অনুলোম – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
বেঁটে ছাতা কিন্তু প্রতাপ কম নয়। ফুট দুয়েক উঠলো মাটি থেকে, দেহের সমান্তরালভাবে। ব্যস্ তাতেই কাজ হলো। অত বড় ডবল ডেকার ব্রেকের শাসনে অচল। বাস অচল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু আমরা, বাসের যাত্রীরা, সচল হয়ে উঠলাম। বাজারের থলি হাতে জাঁদরেল ভদ্রলোকটি আমায় জাপটে ধরলেন, পাশ থেকে আধ মন ওজনের একটি গোড়ালি চেপে বসলো পায়ের পাতায়, আমি প্রাণপণে রড আঁকড়ে ধরা সত্ত্বেও এদিকের মাদ্রাজী ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায় দুই ছুঁই ছুঁই ভাব। বিরক্তির একটা ঢেউ, চাপা আক্রোশ—কিছুটা ড্রাইভারের ওপর, কিছুটা ঈশ্বরের প্রতি। কিন্তু দোষ দু’জনের কারুরই নয়।
যার দোষ সে ততক্ষণে পাদানিতে উঠে পড়েছে।
‘একটু রাস্তা দেবেন’ মিহি সুর।
সুর থামতে পেলো না, সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের ভদ্রলোকেরা ধুয়ো ধরলেন, ‘দাদা, পাশ দেবেন একটু।’
‘মেয়েছেলেকে এগিয়ে যেতে দিন।’
‘যান, চলে যান, ভেতরে জায়গা আছে।’
আশ্বাস আর সহানুভূতির অন্ত নেই। কাত হয়ে, পাশ ফিরে, সামনে ঝুঁকে নানাভাবে মেয়েটিকে এগোতে দেওয়ার প্রয়াস চললো।
বাসের মধ্যে আবার মাখো-মাখো ভাব। মানুষে মানুষে জাপটা-জাপটি, কাঁধ ঘসাঘষি কতকটা। গিয়ারের মোচড়ে আর একসিলেটরের চাপে বাসের সর্বাঙ্গে ঝাঁকানি। আমাদেরও রড আঁকড়ে ইজ্জঁত বাঁচাবার চেষ্টা।
তাল সামলে ঠিক হয়ে দাঁড়িয়েই বেতাল হয়ে গেলাম। কাঁধফাটা পাঞ্জাবি আর আধময়লা ধুতির পাশাপাশি দামী সিল্কের আকাশরঙা শাড়ি, গোধূলির রঙ ছোঁয়ানো ব্লাউজ, বেঁটে ছাতা কিন্তু উদ্ধত নয়, এবার আড়াআড়িভাবে বেড়ার কাজ করছে। গুমোট গরম, হাওয়া একেবারে নেই। কিন্তু কিছু বলা যায় না, ফুর ফুর করে হাওয়া একটু বইলেই হলো। এক হাতে রড চেপে ধরে আর এক হাতে চাপলাম ধুতির প্রান্তভাগ। উড়ে না সিল্কের শাড়িতে গিয়ে ঠেকে।
বাস সজোরে একটা বাঁক ঘুরতেই ভেতরে আবার ওলট-পালট অবস্থা। রডের বারণ মানলো না, এ পাশের লোক ওপাশে ছিটকে পড়লো। মেয়েটি বহুকষ্টে সামলালো নিজেকে। নিজে সামলালো বটে, কিন্তু আমার বেসামাল অবস্থা। ছাতিটা আমার পাঁজরে ঠেকানো। হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি হলে হয়তো ভেল্কি লেগে যেত, কিন্তু এই ঠেকাঠেকি হাড়ে আর কাঠে।
চোখ কান বুজিয়ে হাত দিয়ে ঠেলে দিলাম ছাতিটা, ‘মাপ করবেন, বড় লাগছে।’
‘ও সরি’ মেয়েটি ছাতিটা সরিয়ে নিলো, রিমলেস চশমার ফাঁক দিয়ে একবার নজর বুলিয়ে নিলো আমার দিকে। ছাতির বাঁট হাড় স্পর্শ করেছিলো শুধু, চাউনি অস্থিমজ্জা ত্বক ভেদ করলো।
আশ্চর্য, মেয়েটি বাইরে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকেই আবার চোখ ফেরাললা আমার দিকে। লেডিজ সিট কানায় কানায় পূর্ণ, সামনের ভদ্রলোকেরাও নির্বিকার, উঠে আসন ছেড়ে দেবার নামগন্ধ নেই। একেবারে সামনের লোকটি নিমীলিতনেত্র। কপট নিদ্রা কিনা, কপট-নিদ্রা-বিশারদ মাধবই বলতে পারেন।
কিন্তু কাহিল হলাম আমি। কপাল ভিড়ের চাপে আগেই ঘেমেছিলো, এবার মেয়েটির চাউনির বহর দেখে ঘাড়, গলা আর কানের পাশ ঘেমে উঠলো।
চোখের বিদ্যুৎ বড়জোর মিনিট খানেক, তার পরেই বজ্রাঘাত। বিনা মেঘে।
‘কে, বাদলদা? বাসের গর্জন ছাপিয়ে মেয়েটির গলা শোনা গেলো।
বাধ্য হয়েই ফিরে চাইতে হলো। অন্নপ্রাশনের নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দিয়ে থাকা চলে না, কিন্তু রুজ, পাউডার, স্নোর স্তর পার হয়ে আসল মানুষটার হদিস পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিকের কাজ, হার্পার কোম্পানির চুরাশি টাকা মাইনের ফাইল ক্লার্কের নয়!
ঠোঁট কামড়ে, ভুরু কুঁচকে মনের মধ্যে ডুবুরি নামিয়ে দিলাম। স্মৃতির শুক্তি নাই উঠুক, জল তো ঘোলা করুক একটু। স্থির জলে ছোট ছোট ঢেউ তুলুক—তাতেই হবে।
‘বারে, চিনতে পারলে না’ বাইরের রোদে কনভেক্স লেন্স আগুন ছড়ালো। চিনতে না পারার অপরাধে আঁকা ভুরু বাঁকা হয়ে এলো, ভাঁজ পড়লো গালে।
‘স্কটিশ চার্চ কলেজ, হেমলতা বোর্ডিং, মনে পড়েছে?মেয়েটি দাঁড়ের ঘায়ে যেন উপকূলের দিকে নৌকো এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো, ‘বালিগঞ্জ স্টেশন।’
ব্যস, ব্যস, আর বলতে হবে না। এক গাল হেসে বললাম, ‘ডলি? ডলি সেন?’
‘বলিহারি স্মরণশক্তি তোমার। কোনদিন নিজের নামই ভুলে যাবে।’
ঠিক কথা বলেছে ডলি। সম্পর্কটা এক সময়ে এই রকমই ছিলো। একজনকে ভোলা মানে আর একজনের অস্তিত্ব অস্বীকার করা।
কিন্তু কতদিন আগের কথা! বড়জোর বছর পাঁচেক। কলেজই তো ছেড়েছি মাত্র চার বছর। এক বছর পুরো বেকারি। ট্রামভাড়া আর হাফসোলের খরচেই কষ্টে জমানো টাকার অর্ধেক কাবার। তারপর বহু কষ্টে মেশোর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো, বত্রিশ বছরের চেয়ার ছাড়বার প্রায় মুখে। যোগাযোগ—তিনি ছাড়লেন আর আমি বসলাম—অবশ্য এক চেয়ারে নয়, তাহলে আর বকেয়া সেলাই পড়ে না পাঞ্জাবিটায়, ধুতিতে দু’ হাত অন্তর গিঁট। মেসোর সুপারিশে ফাইলের তদ্বিরে লেগে গেলাম। একটানা অফিস করছি সেই থেকে—রড অবলম্বন করে, কি যাওয়ার পথে—কি ফেরার মুখে। কিন্তু ডলি সেন! আশ্চর্য কোনদিন তার শাড়ির আঁচলও তো চোখে পড়েনি, মানুষটা তো দূরের কথা।
কিন্তু দোষ আমার নয়। ডলি সেন অনেক বদলেছে। পুরানো দিনের সে কাঠামোই নেই। সেদিনের গোলগাল আলুর প্যাটার্নের মেয়েটা বাড়তি মাংস ঝরিয়ে শুকনো খটখটে হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোয়াল-ওঠা গালে, চিবুকে, কপালে রঙের কারসাজি। সবটাই ধার করা।
এতক্ষণ লক্ষ করিনি। ডলি সেনকে চেনার খেয়ালে মত্ত ছিলাম, এখন আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখলাম সকলের দর্শনীয় হয়ে উঠেছি। ডলি সেন ততটা নয়, যতটা আমি।
‘এতদিন ছিলে কোথায়, দেখিনি তো? অন্তরঙ্গ হবার চেষ্টা করলাম।
‘এখানেই তো রয়েছি, বছর তিনেকের ওপর। তবে ট্রামে-বাসে খুব বেশি যাতায়াত করি না?’ ডলি সেন গলাটা চড়ালো।
মনে মনে চটপট হিসাবটা করে নিলাম। ট্রামে-বাসে নয়তো কিসে যাতায়াত করত ডলি সেন। প্রাক্চাকরি-জীবনে আমার সম্বল ছিলো দুটি পা। ট্রাম-বাস আমিও কম ব্যবহার করতাম। কিন্তু ডলি সেনের অবস্থা যে সে পর্যায়ে নামেনি তার চিহ্ন তো ওর সর্বাঙ্গে। এসব মেয়ের ট্রামে-বাসে ওঠা স্রেফ শখ। জনতার সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ির সুযোগ লাভ শুধু! নির্জন নিস্তব্ধতা থেকে কোলাহল আর কলরবে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া।
‘তারপর কি করছ আজকাল?’ ডলি সেন ছাতাটা হাতবদল করলো, ‘চাকরি নিশ্চয়!’
কররেখা না দেখেও একথা বলতে পারার মধ্যে কৃতিত্ব ছিলো না। এক বছরেই কুলীন কেরানি হয়ে উঠেছি। মুখের রেখায় বনিয়াদী দাসত্বের ছাপ। চালচলনে পর্যন্ত।
‘তুমি?’ কথাটা আচমকা মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো। আমার হয়ে পাশের দু’জন ভদ্রলোক জিভ কাটলেন। হা-হুতাশও করলেন কে একজন। জিভ তালুতে আলতো ছুঁইয়ে চাটনি টাকনা দেবার আওয়াজ।
‘পি এ—ভারতজ্যোতি ইনসিওরেন্সের’ ইংরেজি বলছে ডলি সেন এমনিভাবে কথাগুলো উচ্চারণ করলো।
ভারতজ্যোতি ইন্সিওরেন্স! একটুও ভাবতে হলো না, ভাববার উপায়ই রাখেনি মালিকেরা। চৌরাস্তার ওপর ফেরোকংক্রিটের ছতলা বাড়ি। জ্বলছে কোম্পানির নাম, দিনে—রুপপালি অক্ষরে, রাত্রে নিওনের প্রবালরঙা আলোর মালায়। সোজা রাস্তা হলে মাইল খানেক দূর থেকে নজরে পড়ে। এদেশের জাঁদরেল লোকেদের নাম কোম্পানির ডিরেক্টর বোর্ডের পাতায়। উপাধির জ্বালা যত কম, টাকার মালা সেই অনুপাতে বেশি। তাছাড়া শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে নানা প্রদেশের মাটির গভীরে শেকড় চালিয়েছে। বিরাট মহীরুহ। ছায়া চাও ছায়া, ফল—তাও আছে, নয়তো শুধু কলকাতার অফিসে ছ’শো কেরানী কি আর এমনি ঘানি ঘোরাচ্ছে!
আমি আড়চোখে আর একবার ডলি সেনের সাজসজ্জার ওপর আলতোচোখ বুলিয়ে নিলাম। আর বেমানান লাগছে না। মেয়ে কেরানীর তুলনায় প্রসাধন হয়তো একটু উগ্র, কিন্তু ভারতজ্যোতির ‘পি এ’র এত আটপৌরে পোশাক! লাঞ্চের সময় শাড়ির রং পালটায় কিনা কে জানে!
‘ভালোই তো আছে তাহলে’, মুচকি হেসে বললাম।
‘তুমিই বা কম ভালো কি’ হাত দিয়ে ডলি সেন রিমলেসটা ধাতস্থ করলো, ‘অতীত ভুলতে পেরেছো কম কথা!’
সহযাত্রীদের পক্ষে একটু অতিরিক্ত ডোজ। বর্তমান নিয়ে নাড়াচাড়া অবধি সওয়া যায়, কিন্তু ফেলে আসা দিনের কথা! কলেজী জীবনের নরম রোদ আর ফুরফুরে বাতাস। দু’একজন অর্থবোধক কাসি কাসতে শুরু করলে। ভাবটা যেন, একটু বুঝে শুনে, আমরা বৃদ্ধের দল কিছু কিছু এখনও জীবিত।
কথাটায় মনে একটু ঝাঁকুনি লাগলো। তা হলে ডলি সেন বুঝি নিজে মনে রেখেছে সেসব দিনের কথা। করিডরে, সবুজ লনে, জনবিরল পার্কে টুকরো টুকরো করে ছড়ানো প্রজাপতির পাখার মতন বহুবিচিত্র সেসব কাহিনী। কে জানত আজকের এই ঊষর মরুভূর রুক্ষতা অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু এ রুক্ষতা শুধু আমার নিজের। ডলি সেনের জীবনে সেদিনের সবুজ সবুজতর হয়েছে। পান্নার মতন দ্যুতিময়। তাই হয়তো পুরনো দিনের কথার টুকরো বিস্মৃতির ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে জমা হয়নি।
‘আছো কোথায়?’ এর পরে এ প্রশ্ন ছাড়া অন্য কিছু মনেই এলো না।
উত্তর দেবার আর অবসর পেলো না। শোনবার অবকাশও আমার কম। হর্নের আওয়াজের সঙ্গে তাল দিয়ে ড্রাইভার গালিগালাজ দিয়ে চলেছে। ভাষাটা ঠিক অনুধাবন করতে না পারলেও তার মুখচোখের চেহারায় যেটুকু মালুম হলো তাতেই বুঝলাম কেউ পথরোধ করেছে। বীরের বংশ, রক্তকণিকায় ঝাঁঝের ভাগই বেশি, যে হাতে কৃপাণ ধরত আজ না হয় স্টিয়ারিং ধরেছে সে হাতে, কিন্তু রোখ যাবে কোথায়?
‘কি হলো’ ডলি সেন চিন্তিত হয়ে উঠলো।
নিচু হয়েও ব্যাপারটা বিশেষ কোন হদিস করতে পারলাম না। মানুষের পাঁচিল ভেদ করে কিছু দেখাও সম্ভব নয়। তবে দুঃখের খবর চাপা থাকে না। লোকের মুখে মুখে আঁচ করা গেলে কিছুটা। সামনে কয়লার গাড়ি কাত হয়ে পড়েছে। টালখাওয়া চাকাটা গড়িয়ে পড়েছে রাস্তার পাশে। কয়লার চাঙাড়ে রাজপথ ভর্তি। কয়লার বস্তা, সদ্যোমুক্ত চাকা আর বেয়াক্কেলে বলদ দুটোকে আওতায় আনতে গাড়িওয়ালা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। এমনি নাজেহাল অবস্থায় অবশ্য ড্রাইভারের গালাগালগুলো শাকের আঁটিরই শামিল। কাত হওয়া গাড়ির গাড়োয়ানকে আর বেশি কাত করতে পারলো না।
চল্লিশ ফুট রাস্তা তাও ভাগবাঁটরা করা। অর্ধেক ট্রামের, অর্ধেক বাকি আর সবাইয়ের। কাজেই ড্রাইভার একটু বেকায়দায় পড়ে গেছে। বাঁ দিকে আর হাত দুয়েক পথ ফাঁকা পেলে একবার কসরতটা দেখাত। বাসের বাইরে ঝুলে পড়া দু-একজনের ফুটপাথের পাশের লাইট পোস্টের সঙ্গে বোঝাপড়ার সমস্যা একটা ছিলো অবশ্য, কিন্তু অত সব ভাবতে গেলে কলকাতায় বাস চালানো যায় না।
বাঁ হাতটা ডলি সেন নাকের কাছে তুললো। লক্ষ করিনি, কব্জিতে চৌকো ঘড়ি প্ল্যাস্টিক বন্ধনে বাঁধা। চোখ ফিরিয়েই আর্তনাদ করে উঠলো, ‘সর্বনাশ, আর দশ মিনিট বাকি! খুব জরুরি একটা কাজ রয়েছে ফার্স্ট আওয়ারে। চলি, এখান থেকে ট্যাক্সি না নিলে লেট হয়ে যাব।’
আবার সেই বেঁটে ছাতার কারসাজি। ভিড়ের মধ্যে পথ করে নেবার আশ্চর্য কৌশলে ব্যবহৃত হলো। নামবার মুখে ডলি সেন একবার ঘুরে দাঁড়ালো, ‘দেখা করে একদিন বুঝলে?’
আমি বুঝলাম। আশেপাশে দাঁড়ানো সহযাত্রীদের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম তারাও বুঝেছে। বোঝাবুঝির পালায় ওই একটা মস্ত সুবিধা।
কিন্তু মর্মাহত হলাম। ডলি সেনের আচমকা নেমে যাওয়ার জন্য নয়, আমাকে ফেলে যাওয়ার জন্য। অফিস তো আমারও আছে, সেই সঙ্গে লেট হবার সম্ভাবনাও। অবশ্য আমাদের অফিস এমন কিছু পাশাপাশি নয়, কিন্তু একটু এগোনোও তো যেত।
অফিসের সিঁড়িতে উঠতে উঠতে কথাটা মনে পড়লো। দেখা যে করতে বললো ডলি সেন একদিন, কিন্তু কোথায়। বাড়ির ঠিকানা জানবার সুযোগ হলো না। তা বলে অফিসে নিশ্চয় নয় আধময়লা সহস্ৰচ্ছিন্ন পোশাকে বাসের ভিড়ে পাশাপাশি দাঁড়ানো চলে কিন্তু অফিসে সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ানো উচিত কখনও! ঝকঝকে তকতকে কেতাদুরস্ত ব্যাপার সেখানে, কলিং বেলের ছন্দের সঙ্গে বেয়ারা পিয়নদের হুড়োহুড়ি, পাত্তাই দেবে না হয়তো। চাকরির উমেদার ভেবে দাঁড় করিয়েই রাখবে ঘন্টার পর ঘণ্টা। সে হয় না।
অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে আরো কয়েকবার মনে পড়লো ডলি সেনের কথা। ফাইলের পাতায় মেঘ-নীল শাড়ির আবছা ছায়া। টেবিলের কোণে সরে সরে আসা রোদের হিজিবিজি আঁচড়ে রিমলেসের চকমকানি।
পাশে বসা তারানাথবাবু ঝুঁকে পড়লেন, ‘ব্রাদার কি পোয়েট্রি ভাঁজছো?’
‘পোয়েট্রি আমার বাপের জন্মে আসে না।’
‘বাপের জন্মে তো অনেক কিছুই আসে নি। কিন্তু তোমার রকম সকমটা সুবিধের ঠেকছে না। সামনে ফাইল খোলা, গালে হাত, হার্পার কোম্পানির ফাইল ডিপার্টমেন্টে যেন নেই বলে মনে হচ্ছে।’
ফাইলটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলাম। চেয়ারে পিঠ রেখে।
আজ যেমন আচমকা দেখা হয়ে গেলো ডলি সেনের সঙ্গে সেদিনের দেখাটা কিন্তু এত আচমকা নয়। কলেজে যাওয়া-আসার ফাঁকে অনেকদিন দেখেছি। দলের মধ্যেও যেন দলছাড়া। ঝকমকে পোশাক স্নো পাউডার সবই ছিলো কিন্তু আজকের মতন এমন উগ্র নয়। দেখা কলেজের করিডরে হলেও আলাপ হয়েছিলো অন্য জায়গায়।
পিসতুতো বোনের বিয়ে। কোমরে তোয়ালে বেঁধে দৌড়োদৌড়ি করছি। কাজের বাড়িতে ওটা করাই সুবিধা, নয়তো থামলেই সত্যি সত্যি আসল কাজ কেউ ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে।
কপালের ঘামটা মোছবার মুখেই বৌদির সঙ্গে দেখা, দেড়তলার চাতালে।
‘আরে ঠাকুরপো, তোমাকেই যে খুঁজছি।’
ব্যাপারটা আঁচ করলাম। শেষ মুহূর্তে কি একটা এসে পৌঁছোয় নি, তার তদারকে ছুটতে হবে। নয়তো রগচটা কোন আত্মীয় নিমন্ত্রণের ত্রুটিতে বসে আছেন পায়ের ওপর পা তুলে—তাঁকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আনতে হবে টেনে। দুটো কাজই সমান বিরক্তিকর। তাই ভুরু দুটো কুঁচকে বললাম, ‘এখন মরবার সময় নেই বৌদি। বরযাত্রীরা সবে খেতে বসেছে। তাদের কি চাই না চাই দেখতে হবে না?’
তাদের কি চাই না চাই সেটা বৌদি জানা প্রয়োজন মনে করলেন না মোটেই, আমি কি চাই সেটা বুঝি তাঁর অজানা ছিলো না। মুচকি হেসে বললেন, ‘খালি লুচির ধামাটা নিয়ে অত ছুটোছুটি আর নাই করলে ঠাকুরপো,ওটা নিচে রেখে এ ঘরে এসো, ডলি তোমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য বসে রয়েছে।’
‘কে ডলি’ মুখ বেঁকালাম বটে, কিন্তু লুচির খালি ধামাটা ততক্ষণ সিঁড়ির কোণে রেখে দিয়েছি। তোয়ালে দিয়ে রগড়ে লালচে করে ফেলেছি মুখটা। হাতের কাছে চিরুনি একটা পেলে চুলগুলোকে একটু দুরস্ত করে নেওয়া যেত, কিন্তু সে কথা বলিই বা কাকে!
‘ডলি সেন গো তোমাদের কলেজের, যার নামে ছেলেরা মুচ্ছো যায়’ বৌদির হাসি আর থামতেই চায় না।
আশ্চর্য, কোঁচকানো মুখ মুহূর্তে ঠিক হয়ে গেলো। হাত দিয়ে আলতো চুলগুলো ঠিক করে নিলাম। হাঁটুর নিচে নামিয়ে দিলাম ধুতি। মেয়েটা আবার যা ফিটফাট, একটু এদিক ওদিক দেখলে মুখই ফিরিয়ে নেবে হয়তো।
ঘরে ঢুকেই কিন্তু থতমত খেয়ে গেলাম। এ সম্ভাবনার কথাটুকু ভাবিনি। ডলি সেন তো আছেই কিন্তু সারা ঘরে যে গিজগিজ করছে মেয়ের পাল। রংয়ের দোকানকেও হার মানিয়েছে আর মুনিয়া পাখির মতন অনর্গল কিচিরমিচির শব্দ। শোনার বালাই নেই, কেবল বলা।
বৌদি আমাকে নিয়ে চৌকাঠের ওপর দাঁড়াতেই সব নিঝুম। মানুষ নেই, যেন রাশি রাশি কফিন। নড়াচড়াও ভুলে গেলো সবাই। ‘এই বাদল, আমার দেওর’ বৌদি ঠেলে দিলেন আমাকে। পরিচয়ের ছিবিতে ঘাবড়ে গেলাম। অবশ্য এই মুহূর্তে বৌদির দেওর ছাড়া অন্য পরিচয়পত্রে আমার দরকার নেই। আর কাজেও লাগত না আর কিছু।
আমি হাত জোড় করার আগেই ডলি সেন হাত জোড় করলো। অন্য মেয়েরা ফুটন্ত খইয়ের মতন ছড়িয়ে ছিটকে পড়লো চারদিকে।ব্যূহ প্রবেশের আর কোন বাধা রইলো’না। একটু দেরি হলো। হাডুডু খেলার মতন কে আগে কার এলাকায় পা দেরে তাই নিয়ে সামান্য সমস্যা, কিন্তু ডলি সেনই এগিয়ে এলো।
‘উপহারের বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে আপনার নাম পেলাম, অবশ্য তলায় কলেজের নামটা লেখা না থাকলে অন্য কোন আকাশের বাদল বলেই ধরে নিতাম।’
ডলি সেন থামার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ঘামতে শুরু করলাম। চেহারার চটকের চেয়ে কথার চটকও কম নয়।
‘ডলি আবার সম্পর্কে আমার বোনঝি হয়, জানো ঠাকুরপো।’ বৌদি আলগোছা ছুঁড়ে দিলেন কথাগুলো।
‘তাই নাকি?’ একগ্লাস জল পেলে হত ধারে কাছে। জিভটা কেবলই শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে আর অস্পষ্ট হয়ে আসছে গলার আওয়াজ।
‘আপনার তো থার্ড ইয়ার?’ ডলি সেন এগিয়ে একেবারে পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো। খুব মিষ্টি একটা গন্ধ, চুল থেকে না কাপড় থেকে কে জানে, কিন্তু মোলায়েম সুবাস। তোয়ালে দিয়ে আবার ঘাড়ের ঘাম মুছলাম, তারপর বললাম, ‘না, ফোর্থ ইয়ার।’
‘বলেন কি? এত অল্প বয়সে?’
পিছনে হাসির রোল উঠলো। চুড়ির ঝঙ্কারও। রসিকতাটা সবাই উপভোগ করলো এমন একটা ভাব।
‘আমার সেকেন্ড ইয়ার। পড়াশোনা যা করছি মুখ থুবড়ে কতদিন পড়ে থাকতে হবে এখানে ঠিক আছে’ ডলি সেন কথার ফাঁকে শাড়ির পাট ঠিক করে নিলো, মাথার কাঁটার ওপর হাত বোলালো, তারপর বিনা কারণেই ফিক করে হাসলো।
এরপর কি বলা যায় ভাবতে গিয়েই বাধা পেলাম। পিসতুতো দাদা ওপর থেকে নিচে নামছিলেন। একেবারে হন্তদন্ত হয়ে। ব্যস্তবাগীশ লোক। নিজে যেদিকটা না দেখবেন সেদিকটাই পণ্ড হবে এমন একটা ধারণা। আজ বলে নয়, চিরটাকাল।
‘ওরে কে আছিস’ হাঁকটা বোধ হয় আমাকে দেখেই।
আমিই ছিলাম এবং বিশ্রী অবস্থায়। আড়চোখে আমার দিকে চাইতেই আমি সরে দাঁড়ালাম, ‘কিছু বললেন?’
‘বলার তো ইচ্ছা ছিলো’ এবার দাদা চাইলেন ডলি সেনের দিকে।
‘একটু শুনে আসি’ বৌদি আর ডলি সেনের মাঝামাঝি চেয়ে হাসবার চেষ্টা করলাম।
শোনা অবশ্য হলো কিন্তু শুনে আসা নয়। একেবারে নিচের ঘরে চালান দেওয়া হলো আমাকে। নিমন্ত্রিতদের আপ্যায়ন করার কাজে।
সব চুকতে রাত বারোটা। হাত মুখ ধুয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে গিয়েই আবার দেখা। ডলি সেন নামছিলো। সাজপোশাক একই, বাড়তি কেবল পানের রসে লাল টুকটুকে দুটি ঠোঁট
এবার আমিই কথা বললাম, ‘কি, বাসর জাগবেন না?’
‘পরের বাসরে আর জেগে লাভ কি?’ চটিতে পা গলাতে গলাতে ডলি সেন উত্তর দিলো।
‘অভ্যাস করে রাখাই তো ভালো, নয়তো নিজের বাসরে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসবে।’ আশেপাশে কেউ নেই। একেবারে ফাঁকা। রাতও নিশুতি। এমন জায়গায় সব মানুষেরই সাহস আসে। মুখে কথা যোগায়।
‘সেদিন ঘুমে যদি চোখ জড়িয়ে আসে জানবেন সে কপট ঘুম। বাড়তি লোকদের তাড়াবার ফিকির।’ কিছু আটকায় না মেয়েটার মুখে। মানুষজন মানে না।
সিঁড়ির এক ধাপ নেমে বললো, ‘দুনিয়াসুদ্ধ লোকের তো কথা শুনে বেড়াচ্ছেন, আমার কথা শুনবেন একটা?’
একটা। যুগযুগান্ত ধরে অবিরাম শুনতে পারি কথা। সামান্য ক্লান্তি আসবে না, একটু অবসাদও নয়। কিন্তু কথাটা কি?
‘সঙ্গে করে পৌঁছে দেবেন। এত রাত্রে একলা যেতে কেমন লাগছে।’ ডলি সেনের গলায় অনুনয়ের ছোঁয়াচ।
‘এ আবার একটা কথা, আসুন’ সঙ্গে সঙ্গে নামতে আরম্ভ করলাম সিঁড়ি দিয়ে। পিছনে পিছনে ডলি সেন।
কথা বললাম মাঝ রাস্তায় এসে।
‘কোথায় যাবেন?’
‘হেমলতা বোর্ডিং। চার্চ রো।’
একেবারে অযথা, তবু কেমন কথা বলতে ইচ্ছা করলো, ‘বোর্ডিংএ থাকেন বুঝি?’
‘উপায় কি? মেয়ে কলেজে পড়ে বলে বাপ তো আর চাকরি ফেলে রংপুর থেকে এখানে এসে বাসা বাঁধতে পারে না।’ কথার সঙ্গে ডলি কাছে সরে এলো। মিটমিটে গ্যাসের আলো। অ্যাসফাল্ট মোড়া রাস্তাটা চিকচিকই করছে শুধু, এমন কিছু আলোকিত হচ্ছে না। ঝুঁকে পড়া পাকুড় আর শিরিষের ডালগুলো বাতাসে কাঁপছে। নিঃসাড়, নিঝুম।
ঠাট্টা করার লোভ সামলাতে পারলাম না, ‘কি সরে এলেন যে? ভয় করছে বুঝি?’
‘মেয়েরা কি শুধু ভয়েতেই সরে আসে?’ উত্তর দিতে ডলি সেনের একমিনিটও দেরি হলো না।
বন্ধুবান্ধবদের মুখে শুনেই এসেছিলাম এতদিন, আজ সংশয় মিটলো। মুখরা, চক্ষুলজ্জার বালাই নেই, তোয়াক্কা করে না কারুর—সব শুনেছিলাম, কিন্তু নির্জন রাস্তায় গভীর রাত্রে ডলি সেনের মুখরতা অস্বস্তিকর মনে হলো। সাপের মতন তুহিনশীতল স্পর্শ, ছোবলের চেয়ে মারাত্মক।
অনেকক্ষণ কথা হলো না। দু’জনের চটির শব্দ। কুকুরের ভয় দেখানো চিৎকার। খুলে রাখা ড্রেনের জলের আওয়াজ। আর দূর নয়। হেলে পড়া নারকেল গাছের পাশে আঁকাবাঁকা খোয়া-ওঠা রাস্তাটাই চার্চ রো। আধ মাইলের মধ্যে চার্চের গন্ধ নেই। হয়তো অনেক আগে মিশনারিদের যুগে ছিলো কিংবা তালপুকুরে ঘটি না ডোবার পুরনো ইতিকথা।
তা নিয়ে মাথা ঘামালাম না, মাথা ঘামলো অন্য একটা কথা মনে হতে, ‘তাইতো একটা ভুল হয়ে গেলো।’
ডলি সেন শুধু থামলো না, একেবারে ঘুরে দাঁড়ালো, ‘কি?’
‘মানে’ মাথা চুলকালাম, ‘আসার সময় বৌদিকে বলে এসেছেন আপনি?’
ডলি সেন মুখোমুখি দাঁড়ালো, ‘আপনার মতলবটা কি বলতে পারেন? এত দূরে এসে আবার উজান বেয়ে আপনার বৌদির কাছে সামাজিকতা রক্ষা করতে যেতে হবে নাকি? পাগল, আসুন, আসুন’ চটির শব্দ তুলে ডলি সেন এগিয়ে গেলো।
জোর দু পা, তারপরেই মুখ ফিরিয়ে বললো, ‘কি আর হবে, বড়জোর ভাববে ডলিকে নিয়ে তার দেওরটি হাওয়া হয়েছে।’
আর একটি কথা নয়, কথার চেষ্টাও নয়। খুরে দণ্ডবত অমন মেয়ের। কথা বলাই দায়। মুখের মধ্যে তো আর জিভ নেই ডলি সেনের, হুল আছে। তাই যদি থাকে, তা বলে নির্বিবাদে নির্বিচারে এমনি করে ফোটাবে মানুষকে!
ঘড়ির আওয়াজে চমক ভাঙলো। পাঁচটা। কি ভাগ্যিস কাজের চাপ কম, ফাইল নেবার তাড়াও নেই বিশেষ, নয়তো দু ঘণ্টা ধরে বসে বসে পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে চলেছি, কারুর নজর পড়েনি। শুধু কি পুরনো কথাই, সামনের ব্লটিং প্যাডে বার তিনেক লিখেছি ডলি সেনের নাম। নজর পড়তেই তার ওপর বুলিয়ে বুলিয়ে বড় সাহেবের নাম লিখলাম। তাঁর উপাধি আর পদবী। তবু যেন রিমলেসের ঝকমকানির মতন ঝকঝক করে ওঠে মেয়েটার নাম। সব বাধা, সব বিপত্তি ঠেলে।
বাসে উঠেও নেমে আসলাম। সাত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেই বা কি লাভ! সেই তো ঝুপসি অন্ধকার কোটর। গায়ে গায়ে তত্তপোশ। পাশ ফিরতে হলে আর একজনের বিছানায় গিয়ে পড়তে হয়। প্রসাদবাবুর একঘেয়ে গড়গড়া টানা, আশুবাবুর গাল বাজিয়ে স্তোত্র পাঠ, মেসের ঠাকুরের হাতল-ভাঙা কাপে বিনা দুধে চা তৈরির কেরামতি, খবরের কাগজ চোখে চাপা দিয়ে চুপচাপ চিত—তার চেয়ে কার্জন পার্কে একটু গড়িয়ে নিতে ক্ষতি কি! অতখানি আকাশ, আর যদি চাঁদ ওঠার তারিখ থাকে চাঁদও তো দেখা যাবে, সব কিছু পয়সা দিয়ে পাওয়ার যুগে এটা কম লাভ! কেরানীর উপরির চেয়েও লোভনীয়।
তারপরে অনেকবার দেখা হয়েছে ডলি সেনের সঙ্গে, আরো ঘন ঘন। ক্লাস করার ফাঁকে, ছুটির পরে, তা ছাড়াও ছলছুতো করে কাছে এসেছি দু’জনে। দেহের কাছেই শুধু নয়, মনেরও কাছাকাছি। কলেজের ছাত্ররা টিটকিরি শুরু করলো, মুখে মুখে বানানো ছড়া, হেমলতা বোর্ডিং-এর মেয়েরা বাঁকা চাউনি আর মুচকি হাসি।
মতলবটা ডলি সেনই বের করলো প্রথমে, ‘একটা কাজ করবে?’
‘কি?’ গন্ধমাদন আনতে বললে তাই পারি এমনি মনের অবস্থা আমার।
‘কাল তো ছুটি, বারোটা নাগাদ থাকবে বালিগঞ্জ স্টেশনে?’
‘বালিগঞ্জ স্টেশনে, হঠাৎ?’
‘থেকো, দরকার আছে।’
থাকবো তো নিশ্চয়, কিন্তু চিন্তায় পড়লাম। এত জায়গা থাকতে স্টেশনে কেন। স্টেশনমাস্টারকে সাক্ষী রেখে মন দেওয়া-নেওয়ার পালা চলবে নাকি?
বারোটার অনেক আগেই পৌঁছোলাম। ডলি সেন এসে পৌঁছোয় নি। স্টেশনও প্রায় ফাঁকা। দু-একটা তরকারিওয়ালা খালি ঝুড়ি নিয়ে ফিরে চলেছে, দুধের বালতি মাথায় কয়েকটা গয়লা। সিগনাল ডাউন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডলি সেন এসে পৌঁছোলো।
‘এই, দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন, শিগ্গির দুটো টিকেট কিনে আনো?’ আমি বুকিং অফিসের দিকে পা বাড়াতেই ডলি বাধা দিল, ‘তুমি দাঁড়াও এখানে, আমিই যাচ্ছি।’
কারণটা বুঝলাম। অবুঝ নয় ডলি দেন। দাদা-বৌদির রোজগারে থেকে, সন্ধের ঝোঁকে বাড়তি একটা টিউশনি করে বড়জোর নিজের জামা-কাপড়ের খরচটা মেটানো যায়, মনের মেয়েকে নিয়ে রেলভ্রমণের বিলাসিতা সাজে না।
ট্রেন আর ডলি এক সঙ্গেই প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছোলো। ট্রেনে ওঠালো ডলি সেন প্রায় হাত ধরে। কামরায় ঢুকেই হকচকিয়ে গেলাম। গদি-আঁটা আসন, ডবল পাখা, ঝকঝকে মেঝে!
‘একি, এ কামরায় উঠলে যে?’
ডলি সেন হাসলো, ‘কামরাই দেখছো শুধু, টিকেট দুটো যে সাদা রংয়ের সেদিকে খেয়াল নেই বুঝি?’
শুধু কামরা বদলই নয়, ডলি সেনও বদলালো। ট্রেন ছাড়তেই আমার কোলের ওপর মাথা দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো, ‘যাক বাবা, ঘন্টা দু’য়েকের জন্য নিশ্চিন্ত।’
‘সত্যিই তাই। ঘণ্টা দুয়েকেই শুধু নয়, যাওয়া-আসা নিয়ে প্রায় ঘণ্টা পাঁচেকের ব্যাপার। একেবারে নিশ্চিন্ত। দাদার চোখরাঙানি, বৌদির কথার খোঁচা, কুড়ি টাকা মাইনে দেওয়া ছাত্রের বাপের গা-জল-করা হাসি—সমস্ত ম্লান হয়ে গেলো। ছোট কামরা তো নয়, ছোট সংসার যেন আমাদের। চাঁদ থাকার কথা নয়, তাই বর্ষার মেঘকে সাক্ষী রেখে আবোল-তাবোল প্রতিজ্ঞা, দুনিয়ার সব কিছু উপেক্ষা করে পরস্পরের কাছে এগিয়ে আসার শপথ। সংসার-অনভিজ্ঞ দুটি হৃদয়ের অক্ষম ব্যাকুলতা।
সেদিন ফিরে এসে আর অবশ্য টিউশনিতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু ক্ষোভ ছিলো না। কারণ একদিনের কাটা মাইনের অঙ্কটা অন্যভাবে ডলি পুষিয়ে দিয়েছিলো। জমার ঘরে টান পড়েনি।
সামনের ঘড়িটার দিকে চেয়েই উঠে দাঁড়ালাম। মেসের ঠাকুর এমন কিছু আপনজন নয় যে রাত অবধি ভাত কোলে করে বসে থাকবে। ওঠা যাক। কিন্তু উঠতে উঠতেও মনে হলো কথাটা। আজকের ডলি সেনের কাছে সে আবোল-তাবোলেরও কোন মানেই হয়তো নেই। চুরাশি টাকা সম্বল কেরানীকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখাটাও ধৃষ্টতা। সেদিনের সাক্ষী রাখা বর্ষার মেঘও ভয়ে পিছিয়ে যাবে।
দিন কুড়ি বোধ হয় কিংবা একটু কমই হবে। সেজো সায়েব কিসের এক হিসেবপত্র খাড়া করার চেষ্টা করছেন, ফলে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট, তো আছেই, আমাকেও সমানে রাত আটটা অবধি হাজিরা দিয়ে যেতে হচ্ছে। এক নাগাড়ে পাঁচদিন। সাতসকালে চিবিয়ে আসা চাল কোথায় তলিয়ে গেছে ঠিক আছে। দুপুরে সস্তায় কেনা ঘুগনিরও অস্তিত্ব নেই, মাঝে মাঝে চোঁয়া ঢেকুর ছাড়া।
ঘাড়ে-মুখে জল দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম, তখন আটটা দশ। বরাত ভালো। প্রায় ফাঁকা ট্রাম সামনে। উঠে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে চোখে লাগাব এই ইচ্ছা, কিন্তু বিধি বাদী, শার্টে টান পড়তেই দাঁড়িয়ে পড়লাম, ‘কি ব্যাপার, এত রাত্রে!’
মুখরোচক একটা উত্তর মনে এসেছিলো, কিন্তু সে কথা কোন মেয়েকেই বলা যায় না, ডলি সেনকে তো নয়ই। ‘রাত একটু হয়ে গেলো’ ঠোঁট কুঁচকে মুখে হাসি-হাসি ভাব আনতে গিয়েই মুশকিল হলো, সেই ঘুগনির চোঁয়া ঢেকুর।
‘বসো না এখানে’ ডলি জানলা ঘেঁষে বসলো। সঙ্কোচ কাটিয়ে পাশেই বসে পড়লাম।
‘তোমার এত দেরি?’
‘আমার মাঝে মাঝে হয় এরকম দেরি। কাজের চাপ বেশি পড়ে।’ ডলি আঁচলটা গুছিয়ে কাঁধের ওপর রাখলো।
‘বেশ লোক তুমি’ আমি শুরু করলাম।
‘কেন?’
‘সেদিন দেখা করতে বললে অথচ বাড়ির ঠিকানাই দিলে না।’
গাল দুটো লালচে হয়ে উঠলো, একটু কাঁপলো বুঝি নিচের ঠোঁট কিন্তু ডলি সেন সামলে নিলো, ‘বাড়ির ঠিকানা দিয়েই বা লাভ কি তোমায়? কতটুকুই বা থাকি বাড়িতে। ছুটির দিনও নিস্তার নেই। সতেরোর দুই অপূর্ব ঘোষাল লেন।’
‘বলো কি’ একটু বেশি জোরেই চেঁচিয়ে ফেললাম, ‘আমার মেস থেকে শুধু একটা ঢিল ছোড়ার ওয়াস্তা।’
ডলি মুচকি হাসলো, ‘সর্বনাশ, ওসব ছুড়ো না যেন, এমনিতেই পাড়ায় বদনাম আছে।’
‘বদনাম?’
‘নিশ্চয়, মেয়েছেলে বিয়ে-থা করে সংসারী হবে, ঝলমলে পোশাক পরে তার আবার সকাল বিকাল অফিস করা কি। পাড়ার বেকার ছোকরারা ভেবে আকুল।’
কোন উত্তর দিলাম না। ট্রাম জোরে ছুটেছে। হাওয়ায় ডলির কপালের চুলগুলো উড়ছে, মনও হয়তো উড়ু উড়ু।
এরকম হবার অবশ্য কথা নয়। বি এ পাস করলেই আশা ছিলো কিছু একটা জুটে যাবে। আজকের এ চাকরির চেয়ে ভালো জাতের কিছু। অন্তত খড়কুটো দিয়ে বাসা বাঁধা যায়, দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বাঁচাও যায় যাতে। পরীক্ষার পরে ডলি বাপের কাছে ফিরে গেলো রংপুরে। পাস করতে পারেনি সে খবর পেয়েছিলাম, কিন্তু আই এ পাস করতে পারেনি বলে লেখাপড়াই ছেড়ে দেবে একেবারে, পুরনো কলেজে ফিরেও আসবে না!
সত্যি কথা বলতে কি, ডলি সেনের কথা খুব বেশি করে ভাবতে পারিনি। পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই দাদা পথ দেখতে বললেন, বৌদি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন পুরুষ মানুষের বসে খাওয়ার লজ্জাটুকুর কথা।
পথ দেখলাম, কিন্তু সে পথে বড় বড় অফিসের ছায়া, ডলি সেনের চিহ্নমাত্রও ছিলো না। শুধু দরখাস্ত, অনুরোধ, উপরোধ, সুপারিশ, ইনিয়ে-বিনিয়ে নিজের দুঃখের কথা বলা। প্রথমে অস্পষ্ট, তারপর এক সময়ে ডলি সেন নিঃশেষে মিলিয়ে গেলো।
‘বিয়ে-থা করো নি?’ আচমকা ডলির গলার আওয়াজে ভাবনার জট ছিঁড়ে গেলো।
‘বিয়ে-থা?’ হাসলাম, ‘মাসান্তে যা পাই তা একটা প্রাণ বাঁচানোর পক্ষেই প্রাণান্তকর, আবার বাড়তি প্রাণ আমদানির চেষ্টা।’
‘আসল কথা তা নয়’ ডলি সেন হাসলো, ‘বাড়িতে তাড়া দেবার কোন লোক নেই কিনা, তাই বেঁচে গেছো।’
আবার পুরনো কথাগুলো মনের মধ্যে ভিড় করে এলো। কাছের মানুষ পাশাপাশি থেকেও যেন কত দূরে। হাত বাড়িয়ে হাতটুকু ছোঁয়ার অধিকারও আজ নেই, মন তো দূরের কথা।
সেদিন যত না বাধা ছিলো, আজকের বাধা অনেক বেশি। প্রধান বাধা মাইনের অঙ্কটা, ডলি সেনের ঝলমলে পোশাকও কম বাধা নয়।
উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে ডলি সেনও উঠে দাঁড়ালো।
‘একি, তুমি উঠলে এখানে, তোমার তো আরও দু স্টপেজ বাকি?’
‘তোমার সঙ্গেই নামি। এক সঙ্গে কিছুটা রাস্তা যাওয়া যাবে।’
আপত্তি করলাম না। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে আর এক রাতের পাশাপাশি হাঁটার কথা মনে পড়লো। আজকের পথ অত জনবিরল নয়। মানুষের চাউনির ভয় আছে। কিন্তু আসল মানুষটার চাউনিই গেছে বদলে।
‘আচ্ছা, তুমি যাও, আমি একটা কাজ সেরে আসি।’ মাটিতে ছাতার ঠোক্কর দিয়ে ডলি সেন থেমে গেলো।
‘এখানে কোথায় কাজ’ এদিকে ওদিকে চেয়ে দেখলাম।
সামনে ছোট্ট সেকরার দোকান। দুটি মাত্র কর্মচারি। গোটা তিনেক আলমারি। তা হলে হবে কি—নামের বহর আছে। “স্বর্ণমৃগ।”
‘গয়নাপত্র যা গড়াবার এখান থেকে গড়াই। চেনা দোকান। বহুকালের পরিচিত। চলি, দেখা হবে আবার।’ ডলি দ্রুত পায়ে দোকানে ঢুকে গেলো।
আমি খুঁটি বনে গেলাম। একটু সময় তো দিতে হয় মানুষকে। সমস্ত ব্যাপারটা আচমকা ঘটে গেলো। ভাবতেও দিলো না।
মেসের কাছ বরাবর এসে কথাটা মনে হলো। রসিক আছে সেকরাটি। ভাবি মানানসই নামটি দিয়েছে। স্বর্ণমৃগই বটে—আমার চুরাশি টাকার দড়ির জালে একে বন্দী করে রাখা যায় কখনও। মৃগ আর জাল দুই যাবে। তখন কপালে হাত চাপড়ানো ছাড়া আর গতি থাকবে না।
তারপর অনেকদিন আর দেখা হয়নি ডলি সেনের সঙ্গে। দেখা করার ফুরসতও ছিলো না। অফিসে বলাইদা টেবিল চাপড়ে গরম গরম কথা আওড়ালেন। মাগ্নীভাতা বাড়াতেই হবে। কেঁচোর মতন বেঁচে থেকে লাভ কি। কথাগুলো কারুর কারুর মনে লাগলো, বাকি সব মাতলো হুজুগে। অবশ্য এই হট্টগোলে মাইনে যদি কিছু বেড়েই যায়, মন্দ কি। বলাইদার কথায় সায় দিয়ে ফেললাম।
কিন্তু ব্যাপারটা যে এমন হবে কে ভাবতে পেরেছিলো! ভিড় করে দাঁড়ানো কেরানীদের মুখের দিকে আলতো একবার নজর বুলিয়ে বড়ো সায়েবও টেবিলে হাত চাপড়ালেন, ‘ভালোই হয়েছে, কিছু লোক ছাঁটাই করার এমনিতেই দরকার পড়েছিলো। আপনাদের দাবি মানা সম্ভব হবে না, যা খুশি করতে পারেন।’
আধবুড়ো আর কিছু ছোকরার দল পিছিয়ে গেলো। এ বাজারে চাকরি গেলে পথে দাঁড়াতে হবে। মাথায় থাক মাগ্নীভাতা, আপনি বাঁচলে তবে জন্মদাতার নাম। কিছু লোক কিন্তু বেঁকেই রইলো। আমার ত্রিশঙ্কুর অবস্থা। ভাত বাঁচাতে গেলে মান বাঁচে না। মান রাখতে হলে গাছের ছায়া আর রাস্তার টেপাকলের জল সম্বল। এমনি টলোমলো অবস্থায় ডলি সেনের কথা মনে পড়ে গেলো। ওর অফিসে কিছু একটা জুটিয়ে নিতে পারলে মান বাঁচে। লাঠি অক্ষত রেখে সাপকে ক্ষতবিক্ষত করা যায়।
অফিসের ভেতরে নয়, ছুটির একটু আগে, বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। পাঁচটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মত কেরানীর দল রাস্তার ছড়িয়ে পড়লো। ছটা, সাড়ে ছটা, তারপর অফিস নিঃঝুম। দু-একটা পিয়ন বেয়ারা ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। সদর দরজাও বন্ধ হলো একসময়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমার শেষ উপায়ও। বাড়িতে দেখা করার কথাটা মনে হলো। খুব ভোর ভোর একবার গেলে হয় না। কিন্তু তার আগেই অফিসে বলাইদা এক কাণ্ড করে বসলেন। কোন এক সিনিয়র ইনচার্জকে বুঝি অপমান করেছেন মেজো সায়েব, উত্তেজিত মুহূর্তে তার হাত থেকে ফাইলটা টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, মুখে বলেছেন ‘গেট আউট।’
এ ব্যাপার হরদম হচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় প্রতি অফিসে। এ নিয়ে মান-অভিমান করার কি আর বয়স আছে আমাদের। অন্নদাতা যদি বলেই গরম কথা, তাতে রাগ করা চলে কখনো। চাল একটু শক্ত বলে বাড়া ভাত কেউ সরিয়ে রাখে! কিন্তু বলাইদা বললেন, ‘ইনক্লাব’ আর অর্ধেকের বেশি লোক আচমকা ‘জিন্দাবাদ’ বলে বেরিয়ে এলো। হুড় হুড় করে লোক বেরিয়ে আসার সময় কেমন তালেগোলে আমিও বেরিয়ে পড়েছি, একেবারে খেয়াল নেই। কিন্তু বেরিয়ে এসে খেয়াল হলো, বেরোবার সময় অফিসের চৌকাঠ যতটা নিচু মনে হয়েছিলো, ঢোকার সময় কিন্তু অত নিচু আর ঠেকবে না। দোরগোড়াতেই হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে, হাজার মাথা খোঁড়াখুড়ি করলেও ভেতরে ঢোকা যাবে না।
মনের এই অবস্থা নিয়ে টানাপোড়েন করতে লাগলাম ডলি সেনের অফিসে আর গলিতে। নিখোঁজ। জলজ্যান্ত মানুষটা গেলো কোথায়! অবশ্য গলি খুঁজে বের করলাম, পায়চারি করলাম বার পাঁচেক। চোদ্দর পরেই উনিশ, সতেরোরই নামগন্ধ নেই তা আবার সতেরোর দুই।
পুরোপুরি একটা মাস গেলো। একত্রিশটা দিন কিন্তু একত্রিশ বছরের চেয়েও দীর্ঘ। বাঁধা রুটিন। রোজ অফিসের সামনে এসে জটলা করি, আড়চোখে চেয়ে চেয়ে দেখি সায়েবদের জানালাগুলোর দিকে। একটু কৃপাদৃষ্টি কিংবা মুচকি হাসি, সঙ্গে সঙ্গে সুড়সুড় করে আমরাও ঢুকে পড়ি অফিসে। কিন্তু কাকস্য। মেজো সায়েবকেও বলিহারি। সামান্য ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপার, তাও বাপের বয়সী একটা কেরানীর কাছে, মিটমাট করে ফেললেই হয়। বুলডগের গোঁ ধরে বসে থেকে আমাদের নাজেহাল করা।
মেজো সায়েব মেজাজে ভর করে দূরে সরে রইলেন কিন্তু তৎপর হলেন মেসের ম্যানেজার, ত্রিলোচনবাবু। সময় নেই, অসময় নেই তাগাদা। দেড় মাসের খাইখরচা নব্বই টাকা পাঁচ আনা, কিন্তু হাবভাবে মনে হলো সেই কটা টাকার ওপরই যেন ওঁর মরণবাঁচন নির্ভর করছে।
প্রথমে নরম নরম কথা, হেঁ হেঁ ভাব, তারপরেই মেজাজ সপ্তমে। অফিসের অবস্থার কথা কেউ কানে তুলে থাকবে। ভালোয় ভালোয় টাকা বের করে না দিই তো ত্রিলোচন মিত্তির কেমন চিজ তা দেখিয়ে দেবেন। অবশ্য টাকা না দিয়েও সেটা দেখতে পারছি। কিন্তু অসহ্য হয়ে উঠলো। অন্য ভদ্রলোকের সামনে মান রাখা দায়।
একদিন সন্ধ্যার ঝোঁকে তোরঙ্গটা খুললাম। ছেঁড়া ধুতি খানকয়েক, ফুটোফাটা পাঞ্জাবি আর শার্ট, কয়েকটা রুমাল, বি এ পাসের সার্টিফিকেট—একেবারে তলায় কাপড়ে বাঁধা ছিলো জিনিসটা, সন্তর্পণে বের করলাম। মাঝারি ওজনের হার, তেঁতুলপাতা প্যাটার্ন। বহু কালের জিনিস। মার গলার দুটি হারের একটি গেছে বৌদির গলায়, আর একটি আপাতত আমার জিম্মায়, যদি কোন বৌ আসে তো তারই হবে। কিন্তু তার আগেই যে ত্রিলোচনবাবু আসবেন এটা আর কে ভাবতে পেরেছিলো!
হারছড়া পকেটে ফেলে রাস্তায় পা দিলাম। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে কখন ‘স্বর্ণমৃগ’র সামনে এসে দাঁড়িয়েছি খেয়াল নেই। দু-এক মিনিটের দ্বিধা, সামান্য ইতস্তত ভাব, তারপরই লম্বা লম্বা পা ফেলে দোকানে গিয়ে উঠলাম। ভয়টাই বা কিসের। চোরাই মাল তো আর নয়।
অনেকক্ষণ, মিনিট পনেরো ধরে সেকরাটি নাড়াচাড়া করলো। মোটা পুরু ফ্রেমের চশমা নাকের ডগায় এনে উল্টেপাল্টে দেখলো, তারপর আমার দিকে চেয়ে বললো, ‘বিক্রি না বাঁধা।’
বললাম, ‘বাঁধা।’ আশা ছিলো পয়সাকড়ি যোগাড় করে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবো এক সময়ে।
আবার পরীক্ষা চললো, এবার কষ্টিপাথরে। অন্তত শ’ দেড়েক টাকা পাওয়া গেলে মানটা বাঁচে।
একদৃষ্টে চেয়ে আছি কারিগরের দিকে, হঠাৎ ভাঙা চেয়ারটা ক্যাঁচকোঁচ করে উঠলো। সেকরা চশমাটা কপালের ওপর তুলে হাত দুটো জোড় করলো, ‘মাপ করবেন, আগের টাকা শোধ না হলে আর একটি পয়সাও দিতে পারবো না। নেহাত চেনাজানা লোক বলে ওই তারের মতন চুড়ি ক’গাছা রেখেছি, যা দিয়েছি তার ওপর একটি পয়সাও আর দিতে পারবো না।’
আমাকে নয় নিশ্চয়, কারণ আমার সঙ্গে সবে কারবারের পত্তন। কাকে সেটা দেখার জন্য মুখ ফিরিয়েই অবাক হয়ে গেলাম। মিটমিটে আলো, তা হোক, তা বলে নিজের লোককে চিনতে পরবে না, তা কি কখনও হয়!
ঝলমলে শাড়ি ব্লাউজ নয়, রংয়ের প্রলেপ নয়, বেঁটে ছাতা পর্যন্ত সঙ্গে নেই, কিন্তু আটপৌরে পোশাকেও ডলি সেন কম লোভনীয় নয়।
আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রংয়ের ছোপ লাগলো দুটি গালে। ধার করা নয়, আসল রং।
হাতের ইশারায় তাকে দাঁড়াতে বলে সেবার দিকে ফিরলাম। দর কষাকষি, দাম যাচাই, তারপর রফা হলো এক শো কুড়িতে। তা হোক, ডুবন্ত লোকের কাছে খড় গাছাটাই কি কম!
টাকাগুলো গুনে পকেটে রেখে দেখলাম ডলি সেন একভাবে ঠিক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
একসঙ্গে দু’জনে দোকান থেকে বাইরে আসলাম।
বড়জোর তিন চার পা, তারপরই ডলি থেমে গেলো, ‘আমায় তুমি মাপ করো!’
‘মাপ!’
‘হ্যাঁ মাপ, মিথ্যে কথা বলার জন্য। ভারতজ্যোতির পি এ আমি নই, ষাট টাকা মাইনের এজেন্ট। কিন্তু ঝলমলে শাড়ি আর পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে রাখতে হয়। রঙিন পোশাক তো নয়, রঙিন পালক—শিকারী ভোলাবার জন্য।’
জনবিরল অন্ধকার পথ। মনে হলো ডলি সেন ফুপিয়ে কাঁদছে।
‘একটা কথা রাখবে?’ খুব মোলায়েম করলাম গলার স্বর।
‘বলো।’
‘একশো কুড়ি থেকে আপাতত আমার দরকার শ’খানেক। মেসের টাকা বাকি। কুড়িটা টাকা তুমি রেখে দাও।’
মিনিট কয়েক, তারপর ডলি সেন হাতটা প্রসারিত করলো।
টাকা নেওয়ার পরেও হাতটা ছাড়লো না। আস্তে বললো, ‘এই, এবার আমার একটা কথা রাখবে?’
‘কি বলো?’
‘চলো না, সেদিনের মতন বালিগঞ্জ স্টেশন দিয়ে বেড়িয়ে আসি কোথাও। নির্জন ফার্স্ট ক্লাস কামরায় শুধু দু’জনে।’
ডলি সেনের টানা দুটি চোখে আমন্ত্রণ। রঙিন পালক নেই, তবু শিকারীর বুক কাঁপে কেন। শুধু নির্জন কামরায় যাওয়া, সেদিনের পুনরাবৃত্তি নয়! কাছে আসার শপথ নয় আর!
আলোকোজ্জ্বল রাস্তার ওপরে এসেই ডলি সেন দাঁড়িয়ে পড়লো। একটু এগিয়ে আমিও থেমে গেলাম, ‘কি হলো থামলে কেন? এর পরে গেলে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। যেতেই তো ঘণ্টা দুয়েক লাগবে।’
‘শোনো’ থমথমে গলার আওয়াজ।
‘কি?’
‘থাক আজ আর গিয়ে কাজ নেই। যেতে আসতে এক একজনের প্রায় সাড়ে দশ টাকার মতন পড়বে ফার্স্ট ক্লাসে, তাই না?’
তাই-ই। এদিকটা একেবারে ভাবিনি, অথচ সবচেয়ে আগে ভাবা উচিত ছিলো। এত টাকা খরচ করে এ ছেলেমানুষির কোন মানে হয়!
‘জানো ওই টাকায় কত চাল হয়?’ ডলি সেন হাসলো।
তা জানি, এও জানি এক সপ্তাহের মেস-খরচ হয় ও টাকায়। আরো অনেক অনেক কিছু, বিশেষত এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি ও টাকার দাম অনেক।
‘চলি’, ডলি সেন অপূর্ব ঘোষাল লেনে ঢুকলো।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম, দুঃখের নয় তৃপ্তির। মনে হলো কোনদিন যেন আর ডলি সেন ফিরে না আসে। মুখোমুখি না দাঁড়ায়। দুটি চোখে অতৃপ্ত কামনা নিয়ে তো নয়ই, বুকে অনন্ত বুভুক্ষা নিয়েও নয়।
১৩৫৮(১৯৫১)