1 of 2

অনিমন্ত্রিত আশুকাকা – বিমল মিত্র

অনিমন্ত্রিত আশুকাকা – বিমল মিত্র

একটা বিরাট মানকচু কিম্বা মোচা। সকালবেলাই সারাদিনের খাওয়ার জোগাড়টা হয়ে থাকতো। দুপুরবেলা বারোয়ারিতলায় বটগাছের ছায়ায় বাঁশের মাচার ওপর ভিজে গামছা কাছে নিয়ে দিবানিদ্রা। জীবনের পঞ্চান্নটা বছর এমনি করে নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় আশুকাকা কাটিয়ে দিয়ে কি এক খেয়ালে আশুকাকা গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে এল।

রাস্তায় একদিন কার মুখে যেন শুনেছিলাম আশুকাকারা এসে কলকাতার বরানগরে না টালিগঞ্জে কোথায় উঠেছে। সেও অনেকদিন হল। তারপর কতদিন কেটে গেল। এতদিন পরে আবার আশুকাকার সংবাদ পেলাম। শুধু পেলাম নয়, সশরীরে আমার বাড়িতেই এসে গেছেন শুনলাম।

সেদিন আমার অফিসেই—

আমার অফিসের ঠিকানা আশুকাকার জানার কথা নয়। কিন্তু ঠিকানা জোগাড় করে দেখা করতে আসা এ-শুধু আশুকাকার পক্ষেই সম্ভব।

চেয়ারটা নির্দেশ করে বললাম—বোস আশুকাকা—

বসবার আগে অফিসের চারদিকে একবার ভাল করে চেয়ে দেখে নিলে। মাথার ওপর পাখা, দেয়ালের গায়ে ঘড়িটা, টেবিলের ওপর পেতলের ‘কলিং বেল’, ইস্পাতের আলমারি, ইত্যাদি ইত্যাদি—

আশুকাকা চেয়ারে বসে কিন্তু অন্যদিকে দেখতে দেখতে বললে—বেশ জায়গায় অফিস তোমার নবনী, বেশ অফিস—সাজানো, গোছানো—কিন্তু আসতে যেতে পেরাণ বেরিয়ে যায়, এক পিঠের বাস ভাড়াই চোদ্দ পয়সা নিয়ে ছাড়লে—

হঠাৎ যেন কাজের কথা মনে পড়ে গেল। বললে—ভাল কথা, তিন টাকা সাড়ে বারো আনা দাও দিকিনি—তোমার জন্যি এই চারদিনে তিন টাকা সাড়ে বারো আনা পয়সা খরচ করে ফেলেছি—বাসে, ট্রামে, রিকশার মোট তোমার গিয়ে তিন টাকা সাড়ে বারো আনাই দিতে হচ্ছে—

কাছারিতে সাক্ষী দিতে গিয়ে যেমন জল-খাবার, রাহাখরচ নেওয়া স্বভাব আশুকাকার, এও তেমনি। এ আমার জানা ঘটনা। এ-সব ক্ষেত্রে নির্বিবাদে টাকাটা বার করে দেওয়াই নিয়ম। আর আশুকাকা চারখানা এক টাকার নোট কোঁচার খুঁটে বেঁধে কোমরে গুঁজে রাখবে—এটাও তেমনি পরিচিত দৃশ্য। এ-নিয়ে আমার প্রশ্ন বা বিস্ময়-প্রকাশ করার কথা নয়।

শুধু জিজ্ঞেস করলাম—বাড়ির সব খবর কী কাকা—

—বাড়ির খবর পরে শুনো, আর তাছাড়া তা শুনেই বা কি করবে ! সে থাকগে, যে কাজের জন্যে আমি এসেছি—

এই কাজটিই আশুকাকার আসল কথা। আশুকাকার পথ বড় সোজা পথ। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে জানে না। সরল কথার মানুষ। মনের কথা আর মুখের কথার মধ্যে কোনও তফাত নেই আশুকাকার।

বললে—অটলদার বাড়িতে তোমার নেমন্তন্ন হয়েছে ?

বললাম—হ্যাঁ কাকা, হয়েছে তো—

ম্রিয়মাণ নয়, অভিমান নয়, লজ্জা দুঃখ কিছু নয়। আশুকাকা যেন পরের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা কইছে।

বললে—তোমারও হয়েছে ?

বললাম—কেন, তোমার নেমন্তন্ন হয়নি কাকা ?

স্বগতোক্তির সুরে আশুকাকা বলে যেতে লাগল—ব্যাপারটা কী রকম হল বল তো— শ্যামবাজারের পেরবোধদার বাড়ি গিয়ে শুনলাম ওদের নেমন্তন্ন হয়েছে, বালিগঞ্জের সিধুদার বাড়ি গিয়ে শুনলাম ওদেরও হয়েছে—

খানিকক্ষণ চুপচাপ।

আশুকাকা বললে—অথচ বলতে পারবে না যে আমার ঠিকানা জানে না—সিধুদার ছেলেকে দিয়ে আমার বাসার ঠিকানটা ওদের কাছে পাঠিয়েছিলাম—

তা হলে ? মহাসমস্যার কথা আশুকাকা তুলেছে।

ভেবে বললাম—আচ্ছা এমন তো হতে পারে ওরা নেমন্তন্নর চিঠি পাঠিয়েছে, কিন্তু পোস্টাপিসের গোলমালে—

—সেকথা বললে হবে না, নিজে রোজ গোস্টাপিসে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি—আজও গিয়েছিলাম— আরও ভাবিয়ে তুললে আশুকাকা।

বললে—এই নিয়ে সব শুদ্ধ চারদিন হল—তিন দিন গেছি তোমার বাড়িতে, শেষে তোমার অফিসে এসে হাজির হলাম—খবরটা শুনে পর্যন্ত রাত্তিরে, নবনী, আমার ভাল ঘুম হয় না—

এই ব্যাপারে আশুকাকার মতো লোকের ঘুম না-হওয়ারই কথা।

আশুকাকা আবার বলতে লাগলো—অথচ ভাবো একবার, অটলদা তখন বেঁচে। বড় মেয়ের বিয়ের সময় কলাপাতা থেকে শুরু করে পান পর্যন্ত এই আশু ঘোষ একলা সব যোগাড় করেছিল—

তারপর খানিক থেমে আবার বললে—তারপর বড় ছেলের বিয়েতে যখন শেষ পর্যন্ত ছানা এসে পৌছুল না সন্ধে বেলা—মনে আছে অটলদা মুখ কালি করে আমার হাত দুটো জাপটে ধরলে, বললে কী হবে আশু—

সে-সব দিনের সুখ-স্মৃতি বোধ হয় আশুকাকাকে বিচলিত করে তোলবার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু এত সহজে মুষড়ে পড়বার লোকও আশুকাকা নয়।

বললে—যাকগে নবনী—সেই খবরটা নিতেই এতদুরে তোমার কাছে আসা। পরশু বিয়ে অথচ আজ সকাল পর্যন্ত কোনও খবরা-খবর না পেয়ে—যাকগে—

যেন হতাশায় বিরক্তিতে ও-প্রসঙ্গ আর আলোচনা করবে না এমনিভাবে মুখের কথাটাকে অসম্পূর্ণ রেখে থেমে গেল আশুকাকা।

বললাম—তোমার খাওয়া হয়েছে নাকি—বেলা তো দুটো বাজতে চলল—

আশুকাকা সেই ভোরবেলা বেরিয়েছে অনেক তালে সুতরাং খাওয়া আর কেমন করে হবে। এখানে এই শহরের ব্যস্ত আবহাওয়াতে এসেও আশুকাকার ব্যতিব্যস্ত ভাবটা কাটেনি।

হোটেলে যেতে যেতে বললাম—কাকিমা কেমন আছে কাকা ?

—তোমার কাকিমার কথা বোল না নবনী, তিনি তো মারা গেছেন—

আমি যেন চমকে উঠলাম। নিঃসন্তান আশুকাকা বিপত্নীক হল কবে। কিন্তু এমন নিঃসঙ্কোচে স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদটাই বা কে দিতে পারে এক আশুকাকা ছাড়া।

জিজ্ঞেস করলাম—কী হয়েছিল শেষকালে ?

—হবে আবার কী, একরকম না খেতে পেয়েই মারা গেল বলতে পারো—তা সে কথা থাক— অটলদার বাড়িতে এদানি গিছলে নাকি নবনী ?

—এই তো কালই গেছি।—বললাম আমি—আমার বিয়েতে ওই সব করেছিল, এখন আমি না গেলে খারাপ দেখায়, তাই যাওয়া—ক’দিন ধরে প্রায়ই যাচ্ছি—যাবতীয় কেনাকাটা…

আশুকাকা কথাটা লুফে নিলে—খাওয়া-দাওয়ার কী রকম বন্দোবস্ত হচ্ছে দেখলে ?

যা যা হচ্ছিল বললাম।

শুনে আশুকাকা ভীষণ দমে গেল। বললে—সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে, অটলদা নেই, আমাকেও নেমন্তন্ন করলে না—কী যে হবে…

আশুকাকা মাথায় হাত দিয়ে বসবার জোগাড়, বললে—কিন্তু মাছের কি হচ্ছে ?

—মাছ তো দেখলাম আমার সামনেই অর্ডার দিলে—

—ক’রকম মাছ ?

বললাম—এক রকম মাছের কথাই তো শুনলাম—আমার সামনে দেড় মণ মাছেরই তো অর্ডার দেওয়া হোল—

আশুকাকা বলে উঠল—সব পণ্ড হবে নবনী, এই তোমায় বলে রাখছি দেখো—অটলদা বেঁচে নেই, আমি নেই—কী যে করবে ছেলে-ছোকরা—বদনাম হয়ে যাবে মাঝখান থেকে দেখে নিও—

বললাম—আর দইঅলা এসেছিল, তাকেও বুঝি দই-এর অর্ডার দেওয়া হল।

—কী দই ?

—তা জানিনে কাকা—

আশুকাকার জন্যে ভাল করে মাংসের অর্ডার দিয়েছিলাম আর পরোটা। ভেতর থেকে গন্ধ আসছিল। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল আশুকাকা। একজন ওয়েটার এসে যথারীতি ময়লা ন্যাতা দিয়ে টেবিলটা পরিষ্কার করে গেছে। মনে হল আশুকাকার যেন লোভ সামলানো দায় হয়ে উঠেছে। হঠাৎ নিজেই নিজের ধুতির কোঁচাটা দিয়ে পরিপাটি করে টেবিলটা সাফ করতে লাগল আশুকাকা। বললে— বড় ময়লা টেবিলটায়—

মাংস এল। পরোটা এল।

আশুকাকা বললে—খাঁটি পাঁঠার মাংস তো নবনী ? দেখো, আমরা সেকেলে লোক—অভয় দিতেই আশুকাকার মুখ ভর্তি হয়ে উঠল মাংসে।

তারপর আস্তে আস্তে লক্ষ করতে লাগলাম। আশুকাকার ক্ষিদেও খাঁটি, আশুকাকার খাওয়ার রীতিটাও খাঁটি—কারণ আশুকাকা মানুষটাই যে খাঁটি। প্রত্যেকটি গ্রাসের সে কী ভঙ্গি, প্রত্যেকটি খাদ্যবস্তু নিয়ে সে কী কসরৎ। নিশ্বাসে, প্রশ্বাসে, ঝোলে, ঝালে—আঙুলে, প্লেটে, মুখে, ঠোঁটে, সবার ওপর চোখের দৃষ্টিতে সে কী সামঞ্জস্যময় মুভমেন্ট।

আমি দেখতে লাগলাম—

হঠাৎ একটা মাংসের হাড় জিভ আর দাঁত দিয়ে কায়দা করতে করতে আশুকাকা সখেদে বললে— তোমার কাকিমা না খেতে পেয়ে মরেছে, এ-কথাটা আমি ভুলতে পারিনে নবনী—

অনেকক্ষণ ধরে খেয়ে এক সময়ে খাওয়া শেষ হল আশুকাকার।

হাত ধুয়ে এসে বসল আবার। বললে—বেশ খাওয়াটা হল আজ—অনেকদিন পরে মাংস খেলাম সত্যি—সেই আড়াই বছর আগে বারোয়ারীতলায় দুগ্যো পুজোর সময়—মহাষ্টমীর দিন—

পরিতৃপ্তির একটা সশব্দ উদগার তুলল আশুকাকা। কিন্তু মনে মনে বুঝলাম আশুকাকার সমস্যার কোনও আশু সমাধান যেন হল না।

আশুকাকা বিদায় নেবার পরেও অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম। আমিই গিয়ে প্রস্তাব করবো নাকি। বাড়িতে কত আত্মীয় অনাত্মীয়, অনাহূত রবাহূত আসবে—তাঁদের সঙ্গে আশুকাকার নামটা জুড়ে দিতে যদি আপত্তি থাকে, নামমাত্র একটা নেমন্তন্ন চিঠি— তাতেও কি আটকাবে ? নিমন্ত্রিত সম্ভ্রান্ত অভ্যাগতদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন হতে চায় আশুকাকা। তার সেই বাসনা কি অযৌক্তিক। কিম্বা একান্তই হাস্যকর ? অপরের শুধু বিপদে নয় উৎসবেও যে তার একটা অধিকার আছে। আজ অটলদা নেই বলেই কি আশুকাকার সমস্ত অধিকার লুপ্ত হবে ? না কি আশুকাকা আজ ঠিকানাহীন বলেই এই অবজ্ঞা।

কিন্তু আমার অবাক হতে তখনও অনেক বাকি ছিল বুঝি।

বিয়ের দিন নয়, বৌভাতের দিনের ঘটনা। একটু সকাল সকালই গিয়েছিলাম। নেহাত তো নিমন্ত্রণ রক্ষে করা নয়। সন্ধে হবার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে পৌঁছেছি।

গিয়ে পৌঁছুতেই প্রথমে আশুকাকা ছাড়া আর কার সঙ্গে দেখা হবে ?

ফর্সা একটা পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে এগিয়ে এল আশুকাকা। এসেই ধমকের সুরে—এই গিয়ে এখন তোমার আসা হল নবনী—তোমরা বাড়ির লোক হয়ে যদি আসতে এত দেরি কর—

—দাঁড়াও আসছি—বলে আশুকাকা বাড়ির ভেতরে সোজা চলে গেল। এবং তার একটু পরেই ফিরে এল।

বললে—রান্নাটা নিজে তদারক করছি কি না—পোলাওটা নাবলো—একটু চেখে এলাম। আজ রান্নাটা খেয়ে দেখো যদি ফার্স্ট ক্লাস না হয় তো আমি কান মুলতে মুলতে না খেয়ে চলে যাবো এ-বাড়ি থেকে—

আরও কয়েকখানা গাড়ি এসে পড়ল। আশুকাকা দৌড়ে গেল ওদিকে অভ্যর্থনা করতে।

বড় ছেলে ছবি, ছোট ছেলে রবি। রবির বিয়ে। কর্তাব্যক্তির মধ্যে ছবিই একলা। অভ্যর্থনা আয়োজন চূড়ান্ত হয়েছে। আলো, লোকজন, গাড়ি, ফুলের মালা—কোনও ত্রুটি নেই। চাকরবাকর, কর্মচারী দারোয়ান লোকলস্কর কিছুরই শেষ নেই। কিন্তু সকলের ওপরে আছে আশুকাকা। আশুকাকার নজর সব দিকে।

আশুকাকা একবার দৌড়ে ভেতরে যায়, আবার বাইরে আসে।

—ওরে অসোময়, মাটির গেলাসগুলো ধুয়ে সাজিয়ে রাখ বাবা—

—হ্যাঁরে নেবুগুলো কাটবো কি আমি ?

—ঠাকুর, লুচির কড়া চড়িয়ে দাও—সাতটা বেজে গেছে—

—এই যে আসুন, আসুন—বড় আনন্দ হল, অটল দাদা আজ নেই—তিনি থাকলে দেখে যেতে পারতেন তাঁর ছেলের বিয়েতে কোনও ত্রুটি আমরা হতে দিইনি—

সমাগত অভ্যাগতদের মধ্যে বসে বসে ভাবছিলাম কেমন করে কী হল। কোনও খুঁতই নেই কোথাও। আশুকাকাও তো ঠিক শেষ পর্যন্ত এসে পড়েছেন। তবে কি তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল নাকি ! আশুকাকার আচরণ দেখে তো মনে হচ্ছে এখানে তার বহুদিনের যাতায়াত। অন্দরমহলেও অবাধ গতি। কিন্তু তিনদিন আগেও তো টের পাইনি।

আশুকাকা হঠাৎ ইঙ্গিতে আমাকে আড়ালে ডাকলে। কোমরে একটা ভোয়ালে জড়িয়েছে। হাতে চায়ের কাপ। এরই মধ্যে তিন চার কাপ খেয়ে শেষ করতে দেখলাম।

কানের কাছে মুখ এনে আশুকাকা বললে—তুমি বলেছিলে শুধু রুই মাছের কালিয়ার কথা, ভেটকি মাছের ফ্রাইটাও করিয়েছি—কারিগর ভালো, খেয়ে দেখো মন্দ করেনি—এই লুচির কড়াটা নামলেই পাতা সাজিয়ে দেব।…আর একটা কথা—

চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললে—মাংস হবার কথা ছিল না, আমিই রবিকে বলে করালাম। বললাম—কতই বা খরচ তোমার, মাংসটা করা চাই, অটলদাদা খেতে ভালবাসতেন—

আবার চায়ে চুমুক দিলে।

একটু থেমে বললে—নতুন বিলিতি বেগুনের একটা চাটনিও করিয়েছি দেখো—একটা ঝাল-ঝাল—কিছু ভাবনা নেই, আমি তোমার পাশেই বসবোখন—কোনটার পর কী কতটা খেতে হবে—সব বলে দেবখন—কিচ্ছু ভাবনা নেই তোমার নবনী—

আশুকাকা যেন আমার পরম উপকার করছে—এমনি একটা বিশ্বাস আশুকাকার বক্তব্যের পেছনে। কারণ আশুকাকা অন্তরে অন্তরে বিশ্বাস করে নেমন্তন্ন বাড়িতে কাউকে অগ্রিম খাওয়ার তালিকা জানিয়ে দেওয়া একটা পরম উপকারের সামিল।

কিন্তু যে প্রশ্নটা আমার মনের মধ্যে খচ খচ করে বিঁধছে সেটা আর উত্থাপন করবার ফুরসুত পেলাম না।

হঠাৎ আশুকাকা বৈঠকখানায় ঢুকল দু হাত জোড় করে।

—তা হলে এবার উঠতে আজ্ঞে হোক—

—ঠাকুর মশাই উঠুন—সিধুদা ওঠো ওঠো—ও হরিদাস গা তোল ভাই—অশ্বিনীদা বসে রইলে যে, ওঠ, তোমাকে তো সেই আবার টালিগঞ্জে যেতে হবে—

—ওই যে, সামনের বারান্দায় ঢুকেই ডানদিকে ওপরে ওঠবার সিঁড়ি—বরাবর উঠে পড়ুন—ও অসোময়, মাটির খুরি গেলাসগুলো ওপরে নিয়ে এসো—আর ঠাকুরকে বলল ভাঁড়ার থেকে আরও সের পাঁচেক ময়দা নিয়ে যাক—আমি ভাঁড়ারে বলে দিয়েছি—

—ও তোমার নাম কি ভাই—বেশ বেশ—যেমনি বসবে সবাই, একজন গরম লুচির ঝুড়ি নিয়ে এদিক থেকে ঘুরে যাবে, আর ওদিক থেকে আর একজন পেতলের বালতি নিয়ে নিরামিষ ঘি-ভাত দিতে থাকবে—তারপর…

তেতলার ছাদে সবাই বসে গেছি। আশুকাকা নিজে এসে বসিয়ে দিয়ে গেছে তার নির্দিষ্ট আসনে। আমার পাশের কুশাসনে নিজের তোয়ালেটা রেখে দিয়েছে। অর্থাৎ আশুকাকার জন্যে আসন সংরক্ষিত রইল।

সবাই বসে গেছে। ডাইনে বাঁয়ে দুই সারি নিমন্ত্রিতের মধ্যে আশুকাকা একলা তদারক করতে বেরিয়েছে। প্রধান সেনাপতির সৈন্যদের কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের মতো।

—ও অসোময় হাঁ করে কি দেখছ ওখানে দাঁড়িয়ে—কারুর গেলাসে যে জল নেই দেখতে পাচ্ছ না।—

—ওহে তোমার নাম কি—শোন ইদিকে—এর পরে মাংসের পোলাওটা নিয়ে আসবে তুমি, আর বসন্তকে বলবে নিরিমিষ মুগের ডালটা গামলায় যেন ঠিক করে রেডি রাখে—তারপরে ছোলার ডালের মুড়িঘণ্ট…

—সিধুদা তুমি মোটে কিছু খাচ্ছ না—গরম দু’খানা লুচি দিক—তুমি তো বরাবর মাংসের পোলাওটা খেতে ভালবাসতে—ফেলে রাখলে যে—

—ও হরিদাস খাও খাও—তোমাদেরই তো খাবার বয়েস—তোমাদের বয়সে আমরা এক একটা আস্ত পাঁঠা একলা খেয়ে হজম করেছি—

—অশ্বিনীদাকে ভাল করে পরিবেশন করা হচ্ছে না, এ কী খাওয়া হচ্ছে—যেদিকে দেখব না, সেইদিকেই বে-বন্দোবস্ত—

—ও হে এবার মাছ নিয়ে এস—কালিয়াটা—ফ্রাইটা কেমন হয়েছে ঠাকুর মশাই—নিজে তদারক করে করিয়েছি—আমার হাতের কারিগর পেলে অবিশ্যি আরও ভাল হত—

এবার আশুকাকা সোজা এসে তোয়ালে তুলে কুশাসনে বসে পড়ল। বললে—পরের ব্যাচে বসলেও চলত, কিন্তু থাকি অনেক দূরে—

বলে ভাজা দিয়ে লুচি মুখে পুরে দিয়ে বললে—কী করছ নবনী, শাক ভাজা, কুমড়োর ঘ্যাঁট দিয়েই পেট ভরিয়ে ফেললে—ওদিকে ভাল ভাল জিনিসগুলোই যে এখনও বাকি রয়ে গেছে—

বাড়ির আসল কর্তা ছবি কিন্তু আশুকাকার কাছে যেন ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে তদারক করছে—কিন্তু কার্যকর তদারক হচ্ছে না যেন।

খেতে বসেও আশুকাকার শান্তি নেই।

—ও অসোময় গেলাসগুলো একবার দেখো—কার জল চাই, না-চাই—

—এই বার মাংসের পোলাওটা দিয়ে, মাংসের কালিয়াটা নিয়ে এস চট করে—

আশুকাকা মুখ দিয়ে খায়, কিন্তু তীক্ষ্ন দৃষ্টি রয়েছে চারিদিকে। কিসের পরে কি পরিবেশন করতে হবে, কার পাতে কী নেই—কে খাচ্ছে, কে খাচ্ছে না—সমস্ত—

—ওহে বসন্ত মাংসের কালিয়াটা এই রো’তে আর একবার দেখিয়ে নিয়ে যাও তো—নাও নবনী— বেশ মাংস দেখে দেখে গোটা চার পাঁচ দাও দিকি এ-পাতে—খাও, খেয়ে কেমন রান্না হয়েছে বলতে হবে—

ওজর আপত্তি শুনলে না। আমার পাতেও ঢালালে—নিজেও নিলে অনেকখানি আশুকাকা। আশুকাকা খাইয়ে মানুষ।

ছবি একবার সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার সামনে এল। একবার চেয়ে দেখলে আমার পাতের দিকে। কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিল—আশুকাকা বাধা দিলে।

বললে—অটলদা—বুঝলে ছবি—অটলদা আর আমি দু’জনেই মাংস খেতে ভালবাসতাম— একবার কাছারির কাজ শেষ করে অটলদা বললে—আশু, চল আজ একটা খাসি কাটা যাক। অটলদার যে কথা সেই কাজ—খাসি কাটতে হবে—গেলাম মোছনমান পাড়ায়—গিয়ে দেখি…

গিয়ে আশুকাকা কী দেখলে বলা হল না। রসময়ের পা লেগে আশুকাকার জল শুদ্ধ গ্লাসটা উল্টে গেল।

তারপর সে এক হৈ হৈ কাণ্ড।

জলে, পাতায়, কুশাসনে, এঁটোয় একেবারে একাকার।

আশুকাকা ফেটে পড়ল—দেখলে নবনী, কাণ্ডটা দেখলে—

কিন্তু তা হোক। আশুকাকার খাওয়া তা বলে নষ্ট হল না। তখন সবে মাংসের কালিয়া পড়েছিল— তারপরও অনেক কিছু বাকি।

একে একে টোম্যাটোর চাটনি, পাঁপড়ভাজা, দই, মিষ্টি সব এল। আশুকাকা সকলকে খাওয়ালে এবং নিজেও খেলে কম নয়।

হাত ধুয়ে মুখ মুছে পান চিবোচ্ছিলাম। এবার যাবার বন্দোবস্ত করতে হবে।

আশুকাকা হন্তদন্ত হয়ে এসে বললে—নবনী তুমি যেন চলে যেও না, একটু দাঁড়াও, তোমার গাড়িতে যাব যে—

—ও অসোময়, একটা চাঙারিতে বেশ করে সব রকম খাবার সাজিয়ে দাও তো—না ওর দ্বারা হবে না—দাঁড়াও নবনী, নিজেই গিয়ে দেখে-শুনে আনতে হবে—

জিজ্ঞেস করলাম—কী আনবে কাকা—

আশুকাকা চলতে চলতে বললে—তোমার কাকিমার জন্যে কিছু খাবার নেব বেঁধে—দেখি

উর্ধ্বশ্বাসে আশুকাকা দৌড়ে ওধারে চলে গেল।

আমি দাঁড়িয়ে আছি। ছবি এসে দাঁড়াল পাশে। বললে—কে ও-ভদ্রলোক নবনী ?

আমি প্রশ্ন শুনে অবাক, কিন্তু আমার উত্তর দেওয়াও হল না। আশুকাকা সেই মুহূর্তেই এসে পড়েছে। হাতে গামছায় বাঁধা সুবিরাট এক পোঁটলা। বললে—চল নবনী—

উঠে বসল আশুকাকা।

গাড়ি স্টার্ট দিলাম।

আশুকাকার নির্দেশ অনুযায়ী গাড়ি চলছে।

গাড়ি চলছে—আর আশুকাকা পোঁটলাটা দুইহাতে ধরে বসে আছে।

বললে—সব নিয়েছি নবনী, নেবুর কুচিটাও বাদ দিইনি, থরে থরে খুরিতে, মাটির গেলাসে সাজিয়েছি, মালসায় নিয়েছি পোলাও—আর…

নিস্তব্ধ রাত। আর একটু পরে নিশুতি হয়ে যাবে সব। গাড়ির ঘূর্ণ্যমান দুটো রবারের চাকার শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ কানে আসে না। জ্বলন্ত হেডলাইট সামনের অন্ধকারের পাথরে উজ্জ্বল লিপি খোদাই করতে করতে চলেছে—

হঠাৎ প্রশ্ন করলাম—আচ্ছা কাকা শেষ পর্যন্ত রবিরা তোমাকে নেমন্তন্ন করেছিল তাহলে ?

কাকা চমকে উঠল—কই না, করেনি তো ! কখন করলে ?

—করেনি ?

আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না।

ততোধিক দৃঢ়তার সঙ্গে আশুকাকা বললে—না, করেনি তো—

কী জানি, কেন হঠাৎ আশুকাকা নিজের মনেই বলে উঠল—না করলেই বা…

অন্ধকারের মধ্যেই আশুকাকার মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম। পরিতৃপ্তির সঙ্গে পান চিবোচ্ছে। সঙ্কোচ, লজ্জা, কিন্তু কিছু নেই ও-মুখে।

বললে—না করলেই বা নবনী—ওরা কি আর আমায় চেনে—অটলদা চিনতো, অটলদা বেঁচে থাকলে আমাকে নেমন্তন্ন করতে ভুলতো না, তা যাক—ওরা না হয়, ছেলেমানুষ—তা বলে আমি তো আর ছেলেমানুষী করে রাগ করে দূরে থাকতে পারিনে—

থামলো আশুকাকা—

গাড়ি মোড় ঘুরছিল। সোজা রাস্তায় পড়ে আশুকাকা আবার আরম্ভ করলে, অনেক ভাবলাম— বুঝলে নবনী, সেদিন তোমার বাড়ি থেকে ফিরে গিয়ে অনেক ভাবলাম। বুঝলাম ছবির তে দোষ নেই—ওরা ছেলেমানুষ, ওরা আমায় চেনে না, কিন্তু আমি যদি ছেলেমানুষী করে নেমন্তন্ন করেনি বলে না যাই, সব পণ্ড হয়ে যাবে যে—সব লণ্ড-ভণ্ড হয়ে যাবে—সগ্যো থেকে অটলদা সব তো দেখছেন— বলবেন, আশু আমার পেটের ভাই না হয় না হল, কিন্তু মায়ের পেটের ভাই-এর চেয়ে কম ছিল কিসে ? অনেক ভাবলাম, জানো নবনী—শেষে বৌভাতের দিন ভোরবেলাই গিয়ে হাজির। নিজের পরিচয় দিলাম নিজেই—কী করবো বলো—

আশুকাকা যা বললে, তা সত্যিই বিশ্বাস করে।

—এবার কোন দিকে যাবো কাকা ?

আশুকাকার উত্তর দেবার আগেই মোড়ের মাথায় হঠাৎ ব্রেক কষতে হল। ওদিক থেকে আর একখানা গাড়ি অজান্তে সামনে এসে পড়েছে।

কিন্তু সেই হঠাৎ ব্রেক কষার আকস্মিকতায় অশুকাকার হাত থেকে পোঁটলা গেছে খুলে—আর মাথাটা গিয়ে ঠোকর খেয়েছে সামনের কাচের সঙ্গে।

তারপর সে এক কাণ্ড। ডালে, ভাতে, দই, চাটনিতে, মাছে মাংসে অত সাজানো চাঙারি হঠাৎ উল্টে পড়েছে গাড়ির মেঝেতে। ছত্রাকার খাদ্যসামগ্রী জুতার ধুলোর ওপর মাখামাখি।

—এ কী হল নবনী—

গাড়ির ভেতরের আলোটা জ্বেলে নেবে দাঁড়ালাম। আশুকাকার চোখে কখনও জল দেখিনি। এবারও জল নেই কিন্তু এর চেয়ে বুঝি জল বেরুন ভাল ছিল।

—এ কী হল নবনী—

তারপর আশুকাকা নিজের হাতে সেই দই, সেই পোলাও, মাংস, মাছ, লুচি, ডাল যাবতীয় জিনিস আবার ধুলো থেকে আলগোছে তুলতে লাগল। আর আমি নির্বাক সেই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। তারপর প্রত্যেকটি জিনিস প্রত্যেকটি ভাত যখন খুঁটে নেওয়া শেষ হল, আশুকাকা বললে—আচ্ছা নবনী, তুমি তাহলে এসো, অনেক রাত হয়ে গেছে—আমি এটুকু বেশ হেঁটে যেতে পারবো—

আশুকাকা পুঁটলি নিয়ে সোজা উঠে দাঁড়িয়ে চলতে লাগল।

গাড়িটা পাশের গলির ভেতর ঢুকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নেব। ছোট গলি। অতিকষ্টে গাড়িটা ঘোরালাম।

মনে মনে ভাবছিলাম। আশুকাকা বলেছিল কাকিমা মারা গেছে—না খেতে পেয়ে মারা গেছে। তবে এ কোন কাকিমার খাবার বেঁধে নিয়ে গেল কাকা। মিথ্যে কথা বলবার লোক তো নয় আশুকাকা। তবে কি কাল সকালে উঠে নিজেই খাবে ? কিম্বা হয়তো সে কাকিমার মৃত্যুর পর আবার এক কাকিমার আবির্ভাব হয়েছে। আশুকাকা হয়তো বিয়ে করেছে দ্বিতীয় পক্ষে। হয়তো মাথার দিব্যি দিয়ে বিয়ে করতে বলে গিয়েছিল মরবার সময়। হয়তো অরক্ষণীয়া শ্যালিকাই দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী হয়ে এসেছে। কী জানি !

গলি থেকে বেরিয়েই ডানদিকে বড় বাসা একটা।

সেইখানে সেই রাত্রির দ্বিপ্রহরে আমি ভূত দেখলাম।

একটা ডাস্টবিনের ধারে বসে আশুকাকা পুঁটলি বাঁধছে। থরে থরে মাছ, মাংস, রসগোল্লা, সন্দেশ, দই সাজিয়ে রাখছে চাঙারিতে। আশুঙ্কাকার দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীর জন্যেই হয়তো। গাড়িটা থামিয়ে দেখলাম। দেখতে লাগলাম। আশুকাকাই তো। কোনও সন্দেহ নেই—

—আশুকাকা—ডাকলাম।

আশুকাকা আমার দিকে চাইলে। বড় কাতর সে চাউনি।

—কে ? নবনী ?—বেশ স্পষ্ট মনে আছে আশুকাকার গলা।

—হ্যাঁ, কিন্তু তুমি এখেনে ?

গাড়ির দরজা বন্ধ করে নামলাম। কৌতুহলের তো সীমা ছিল না আমার।

কিন্তু কাছে যেতেই একটা ধবধবে সাদা লোমওয়ালা কুকুর আমাকে দেখে ভয়ে ওদিকে পালিয়ে গেল।

চোখের কানের কী মর্মান্তিক ভূল ! আশুকাকা নয়, ছিঃ ছিঃ—একটা কুকুর !

কুকুরটা বোধ হয় আগে কোনও সৌখিন লোকের পোষা কুকুর ছিল।

১৬ এপ্রিল ১৯৫০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *