অধ্যায় ২৮ : বেড়ে ওঠার জন্যে পরিসর – জন স্টুয়ার্ট মিল
কল্পনা করুন শৈশবে আপনাকে অন্য সব শিশু থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে, সবার সাথে খেলার পরিবর্তে কোনো গৃহশিক্ষকের কাছে আপনি গ্রিক আর বীজগণিত শিখছেন, অথবা খুবই বুদ্ধিমান প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ব্যক্তির সাথে কথোপকথনে ব্যস্ত আপনি। সেক্ষেত্রে কেমনভাবে বেড়ে উঠতে পারেন আপনি? মোটামুটি এমনটাই ঘটেছিল জন স্টুয়ার্ট মিলের (১৮০৬-১৮৭৩) সাথে। তিনি মূলত ছিলেন শিক্ষা-সংক্রান্ত একটি গবেষণা। তাঁর বাবা জেমস মিল, দার্শনিক জেরেমি বেনথামের একজন বন্ধু, জন লকের সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি নিজেও ধারণ করতেন, একটি শিশুর মন হচ্ছে শূন্য, খালি স্লেটের মতো। জেমস মিল বিশ্বাস করতেন, যদি আপনি সঠিকভাবে কোনো শিশুকে বড় করতে পারেন, একজন প্রতিভাবান মানুষ হিসাবে সেই শিশুটির বেড়ে ওঠার খুব ভালো একটি সম্ভাবনা থাকবে। সুতরাং জেমস মিল তার ছেলে জনকে ঘরে রেখেই শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করেন, নিশ্চিত করেন তার ছেলে যেন সমবয়সী অন্য শিশুদের সাথে খেলাধুলা করে কোনো সময় নষ্ট বা খারাপ কোনো অভ্যাস রপ্ত না করে। তবে এটি শুধুমাত্র তাকে জোর করে কিছু শেখানো, বা মুখস্থ করানো বা তেমন কোনোকিছু ছিল না। জেমস তাকে সক্রেটিসের মতো পাল্টা প্রশ্ন করার পদ্ধতি ব্যবহার করে শিখিয়েছিলেন, তার ছেলেকে উৎসাহ দিয়েছিলেন কোনো ধারণা গিলে খাবার চেয়ে বরং যা শিখছে তা যেন সে ভালো করে যাচাই করে দেখে।
বিস্ময়কর ফলাফল যা হয়েছিল তাহলো, মাত্র তিন বছর বয়সেই জন স্টুয়ার্ট মিল প্রাচীন গ্রিক পড়তে শুরু করেছিলেন, ছয় বছর বয়সে তিনি রোমের একটি ইতিহাস লিখেছিলেন, সাত বছর বয়সে তিনি প্লেটোর ডায়ালগ বুঝতে পারতেন এর মূল ভাষায়। আট বছর বয়সে তিনি ল্যাটিন শিখতে শুরু করেন। বারো বছর বয়সেই ইতিহাস, অর্থনীতি এবং রাজনীতি সম্বন্ধে তার বেশ স্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠেছিল, এবং বেশ জটিল গাণিতিক সমস্যা তিনি সমাধান করতে পারতেন এবং বিজ্ঞানের প্রতি তার তীব্র আর বুদ্ধিদীপ্ত একটি আগ্রহ ছিল। তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান, তার বয়স যখন বিশের দশকে, তার সময়ে তিনি অন্যতম মেধাবী চিন্তাবিদ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যদিও কখনোই সত্যিকারভাবে তার অদ্ভুত শৈশবের মানসিক চাপটি তিনি এড়াতে পারেননি, তাঁর নিঃসঙ্গতা আর জীবনের অন্যসব সম্পর্কের সাথে বিচ্ছিন্নতা হয়তো সেটারই সাক্ষ্য বহন করে।
তবে যাই হোক, তিনি একধরনের প্রতিভায় রূপান্তরিত হয়েছিলেন, সুতরাং বলা যেতে পারে তাঁর বাবার পরীক্ষা কাজ করেছিল। তিনি সকল অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন সূচনাপর্বের একজন নারীবাদী (জন্মনিয়ন্ত্রণের সপক্ষে প্রচারণার জন্যে তাকে গ্রেফতার হতে হয়েছিল), রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং মহান এক দার্শনিক, হয়তো ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা দার্শনিক ছিলেন তিনি। তিনি প্রতিপালিত হয়েছিলেন ইউটিলিটারিয়ান বা উপযোগবাদের মতাদর্শে এবং তাঁর উপর জেরেমি বেনথামের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। মিল প্রতি গ্রীষ্মকালই সারের গ্রামে বেনথামের বাসাতেই কাটাতেন। কিন্তু যদিও মিল বেনথামের সাথে একমত হয়েছিলেন যে সঠিক কাজ হচ্ছে সবসময় সেটি, যা সবচেয়ে বেশি সুখের কারণ হয়, কিন্তু তিনি তাঁর শিক্ষকের সুখের ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। বেনথামের সংজ্ঞাটিকে তাঁর কাছে মনে হয়েছিল স্থুল, সুতরাং তরুণ মিল বেনথামের তত্ত্বটির নিজের একটি সংস্করণ প্রস্তাব করেছিলেন। উচ্চমানের ও নিম্নমানের সুখের মধ্যে পার্থক্য করেছিল তাঁর তত্ত্বটি। যদি বাছাই করার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে কর্দমাক্ত খোঁয়াড়ে গড়াগড়ি করে খাওয়া চিবানো পরিতুষ্ট শূকর হবার চেয়ে কি একজন দুঃখী বিষণ্ন মানুষ হওয়া উত্তম হবে? মিল ভাবতেন খুব স্পষ্ট কারণে সুখী শূকর হবার চেয়ে আমরা বরং একজন দুঃখী মানুষ হতে চাইব। কিন্তু সেটি স্পষ্টতই বেনথামের প্রস্তাবনা-বিরোধী। বেনথাম, যদি আপনি মনে করতে পারতেন, বলেছিলেন, যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সুখপূর্ণ অভিজ্ঞতা; কীভাবে সেটি সৃষ্টি হলো সেটি ভাবার কোনো দরকার নেই। মিল একমত ছিলেন না, তিনি ভাবতেন আপনি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের সুখ পেতে পারেন, এবং তাদের কোনো-কোনোটি অন্যগুলোর চেয়ে অনেক ভালো। আর এতবেশি ভালো যে নিম্নমানের কোনো পরিমাণ সুখই উচ্চমানের সুখের ক্ষুদ্রতম পরিমাণের কখনোই সমতুল্য হতে পারবে না। নিম্নমানের সুখগুলো, যেমন প্রাণীদের মধ্যে যে সুখের অভিজ্ঞতাগুলো আমরা দেখি, সেগুলো কখনোই উচ্চতর, বুদ্ধি বৃত্তিক সুখগুলো, যেমন বই পড়ার কিংবা সংগীত শোনার সুখগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। মিল আরো যোগ করেছিলেন, কোনো সন্তুষ্ট নির্বোধ হবার চেয়ে অসন্তুষ্ট সক্রেটিস হওয়া উত্তম। তার কারণ দার্শনিক সক্রেটিস তার চিন্তা থেকে এতবেশি সূক্ষ্ম সুখ সংগ্ৰহ করতেন, কোনোদিনও কোনো নির্বোধ যা অনুভব করার সুযোগ পাবেনা।
মিলকে কেন বিশ্বাস করব? তাঁর উত্তর ছিল, যে-কোনো মানুষ, যারা উচ্চ ও নিম্ন উভয় ধরনের সুখই অনুভব করে তারা উচ্চমানের সুখকে শ্রেয়তর মনে করে। শূকর পড়তে পারে না, কিংবা সংগীতও শুনতে পারেনা, সুতরাং এই বিষয়ে তার কোনো মতামত আমাদের আলোচনায় পড়বে না। যদি কোনো শূকর পড়তে পারত, তাহলে সে পড়াটাই শ্রেয়তর মনে করত কাদায় গড়াগড়ি করার চেয়ে।
মিল এমনটাই ভাবতেন, কিন্তু কিছু মানুষ বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন যে মিল ধরে নিয়েছেন যে সবাই কাদায় গড়াগড়ি করার চেয়ে পড়তে আনন্দ পাবেন। আরো জটিলতা হচ্ছে, যখনই মিল সুখের নানা গুণাবলি (যেমন উচ্চমান এবং নিম্নমান) ও তাদের পরিমাণ নিয়ে আলোচনা করেছেন, বিষয়টি আরো কঠিন হয়ে গেছে কারো পক্ষে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য, কীভাবে আপনি হিসাব-নিকাশ করবেন কোটি চাইছেন। বেনথামের দৃষ্টিভঙ্গির একটি ভালো গুণ ছিল এর সরলতা; সব আনন্দ আর কষ্টকে যেখানে মাপা হয়েছে একই বিনিময়মূল্য দিয়ে। মিল কোনো উপায় রাখেননি, যার মাধ্যমে উচ্চ আর নিম্নমানের সুখের মূল্যের মধ্যে বিনিময় হারটি আমরা বের করতে পারি।
মিল তার উপযোগবাদী চিন্তা করেছিলেন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। তিনি ভাবতেন যে, মানুষ খানিকটা গাছের মতো। আপনি যদি বেড়ে ওঠার জন্য গাছকে যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা না দেন, এটি দুর্বল ও বাঁকা হয়েই বেড়ে উঠবে, কিন্তু সঠিক জায়গা পেলে এটি এর পুরো সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অনেক বড়, ঋজু আর শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বেড়ে উঠবে। একইভাবে, সঠিক পরিস্থিতিতে, মানুষও ভালো করে, এবং সেই মানুষটির জন্যেই ফলাফল শুধু ভালো হয় না, কল্যাণ হয় সমগ্র সমাজেরও, এটি সুখকে যতটা সম্ভব ততটা বৃদ্ধি করে। ১৮৫৯ সালে তিনি একটি সংক্ষিপ্ত, অনুপ্রেরণাদায়ক বই লেখেন তার দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে। যদি আমরা প্রতিটি মানুষকে যথেষ্ট পরিমাণ সুযোগ ও পরিসর দিতে পারি, যা তারা প্রয়োজনীয় মনে করে, সেটি হবে সমাজসংগঠনের জন্য সবচেয়ে উত্তম উপায়। সেই বইটির নাম On Liberty এবং বইটি এখনও ব্যাপকভাবেই পড়া হয়। Paternalism (ল্যাটিন প্যাটের বা পিতা) হচ্ছে কাউকে তার নিজের মঙ্গলের কিছু করার জন্য বাধ্য করা (যদিও এটি একইভাবে Maternalism হতে পারে, ল্যাটিন ম্যাটের যার অর্থ মা)। যদি শৈশবে আপনাকে জোর করে সব্জি খাওয়ানো হয় তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন এই ধারণাটি আসলে কী। আপনি সবুজ সব্জি খেলে অন্য কারো লাভ নেই, কিন্তু তারপরও আপনার মা-বাবা সেটি আপনাকে দিয়ে জোর করে করানোর চেষ্টা করেন, কারণ সেটি আপনার জন্য মঙ্গলজনক। মিল ভাবতেন Paternalism ঠিক আছে যখন সেটি নির্দেশিত শিশুদের প্রতি : শিশুদের দরকার আছে সুরক্ষিত করে রাখার, তাদের নিজেদের কাছ থেকে ও তাদের আচরণকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে। কিন্তু সভ্যসমাজে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি Paternalism অগ্রহণযোগ্য। একটিমাত্র ক্ষেত্রে তা যথার্থ হতে পারে যখন কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির কাজ দ্বারা অন্য কারো ক্ষতি হবার ঝুঁকি থাকে অথবা তাদের খুব গুরুতর মানসিক সমস্যা থাকে।
মিলের বার্তাটি ছিল খুব সাধারণ, যা পরিচিত Harm Principle হিসাবে। প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার থাকা উচিত, তার যেমন ইচ্ছা, যতক্ষণ না তার সেইভাবে বাঁচার প্রক্রিয়ায় অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ডে এটি বেশ বৈপ্লবিক একটি ধারণা, যখন বহু মানুষই ভাবতেন যে সরকারের দায়িত্বের একটি অংশ হচ্ছে মানুষের উপর ভালো নৈতিক মূল্যবোধ আরোপ করা। মিল তা মনে করতেন না। তিনি ভাবতেন যে অপেক্ষাকৃত বড় মাত্রার সুখ আসবে যদি মানুষকে তার আচরণের ক্ষেত্রে আমরা বেশি স্বাধীনতা দেই। এবং মানুষ কী করবে সেটি সরকারই তা নির্দেশনা দেবে, শুধুমাত্র এই বিষয়টিই মিলকে চিন্তিত করেনি, তিনি ঘৃণা করতেন আরেকটি বিষয়, যাকে তিনি বলতেন tyranny of the majority বা সংখ্যাগরিষ্ঠের নিপীড়ন, যেভাবে সামাজিক চাপগুলো কাজ করে বহু মানুষের উপর, তারা যা হতে চায় বা করতে চায়, সেইসব ক্ষেত্রগুলোয় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে। অন্যরা হয়তো ভাবছেন তারা জানেন কোটি আপনাকে সুখী করবে। কিন্তু তারা সাধারণত ভুল করেন। আপনি অনেক ভালো জানেন তাদের চেয়ে আপনি আপনার জীবন নিয়ে আসলেই কী করতে চান। এবং এমনকি যদি আপনি সেটি নাও জানেন, মিল যুক্তি দেন, প্রত্যেকটি মানুষকে একইভাবে জীবন কাটাতে বাধ্য না করে বরং আমাদের সবাইকে নিজের মতো করে ভুল করার সুযোগ দেয়া উচিত। উপযোগবাদের ধারণার সাথে এটি মানানসই, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করার চেয়ে বরং বৃদ্ধি করলে এটি সামগ্রিক সুখের পরিমাণ বৃদ্ধি করবে।
মিল মনে করতেন, বাকি সবার চেয়ে বিশেষ করে প্রতিভাবানদের (তিনি নিজেও তাদের একজন ছিলেন) বিকশিত হবার জন্যে প্রয়োজন আরো বেশি স্বাধীনতা। তারা কদাচিৎ সমাজের ধরাবাঁধা নিয়মের আওতায় পড়েন বা কীভাবে তাদের আচরণ করা উচিত সে-বিষয়ে সমাজের প্রত্যাশার সাথে প্রায়শই তাদের আচরণ সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এবং প্রায়শই তাদের মনে হতে পারে খ্যাপাটে। যদি আপনি তাদের বিকশিত হবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, তাহলে আমরা সবাই সুফল পেতে ব্যর্থ হব, কারণ তারা সেই পরিস্থিতিতে তাদের সম্ভাবনা অনুযায়ী সমাজের কোনো অবদান রাখতে পারবেনা। সুতরাং যদি আপনি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সুখ অর্জন করতে চান, মানুষকে তাদের নিজেদের মতো জীবন কাটাতে দিন, কোনো ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপ ছাড়াই, যদি না,অবশ্যই, তাদের কাজের মাধ্যমে অন্য কারো ক্ষতি হবার ঝুঁকি থাকে। যদি আপনি মনে করেন যে তারা যা করছে তা আপত্তিকর, সেটি কিন্তু কোনো ভালো কারণ না তাদের সেভাবে জীবন কাটাতে বাধা দেবার জন্য। মিল খুব স্পষ্ট ছিলেন এই বিষয়ে কারো ক্ষতি করা আর কারো মনে আপত্তির অনুভূতি সৃষ্টি করা খুবই ভিন্ন ব্যাপার, দুটো বিষয়কে কখনোই এক করে দেখা উচিত না। মিলের এই অবস্থানের বেশকিছু অস্বস্তিকর পরিণতি আছে। একটি মানুষকে কল্পনা করুন, যার কোনো পরিবার নেই, যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতি রাতে সে দুই বোতল ভদকা পান করবে, খুব সহজ যে কারোর জন্যে বোঝা যে, লোকটি মদ্য পান করে তার জীবনের ইতি টানতে চাইছে। এখানে আইনের কি উচিত হবে হস্তক্ষেপ করে তাকে থামানো? মিল মনে করতেন, না, যদি না অন্য কারোর জন্যে লোকটির কাজ ঝুঁকিপূর্ণ প্রমাণিত হয়। আপনি তাকে বোঝাতে পারেন, বলতে পারেন সে তার জীবন নষ্ট করছে, কিন্তু কারোরই উচিত হবে না তার জীবনযাত্রা বদলাতে তার উপর জোর খাটানোর প্রচেষ্টা করা। সরকারের উচিত হবে না তাকে মদ্যপান করে মারা যাওয়া থেকে ঠেকাতে। এটি তার স্বাধীন ইচ্ছা। কিন্তু এটি তার স্বাধীন ইচ্ছা হবে না যদি তার উপর কোনো শিশুর প্রতিপালনের দায়িত্ব থাকে। কিন্তু যেহেতু তার উপর কেউ নির্ভর করে নেই, সে তার ইচ্ছামতো যা-কিছু করতে পারে। কীভাবে কেউ বাঁচবে সেই স্বাধীনতা ছাড়াও, মিলের মতে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হচ্ছে সবার জন্যে তাদের পছন্দমতো চিন্তা আর কথাবলার স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করা। সমাজের জন্যে সব বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা খুবই কার্যকরী একটি বিষয় বলে তিনি মনে করতেন, কারণ এটি মানুষদের কঠোরভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে কী তারা বিশ্বাস করে, যদি ভিন্নমত-পোষণকারী কেউ আপনার দৃষ্টিভঙ্গি চ্যালেঞ্জ না করে, তাহলে সম্ভাবনা আছে সেইসব ধারণাগুলো ‘মৃত মতবাদ’ বা সংস্কার হিসাবে ধারণ করার, যাকে আপনি আসলেই সুরক্ষা করতে পারবেন না। তিনি বাকস্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন সেই পর্যায় অবধি যতক্ষণ কিনা এটি হিংস্রতার জন্ম দেয়। একজন সাংবাদিক, তিনি বিশ্বাস করতেন, অবশ্যই স্বাধীন হবে তার মুক্তচিন্তা ও মতামত প্রকাশে, কোনো সম্পাদকীয়তে যেমন তিনি বলতে পারেন, শস্য মজুতদার ব্যবসায়ীরা গরিবদের অভুক্ত থাকার কারণ, কিন্তু যদি তিনি হাতে প্ল্যাকার্ড ও উত্তেজিত জনতা নিয়ে কোনো শস্যব্যবসায়ীর বাড়ির সামনে জমায়েত হন, তাহলে তিনি হিংস্রতা উসকে দিচ্ছেন, যা মিলের Harm Principle বিরোধী।
মিলের সাথে অনেকেই একমত হননি, কেউ ভেবেছেন স্বাধীনতার ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি মূলত সেই ধারণাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, যেখানে এককভাবে কোনো মানুষ তার জীবন সম্বন্ধে কী ভাবে সেটাই শুধু গুরুত্বপূর্ণ (মানে অনেক বেশি ব্যক্তিতান্ত্রিক, অবশ্যই রুশোর স্বাধীনতার ধারণা থেকে এটি ব্যতিক্রম); অন্যরা মিলকে দেখছেন অতিসহনশীল একটি সমাজের দরজা-উন্মুক্তকারী হিসাবে, যা চিরকালের জন্য সবার নৈতিকতাকে ধ্বংস করবে। তার সমসাময়িক জেমস ফিৎসজেরাল্ড স্টিফেন, যুক্তি দিয়েছিলেন যে বেশিরভাগ মানুষকে বাধ্য করা দরকার একটি সংকীর্ণ পথে চালনা করার জন্য, খুব বেশি স্বাধীনতা তাদের দেয়া যাবে না, কীভাবে তারা তাদের জীবন কাটাবেসেই বিষয়ে খুব বেশি বাছাই করার স্বাধীনতা তাদের দেয়া যাবে না, কারণ কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অনেকেই ভুল আর আত্মবিনাশী সিদ্ধান্ত নেবেন তাদের নিজেদের জন্য। একটি বিশেষ ক্ষেত্রে মিল বিশেষভাবে বৈপ্লবিক ধারণা পোষণ করতেন, সেটি হচ্ছে নারীবাদ, তিনি হচ্ছেন সূচনাপর্বের একজন নারীর অধিকার আদায় সংগ্রামের কর্মী। ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডে বিবাহিত রমণীদের কোনো অধিকার ছিল না সম্পত্তির মালিক হবার, এবং তাদের স্বামীদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবার জন্য কোনো আইনী আশ্রয়ও ছিল না। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মিল তার The Subjection of Women-এ যুক্তি দেন, দুটি লিঙ্গকে সমান মর্যাদায় সমাজে ও আইনের চোখে দেখা উচিত। তাঁর সময়ে অনেকেই দাবি করছেন নারীরা পুরুষদের তুলনায় প্রাকৃতিকভাবেই নিম্নপর্যায়ের। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, কীভাবে এই মানুষগুলো তাদের সেই সিদ্ধান্তে এসেছেন, যখন তাদেরকে তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহার করে বিকশিত হবার সুযোগই দেয়া হচ্ছে না? তাদেরকে উচ্চতর শিক্ষা এবং বহু পেশা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। সর্বোপরি, তিনি দুটি লিঙ্গের মধ্যে আরো বেশি সাম্য চেয়েছিলেন। বিয়ে হওয়া উচিত সমমানের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব, তিনি প্রস্তাব করেছিলেন। বিধবা হ্যারিয়েট টেলরের সাথে তার নিজের বৈবাহিক জীবন তেমনই ছিল, যদিও তারা সেই সম্পর্কে প্রবেশ করেছিলেন অনেক বেশি বয়সে, তবে দুজনেই অনেক সুখী হয়েছিলেন। তারা পরস্পরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন (এমনকি হয়তো প্রেমও ছিল তাদের) যখন হ্যারিয়েটের প্রথম স্বামী জীবিত ছিলেন। ১৮৫১ অবধি মিলকে অপেক্ষা করতে হয়েছে হ্যারিয়েটের দ্বিতীয় স্বামী হবার জন্য। তিনি মিলকে সাহায্য করেছিলেন On Liberty আর The Subjection of Women দুটি বই লেখার জন্য, তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বইদুটি প্রকাশের আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ১৮৫৯ সালে তাঁর বিখ্যাত On Libertyপ্রকাশিত হয়। সেই বছর আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি ছিল চার্লস ডারউইনের ‘অন দি অরিজিন অব স্পিসিস’।