অনসূয়া

কাঁঠালের ভূতি-পচা, আমানি, মাছের যত আঁশ,
               রান্নাঘরের পাঁশ,
     মরা বিড়ালের দেহ, পেঁকো নর্দমায়
বীভৎস মাছির দল ঐকতান-বাদন জমায়।
          শেষরাত্রে মাতাল বাসায়
স্ত্রীকে মারে, গালি দেয় গদ্‌গদ ভাষায়,
          ঘুমভাঙা পাশের বাড়িতে
পাড়াপ্রতিবেশী থাকে হুংকার ছাড়িতে।
               ভদ্রতার বোধ যায় চলে,
     মনে হয় নরহত্যা পাপ নয় ব’লে।
          কুকুরটা, সর্ব অঙ্গে ক্ষত,
     বিছানায় শোয় এসে, আমি নিদ্রাগত।
নিজেরে জানান দেয় তীব্রকণ্ঠে আত্মশ্লাঘী সতী
               রণচন্ডা চন্ডী মূর্তিমতী।
          মোটা সিঁদুরের রেখা আঁকা,
                  হাতে মোটা শাঁখা,
          শাড়ি লাল-পেড়ে,
               খাটো খোঁপা-পিন্ডটুকু ছেড়ে
       ঘোমটার প্রান্ত ওঠে টাকের সীমায়–
অস্থির সমস্ত পাড়া এ মেয়ের সতী-মহিমায়।
এ গলিতে বাস মোর, তবু আমি জন্ম-রোমান্টিক–
          আমি সেই পথের পথিক
     যে-পথ দেখায়ে চলে দক্ষিণে বাতাসে,
পাখির ইশারা যায় যে-পথের অলক্ষ্য আকাশে।
          মৌমাছি যে-পথ জানে
               মাধবীর অদৃশ্য আহ্বানে।
          এটা সত্য কিংবা সত্য ওটা
               মোর কাছে মিথ্যা সে তর্কটা।
          আকাশকুসুম-কুঞ্জবনে,
                   দিগঙ্গনে
          ভিত্তিহীন যে-বাসা আমার
     সেখানেই পলাতকা আসা-যাওয়া করে বার-বার।
          আজি এই চৈত্রের খেয়ালে
               মনেরে জড়ালো ইন্দ্রজালে।
                   দেশকাল
          ভুলে গেল তার বাঁধা তাল।
     নায়িকা আসিল নেমে আকাশপ্রদীপে আলো পেয়ে।
                   সেই মেয়ে
               নহে বিংশ-শতকিয়া
     ছন্দোহারা কবিদের ব্যঙ্গহাসি-বিহসিত প্রিয়া।
          সে নয় ইকনমিক্‌স্‌-পরীক্ষাবাহিনী
আতপ্ত বসন্তে আজি নিশ্বসিত যাহার কাহিনী।
               অনসূয়া নাম তার, প্রাকৃতভাষায়
কারে সে বিস্মৃত যুগে কাঁদায় হাসায়,
          অশ্রুত হাসির ধ্বনি মিলায় সে কলকোলাহলে
                   শিপ্রাতটতলে।
     পিনদ্ধ বল্কলবন্ধে যৌবনের বন্দী দূত দোঁহে
               জাগে অঙ্গে উদ্ধত বিদ্রোহে।
          অযতনে এলায়িত রুক্ষ কেশপাশ        
বনপথে মেলে চলে মৃদুমন্দ গন্ধের আভাস।
               প্রিয়কে সে বলে, “পিয়’,
                   বাণী লোভনীয়–
               এনে দেয় রোমাঞ্চ-হরষ
                   কোমল সে ধ্বনির পরশ।
               সোহাগের নাম দেয় মাধবীরে
                    আলিঙ্গনে ঘিরে,
               এ মাধুরী যে দেখে গোপনে
                   ঈর্ষার বেদনা পায় মনে।
     যখন নৃপতি ছিল উচ্ছৃঙ্খল উন্মত্তের মতো
          দয়াহীন ছলনায় রত
               আমি কবি অনাবিল সরল মাধুরী
                   করিতেছিলাম চুরি
                  এলা-বনচ্ছায়ে এক কোণে,
             মধুকর যেমন গোপনে
                   ফুলমধু লয় হরি
             নিভৃত ভান্ডার ভরি ভরি
                   মালতীর স্মিত সম্মতিতে।
             ছিল সে গাঁথিতে
                   নতশিরে পুষ্পহার
             সদ্য-তোলা কুঁড়ি মল্লিকার।
          বলেছিনু, আমি দেব ছন্দের গাঁথুনি
                   কথা চুনি চুনি।
                    অয়ি মালবিকা
অভিসার-যাত্রাপথে কখনো বহ নি দীপশিখা।
     অর্ধাবগুণ্ঠিত ছিলে কাব্যে শুধু ইঙ্গিত-আড়ালে,
               নিঃশবদে চরণ বাড়ালে
          হৃদয়প্রাঙ্গণে আজি স্পষ্ট আলোকে–
                 বিস্মিত চাহনিখানি বিস্ফারিত কালো দুটি চোখে,
                   বহু মৌনী শতাব্দীর মাঝে দেখিলাম–
                             প্রিয় নাম
                   প্রথম শুনিলে বুঝি কবিকণ্ঠস্বরে
                             দূর যুগান্তরে।
                        বোধ হল, তুলে ধ’রে ডালা
                   মোর হাতে দিলে তব আধফোটা মল্লিকার মালা।
সুকুমার অঙ্গুলির ভঙ্গীটুকু মনে ধ্যান ক’রে
       ছবি আঁকিলাম বসে চৈত্রের প্রহরে।
    স্বপ্নের বাঁশিটি আজ ফেলে তব কোলে
                         আর-বার যেতে হবে চ’লে  
                  সেথা, যেথা বাস্তবের মিথ্যা বঞ্চনায়
                             দিন চলে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *