অধ্যায় ৪ : দার্শনিকদের থেকে সাবধান – ডায়োজেনিস ও প্রাচীন সিনিক দর্শন
[প্রাচীন সিনিক দর্শন : আমি ‘সিনিক’ শব্দটি অনুবাদ করছি না, কারণ ‘হতাশাবাদ’ শব্দটি সিনিক দার্শনিকদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না।]
১৯৬৭ সালে ডিজনির অ্যানিমেটেড ফিল্ম ‘দ্য জাঙ্গল বুক’-এর একটি চরিত্র, ভালুক ‘বালু’ গানে গানে একটি দার্শনিক ম্যানিফেস্টো ঘোষণা করেছিল, শুধুমাত্র অবশ্য প্রয়োজনীয় কিছুর উপর সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বালু দর্শকদের সব চিন্তা আর কষ্ট ভুলে যেতে বলেছিল। বালু তাদের শুধুমাত্র অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে জীবন কাটাতে বলেছিল, কারণ সে সবাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, প্রকৃতি মায়ের রেসিপিগুলোই জীবনের অবশ্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকে বের করে আনে। অবশ্যই বালু কোনো দর্শন পড়েনি, তার জীবনের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে আমরা যেমন দেখি, আর যদি সে দর্শন পড়ত তাহলে অবশ্যই সে তার দর্শনের সাথে মিল পেত ডায়োজেনিস অব সিনোপের দর্শনের। ডায়োজেনিস ভালুক ছিলেন না যদিও, তিনি ছিলেন কুকুর ( হ্যাঁ, তাকে সে নামে ডাকা হতো)।
কুকুরের গ্রিক শব্দ kuon, আর ডায়োজেনিস ও তাঁর সেই দর্শনের অনুসারী দার্শনিকদের বলা হতো, সিনিকস বা Cynics; আর নামটি এসেছে এই প্রাণীটির সম্মানে। মনে রাখা দরকার যে প্রাচীন গ্রিসে কুকুর তেমন পছন্দের কোনো প্রাণী ছিল না। অবশ্য তাদের এই নামে ডাকার আরেকটি কারণ মনে করা হয় প্ৰথম সিনিক দার্শনিক অ্যান্টিসথেনিস এথেন্সে যে জিমনেশিয়ামে পড়াতেন, তার নাম ছিল Kznosarges, যে নামটির অর্থ : place of the white dog; এছাড়াও নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, প্রথম সিনিকদের অপমানসূচক অর্থে কুকুর বলা হতো, কারণ তারা তাদের মতো নির্লজ্জভাবেই সামাজিক সব রীতিনীতি অস্বীকার এবং রাস্তায় বসবাস করতেন বলে। বিশেষ করে ডায়োজেনিসকে কুকুর হিসাবে সম্বোধন করা হয়েছে প্রায়শই। তিনি অবশ্যই এমন খেতাব পছন্দ করতেন, তিনি বলতেন : ‘অন্য কুকুররা তাদের শত্রুদের কামড়ায় আর আমি আমার বন্ধুদের কামড়াই, তবে তাদের সুরক্ষা করতে।’ যাই হোক, ডায়োজেনিস কারো প্রশংসার জন্য কখনোই চিন্তিত ছিলেন না। তিনি রাস্তার কুকুরের মতো জীবনযাপন করতেন, ভিক্ষা করে খাবার সংগ্রহ করতেন এবং যদি মনে করতেন কারো দরকার আছে, আসলেই তাকে লক্ষ্য করে চিৎকার করতেন, হয়তো উপদেশ দিতেন।
ডায়োজেনিস ও অন্য সিনিক চিন্তাবিদরা এমন একটি শিক্ষা দেবার চেষ্টা করেছিলেন, যার সাথে আমরা ভালুক বালুর সেই গানের মিল পাব। সিনিকরাও ভাবতেন শুধুমাত্র অবশ্য প্রয়োজনীয় কিছু নিয়ে প্রকৃতির নিয়ম মেনেই আমাদের বাঁচা উচিত। তাদের ক্ষেত্রে এটি ছিল, এমনকি জঙ্গলে গাছ থেকেও কোনো ফল না-পেড়ে বরং সামান্য পরিমাণ ডাল খেয়ে বাঁচা; একটি লাঠি বা চামড়ার থলে ছাড়া যাদের আর কোনো সম্পদ ছিল না, এবং তারা থাকতেন কোনো-না-কোনো ভাবে গড়ে নেওয়া আশ্রয়ে। যেমন ডায়োজেনিস থাকতেন একটা বিশাল আকারের মাটির কলসে। কোনো চিন্তা আর সমস্যা ছাড়া বাঁচা শেখাতে সবকিছু থেকে বিচ্যুত জীবনাচরণের উপদেশ দিয়েছিলেন তারা। গ্রিক দর্শনের কিছু চিন্ত াধারার মতো তাদেরও সর্ব্বোচ্চ উদ্দেশ্য ছিল সবধরনের ataraxia আর apatheia: গ্রিক ভাষায় অ্যাটারাক্সিয়া শব্দটির মানে সব উদ্বেগ আর চিন্তা থেকে চলমান অব্যাহত মুক্তি, একটি শক্তিশালী স্থিরতা, আর অ্যাপেথিয়া হচ্ছে মনের সেই অবস্থা যা কোনো প্যাশন বা তীব্রতম আবেগ বিচলিত করতে পারেনা, তবে এটি নির্বিকার কোনো পরিস্থিতি বলা যাবে না, বরং মনমেজাজে বিরাজমান প্রশান্তি।
কোনো সমস্যা এড়ানোর জন্যে সিনিকদের বৈপ্লবিক উপায়গুলো অনেককেই ভাবতে বাধ্য করেছে সিনিকদের নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে, যেন তারা নিজেরাই মনে হয় আক্রান্ত নানা অস্থিরতায়। ধারণা করা হয়, প্লেটোই ডায়োজেনিসকে বলেছিলেন, ‘পাগল হয়ে যাওয়া এক সক্রেটিস’। তিনি সেই সময়ের পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যদিও প্লেটোর সময়ে না হয়ে থাকেন তবে অবশ্যই অ্যারিস্টোটলের সময়। অ্যারিস্টোটলও তার কথা বলেছিলেন ও এমনকি তাঁকে ডেকেছিলেন ‘কুকুর’ নামে। কিন্তু সিনিকদের অ্যারিস্টোটল-পরবর্তী কোনো আন্দোলন হিসাবে ভাবা যাবে না, বরং বলা যেতে পারে সক্রেটিস-পরবর্তী একটি আন্দোলন। এমনকি ডায়োজেনিস-এর আগেও সিনিক ছিলেন অ্যান্টিসথেনিস তিনি তার পেশা শুরু করেছিলেন বিখ্যাত সোফিস্ট গর্গিয়াসের সাথে। কিন্তু সক্রেটিসের সাথে তার দেখা হবার পর তিনি বক্তৃতা ছেড়ে, নিজের লেখা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। জেনেফোন এবং ডায়োজেনিস লেইয়ারশিয়াস তাকে একধরনের চরমপন্থী সক্রেটিসবাদী হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন (ডায়োজেনিস লেইয়ারশিয়াস Lives of the Philosophers নামে দার্শনিকদের জীবনী সংকলন লিখেছিলেন, তিনি ডায়োজেনিস দ্য সিনিক নন)।
অ্যান্টিসথেনিস শুধুমাত্র সক্রেটিসপন্থী ছিলেন না, তিনি ছিলেন আদি বা প্রোটো-সিনিক। তিনি তাঁর দরিদ্রতাকে সম্মানসূচক একটি চিহ্ন হিসাবে ধারণ করতেন, দাবি করতেন এটাই সত্যিকারের সম্পদ। তিনি বলেছিলেন, ‘আনন্দ অনুভব করার চেয়ে বরং পাগল হয়ে যাওয়া ভালো’। সম্পদ আর আনন্দের এই অস্বীকার সিনিসিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অ্যান্টিসথেনিসই সমাজের সব ভণ্ডামি আর অহংকারগুলোকে ঠাট্টা করার সিনিকবাদী আচরণটির অগ্রদূত। এথেন্সবাসীদের গর্ব যে, তারা মাটি থেকে জন্ম নেওয়া মানুষের বংশধর, এমন অহংকারকে শ্লেষ করে তিনি বলতেন, ‘পোকামাকড় আর শামুকের জন্য এটা প্রযোজ্য।’ তিনি আরো প্রস্তাব করেছিলেন যে, তাদের একটি গণতান্ত্রিক সম্মেলন করা উচিত এবং গাধাদের ঘোড়া হিসাবে ঘোষণা দিয়ে একটি আইন পাস করা উচিত, আর যাই হোক, তারা তো ভয় পায় না বোকাদের বুদ্ধিমান ভেবে সেনানায়ক হিসাবে ঘোষণা করতে’।
ডায়োজেনিস লেইয়ারশিয়াসের মতে, তিনি সেই পরিচিত সিনিক-সজ্জায় ঘুরে বেড়াতেন, হাতে লাঠি আর ছোট একটি ব্যাগ নিয়ে, পাতলা কাপড় ছাড়া যাদের পরনে কিছুই থাকত না, শীতের সময় যা তারা আরেক ভাঁজ করে নিতেন, এছাড়া দাড়ি-গোঁফ তো ছিলই, যা কখনোই কাটতেন না। কিন্তু ডায়োজেনিস দ্য সিনিকের নানা গল্প আর বিস্তারিত বিবরণ কতটা পূর্বদৃষ্টিতে প্রযোজ্য ছিল অ্যান্টিসথেনিসের ক্ষেত্রে সেটা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে। কিন্তু ডায়োজেনিস দ্য সিনিকের গল্পও এসেছে একই জায়গা থেকে, হতে পারে বিশাল একটি অংশই হয়তো কাল্পনিক। অ্যান্টিসথেনিসের যতটুকুই ভূমিকা থাকুক না কেন এই দর্শনের আন্দোলনটি শুরু করার জন্য বা সিনিক নামটি দেবার জন্য, ডায়োজেনিস অব সিনোপে মূলত সিনিসিজমের প্রতিভূ হয়ে আছে প্রাচীন সেই স্বপ্নে। তাঁকে নিয়ে নানা ঘটনা মাত্র কয়েক হাজার শব্দে সীমাবদ্ধ করা কারো পক্ষে সম্ভব না। শুধুমাত্র সেই ঘটনাগুলো বর্ণনা করা যেতে পারে যে-ঘটনাগুলোর দার্শনিক অর্থ আমরা আলোচনা করতে পারি। তাঁর সম্বন্ধে সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনাটি দিয়ে শুরু করতে পারি আমরা, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ডায়োজেনিস সম্বন্ধে শুনেছিলেন তার শিক্ষক অ্যারিস্টোটলের কাছে এবং তাঁকে খুঁজে বের করেছিলেন দেখা করার জন্য। এই দার্শনিককে তিনি দেখেছিলেন একটি মদ রাখার মাটির বড় পাত্রের সামনে বসে রোদ পোহাচ্ছেন, এই মাটির বড় পাত্রটিকে তখন তিনি ঘর হিসাবে ব্যবহার করতেন। তাঁর সামনে এসে আলেকজান্ডার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার জন্য আমি কী করতে পারি? ডায়োজেনিস উত্তরে তাঁকে তাঁর সামনে থেকে সরে দাঁড়াতে বলেছিলেন, আলেকজান্ডার যেন তাঁর সূর্যের আলো উপভোগ করতে কোনো দিক থেকে বাধা সৃষ্টি না করেন। আরেকটি গল্প অনুযায়ী আলেকজান্ডার নাকি বলেছিলেন, যদি তিনি আলেকজান্ডার না হতেন তাহলে ডায়োজেনিস হতেন। যৌথভাবে এই দুটি কিংবদন্তীর কাহিনী ডায়োজেনিস সম্বন্ধে আমাদের মনে একটা সুস্পষ্ট একটি ধারণা দেয়। তিনি দরিদ্র এবং তাঁর কিছু ছিল না, কিন্তু তারপরও তিনি পুরোপুরিভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলেন। প্রাচীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজার ও তাঁকে দেবার মতো কিছু নেই, কারণ প্রকৃতি, এই ক্ষেত্রে সূর্যের আলো ছাড়া, আর কিছুর দরকার নেই তার। তাঁর প্রজ্ঞা মূলত সেটাই, এমন কিছু কামনা না-করা যা কারোর দরকার নেই। ডায়োজেনিসের প্রতি আলেকজান্ডারের এই তথাকথিত মুগ্ধতাও একই সাথে অনেক কিছু বলছে। এমনকি বিত্তবান, শক্তিশালী মানুষরাও সিনিকদের প্রশংসা করতে পারে, কারণ তারা একধরনের স্বাধীনতা উপভোগ করে, আত্মনিয়ন্ত্রণ, যা অর্জন করতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, যদি আদৌ সেটি কেউ করতে পারে।
একজন বিখ্যাত স্টয়িক বা বৈরাগ্যবাদী দার্শনিক মন্তব্য করেছিলেন, ‘সিনিসিজম হচ্ছে ভার্চু বা সদ্গুণ অর্জন করার সংক্ষিপ্ততম উপায়।’ সে-কারণেই ডায়োজেনিস ও তাঁর অনুসারীদের আবেদন চিরন্তন। এমনকি সেটি পৌছেছিল ফ্রিয়েডরিখ নিচাহ অবধি, যিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘সিনিসিজম হচ্ছে একটি মাত্র রূপ, যেখানে নিম্নমানের কোনো আত্মা সততার নিকটে পৌঁছাতে পারে।’ প্রাচীনকালেই ডায়োজেনিস বাস্তবের চেয়ে আরো বেশি কাহিনি হয়ে উঠেছিলেন। সিনিক সাহিত্যের একটি বিশাল ক্ষেত্র গড়ে উঠেছিল, যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন তিনি। এমনকি মধ্যযুগীয় আরব-সাহিত্যে মাটির পাত্রে বাস করা এই অদ্ভুত দার্শনিকের কথা এসেছে, যদিও একটি ঐতিহাসিক সংশয়ের কারণে তাঁকে সেখানে মনে করা হয়েছে সক্রেটিস। ডায়োজেনিসের জীবনী সম্বন্ধে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে তিনি অবশ্যই সিনোপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কৃষ্ণ সাগরের তীরের এই শহরটি বর্তমানে তুরস্কের অংশ। তাঁর বাবা শহরের মুদ্রা তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। কোনো অদ্ভুত কারণে তাঁর বাবা মুদ্রার উপরের খোদাই কাজ নষ্ট করতেন। আরেকটি গল্পে এই দোষটি দেয়া হয়েছে ডায়োজেনিসকে। সিনিক আন্দোলনে এটি প্রতীকীরূপ পেয়েছে ‘মুদ্রা নষ্ট করা’। এর মানে সামাজিক প্রথাকে আক্রমণ করা। এখানে একটি তথ্য দেয়া যেতে পারে যে, মুদ্রা বা কয়েন- এর গ্রিক শব্দ nomisma, প্রথার জন্য ব্যবহৃত শব্দ nomos এর মতোই শুনতে এবং প্রত্নতত্ত্ববিদরা আসলেই সিনোপে এমন মুদ্রা খুঁজে পেয়েছেন যেখানে মুদ্রার উপর খোদাই-কাজ নষ্ট-করা, এদের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব মধ্য চতুর্থ শতাব্দী।
যাই হোক না কেন, ডায়োজেনিস তাঁর জন্মশহর থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, তিনি অবশ্য সেকারণে কোনো অনুশোচনা করেননি। বলেছেন, নির্বাসনই আমাকে দার্শনিক বানিয়েছে।’ আরেকটি বেশ কল্পনাপ্রবণ কাহিনী বলছে, দেশ ছেড়ে পালাবার সময় তাঁকে দাস হিসাবে বিক্রি করার জন্য নিলামে তোলা হয়েছিল, তিনি তার বিক্রেতাকে কে বলেছিলেন, “তাকে এমন কারো কাছে বিক্রি করতে, যার মনিব দরকার।’ তবে ডায়োজেনিসের ভৌগোলিক অবস্থানগুলো চিহ্নিত করা কঠিন, মনে করা হয় আলেকজান্ডারের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি ঘটেছিল করিন্থে। অন্যরা এই ঘটনায় তাঁকে রেখেছেন এথেন্সে; যেখানে তিনি সক্রেটিস যেমন করে থাকতেন সেভাবে থাকার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন, যেমন অ্যান্টিসথেনিসও করেছিলেন। যেমনটা ভাবা সম্ভব, প্রাচীন তথ্যসূত্রগুলো তাকে অ্যান্টিসথেনিসের ছাত্র হিসাবে উল্লেখ করেছে, কারণ প্রতিটি বিখ্যাত দার্শনিক আরেকজন বিখ্যাত দার্শনিকের ছাত্র হবে এমনভাবে ভাবার একটি প্রবণতা ছিল সেই সময়। তবে তিনি যেখানে ছিলেন সেখানেই তিনি অনন্য ছিলেন। তিনি তাঁর নিজের আইনে চলেছেন। তিনি যেভাবে পছন্দ করেন, সেভাবেই আচরণ, কথাবলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাকস্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা মানুষের সবচেয়ে সেরা সম্পদ, এবং তিনি এই স্বাধীনতা ব্যবহার করেছিলেন গ্রিকদের বিরুদ্ধে, তাদের ভণ্ডামিগুলোকে তিরস্কার করতে। একটি বিখ্যাত গল্পে আমরা তাঁকে বাজারে লণ্ঠন হাতে আবির্ভূত হতে দেখি। কী করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘তিনি আসলে মানুষ খুঁজছেন’, যেন এই কথায় শহরের লোকদের যথেষ্ট অপমানিত করা হয়নি। তিনি আরো যোগ করেন, ‘গ্রিসের কোথায় সৎ আর ভালো মানুষ খুঁজে পাবেন, কেউ কি বলতে পারবেন’?
কিন্তু স্বদেশি গ্রিকরা তার এত ঘৃণার কারণ কেন হয়েছিল? একটি উত্তর হচ্ছে তারা আসলে দরিদ্রতাকে গ্রহণ করে নেয়নি, সেইসাথে এর সঙ্গে অদ্ভুতভাবে যুক্ত থাকা স্বাধীনতা আর স্বনির্ভরতাকেও তারা অর্জন করতে পারেনি। যদি নির্বাসন তাঁকে একজন দার্শনিক বানিয়ে থাকে, এর কারণ নির্বাসন তাঁকে একটি অমূল্য উপহার দিয়েছে, তাঁর দারিদ্র্য। ডায়োজেনিস লেইয়ারশিয়াস থিওফ্রাসটাসকে উদ্ধৃত করে বলেন যে, “ইঁদুর যেমন কোনোকিছু ছাড়াই তাদের জীবন গড়ে নেয়, সিনিকরা তেমনি একটি জীবন মেনে নেয়।’ এমন একটি গল্পে আমরা তাঁকে দেখি লাঠি, থলে আর খাবার জন্যে একটি পেয়ালা ছাড়া কিছু তার নেই, আর যখন তিনি একটি শিশুকে দুই হাত দিয়ে পানি খেতে দেখেছিলেন, তিনি তার পানি পান করার পেয়ালাটাও ফেলে দিয়েছিলেন। ডায়োজিনিস তাঁর এই কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের উপরও আরোপ করেছিলেন, নিজের উপরে যেমন করেছিলেন। একবার তিনি এক ধনীব্যক্তির বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন, তিনি সেই বিলাসবহুল বাসার নানা জায়গা ঘুরে মালিকের মুখের উপর থুতু ছুড়ে মারেন। তিনি হতভম্ব হয়ে যাওয়া সেই মালিককে ব্যাখ্যা করেন যে, তার বাসার সবকিছু এত সুন্দর যে, তিনি কোথাও থুতু ফেলতে পারছিলেন না। তাকে নিয়ে আরো অনেক গল্প আছে, যেমন তিনি টাকাপয়সা সহ্য করতে পারতেন না, তিনি বলতেন, ‘সোনার রং হলুদ কারণ এটি ভয় পেয়েছে এত মানুষের লালসার কারণ হবার জন্যে।’ তিনি অর্থলালসাকে সব অশুভ কাজের জননী হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন (একই রকম বাক্য আমরা পরে গসপেল বা যিশুর জীবনকাহিনিতেও পাই); অ্যান্টিসথেনিসের মতোই তিনি তাঁকে তাঁর দরিদ্রতায় সমৃদ্ধ মনে করতেন।
সবকিছুই কিন্তু একটি প্রশ্নের জন্ম দেয়, কেন অ্যান্টিসথেনিস আর ডায়োজেনিস, তবে না-খেতে পেয়ে মারা যাননি কেন? ধনীব্যক্তিদের অপমান করা ঠিক আছে, কিন্তু খাদ্যঘাটতির সম্ভাবনা তার চেয়েও অনেক বেশি। তাহলে তারা কীভাবে বেঁচে ছিলেন। অন্ততপক্ষে ডায়োজেনিসের ক্ষেত্রে এর উত্তর হচ্ছে, ভিক্ষা করে। বিষয়টি খানিকটা ভণ্ডামি মনে হতে পারে, যখন কিনা সিনিকরা তাদের স্বনির্ভরতার দাবি করছে। কিন্তু ডায়োজেনিস অন্য মানুষের সম্পদের উপর তাঁর দাবি সমর্থন করতেন এমন একটি শ্লেষাত্মক সিলোজিজমের বাক্যচাতুরী ব্যবহার করে, ‘সবকিছুর উপর দেবতাদের অধিকার আছে, আর বিজ্ঞব্যক্তিরা দেবতাদের বন্ধু, বন্ধুরা সবকিছু নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করেন, সুতরাং সবকিছুই বিজ্ঞব্যক্তিদের।’ ভিক্ষুক হিসাবে তাঁর জীবন অবশ্যই আরো কিছু কাহিনির জন্ম দিয়েছে। যেমন এক ব্যক্তি যখন তাকে ভিক্ষা দেবার জন্য সময় নিচ্ছিলেন, তিনি বলেন, ‘আমি শুধু ভিক্ষা চাইছি, আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য খরচ চাইছি না।’ মাঝে মাঝে কোনো মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে ভিক্ষা করতে দেখা যেত, মানুষ প্রশ্ন করলে বলতেন, আসলে তিনি অনুশীলন করছেন, ভিক্ষা দিতে কেউ অস্বীকার করলে, সেই প্রত্যাখ্যান কীভাবে সামাল দিতে হয়। আর প্রাচীন গ্রিসে এইসব মূর্তি মূলত ছিল ধর্মীয় প্রকৃতির, যা আমাদের সিনিকদের সামাজিক প্রথাবিরোধী আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে আসে। ধর্মের চেয়ে আর কিছুই গ্রিকসমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আর সিনিকরা জেনোফেনেস আর প্লেটোর পথ অনুসরণ করেছিলেন জনপ্রিয় ধর্মবিশ্বাসকে সমালোচনা করার মাধ্যমে।
অ্যান্টিসথেনিসের সাথে একবার এক যাজকের সাক্ষাৎ হয়েছিল, যিনি দাবি করেছিলেন যে, তার মতো ধর্মবিশ্বাসীরা মৃত্যুর পর বিশেষভাবে পুরস্কৃত হবেন। উত্তরে তিক্তভাবে তিনি জানতে চাইছিলেন, ‘বেশ তাহলে তুমি এখনই মরছ না কেন?’ ডায়োজেনিস একবার এক চোরকে মারধোর করতে দেখেছিলেন মন্দিরের প্রহরীদের, বলেছিলেন, ‘দেখো বড় চোররা ছোট চোরদের ধরছে।’ কিংবা একবার এক মন্দিরে সমুদ্রেঝড়ে বেঁচে যাওয়া নাবিকদের দেবতার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ নিবেদন করা উপহার দেখে তিনি বলেন, ‘যারা বাঁচেনি তারা যদি নিবেদন করত, পরিমাণ আরো বেশি হতো।’ কিন্তু তার মানে আবশ্যিকভাবে সিনিকরা নাস্তিক ছিলেন না। তাঁর বক্তব্যে বোঝা যায় যে তিনি নাস্তিক ছিলেন না। সিনিকরা স্বর্গীয় সত্তার ধারণাটিকে পরিত্যাগ করেননি ঠিকই, তবে এর সম্বন্ধে মিথ্যা ধারণাগুলো তারা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ঠিক যেভাবে সম্পদ আর স্বাধীনতা-সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণা তারা বাতিল করেছিলেন, কিন্তু সত্যিকারের সম্পদ আর সত্যিকারের স্বাধীনতা তারা কখনো পরিত্যাগ করেনি।
সিনিকরা বেশ বৈপ্লবিক উপায়ে তাদের ধারণাগুলো প্রচার করতেন, কিন্তু তাদের ধারণাগুলো কি আসলেই বৈপ্লবিক ছিল? বহু দার্শনিকই কিন্তু অবাক হবেন না শুনে যে, সম্পদ হচ্ছে মূল্যহীন, এমনকি অ্যারিস্টোটল সম্পদকে জায়গা দিয়েছিলেন ভালো জীবনে, শুধুমাত্র সদ্গুণের উপকরণ হিসাবে। আর সক্রেটিস তো এমন জীবনই কাটিয়েছিলেন। এছাড়া বহু দার্শনিক নিজেদের সাধারণ প্রথাগত ধর্মীয় আচার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। সিনিকরা বেশি বৈপ্লবিক যদিও আনন্দের ব্যাপারে। যদিও প্লেটো কিংবা অ্যারিস্টোটল ভোগবাদী ছিলেন না, কিন্তু পুরোপুরি তারা সেটি বাদও দেননি। কারণ যে দর্শন দাবি করে আমরা সব আনন্দ বিসর্জন দেব, তা অনুসরণ করা বেশ কঠিন। সিনিকরা এর বিরোধী ছিলেন, যেমন ডায়োজেনিস নিজেই বলেছিলেন, ‘আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার কাজটাই তো আনন্দের।’ খুব প্রচলিত একটি সিনিক-প্যারাডক্স এটি, আপনি হয়তো ভাববেন, কিন্তু তিনি সেটি অনুসরণ করতেন। সাধারণ খাবারের মধ্যে একবার মিষ্টি কিছু খুঁজে পেয়ে তিনি সেটি ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘এই অত্যাচারীর কাছ থেকে দূরে থাকো।’ আর অ্যান্টিসথেনিসকে আমরা দেখেছি বলতে, ‘পাগলামিও আনন্দের চেয়ে ভালো।’ আনন্দের বদলে সিনিকরা পরিশ্রম আর সংগ্রামের জীবনকে উৎসাহিত করতেন, গ্রিকরা যাকে বলত, ponos, তবে এর মানে কিন্তু শারীরিক পরিশ্রমের কাজ নয়। ডায়োজিনিস তো ভিক্ষা করে বাঁচতেন, কোনো কাজ করতেন না। এর মানে হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে ইচ্ছা করেই কঠোর জীবন বেছে নেয়া। যেমন একটিমাত্র চাদর আর খালিপায়ে হাঁটা এমনকি শীতের সময়। তাহলে কি সিনিকরা আমাদের বলছেন, আনন্দ শুধু ভালো থেকে আলাদাই নয়, আসলেই খারাপ কিছু? এটি ভোগবাদবিরোধী দার্শনিকদের চেয়েও বেশি দূর হয়ে যাবে, যারা মনে করতেন আনন্দ নিজেই ভালো বা মন্দ কিছু না, তাহলে আমরা তাদের সাথে মিল পাব এমনকি প্লেটোর, যিনি ভালো একটি জীবন থেকে আনন্দকে বাদ দিয়েছিলেন।
সিনিকদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে হলে তারা কী বর্জন করছেন শুধু সেটি দেখলে হবে না। তারা সামাজিক নিয়মকানুনকে উপেক্ষা করেছেন, তারা কোনো আনন্দ অনুসন্ধান করা থেকে বিরত থেকেছেন, তারা এমনকি নিজেদের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কোনো মাথা ঘামাতেন না এমন সন্দেহ করা যেতে পারে। তবে এই সবকিছুই একটি ইতিবাচক ধারণার খাতিরে, সেটি হচ্ছে জীবনে আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান, যা একটি মাত্র শব্দে প্রকাশ করা যাবে : প্রকৃতি। এখানে আমরা সিনিকদের সাথে অ্যারিস্টোটলের একটি কৌতূহলোদ্দীপক তুলনা করতে পারি। অ্যারিস্টোটলও মনে করতেন যে মানুষের জন্য ভালো একটি জীবন নির্ধারণ করে প্রকৃতি। কিন্তু তিনি মনে করতেন যে আমরা আমাদের প্রকৃতিকে ত্রুটিহীন করতে পারি শুধুমাত্র অসাধারণ প্রচেষ্টায় আমাদের ক্ষমতার সম্পূর্ণ ব্যবহার করে। সিনিকদের মতামত ছিল ভিন্ন। তারা সমাজকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ মনে করতেন এবং তারা এমনভাবে আচরণ করতেন যেন সেই সামাজিক প্রথাকে অপমান করা যায়। তাদের কাছে সদ্গুণ হচ্ছে প্রাকৃতিক কোনো অস্তিত্ব যেমন, কুকুরদের কাটানো জীবন যেমন। সম্পদ এবং এমনকি যথেষ্ট পরিমাণ কাপড়ও এই প্রাকৃতিক জীবনের পরিপন্থী হতে পারে। আমরা যেমন সেই কাহিনি শুনেছি, ডায়োজেনিস নাকি একবার তাঁর নিজের ভিতরের কুকুরটাকে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন কাঁচা মাংস খেয়ে দেখে। সিনিকদের জীবনাচরণের অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য এটি ব্যাখ্যা করে; যদিও তারা আনন্দকে বর্জন করেছেন কিন্তু তারা প্রাকৃতিক তাড়নাকে পূরণ করতেন যখন ও যেখানে তারা সেটি করার জন্য ভাবতেন। যেমন একবার ডায়োজেনিসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন তিনি বাজারের মধ্যে বসে খাচ্ছেন, তিনি বলেছিলেন, ‘কারণ আমার এখানেই ক্ষুধা পেয়েছে।’ কুখ্যাতভাবে তিনি নিজে বাজারের মধ্যে হস্তমৈথুন করেছিলেন, কিন্তু যখনই তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে এর কারণ, তিনি তার অমর একটি বাণী উপহার দিয়েছেন, ‘হায়, যদি শুধু আমার পেটের উপর হাত বুলিয়ে ক্ষুধা দূর করতে পারতাম আমি।’ অথবা আলেকজান্ডারের সাথে তার সেই বিখ্যাত সাক্ষাৎটির কথা ভাবুন। ডায়োজেনিস কিন্তু সেই মাটির পাত্রের উপর মাথা ঠুকে নিজের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছিলেন না, তিনি রোদ পোহাচ্ছিলেন। মূলত এসব প্রমাণ করে সিনিকরা এভাবে আনন্দবিরোধী ছিলেন না, তারা শুধু সেই আনন্দবিরোধী ছিলেন যা প্ৰকৃতি দেয় না। যদি কোনো কষ্ট ছাড়াই আনন্দ পাওয়া যায়, উপভোগ করুন, যেমন কুকুররা করে,কিন্তু আপনার সুখকে এমন কোনো আনন্দের উপর নির্ভরশীল করে ফেলবেন না যা অর্জন করা কঠিন।
প্রকৃতি যা দিতে পারে না এমন কিছু প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে সিনিকরা নিজেদের কার্যত অনাক্রম্য করে তোলেন। অথবা সেই আদর্শের কাছে মানুষের পক্ষে যতটুকু যাওয়া সম্ভব। একারণে ডায়োজেনিস বলতেন, ‘দর্শন আপনাকে ভাগ্যের যে-কোনো উত্থান-পতনের জন্য প্রস্তুত করবে, এটি আপনাকে সমৃদ্ধ করবে কোনো সম্পদ না-থাকা সত্ত্বেও।’ সমসাময়িক অনেকেই, সন্দেহ নেই সিনিকদের কাহিনি পড়তেন ও সংগ্রহ করতেন, কারণ সেগুলো আমাদের প্ররোচিত করে। ডায়োজেনিসের পরে বিখ্যাত সিনিক ছিলেন ক্রেটিস, যদিও সিনিকদের সেরা উক্তিগুলো সব অ্যান্টিসথেনিস আর ডায়োজেনিসের, কিন্তু ক্রেটিস সিনিকদের একটি মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, ‘দর্শন হচ্ছে এক বস্তা সীমের বিচি, আরো কিছু সম্বন্ধে কোনো চিন্তা না-করা’, এই আদর্শের অনুসন্ধানে তিনি সব সম্পদ বিলিয়ে চূড়ান্ত দরিদ্রের জীবন বেছে নিয়েছিলেন ডায়োজেনিসের মতো। যৌনতার ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, ক্ষুধা কামনাকে ধ্বংস করবে, যদি না করে, তবে কাজটি করবে সময়, আর যদি আপনি এই দুটির কোনোটাই ব্যবহার না করতে পারেন, তাহলে দড়ি ব্যবহার করতেন পারেন। কিন্তু তাঁর এই কঠোরতা তাঁর জন্য কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি ভালোবাসা খুঁজে পাবার জন্য। প্রাচীন সাহিত্যের বিষয় হওয়া তাঁর প্রেমকাহিনির নায়িকা ছিলেন উচ্চবংশে জন্ম নেওয়া হিপপারকিয়া, যিনি ক্রেটিসকে বিয়ে করে যোগ দিয়েছিলেন তাঁর সিনিক জীবনে। এমনকি তাঁর ভাইও তাদের সঙ্গী হয়েছিল। আমরা হিপপারকিয়ার দর্শন সম্বন্ধে এখন তেমন কিছু জানিনা, কারণ তারা কেউ কিছু লিখে যাননি। যদিও একটি রিপোর্ট আছে সেখানে তিনি নারী হিসাবে রমণীয় নানা কর্মকাণ্ডে জীবন কাটানোর চেয়ে দার্শনিক হওয়া শ্রেয়তর মনে করেছিলেন। তাঁকে লেখা ক্রেটিস-এর কিছু চিঠিও তথ্য দিয়েছে, সেখানে গৃহস্থালি ও শিশু-প্রতিপালন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে তারা আলাপ করেছেন। এছাড়া আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব এমন কিছু কারণে হিপপারকিয়াকে শুধুমাত্র যৌনবস্তু হিসাবে রূপান্তর করার চেষ্টাও করা হয়েছে, যেখানে দাবি করত ক্রেটিস আর হিপপারকিয়া প্রকাশ্যেই সঙ্গম করতেন ডায়োজেনিসের আত্মমৈথুনের পথ অনুসরণ করে।
আপনি যদি ভেবে থাকেন যে ইন্দ্রিয়পরায়ণ গ্রিকরা এই ঘটনায় আদৌ বিচলিত হয়নি, আবার ভেবে দেখুন। তারা আসলেই বিচলিত হয়েছিল। এবং সেটাই সিনিকরা করতে চেয়েছেন, যখন সক্রেটিস সবাইকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছেন তাদের সাথে কথোপকথন আর যুক্তিতর্ক দিয়ে। সিনিকরা চেষ্টা করেছেন তাদের জীবনের উদাহরণ দিয়ে, সম্পদ ত্যাগ করে এবং তাদের চারপাশের সমাজকে আরো তীব্রভাবে সমালোচনা করার মাধ্যমে। একসময় তাদের বক্তব্য প্রসার করার জন্য তারা কলমও ধরেছেন। ডায়োজেনিস হয়তো কিছু লিখে যাননি, তবে ক্রেটিস সম্ভবত একটি বই লিখেছিলেন; In Praise of Lentil Soup (ডালের প্রশংসায়) ক্রেটিস-এর লেখা বলে মনে করা হয়। এটাই সিনিকদের প্রিয় সাধারণ খাদ্য ছিল। সিনিক-মতাদর্শ রোম সমাজেও প্রবেশ করেছিল, তবে অবশ্যই তাদের সমালোচক ছিল অনেক বেশি। রোমের দার্শনিকদের মধ্যে যিনি সিনিক হিসাবে নিজেকে পরিচিতি দিয়েছিলেন, তিনি ডেমেট্রিয়াস; তিনি একবার ভয়ংকর সম্রাট ক্যালিগুলার দেয়া উপহার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, পরে যখন ক্যালিগুলা সবচেয়ে সুন্দর একটি গোছলখানা বানান, তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘ওখানে যারা গোছল করতে যায়, তারা নিজেদের আরো নোংরা করে।’ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আমরা বেশকিছু সিনিক রচনা দেখতে পাই, যারা ডায়োজেনিসের সেই বন্য বুদ্ধিমত্তাটিকে ধরতে চেয়েছিলেন তাদের লেখায়, যা সিরিও-কমিক বলা চলে, যেখানে হাস্যরসের মোড়কে গুরুগম্ভীর ধারণাগুলোকে উপস্থাপন করার চেষ্টা হয়েছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিওন ও মেনিপপাস, যাদের ব্যঙ্গাত্মক শৈলী রোমের সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল। সিনিকদের প্রতি রোমান দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মিশ্র। সিসেরো তাদের পছন্দ করতেন না, কিন্তু এপিকটিটাস, সেনেকা ও অন্যান্য বৈরাগ্যদর্শনবাদীরা তাদের প্রতি খানিকটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সিনিকদের অনেকেই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, কারণ অন্তত তারা ভোগবাদী নন বা তারা আনন্দ অনুসন্ধান করেন না। তাদের ব্যতিক্রম ছিলেন এপিকিউরিয়ানরা, যাদের নিয়ে আমরা পরের অন্য এক অধ্যায়ে কথা বলব। তাদের জীবনযাত্রা সিনিকদের চেয়ে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল অনেক, কিন্তু অন্য দার্শনিক ধারার অনুসারীরা তাদের প্রতি কেবল ঘৃণা প্রদর্শন করেছে, আংশিকভাবে তার কারণ, তারা ছিলেন ভোগবাদী।