অধ্যায় ৩১ : দুনিয়ার মজদুর এক হও – কার্ল মার্ক্স
উত্তর-ইংল্যান্ডে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বহু কটন বা সুতার কল ছিল, তাদের দীর্ঘ চিমনি দিয়ে বেরিয়ে আসা কালো ধোয়ার কুণ্ডলী দূষিত করত পরিবেশ আর কালো ঝুল ঢেকে রাখত রাস্তসহ সবকিছুই। এই কারখানাগুলোর ভিতরে শ্রমিকরা: পুরুষ, নারী এবং শিশুরা দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হতো। আর সেই সুতা বোনার যন্ত্রগুলোকে সচল রাখার জন্য কখনো তাদের কাজের সময় ছিল দিনে টানা ১৪ ঘণ্টা। পুরোপুরিভাবে হয়তো তাদের ক্রীতদাস বলা যাবেনা, কারণ তারা কিছু বেতন পেত, খুবই সামান্য ছিল তার পরিমাণ, আর কাজের পরিবেশ ছিল বিপজ্জনক এবং কষ্টকর। সামান্য অমনোযোগ সেখানে প্রাণঘাতী কিংবা পঙ্গু করে দেবার মতো ভয়ংকর দুর্ঘটনার কারণ হতো প্রায়শই। এইসব পরিস্থিতিতে চিকিৎসাসেবাও ছিল ন্যূনতম। খুব সামান্যই তাদের সুযোগ ছিল ভাগ্য- পরিবর্তনের, যদি তারা কাজ না করে তাহলে অভুক্ত থাকতে হবে, যদি তারা কাজ ছেড়ে চলে যায়, আরেকটা কাজ পাবার সম্ভাবনাও ছিল খুবই কম। এই পরিবেশে যারা কাজ করত, তারা বেশিদিন বেঁচেও থাকত না, তাদের জীবনের এমন সময় ছিল খুব কম যা-কিনা তারা তাদের নিজেদের বলে দাবি করতে পারত। কিন্তু একই সময় এইসব কারখানার মালিকরা ক্রমশ বিত্তশালী হয়ে উঠেছিল, শ্রমিকদের শোষণ তাদের সুযোগ করে দিয়েছিল পুঁজির বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তোলার জন্য। তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই, কীভাবে বেশি মুনাফা অর্জন করা যায়। তারা পুঁজির মালিক ছিলেন (যে পুঁজি তারা বিনিয়োগ করতে পারতেন আরো মুনাফা অর্জন করতে), তারা বহু দালান ও যন্ত্রের মালিক ছিলেন, মূলত তারা শ্রমিকদেরও মালিক ছিলেন, শ্রমিকদের বলতে গেলে কিছুই ছিল না, তাদের যা করার ছিল সেটি হচ্ছে তাদের শ্রম দেবার ক্ষমতাকে বিক্রি করে কারখানা- মালিককে আরো বেশি বিত্তবান হতে সাহায্য করা। তাদের শ্রমের মাধ্যমে তারা কারখানা-মালিকের ক্রয় করে আনা কাঁচামালে আরো মূল্য যোগ করত। তুলা যখন কারখানায় প্রবেশ করত তখন এর মূল্য যা থাকত, তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেত যখন সেটি কারখানা ত্যাগ করত। কিন্তু এই বাড়তি মূল্যের প্রায় পুরোটাই পেতেন মালিকরা যখন তারা তাদের উৎপাদিত দ্রব্যটি বিক্রি করতেন বাজারে। আর মালিকরা শ্রমিকদের যতটা কম সম্ভব মজুরি দিতেন মুনাফার পরিমাণ বাড়াতে, কখনো শুধুমাত্র এমন পরিমাণ যেন কোনোভাবে তারা বেঁচে থাকে শুধুমাত্র শ্রম দেবার জন্যে। শ্রমিকদের কাজেরও কোনো নিরাপত্তা ছিল না, তারা যা চাইছে যদি এমন কোনো দাবি পূরণে মালিক অস্বীকার করত, তাদেরকে বরখাস্ত করা হতো, অনাহারে তারা মারা যেত, কারণ আর কোনো কাজও তারা খুঁজে পেত না। যখন জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩), ১৮৩০-এর দশকে লেখা শুরু করেছিলেন, এটাই ছিল ভয়াবহ সেই পরিস্থিতি, শুধু ইংল্যান্ডেই না, পুরো ইউরোপজুড়ে যা সৃষ্টি করেছিল শিল্পবিপ্লব, আর এই পরিস্থিতি তাকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করেছিল। মার্ক্স ছিলেন ইগালেটারিয়ান বা সাম্যবাদী: তিনি মনে করতেন সব মানুষের সাথে সমানভাবেই আচরণ করা উচিত। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজে যাদের হাতে পুঁজি আছে— প্রায়শই উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ, তারা ক্রমশ সম্পদশালী হতে থাকে। অন্যদিকে যাদের শ্রম দেবার ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই নেই, তারা তাদের শ্রম বিক্রি করে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হয় এবং শোষিত হয়। মার্ক্সের মতে পুরো মানব-ইতিহাসকেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে একটি শ্রেণিসংগ্রাম হিসাবে: বিত্তবান পুঁজিপতিশ্রেণি (বুর্জোয়া) এবং শ্রমিকশ্রেণি বা প্রলেতারিয়েত শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব। আর মানুষদের তাদের সম্ভাবনা-পূরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে এই সম্পর্ক, আর এটি কাজকে পরিতৃপ্তি পাবার মতো কোনো কর্মকাণ্ড নয়, বরং যন্ত্রণাদায়ক আর কষ্টকর কোনো অভিজ্ঞতায় রূপান্তর করেছে।
ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষকে সহজে ক্ষিপ্ত করে তোলার দুর্দান্ত ক্ষমতাসহ অসম্ভব প্রাণশক্তিপূর্ণ এই মানুষটিকে মোটামুটি প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই অর্থকষ্টে কাটাতে হয়েছিল। জার্মানি থেকে প্যারিস তারপর ব্রাসেলসে এসে তিনি বসবাস শুরু করেছিলেন আইনের হাত থেকে পালাতে। পরে তিনি স্থায়ী হয়েছিলেন লন্ডনে, সেখানে তিনি তাঁর সাত সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেছিলেন, সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী জেনী এবং তার বাসার কাজে সহকারী হেলেন ডেমুথ, যার সাথে তাঁর একটি বিবাহ-বহির্ভূত সন্তানও ছিল। বন্ধু ফ্রিয়েডরিখ এঙ্গেলস তাকে সাহায্য করেছিলেন পত্রিকার জন্যে লেখালেখির কাজ খুঁজে বের করতে। এমনকি মার্ক্সের বিবাহ-বহির্ভূত ছেলেকেও তিনি দত্তক নিয়েছিলেন বন্ধুর মুখ রক্ষা করার জন্যে। কিন্তু স্পষ্টতই অভাব ছিল চিরন্তন, প্রায়শই তাঁর বাচ্চারা অসুস্থ, অভুক্ত থাকত, তার তিনটি সন্তান শৈশবেই মারা যায়। জীবনের পরবর্তী সময়ে, মার্ক্স তার বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রিডিং রুমে, গবেষণা আর লেখালেখি করে। অথবা তাঁর ছোট ফ্ল্যাটে, যেখানে তিনি যা লিখতে চাইতেন মুখে বলতেন, তাঁর স্ত্রী সেটি লিখতেন, কারণ মার্ক্সের হাতের লেখা খুবই অপরিচ্ছন্ন ছিল, যা এমনকি তিনি নিজেই পড়তে পারতেন না মাঝে মাঝে। এই ভীষণ কষ্টের পরিস্থিতিতেও তিনি বহু বই আর প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তার সব লেখা যোগ করে সংকলিত ৫০টি মোটা খণ্ডের রচনাসমগ্র আমরা এখন দেখতে পাই। তার ধারণাগুলো লক্ষকোটি মানুষের জীবন বদলে দিয়েছিল। কারো জন্য সেটি ভালো হয়েছিল এবং নিঃসন্দেহে কারো জন্য সেটি খারাপ ফলাফল নিয়ে এসেছিল। সেই সময়, হয়তো তাকে কেউ দেখলেই মনে করত খ্যাপাটে একজন মানুষ, হয়তো খানিকটা পাগল। খুব কম মানুষই ভাবতে পেরেছিলেন তাঁর চিন্তা একদিন কত প্রভাবশালী হয়ে উঠবে।
তিনি শ্রমিকদের কষ্টটি বুঝতেন, সমাজের পুরো কাঠামো যাদের নিষ্পেষিত করে রেখেছে। মানুষ হিসাবে বাঁচার কোনো উপায় তাদের ছিল না। কারখানার মালিকরা খুব দ্রুত বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা আরো বেশি পণ্য উৎপাদন করতে পারবেন যদি তারা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করতে পারেন। প্রতিটি শ্রমিক তাহলে প্রোডাকশন লাইনের একটি ছোট অংশে বিশেষায়িত হবে শুধুমাত্র কোনো সুনির্দিষ্ট অংশের কাজ করার জন্যে। কিন্তু এটি শ্রমিকদের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলেছিল। তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল একঘেয়ে, পুনরাবৃত্তিপূর্ণ কাজ বারবার করার জন্য। সৃজনশীল হবার পরিবর্তে ক্লান্ত এই শ্রমিকরা রূপান্তরিত হয়েছিল সুবিশাল একটি যন্ত্রের যন্ত্রাংশের মতো, যে যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, এর মালিককে আরো বিত্তবান করে তোলা। পরিস্থিতি এমন ছিল যেন তারা কোনো মানুষই নয়, শুধুমাত্র পাকস্থলী, যেখানে খাদ্য দিতে হবে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হলে, আর পুঁজিপতিরা মুনাফা আদায় করে নেবে : যাকে মার্ক্স বলেছিলেন শ্রমিকদের শ্রমে সৃষ্ট উদ্বৃত্ত মূল্য (surplus value)। পুরো এই পরিস্থিতি শ্রমিকদের জীবনে যে প্রভাব ফেলেছিল, তাকে মার্ক্স চিহ্নিত করেছিলেন alienation বা বিচ্ছিন্নতা হিসাবে। এই শব্দটি দিয়ে তিনি আসলে বেশকিছু বোঝাতে চেয়েছিলেন। শ্রমিকরা আসলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তারা আসলেই যা তার থেকে, মানুষ। তারা যা উৎপাদন করে সেটিও তাদের বিচ্ছিন্ন করে, শ্রমিকরা যত পরিশ্রম করে তারা ততবেশি উৎপাদন করে, আরো বেশি লাভ করে পুঁজিপতিরা। শ্রমিকদের উৎপাদিত দ্রব্যগুলোও শ্রমিকদের উপর তাদের প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু কিছুটা আশাবাদ আছে এই মানুষগুলোর জন্যে, যদিও তাদের জীবন দুর্বিষহ এবং পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রিত তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে পুঁজিবাদ একদিন নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে, প্রলেতারিয়েতরা সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করবে। একসময় এইসব রক্তপাত শেষেই জন্ম নেবে সুন্দর পৃথিবী, যেখানে মানুষকে আর শোষিত হতে হবে না, বরং তাদের সুযোগ হবে সৃজনশীল হবার, পরস্পরকে সহযোগিতা করার। প্রতিটি মানুষই যা তারা পারে সমাজে অবদান হিসাবে রাখবে, পরিবর্তে সমাজ তাদের দেখাশুনা করবে, from each according to his ability, to each according to his need এটাই ছিল মার্কসের ভিশন। কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শ্রমিক নিশ্চিত করবে সবার চাহিদা মেটানোর জন্যে। কারোরই অন্ন, বস্ত্র আর আশ্রয়ে ঘাটতি যেন না হয়। এই ভবিষ্যৎটি হচ্ছে কমিউনিজম, সহযোগিতার সুফল ভাগাভাগি করে নেয়ার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি পৃথিবী।
মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যেভাবে সমাজ বিকশিত হয় সেই বিষয়ে তাঁর গবেষণা উন্মোচন করেছে ভবিষ্যতে এমন একটি পৃথিবী অবশ্যম্ভাবী। আর এটি ইতিহাসের মূল কাঠামোরই অংশ। এই প্রকৃতি ত্বরান্বিত করতে খানিকটা সাহায্য করা যায়, এবং এঙ্গেলস-এর সাথে লেখা তার ১৮৪৮ সালের Communist Manifesto
বইটিতে তিনি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুঁজিবাদকে উৎখাত করার জন্যে সারা পৃথিবীর শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান। এখানে আমরা জ্যাঁ-জাক রুসোর সোস্যাল কন্ট্রাক্ট-এর প্রথম বাক্যটির প্রতিধ্বনি শুনতে পাই, যখন মার্ক্স এবং এঙ্গেলস ঘোষণা করেছিলেন, তাদের বন্দি করে রাখা শৃঙ্খলটি ছাড়া শ্রমিকদের আসলে হারাবার আর কিছু নেই। ইতিহাস বিষয়ে মার্ক্সের ধারণাটিকে প্রভাবিত করেছিলেন হেগেল। হেগেল, যেমনটি আমরা দেখেছিলাম, ঘোষণা করেছিলেন, সবকিছুর একটি অন্তর্নিহিত কাঠামো আছে এবং আমরা ক্রমশ সেই পৃথিবীর দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যা কোনো-না-কোনোভাবে আত্মসচেতন হয়ে উঠবে। মার্কস হেগেল থেকে সেই ধারণাটি গ্রহণ করেছিলেন যে প্রগতি অবশ্যম্ভাবী, এবং ইতিহাসের একটি ছন্দ আছে, এলোমেলো ধারাবাহিক কোনো ঘটনার সমষ্টি এটি নয়, কিন্তু মার্ক্সের সংস্করণে, এই প্রগতি ঘটছে তার কারণ এটি পরিচালিত করছে অর্থনৈতিক শক্তি। শ্রেণিসংগ্রামের পরিবর্তে মার্ক্স ও এঙ্গেলস এমন একটি পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যেখানে কেউই ভূস্বামী হবে না, কোনো উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ থাকবে না, যেখানে শিক্ষা দেয়া হবে বিনামূল্যে, যেখানে জনগণের কারখানা সবার জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করবে। কোনো ধর্মের দরকার নেই। ধর্ম হচ্ছে, তিনি বিখ্যাতভাবে ঘোষণা করেছিলেন, জনগণের জন্য আফিম। এটি হচ্ছে মাদকের মতো, যা মানুষকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে রাখে, তারা যে শোষিত হচ্ছে সেটি তারা অনুধাবন করতে পারেনা। বিপ্লবের পর নতুন সেই পৃথিবীতে মানুষ তাদের মানবতা অর্জন করবে। তাদের কাজ হবে অর্থবহ, তারা এমনভাবে পরস্পরের সহযোগিতা করবে যা সবার উপকারে আসবে। বিপ্লব হবে এইসব কিছু অর্জন করার একটি উপায়এবং এর অর্থ সহিংসতা কারণ ধনীরা কোনো সংগ্রাম ছাড়া তাদের সম্পদ ত্যাগ করতে রাজি হবে না।
মার্ক্স মনে করতেন, অতীতের দার্শনিকরা শুধুমাত্র পৃথিবীকে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তিনি চেয়েছেন এটি পরিবর্তন করতে। যদিও আগের দার্শনিকদের প্রতি তিনি খানিকটা অবিচার করেছিলেন এটি বলে, কারণ তাদের অনেকেই নৈতিক এবং রাজনৈতিক সংস্কারের চালিকাশক্তি ছিলেন। কিন্তু তাঁর ধারণার প্রভাব ছিল বাকি সবার চেয়ে বেশি। এটি ছিল ছোঁয়াচে, রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে ও অন্যকিছু জায়গায় যা অনুপ্রাণিত করেছিল বিপ্লব। দুঃখজনকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যে সুবিশাল রাষ্ট্রটির আবির্ভাব হয়েছিল রাশিয়া ও তার কিছু প্রতিবেশীদের নিয়ে, এবং অন্যান্য মার্ক্সবাদী চিন্তাধারায় গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো প্রমাণিত হয়েছিল নিপীড়ক, অদক্ষ আর দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্র হিসাবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে সংগঠিত করার কাজটি যেভাবে কল্পনা করা হয়েছিল তারচেয়ে অনেক বেশি কঠিন প্রমাণিত হয়েছিল। মার্ক্সবাদীরা দাবি করেন, যাই ঘটুক না কেন এটি মার্ক্সবাদী ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্থ করেনি।বহু মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন, সমাজ নিয়ে কার্ল মার্ক্সের ধারণাই সঠিক, কিন্তু শুধুমাত্র যারা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো পরিচালনা করেছিলেন, তারা সত্যিকারভাবে কমিউনিস্ট মতাদর্শে কাজ করেননি। অন্যরা দেখিয়েছেন যে মানবপ্রকৃতি আমাদের আরো বেশি প্রতিযোগিতামূলক এবং লোভী করে তোলে, যতটা তিনি তার কাঠামোতে অনুমতি দিয়েছিলেন : তাদের মতে কোনো একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে মানুষ পুরোপুরিভাবে পরস্পরের সহযোগিতা করবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেআ, আমরা আসলেই সেরকম প্রাণী নই। ১৮৮৩ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে যখন তিনি মারা যান, খুব কম মানুষই পরবর্তী ইতিহাসে তাঁর দর্শনের প্রভাব সম্বন্ধে আগাম ভাবতে পেরেছিল। মনে হয়েছিল তাঁর সাথে তার ধারণাগুলোও সমাহিত করা হয়েছে লন্ডনের হাইগেট সমাধিক্ষেত্রে। তাঁর সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে এঙ্গেলস-এর মন্তব্য, ‘তাঁর নাম ও কাজ বহু যুগ ধরে টিকে থাকবে’, সেখানে উপস্থিত সবার মনে হয়েছিল বেশ অভিলাষী ভাবনা।
সন্দেহ নেই বেশিরভাগ মানুষই একমত হবেন, বিদ্যমান এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কোনো-না-কোনোভাবে উন্নতি আর সংশোধন করা প্রয়োজন, আমাদের এই গ্রহটিকে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে অতিরিক্ত ভোগবাদিতার মাধ্যমে। এছাড়া অপ্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপন যা আমাদেরকে জীবনের প্রতি অমনোযোগী করে তুলেছে প্রায় সর্বক্ষণ। এছাড়া বহু মানুষকে এটি রেখেছে স্বাস্থ্য সুবিধাবঞ্চিত এবং ক্ষুধার্ত, উপরন্তু ইন্ধন জুগিয়ে চলছে বহু অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধেরও। তাসত্ত্বেও আমরা প্রায়শই সদাপ্রস্তুত এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী সমালোচক, কার্ল মার্ক্সকে গুরুত্ব না-দেবার জন্য। বিষয়টির আসলে আমাদের খুব বেশি অবাক করা উচিত না। বাস্তবিকভাবেই তাঁর রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ধারণাগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে ভয়ংকর একনায়কতন্ত্র আর সর্বনাশা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পিত অর্থনীতি পরিকল্পনা করার জন্যে। সুস্পষ্টভাবে, মার্ক্স পৃথিবীর এই ক্ষতিকর দিকগুলো সমাধান করার জন্য যে-উপায়গুলো প্রস্তাব করেছিলেন এখন শুনতে কিছুটা পাগলামো মনে হবে। তিনি ভেবেছিলেন আমাদের উচিত হবে সবধরনের ব্যক্তিগত সম্পদের বিলোপ নিশ্চিত করা। কোনো মানুষকেই ব্যক্তিগতভাবে কোনোকিছুর মালিক হবার অনুমতি দেয়া যাবে না। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে কেউ হয়তো তাঁর এই ধারণায় সমব্যথী হতে পারেন, কিন্তু এটা অনেকটাই আড্ডা দেওয়া বা টেলিভিশন দেখা নিষিদ্ধ করার মতোই। মানব-আচরণের বিরুদ্ধেই তাঁর এই ধারণার যুদ্ধ। এবং মার্কস বিশ্বাস করতেন এই পৃথিবীর সমস্যার সমাধান হবে কেবল প্রলেতারিয়েতদের একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে, বর্তমানে তাঁর এই দাবিটির খুব বেশি কোনো অর্থ হয়না। সাধারণ নির্বাচনে প্রকাশ্যভাবে মার্ক্সবাদী হিসাবে দাবি করা রাজনৈতিক দলগুলোর সংগৃহীত ভোটের সংখ্যা খুব সামান্যই। যেমন ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে মার্কসবাদী দল ৪০ মিলিয়ন ভোটের মধ্যে পেয়েছিল মাত্র ১৬৮৫টি ভোট। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের উচিত হবে না খুব দ্রুত সর্বতোভাবে মার্ক্সকে প্রত্যাখ্যান করা। আমাদের বরং তাকে দেখা উচিত পুঁজিবাদের ক্ষতিকর দিকগুলোকে শনাক্তকারী একজন পথনির্দেশক হিসাবে যিনি আমাদের আরো বেশি প্রতিশ্রুতিময় ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হবার জন্যে সাহায্য করতে পারেন।
জার্মানির ট্রিয়ার-এ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কার্ল মার্ক্স। তিনি ছিলেন ইহুদি ধর্মযাজক বা রাবাইদের সুদীর্ঘ একটি বংশধারার উত্তরসূরি, তবে জার্মান সমাজের সাথে আত্তীকৃত হবার জন্যে যখন তাঁর বয়স ছয়, তার পরিবার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছিল। অভিজাত এবং সুখ্যাত বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা তাকে দেখি বেশকিছু পরিমাণ ঋণ তিনি পুঞ্জীভূত করেছিলেন, এছাড়া অতিরিক্ত মদ্যপান করে শান্তিবিঘ্নিত করার জন্য তাকে কারাগারেও যেতে হয়েছিল, এবং সেই সময় একটি ডুয়েল বা দ্বন্দ্বযুদ্ধে তাকে আমরা জড়িয়ে যেতে দেখি। তিনি চেয়েছিলেন মূলত নাট্যসমালোচক হতে। স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট, মার্ক্সের বাবা তাকে আরো বেশি শৃঙ্খলাপূর্ণ বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। সেখানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন দার্শনিকদের একটি গোষ্ঠীর সাথে, যারা পরিচিত ছিলেন ইয়ং হেগেলিয়ানস (Young Hegelians) নামে, যারা আধুনিক অর্থনীতি এবং রাজনীতি বিষয়ে অতিমাত্রায় সংশয়বাদী ছিলেন। এরপরে তিনি জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট করেসপন্ড লিগের সাথে (এঙ্গেলসকে সাথে নিয়ে ব্রাসেলসে যা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন), এটি ছিল ছোট একটি বুদ্ধিজীবীদের গ্রুপ যারা শ্রেণীপ্রথা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিপ্রথা বিলোপ করার জন্যে আন্দোলন করছিলেন। পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন (Rheinische Zeitung- এর প্রধান সম্পাদকও হয়েছিলেন, পরে প্রুশিয়ান কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল)। আমরা একপর্যায়ে তাকে গোপনে বিয়ে করতে দেখি ধনাঢ্য পরিবারে তরুণী জেনি ফন ভেস্টফালেনকে। কিন্তু তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অবশ্য তরুণ দম্পতিকে জার্মানি ছেড়ে পালাতে হয় এবং একপর্যায়ে তারা ফ্রান্স, বেলজিয়াম হয়ে অবশেষে বসতি গড়েন লন্ডনে।
কার্ল মার্ক্স অসংখ্য বই এবং প্রবন্ধ লিখেছিলেন, কখনো কখনো তাঁর সহলেখক ছিলেন ফ্রিয়েডরিখ এঙ্গেলস। তাঁর কিছু বিখ্যাত বইয়ের মধ্যে যেমন আছে, Critique of Hegel’s Philosophy of Right (১৮৪৩), The Holy Family (১৮৪৫), Theses on Feuerbach (১৮৪৫), 1844 Manuscripts, The German Ideology (১৮৪৫), The Communist Manifesto (১৮৪৮), Critique of the Gotha Program (১৮৭৫), এবং সুবিপুল Capital (১৮৬৭-১৮৯৪)। মূলত কার্ল মার্ক্স লিখেছিলেন পুঁজিবাদ নিয়ে, পশ্চিমা বিশ্বে যে-ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বর্তমানে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তার সময়েও এই ব্যবস্থা ছিল চলমান, এবং কোনো সন্দেহ নেই মার্কস ছিলেন এর অন্যতম সেরা বুদ্ধিদীপ্ত এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ সমালোচক। তিনি পুঁজিবাদের বেশকিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছিলেন :
এক. আধুনিক শ্রম ‘alienated’ বা বিচ্ছিন্ন : মার্ক্সের অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টির একটি তিনি উপস্থাপন করেছিলেন তাঁর শুরুর দিকের একটি বই 1844 Manuscripts-এ, সেটি হচ্ছে : আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম আনন্দগুলোর একটি উৎস হতে পারে কাজ। কাজ নিয়ে মার্ক্সের এত উচ্চাশা ছিল বলেই তিনি খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন মানবজাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে দুর্বিষহ নানা কাজ বাধ্য হয়ে সহ্য করতে দেখে। কাজে নিজেকে পরিপূর্ণ হিসাবে অনুভব করতে হলে মার্কস লিখেছিলেন শ্রমিকদের প্রয়োজন ‘তারা যে দ্রব্য সৃষ্টি করছে সেখানেই তাদের নিজেদের প্রতিফলনকে দেখতে পাওয়া’। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠতম পরিস্থিতিতে শ্রম আমাদের সুযোগ দেয় আমাদের মধ্যে ভালো যা-কিছু আছে সেটির বহির্মুখি প্রকাশের জন্য (আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের শৃঙ্খলা, আমাদের যুক্তি) এবং শ্রমই সেই বিষয়গুলোকে একটি স্থিতিশীল, টিকে থাকার মতো একটি রূপ দিতে পারে কোনো দ্রব্য বা সেবায়, যা আমাদের থেকে স্বতন্ত্র। আমাদের কাজ যদি সবকিছু ঠিক থাকে, হওয়া উচিত প্রাত্যহিক যেভাবে আমরা সবকিছু ব্যবস্থাপনা করি তার চেয়ে কিছুটা উত্তম, কারণ এটি আমাদের সুযোগ দেয় সব মনোযোগ একীভূত করতে এবং আমাদের সেরা অংশটির নির্যাসকে এর সাথে যুক্ত করতে। সেই মানুষটির কথা ভাবুন, আপনি যে চেয়ারে বসে আছেন, সেই চেয়ারটি যিনি বানিয়েছেন, হতে পারে চেয়ারটি সাদামাটা, তবে শক্তিশালী, সৎ এবং অভিজাত। কিন্তু এর যে সৃষ্টিকর্তা সে কিন্তু সবসময় এই গুণগুলোর পরিচয় দেয়না। কখনো সে হয়তো বদমেজাজি, হতাশাগ্রস্থ, অনিশ্চিত। তারপরেও তার চরিত্রের ইতিবাচক বিষয়গুলোর একটি স্মারক বা মেমোরিয়াল হচ্ছে তার শ্রমের এই সৃষ্টি, এই চেয়ারটি। মার্ক্স ভাবতেন আদর্শগতভাবে এটাই হওয়া উচিত ‘কাজ’। কিন্তু তিনি লক্ষ করেছিলেন কীভাবে আধুনিক এই বিশ্বে ক্রমশ কমে যাচ্ছে সেইসব কাজের সংখ্যা, যে কাজগুলোর মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্যসূচক গুণ আছে, যা আমাদের শ্রেষ্ঠতম অংশটি সেই কাজে প্রকাশ করার সুযোগ করে দিতে পারে।
আধুনিক কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলোর আংশিক কারণ হচ্ছে এটি অবিশ্বাস্যরকম বিশেষায়িত। যে-কেউই তা বলতে পারবেন, কারণ পেশার নামও এখন বেশ অদ্ভুত: packaging technology specialists, beverage dissemination officers, gastronomical hygiene technicians at information architects ইত্যাদি। বর্তমানে এইসব বহু কাজ করার জন্য দরকার বহুদিনের প্রশিক্ষণ, যা আধুনিক অর্থনীতিকেও করেছে বিস্ময়করভাবে উৎপাদনশীল। কিন্তু আমরা এমন এক পরিস্থিতির শিকার যে যেখানে কদাচিৎ হয়তো সম্ভব হতে পারে কারো পক্ষে দৈনন্দিন কাজে তার নিজের প্রকৃত চরিত্রটি প্রকাশ করার জন্যে।
মার্ক্সের দৃষ্টিতে, আমাদের অন্তরে আমরা সবাই একটি বিশেষ বিষয় নয় বরং সাধারণ সব কাজেই বিশেষজ্ঞ। আমরা শুধুমাত্র একটি কাজ করার জন্য জন্ম নিইনি। শুধুমাত্র এই অর্থনীতি তার লোভী উদ্দেশ্য চরিতার্থে আমাদের বাধ্য করেছে শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রে নিজেদেরকে বিসর্জন দেবার জন্য, আমাদের রূপান্তরিত করে মার্ক্সের ভাষায়: one-sided এবং dependent (একপেশে এবং নির্ভরশীল) 4 spiritually depressed 4 physically to the condition of a machine, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে হতাশ, শারীরিকভাবে কোনো যন্ত্রের মতো। 1844 Manuscripts বইটিতে মার্ক্স প্রথম যুক্তি দেন যে আধুনিক কাজ বিচ্ছিন্নতাবোধ সৃষ্টি করে, জার্মান ভাষায় যার নাম দিয়েছিলেন তিনি, Entfremdung; আমাদের হৃদয়ে, আমরা বহু সত্তাকে ধারণ করি, আমাদের আধুনিক অর্থনীতি যতটা আমাদের অনুমতি দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি বাছবিচারহীন। কোনো এক হিসাব- নিরীক্ষক কেরানির বাইরের শান্ত চেহারার নিচে হয়তো এমন কেউ আছেন যিনি হয়তো বাগান করতে ভালোবাসেন। বহু কবিও যেমন চাইবেন শিল্পকারখানায় কয়েক বছর কাজ করতে, আর মার্ক্স এই বহুমুখী সম্ভাবনাগুলোকে শনাক্ত করেছিলেন। বিশেষায়িত হবার তাড়না হয়তো অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা হতে পারে, তবে এটি মানবচরিত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
মার্ক্স চেয়েছিলেন আমাদের সাহায্য করার জন্যে যেন আমরা আরো অর্থবহ কোনো কাজ খুঁজে পাই। মার্ক্স লিখেছিলেন কাজ অর্থবহ হয়ে ওঠে দুটি উপায়ের যে-কোনো একটিতে : হয় এটি কোনো শ্রমিককে সাহায্য করে কারো কষ্ট লাঘব করার জন্য অথবা স্পর্শযোগ্য উপায়ে এটি কাউকে সাহায্য করে অন্যদের খুশি করতে। খুব অল্প কাজই আছে যা এই ধরনের সুযোগ দিতে পারে (হয়তো চিকিৎসাসেবা)। যখন আমাদের কাজ অর্থহীন হয় আমরা কষ্টভোগ করি, এমনকি যখন আমরা ভালো বেতন পাই। মার্ক্স প্রথম চেষ্টা করেছিলেন এর উত্তর খুঁজতে, কীভাবে আমাদের অর্থনীতিকে সংস্কার করা উচিত। আমাদের এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থাকা উচিত যা আমাদের অধিকাংশের দুর্দশা কমাবে এবং আনন্দ বাড়াবে। আমাদের গভীরে আমরা সবাই অন্য মানুষকে সাহায্য করার তাগিদ অনুভব করি। আমাদের সেই অনুভূতিটি অনুভব করার প্রয়োজন যে, আমরা সত্যিকারের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে কাজ করছি, শুধুমাত্র কোনো নির্বিকার ইচ্ছার অনুসারী না হয়ে। মার্ক্স অনেক কাজ সম্বন্ধে জানতেন যেখানে কোনো একজন প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারে, কিন্তু তাদের সেই শক্তিকে কোথাও তিনি পুঞ্জীভূত হতে দেখেননি কখনোই। তাদের বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা সবই হ্রাস পায়। তারা এমন কোনোকিছুর দিকে আঙুল তুলে বলতে পারেনা, আমি এটা করেছি, এটা আমি। অনেক চাকচিক্যময় কাজ করা মানুষকে এই যন্ত্রণাটি আক্রমণ করতে পারে। দৈনন্দিন কাজ হিসাবে তাদের কাজ হতে পারে উত্তেজনাময়, কিন্তু সময়ের সাথে এটি কোনোকিছু সৃষ্টি করতে পারেনা। কারণ তাদের সেই পরিশ্রমগুলো অর্থপূর্ণ কোনো উপায়ে পুঞ্জীভূত হয় না। তাদের কাজের দীর্ঘমেয়াদি কোনো নৈর্ব্যক্তিক উদ্দেশ্য কিংবা লক্ষ্য নেই। কয়েক বছর পর তারা একসময় থেমে যায়। পরিস্থিতিটা বিপরীত কোনো বড় প্রকল্পে কাজ করা একজন স্থপতির জন্য। অসংখ্য খুঁটিনাটি বিষয়, যা বিরক্তিকর এবং হতাশাময় হতে পারে, ধীরে ধীরে একটি সার্বিক রূপে যুক্ত হয়, একটি পরিপূর্ণ অর্জনে। এবং সবাই যারা এর অংশ, তারা একটি দিকনির্দেশনা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে। তাদের পরিশ্রম প্রয়োজন ছিল সুন্দর কোনোকিছুকে অস্তিত্ব দেবার জন্য। এবং তারা সেটি জানে।
দুই. আধুনিক কাজ অনিশ্চয়তাময়: পুঁজিবাদ মানুষকে রূপান্তরিত করেছে পুরোপুরিভাবে ব্যয়যোগ্য অপ্রয়াজনীয় একটি রূপে। উৎপাদনের অসংখ্য নিয়ামকের মধ্যে যে একটিমাত্র নিয়ামক, যাকে নিষ্ঠুরভাবে একমুহূর্তের মধ্যে বাদ দেয়া যেতে পারে যখনই খরচ বাড়বে এবং আরো বেশি মুনাফা সঞ্চিত করার মতো পরিস্থিতি আসে প্রযুক্তির ব্যবহারে। পুঁজিবাদে সে-কারণেই কাজের কোনো নিরাপত্তা কিংবা নিশ্চয়তা নেই। এবং তারপরও যেমনটি মার্ক্স জানতেন আমাদের সবারই অভ্যন্তরে আমরা আসলে নিরাপত্তা খুঁজি সেই একটি তীব্রতার সাথে যেমন নিরাপত্তা আমরা পাই কোনো সম্পর্কের মধ্যে। আমরা কারো মর্জিমতো কাজ থেকে বহিষ্কৃত হতে চাইনা, আমাদের প্রত্যাখানে শঙ্কা আছে। মার্ক্স জানতেন পুঁজিবাদ আমাদের ইচ্ছামতো ব্যবহার করে পরিত্যাগ করতে পারে, কারণ সেখানে সবকিছুই প্রয়োজন আর মূল্যের উপর নির্ভর করে। কিন্তু শ্রমিকের আবেগীয় সেই কামনার প্রতি মার্কসের সহমর্মিতা ছিল। কমিউনিজম, যদি আবেগ দ্বারা এটিকে বোঝা যায়, এটি হচ্ছে একটি প্রতিজ্ঞা যে, পৃথিবীর হৃদয়ে আমাদের সবসময় একটি জায়গা থাকবে, আমাদেরকে কখনো ছুড়ে ফেলা হবে না। এটাই গভীরভাবে মর্মভেদী।
তিন. শ্রমিকরা কম বেতন পায় আর পুঁজিপতিরা আরো ধনী হয়: এটাই পুঁজিবাদের ব্যাপারে মার্কসের প্রধানতম অস্বস্তি ছিল। বিশেষ করে তিনি বিশ্বাস করতেন যে পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের বেতন যথাসম্ভব সংকুচিত করে রাখেন বেশি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে, প্রফিট মার্জিন (যাকে তিনি বলেছিলেন primitive accumulation বা জার্মান ভাষায় Ursprüngliche Akkumulation); এবং শ্রমিকদের জন্য সবসময়ই কঠিন তাদের এই অবস্থার প্রতিবাদ করা। শুধুমাত্র যে তাদের আবশ্যিকভাবে কাজের প্রয়োজন তাই শুধু না, তাদের ভূস্বামী কিংবা চাকুরিদাতারা ইচ্ছা করলেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারেন চিরস্থায়ীভাবে তাদের এই দুর্গতিতে বন্দি করে রাখতে, জীবনযাত্রার মান বাড়িয়ে ও বেতন না-বাড়িয়ে। প্রলেতারিয়াতকে দুর্বল করে রাখার জন্য আধুনিক জীবনও বেশকিছু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে: ঘনবসতি, অসুস্থতা, অপরাধপ্রবণ শহর, কারখানায় দুর্ঘটনা। সংক্ষেপে মার্কস লিখেছিলেন, শ্রমিককে প্রায় নিরন্তরভাবে শোষণ করা যেতে পারে।
চার. পুঁজিবাদ খুবই অস্থিতিশীল: পুঁজিবাজারে ভরাডুবি বা কম্পিউটারনির্ভর স্টকমার্কেট আসার বহু আগেই মার্ক্স শনাক্ত করেছিলেন যে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধারাবাহিক বিপর্যয় দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। আংশিকভাবে এর কারণ পুঁজিবাদীরা ক্রমশবেশি লাভের জন্য বেশি ঝুঁকি নিতে চায়। আর তাদের এইসব জল্পনাকল্পনা বাজারে দ্রব্যমূল্য ও শ্রমবাজারকে অস্থিতিশীল করে। কিন্তু মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর দুর্বলতার কারণে পুঁজিবাদ নিয়ত পরিবর্তনশীল, অন্তর্নিহিতভাবে অস্থিতিশীলই শুধু না, মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্তর্নিহিতভাবে অস্থিতিশীল যা সারাক্ষণই নিজের কাছেই পরাজিত হয়, যেন কোনো এক জাদুকর, যে আর তার নিজের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা, যে শক্তিকে সে নিজেই ডেকে নিয়ে এসেছে অন্য জগৎ থেকে। কার্ল মার্কস বলেন পুঁজিবাদের সমস্যা এর ঘাটতি থেকে না, বরং এর প্রাচুর্য থেকে। আমাদের এখন প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত জিনিস আছে। আমাদের কারখানা এবং উৎপাদন পদ্ধতি এখন আগের চেয়েও অনেক দক্ষ, আমরা চাইলে এই গ্রহের প্রতিটি মানুষকে একটি গাড়ি উপহার দিতে পারি, কিংবা বাড়ি, ভদ্র স্কুল এবং হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে পারি। আমাদের খুব অল্প কয়েকজনের প্রয়োজন আছে কাজ করার, কিন্তু আমরা আমাদের এই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করছি না। মার্ক্স ভাবতেন এটাই অদ্ভুত, একধরনের অসুস্থ মর্ষকামিতার ফলাফল।
১৭০০ খ্রিস্টাব্দে কোনো জাতির খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিৎ করার জন্যে প্রয়োজন ছিল সেই জাতির সব পূর্ণবয়স্ক মানুষদের শ্রম। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে কৃষিকাজে কাজ করার জন্যে অনেক অল্পপরিমাণ মানুষের প্রয়োজন। গাড়ি বানানোর জন্য আসলেই তেমন কোনো শ্রমিকের দরকার নেই আর। বেকারত্ব বর্তমানে ভয়াবহ আর ক্ষতিকর একটি অবস্থা হিসাবে দেখা হয়। কিন্তু মার্ক্সেরদৃষ্টিভঙ্গিতে এটি সফলতার চিহ্ন। এটি অবিশ্বাস্যরকম উৎপাদনক্ষমতার ফলাফল। একশো মানুষের কাজ এখন একটা যন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব। কিন্তু তারপরও এখান থেকে ইতিবাচক কোনো উপসংহার না টেনে আমরা বেকারত্বকে দেখি একটি অভিশাপ এবং ব্যর্থতা হিসাবে। কিন্তু যৌক্তিকভাবে, অর্থনীতির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আমাদের আরো অনেককে বেকার করার ব্যবস্থা করা এবং এই বাস্তব সত্যটির জয়গান করা উচিত ব্যর্থতা নয় প্রগতির চিহ্ন হিসাবে। মার্ক্স বিশ্বাস করতেন যেহেতু আমরা সম্পদের সুষম বণ্টন করছি না সবার সাথে, বা বেকারত্বের জয়গান করার চেষ্টা করছি না, নানাধরনের অস্থিতিশীলতা, দুঃখ আর অস্থিরতার দ্বারা আমরা আক্রান্ত। তিনি লিখেছিলেন হঠাৎ করে সমাজ তার নিজেকে খুঁজে পায় সাময়িক বর্বরতার একটি পরিস্থিতি, এবং কেন? কারণ, অনেক বেশি সভ্যতা, অনেক বেশি শিল্প এবং অনেক বেশি বাণিজ্য।
পাঁচ. পুঁজিবাদ পুঁজিপতিদের জন্যও ভালো নয়: যদিও মার্ক্স পুঁজিপতি বা বুর্জোয়াদের রক্তপিপাসু ভ্যাম্পায়ারের সাথে কিংবা শত্রুভাবাপন্ন ভাই হিসাবে তুলনা করেছেন, তবে তিনি ভাবেননি যে তারা আসলে তাদের হৃদয় থেকেই অশুভ। বাস্তবিকভাবে তিনি বিশ্বাস করেন, তারা নিজেরাও এই পুঁজিবাদের শিকার। যেমন, তারা খুব ভালো করে জানেন বুর্জোয়া বিবাহের পশ্চাতে থাকা দুঃখ আর গোপন কষ্ট। তার সময়ের সচ্ছল পরিবারের মানুষরা তাদের পরিবার নিয়ে কথা বলতেন প্রায় শ্রদ্ধাপূর্ণ আর আবেগময়তার সাথে। কিন্তু মার্ক্স মনে করতেন বিবাহ আসলে বাণিজ্য বা ব্যবসার একটি সম্প্রসারিত রূপ। বিবাহের মাধ্যমে পুরুষের হাতে অর্থ বা পুঁজি সঞ্চিত হয়, যা পুরুষরা ব্যবহার করেন তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আদর্শায়িত কোনো বুর্জোয়া পরিবার বাস্তবিকভাবে নানা মানসিক চাপ, শোষণ এবং ক্ষোভের টানাপড়েনের শিকার। এবং তারা একসাথে থাকে ভালোবাসার জন্যে নয় বরং অর্থনৈতিক কারণে। মার্ক্স মনে করতেন, পুঁজিপতিরা নিশ্চয়ই এভাবে বাঁচতে চান না, তিনি শুধুমাত্র বিশ্বাস করতেন পুঁজিবাদী সমাজ সবাইকে বাধ্য করে তাদের জীবনের কেন্দ্রে অর্থনৈতিক স্বার্থটাকে গুরুত্ব দেবার জন্য যেন তারা আর গভীর আর সৎ সম্পর্ক যে কী সেটাও বিস্মরিত হয়। তিনি এই মনোজাগতিক প্রবণতার নাম দিয়েছিলেন commodity fetishism (Warenfetischismus), কারণ এটি আমাদের সেই দ্রব্যগুলোকে মূল্য দিতে বাধ্য করে যাদের কোনো নৈর্ব্যক্তিক মূল্য নেই, এবং আমাদের উৎসাহিত করে আমাদের সম্পর্কগুলোকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মূল্যায়ন করার জন্য।
মার্ক্সের কাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে: তিনি আমাদের সচেতন করেছিলেন এইসব সূক্ষ্ম প্রতারণাপূর্ণ কৌশলের ব্যাপারে, যেভাবে কোনো একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নানা বিচিত্র বিষয় নিয়ে মানুষের ধারণাগুলো প্রভাবিত করে। অর্থনীতি জন্ম দেয় এমন কিছু যাকে মার্ক্স বলেছিলেন ideology; ১৮৪৫ সালে তাঁর The German Ideology বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রতিটি যুগের শাসকশ্রেণীর ধারণাগুলো শাসন করার ধারণা।’ কোনো একটি পুঁজিবাদী সমাজ হচ্ছে সেটি, যেখানে বেশির ভাগ মানুষ, ধনী কিংবা গরিব, নানাধরনের যে- বিষয়গুলোয় বিশ্বাস স্থাপন করে সেগুলো আসলে একধরনের পূর্বনির্ধারিত মতামতপুষ্ট ধারণা যা সংশ্লিষ্ট সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে : যেমন যদি কোনো ব্যক্তি কাজ না করেন তিনি আসলেই মূল্যহীন, এবং যদি আমরা যথেষ্ট পরিমাণ কঠোর পরিশ্রম করি, তাহলে সামনে এগুতে পারব, এবং আমাদের যত সম্পত্তি থাকবে তত সুখী হব এবং সব মূল্যবান কিছুই (এবং মানুষ) সবসময়ই আরো অর্থ উপার্জন করতে সাহায্য করবে। সংক্ষেপে পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় অশুভ দিকটি হচ্ছে এটা নয় যে আমাদের শাসন করছে বা উপরে আছে যারা তারা দুর্নীতিগ্রস্থ, সেটা বাস্তব সত্য যে কোনো মানব প্রাধান্য পরম্পরায়, বরং পুঁজিবাদ আমাদের সবাইকে শেখায় আরো বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, প্রথানুবর্তী এবং রাজনৈতিকভাবে আত্মতুষ্ট হতে।
বিস্ময়করভাবে মার্ক্স খুব সামান্যই লিখেছেন একটি কমিউনিস্ট সিস্টেম কেমন দেখতে হতে পারে সে-বিষয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন তার লেখাগুলো মূলত একধরনের বর্ণনা, সেগুলো কোনো প্রেসক্রিপশন নয়, যা নির্দেশ করে কী ঘটতে পারে শুধু। যখন তাঁর এই অস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে (যেমন তার বক্তব্য dictatorship of the proletariat বা প্রলেতারিয়েতদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে), তিনি উল্টো তিরস্কার করে বলেছেন, তিনি রান্নার প্রণালী বা রেসিপি লিখতে চাননি ভবিষ্যতের কোনো রান্নাঘরের জন্য (তাঁর ভাষায় for the cook-shops of the future)। হয়তো তিনি বিজ্ঞতা এবং বিচক্ষণতার সাথে অনুভব করতে পেরেছিলেন, কত কঠিন হতে পারে ভবিষ্যতর রুচিবোধ সম্বন্ধে বর্তমানে বসে ভবিষ্যদ্বাণী করা, সেটি রান্না-বিষয়ে হোক কিংবা রাজনৈতিক বিষয়ে। তাসত্ত্বেও মার্ক্সের প্রস্তাবিত ইউটোপিয়ার কিছুদৃশ্য আমরা দেখতে পাই লুকিয়ে আছে তাঁর The Communist Manifesto রচনাটিতে। তার কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো এমন একটি পৃথিবীর কথা বলেছে যেখানে সম্পদের কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা থাকবে না, উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদও কেউ পাবেন না। সেখানে উচ্চ আয়করের ব্যবস্থা থাকবে উচ্চ আয়ের উপরে ভিত্তি করে আনুপাতিক হারে; ব্যাঙ্কিং, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং যানবাহন ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রিত হবে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থার অধীনে; সব শিশুর জন্য বিনামূল্যে শিক্ষাব্যবস্থার নিশ্চয়তা থাকবে। মার্ক্স এও আশা করেছিলেন সেই সমাজে প্রত্যেকটি মানুষ তার প্রকৃতি অনুযায়ী তাদের চরিত্রের ভিন্ন ভিন্ন দিক বিকাশ করার সুযোগ পাবে। দ্য জার্মান আইডিওলজি বইটিতে তিনি যেমন লিখেছিলেন, কোনো কমিউনিস্ট সমাজে, আমার জন্যে সম্ভব হবে আজকে একটা কাজ করা এবং কাল আরেকটা কাজ করা, সকালে শিকার করা, বিকালে মাছ ধরা, সন্ধ্যায় গবাদিপশু প্রতিপালন, রাতের খাবারের পর সমালোচনা করা, আমার মনে যা আছে সেটাই প্রকাশ করা, এর জন্য কখনোই আমাকে শিকারি, জেলে,রাখাল বা সমালোচক এর যে-কোনো একটি হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমাদের সুযোগ থাকবে ভিন্ন ভিন্ন অংশগুলোকে লালন করার, যেমন আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের বুদ্ধিমত্তা, আমাদের দয়াশীলতা এবং আমাদের তীব্রতম ইচ্ছাগুলো। এবং সবারই সামান্য কিছু সময় থাকবে দর্শনচর্চা করার।
মার্ক্স লন্ডনে আসার পর তাঁকে সবধরনের সহায়তা দিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগী ফ্রিয়েডরিখ এঙ্গেলস। এঙ্গেলস ছিলেন ধনী পরিবারের ছেলে, তার বাবা ম্যানচেস্টারে একটি কারখানার মালিক ছিলেন। পুঁজিবাদবিরোধী এক মানুষকে পুঁজিবাদের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এঙ্গেলসই মার্ক্সের সব ঋণ শোধ করে দেবার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, নিশ্চিত করেছিলেন তাঁর লেখা যেন প্রকাশিত হয়। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজন দুজনের জন্য চমৎকার কবিতাও লিখেছিলেন। তাঁর সময়ে বুদ্ধিজীবীমহলে মার্ক্স তেমন সম্মানিত কিংবা জনপ্রিয় কেউ ছিলেন না। তিনি তার বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন বৃটিশ মিউজিয়ামের রিডিংরুমে, যেখানে ধীরে ধীরে তিনি লিখেছেন পুঁজি নিয়ে তাঁর প্রায় অন্তহীন বইটি। তিনি এবং এঙ্গেলস সবসময় চেষ্টা করেছেন রাষ্ট্রীয় পুলিশ থেকে পালিয়ে বেড়াতে (তাদের মধ্যে ছিলেন মার্ক্সের নিজের শ্যালক, যিনি প্রুশিয়ায় গোপন পুলিশের প্রধান ছিলেন)। যখন ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে মার্ক্স মৃত্যুবরণ করেন, তখন তার কোনো রাষ্ট্র ছিল না, অল্পকিছু মানুষ তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। মার্ক্সের সমসাময়িক সময়ে প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রথাগত কোনো মানুষদের পক্ষে বিশ্বাস করা অসম্ভব ছিল যে একদিন তার ধারণাগুলো বিশ্বকে পুনর্নির্মাণ করবে। কিন্তু মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই সেটি ঘটেছিল। বিংশ শতাব্দীর কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আদর্শগত আন্দোলনের ভিত্তি ছিল তাঁর রচনাগুলো। আধুনিক সব সমস্যাগুলো নিয়ে মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অস্বাভাবিকরকম বিস্তৃত। তিনি চমৎকার শোনায় বেশকিছু শব্দও উদ্ভাবন করেছেন যেমন, dialectical materialism, কারণ তিনি আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিলেন আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা আর বাছবিচারগুলো সুবিশাল ঐতিহাসিক শক্তির সাথে যুক্ত করার জন্য। তিনি আমাদের সাহায্য করেছিলেন আমরা যেন আমাদেরকে আরো বিশাল, নৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রামের অংশ হিসাবে দেখি। তাঁর কাজ অনেক সময় সংশয়ের উদ্রেক করে, তার কারণ শুধুমাত্র তিনি তাঁর জীবদ্দশায় বেশ কয়েকবারই মন পরিবর্তন করেছিলেন। বরং আরো একটি কারণ ছিল, তিনি আধুনিক সমস্যাকে ব্যাখ্যা করতে নিজস্ব একটি ভাষা উদ্ভাবন করতে চেয়েছিলেন, যে ভাষা যেমন নির্দেশাত্মক নয় তেমনি কঠোরভাবে বৈজ্ঞানিকও নয়।
বিংশ শতাব্দীতে তাঁর ধারণাগুলো নিয়ে যা ঘটেছে সেটা বিবেচনা করে যেন আমরা তাঁর লেখাকে গুরুত্বহীন হিসাবে না ভাবি সেই বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। কারণ বর্তমান এই সময়ে মার্ক্স বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্যে। আমাদের অনেকেরই মতো তিনি বোঝার চেষ্টা করেছিলেন কেন আধুনিক অর্থনীতি এর বস্তুগত সমৃদ্ধির সাথে এত বেশি দুর্গতির কারণ হয়েছে। পুঁজিবাদের ক্ষমতা তাকে বিস্মিত করেছিল, যেভাবে এটি সুযোগ করে দিয়েছে ‘প্রকৃতির শক্তির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করার, পুরো মহাদেশ পরিষ্কার করা হয়েছিল সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য, নদী খনন করা হয়েছে, মাটি থেকে যেন জাদুবলে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরো জনগোষ্ঠী’। কিন্তু তিনি এটাও দেখেছিলেন এই পুঁজিবাদ আমাদের আরো বেশি সুখী, বিজ্ঞ আর দয়ালু বানাচ্ছে না, অন্তর্গতভাবে আরো বেশি পরিপূর্ণতার দিকে এটি আমাদের পথ দেখাতে পারেনা।
মার্ক্সের ধারণায় অনুপ্রাণিত ইতিপূর্বের রাষ্ট্রকাঠোমোগুলোর কথা বিবেচনা করুন, মার্ক্সের পূর্বধারণাকৃত বিপ্লবের বাস্তবায়ন করে কোনোকিছু উন্নতি করার খুব-একটা সম্ভাবনা নেই, কিন্তু আমাদের অবশ্যই গভীরভাবে ভাবতে হবে পুঁজিবাদের প্রধান সমস্যাগুলো নিয়ে মার্ক্স কী ভেবেছিলেন। দীর্ঘ একটি সময় ধরে মার্ক্সবাদী বলতে বুঝিয়েছে আপনাকে তাঁর ধারণার একটি বিশাল অংশের সাথে একমত হতে হবে; পৃথিবীর অসুখ দূর করার জন্য তার সমাধানগুলোর সাথে একমত হতে হবে। এবং সেই বিষয়গুলো এত অদ্ভুত যে তিনি আর যা-কিছু বলেছিলেন সেগুলো অবহেলিত হয়েছে। কিন্তু মার্ক্স ছিলেন সেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের শুরুর দিনগুলোয় কোনো মেধাবী চিকিৎসকের মতো। তিনি রোগের প্রকৃতিটি নির্ণয় করতে পেরেছিলেন, যদিও তাঁর কোনো ধারণা ছিল না কীভাবে সেটি নিরাময় করতে হবে। কিছু কিছু পদক্ষেপের উপর থেকে তিনি তাঁর নজর সরাতে পারেননি, যে পদক্ষেপগুলো হয়তো সম্ভব ছিল ১৮৪০-এর দশকে, তবে তারা আর এখন দিকনির্দেশনা হতে পারেনা। ইতিহাসের এই মুহূর্তে, আমাদের সবারই কিছুটা মার্ক্সবাদী হওয়া প্রয়োজন সেই অর্থে যে আমাদের বর্তমান সমস্যাগুলো শনাক্তকরণে তাঁর সাথে আমরা একমত। সেইসব সমাধানগুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে যেগুলো আমাদের সময়ে কার্যকরী। আর লোভনীয়ভাবেই এই সমাধানগুলো সত্যি আছে নানা গবেষণাপত্র কিংবা অর্থনীতির বইয়ের পাতায়, যা সবকিছুই উপেক্ষা করেছে গণমাধ্যমগুলো। আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন কীভাবে একটি অর্থনীতি গড়ে তোলা উচিত যা আমাদের জন্য আরো বেশি সমৃদ্ধিই আনবে না বরং তৈরি করবে প্রকৃতি, অর্থ এবং আমাদের নিজেদের সাথে এবং পরস্পরের মধ্যে একটি আরো উত্তম সম্পর্ক সৃষ্টি করতে সহায়ক হবে। আমাদের প্রয়োজন নেই প্রলেতারিয়েতদের একনায়কতন্ত্র, কিন্তু আমাদের পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন কেন আমরা শ্রমের মূল্য দিই এবং সেই শ্রম থেকে আমরা কী পেতে চাচ্ছি। আমাদের উচিত হবে না ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা বিলোপ করা, কিন্তু আমাদের প্রয়োজন অর্থ এবং ভোগের সাথে আরো বিচক্ষণ ও সত্যিকারের সম্পর্ক। এবং আমাদের অবশ্যই পুঁজিবাদকে সংস্কার করা শুরু করতে হবে, তবে শুধুমাত্র ব্যাংকের প্রধান কর্মকর্তাদের বহিষ্কার করে নয়, আমাদের নিজেদের মনে যা আছে সেখানে আমূল পরিবর্তন এনে। শুধুমাত্র তখনই আমরা সত্যিকারভাবে পারব এমন কোনো অর্থনীতিকে কল্পনা করতে যেটা শুধু উৎপাদনশীল আর উদ্ভাবনীমূলকই হবে না, বরং মানুষের স্বাধীনতা আর পরিপূর্ণতা অর্জনেও সহায়ক হবে। যেমন মার্ক্স ঘোষণা করেছিলেন philosophers have only interpreted the world in various ways. The point, however, is to change বা দার্শনিকরা শুধুমাত্র ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে, যেটা দরকার, সেটি হচ্ছে পরিবর্তন করা।