2 of 2

অন্দরমহল – সমরেশ বসু

অন্দরমহল – সমরেশ বসু

অশোক ঠাকুর বসেছিল বাইরের বৈঠকখানা বাড়িতে ওর নিজের ঘরে। বেলা এগারোটা বেজে গিয়েছে। রবিবার ছাড়া কোনওদিনই সকালবেলায় আড্ডা জমে না। বন্ধুবান্ধবরা অধিকাংশই চাকুরিজীবী। অথবা অন্য কোনও পেশায় আছে। যারা বেকার, তারাও নানা ফিকিরে থাকে। ফলে, যাকে বলে উইক ডেজ, সেই দিনগুলোতে সকালবেলা ওর ঘর ফাঁকাই থাকে। অবশ্য অষাকান্ত, ফটিক যার ডাকনাম, সে ছিল।

ফটিকেরও আর বেশিদিন সকালবেলার আড্ডায় উপস্থিত থাকা চলবে না। সি. এ. করবার পরে এখন ওর বেকার বসে থাকার কথা না। কিন্তু মনের মতো একটা ফার্ম বা সেরকম ভালো সি. এ. কাম ল-ইয়ার জুটছে না, যার ‘আর্টিকল’ হিসেবে কাজে যোগ দিতে পারে। অথচ ফটিক আরও একটা বিষয়ে ভালোরকম অনুশীলন করেছে, যা দিয়ে ও জীবিকার কথা ভাবে না। তা হল ক্যারাটে। দেখতে ও তেমন একটা বলশালী না। যাকে বলে শরীরে গোছা-গোছা মাংসপেশি নেই। কিন্তু শক্ত পেটানো লম্বা শরীর।

তুলনায় অশোক ছোটখাটো মানুষ। দেখলেই বোঝা যায়, শৌখিন তরুণ। ক্ষীণজীবী না, স্বাস্থ্য বেশ উজ্জ্বল। চোখে-মুখে একটা গভীরতা আছে। ও একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল। ফটিক একটা ইংরেজি পত্রিকার শব্দকল্পদ্রুম নিয়ে গভীর মনোনিবেশে শব্দের ধাঁধা মেলাবার চেষ্টা করছে।

অশোকের ঘর চুপচাপ থাকলেও ওর বড়দার ঘরে এখনও ধ্রুপদ-ধামারের চর্চা চলেছে চড়া স্বরের ঝংকারে। মেজদার ঘরে জ্যোতিষচর্চার প্রচণ্ড বিতর্ক চলছে নানান গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ও তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে।

কলকাতার উপকণ্ঠে, এই ঠাকুরবাড়িকে এখন লোকেরা পাগলের বাড়ি বলে। তিন ভাইয়ের কেউ বিয়ে করেনি। করবার কোনও লক্ষণও নেই। বড় ছেলে গানের চর্চায় চুল পাকিয়ে ফেলেছে। মেজও জ্যোতিষে চুল পাকাতে বসেছে। কনিষ্ঠতম অশোক মেতে আছে অপরাধতত্ত্ব নিয়ে। বয়েস হল প্রায় ত্রিশ। ইতিমধ্যেই কিছু দুরূহ অপরাধের রহস্য উদ্ধার করে কলকাতার পুলিশের উচ্চমহলে ও যথেষ্ট সুনাম করেছে।

অশোক হঠাৎ খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল। বড়দা, মেজদার ঘরের গানের চিৎকার, জ্যোতিষের চড়া স্বরে বিতর্কের মধ্যেও, অস্পষ্ট মৃদু আড়ষ্ট খসখস শব্দটা ওর কানে এসেছে। ফটিকের দিকে তাকিয়ে দেখল, ও শব্দের ধাঁধায় নিমগ্ন। বাইরের চওড়া রকের ওপর খসখস শব্দটা কানে আসার মতো না। কিন্তু অশোকের মন আর দৃষ্টি বইয়ের দিকে থাকলেও ওর শ্রবণেন্দ্রিয় হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল। বলল, ‘ভদ্রলোক ঠিক করতে পারছেন না, ঠিক জায়গায় এসেছেন কি না।’

ফটিক অবাক চোখে মুখ তুলে তাকাল : ‘কার কথা বলছিস?’

‘এখনও দেখতে পাচ্ছিনে, পায়ের শব্দটা শুনেছি।’ অশোক হেসে বলল, ‘বড়দা-মেজদার ঘরের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ভদ্রলোক ঘাবড়ে গেছেন। ভাবছেন, কোথায় এসে উঠলাম। কোনদিকে যাবেন ঠিক করতে পারছেন না।’

ফটিক ভুরু কুঁচকে বাইরের দিকে দেখল : ‘টের পেলি কী করে, কেউ এসেছে কি না?’

‘সুকতলা ক্ষয়ে যাওয়া পুরোনো জুতোর শব্দ পেয়েছি।’ অশোক বলল, ‘ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছে, তবে বোধহয় শহুরে মানুষ নন। সন্দেহ হচ্ছে, ভদ্রলোক আমার কাছেই এসেছেন। একটু বাইরে গিয়ে দ্যাখ তো।’

ফটিকের চোখে সংশয়। তবু উঠে বাইরে গেল। দেখল, সত্যি এক ভদ্রলোক রকের ওপর এসে দাঁড়িয়েছেন। গায়ে ধুতি-পাঞ্জাবি। জুতোজোড়া সত্যি পুরোনো। হাতে একটি ছাতা। বয়েস অনুমান ষাটের কাছাকাছি। চোখে-মুখে সংশয় ও বিভ্রান্তি। তাকিয়ে দেখছেন সব ঘরের দিকেই। কিছুই যেন স্থির করতে পারছেন না।

ফটিক এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কাকে খুঁজছেন?’

ভদ্রলোক ফটিককে দেখে তেমন আমল দেওয়ার চেষ্টা করলেন না। বললেন, ‘খুঁজছি তো অশোক ঠাকুরকে। কিন্তু মনে হচ্ছে, ভুল বাড়িতে এসে পড়েছি। লোকে যে কীসব আজেবাজে বাড়ি দেখিয়ে দেয়। এখানে তো শুনছি গান-বাজনা আর কীসব চিৎকার-চেঁচামেচি।’ কথাগুলো বলে ভদ্রলোক ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন।

ফটিক মনে-মনে হেসে বলল, ‘আজেবাজে বাড়ি দেখিয়ে দেয়নি, এটাই অশোক ঠাকুরের বাড়ি।’

‘অ্যাঁ?’ ভদ্রলোক ফিরে দাঁড়ালেন : ‘সত্যি? তা উনি কি গানবাজনা করেন নাকি?’

ফটিক বলল, ‘না। উনি বই পড়ছেন। গান করছেন ওঁর বড়দা। আর মেজদা জ্যোতিষ নিয়ে আলোচনা করছেন।’

‘তাই বলুন।’ ভদ্রলোক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন : ‘আমি ভাবলাম, কোথায় এসে উঠলাম! তা অশোকবাবু কি বাড়ির ভেতরে আছেন?’

ফটিক বলল, ‘উনি ওই ঘরে বসে বই পড়ছেন। আসুন।’

‘আপনি?’ ভদ্রলোকের মনে তখনও সংশয়।

ফটিক বলল, ‘আমি অশোকবাবুর বন্ধু।’

‘আশ্চর্য, আর আমি মন্দিরের পাশে ওই ঘরটাকে ভাবছিলাম খালি ঘর।’ ভদ্রলোক কোঁচা তুলে মুখ ও ঘাড়ের ঘাম মুছলেন। ফটিকের পিছনে-পিছনে এগিয়ে গেলেন।

ফটিক বলল না, অশোক আগেই ভদ্রলোকের আসাটা টের পেয়েছে। ভদ্রলোক অশোকের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মাদুরের ওপর শতরঞ্চি পাতা। গোটাকয়েক তাকিয়া এদিকে-ওদিকে ছড়ানো। আর কয়েকটা ছাইদানি। কিছু বইপত্র, ম্যাগাজিন এলোমেলা এখানে-সেখানে। অশোক তাকিয়ায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বই পড়ছিল। সোজা হয়ে বসে, কপালে দু-হাত ছুঁইয়ে ডাকল, ‘আসুন।’

ভদ্রলোক জুতোজোড়া বাইরে খুলে ছাতা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন।

অশোক বলল, ‘বসুন। আমার নাম অশোক ঠাকুর।’

‘আশ্চর্য, আপনার বয়েস এত কম ভাবতে পারিনি।’ ভদ্রলোক বিস্ময়ে নমস্কার করতেই ভুলে গেলেন। অশোককে দেখতে-দেখতে ছাতা পাশে রেখে বসলেন।

অশোক হেসে বলল, ‘মনে হচ্ছে, অনেক দূর থেকে আসছেন।’

‘তা আসছি।’ ভদ্রলোক অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রথম ট্রেন ধরে এসেছি।’

অশোক বলল, ‘বুঝেছি। পাড়াগাঁর রাস্তা, বেশ খানিকটা হেঁটে স্টেশনে এসে ট্রেন ধরতে হয়েছে।’

‘কী করে বুঝলেন?’ ভদ্রলোক আরও অবাক হলেন।

অশোক বলল, ‘আপনার জুতো-ছাতা-জামাকাপড় সব দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তা কোথা থেকে আসছেন? মনে হচ্ছে, রাস্তায় বৃষ্টিও হয়েছে। কাদা মাড়াতে হয়েছে।’

ভদ্রলোক নিজের জামাকাপড় দেখলেন। ছাতাটা দেখলেন। বাইরে রাখা জুতোজোড়ার দিকে লক্ষ করলেন। অবাক হেসে বললেন, ‘ঠিক বলেছেন। আসছি পাটুলি থেকে। হুগলির পাটুলি নয়, বর্ধমানের পাটুলি। আমার নাম ব্রজনাথ রায়। আসলে শাণ্ডিল্য গোত্রীয়। নবাবি আমলে পাওয়া রায় উপাধি। আদি বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদ, একশো বছর আগে। তারপরে পাটুলি। লোকে আমাদের এখনও জমিদার বলে। তবে তালপুকুরে ঘটি ডোবে না। তিন শরিকে ভাগাভাগি, জমিজমা যা আছে, কোনওরকমে চলে যায়। তবে ছেলেরা চাকরি-ব্যবসাও করে। আমার দুই দাদা মারা গেছেন। রায়বাড়িতে বড় বলতে এখন আমিই আছি। বড় শরিক বলতে আমার ভাইপো নীতীশ রায় ছিল—।’

‘তিন সপ্তাহ আগে খুন হয়েছে।’ অশোক বইটা একপাশে রাখল ‘কিন্তু গ্রামের নাম পাটুলি, না পাটলি?’

ব্রজনাথ থমকে গেলেন এক মুহূর্ত। অশোকের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে দেখলেন। তারপরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘বুঝেছি, খবরের কাগজে নীতীশের খুনের ঘটনা পড়েছেন। হ্যাঁ, পাটলিই আসল নাম, তবে আমাদের মুখে পাটুলি। স্টেশনে পাটলি বলেই লেখা আছে। গ্রামটা কিন্তু স্টেশন থেকে বেশ দূরে, গঙ্গার ধারের কাছাকাছি। নীতীশের খুনের জন্যেই আপনার কাছে এসেছি।’

‘নীতীশবাবু তো রাজনীতি করতেন। তাঁর দলের লোকেরা বলেছে, এটা পলিটিকাল মার্ডার।’ অশোক বলল, ‘খবরের কাগজে তাই বলেছে। কিন্তু প্রমাণ করা যায়নি। পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তারও করেনি।’

ব্রজনাথবাবু বললেন, ‘সবই জানেন দেখছি। কিন্তু আমি তো বাবা—আপনাকে আর কী বলব, ছেলেমানুষ, বাবা-ই বলি, আমি বড় বিপদে পড়েছি। বিপদ না বলে, জঘন্য অপবাদ আমার নামে দেওয়া হচ্ছে…আমি নাকি নীতীশকে লোক লাগিয়ে খুন করেছি। পুলিশের মতিগতিও সুবিধের নয়। তারাও সেইরকমই সন্দেহ করছে। আমাকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। আর বুঝুন, থানা কি এখানে? সেই পূর্বস্থলীতে।’

‘কারা বলছে আপনি খুন করিয়েছেন, আর কেনই বা বলছে?’ অশোকের দৃষ্টি ব্রজনাথের চোখের দিকে।

ব্রজনাথ বললেন, ‘কারা আবার? নীতীশের ভাই-বোন কেউ নেই। বিয়ে করেনি। আমাদের আর-এক শরিক কথাটা রটাচ্ছে, তার সঙ্গে গাঁয়ের মাতব্বররাও আছে। নীতীশকে খুন করিয়ে, আমি নাকি ওর যাবতীয় জমিজমা, সম্পত্তির মালিক হতে চাই। যেন হাতের মোয়া। আসলে, নীতীশের সঙ্গে আমার ঝগড়া ছিল। বাক্যালাপ ছিল না। এখন এই অপবাদের হাত থেকে আপনি আমাকে বাঁচান।’

‘নীতীশবাবুর সঙ্গে আপনার ঝগড়া কী নিয়ে? বাক্যালাপই বা ছিল না কেন?’

‘সে বাবা অনেক ব্যাপার।’ ব্রজনাথ বললেন, ‘প্রথম কথা, তার রাজনীতি করা আমার মোটেই পছন্দ ছিল না। জমিজমা, ধান-চাল নিয়ে তার পার্টিবাজি আর দান-ধ্যান আমার সহ্য হত না। এমনকী, নীতীশ আমার জমির ধান পর্যন্ত নিজের দলের লোকদের দিয়ে কাটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমি তো রাজনীতি করিনে, আমার জমিতে তোর হাত দেওয়ার কারণ কী? তা ছাড়া বন্দুক!’

‘বন্দুক?’ অশোক ভুরু কুঁচকে তাকাল।

ব্রজনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, বন্দুক একটা আছে। সেটা নীতীশের কাছেই থাকত। আমি জানতাম, ও বাজে লোকদের মাঝে-মাঝে বন্দুকটা ভাড়া দিত, কেউ জানতে পারত না। তা নিয়েও ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া ছিল। বন্দুকটা যাদের ভাড়া দিত, তারা কেউ ভালো লোক ছিল না। নেহাত ডাকাতি করার জন্যেই বন্দুক ভাড়া দেওয়া হত।’

‘তার মানে, নীতীশবাবু রাজনীতি করতেন, অথচ বন্দুক ভাড়া দিতেন ডাকাতদের?’

‘তাই বলতে হবে। রাজনীতি যারা করে, তারা কি ডাকাতি করে না?’

‘কিন্তু দলের লোককে ভাড়া দেবেন কেন? তাদের তো এমনিতেই দিতে পারতেন।’

‘তা পারত, কিন্তু দিত না। আমি জানি, ও টাকা নিয়ে বন্দুক ভাড়া দিত। এটা আমি পুলিশকে জানাব বলে ওকে ভয় দেখাতাম। সত্যি কি আর জানাতাম? ব্যাপারটা তো খারাপ। তা ছাড়া ওর যা সম্পত্তি, জমিজমা, সেসব নিয়ে ও একলা ভোগ করবে কেন? আমাদের দেবে না কেন? চোখের সামনে দেখছিস, আমরা কষ্টে আছি, অথচ তুই কতগুলো উড়নচণ্ডে বদমাইশকে ধান, টাকা দিয়ে পুষছিস। লোকেরা সবাই জানত, ওসব নিয়ে ওর সঙ্গে আমার মন-কষাকষি ছিল। তা বলে ওকে আমি খুন করাব কেন? আমার লাভটা কী?’

‘লাভ, নীতীশবাবুর জমি-সম্পত্তি।’ অশোক হাসল : ‘নীতীশবাবু বাপের এক ছেলে। বিয়ে করেননি। উইল-টুইলও কিছু করেননি বোধহয়?’

‘না—করলে এতদিনে জানা যেত।’

‘তাহলে নীতীশের সম্পত্তির ওয়ারিশ তো আপনারাই। আপনাদের দুই শরিকের ওয়ারিশন, তাই না?’ অশোক ঘাড় কাত করে তাকাল।

ব্রজনাথ বললেন, ‘ব্যাপারটা তাই দাঁড়াচ্ছে। আর সেইজন্যেই আপনার কাছে এসেছি। প্রমাণপত্র কিছু নেই, অথচ আমার নামে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, নীতীশকে আমিই খুন করিয়েছি। মতলবের দিক থেকে দেখতে গেলে, আমরা দুই শরিক মিলে ওকে খুন করতে পারি। অন্য শরিকের কথা জানিনে। আপনাকে বলতে এসেছি, আমি খুন করাইনি। বরং নীতীশকে মনে-মনে ভালোবাসতাম। শত হলেও, ওর বাবার পরে, আমিই তো অভিভাবক। আমি ওর ছোটকাকা। দাদাদের আর কেউ বেঁচে নেই। ওকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেছি—আর কেউ নয়, আমিই চেষ্টা করেছি। সত্যি কথা বলতে কী, আমার ওপর রাগ-ঝাল থাকলেও নীতীশ বুঝত, ছোটকাকা ওর ভালোই চায়। এমনকী, আমার বড় মেয়েকে বলেওছিল, আমার সম্বন্ধ করা মেয়ে বিয়ে করার ইচ্ছে ওর আছে।’

‘শুনুন ব্রজনাথবাবু, আপনি যা বলছেন, তাতে আপনার ওপর সন্দেহ ঘোচে না।’ অশোক গম্ভীর স্পষ্ট স্বরে বলল, ‘আপনাকে যুক্তির ঊর্ধ্বে বিশ্বাস করা ছাড়া, আর কিছুতেই আপনার বা অন্য শরিকের মতলবকে বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। হয়তো প্রমাণ করা যাবে না, সেটা আলাদা কথা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অন্য শরিককে বাদ দিয়ে, আপনাকেই কেন এ-অপবাদ দেওয়া হচ্ছে?’

ব্রজনাথ অসহায়ভাবে দু-হাত তুলে বললেন, ‘সেটারই কোনও কারণ আমি বুঝতে পারছি না। এটা অন্য শরিকের চাল হতে পারে। পুলিশ তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু আপনাকে আমি বলছি, এসব ফালতু। পুলিশ কোথাও কিছু করতে না পেরে এখন আমাদের নিয়ে পড়েছে। আমি কাটোয়ায় গেছলাম আমার এক উকিল-বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করতে। কেননা, এ তো সাপ নিয়ে খেলা হচ্ছে। পুলিশ আসল খুনিকে ধরতে না পেরে, এখন হাতের কাছে যা পাচ্ছে, তাই নিয়ে টানাটানি করছে। আমার উকিল-বন্ধুর পরামর্শে আপনার কাছে এসেছি।’

‘কী বলেছেন আপনার উকিল-বন্ধু?’ অশোকের চোখে ভ্রকুটি সন্দেহ।

ব্রজনাথ বললেন, ‘উকিল-বন্ধুর পরামর্শ হল, পুলিশ যাই বলুক, আমাকে খুনি হিসেবে প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু এ-অপবাদ থেকে অব্যাহতি পেতে হলে খুনিকে ধরাবার জন্যে আমারই কিছু করা উচিত। তাই সে আপনার কাছে আমাকে আসতে বলল।’

বলতে-বলতে ব্রজনাথ হঠাৎ হাতজোড় করে ব্যগ্র ব্যাকুল স্বরে বললেন, ‘আমি জানি, আপনিও হয়তো আমাকে সন্দেহ করছেন। তবু আমি আপনার কাছে ছুটে এসেছি। দেখুন বাবা, এতকাল মান-সম্মান নিয়ে বেঁচে আছি, লোকের মুখে মন্দ অপবাদ কখনও শুনিনি। বংশের গৌরব বলে একটা কথা আছে। জমি-বাড়ি বেচে হোক বা যেভাবেই হোক, আপনার টাকা আমি জোগাব—আপনি বাবা এ-খুনের একটা কিনারা করুন। শুনেছি, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আপনি সেইরকম। আপনি এই খুনের তদন্তের ভার নিন। আমাকেই যদি খুনি হিসেবে প্রমাণ করেন, তাতেও আমার আপত্তি নেই, ফাঁসি যাব। তবু আসল রহস্য ফাঁস হোক। ভাইপো খুনের দায়ের এ-অপবাদ থেকে হয় আমাকে রেহাই দিন, না হয় শাস্তি দিন।’

অশোক ব্রজনাথের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ফটিকের দিকে তাকাল। ফটিক তাকিয়েছিল ওর দিকেই। ফটিক অবাক হয়েছে, অথচ ওর চোখেও সন্দেহ। অশোক খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল। গম্ভীর মুখ, চোখে অন্যমনস্কতা। ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা। অন্য ঘরে গান আর জ্যোতিষচর্চায় ভাটা পড়েছে।

অশোক মুখ ফিরিয়ে ব্রজনাথের দিকে তাকাল। এখন ওর চোখে জিজ্ঞাসু অনুসন্ধিৎসা, কিন্তু ভ্রকুটি সন্দেহের ছায়া নেই। জিগ্যেস করল, ‘নীতীশবাবুকে তো কুপিয়ে মারা হয়েছে।’

‘হ্যাঁ, গলায় ধারালো দা বা কুড়ুল, এরকম কিছু দিয়ে কুপিয়ে মেরেছে।’ ব্রজনাথ বললেন, ‘বাড়ির সামনের অংশে, বাগানে বসেছিল। প্রায়ই চেয়ার পেতে সন্ধেবেলা ওখানে বসত। ওর বন্ধুরাও আসত সেই সময়ে। রাত্রি অবধি আড্ডা হত। নীতীশ তো আবার গ্রামের ইস্কুলে পড়াত। লেখাপড়ায় তো খারাপ ছিল না! বর্ধমান ইউনিভারসিটি থেকে এম. এ. পাশ করেছিল।’

‘ঘটনা কখন ঘটে?’

‘ওই সন্ধেবেলাতেই। সেদিকে আমরা এমনিতেই যাইনে। ওর বাবার আমলের চাকর, বুড়ো পীতু কয়েকটা চেয়ার এনে দিত। আর একটা টেবিল আর হ্যারিকেন। বন্ধুরা আসতে-আসতে সন্ধে উতরে যেত। আড্ডা চলত অনেকক্ষণ। শুনেছি—।’ ব্রজনাথ থেমে গেলেন।

অশোক কোনও কথা বলল না, ব্রজনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ব্রজনাথ একটু গলাখাঁকারি দিলেন : ‘কোনওদিন চোখে দেখিনি, তবে শুনেছি রাত্রে নাকি ওরা মদ খেত। কিন্তু খুনের দিন মদের বোতল-টোতল কিছুই ছিল না। বন্ধুরা আসবার আগেই যা ঘটবার ঘটে গেছল।’

অশোক বলল, ‘তার মানে খুনি ওত পেতেছিল, তাই না? বাগানে চেয়ার নিয়ে নীতীশ বসবার পরেই, ওর বন্ধুরা আসবার আগে, খুনি তার কাজ করেছিল।’

‘ঠিক তাই।’ ব্রজনাথ বললেন, ‘কারণ, বন্ধুরা আসার আগে, পীতু হ্যারিকেন নিয়ে এসে নীতীশকে গলা কাটা অবস্থায় দেখতে পেয়ে চিৎকার করেছিল।’

অশোক জিগ্যেস করল, ‘গলা কাটা মানে কী? একেবারে বলি নাকি?’

‘না-না, ধড়-মুন্ডু আলাদা হয়নি। চোয়ালের নীচে, গলার ধার দিয়ে কোপ মেরেছিল।’

ব্রজনাথের মুখে যন্ত্রণার ছাপ, গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে এল : ‘মাথার পেছনদিকেও একটা কোপ লেগেছিল। কিন্তু গলার কোপেই মারা যায়। নীতীশ চেয়ারেই বসেছিল, উঠতেও পারেনি, পড়েও যায়নি।’

‘হুঁ, পীতুই তাহলে প্রথম দেখেছিল। পুলিশ কখন আসে?’

‘পুলিশ খবর পেয়ে আসতে-আসতে পরের দিন ভোরবেলা।’

‘নীতীশ তখনও সেইভাবেই পড়ে ছিল?’

‘হ্যাঁ, কেউ ছোঁয়নি। তবে সারা রাত লোকজন ভিড় করেছিল।’

‘যারা সন্ধেবেলায় আসত, তারা এসেছিল?’

‘হ্যাঁ, সকলেই এসেছিল। তারাই থানায় গিয়ে খবর দেয়। তাদের ধারণা, নীতীশকে ওদের বিরোধী রাজনৈতিক দলের লোকেরা মেরেছে। তা নিয়ে পোস্টারও পড়েছে।’

‘পুলিশ কী বলছে?’

‘তারা তদন্ত করেই চলেছে।’ ব্রজনাথ অসহায়ভাবে হাত তুলে বললেন, ‘কিন্তু কোনও কূলকিনারা আর করতে পারছে না। কাউকে অ্যারেস্টও করেনি। নীতীশের অ্যান্টিপার্টির লোকদের অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, থানায় ডেকে নিয়ে গেছে। কয়েকজনকে কয়েকদিন আটকেও রেখেছে। কিন্তু কেস দিতে পারেনি। এখন আমাদের নিয়ে পড়েছে। কী বিপদ বলুন তো! বিশেষ করে আমাকেই তাদের সন্দেহ বেশি, কারণ, নীতীশের সঙ্গে আমার মন-কষাকষি ছিল, বাক্যালাপ ছিল না। আর ও মরলে আমার লাভ। কী বলব, বলুন।’

অশোক আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিগ্যেস করল, ‘আপনার কাকে সন্দেহ হয়?’

‘আমার?’ ব্রজনাথ একটুও না ভেবে বললেন, ‘আমি নীতীশের দলের লোকদেরও বিশ্বাস করি না। তাদের মধ্যে কার মনে কী ছিল, কে বলতে পারে? বিশেষ করে ও যাদের বন্দুক ভাড়া দিত, তাদের সঙ্গে কোনওরকম বিবাদ হতে পারে। আবার ওর অ্যান্টিপার্টির লোকেরাও মারতে পারে। তার একটা কারণ আছে। বেলেরহাটের একজনকে তার কিছুদিন আগে গুলি করে মারা হয়েছিল। সে ছিল নীতীশদের অ্যান্টিপার্টির লোক। এটা তার বদলা হতে পারে।’

‘সেই গুলি করে খুন করার ব্যাপারে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেছে?’

‘করেছে। দুজনকে গ্রেপ্তার করে চালান দিয়েছে, কেসও হয়েছে।’

‘তাদের কাছে কি বন্দুক পাওয়া গেছল?’

‘শুনেছি কোনও বন্দুক পাওয়া যায়নি। তবে তাদের বাড়ি তল্লাশি করে একটা পাইপগান আর কয়েকটা বোমা পাওয়া গেছল।’

‘বেলেরহাটের লোকটিকে কি পাইপগান দিয়ে গুলি করা হয়েছিল?’

‘তা তো বলতে পারিনে, বাবা।’ ব্রজনাথ মাথা নাড়ালেন ‘শুনেছি, তাকে গুলি করে মারা হয়েছে। আর কয়েকজন সাক্ষিও দিয়েছে।’

‘নীতীশের খুনের কোনও সাক্ষী পাওয়া যায়নি?’

‘না। সাক্ষীর মধ্যে একমাত্র পীতু, যে ওই অবস্থায় নীতীশকে দেখেছিল।’

অশোক ফটিকের দিকে তাকাল। ফটিক বলল, ‘কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। পুলিশের ভূমিকাটা কী? খুনিকে কভার করছে?’

‘কভার করলেও, তিন সপ্তাহের মধ্যে একটা কেস দাঁড় করাতে অসুবিধেটা কী?’ অশোক ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে না পারার কোনও কারণ তো দেখিনে? ডিস্ট্রিক্ট অথরিটিই বা চুপ করে আছে কেন?’

ব্রজনাথ তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না বাবা, তা বলা চলবে না। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট নিজে আমাদের গাঁয়ে এসেছিলেন। শুনছি, ওপর থেকে পুলিশকে চাপও দেওয়া হচ্ছে। সেই চাপ এখন আমার ওপর। বোঝো ঠ্যালা!’

‘নীতীশবাবুর বন্দুক কোথায়?’

‘এখন থানায় নিয়ে গেছে।’

অশোক বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপরে জিগ্যেস করল, ‘আপনার ভাইপোর চরিত্র কেমন ছিল? মানে—।’

‘মেয়েমানুষের ব্যাপার?’ ব্রজনাথ দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘কোনও দোষ ছিল না। এমনকী, ওর শত্রুও বলতে পারবে না, নীতীশের চরিত্রের ওসব দোষ ছিল। মদ খাওয়ার কথা শুনেছি, দেখিনি। ও বাবা, সে-কথা যদি বলেন মাঝে-মধ্যে আমিও তো একটু-আধটু খেয়ে থাকি।’

অশোক হেসে উঠল : ‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ। মিছে কথা কেন বলব, বাবা?’ ব্রজনাথ সরলভাবেই বললেন, ‘ঝাঁপানের সময়, অথবা দোল-দুর্গোৎসবে, কালীপুজোয় খাই বইকী। সবাই জানে, এ আর অস্বীকার করার কী আছে!’

‘হুঁ, থানা বললেন পূর্বস্থলী?’

‘হ্যাঁ।’

‘সদর থেকে অনেক দূর। আপনাদের গ্রাম থেকেও থানা বেশ দূরেই, তাই না?’

‘হ্যাঁ, তা হবে মাইল-দশেক।’

‘তা এখন আপনি কী চান?’

‘বললাম তো বাবা, আপনি কী টাকা চান বলুন, আমি দেব। এ-খুনের একটা কিনারা করুন। আমার উকিল-বন্ধু বলেছে, আপনি বাবা হাত দিলে এর রহস্য ফাঁস হবেই। আমাকে অপবাদের হাত থেকে বাঁচান। আসল খুনিকে ধরিয়ে দিন। আমি আজ কিছু টাকা নিয়ে এসেছি।’ ব্রজনাথ পাঞ্জাবি তুলে কোমরের কষিতে হাত দিলেন।

অশোক বলল, ‘এখন টাকা রাখুন। আপনি আজ বাড়ি যান। আজ হল মঙ্গলবার, হাতে পাঁজি করেই এসেছেন। আগামী শুক্রবার আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে।’

‘কোথায়?’ ব্রজনাথ অবাক চোখে তাকালেন।

‘আপনার গ্রামে, আপনার বাড়িতে।’

‘বলছেন বাবা?’ ব্রজনাথ হাতজোড় করলেন : ‘আমার পরম ভাগ্য।’

‘কিন্তু গ্রামে গিয়ে কাউকেই কিছু বলবেন না। এমনকী, আপনার বাড়ির লোক বা শরিকদের কাউকে কিছু বলবেন না। আমরা দুই বন্ধু যাব, আপনার আত্মীয় সেজে। কেবল আপনার গিন্নিকে বলবেন। তা নইলে অসুবিধে হবে। আপনার ছেলেমেয়েরা—।’

‘কেউ নেই, বাবা। বড় ছেলে কলকাতায় চাকরি করে। শনিবার রাত্রে যায়, সোমবার সকালে কলকাতায় ফিরে আসে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ছেলে ক্লাস টেনে পড়ে। আমি বউকে শিখিয়ে রাখব, আপনাদের বাবা-বাছা করে ঘরে তুলে নেব।’

অশোক হেসে বলল, ‘ঠিক আছে। আপনি এখন আসুন।’

ব্রজনাথ তবু একটু দ্বিধা করলেন : ‘কিছু টাকা নিয়ে এসেছিলাম—।’

‘থাক, পরে হবে। একটা কথা বলে যান। নীতীশবাবুকে যে-অস্ত্র দিয়ে মারা হয়েছিল, সেটা কি পাওয়া গেছে?’

‘না। সেইজন্যেই তো বোঝা যাচ্ছে না, দা দিয়ে না কুড়ুল দিয়ে মেরেছে।’

‘ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাওয়া যায়নি?’

‘আমরা কিছু পাইনি। পুলিশ আমাদের কিছুই বলেনি, বলতেও চায় না। গ্রামের পুলিশ যে কী চিজ, তা বাবা আপনাদের শহরের লোককে বোঝাতে পারব না।’

অশোক মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল। ব্রজনাথও ছাতা হাতে উঠে দাঁড়ালেন।

শুক্রবার ঘোর দুপুরে অশোক ফটিককে নিয়ে পাটলিতে এল সাইকেল রিকশায়। আসবার পথে ও বর্ধমানের ডি. এম.-এর সঙ্গে দেখা করেছিল। যুবক জেলাশাসকটি মানুষ ভালো। অশোকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি। পরশু রাত্রে তাঁর বাংলোতে খাইয়েছেন। পূর্বস্থলী থানার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। সাহায্য করার নির্দেশও পাঠিয়েছেন।

অশোক থানার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। অফিসার ইনচার্জের বক্তব্য শুনেছে। তাঁর বক্তব্য, এই বিরাট অঞ্চলের থানার মোটামুটি সব অপরাধীকে তিনি চেনেন। রাজনৈতিক দলাদলির বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খ জানেন। কিন্তু তিনি সত্যি লজ্জিত আর মর্মাহত, নীতীশের খুনিকে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছেন না। নীতীশের শত্রু ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু এরকম হাই হার্টেড মার্ডারার শত্রু তার কেউ ছিল বলে এখনও জানা যায়নি। বরং, বিরোধী রাজনৈতিক দলের লোকেরাও নীতীশকে সেরকম শত্রু মনে করত না। কারণ, নীতীশ খুন-খারাপি করবার মতো রাজনীতি করত না। তার বন্দুক ভাড়া দেওয়ার কথা অবশ্য থানা কোনওদিন শোনেনি। শুনলে অনেক আগেই বন্দুক সিজ করে নিত। অনেক ভেবে, চিন্তা করেই, এখন সন্দেহটা নীতীশের সম্পত্তির দাবিদারদের ওপর এসে পড়ছে।

অশোক অফিসার ইনচার্জকে জানিয়ে এসেছে, ওর পাটলিতে যাওয়ার ঘটনা যেন গোপন থাকে। লোক পাঠিয়ে খবর দিলেই যেন উনি সদলবলে হাজির হন।

অশোক রিকশাওয়ালার সঙ্গে গোটা পথ কথা বলতে-বলতে এসেছে। রিকশাওয়ালাটি রুগ্ন। গরিব ব্রাহ্মণের ছেলে। বয়েস অবিশ্যি চল্লিশের কম না। রুগ্ন বলতে, নেশা-ভাং করে শরীরটি জখম করেছে। লেখাপড়া শেখেনি। জমিজমা নেই। রিকশা টেনেই যা আয় হয়। নীতীশের খুনের ব্যাপারে তার স্পষ্ট জবাব, ‘ওসব হল বাবু, নিজেদের দলের ব্যাপার। ছোট মুখে বড় কথা কী বলব, বলুন। পুলিশ জানে না, এ কখনও হয়? চেনাশোনা লোক ছাড়া নীতীশদাকে কেউ মারতে পারে না। বাইরের লোক এসে মেরে যায়নি। এই তো, বছরখানেক আগে এক খুনি আসামি থানার হাজত থেকে পালাল। আজ অবধি পুলিশ তাকে খুঁজে বের করতে পারেনি। অথচ, লোকের কাছে শুনুন, সে নাকি আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

রিকশা রায়বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বিরাট দোতলা বাড়ি। কালের থাবায় জীর্ণ। ভাঙনের নানা চিহ্ন স্থানে-স্থানে। শ্যাওলার রং হয়েছে যেন ভুতুড়ে বাড়ির মতো। সামনে অনেকখানি খোলা জায়গা। কাছেপিঠে লোকজন কেউ নেই। একেবারে নিঝুম। তার মধ্যেই হঠাৎ একটি মেয়ে-গলার খিলখিল হাসি শোনা গেল। সেটাও একরকম ভুতুড়ে। গায়ে কাঁটা দেয়। আর হাসতে-হাসতেই একটি আঠারো-কুড়ি বছরের যুবতীকে বাড়ির দিক থেকে ছুটে আসতে দেখা গেল। তার পিছনে আর-একজন বর্ষীয়সী স্ত্রীলোক তাড়া করে আসছিল। অশোকদের দেখে দুজনেই থমকে গেল।

মেয়েটির পরনে ময়লা শাড়ি আর জামা। শরীর ভরা উদ্ধত যৌবন। মুখশ্রী খারাপ নয়, বড়-বড় চোখে একটা চটক আছে। মাথার চুল ঝাঁকড়া, আর ঘাড় অবধি ছাঁটা। চোখের দৃষ্টি বুনো, আর লাল। রিকশাওয়ালা বলল, ‘বোবা। মাথায় ছিটও আছে। নীতীশদার চাকর পীতু গয়েনের নাতনি।’

মেয়েটা তার বুনো অবাক চোখে ভুরু কুঁচকে অশোকদের দিকে তাকিয়ে রইল। অশোক রিকশার ভাড়া মেটাতে-মেটাতে বলল, ‘ব্রজনাথবাবুর দরজাটা কোন দিকে হবে?’

রিকশাওয়ালা বলল, ‘সামনের অংশটা নীতীশদার। ডানদিকে যে-বাগান দেখছেন, ওখানেই খুন হয়েছিলেন। আপনারা বাড়ির বাঁ-দিকে গিয়ে বেড়ার সীমানা দেখতে পাবেন। ওটাই ছোট কাকার অংশ।’

অশোক আর ফটিক কয়েক পা এগোতেই বোবা মেয়েটা বাড়ির সামনের দিকে হেঁটে চলে গেল। যেতে-যেতে মুখ ফিরিয়ে দুজনকে বারে-বারে দেখতে লাগল, আর শাড়ির আঁচলটাকে দাঁত দিয়ে চিবোতে লাগল।

অশোক আর ফটিক বাঁ-দিকে গেল। বেশ খানিকটা জমি ঘিরে কঞ্চির বেড়া। ভিতরে নানারকম ফুলগাছ লাগানো হয়েছে। তৈরি বাগান, গোলাপ গাছে গোলাপও ফুটেছে।

ব্রজনাথ বেরিয়ে এলেন। খালি গা, পরনে ধুতি। হাসতে-হাসতে এগিয়ে এসে বললেন, ‘এসো বাবা, এসো। অনেককাল বাদে, চিনতেই পারা যায় না।’

অশোকের ষষ্ঠেন্দ্রিয় সজাগ হল। মনে হল, বাড়িটার নানা দরজা-জানলায় অনেক চোখ। ও ঝপ করে ব্রজনাথকে প্রণাম করে বলল, ‘কাটোয়ায় এসেছিলাম। ভাবলাম, সেই কবে আপনাকে কলকাতায় দেখেছি, একবার ঘুরে যাই।’

‘বেশ করেছ বাবা, খুব ভালো করেছ।’ ব্রজনাথ অশোকের হাত ধরে বললেন, ‘এভাবে না এলে কি আত্মীয়তা থাকে? চলো, ভেতরে চলো। বাড়ির খবর সব ভালো?’

অশোক ব্রজনাথের সঙ্গে চলতে-চলতে বলল, ‘ওই একরকম। আপনাদের খবর সব ভালো?’

‘না, বাবা। আমরা বড় অশান্তিতে আছি। এসো, সব বলব।’ ব্রজনাথ অশোক আর ফটিককে নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকলেন। দোতলায় উঠে অনেকটা নিশ্চিন্ত। ব্রজনাথের মধ্যবয়েসি স্ত্রী এগিয়ে এলেন। হেসে বললেন, ‘বসুন। এখানে কেউ কোনও কথা শুনতে পাবে না। ছেলেকে বলব, আপনি আমার দূরসম্পর্কের বোনের ছেলে। বড় ছেলে কাল রাত্রে ফিরলে তাকেও তাই বলা হবে। এখন একটু জিরোন।’

‘তা জিরোব, তবে বোনের ছেলেকে বা তার বন্ধুকে ”আপনি” বলবেন না।’ অশোক হেসে বলল।

ব্রজনাথের প্রৌঢ়া স্ত্রী ঘোমটা টেনে হেসে জিভ কাটলেন : ‘তাও তো বটে। তাহলে বাবা, দুজনের নাম ধরেই ডাকব।’

সকালবেলার মধ্যেই মোটামুটি জানাজানি হয়ে গেল, অশোক আর ফটিক কে। একদিন-দু-দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। অশোক ব্রজনাথের দূরসম্পর্কের শালির ছেলে। ফটিক তার বন্ধু। ব্রজনাথের ছোট ছেলে বরুণ ক্লাস টেনে পড়ে। সে প্রথমে খুবই অবাক হয়েছিল। জীবনে সে মাসতুতো ভাইয়ের কথা শোনেনি—তাকে একেবারে সশরীরে দেখে অবাক হওয়ারই কথা। অশোক তা বুঝতে পেরে নিজেই বরুণকে আপন করে নিয়েছে। অল্পবয়সের একটা ধর্ম, নতুনের এবং স্নেহ-ভালোবাসার কাছে সহজেই আত্মসর্ম্পণ করে। অশোক বরুণের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছে রাত্রেই। সকালবেলাই বরুণকে নিয়ে, ফটিককে সঙ্গে করে গ্রামে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ল।

বর্ধিষ্ণু গ্রাম। রায়বাড়ি ছাড়াও একাধিক পুরোনো পাকা বাড়ি, আর কিছু মন্দির আছে গ্রামে। ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-তিলি-গোপ-ছুতার-বাগদি-বাউরি নানা জাতির বাস। মুসলমানও কম নেই। গঙ্গার ধারে জেলেপাড়া, কাছেই একটা ছোট বাজার। গ্রামের মধ্যে দোকানপাটও কিছু আছে। এমনকী তেলেভাজা, চায়ের দোকানও। এসব ছেড়ে দিলে, পাটলি বর্ধিষ্ণু হয়েও গণ্ডগ্রাম।

অশোক গ্রামের চারদিকে ঘুরে বেড়াল। তেলেভাজার দোকানে তেলেভাজা খেল। সকলের সঙ্গে বসে চায়ের দোকানে চা খেল। চোখ আর কান সজাগ রাখল। দোকান, মন্দির, পুরোনো পাকা বাড়ির দেওয়ালে আর গাছের গায়ে পোস্টার দেখল, ‘নীতীশ রায়ের হত্যাকারীর শাস্তি চাই।’…’পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদ করুন।’—ইত্যাদি-ইত্যাদি।

বরুণের দৌলতে নীতীশের দলের একজনের সঙ্গে পরিচয়ও হয়ে গেল। বরুণের মাসতুতো দাদা হিসাবে কিছু কথাবার্তার মধ্যে নীতীশের খুনের কথা উঠল। তার দৃঢ় বিশ্বাস, বিরোধী দলের লোকরাই নীতীশকে খুন করেছে।

বরুণের সঙ্গে নীতীশের বিরোধী দলের লোকদের সঙ্গেও পরিচয় আছে। গ্রাম সম্পর্কে সকলেই দাদা। বাজারের কাছে একটা খড়ের চাল মাটির দেওয়াল ঘরে তাদের অফিসও রয়েছে। তাদের দু-চারজনের সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেল। তারা নীতীশকে ‘নীতীশদা’ বলে। খুনের কথা উঠতেই তাদের সাফ জবাব, নীতীশদা অনেককে টাকাপয়সা ধার দিত। বন্ধকি কারবার ছিল। বন্দুক ভাড়া দিত। তাদেরই কেউ নীতীশদাকে খুন করেছে।

বরুণকে বাদ দিয়ে গ্রাম বেড়াতে-বেড়াতে দু-চারজন গৃহস্থ ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। ব্রজনাথের আত্মীয় শুনেই তাদের ঠোঁটে কুলুপ। একজনই মাত্র মুখ খুলেছিলেন ‘দলাদলি বাজে কথা। শরিকরাই সম্পত্তির লোভে ছেলেটাকে খুন করেছে।’

অশোক দেখল, এভাবে বালির স্তূপে সোনার দানা খোঁজা অসম্ভব। দুপুরে খাওয়ার পরে, ফটিককে বলল, ‘আমি একবার নীতীশের খুনের জায়গাটা দেখতে যাব। তুই কাছেপিঠে থাকিস।’

বেলা আড়াইটার সময়, গ্রাম একেবারে নিঝুম। দুপুরটা যেন সত্যি ভূতে ঢ্যালা মারার মতো খাঁ-খাঁ করছে। অশোক নিতান্ত ঘুরতে-ঘুরতে নীতীশের সীমানার দিকে চলে গেল। সামনের বড় অংশটাই নীতীশের, বাইরে বাঁ-দিকে বাগান। বরুণ আগেই দেখিয়ে দিয়েছিল, বাগানের কোন জায়গায় নীতীশ খুন হয়েছিল।

সামনে বড় জোড়া থামওয়ালা বারান্দার মাঝখানে ভিতরে ঢোকবার দরজা। কারও কোনও সাড়াশব্দ নেই। ভিতরে নিশ্চয় পীতু আর তার পরিবার আছে। অশোক শুনেছে, পীতু, পীতুর ছেলে-বউ আর তাদের বোবা নাতনি ফুড়কি আছে। পীতুর ছেলের বয়েস পঞ্চাশের ওপর। নাম হীরালাল। তার বউ খাঁদনই বলতে গেলে নীতীশের সংসার দ্যাখে। পীতু বাকি সব দেখাশোনা করে। পীতু জাতিতে ছুতার। তার জল চলে না। সেইজন্য খাঁদন নীতীশের রান্না করত। বোবা ফুড়কি কোনও কাজের না। একে বোবা, তায় নাকি মাথাটাও খারাপ আছে। পাগলের মতো হাসে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। বাপ-মা-দাদুর কথা শোনে না। হীরালালের ছেলেও আছে। সে এখানে থাকে না। হীরালাল প্রধানত নীতীশের চাষবাস দেখাশোনা করে। জনমজুর জোগাড় করা, কাজ করানো, মজুর দেওয়া তারই কাজ। পীতু নীতীশের খাস চাকর। বলতে গেলে, এখন সে কিছুই করে না। নীতীশের শোয়া-বসা, হাতের কাছে জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়া, এইসব সামান্য কাজ ছিল তার। বুড়ো বড় মদ খায়। নীতীশও তা জানত। কিন্তু কিছু বলত না।

অশোক বাড়ির সামনে একবার দাঁড়াল। খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে তাকাল। সামনের দিকে কিছুটা অন্ধকার মতো। ঢোকবার মুখে দু-পাশে ঘর, মাঝখানটা অন্ধকার। ভিতরের উঠোনের অংশবিশেষ দেখা যায়। ফাঁকা উঠোনটা রোদে পুড়ছে। পায়রারা বকবকম করছে। কিন্তু কোথা থেকে একটা কান্নার চাপা স্বর ভেসে আসছে। কোনও মেয়ের স্বর। অথবা দূরের কোনও গাছে গৃধিনী ডাকছে? অশোক এরকম গৃধিনীর ডাক শুনেছে। শুনলে মনে হয়, কোনও মেয়ে সরু গলায় ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে।

অশোক বাড়িটার সামনের দিক ছাড়িয়ে বাঁ-দিকে বাগানে গেল। বড়-বড় আম-জাম-কাঁঠাল গাছ। ছায়ানিবিড়, ঠান্ডা। পাখি ডাকছে। একটা জায়গা দেখলেই বোঝা যায়, সেখানে ঘাস যেন কম। অন্যত্র যেমন ঘাস আর চোরকাঁটা লম্বা, সেখানে সেরকম না। তার মানে এখানেই নীতীশের আড্ডা বসত। চেয়ার-টেবিল বসে, সকলের পায়ের চাপে, ঘাস এখানে বাড়তে পারেনি। বড় একটা অর্জুন গাছ রয়েছে। গাছের তলায় এখনও চেয়ারের পায়ার দাগ। অর্জুন গাছে কি লাল আঠা বেরোয়? গাছটার গায়ে কাটাকুটি দাগ। কাছে গিয়ে অশোক থমকে দাঁড়াল।

অর্জুন গাছের ছাল খসে যাওয়া, ফরসা মানুষের পেশল পাকানো গায়ের মতো দেখাচ্ছে। সেখানে দু-তিন জায়গায় রক্তের ছিটে লেগে আছে। নীতীশ কি এই গাছের কাছেই চেয়ারে বসেছিল? ও গাছটার আরও কাছে এগিয়ে গেল। প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে গাছের গায়ে এক জায়গায় ওর চোখ স্থির হয়ে গেল। পাতলা ছালের ওপরে রক্তাক্ত হাতের দাগ। হাতের রক্ত মুছেছিল কেউ। খুনি? কিন্তু হাতের দাগ দেখে মনে হচ্ছে, তেমন শক্ত মোটা থাবা নয়। অস্পষ্টই, কিন্তু আঙুলের ছাপ সরু।

অশোক নীচের দিকে তাকাল। পায়ের ছাপ নেই। তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে। বৃষ্টিও হয়নি। পায়ের ছাপ থাকবার কথা না। তারপরেই চিকচিক করে উঠল ভাঙা কাচের লাল চুড়ির একটা টুকরো। কাকতালীয় ব্যাপার। কাচের চুড়ির টুকরো যেখানে-সেখানেই পড়ে থাকতে পারে। তবু ও নিচু হয়ে টুকরোটা তুলে নিতে গেল। আর তখনই হাত-দুয়েক দূরে চোখে পড়ল, আরও একটা লাল কাচের চুড়ির টুকরো। সেটাও তুলতে গিয়ে ও একেবারে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাসের গায়ে কুড়ুলের ছোট একটা কোপের দাগ। সেই দাগে শুকনো রক্তের ছিটে লেগে আছে।

অশোক মুখ তুলে তাকাল। কিন্তু খুনি ওদিকে কোথায় যাবে? ওদিক গেলে তো বাড়ির দিকে যেতে হয়। নীতীশের বাড়ির বাগানের দিকের অংশ। পাশ দিয়ে ঘুরে সামনের দিকে যাওয়া যায়। অথবা পশ্চিমে গিয়ে, বাড়ির শেষ প্রান্তে পুকুরের ধার দিয়ে, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সীমানার বাইরেও চলে যাওয়া যায়।

হঠাৎ ‘আঁউ-আঁউ’ শব্দে একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল। অশোক মুখ তুলে নীতীশের বাড়ির বাগানের দিকের অংশে তাকাল। একটা খোলা জানলা দিয়ে যেন শব্দটা আসছে। অশোক দ্রুত অথচ নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। শুনতে পেল, ঠাস-ঠাস ছপটির ঘা। আর ‘আঁউ-আঁউ’ চিৎকার। তার মধ্যেই গোঙানো পুরুষের গলা শোনা গেল, ‘ওকে এখন আর মেরে কী হবে? যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।’

মেয়েমানুষের গলা শোনা গেল : ‘কোথায় হয়ে গেছে? যে-জন্যে এত ব্যাপার তার কী হবে? হারামজাদির পেটে বাচ্চা, দুদিন বাদেই লোকের চোখে পড়বে। বাবুর সঙ্গে শোওয়ার সময় মনে ছিল না? ও কি ভেবেছিল—বাবু ওকে বে করবে? রাক্ষুসি সর্বনাশী সব খেয়ে এখন গলার কাঁটা হয়ে বসেছে।’

গোঙানো পুরুষের গলা শোনা গেল, ‘বউ, ওই করে তুই ছুঁড়িকে তাড়িয়ে সর্বনাশ করলি। ছুঁড়ি কি মানুষ? ওর কি জ্ঞানগম্যি আছে? তোর লাঞ্ছনায় ছুঁড়ি মাথা ঠিক রাখতে পারে না—আবার কী একটা অঘটন ঘটিয়ে বসবে।’

আবার হঠাৎ ‘আঁউ-আঁউ’ শব্দ, কিন্তু স্বরের সংকেতটা আলাদা। অশোক দেখল, ফুড়কির মুখ জানলায়। অশোককে দেখছে। সঙ্গে-সঙ্গে আর-একটি স্ত্রীলোকের মুখ জানলায় দেখা দিল। চোখদুটো জ্বলছে। অশোককে দেখেই আতঙ্ক ফুটে উঠল। অশোক তাড়াতাড়ি সরে এসে বাগানের অন্য দিকে চলে গেল। দূরে রাস্তার সামনে ফটিককে চোখে পড়ল।

অশোক আবার অর্জুন গাছের কাছে এগিয়ে গেল। পীতু এসে তার সামনে দাঁড়াল। খালি গা, নেংটির মতো ধুতি গোটানো। নিশ্বাসের গন্ধেই টের পাওয়া যাচ্ছে, মদ খেয়েছে। চোখ লাল। বলল, ‘আপনি তো ছোটবাবুর শালির ছেলে, কলকাতা থেকে এসেছেন?’

‘হ্যাঁ।’ অশোক বলল, ‘নীতীশবাবুর খুনের কথা শুনে জায়গাটা দেখতে এসেছি।’

পীতু তেমন মাতাল না। একটু আগেই তার গোঙানো স্বরের কথা শোনা গিয়েছে। বলল, ‘হ্যাঁ বাবু, এই অর্জুন গাছের নীচেই আমার নীতু ভাই বসেছিল। আমি তার টেবুল পেতে দিয়েছি। ভাই এসে বসেছে। হ্যারিকেনটা জ্বেলে আনতে গেছি। এসে দেখি—।’ পীতুর দন্তহীন চোপসানো ঠোঁট থরথর করে কেঁপে উঠল। গলার স্বর ডুবে গেল।

‘কে এমন কাজ করতে পারে?’ অশোক জিগ্যেস করল।

পীতু চোখ মুছে ভাঙা গলায় বলল, ‘ভগমান জানেন, বাবু। আমার নীতু ভাইয়ের তেমন শত্তুর তো ছিল না।’

‘শত্রু তো নিশ্চয় ছিল, নইলে অমন করে কেউ খুন করে?’

‘তা বটে।’ পীতু বলল, ‘চোখে ভালো দেখতেও পাইনে। সবে তখন সন্ধে হয়েছে। বাতি আনতে আর আমার কতক্ষণ লেগেছে? গেছি, চিমনি মুছেছি, সলতেটা সাফ করেছি। আমার ছেলের বউ দেশলাই জ্বালিয়ে সলতেয় দিল। বাতি নিয়ে আসতে-আসতেই—আঃ। কী বলব, একটা টুঁ শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাইনি।’

অশোক কথা শুনতে-শুনতে আড়চোখে দেখল, বাগানের দিকের জানলায় ফুড়কি আর খাঁদনের মুখ দেখা যাচ্ছে। তারা এদিকেই তাকিয়ে আছে। অশোকের কপালে গাঢ় চিন্তার রেখা। খাঁদন আর পীতুর কথাগুলো কানে বাজছে। ফুড়কির পেটে বাচ্চা। কোন বাবুর সঙ্গে শুয়েছিল? নীতীশ ছাড়া বাবু কে? সে রাক্ষুসি সর্বনাশী কেন? খাঁদনের লাঞ্ছনায় ফুড়কি মাথা ঠিক রাখতে পারে না। তার মানে কী? নীতীশ ফুড়কিকে কথা দিয়েছিল বিয়ে করবে। অথচ গর্ভবতী করেও কথা রাখেনি। বরং এমন কিছু বলেছিল, একটা সামান্য বোবা মেয়ে অতি হিংস্র আর ভয়ঙ্করী হয়ে উঠেছিল। সংকেতটা যেন সেদিকেই ঝিলিক দিচ্ছে। আর তাই যদি হয়, তবে বাকি রহস্য বাড়ির মধ্যেই আছে। অশোক পকেটে হাত দিয়ে ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরো অনুভব করল। অর্জুন গাছের পাতলা ছালের ওপর সরু আঙুলের আবছা রক্তাক্ত দাগ। কুড়ুলের কোপ ঘাসে, শুকনো রক্তের ছিটে ঘাসের গায়ে। অশোক রায়বাড়ির দিকে তাকাল। হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ির সামনের দিকে গেল। পীতু পিছনে-পিছনে।

অশোক পিছন ফিরে ফটিকের দিকে তাকাল। ফটিক পায়ে-পায়ে এগিয়ে এল। অশোক জোড়া থাম দেওয়া বারান্দায় উঠল। জিগ্যেস করল, ‘পুলিশ বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিল?’

‘তা ঢুকেছিল বইকী।’ পীতুর গলা এখন অনেকটা পরিষ্কার : ‘বাড়ির ভেতরে ঢুকে কী আর দেখবে? খুন যারা করেছে, তারা তো আর বাড়ির ভেতরে ঢোকেনি।’

অশোক বাড়ির ভিতরে ঢোকার দরজার দিকে গেল। পীতু জিগ্যেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছ, বাবু?’

‘বাড়ির ভেতরটা একটু দেখতে ইচ্ছে করছে।’ অশোক ভিতরে পা দিল।

পীতুর স্বর বদলে গেল। শক্ত গলায় বলল, ‘তা হয় না, বাবু। পরের বাড়িতে তুমি কেন ঢুকবে?’

‘এমনি। পাড়াগাঁয়ের বাড়ি কোনওদিন দেখিনি তো।’ অশোক ভিতরে গেল।

পীতু রেগে গিয়ে বলল, ‘এ কেমন কথা, অ্যাঁ?’

‘এটাই ঠিক কথা।’ ফটিক সামনে এসে বলল, ‘তুমি এখানেই আমার কাছে দাঁড়াও।’

অশোক ভিতরে ঢুকতেই খাঁদন একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। অশোক জিগ্যেস করল, ‘নীতীশবাবু কোন ঘরে থাকতেন?’

খাঁদন ভ্রকুটি চোখে তাকিয়ে ওপরের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল, ‘উপরের ঘরে থাকত। কেন?’

‘সিঁড়িটা কোন দিকে?’ অশোক আশেপাশে তাকিয়ে বাঁ-দিকে দালানের কোণে সিঁড়ি দেখতে পেল। কোনও কথা না বলে সোজা সেদিকে গেল।

খাঁদন চিৎকার করে উঠল, ‘এ কেমন কথা? আমি এখুনি লোকজন ডাকব।’

‘ডাকো।’ অশোক তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। ওপরের রেলিং-দেওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখল, বাড়ির সীমানা ভাগের উঁচু লম্বা পাঁচিল। সব ঘরের দরজা বন্ধ। বাইরে থেকে শিকল টানা। অশোক দেখল, সিঁড়ি উঠে গিয়েছে তিনতলার ছাদে। সেদিকে তাকাতেই তিন ধাপ সিঁড়ির ওপরে, সেই লাল ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরো। অশোক উঠে গিয়ে তুলে নিল। সিঁড়ির ধুলোয় পায়ের ছাপ। ছোট মাপের, একটু লম্বা। তার পাশে মোটা থ্যাবড়া পায়ের দাগও রয়েছে।

অশোক ওপরে উঠল। ছাদের দরজায় খিল লাগানো। অশোক খিল খুলে ফেলল। ছাদে উঠে দেখল, সেখানেও সীমানার পাঁচিল তোলা। দরজার কাছেই কাচের চুড়ির তিন-চার টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে। অশোক আশেপাশে চোখ ফেরাল। চিলেকোঠার শিকল খুলে ভিতরে ঢুকল। ঢুকেই চোখে পড়ল, ছোট হাতলের চওড়া কুড়ুল। ধারালো কুড়ুলের গায়ে রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গিয়েছে। রক্ত-লাগা জামা-শাড়ি কোণে জড়ো করা। ব্রজনাথের কথা মনে পড়ল : ‘ভাইপোর আমার মেয়েমানুষের দোষ ছিল না। সেদিক থেকে তার চরিত্রের কেউ দোষ দিতে পারবে না।’

হয়তো কথাটা সত্যি। তবে, বোবা ফুড়কির উদ্ধত যৌবন নিশ্চিন্তে ভোগ করা মানেই চরিত্র খারাপ না। হয়তো ফুড়কিকে নীতীশ ভালোবেসেছিল। অথবা শুধু ভোগ করতে গিয়েই কথা দিয়েছিল, ওকে বিয়ে করবে। গর্ভবতী হওয়ার পরে খাঁদনের লাঞ্ছনায় ফুড়কি মাথার ঠিক রাখতে পারেনি।

পায়ের শব্দে অশোক ঝটিতি পিছন ফিরে তাকাল। ফুড়কি। হাতে কেউটে সাপের মতো ধারালো কাস্তে। লাল চোখ জ্বলজ্বল জ্বলছে। সাক্ষাৎ মৃত্যু! ফুড়কি কাস্তে তুলে, অশোকের মাথা লক্ষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অশোক চকিতে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ফুড়কি কাস্তে-হাতে মুখ থুবড়ে পড়ল। অশোক জুতোসুদ্ধ ফুড়কির কাস্তে-ধরা হাতটা চেপে ধরে, অন্য পা দিয়ে পিঠে একটা জোরে লাথি মারল। ফুড়কি ‘আঁউ-আঁউ’ শব্দে চিৎকার করে উঠল। অশোক ওর মুঠি থেকে কাস্তেটা ছিনিয়ে নিল। ফুড়কি লাফিয়ে ওঠবার আগেই অশোক একলাফে চিলেকোঠার বাইরে। ঝটিতি চিলেকোঠার দরজা টেনে, শিকল তুলে দিল। নীচে নেমে এল দ্রুত। খাঁদন আর পীতুর চিৎকারে তখন রায়বাড়ির মহিলা-পুরুষ ছাড়াও পাড়ার কিছু লোকজন এসে ভিড় করেছে।

ব্রজনাথ এগিয়ে এলেন। চোখে-মুখে উদ্বেগ। অশোক বলল, ‘কাউকে তাড়াতাড়ি পূর্বস্থলী থানায় পাঠান। আমার নাম করে বলবেন, খবর পেয়েই যেন চলে আসেন। খুনি ধরা পড়েছে। সে এখন চিলেকোঠায় বন্দিনী।’

‘বন্দিনী?’ অনেকে একসঙ্গে বলে উঠল।

অশোক বলল, ‘হ্যাঁ, ফুড়কি। তবে ওর দোষ কতটা, সেটা আইন বিচার করবে। নীতীশবাবুর বাচ্চা ওর পেটে রয়েছে।’

সকলে হতবাক। খাঁদন মাটিতে লুটিয়ে কান্না জুড়ে দিল : ‘এ কী সব্বনেশে লোক গো, কোথা থেকে এল? এ কখনও মানুষ নয়, দানো, দানো।’

পীতু ইতিমধ্যে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। ওপর থেকে ফুড়কির আর্তনাদ এখন গৃধিনীর কান্নার মতো মৃদুতর হয়ে ভেসে আসছে। নীতীশের নীতীশের

 গোয়েন্দা-রহস্য

পুজো সংখ্যা, ১৯৮১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *