অধ্যায় ৪৯ : অজ্ঞতার মাধ্যমে ন্যায়বিচার – জন রলজ
হয়তো আপনি বিত্তবান কেউ, হয়তো আপনি অতি-ধনী, যাদের বলা হয় সুপার- রিচ। কিন্তু আমরা অধিকাংশই তা নই, আর কিছু মানুষ খুবই দরিদ্র, এতই দরিদ্র যে তারা তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনের বেশিরভাগ অংশই কাটায় অনাহার, ক্ষুধা আর নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে। স্পষ্টতই যা ন্যায়বিচার অথবা নৈতিকভাবে সঠিক বলে মনে হয় না, আর অবশ্যই সেটি তা নয়। পৃথিবীতে যদি আসলেই সত্যিকারের ন্যায়বিচার থাকত,তাহলে কোনো শিশুই অভুক্ত থাকত না, যখন কিনা কিছু মানুষের এতবেশি পরিমাণ টাকা আছে যে তারা জানেনই না সেটি দিয়ে কী করবেন। অসুস্থ হলে প্রত্যেকেরই ভালো চিকিৎসা সেবা পাবার সুযোগ থাকত। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের দরিদ্রদের চেয়ে আফ্রিকার দরিদ্ররা এত বেশি খারাপ অবস্থায় থাকত না। পশ্চিমের ধনীরা বহু হাজার গুণ বেশি ধনী হতেন না সেইসব মানুষদের তুলনায়, যারা নিজেদের কোনো দোষ ছাড়াই নানা প্রতিবন্ধকতা আর সমস্যাপূর্ণ সমাজে ও পরিবেশে জন্ম নিয়েছেন। ন্যায়বিচার হচ্ছে সব মানুষের সাথে পক্ষপাতহীনভাবে আচরণ করা। আমাদের চারপাশে বহু মানুষ আছেন, যাদের জীবন পরিপূর্ণ নানা ভালো জিনিস দিয়ে, আর অন্যরাও আছেন, নিজেদের কোনো অপরাধের কারণে নয়, যাদের খুব সামান্যই সুযোগ থাকে কীভাবে তারা বাঁচবেন তা বেছে নেবার ক্ষেত্রে : যে কাজ তারা করেন তারা সেই কাজ নিজেরা বাছাই করতে পারেন না, অথবা এমনকি সেই শহরটিও না, যেখানে তারা বসবাস করেন। কিছু মানুষ যারা এই অসমতা নিয়ে ভাবেন, তারা হয়তো শুধু বলেন, ‘বেশ, জীবন তো এরকমই, এটি ন্যায়বিচার করেনা’ এবং তারা তাদের কাঁধ ঝাঁকান। এরা সাধারণত সেইসব মানুষ যারা বিশেষভাবে ভাগ্যবান, অন্যরা অবশ্য তাদের সময় ব্যয় করেন ভাবতে কীভাবে সমাজকে আরো ভালোভাবে সংগঠিত করা সম্ভব এবং হয়তো চেষ্টাও করেন এটিকে আরো ন্যায়বিচারপূর্ণ করে তোলার জন্যে।
জন রলজ (১৯২১-২০০২)ছিলেন তেমনই একজন নম্র, ভদ্র হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি একটি বই লিখেছিলেন, যা এইসব বিষয় নিয়ে মানুষের ভাবনাগুলো আমূল বদলে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সেই বইটির নাম A Theory of Justice, এটি তাঁর দীর্ঘ বিশ বছরের গভীর ভাবনার ফসল। সত্যিকারভাবে বইটি আসলেই অধ্যাপকদের বই, যা লেখা হয়েছিল অন্য অধ্যাপকদের জন্য, খানিকটা শুষ্ক পাঠ্যপুস্তকের শৈলীতে। তবে এই ধরনের অন্য বইগুলোর ব্যতিক্রম, এটি লাইব্রেরির তাকে অবহেলায় ধুলো সংগ্রহ করেনি, বরং এটি বহুলপঠিত, বহুবিক্রীত বই হিসাবে খ্যাতি পেয়েছিল। এবং একটি উপায়ে এটি এতবেশি অসাধারণ যে বহু মানুষই বইটি পড়েছেন আর ভেবেছেন, আর এর মূল ধারণাগুলো এতবেশি কৌতূহলোদ্দীপক যে খুব শীঘ্রই বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী বইগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সেরা বই হিসাবে সেটি বিবেচিত হতে শুরু করেছিল, যার পাঠক ছিলেন দার্শনিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদসহ বহু মানুষ। বইটি নিয়ে যদিও এমনকিছু রলজ নিজেই কখনো কল্পনা করেননি যে সম্ভব হতে পারে। রলজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, ১৯৪৫-এর ৬ আগস্ট, যখন জাপানের হিরোশিমা শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র, তখন তিনি প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ছিলেন। তাঁর যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং বিশ্বাস করতেন যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা ভুল ছিল। অনেকের মতো যারা সেই সময় বেঁচেছিলেন, তিনিও চেয়েছিলেন একটি আরো ভালো পৃথিবী, আরো একটি উত্তম সমাজ গড়ে তোলার জন্যে। কিন্তু পরিবর্তন আনার জন্য তাঁর বাছাইকৃত পথটি ছিল চিন্তা ও লেখার মাধ্যমে কিছু করা, কোনো রাজনৈতিক দল বা আন্দোলন নয়। যখন তিনি ‘এ থিওরি অব জাস্টিস’ লিখছিলেন, তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে, সারা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে তখন যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ মিছিল চলছে। তাদের প্রত্যেকটি শান্তিপূর্ণ ছিল না। রলজ সেই মুহূর্তের সমস্যাগুলো না নিয়ে, বরং আরো বিমূর্ত ন্যায়বিচার সংক্রান্ত সাধারণ প্রশ্নগুলো নিয়ে লিখতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর কাজের কেন্দ্রে ছিল সেই ধারণাটি, আমাদের স্পষ্ট করে ভাবতে হবে কীভাবে আমরা একসাথে বাস করব এই সমাজে আর রাষ্ট্রে, এবংকীভাবে সেটি আমাদের জীবনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ আমাদের অস্তিত্বকে সহনযোগ্য করতে হলে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা করা প্রয়োজন, কিন্তু কীভাবে?
কল্পনা করুন, আপনাকে একটি নতুন আরো বেশি উত্তম কোনো সমাজ পরিকল্পনা করতে হবে। একটি প্রশ্ন হয়তো আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে, সেই উত্তম সমাজে কে কী পাবে? যদি আপনি কোনো সুন্দর প্রাসাদে বাস করেন, যেখানে বাসার মধ্যেই সুইমিং পুল আছে, গৃহভৃত্য আছে এবং ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ আছে, আপনি চাওয়ামাত্র কোনো ক্রান্তীয় দ্বীপে আপনাকে যা উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে, আপনি হয়তো এমন কোনো পৃথিবীকে কল্পনা করতে পারেন যেখানে কিছু মানুষ খুবই বিত্তশালী, হয়তো তারা যারা সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে, অন্যরা অনেক দরিদ্র। আর আপনি যদি এখন দরিদ্র পরিবেশে বাস করেন, আপনি হয়তো এমন একটি সমাজ পরিকল্পনা করবেন যেখানে কারোরই অতিমাত্রায় ধনী হবার সুযোগ নেই, যেখানে যা-কিছু আছে সম্পদ হিসাবে তার উপর সবারই সমান ভাগ থাকবে: কোনো ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ থাকার সুযোগ নেই সেখানে, বরং দুর্ভাগা মানুষদের জন্য ভালো একটি সুযোগ থাকবে সুন্দর একটি জীবন পাবার। মানুষের প্রকৃতি এরকমই : মানুষ সাধারণত নিজেদের অবস্থানের কথা ভাবে, যখন তারা একটি উত্তম পৃথিবীর বিবরণ দেয়, তারা সেটি অনুধাবন করুক বা না-করুক। এই পূর্বসংস্কার আর পক্ষপাতগুলো রাজনৈতিক চিন্তাকেও বিকৃত করে। রলজ-এর প্রতিভার সুস্পষ্ট প্রকাশ ছিল একটি চিন্তার পরীক্ষা উদ্ভাবনে, তিনি যার নাম দিয়েছিলেন The Original Position, যা-কিছু স্বার্থপর পক্ষপাতকে দমিয়ে রাখে যা আমাদের সবার মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর মূল ধারণাটি ছিল খুব সরল: একটি উত্তম সমাজ পরিকল্পনা করুন, কিন্তু সেটি করতে হবে সেই সমাজে আপনি কোন্ অবস্থানটি পূর্ণ করবেন বা আপনার অবস্থানটি কোথায় হবে তা না-জেনেই। আপনি জানেন না যে আপনি বিত্তবান না দরিদ্র হবেন সেই সমাজে, আপনার কি কোনো শারীরিক সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধিতা থাকবে কিনা, কিংবা সুদর্শন হবেন কিনা; পুরুষ, নারী, কুৎসিত, বুদ্ধিমান অথবা বোকা, প্রতিভাবান, দক্ষ অথবা অদক্ষ, সমকামী, উভকামী অথবা বিষমকামী ইত্যাদি নানা অবস্থান কোটি আপনার হবে তা আপনার জানা নেই। রলজ বিশ্বাস করতেন এই মূল অবস্থান বা অরিজিনাল পজিশনে দাঁড়িয়ে বা এই কাল্পনিক veil of ignorance বা অজ্ঞতার পর্দার পেছনে দাঁড়িয়ে সমাজ পরিকল্পনার প্রক্রিয়ায় আপনি আরো বেশি পক্ষপাতহীন মূলনীতি বাছাই করবেন, কারণ আপনি জানেন না সেই সমাজে আপনার নিজের অবস্থান কোথায় হবে, কী ধরনের মানুষ আপনি হবেন সেই সমাজে। নির্বাচন করার এই সরল কৌশল, যেখানে আপনার নিজের অবস্থান কী হবে সেটি জানা থাকবে না,তার উপর ভিত্তি করে রলজ তাঁর ন্যায়বিচারের তত্ত্বটি গড়ে তোলেন। আর সেটি দুটি মূলনিতির উপর দাঁড়িয়ে, যেগুলোকে তিনি মনে করেছিলেন সব যুক্তিসংগত মানুষ গ্রহণ করে নেবেন: স্বাধীনতা ও সাম্যর মূলনীতি।
তাঁর প্রথম মূলনীতিটি ছিল লিবার্টি প্রিন্সিপাল; এটি দাবি করছে সবারই মৌলিক কিছু স্বাধীনতা থাকতে হবে এবং যা অবশ্যই কেড়ে নেয়া যাবে না, যেমন, বিশ্বাসের স্বাধীনতা, তাদের নেতা নির্বাচনে ভোট দেবার স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের ব্যাপক স্বাধীনতা। এমনকি যখন এই সবকিছু স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করলে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন উন্নত হয়,তারপরও রলজ মনে করতেন, এটি এতবেশি গুরুত্বপূর্ণ যে এই স্বাধীনতাকে সুরক্ষা করা উচিত সবার আগে। সব উদারনীতিবাদীদের মতোই রলজ এইসব মৌলিক স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন অনেক বেশি, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে প্রত্যেকেরই এই অধিকার থাকা উচিত, কারোই সেগুলো কেড়ে নেয়া উচিত না। রলজের দ্বিতীয় মূলনীতি, দ্য ডিফারেন্স প্রিন্সিপাল, মূলত সাম্য বিষয়ক। সমাজকে এমনভাবে সংগঠিত করতে হবে যেন সেটি আরো সমপরিমাণ সম্পদ আর সুযোগ দেয় তাদেরকে, যারা সবচেয়ে বেশি সুযোগবঞ্চিত। যদি সবাই ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে, তাহলে সেই অসাম্যকে কেবল তখনই অনুমতি দেয়া যায় যদি সেটি যারা খারাপ আছে তাদেরকে সরাসরিভাবে সাহায্য করে। সর্বনিম্ন বেতন পায় এমন কোনো শ্রমিকের চেয়ে কোনো একজন ব্যাঙ্কার ১০,০০০ গুণ বেশি বেতন পেতে পারেন শুধুমাত্র তখনই যদি সেখানেকম বেতন পাওয়া শ্রমিক সরাসরি উপকৃত হয় এবং বেশি পরিমাণ অর্থ পায় তার পক্ষে কখনো যা আয় করা সম্ভব হতো না যদি ব্যাঙ্কারকে এর চেয়ে কম বেতন-ভাতা দেয়া হতো। যদি রলজ দায়িত্বে থাকতেন, তাহলে কারোরই আর অস্বাভাবিক মাত্রার বোনাস পাওয়া লাগত না, যদি-না সবচেয়ে দরিদ্রতমরা সেই পরিণতিতে বেশি টাকা পেতেন। রলজ মনে করতেন এমনই একটি পৃথিবী কোনো যুক্তিসঙ্গত মানুষের বেছে নেবার কথা, যদি তারা না জানেন তারা নিজেরা কি ধনী না গরিব হবেন। রলজ-এর আগে, দার্শনিক আর রাজনীতিবিদরা, যারা ভাবতেন কার কী পাওয়া উচিত, তারা প্রায়শই এমন কোনো পরিস্থিতির সমর্থন করেছেন যা সর্ব্বোচ্চ গড়পড়তা সম্পদ উৎপাদন করে। এর মানে হতে পারে যে, কিছু মানুষ সুপাররিচ হতে পারে, বহু মাঝারি ধনী হবে এবং অল্পকিছু খুব গরিব হতে পারে। কিন্তু রলজ মনে করতেন, এই পরিস্থিতি আরো খারাপ সেই পরিস্থিতির চেয়ে যেখানে কোনো সুপাররিচ নেই, কিন্তু সবারই অপেক্ষাকৃত কমবেশি সমান ভাগ আছে, যদিও গড় সম্পদের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম।
এটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া একটি ধারণা, বিশেষ করে তাদের প্রতি, যারা পৃথিবী যেভাবে আছে সেখানে অনেক বেশি বেতন আয় করতে পারেন। রবার্ট নজিক (১৯৩৮-২০০২), আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন রাজনৈতিক দার্শনিক, রলজ-এর চেয়ে বেশি ডানপন্থী ছিলেন যিনি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। নিশ্চয়ই কোনো একজন ভক্ত, যিনি খুব ভালো একজন বাস্কেটবল খেলোয়াড়কে দেখতে আসেন, টিকিটের মূল্য থেকে একটি অংশ সেই খেলোয়াড়কে দান করার স্বাধীনতা থাকা উচিত। এভাবে নিজেদের টাকা খরচ করার অধিকার তাদের আছে। আর যদি মিলিয়ন সংখ্যক দর্শক তাকে দেখতে আসেন, তবে নজিক মনে করতেন, সেই খেলোয়াড় মিলিয়ন ডলারই আয় করবে ন্যায়সঙ্গতভাবে। রলজ পুরোপুরিভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ছিলেন। এই ধরনের কোনো সমঝোতার কারণে যতক্ষণ-না গরিবরা আরো বেশি ধনী হবে, রলজ যুক্তি দেন, তাহলে বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত আয়কে এত উচ্চমাত্রায় বাড়তে দেয়ার অনুমতি দেয়া উচিত না। বিতর্কিতভাবে, রলজ বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিভাবান কোনো ক্রীড়াবিদ বা খুবই বুদ্ধিমান কোনো মানুষ হওয়া মানে এই না যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের অনেক বেশি টাকা আয় করার অধিকার আছে। আংশিকভাবে এর কারণ ছিল, তিনি বিশ্বাস করতেন, এই দক্ষতা আর যোগ্যতাগুলো শুধুমাত্র ভাগ্যের ব্যাপার। শুধুমাত্র আপনি বেশিকিছু পাবার যোগ্যতা রাখেন না কারণ আপনি যথেষ্ট ভাগ্যবান যে দ্রুত দৌড়াতে পারেন বা খুব ভালো বল খেলতে পারেন অথবা আপনি খুবই মেধাবী। খেলোয়াড়ি বা বুদ্ধিমত্তার প্রতিভা হচ্ছে প্রাকৃতিক লটারিতে জেতার পরিণতি মাত্র। বহু মানুষ অবশ্য দৃঢ়ভাবেই দ্বিমত পোষণ করবেন রলজ-এর সাথে এবংতারা মনে করেন যে এমনকিছু শ্রেষ্ঠত্বকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা উচিত। কিন্তু রলজ ভাবতেন কোনোকিছু খুব ভালো হওয়া আর আরো বেশি পারিশ্রমিক পাবার দাবির মধ্যে কোনো বাধ্যতামূলক স্বয়ংক্রিয় যোগসূত্রতা নেই। কিন্তু কী হতে পারে যদি অজ্ঞতার সেই পর্দা বা ভেইল অব ইগনোরান্সের পেছনে দাঁড়িয়ে কিছু মানুষ বাজি রাখা শ্রেয়তর মনে করেন? কী হতে পারে যদি সেই মানুষগুলো ভাবেন জীবন এমন একটি লটারি এবং তারা নিশ্চিত করতে চান সমাজে বেশকিছু সমাজে আকর্ষণীয় কিছু পদ থাকবে সেগুলো যেন দখল করা যেতে পারে? জুয়াড়িরা স্পষ্টতই সেই ঝুঁকিও নিচ্ছে যে তারা সমাজে দরিদ্র অবস্থানটিও পেতে পারেন, যদি তাদের একটি সুযোগ থাকে অত্যন্ত ধনী হবারও। সুতরাং তারা এমন একটি পৃথিবী চাইবেন যেখানে বৈচিত্রময় ব্যাপ্তির অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকবে, রলজ যেমন চাইছেন তারচেয়েও বেশি। রলজ বিশ্বাস করতেন যে যুক্তিসঙ্গত মানুষ তাদের জীবন নিয়ে বাজি খেলতে চায়না এভাবে। হয়তো তার এই ধারণাটি ভুল ছিল।
আমরা অনেকেই অনুভব করি যে আমাদের সমাজ খানিকটা, অথবা এমনকি পুরোটাই, অন্যায়ভাবেই পক্ষপাতদুষ্ট। কিন্তু আমাদের জন্যে বেশ কষ্টকর হয়ে যায় যখন আমরা আমাদের অবিচারের সেই ধারণাটিকে ক্ষমতাবানদের কাছে এমন কোনো উপায়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা করি, যা শুনলে যৌক্তিক মনে হতে পারে, বিশেষ করে যেখানে কোনো ধরনের ব্যক্তিগত তিক্ততা বা ঘৃণা নেই সেজন্যেই আমাদের জন রলজকে দরকার, বিংশ শতাব্দীর এই মার্কিন দার্শনিক আমাদের চমৎকার আঁটসাঁট একটি মডেল দিয়েছিলেন সেগুলো শনাক্ত করার জন্যে যা আসলেই অনায্য হতে পারে এবং কীভাবে সেগুলো সমাধান করার আমাদের পক্ষে সমর্থন জোগাড় করতে পারি। ১৯২১ সালে বাল্টিমোরে জন্ম নেয়া রলজ খুব অল্পবয়স থেকে আধুনিক পৃথিবীর অন্যায় আর অবিচারগুলো দেখেছিলেন ও প্রতিক্রিয়াও দেখিয়েছিলেন। শৈশবে তিনি দেখেছিলেন কীভাবে মেইন অঙ্গরাজ্যের দরিদ্র অঞ্চলে তার স্বদেশি আমেরিকাবাসীরা স্পষ্টতই বঞ্চিত হচ্ছে সেইসব সুযোগগুলো থেকে যে-সুযোগগুলো তার আইনজীবী বাবা আর সমাজকর্মী মা তাকে দিয়েছিল। রলজ একই সাথে যন্ত্রণার বা কষ্টের সেই স্বেচ্ছাচারী অযৌক্তিতায় অভিজ্ঞ হয়েছিলেন যখন তাঁর দুই ভাই সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, যে অসুখ তাদের সংক্রমিত করেছিল তার কাছে থেকেই, তার নিজের অজান্তে। এটি যদি যথেষ্ট না হয়ে থাকে, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছিলেন সৈন্য হিসাবে, বিশেষ করে মিত্রবাহিনীর ইউরোপীয় ক্যামপেইনে দ্বিতীয় পর্যায়ে। এই সবকিছুই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল আদৌ রহস্যময় না এমন একটি মিশন নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার পেশাগত জীবন গড়ে তুলতে; তিনি চেয়েছিলেন চিন্তা আর ধারণার শক্তি ব্যবহার করে যে অন্যায়- পৃথিবীতে তিনি বাস করেন সেটি পরিবর্তন করবেন। হার্ভার্ড আর কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মেধাবী রলজ তার সময়ের একজন বাস্তবমুখি দার্শনিকে রূপান্তরিত হন; ইসাইয়া বার্লিন, এইচ. এল. এ. হার্ট ও স্টুয়ার্ট হ্যাম্পশায়ারসহ তারা পৃথিবীকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন তাদের কাজ দিয়ে (তারা পরস্পরের বন্ধুতেও পরিণত হন)। ১৯৭১ সালে এ থিওরি অব জাস্টিস প্রকাশিত হবার পর রলজ মূলত সুপরিচিত হয়ে ওঠেন, আর তিনি সেকারণে এখনও শ্রদ্ধেয়। ব্যক্তিগতভাবে সফলতা কখনো প্রভাবিত করেনি রলজকে। তিনি খুব বিনয়ী আর দয়ালু মানুষ ছিলেন, তিনি অন্যদের ভাবনাগুলোকে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত দুটি স্তরেই গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। আধুনিক বিশ্বের ন্যায়বিচার সম্বন্ধে তিনি মূলত যা ভাবতেন :
এক. সবকিছু এখন যেভাবে আছে সেটি পুরোপুরিভাবে অনায্য : সব পরিসংখ্যানই ইঙ্গিত দিচ্ছে সমাজে কাঠামোগত অবিচার আছে। আয়ুষ্কাল ও আয়ের তুলনামূলক পরিসংখ্যান আমাদের একটি অনস্বীকার্য নীতিকথার দিকে নির্দেশনা দেয়। কিন্তু তারপরও দিনের পর দিন, আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে এই অন্যায্যতাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করার জন্যে, বিশেষ করে আমাদের নিজেদের জীবনের সংশ্লিষ্টতায়। এর কারণ শতকণ্ঠ আমাদের সারাক্ষণই বলছে যে, আমরা যদি কাজ করি ও আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে, আমরা অবশ্যই পারব। রলজ খুব ভালো করেই জানতেন যে কীভাবে আমেরিকান ড্রিম রাজনৈতিক পদ্ধতি আর কাঠামো থেকে প্রবেশ করেছে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। এবং তিনি জানতেন এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো। নিশ্চয়ই, বহু মানুষ আছে তারা এই নিখুঁত এই নীতিবাক্যের কাহিনীর উদাহরণ হতে পারে, যেমন, নিঃস্ব থেকে প্রেসিডেন্ট, ধনকুবের কোনো বড় ব্যবসায়ী যারা দরিদ্র অনাথ ছিলেন। আনন্দের সাথে গণমাধ্যমগুলো তাদেরকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। তাহলে কেন আমরা আমাদের ভাগ্য নিয়ে অভিযোগ করতে পারি যখন কিনা তারা উন্নতির শিখরে উঠতে পেরেছে? রলজ বিষয়টি কখনোই মেনে নেননি। নিশ্চয় তিনি জানতেন অসাধারণ কিছু সফলতার গল্প, কিন্তু তিনি একজন পরিসংখ্যানবিদও ছিলেন, যিনি জানতেন কপর্দকশূন্য থেকে ধনী হবার কাহিনী সার্বিকভাবে এতটাই পরিসংখ্যানগতভাবে তুচ্ছ যে এটি রাজনৈতিক তাত্ত্বিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো মনোযোগ প্রত্যাশা করে না। আসলেই, তাদের কথাবলা অব্যহত রাখা হচ্ছে শুধুমাত্র একটি ধূর্ত রাজনৈতিক চাল, যা পরিকল্পনা করা হয়েছে যেন ক্ষমতাবানদের সমাজকে সংস্কার করার প্রয়োজনীয় দায়িত্ব নিতে না হয়। যেমন রলজ আমাদের জোর করে মনে করিয়ে দেন, আধুনিক যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অনেক অংশেও, যদি আপনি দরিদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন, আপনার দরিদ্র থাকার সম্ভাবনা (এবং অল্পবয়সে মারা যাবার) অনেক বেশি আর তর্কাতীত। কিন্তু আমরা কী করতে পারি এই পরিস্থিতিতে? রলজ রাজনীতিসচেতন ছিলেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অন্যায্যতা আর অবিচার নিয়ে বিতর্কগুলো, এবং কী করা উচিত এমন প্রশ্নগুলো জটিলতা আর তুচ্ছ দ্বন্দ্বে বছরের পর বছর থমকে থাকে, কোনোকিছুই করা হয়না। সুতরাং রলজ যা করতে চাচ্ছিলেন, সেটি খুব সরল, অর্থনৈতিকভাবে ও বিবাদকুশলতার মাধ্যমে মানুষকে দেখানো কীভাবে তাদের সমাজগুলো অন্যায্য এবং তারা কী করতে পারে, আর এমনভাবে যেন এটি কোনো বিতর্কের জটিলতা অতিক্রম করে হৃদয় আর মনকে স্পর্শ করতে পারে (কারণ তিনি জানতেন রাজনীতিতে আবেগের জায়গা আছে)।
দুই. কল্পনা করুন আপনি যদি আপনি না হন: কেন সমাজগুলো নায্য হয়ে ওঠে না, তার বড় একটি কারণ হচ্ছে বর্তমানে বিদ্যমান অবিচারের কারণে যারা সুবিধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তাদের সেই প্রয়োজনীয়তা নেই এই বিষয়টি গভীরভাবে ভাবা যে, কেমন হতো যদি তাদের ভিন্ন কোনো পরিস্থিতে জন্ম হতো। তারা সাধারণত সব পরিবর্তনের বিরোধিতা করেন, কারণ তাদের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে সংস্কার আর পক্ষপাতিত্ব। রলজ সহজাতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, আগে এই মানুষগুলোকে বোঝাতে হবে, তাদের দলে আনতে হবে, তারপর তাদের কল্পনা ও জন্মগত নৈতিকতার বোধের কাছে কোনো-না-কোনোভাবে বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করতে হবে। সুতরাং তিনি রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি চিন্তার পরীক্ষা উদ্ভাবন করেন, যা অনায়াসে হবস, রুসো আর কান্টের সমতুল্য হতে পারে। এই পরীক্ষাটি ছিল, veil of ignorance, অজ্ঞতার পর্দা, এর মাধ্যমে রলজ আমাদের নিজেদের জন্মের আগে সচেতন, বুদ্ধিমান সত্তা হিসাবে কল্পনা করতে আহ্বান জানান, কিন্তু আমাদের জানা থাকবে না যে, কোন্ ধরনের পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে আমরা জন্ম নিতে যাচ্ছি। আমাদের ভবিষ্যৎ ঢাকা অজ্ঞতার পর্দা দিয়ে। এই গ্রহের বাইরে দাঁড়িয়ে, আমাদের জানা থাকবে না, কী ধরনের বাবা-মা আপনি পাবেন, আপনার থাকার পরিবেশটি কেমন হবে, কেমন হবে আমাদের স্কুল বা স্থানীয় হাসপাতালে আমরা কীভাবে চিকিৎসা পাব, কীভাবে পুলিশ বা বিচারব্যবস্থা আমাদের সাথে আচরণ করতে পারে ইত্যাদি। যে প্রশ্নটি রলজ আমাদের সবাইকে ভাবতে বলেছিলেন, সেটি হচ্ছে : যদি আমাদের কিছুই জানা না থাকে, আমরা কোথায় জন্ম নেব, কোন্ পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠব, তাহলে কোন্ ধরনের সমাজে প্রবেশ করার জন্য আমরা নিরাপদ বোধ করব? কোন্ ধরনের রাজনৈতিক পদ্ধতি যুক্তিসঙ্গত আর সুস্থ হতে পারে আমাদের বাঁচার জন্য, আর অজ্ঞতার পর্দা যে চ্যালেঞ্জটি আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে সেটির মোকাবেলা করার জন্য? বেশ, অন্তত একটা বিষয় স্পষ্ট, অবশ্যই আমেরিকা নয়। আমেরিকায় বহু আর্থসামাজিক পরিস্থিতি আছে যেখানে জন্ম নেয়া সুখকর হতে পারে, দেশে বহু অংশেই ভালো স্কুল আছে, নিরাপদ পরিবেশ আছে, কলেজে যাবার সুযোগ আছে, ভালো চাকরি পাবার উপায় আছে এবং কিছু চমৎকার অভিজাত কান্ট্রি ক্লাবও আছে। খুব বাড়িয়ে যদি বলা হয়, তাহলে এই বিশাল এবং সুন্দর দেশে শতকরা ৩০ শতাংশমানুষ এই সুযোগসুবিধা পায়। বিস্ময়ের কারণ নেই কেন এই পদ্ধতিটি বদলায় না: কারণ তাহলে অনেক বেশি মানুষ, বহু মিলিয়ন মানুষ, এর থেকে উপকার পায়। আর এখানে veil of ignorance কাজে আসে। এটি আমাদের সেই মানুষগুলো, যারা ভালো করেছে, তাদের নিয়ে চিন্তা করতে বাধা দেয় বরং আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেই ভয়াবহ ঝুঁকিটার দিকে যা সংশ্লিষ্ট থাকে অজ্ঞতার পর্দার আড়ালে কোনো লটারির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে প্রবেশ করার সাথে, কোথায় আপনার জন্ম হবে সেটি না জেনেই, কোনো শিল্পপতির ঘরে, নাকি পিতৃহীন কোনো বস্তিবাসী মায়ের ঘরে। এই জন্ম-লটারিতে মানসিকভাবে সুস্থ এমনকি কোনো জুয়াড়ি আছেন যিনি কিনা আসলেই বাজি খেলবেন বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের অংশ হিসাবে জন্ম নেবার জন্যে, যাদের জন্য আছে শুধুমাত্র নিম্নমানের স্বাস্থ্যসুবিধা, অপ্রতুল আবাসন, আইন আর শিক্ষাসুবিধা পাবার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা? নাকি সেই যৌক্তিক জুয়াড়ি দাবি করবেন পুরো খেলার নিয়ম বদলাতে, ভালো কোনো ফলাফলের জন্য যা সবচেয়ে বেশি সুবিধা দেবে যে-কোনো একক খেলোয়াড়কে?
তিন. আপনি যা জানেন সেটি ঠিক করতে হবে: রলজ এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন আমাদের হয়ে, যে-কোনো সুস্থ জুয়াড়ি যারা এই অজ্ঞতার পর্দার আড়ালে চিন্তার খেলাটি খেলবে, তারা এমন একটি সমাজ চাইবে যে কিছু জিনিস অবশ্যই জায়গামতো থাকতে হবে। তারা চাইবেন সব স্কুলগুলোর মান যেন খুব ভালো হয় (এমনকি সরকারি স্কুলগুলোও), হাসপাতালগুলো যেন চমৎকার চিকিৎসাসেবা দেয় (সবগুলো, এমনকি যেগুলো বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়), তারা সবাই এমন আইনকাঠামো চাইবে যা নিরপেক্ষ আর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে, সবার জন্য উপযুক্ত বাসস্থান হবে। এই অজ্ঞতার পর্দা সবাইকে বাধ্য করে মেনে নিতে যে-দেশে তারা আসলেই চাইছেন জন্ম নিতে সেই দেশটি হয়তো ডেনমার্ক বা সুইজারল্যান্ডের মতো কোনো দেশ হবে, এর মানে এমন কোনো দেশ যেখানে আপনার যেখানেই জন্ম হোক না কেন আপনি খুব খারাপ কোনো পরিস্থিতিতে পড়বেন না। সেখানে যানবাহন ব্যবস্থা, স্কুল, হাসপাতাল এবং রাজনৈতিক পদ্ধতি থাকবে যেটি যথেষ্ট পরিমাণ ভালো, সমাজের কোন্ স্তরে আপনার জন্ম হচ্ছে তার উপর বিষয়টি নির্ভর করবে না। অন্যার্থে, আপনি জানেন কোন্ ধরনের সমাজে আপনি বাস করতে চান। কিন্তু সেই বিষয়টির উপর আপনি শুধু নজর দেননি এখন অবধি। রলজের এই চিন্তার পরীক্ষাটি আমাদের সুযোগ করে দেয় নৈর্ব্যাক্তিকভাবে ভাবতে, বিস্তারিতভাবে একটি ন্যায্য সমাজ কেমন দেখতে হতে পারে। যখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব আমাদের সম্পদ বণ্টনে, আমাদের নিজেদের পক্ষপাতিত্ব অতিক্রম করে আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করতে হবে, এই বিষয়টি নিয়ে আমি কীভাবে অনুভব করতে পারি যদি আমি অজ্ঞতার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকি? আর ন্যায্য উত্তরটি আবির্ভূত হবে সরাসরি, যখন আমরা ভাবব সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও যদি আমাদের জন্ম হয়, তারপরেও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার জন্যে আমাদের আসলে কী দরকার।
চার. এর পরে কী করতে হবে: অনেককিছু নির্ভর করছে আপনার সমাজের যা সমস্যা আছে তার উপর: এই অর্থে রলজ উপযোগীভাবে অন্ধবিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি শনাক্ত করেছিলেন যে অজ্ঞতার পর্দার পরীক্ষা ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসবে ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে। কারো জন্যে অগ্রাধিকার হবে বায়ুদূষণ বন্ধ করা, অন্যদের জন্য স্কুলপদ্ধতির পরিবর্তন। কিন্তু যখন তিনি বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে যুক্তরাষ্ট্রের কথা ভাবছিলেন, রলজ দেখতে পাচ্ছিলেন কিছু স্পষ্ট বিষয় আছে যেখানে কিছু করা প্রয়োজন: শিক্ষাব্যবস্থাকে রাতারাতি উন্নত করতে হবে। নির্বাচনের জন্যে ধনী যেমন সুযোগ পাবে, দরিদ্রদেরও তেমন সুযোগ থাকা উচিত, সব পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন করতে হবে। রলজ আমাদের সেই উপকরণটি দিয়েছেন যা দিয়ে আমরা আমাদের সমাজকে সমালোচনা করতে পারি চমৎকার একটি সাধারণ পরীক্ষার মাধ্যমে। আমরা জানি কখন আমাদের এই সমাজকে আমরা ন্যায়বিচারপূর্ণ একটি সমাজে রূপান্তর করতে পারব, যখন জন্মের আগে সব সততার সাথে একটি কাল্পনিক অজ্ঞতা পর্দার আড়াল থেকে আমরা বলতে পারব, আমরা আদৌ চিন্তিত নই আমাদের ভবিষ্যৎ পিতামাতার পরিস্থিতি যেমন হোক না কেন, বা যে-কোনো পরিবেশে আমাদের জন্ম হোক না কেন। আর আমরা যে এখন সেই চ্যালেঞ্জটা কোনোভাবেই মানতে পারবনা সেটি প্রমাণ করে ঠিক কতটা অন্যায্যতা আমাদের সমাজে এখন রয়ে গেছে, আর সেকারণে আমাদেরও আরো অনেক কিছু অর্জন করারও বাকি আছে।
বিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ সময়জুড়ে বহু দার্শনিকই অতীতের মহান দার্শনিকদের সাথে তাদের সংযোগটি হারিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু রলজের ‘থিওরি অব জাস্টিস’ সেই শতাব্দীতে রাজনৈতিক দর্শন সম্বন্ধে লেখা হয়েছে অল্পকিছু বইয়ের একটি, যা অ্যারিস্টোটল, হবস, লক, রুসো, হিউম ও কান্টের সাথে একই নিশ্বাসে উচ্চারণ করার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। রলজ নিজে অবশ্যই খুবই বিনয়ী ছিলেন এই বিষয়টিতে একমত হবার জন্য। তার উদাহরণ যদিও অনুপ্রাণিত করেছে নতুন প্রজন্মের দার্শনিকদের যারা আজও লিখছেন, যেমন মাইকেল সান্ড্যাল, থমাসপজ, মার্থা নাসবম এবং উইল কিমলিকা, তারা সবাই বিশ্বাস করেন যে দর্শনের দায়িত্ব গভীর আর কঠিন প্রশ্নগুলোর মোকাবেলা করা : কীভাবে আমরা একসাথে বাস করতে পারি, কীভাবে আমাদের সবার একসাথে বাস করা উচিত, আর আগের প্রজন্মের কিছু দার্শনিকদের ব্যতিক্রম, তারা ভীত নন সেগুলোর উত্তর দেবার জন্য এবং সামাজিক পরিবর্তন আনার জন্য। তারা বিশ্বাস করেন শুধুমাত্র আমরা কীভাবে বাঁচব তা নিয়ে আলোচনাটিকে পরিবর্তন না করে দর্শনের আসলে উচিত আমরা কেমনভাবে বাঁচব সেটি পরিবর্তন করা।