে একটা গুদোমঘর, তাই তো?

সবিস্ময়ে তটিনী বলে উঠল, আপনি জানলেন কী করে, প্রতুলবাবু?

জেনেছি কোথাও থেকে নিশ্চয়ই। কিন্তু তুমি তাঁকে চিনলে কী করে?

চিনতাম আগেই। ‘দৈনন্দিন’ সংবাদপত্র অফিসের তিনি ম্যানেজার। কাগজে একবার তাঁর ছবি দেখেছিলাম।

তা হলে এখন আমি চলি।

কোথায়?

বেলগাছিয়া।

আমিও কেন আপনার সঙ্গে যাই না?

না। তোমাকে যেতে হবে না। আমি একাই যাব।

কথাশেষে প্রতুল আর একমুহূর্তও না দাঁড়িয়ে ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠল।

আর. জি. কর রোডের ডানদিক থেকে মাধব মণ্ডল লেনটা বেরিয়ে সোজা গিয়ে মিশেছে খাল-পাড়ে। পূতিগন্ধময় অপরিচ্ছন্ন গলিটার দু-পাশে সারি-সারি ক’টা গুদোমঘর—কোনওটা কাঠের, কোনওটা টিনের কোনওটা-বা লোহার।

মোড়ের মাথায় ট্যাক্সি থেকে প্রতুল যখন নামল, তখন সেখানে জনপ্রাণী বলতে কেউই নেই। একে গলিটা সরু, তার ওপর আবার নোংরা।

সারা গলিটা প্রতুল প্রথমে একবার ঘুরে নিল। আশপাশে যদিও দু-একখানা দ্বিতল কোঠা আছে, তাও আবার সেগুলো অন্ধকারে নিঝুম হয়ে রয়েছে। দূরে-দূরে যে-গ্যাসপোস্টগুলো আছে, তার মৃদু আলোটুকু যেন সেখানকার নিস্তব্ধতাকে আরও গভীর রহস্যময় করে তুলেছে।

পরপর ক’টা নম্বর দেখতে-দেখতে একসময় প্রতুল ‘৯৩সি’ গুদোমখানা দেখতে পেল। দেখেই তার মনে হল, এ-গলিটার ভেতরে যতগুলো বাড়ি ও গুদোম আছে, বয়েসের দিক দিয়ে বোধহয় এইটিই সবচেয়ে প্রাচীন এবং বয়েসের ভারেই যেন মনে হল একপাশে হেলে পড়েছে। জানলাগুলো পাল্লাহীন, দরজাটার অবস্থাও প্রায় সেইরকম। বায়ু-চলাচলের পথটুকুও নেই। যত রাজ্যের মাকড়সা সেখানে নির্বিচারে জাল বুনে রেখেছে।

সামনের দরজাটার কাছে এসে সে দেখল, দেওয়ালে লেখা রয়েছে : ভাড়া দেওয়া হইবে।

এইসময় মনে পড়ল প্রতুলের, ত্রিবান্দম বলেছিল পিছনের পথ দিয়ে ঢুকতে।

চারদিকটায় একবার সে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। তারপর ওপাশের কোণের দিকে টিন, কাঠ, রাশীকৃত জঞ্জাল সরিয়ে সে একটা দরজা আবিষ্কার করল এবং পরক্ষণেই দেশলাইয়ের একটা কাঠির মৃদু আলোকে কোনওরকমে ভেতরে ঢুকে গেল।

ভেতরটা আরও অন্ধকার। দু’হাত দূরের জিনিস পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয় না। চারধারে কেমন একটা গুমোট গন্ধ। তারই মধ্যে প্রতুল কোনওরকমে হাতড়াতে-হাতড়াতে এগিয়ে যেতে লাগল।

হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হতেই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। শব্দটা কীসের? কোনও মানুষের পদধ্বনি, না আর কিছুর?

দেশলাইয়ের আর একটা কাঠি জ্বালল সে। কিন্তু তার ভাগ্য আজ এমনই বিমুখ যে, সেটিও হঠাৎ গেল নিভে।

মনে-মনে কিন্তু প্রতুল তখন ভাবছিল, যদি ত্রিবান্দমই এ-রহস্যের প্রকৃত হোতা হয়, তা হলে আজ আর তাকে যে প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে হবে না—এটা ঠিক…।

সহসা কাদের কণ্ঠস্বর ভেসে এল ইন্সপেক্টরকে ফোন করে দাও, আর এর ভার তারই কাঁধে চাপিয়ে দাও। সে-ই এর প্রতিকার করবে।

কণ্ঠস্বরটার উদ্দেশে প্রতুল চারদিকটায় কান পাততে লাগল। কোন দিক থেকে স্বরটা ভেসে আসছে? কে-ই-বা কথা বলছে? ত্রিবান্দম? তা হলে…।

পর মুহূর্তেই চিন্তাস্রোতটা তার ভিন্নমুখী হল। কিন্তু মিস্টার বিক্রমের ব্যাপার কী? তিনি কোথায়?

এলোমেলোভাবে নানা কথা চিন্তা করতে-করতে প্রতুল এগোতে লাগল। হঠাৎ সামনে কিসে ধাক্কা খেতেই অনুভব করে সে বুঝল, একটা দরজা। ধীরে-ধীরে সেটা খুলে ফেলে সে লঘু সন্তর্পিত পদে পূর্বের মতো ভেতরে এগোতে লাগল। কিন্তু সেখানটা তেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার নয়। আলো নেই বটে, তবে কোথা থেকে যেন অল্প একটু আলোর আভা এসে পড়েছে।

আরও দু-এক পা অগ্রসর হতেই সহসা তার নজরে পড়ল, হাতকয়েক দূরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে কে যেন তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো বসে রয়েছে।

হয়তো ত্রিবান্দম। প্রতুল ধীর কণ্ঠে তাকে ডাকল, কিন্তু কোনও সাড়াই এল না।

পকেট থেকে আর-একবার দেশলাইটা বের করে সে একটা কাঠি জ্বালল। কিন্তু দূরের মানুষটাকে তেমন চেনা গেল না। আবছা মতো শুধু দেহটাই চোখে পড়ল।

চোখে না পড়লেও সে ত্রিবান্দম—মনে-মনে ভেবে নিয়ে প্রতুল তার কাছে এগিয়ে গেল। বার দুই ডাকার পরও যখন সে সাড়া পেল না, তখন আপনমনেই সে গর্জন করতে লাগল, ঘুমোনো হচ্ছে বাবুর, এদিকে…।

আর-একটা কাঠি জ্বালতেই প্রতুল বিস্ময়ের এক অব্যক্ত ধ্বনি করে উঠল। এতক্ষণ যাকে সে মানুষ ভেবেছিল, সে মানুষই, তবে মৃত। একেও ছুরি মারা হয়েছে। তার সমস্ত জামা-কাপড় তাজা রক্তে জমাট বেঁধে গিয়েছে।

বিস্ময়ের প্রথম ঘোরটা কেটে গেলে প্রতুল লোকটিকে চেনার উদ্দেশে মুখ বাড়াতেই কোথা থেকে একঝলক বাতাস এসে কাঠিটাকে দিল নিভিয়ে।

ছয়

চিন্তাচ্ছন্ন মস্তিষ্কে হাতড়াতে-হাতড়াতে প্রতুল কোনওরকমে বাইরে বেরিয়ে এল। আনন্দমোহনকে একটা ফোন করতে হবে। কিন্তু ফোন পাওয়া যায় কোথায়?

মনে পড়ল বন্ধু লোকেশের কথা। সম্প্রতি সে একটা ফোন নিয়েছে বটে! দ্রুতপদে প্রতুল বড় রাস্তার মোড়ে একখানা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।

লোকেশ তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ডেকে তুলতে তাকে অবশ্য বিশেষ বেগ পেতে হল না।

আনন্দমোহন তখন লালবাজারেই ছিলেন। তাঁকে সব খবরটা সংক্ষেপে জানিয়ে দিয়ে প্রতুল বলল, আপনি চলে আসুন এখুনি…।

ওধার থেকে স্বর ভেসে এল আমি এখুনি যাচ্ছি লোক সঙ্গে নিয়ে…।

রিসিভারটা নামিয়ে রাখতেই লোকেশ কী যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাধা দিয়ে প্রতুল বলে উঠল, এখন আর একমিনিটও দাঁড়ানোর সময় নেই ভাই, পরে একদিন এসে গল্পসল্প করব’খন।

সেখান থেকে বেরিয়ে প্রতুল পুনরায় গলিটার ভেতরে এসে দাঁড়াল। মাথার মধ্যে তখন তার রাশি-রাশি চিন্তার স্রোত বয়ে চলেছে। কে খুন হল? ত্রিবান্দম, না আর কেউ? ত্রিবান্দম কী জন্য তাকে সেখানে আসতে বলেছিল? তাকে বন্দি করার জন্য নয়তো?

পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করে সে একটা সিগারেট নিল। পরক্ষণেই দেশলাইটা বের করতে গিয়ে তার মনে পড়ল, সেটা সে ফেলে এসেছে ভেতরে।

এর জন্য প্রতুল মনে-মনে নিজেকে অভিসম্পাত করতে লাগল। কিন্তু আনন্দমোহন আসছেন না কেন এখনও? আধঘণ্টার ওপর সময় বয়ে গেল, অথচ তাঁর দেখা নেই কেন? পথে কোনও বিপদ-আপদ…।

মোড়ের মাথায় অকস্মাৎ পুলিশ-ভ্যানের অত্যুজ্জ্বল হেডলাইট চোখে পড়তেই প্রতুলের মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠল। তা হলে তিনি এসে গেছেন!

গাড়িটা এসে থামল প্রতুলেরই প্রায় দু-হাত আগে। ব্যস্তসমস্তভাবে আনন্দমোহন গাড়ি থেকে নেমে এলেন। তাঁর সঙ্গে এল জন-দুই পুলিশ ও একজন সার্জেন্ট।

আনন্দমোহন প্রশ্ন করলেন, ব্যাপার কী, প্রতুলবাবু? এটাও কি সেই ‘স্ট্যাবিং’-এর ব্যাপার নাকি?

ঘাড় নেড়ে প্রতুল জবাব দিল, ঠিক তাই।

প্রহরী তিনজনের দুজনকে আনন্দমোহন বললেন, তোমরা এদিকটায় পাহারা দাও, কেউ যেন পালিয়ে না যায়। —পরে তৃতীয়জনকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি পিছনদিকে যাও। ওদিকটায় একটু ভালো করে লক্ষ রেখো। ওদিক দিয়ে পালানোই বেশি সম্ভব।

পরমুহূর্তেই তিনি সামনের দরজাটার কাছে এসে দাঁড়াতেই প্রতুল বলল, ওদিক দিয়ে নয়। ওপাশে আর-একটা পথ…।

‘ভাড়া দেওয়া হইবে’ লেখাটা নজরে পড়তেই আনন্দমোহন বললেন, এটা তো দেখে মনে হচ্ছে, মান্ধাতার আমল থেকে টাঙানো রয়েছে।

প্রতুল কোনও মন্তব্য করল না। তাঁকে সঙ্গে করে সে জঞ্জালের ধারে ঢোকার পথটায় এসে দাঁড়াল।

পকেট থেকে টর্চ বের করে আনন্দমোহন বললেন, ভেতরে কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন নাকি আপনি?

না, কাউকে দেখতে পাইনি, তবে কার যেন কথা শুনতে পেয়েছিলাম। স্বরটা কার—সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

ধীরে-ধীরে আনন্দমোহন অগ্রসর হতে-হতে অকস্মাৎ কীসে একটা হোঁচট খেতেই তাঁর হাতের টর্চটা মেঝের ওপর পড়ে গেল।

হাতড়ে-হাতড়ে সেটাকে তুলে প্রতুল দেখল, সেটা একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। ডুমটা পর্যন্ত ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

আপশোসের সঙ্গে আনন্দমোহন বলে উঠলেন, যাঃ, তা হলে উপায়? আপনার কাছে দেশলাই আছে?

সেটা আমি ভেতরে ফেলে এসেছি।

অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে তারা স্খলিত চরণে অগ্রসর হতে লাগল। চারদিকে যেমনই গাঢ় অন্ধকার, তেমনই প্রগাঢ় স্তব্ধতা।

অকস্মাৎ আনন্দমোহন বলে উঠলেন, আছে, আছে, আমার পকেটেই দেশলাই আছে। একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম! পকেট থেকে তিনি দেশলাইটা বের করে একটা কাঠি জ্বাললেন। অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকার পর বারুদের শিখাটা তাদের কাছে মনে হল যেন বিদ্যুতের আলো।

কিন্তু তা কতক্ষণের জন্যই বা! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেটা গেল নিভে।

কাঠির পর কাঠি জ্বালাতে-জ্বালাতে তারা সতর্ক দৃষ্টি আর উৎকণ্ঠিত মন নিয়ে ক্রমশ ভেতরে ঢুকতে লাগল।

এবারও কথা কইলেন আনন্দমোহন। বললেন, আর কতটা, প্রতুলবাবু…?

অদূরে অঙ্গুলি নির্দেশ করে প্রতুল বলে উঠল, ওই যে—ওই দেখুন লাশটা…।

পকেট থেকে রুমালখানা বের করে আনন্দমোহন প্রথমে সেটা সলতের মতো পাকালেন। তারপর আলোটা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হবে বলে তার একটা মুখে অগ্নিসংযোগ করে তিনি তীক্ষ্ন দৃষ্টি একবার মৃতদেহের ওপর ফেললেন। কিন্তু পরক্ষণেই বিস্ময়ের একটা বিচিত্র ধ্বনি তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গে চোখ দুটোও মনে হল যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। তেমনি স্বরেই তিনি বলে উঠলেন, এ যে বিক্রম রায়ের মৃতদেহ!

প্রতুলও তাঁর কথার প্রতিধ্বনি তুলে সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠল, বিক্রম রায়! তা হলে তটিনীর কথা মিথ্যে নয় দেখছি!

প্রতুলের পানে ফিরে আনন্দমোহন বললেন, তটিনী? সে কি এখানে এসেছিল নাকি?

হ্যাঁ, কাল রাত্রে বিক্রম রায় বাড়ি থেকে বেরোনোর পরই তটিনী তাঁকে অনুসরণ করে এখান পর্যন্ত এসেছিল…।

সে তো আমাকে জানায়নি কিছু…।

না, সে জানায়নি। তার কারণ এই যে, সে আপনাকে রীতিমতো ভয় করে চলে। অত রাত্রে অনুসরণ করেছে জানলে পাছে আপনি রাগ করেন, তাই সে জানায়নি।

অতঃপর আনন্দমোহন শুরু করলেন অনুসন্ধান। কিন্তু দৃষ্টি তাঁর তীক্ষ্ন হলেও আলো না থাকাতে কিছুই ধরা পড়ল না। তবু যথাসম্ভব তিনি চারদিকটা দেখে নিলেন। নাঃ, কেউ নেই কোথাও। কাজ শেষ করে বোধকরি বহুক্ষণ আগেই সরে পড়েছে।

প্রতুল তখন প্রকৃত হত্যাকারীর চিন্তায় মগ্ন। সত্যিই কি ত্রিবান্দম হত্যাকারী? কেন সে এখানে আসার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চোখের সামনে মৃতদেহ ফেলে রেখে সরে পড়ল? এ-ও কি তবে তার আর-একটা কৌশল?

সাত

একান্ত নিরাশ মনে আনন্দমোহন বাইরে বেরিয়ে এলেন। পুলিশ দুজনকে ডেকে বললেন, তোমরা ভেতরে ঢুকে লাশটা বের করে নিয়ে এসে মর্গে চালান দাও। তার আগে একবার আলো নিয়ে চারদিকটা ভালো করে খুঁজে দ্যাখো। জিনিসপত্তর যা আছে নিয়ে আসবে। যদি কারও হাতের ছাপ…।

তাঁকে শেষ করতে না দিয়ে প্রতুল বলল, আপনার কি মনে হয়, এ-খুনটার সঙ্গেও ত্রিবান্দম জড়িত আছে?

ঠিক তাই। সে-ই যে প্রকৃত খুনি—এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।

তা হলে সে আমায় ওইভাবে ফোন করেছিল কেন?

উদ্দেশ্যটা তার মহৎ ছিল না নিশ্চয়ই। ভেবেছিল, আপনাকেও যদি এ-জগৎ থেকে সরাতে পারে…।

কিন্তু তা-ই বা কী করে হয়? সে কি ভেবেছে যে, আমি এতই বোকা? আর আমাকে ওই ধরনের ফোন করে ডেকে নিয়ে এসে খুন করার কথা ভাবা যে কতখানি মূর্খামি—আপনি কি বলতে চান, সে তা বোঝে না?

গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে আনন্দমোহন বিরক্তিভরা কণ্ঠে বললেন, সমস্ত ব্যাপারটাই গোড়া থেকে কেমন যেন গোলমেলে। কিছুই…।

কথাটা অসমাপ্ত রেখেই তিনি গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। পরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রতুলের পানে তাকিয়ে তিনি বললেন, আসবেন নাকি আমার সঙ্গে?

না, আমাকে আর-একটা কাজ সারতে হবে। আপনি চলে যান।

আনন্দমোহনের গাড়িটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতেই প্রতুল একখানা ট্যাক্সি ডাকল। তারপর ড্রাইভারকে আদেশ দিল, সোজা বাড়ির পথে যাওয়ার জন্যে।

বাড়ি ফিরে প্রতুল দেখল, তটিনী তারই প্রতীক্ষায় বসে।

একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে প্রতুল বলল, মিস্টার বিক্রম রায় খুন হয়েছেন।

তটিনী যেন আকাশ থেকে পড়ল। অস্ফুট স্বরে বলল, খুন হয়েছেন?

হ্যাঁ, কিন্তু কে করেছে, ঠিক বুঝতে পারছি না।

ত্রিবান্দম ভাণ্ডারীকে কি…?

প্রতুল তার কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ত্রিবান্দম লোকটাকে আমার তিলমাত্র সন্দেহ হয় না। তোমার বাবা কিন্তু বলছেন, প্রকৃত হত্যাকারী ও-ই।

আপনি তার দেখা পেয়েছিলেন?

না, ওখানে দেখা পাইনি। বুঝতে পারলুম না, কী কারণে সে আমাকে ওখানে যেতে বলেছিল। যদি মিস্টার বিক্রমের মৃতদেহ দেখানোর জন্যেই হয়…।

টেবিলের ওপর ফোনটা বেজে উঠতেই তার কথায় ছেদ পড়ে গেল অকস্মাৎই। রিসিভারটা তুলে নিয়ে প্রতুল কানে লাগাল। কিন্তু পরমুহূর্তেই মুখখানা তার এক অজানিত কারণে প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। বলল, কে, ত্রিবান্দম! কী খবর?

ওধার থেকে স্বর ভেসে এল হ্যাঁ, আমি ত্রিবান্দম ভাণ্ডারী কথা বলছি। আপনি নিশ্চয়ই আমার ওপর খুব চটে গেছেন? অবশ্য যাওয়ারই কথা। কিন্তু কী করব বলুন, এমন এক সঙ্কটময় মুহূর্তে আমি পড়েছি যে, কোনও কাজ স্থিরভাবে করতে পারছি না।

এক লহমার জন্য চুপ করে ত্রিবান্দম পুনরায় বলল, আমি আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। অত্যন্ত জরুরি কতকগুলো কথা আছে। আপনি একবার দয়া করে…।

ঝাঁঝালো স্বরে প্রতুল বলে উঠল, আমি তোমার চাকর নই। আর কোথাও আমি যেতেও পারব না। কী এমন জরুরি দরকার, শুনি?

সেটা আপনার সাক্ষাতেই বলব। কিন্তু…।

তা হলে আমার বাড়িতে চলে এসো। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব’খন।

দেখুন, সত্যি কথা বলতে কি পুলিশের চোখে আমি এখন অপরাধী। তাই…।

মুহূর্তের জন্য কী একটা ভেবে নিয়ে প্রতুল বাধা দিয়ে বলে উঠল, না, না, তোমার কোনও ভয় নেই। নিঃসন্দেহে তুমি আসতে পারো।

বেশ, তাই যাচ্ছি।

পরস্পরের কথা শেষ হতেই প্রতুল রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

আট

কয়েকমিনিট চুপ করে থাকার পর কী একটা ভেবে নিয়ে তটিনী বলল, আপনি কি ত্রিবান্দমকে পুলিশের হাতে দিতে চান নাকি, প্রতুলবাবু?

পরিহাস-তরল কণ্ঠে প্রতুল বলল, তা হলে তো আমাদের দেশের সব ক’জন সিদ্ধ মহাপুরুষকেও ফাটকে পুরতে হয়।

তার মানে? আপনি কি ত্রিবান্দমকে একেবারেই সিদ্ধ মহাপুরুষের পর্যায়ে ফেলতে চান?

না, তা ফেলতে চাই না, তবে এ-ব্যাপারে সে যে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত—এ-কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।

কতক্ষণ উভয়েই চুপচাপ। কারও মুখে কোনও কথা নেই। চারদিকে বিরাজ করতে লাগল একটা শ্বাসরোধকারী কুশ্রী নীরবতা। দেওয়ালে বিলম্বিত বড় ঘড়িটা শুধু অবিরাম টিকটিক শব্দ করে চলেছে।

অকস্মাৎ দ্বারপথে কলিং বেলটা সজোরে বেজে উঠতেই প্রতুল চকিত হয়ে উঠল। দ্রুতপদে এসে সে দরজাটা খুলতেই দেখে ত্রিবান্দম দাঁড়িয়ে।

কিন্তু কী অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটেছে তার মুখ-চোখের! মনে হয় যেন, এরই মধ্যে তার দেহের এবং মনের ওপর দিয়ে একটা প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে। চুলগুলো বিশৃঙ্খল, দেহটা পরিশ্রান্ত, মুখখানা মলিন।

প্রতুল তাকে ভেতরে ডেকে আনল।

চেয়ারে বসতে গিয়ে হঠাৎ তটিনীর ওপর নজর পড়তেই ত্রিবান্দম প্রতুলের পানে ফিরে বলে উঠল, আপনার সঙ্গে আমার গোপনীয় কথা আছে। তাই বলছিলাম কি, যদি দয়া করে…।

কথাটা সে শেষ না করে তটিনীর পানে ধীরে-ধীরে মুখখানা ফেরাল।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে প্রতুল মৃদু হেসে বলল, তোমার কোনও ভয় নইে। এ হচ্ছে আমার ঘরের লোক। নির্ভয়ে তুমি এর সামনে তোমার বক্তব্য বলে যেতে পারো।

কথাশেষে সে দরজাটা বন্ধ করে দিতে যাওয়ার উপক্রম করতেই ত্রিবান্দম বাধা দিয়ে বলল, না, না, বন্ধ করবেন না, দরজাটা খোলাই থাক।

বিস্মিত কণ্ঠে প্রতুল প্রশ্ন করল, কেন বলো তো?

কেন, তা বলতে পারব না। দয়া করে আমার কথাটা শুনুন।

তার উদ্দেশ্যটা বুঝতে না পেরে একখানা চেয়ারে বসে প্রতুল নিজের পকেটের ভেতর হাত ভরে রইল। স্পর্শে দেখে নিল, পিস্তলটা ঠিক আছে কি না। তারপর বলল, এবার বলো, তোমার যা বলবার আছে। —পরক্ষণেই সে টেবিলের ওপর সিগারেট কেসটা দেখিয়ে বলল, খাও নাকি?…না, না, লজ্জা করবার কিছু…।

না, দয়া করে আমাকে আমার বক্তব্য বলতে দিন। দেরি করলে হয়তো আমারও প্রাণটা তারা…।

তারা? তারা কারা?

তা ঠিক জানি না। তবে আমার মনে হয়, আমার পেছন-পেছন কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাক সে-কথা। এখন কথা হচ্ছে এই যে, পুলিশের হাত থেকে আমার পালিয়ে আসার সংবাদ বোধহয় আপনি জানেন?

গম্ভীর স্বরে প্রতুল বলল, জানি।

প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় পুলিশ-ভ্যানে উঠতে গিয়ে হঠাৎ আমার একটা লোককে স্মরণ হল। আমাদের অফিসে লোকটা নিয়মিত আসত না বটে, তবে আমার সন্দেহ হয়েছিল ওরই ওপর। চাঁদমোহন খুন হওয়ার দিন সে এসেছিল। প্রহরীদের বললাম, আমি একবার ঘণ্টাখানেকের জন্যে আনন্দমোহনের আদেশ নিয়ে ছুটি চাই। তারা তো আমার কথা হেসেই উড়িয়ে দিল। তখন বাধ্য হয়েই আমি তাদের গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে এলাম।

তারপর কী করলে?

যে-লোকটার কথা বললাম আপনাকে—তারই উদ্দেশে আমি ফকির সরকার লেনে যাই। সেখানেই সে থাকে। তার বাড়িখানা খুঁজে বের করে আমি একটা জানলার আড়ালে লুকিয়ে থাকি। হঠাৎ আমার কানে এল, সামনের ঘর থেকে সেই লোকটার গলার স্বর। সে আর-একজনকে হিন্দি ভাষায় বলছে, ‘খুব সাবধানে কাজ করতে হবে। যে-কোনও মুহূর্তে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। আমি রাইমোহনকে খুন করেছি, এবার পালা বিক্রমের। তাকে কাল একবার আমাদের মাধব মণ্ডল লেনের গুদোমে রাত্রি ন’টার সময় দেখা করতে বলেছি। কারণ, ওই ঘরটাই তার পক্ষে উপযুক্ত জায়গা।’ তারপর তাদের আর কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। বুঝলাম, তারা এবার বেরোবে। তাই আমিও সরে পড়লাম সেখান থেকে।

মুহূর্তের জন্য থেমে ত্রিবান্দম বলে চলল, তখন প্রথমেই আমার মনে হল, লালবাজারে একটা খবর দিই। কিন্তু আমার কথা তাঁরা বিশ্বাস করবেন কি না—সন্দেহটা মনে জাগতেই ভাবলাম, আগে একবার মাধব মণ্ডল লেনে গুদোমঘরটা দেখে আসি। তাতে হয়তো আপনাদের সাহায্য করা আমার পক্ষে অনেকটা সহজ হবে। আমি গুদোমঘরটা খুঁজে বের করলাম। তারপর আপনাকে ফোন করি।

ভ্রূ-কুঞ্চিত করে প্রতুল প্রশ্ন করল, তারপর?

তারপর আমি রাত্রে বাড়ি না ফিরে পথেই কাটালুম। আজও তাই কেটেছে। রাত ন’টার সময় কথামতো গুদোমঘরে গিয়ে দেখি, মিস্টার বিক্রম রায়কে শয়তানরা খুন করে রেখেছে। তারপর কী ঘটল না-ঘটল, আমি জানি না। আপনি হয়তো ভাবছেন, স্যার, আমি নিজের দোষ ঢাকার জন্যে সব মিথ্যে বলছি। কিন্তু না, আমার কথা বিশ্বাস করুন…।

হঠাৎ কী মনে পড়তেই সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, একটা কথা আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি কাল খুনিদের ঠিকানাটা বের করেছি। আপনার যদি কাজে লাগে, আমি জানাতে পারি। আনন্দবাবুকে বললে হয়তো…।

বাধা দিয়ে প্রতুল আগ্রহভরা কণ্ঠে বলে উঠল, বলো—বলো ঠিকানাটা কী…

ত্রিবান্দমের চোখ দুটো এক অজানা আশায় প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। খুশিভরা কণ্ঠে বলল, তার ঠিকানা হচ্ছে…।

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘরের মধ্যে একটা ‘সোঁ’ করে কীসের শব্দ উঠল। পরক্ষণেই দেখা গেল, যন্ত্রণার একটা অস্ফুট ধ্বনি করে ত্রিবান্দম লুটিয়ে পড়ল মেঝের ওপর।

বিস্ময়-চকিত হয়ে প্রতুল তার পানে ঝুঁকে পড়তেই দেখল, তীক্ষ্নধার একখানা ছোরা তার বাঁ-দিকের ফুসফুসের ওপর প্রোথিত। ক্ষতস্থান থেকে অনর্গল ধারায় রক্তস্রোত নির্গত হয়ে জামাটাকে সিক্ত করে তুলছে।

প্রতুল আর একমুহূর্তও অপেক্ষা না করে হত্যাকারীর উদ্দেশে দ্রুতপদে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। অদূরে সিঁড়ির গোড়ায় একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি দেখতে পেয়েই সে ছুটে গেল সেদিকে। ছায়ামূর্তিটিই নিশ্চয় হত্যাকারী।

অগ্রবর্তী লোকটিও পিছনে পদশব্দ শুনে তীরের বেগে ছুটতে লাগল। প্রথমে একতলায়, পরে সবেগে সে রাস্তায় গিয়ে পড়ল!

প্রতুলও নাছোড়াবান্দা। হিংস্র জানোয়ার যেমন তার শিকারের পিছনে ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটতে থাকে, সে-ও সেইরকম লোকটিকে অনুসরণ করতে লাগল। কিন্তু তবু মনে হল, মাঝের ব্যবধানটা তাদের যেন ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

গভীর রাত। পথ জনবিরল। গাড়িঘোড়াও তেমন নেই। তাই ফাঁকা পথ পেয়ে তারা উভয়েই ছুটে চলল—জোরে—আরও জোরে।

অকস্মাৎ পথের ওপর অন্ধকারে কীসে একটা হোঁচট খেতেই অগ্রবর্তী লোকটা সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। এই অবসরে প্রতুলও তার কাছে এসে সজোরে একটা ঘুষি চালিয়ে দিল তার কাঁধে।

কিন্তু লোকটি তার আগেই অচৈতন্য হয়ে পড়েছে। লোহার একখানা বিমে ধাক্কা খেয়ে সে এমনভাবে পড়েছে যে, তার কপালটা অনেকখানি কেটে গেছে।

আরও একটু ঝুঁকে পড়তেই প্রতুল ভাবল, অনতিবিলম্বেই তাকে হাসপাতালে পাঠানো প্রয়োজন।

ইতিমধ্যে এধার-ওধার থেকে লোক ছুটে এল। নানাজনের নানা মত সেখানকার নীরব আবহাওয়াটুকু কয়েকমিনিটের মধ্যেই সরগরম করে তুলল।

পিছন ফিরে প্রতুল দেখল, তটিনীও ছুটে আসছে। কাছে আসতেই সে বলল, একে এখুনি অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো দরকার। তুমি একবার খবর দাও।

নিকটস্থ একটা ডাক্তারখানা থেকে ফোনে হাসপাতালে খবরটা পৌঁছে দিয়ে তটিনী এসে দাঁড়াতেই প্রতুল বলল, তোমার বাবাকে একবার খবরটা দিতে হবে।

তটিনী বলল, দিচ্ছি, কিন্তু আগে এদিককার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাক।

মিনিটদশেকের মধ্যেই একখানা অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হল। স্থানীয় থানা থেকে খবর পেয়ে দারোগাও ছুটে এল। এসেই শুরু করল তদন্ত। পথচারীর মন্তব্যে সে প্রতুলকেই দোষী সাব্যস্ত করে থানায় নিয়ে যেতে চাইল।

মৃদু হেসে প্রতুল এগিয়ে যেতেই তটিনী বলে উঠল, আপনি কি চললেন নাকি, প্রতুলবাবু?

গভীর বিস্ময়ে চোখ দুটো বড়-বড় করে দারোগাটি সঙ্গে-সঙ্গে বলল, প্রতুলবাবু? মানে প্রতুল লাহিড়ী? বাংলার…।

তাকে শেষ করতে না দিয়ে তটিনী বলে উঠল, হ্যাঁ, বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ী।

জিব কেটে সলজ্জ কণ্ঠে দারোগাটি কী বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে প্রতুল তাকে একধারে টেনে নিয়ে গিয়ে কীসব বলে দিল। তারপর পুনরায় অচৈতন্য লোকটির সামনে এসে দাঁড়াল।

স্ট্রেচারে করে লোকটিকে গাড়িতে তোলা হলে দারোগাটি অর্থপূর্ণ হাসি হেসে নমস্কার জানিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিল।

তটিনী বলল, এবার আমি চললুম বাবাকে খবরটা দিতে। আপনি যা হয় এদিককার একটা ব্যবস্থা করুন।

সে চলে যেতেই প্রতুল বাসায় ফিরে এল। ত্রিবান্দমের দেহটা তখনও মনে হল যেন কাঁপছে। ছুটে গিয়ে তার ওপর ঝুঁকে পড়তেই প্রতুল দেখল, ওষ্ঠপ্রান্তটা তার বারেকের জন্য কেঁপে উঠেই চিরতরে স্থির হয়ে গেল।

ঘণ্টাখানেক কেটে যাওয়ার পরও যখন তটিনী কিংবা আনন্দমোহন কেউই এলেন না, প্রতুল তখন রীতিমতো চিন্তিত হয়ে উঠল।

টেবিলের কাছে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিয়ে সে কানে লাগাল। একটু পরেই বলতে শুরু করল, কে? আনন্দবাবু? …হ্যাঁ, আমি প্রতুল কথা বলছি। …কী বললেন, তটিনী যায়নি আপনার কাছে?

সংক্ষেপে এদিককার ঘটনাটা বর্ণনা করে প্রতুল বলল, আপনি তা হলে এখুনি একবার আসুন।

আনন্দমোহন আসতেই সে সমস্ত ঘটনাটা বিশদভাবে বর্ণনা করে পরিশেষে বলল, আমি তো তটিনীকে পাঠালুম আপনার কাছে! বুঝতে পারলুম না ঠিক…।

হয়তো পথে কোথাও আটকে পড়েছে। ভাববার কিছু নেই। কিন্তু আপনি খুনির কী ব্যবস্থা করছেন?

মৃদু হেসে প্রতুল বলল, আগে বেচারা একটু সামলে নিক, তারপর…।

ত্রিবান্দমের দেহটা নজরে পড়তেই সে বলে উঠল, এর ব্যবস্থাটা আপনাকেই করতে হবে। আমাকে এখুনি একবার যেতে হবে হাসপাতালে।

নয়

পরদিন সকালে চায়ের পেয়ালায় সবেমাত্র প্রতুল চুমুক দিয়েছে, এমনসময় ব্যস্তসমস্ত হয়ে আনন্দমোহন তার ঘরে ঢুকে বলে উঠলেন, এদিকে বিপদ, প্রতুলবাবু!

আবার কী হল?

তটিনী কাল থেকে এখনও ফেরেনি।

বিস্ময়-চকিত কণ্ঠে প্রতুল বলল, এখনও ফেরেনি? কোনও খোঁজখবর নিয়েছেন কি?

কোথায় আর নেব! আজ এখুনি একটা চিঠি পেয়েছি।—কথাশেষে একখানা কাগজ আনন্দমোহন প্রতুলের হাতে দিলেন।

প্রতুল সেখানা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করল :

শ্রীচরণেষু—

বাবা, আপনারা হাসপাতালে যে-লোকটিকে বন্দি করেছেন, তাকে ছেড়ে দিন। নইলে এরা আমাকে বন্দি করে রেখেছে—ছাড়বে না।

তটিনী

পড়া শেষ হতেই প্রতুলের চোখ দুটো ক্রোধে যেন জ্বলে উঠল। বলল, শয়তানরা দেখছি বাঘের ঘরে ঘোগ হয়ে ঢুকতে চায়! পরক্ষণেই নিম্নকণ্ঠে সে বলল, তাহলে কী করা যায় বলুন তো? তটিনী তো কোনওরকম ঠিকানাও দেয়নি…।

আনন্দমোহন কী বলতে যাচ্ছিলেন, এমনসময় একজন লোক ঘরে ঢুকল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রতুলের পানে তাকিয়ে সে বলল, আপনি আপনার রুগিকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছেন?

তার মানে? আমরা তো কিছুই জানি না?

তা হলে সে পালিয়ে গেছে। তার মাথায় আঘাত তেমন লাগেনি, তাই ভোরে উঠেই পালাতে পেরেছে।

লোকটির শেষের কথাগুলোয় প্রতুলের মধ্যে তেমন চাঞ্চল্য প্রকাশ পেল না। আনন্দমোহনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে বলল, ঠিক এইটাই আমি ধারণা করেছিলুম। যাক, চলুন একবার হাসপাতালে। দেখা যাক, কীভাবে পালালেন মহাপ্রভু।

হাসপাতালে এসে তারা জানল, ভোরবেলাতেই লোকটা পালিয়েছে। সকল রুগি তখন তন্দ্রায় আচ্ছন্ন, নার্সরা যখন সবেমাত্র কিছুক্ষণের জন্য পাশের রুমে গেছে, সেই অবসরে সে তার জামা-জুতো নিয়ে সরে পড়েছে।

কতক্ষণ নীরব থেকে একসময় প্রতুল বলল, আনন্দবাবু, আপনি জনকয়েক পুলিশ আর সার্জেন্টের ব্যবস্থা করুন। আমি লোকটিকে আজই ধরব।

সবিস্ময়ে আনন্দমোহন প্রশ্ন করলেন, আপনি তার সন্ধান পাবেন কী করে?

সে-ব্যবস্থা আমি আগেই করে রেখেছি।

বাক্যালাপে সময় নষ্ট না করে আনন্দমোহন আধঘণ্টার মধ্যেই প্রতুলের কথামতো জনআষ্টেক সশস্ত্র পুলিশ আর জনছ’য়েক সার্জেন্টকে তার সামনে হাজির করলেন। বললেন, এবার কী করবেন, করুন।

সন্ধানী দৃষ্টিটা একবার হাসপাতালের চারধারে বুলিয়ে নিয়ে পিছন দিকের একটা পথ দিয়ে প্রতুল তাদের সঙ্গে করে যাত্রা করল।

এখনকার পদক্ষেপটা প্রতুলের অন্য সময়ের পথ-চলা থেকে যেন একটু স্বতন্ত্র। ডেলি প্যাসেঞ্জাররা যেমন ট্রেন ফেল হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে কোনওদিকে না তাকিয়ে সজোরে পা চালাতে থাকে মাঝে-মাঝে প্রতুল ঠিক তাদের মতো চলতে লাগল। আবার কখনও এমনভাবে গতিটা সে কমিয়ে দিল—যাতে মনে হয়, দুনিয়ায় তাগিদ বলতে যেন তার আর কিছুই নেই।

পিছনে হাত পঞ্চাশেক ব্যবধানে সদলবলে আনন্দমোহন তার গতি লক্ষ করে এমন বিস্মিত ও বিরক্ত হচ্ছিলেন যে, যে-কোনও মুহূর্তে তাঁর পক্ষে ফিরে যাওয়াটা মোটেই বিচিত্র নয়।

গলির পর গলি পার হয়ে প্রতুল কিন্তু সমানেই এগিয়ে চলল। দৃষ্টিটা মাঝে-মাঝে পথের ওপর তীক্ষ্ন হয়ে উঠছে, আবার কখনও আশপাশের বাড়িগুলোর প্রতি শ্যেনের মতো গিয়ে পড়ছে।

চিন্তিত মস্তিষ্কে কতক্ষণ পার হয়ে আসার পর একসময় খিদিরপুরের একখানা দোতলা বাড়ির সামনে এসে সে থমকে দাঁড়াল। ইঙ্গিতে পুলিশ ও সার্জেন্টদের সারা বাড়িখানা ঘিরে ফেলার আদেশ দিয়ে সে আনন্দমোহনের সঙ্গে ফটকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল, এই বাড়িতে ঢুকেছেন মহাপ্রভু।

সবিস্ময়ে আনন্দমোহন বললেন, এই বাড়িতে? আপনি কি আগেই জানতেন নাকি?

আগে জানতাম না, এখন জানলাম। যাক ও-কথা, এখন ভেতরে আসুন।

লঘু সন্তর্পিত পদে তারা ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর উঠল দ্বিতলে। বারান্দার একেবারে শেষের ঘরখানার সামনে প্রতুল মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়েই ভেজানো দরজাটা চট করে খুলে দিল।

টেবিলের সামনে মুখোমুখি বসেছিল যে-দুটি লোক, মুহূর্তেই মনে হল, যেন তাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। তাদের মধ্যে একজন—মাথায় যার ব্যান্ডেজ বাঁধা, তাকে উদ্দেশ করে প্রতুল বলল, আপনি হঠাৎ হাসপাতাল থেকে চলে এলেন কেন?

লোকটি বাধা দিয়ে বলে উঠল, কিন্তু আপনারা এখানে এলেন কী করে? এ-বাড়িই বা চিনলেন কেমন করে?

কথাশেষে সে দ্বিতীয় লোকটিকে ইশারায় কী বলে দিতেই লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করল। কিন্তু তাকে বাধা দিয়ে প্রতুল বলল, যাবেন না, আপনিও এখানে দাঁড়ান…।

প্রথম লোকটি এইসময়ে পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করল। প্রতুলের পানে সেটা উদ্যত করে বলল, ওকে বাধা দেওয়ার আপনি কে? ছেড়ে দিন, নইলে…।

নইলে কী করবে?

এখুনি গুলি করে মারব। আপনি কার হুকুমে এ-বাড়িতে ঢুকেছেন?

তোমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে আমার একটা কথার উত্তর দাও দেখি। তটিনী কোথায়?

দ্বিতীয় লোকটি সহসা টেবিলের পাশে সরে এসে গুরুভার একটা বস্তু প্রতুলের দিকে সজোরে নিক্ষেপ করল।

প্রতুল যেন এ-মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। চকিতে এক-পা সরে দাঁড়িয়ে সে তার জবাব দিল পিস্তলের গুলিতে।

অব্যর্থ লক্ষ্য। পরক্ষণেই দেখা গেল, লোকটি ডানহাতখানা বাঁহাত দিয়ে চেপে ধরেছে।

প্রথম লোকটি এবার ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতুলের ওপর। কিন্তু তার শক্তি কতটুকু? মুহূর্তেই প্রতুল তাকে দু-হাতে শূন্যে তুলে ঘরের অপর পার্শ্বে অবস্থিত টেবিলের ধারে নিক্ষেপ করল।

টাল সামলাতে না পেরে লোকটি ছিটকে গিয়ে পড়ল। পুনরায় আঘাত পাওয়ামাত্রই তার ললাটের ক্ষতস্থান থেকে অঝোরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেল।

দ্বিতীয় লোকটি এইবার ছুটে এল। হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েও যেন তার কিছুই হয়নি—এমনই ভঙ্গিতে সে প্রতুলের দিকে এগিয়ে আসতেই পিছনদিক থেকে আনন্দমোহন পিস্তলের কুঁদোটা সজোরে বসিয়ে দিলেন তার মাথায়।

সঙ্গে-সঙ্গে লোকটি লুটিয়ে পড়ল মাটির বুকে। চোখের সামনে ফুটে উঠল কালো আকাশের বুকে অসংখ্য স্তিমিত তারকা।

প্রথম লোকটি ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াতেই প্রতুল বলল, এখনও কিছু পাওনা আছে বুঝি?

দেখো দেখি, এটা কেমন লাগে! বলেই সে আর-একটা ঘুষি এমনভাবে তার মুখের ওপর বসিয়ে দিল যে, সঙ্গে-সঙ্গে তার নাকের পাতাটা চিরে গেল। সামনের দাঁত দুটো খসে পড়ল জিবের ওপর।

ক্রুদ্ধ কণ্ঠে প্রতুল বলল, এখনও বলো তটিনী কোথায়? নইলে তোমার শাস্তির সবে শুরু হয়েছে, মনে রেখো।

লোকটির তখন আর কথা কইবার মতো শক্তি বোধকরি ছিল না। তত্রাচ ক্লিষ্ট কণ্ঠে সে ধীরে-ধীরে বলল, পাশের ঘরে।

আনন্দমোহনকে সেখানে অপেক্ষা করতে বলে প্রতুল ছুটে এল পাশের ঘরে। তটিনী অচৈতন্য। সম্ভবত ক্লোরোফর্ম দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছে।

মাথায় হাত বুলোতে-বুলোতে প্রতুল তাকে দু-বার ডাকল। কিন্তু কোনও সাড়া পেল না।

পুনরায় সে এ-ঘরে চলে এল। পূর্ববৎ কঠিন স্বরেই লোকটিকে বলল, কতক্ষণ তাকে ক্লোরোফর্ম করা হয়েছে?

কুঁতিয়ে-কুঁতিয়ে লোকটি বলল, ঘণ্টাদুয়েক।

আনন্দমোহনের পানে ফিরে প্রতুল বলল, তাহলে এখুনি জ্ঞান ফিরে আসবে।

লোকটির জীবনীশক্তি বোধকরি শেষ হয়ে এসেছিল। তাই সে বলল, যাওয়ার আগে আপনাদের কাছে একটা কথা শুনে যেতে চাই, প্রতুলবাবু। কী করে আপনারা এ-বাড়ির সন্ধান পেলেন?

মৃদু হেসে প্রতুল বলল, খুবই সহজ উপায়ে। তোমার জুতোর তলাটা একবার দ্যাখো। দেখবে, একটা ‘দ’ অক্ষর লেখা। অর্থাৎ, তুমি দস্যু। সেটা হাসপাতালেই আমি করে রেখেছিলাম। আর তারই সঙ্গে এমন একটা কালি লাগিয়ে রেখেছিলাম যে, যেখান দিয়েই তুমি চলো না কেন, ওই অক্ষরটার ছাপ পড়তে-পড়তে যাবে।—কথাশেষে সে নিজেই লোকটির একপাটি রবারের জুতো তুলে দেখাল।

আনন্দমোহন সপ্রশংস দৃষ্টিতে একবার প্রতুলের পানে তাকালেন।

প্রতুল পুনরায় বলল, কিন্তু তোমরা এতগুলো লোককে খুন করলে কেন?

পাশ ফিরে লোকটি ধীরে-ধীরে বলে চলল, আমি যখন রেঙ্গুনে, তখন আমার বাবা একটি ক্লাব তৈরি করেন। তাতে একসময় চাঁদমোহন, রাইমোহন, বিক্রম রায়—এরা তিনজন সভ্য হতে চেয়েছিল। কী কারণে জানি না, বাবা তাদের সভ্য করেননি। তার কিছুদিন পরেই বাবাকে তারা হত্যা করে—পিঠে ছুরি বসিয়ে দিয়ে। রেঙ্গুন থেকে ফিরে এসে খবরটা শুনে আমি তার প্রতিহিংসা নেব বলে বহুদিন ধরে সুযোগ খুঁজে এসেছি, কিন্তু তাদের খোঁজ পাইনি। শেষে একদিন চাঁদমোহনকে একটা অফিসে দেখলাম। পরে জানলুম ওইটে তার নিজেরই। তারপর একে-একে সবাইকে খুঁজে বের করে আমি…।

বাধা দিয়ে প্রতুল প্রশ্ন করল, ত্রিবান্দমকে মারলে কেন?

ত্রিবান্দম আমাদের গোপনীয় অনেক কিছু জানতে পেরেছিল। তাই তাকেও…তাই তাকেও…তাই…।

লোকটির কথা শেষ হল না। বোধকরি আর কোনওদিনই হবে না। শুধু রক্তাক্ত ওষ্ঠটা তার বারেক কেঁপে উঠল। একসময় দেহটাও তার ধীরে-ধীরে নিস্পন্দ হয়ে গেল।

রোমাঞ্চ (সাপ্তাহিক)

পুজো সংখ্যা, ১৯৪৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *