অধ্যায় ৫১ : একজন আধুনিক গোমাছি – পিটার সিংগার

অধ্যায় ৫১ : একজন আধুনিক গোমাছি – পিটার সিংগার

আপনি একটি বাগানে, যেখানে আপনি জানেন যে একটি পুকুর আছে, হঠাৎ করে পুকুরের পানিতে কিছু পড়ার শব্দ এবং চিৎকার শুনতে পেলেন। আপনি বুঝতে পারলেন যে একটি শিশু পানিতে পড়ে গেছে, এবং সে ডুবে মারা যেতে পারে। কী করবেন আপনি? আপনি কি কিছু না করে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাবেন? এমনকি যদিও আপনি কথা দিয়েছেন এক বন্ধুর সাথে দেখা করবেন, আর অপেক্ষা করলে দেরি হয়ে যাবে সেখানে পৌঁছাতে। পুকুরটা খুব গভীর না, কিন্তু খুবই কর্দমাক্ত। আপনার সবচেয়ে ভালো জুতাটা নষ্ট হবে যদি আপনি সাহায্য করতে চান। কিন্তু আপনার আশা করা ঠিক হবে না যে অন্য মানুষরাও সেটি বুঝবে যদি আপনি পানিতে লাফিয়ে না পড়েন শিশুটিকে বাঁচাতে। বিষয়টি মানুষ আর জীবনকে মূল্য দেবার বিষয়। একজন শিশুর জীবন অনেক বেশি মূল্যবান যে-কোনো মূল্যেরই একজোড়া জুতার চেয়ে, এমনকি সবচেয়ে মূল্যবান কোনো গাড়ির চেয়েও। আর এর ব্যতিক্রম কিছু যারা ভাবেন তারা আসলেই একধরনের অমানব। আপনি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন এমন পরিস্থিতিতে, তাই না? অবশ্যই, আপনি সেটি করবেন। কিন্তু আবার ধরুন, আপনি সম্ভবত যথেষ্ট পরিমাণ টাকা আয় করেন, উন্নয়নশীল দেশের কোনো শিশুকে অনাহারে বা কোনো ক্রান্তীয় ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা আপনার আছে। আর সেটি করতে এই পুকুরে ডুবতে থাকা বাচ্চাটি বাঁচানোর জন্য যে জুতাটি নষ্ট করতে আপনি প্রস্তুত, সম্ভবত তার মূল্যের চেয়ে বেশি পরিমাণ কিছু হবে না। তাহলে কেন আপনি অন্য শিশুটিকে সাহায্য করেননি, ধরে নিচ্ছি আপনি করেননি? খুব সামান্য পরিমাণ টাকা সঠিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দিলে সেটি অন্তত একটি জীবন বাঁচাতে পারে। শৈশবের বহু সংক্রামক ব্যাধিকে খুব সহজে প্রতিরোধ করা যেতে পারে তুলনামূলকভাবে অল্পকিছু টাকার বিনিময়ে, যা তাদের টিকা বা অন্য ঔষধের মূল্য পরিশোধ করতে সাহায্য করবে। কিন্তু কেন আপনি একইভাবে অনুভব করেন না যখন আফ্রিকাতে কেউ মারা যায়, ঠিক যেমন করে আপনি অনুভব করেন যখন কোনো শিশুকে চোখের সামনে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখেন। যদি আপনি একইভাবে অনুভব করেন দুটি ক্ষেত্রেই, তাহলে আপনি অবশ্যই ব্যতিক্রম। আমরা অধিকাংশ মানুষ তেমন নই, এমনকি যখন এই বাস্তব সত্যটা নিয়ে আমরা খানিকটা অস্বস্তি অনুভব করি।

অস্ট্রেলীয় দার্শনিক পিটার সিংগার (জন্ম ১৯৪৬) যুক্তি দিয়েছিলেন, আপনার সামনে ডুবতে থাকা শিশু আর আফ্রিকায় অভুক্ত কোনো শিশু আসলে খুব বেশি ভিন্ন নয়। আমাদের আরো বেশি ভাবা উচিত সেইসব শিশুদের নিয়ে সারা পৃথিবীজুড়ে যাদের আমরা বাঁচাতে পারি, যতটা আমরা করি তার চেয়েও। যদি আমরা কিছু না করি, তাহলে শিশুরা যারা হয়তো বাঁচত, তারা অবশ্যই অল্পবয়সে মারা যাবে। এটি কোনো অনুমান নয়। আমরা জানি এটি সত্য। আমরা জানি যে হাজার হাজার শিশু প্রতিবছর মারা যায় দরিদ্রতাজনিত কারণে। কেউ মারা যায় অনাহারে, যখন উন্নত বিশ্বে মানুষরা ফ্রিজে পচতে থাকা খাদ্য ফেলে দিতে বাধ্য হয়, তাদের সেগুলো খাওয়ার জন্য সময় কিংবা ইচ্ছা হয়ে ওঠে না বলে। অনেকেই পরিষ্কার পানি পায় না পান করার জন্য। সুতরাং আমাদের উচিত যা আমাদের আসলেই দরকার নেই এমন একটি কিংবা দুটি বিলাসিতা পরিত্যাগ করে, সেইসব ভাগ্যবঞ্চিত মানুষগুলোকে সাহায্য করা, কারণ তারা এমন জায়গায় জন্ম নিয়েছে, যেখানে জন্ম নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো হাত নেই। জীবনের আদর্শ হিসাবে এটি বেশ কঠিন দর্শন। তার মানে এমন নয় যে আমাদের কী করা উচিত সে-বিষয়ে সিংগার ভুল কিছু বলছেন। আপনি হয়তো বলতে পারেন যদি আপনি কোনো অর্থ দান না করেন, অন্য কেউ সম্ভবত সেটি করবে। এখানে ঝুঁকিটি হচ্ছে আমরা সবাই সেই ‘দেখতে থাকা’ মানুষগুলোর মতো হবে, প্রত্যেকেই মনে করবেন যে অন্য কেউ-না-কেউ যা প্রয়োজন সেটি অবশ্যই করবে। এই পৃথিবীর বহু মানুষ চরম দরিদ্রসীমার নিচে বাস করেন, প্রতিদিনই তারা ক্ষুধার্ত হয়ে দিন পার করে। তাদের প্রয়োজন কখনোই মিটবে না অল্প কয়েকজনের দানে। এটি সত্য যে চোখের সামনে ডুবতে থাকা কোনো শিশুর ক্ষেত্রে খুব সহজ দেখা যে অন্য কেউ শিশুর সাহায্যে এগিয়ে আসছে কিনা, কিন্তু বহুদূরের কোনো দেশে কষ্ট ভোগ করছে যারা, তাদের ক্ষেত্রে বলা সম্ভব না আমাদের কাজের কী প্রভাব পড়ছে বা অন্য মানুষদের কাজের প্রভাবই কী সেখানে, অবশ্যই তার মানে এই না যে কোনোকিছু না-করাই শ্রেষ্ঠ সমাধান।

এই বিষয়টির সাথে যুক্ত সেই ভয়টিও যে, ভিন দেশের গরিব মানুষকে দান করলে বিত্তবানদের দানের উপর সেই মানুষগুলোর নির্ভরশীলতা বাড়বে, এবং সেটি তাদের বাধা দেবে তাদের নিজেদের খাদ্য উৎপাদনে সচেষ্ট হতে বা পানির জন্য কুয়া আর বসবাসের জায়গা নির্মাণের ক্ষেত্রে। এবং একসময় এটাই পরিস্থিতির আরো অবনতির কারণ হবে, এমনকি যদি আপনি কিছু না দানও করেন। এমন উদাহরণও আছে যে পুরো দেশই বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, যদিও, দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় শুধুমাত্র দান করাই উচিত না আমাদের বরং আমরা সতর্কভাবে ভাবব কী সাহায্য এসব দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রদান করছে। কিন্তু এর মানে এই না যে আমরা চেষ্টা করব না সাহায্য করতে। কিছু মৌলিক চিকিৎসা সহায়তা বহু দরিদ্র মানুষকে একটি ভালো সুযোগ দেয় বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়াই স্বনির্ভর হবার জন্যে। এমন বেশকিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান আছে যারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষিত করে স্বনির্ভর হবার জন্য, পরিষ্কার খাবার পানির জন্য কুয়া খনন, স্বাস্থ্যশিক্ষা দান ইত্যাদি নানা কর্মসূচি পরিচালনা করার মাধ্যমে। সিংগারের যুক্তি এমন নয় যে আমাদের উচিত অন্যকে সাহায্য করার জন্যে টাকা দান করা বরং আমাদের সেইসব দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করা উচিত যাদের সম্ভাবনা আছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গতদের উপকার করা, যা তাদের স্বনির্ভর হতে সাহায্য করবে। তার বার্তা খুব স্পষ্ট: যখন কিনা প্রায় সুনিশ্চিতভাবে আপনি অন্য মানুষের জীবনকে সত্যিকারভাবে প্রভাবিত করতে পারবেন এবং আপনার সেটি করা উচিত।

সিংগার সুপরিচিত জীবিত দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম একজন। আংশিকভাবে এর কারণ তিনি বেশকিছু সর্বজনীন ধারণা আর দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে প্রশ্ন করেছিলেন। তার কিছু বিশ্বাস স্পষ্টতই খুবই বিতর্কিত। বহু মানুষ বিশ্বাস করেন মানুষের জীবনের চূড়ান্ত পবিত্রতায়। এর মানে অন্য কোনো মানুষকে হত্যা করা সবসময়ই ভুল। সিংগার সেটি মনে করেন না। যদি কেউ এমন কোনো পরিস্থিতিতে থাকে, যাকে বলা হয় persistent vegetative state বা কোনো অসুখের কারণে যার পরিস্থিতি অপরিবর্তনীয়ভাবে বোধশক্তিহীন, যে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন করা সম্ভব না মানে, সেই মানুষটিকে বাঁচানো হয়েছে শুধুমাত্র শরীর হিসাবে, কোনো ধরনের অর্থময় সচেতনা ছাড়া এবং যার ভবিষ্যতে কোনো সময় নিরাময় হবার সম্ভব নয়, তাহলে সিংগার মনে করেন এই ক্ষেত্রে ইউথানাসিয়া বা তাকে দয়া প্রদর্শন করে মরার সুযোগ দেয়া উচিত, বা মরতে সাহায্য করা উচিত কোনো কষ্টভোগ করা ছাড়াই। এই পরিস্থিতে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থহীন। তিনি বিশ্বাস করতেন, কারণ এই পরিস্থিতিতে তাদের কোনো সুখ অনুভব করার ক্ষমতা নেই, এমনকি তারা কীভাবে বাঁচতে চান সেটাও তারা নির্বাচন করতে পারে না। তাদের বেঁচে থাকার কোনো শক্ত ইচ্ছা নেই, কারণ কোনো ধরনের ইচ্ছা ধারণ করার ক্ষমতা তাদের নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো তাকে বেশ কুখ্যাত করেছে বেশকিছু গোষ্ঠীর কাছে। এমনকি এইসব বিশেষ ক্ষেত্রে ইউথানাসিয়া বা দয়ার সাথে মৃত্যুর বিষয়টি সমর্থনের জন্য তাকে নাৎসি বলেও চিহ্নিত করা হয়েছিল, যদিও সেই বাস্তবতাটি উপেক্ষা করে যে, তাঁর বাবা-মাও ছিলেন ভিয়েনাবাসী ইহুদি, যারা নাৎসিদের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। আর এই নামে তাকে ডাকার কারণ নাৎসিরা বহু অসুস্থ আর শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীকে হত্যা করেছিলে, কারণ তারা দাবি করেছিল এদের জীবনগুলো আসলেই যাপনের উপযুক্ত না, তাদের বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু খুবই ভুল হবে যদি কেউ নাৎসিদের এই হত্যা নীতিকে ইউথানাসিয়া বা দয়ার সাথে মৃত্যু হিসাবে চিহ্নিত করে। আর যাই হোক না কেন এটির উদ্দেশ্য কাউকে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রণাভোগ থেকে মুক্তি দেয়া ছিল না, আর নাৎসিরা মনে করত তাদের সমাজ থেকে বাতিল করা যাবে কারণ তারা অপ্রয়োজনীয়, তাদের ভাষায় useless mouths, যাদের খাওয়াতে হবে কিন্তু তারা কোনো কাজ করতে পারবে না, এবং তারা মনে করত এরা তাদের তথাকথিত শুদ্ধ এরিয়ান বর্ণকে দূষিত করছে। এখানে কোনো দয়া প্রদর্শন নেই। এর ব্যতিক্রম সিংগার আগ্রহী ছিলেন সংশ্লিষ্ট সেই মানুষগুলোর জীবনের গুণগত মান নিয়ে, নাৎসিনীতির কোনো অংশকেই তিনি সমর্থন করতেন না। কিন্তু তার সমালোচকরা তার দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক ততটাই বিকৃত করেছিল যেন একই রকম মনে হয়।

সিংগার প্রথম পরিচিতি পান তার প্রভাবশালী বই Animal Liberation (১৯৭৫) প্রকাশ হবার পর, যেখানে তিনি প্রাণীদের উপর মানুষের আচরণ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জেরেমি বেনথাম প্রস্তাব করেছিলেন, প্রাণীদের কষ্ট আর দুর্দশার লাঘব করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে, কিন্তু সত্তরের দশকে যখন সিংগার প্রথম লিখতে শুরু করেছিলেন এই বিষয়ে, খুব কম দার্শনিকই বিষয়টি এভাবে দেখেছিলেন। সিংগার, বেনথাম আর মিল হচ্ছেন কনসিকোয়েনসালিস্ট। এর মানে তারা বিশ্বাস করেন শ্রেষ্ঠ কাজটি হবে সেটি যা সংশ্লিষ্ট সবার সেরা স্বার্থটি রক্ষা করবে। সেরা কাজটি হবে সেটি যেটি সবচেয়ে সেরা পরিণতির কারণ হয়। আর কোনটি সবচেয়ে ভালো পরিণতি সেটি জানার জন্য, আমাদের জানার দরকার এবং বিবেচনা করতে হবে সবার জন্যে কোটি সবচেয়ে ভালো, যার মধ্যে সব প্রাণীদের কল্যাণও অন্তর্ভুক্ত। বেনথামের মতো, সিংগার বিশ্বাস করতেন যে প্রায় সব প্রাণীদের মূল ও সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যন্ত্রণা বা ব্যথা বা কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা। মানুষ হিসাবে, আমরা মাঝে মাঝে বেশি পরিমাণ কষ্ট পাই, একই পরিস্থিতিতে কোনো প্রাণী যতটুকু পেতে পারে, কারণ আমাদের যুক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা আছে, বোঝার ক্ষমতা আছে আমাদের সাথে কী ঘটছে। এই বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। সিংগার, যারা প্রাণীদের বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ গুরুত্ব দেন না তাদের নাম দিয়েছেন speciesist বা প্রজাতিবাদী, এটি অনেকটি বর্ণবাদী (racist) বা লিঙ্গবাদী (sexist) শব্দগুলো যেভাবে ব্যবহৃত হয় তেমন। বর্ণবাদী তাদের নিজের বর্ণের মানুষদের সাথে ভিন্নভাবে আচরণ করে: তারা তাদের সাথে বিশেষ সুবিধা দিয়ে আচরণ করে। তারা অন্য কোনো বর্ণের মানুষকে সেই সুবিধাটা দিতে চায়না যারা সেটি পাবার যোগ্য। একজন শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী হয়তো, যেমন, কোনো একটি কাজের জন্য অন্য একজন শ্বেতাঙ্গকে নির্বাচন করবে এমনকি যখন তার চেয়েও যোগ্য কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি আছেন, যিনি সেই পদের জন্য আবেদন করেছেন। স্পষ্টতই সেটি ন্যায়বিচার নয় ও ভুল। Speciesism-ও বর্ণবাদের মতো। এটি শুধুমাত্র সৃষ্টি হয় যখন আপনি শুধু আপনার প্রজাতির দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কিছু দেখেন অথবা এর প্রতি আপনি বিশেষভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। মানুষ হিসাবে আমরা শুধুমাত্র ভাবি অন্য মানুষদের কথা যখন সিদ্ধান্ত কী করতে হবে। কিন্তু সেটি ভুল। প্রাণীরা কষ্টভোগ করে এবং তাদের কষ্টকে আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত।

সমান পরিমাণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন মানে না এই যে সব প্রাণী প্রজাতির সাথে ঠিক একইভাবে আচরণ করা উচিত, সেটির কোনো অর্থ হয় না। যদি আপনি কোনো ঘোড়ার পিঠে হাত দিয়ে একটা চড় মারেন, সেটি ঘোড়ার জন্য তেমন কোনো ব্যথার কারণ হবে না। কারণ ঘোড়ার চামড়া বেশ পুরু, কিন্তু আপনি যদি সেই একই চড় মারেন কোনো মানবশিশুকে, সেটি বেশ তীব্র ব্যথার কারণ হবে। কিন্তু আপনি যদি যথেষ্ট তীব্রতার সাথে কোনো ঘোড়াকে আঘাত করেন, কোনো শিশুকে সেই চড় মারলে যেমন ব্যথা হতে পারত সেই পরিমাণ ব্যথা সৃষ্টি করার জন্য, তাহলে সেটি কোনো শিশুকে চড় মারার মতোই নৈতিকভাবে ভুল কাজ। অবশ্যই, দুটো কাজের কোনোটাই করা আপনার উচিত নয়। সিংগারের প্রস্তাবনা, আমাদের সবারই নিরামিষাশী হওয়া উচিত, শুধুমাত্র এই কারণে যে আমরা কোনো প্রাণী না-খেয়েই খুব সহজেই ভালোভাবে বাঁচতে পারি। প্রাণী থেকে উৎপাদিত হওয়া যে-কোনো খাদ্যের পেছনে যন্ত্রণাভোগ আর নিষ্ঠুর খামার পদ্ধতি, আর তীব্রভাবে প্রাণীরাও সেই যন্ত্রণাটি অনুভব করে। কোনো খামারে চাষ করা মুরগিদের যেমন রাখা হয় খুবই ক্ষুদ্রসংকীর্ণ খাঁচায়, কিছু শূকরকে এমনভাবে আটকে রাখা হয় যে তারা এমনকি পাশ ফিরতেও পারে না, আর গবাদি পশুদের জবাই করার পদ্ধতি খুবই যন্ত্রণাময় তাদের জন্যে। সিংগার যুক্তি দিয়েছিলেন, অবশ্যই এটি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এমন খামারব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখা। কিন্তু এমনকি আরো মানবিক খামারপদ্ধতিও অপ্রয়োজনীয়, কারণ আমরা মাংস ছাড়া বেশ ভালোভাবে বাঁচতে পারি। আর তার মূলনীতির সাথে বিশ্বস্ততা প্ৰদৰ্শন করে তিনি এমনকি তার একটি বইয়ে ডাল বানানোর রেসিপি প্রকাশ করেছিলেন তার পাঠকদের মাংসের বিকল্প আমিষ খোঁজার জন্য অনুপ্রাণিত করার জন্য।

খামারে চাষ করা প্রাণীরাই শুধুমাত্র মানুষের দ্বারা নির্যাতিত হয় না, বিজ্ঞানীরাও প্রাণীদের ব্যবহার করেন তাদের গবেষণায়। শুধুমাত্র ইঁদুর কিংবা গিনিপিগ নয়, বিড়াল, কুকুর, বানর এবং শিম্পাঞ্জিদেরও আমরা পরীক্ষাগারে দেখি, তাদের অনেককেই নানা ধরনের যন্ত্রণা আর নির্যাতনের শিকার হতে হয়, যখন তাদের শরীরে নানা ঔষধ কিংবা বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। কোনো একটি গবেষণা নৈতিকভাবে আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য কিনা সেটি পরীক্ষা করার জন্য তাঁর সিংগার টেস্টটি প্রস্তাব করেছিলেন: আমরা কি সেই একই পরীক্ষাটি কোনো মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এমন কারো উপরে করতে পারব? যদি সেটি না পারি, তিনি বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই ধরনের মানসিক সচেতনা আছে এমন কোনো প্রাণীর উপর সেই পরীক্ষাটি করা অনৈতিক। তার এই পরীক্ষাটি খুবই কঠিন, এবং খুব বেশি পরীক্ষা এই টেস্টটি পাস করতে পারবে না। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে, সিংগার প্রাণীদের গবেষণায় ব্যবহার করার বিষয়টি বিরোধিতা করেন। নৈতিকতার প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধানে সিংগারের সার্বিক পদ্ধতির ভিত্তি হচ্ছে কনসিসটেন্সি বা সঙ্গতি বা পূর্বাপর মিলের ধারণা।এর মানে হচ্ছে একই ধরনের বিষয়গুলোকে একইভাবে আমাদের দেখতে হবে। তার কাছে বিষয়টি যুক্তির যে, যদি মানুষের ক্ষতি করা ভুল হয় যদি সেটি যন্ত্রণা বা ব্যথার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে অন্য প্রাণীদের যন্ত্রণা ভোগ করার বিষয়টিরও আমরা তাদের সাথে কীভাবে আচরণ করব সেটিকে প্রভাবিত করা উচিত। যদি কোনো প্রাণীর ক্ষতি করলে কোনো মানুষের ক্ষতি যতটা যন্ত্রণার সৃষ্টি করে তারচেয়ে বেশি যন্ত্রণার কারণ হয়, তাহলে যদি বাধ্য করা হয় তবে উত্তম হবে প্রাণী ও মানুষের মধ্যে যন্ত্রণা দেবার জন্য মানুষকেই বেছে নেয়া।

বহু বছর আগের সক্রেটিসের মতো, সিংগার ঝুঁকি নিতে ভয় পাননি যখন আমাদের কীভাবে জীবন কাটানো উচিত সেই বিষয়ে জনসমক্ষে কোনো বক্তব্য দিয়েছেন। তার কিছু বক্তৃতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে, তাকে হত্যা করার হুমকিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাসত্ত্বেও তিনি দর্শনের সেরা ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিছু ব্যাপকভাবে ধারণকৃত ধারণাকে নিরন্তরভাবেই তিনি চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছেন। তার দর্শন প্রভাবিত করেছে তার জীবনাচরণকে, এবং যখন তিনি অন্যদের সাথে একমত নন, সবসময়ই তিনি প্রস্তুত তার চারপাশে সবার মতামতকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য, একটি উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেবার জন্যে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, সিংগার তার উপসংহারগুলোকে সমর্থন করেছেন তার যুক্তিনির্ভর প্রস্তাবনাগুলো দিয়ে যা গভীর ও ব্যাপক গবেষণা ও বাস্তব সত্য দ্বারা তথ্যপুষ্ট। তার উপসংহারগুলোর সাথে আপনার একমত হবে না দার্শনিক হিসাবে তার আন্তরিকতাটি অনুভব করার জন্য। দর্শন, আর যাই হোক না কেন, সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী হয় বিতর্কের মাধ্যমে, যুক্তি আর সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যবহারে। সিংগারের কোনো দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যদি আপনি ভিন্নমত পোষণ করেন, যেমন, প্রাণীদের নৈতিক অবস্থান অথবা কোনো পরিস্থিতিতে ইউথানাসিয়া বা দয়াপূর্ণ যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর অধিকার নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, খুব ভালো সম্ভাবনা আছে তার বই পড়ার পর বিষয়গুলো আপনাকে খুব কঠিনভাবে ভাবাবে, আপনি আসলেই কী বিশ্বাস করেন এবং কীভাবে সেগুলোকে সমর্থন করছেন বাস্তব তথ্য, যুক্তি আর নৈতিক মূলনীতিগুলো।

দর্শনের সূচনা হয়েছিল বিব্রতকর প্রশ্ন আর কঠিন চ্যালেঞ্জের সাথে: সক্রেটিস যেমন গোমাছি হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন, দার্শনিক পিটার সিংগারের মতো আজকের সময়ের গোমাছি যখন আছেন, খুবই ভালো সম্ভাবনা আছে যে সক্রেটিসের সেই চেতনাও অব্যাহত থাকবে ভবিষ্যতের রূপ দেবার জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *