2 of 2

অদ্ভুত এক হাওয়া – বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

অদ্ভুত এক হাওয়া – বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

আর একটু হলেই ট্রেনটা বেরিয়ে যেত। দুটো লোক সামনের কামরার দরজা আটকে দাঁড়িয়েছিল। অরূপ প্রায় তাদের ঠেলেই মনীষাকে তুলে দিল। ওভাবে উঠতে গিয়ে শাড়িটা গোড়ালি ছাড়িয়ে একটু উঁচুতে উঠে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে নামিয়ে দিতে গিয়ে নীচে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুটোর দিকে চোখ পড়ে গেল। তাকিয়ে আছে ওর পা—র দিকে। মনীষা অনেক পুরুষ মানুষের তাকিয়ে থাকা দেখেছে। কিন্তু এদের দৃষ্টি অদ্ভুত, আলাদা।

সবে নড়ে উঠেছে ট্রেন, অরূপ কাঁধের ব্যাগ আর দু—হাতে দুটো সুটকেস নিয়ে কোনোরকমে উঠে পড়ল। ট্রেনটা এবার সত্যিই চলতে শুরু করেছে। বুক ভরে নিশ্বাস নিল অরূপ। ছাড়ল অনেকটা সময় নিয়ে। তারপর তাকাল মনীষার দিকে। যৎসামান্য হাসি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েও পারল না মনীষা। চোখ ফিরিয়ে নিল জানালা দিয়ে বাইরে। দূরে ছুটে চলা টিমটিমে দু—একটা আলোর অন্ধকারের ভেতরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে দু—এক ফোঁটা। বৃষ্টির ওপারে মেঘ। মেঘের ওপারে ছুটে চলেছে চাঁদ ট্রেনের পাশাপাশি।

বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সেই কাকসকালে, প্রায় মশারির ভেতরে। ঘুমের মধ্যে মনীষা তখন জড়িয়ে শুয়েছিল অণিমাকে। সাতাশ বছর আগে অণিমার পেটের ভেতর যখন একটু একটু করে বেড়ে উঠছে মনীষা তখন থেকেই অণিমার গায়ের গন্ধের নেশা ধরে গিয়েছিল। ঘুম পেলে সেই গন্ধটা তার নাকে এসে লাগত। আজ সকাল পর্যন্ত ছিল সেই গন্ধটা। এখন নেই। নেই? খুব জোরে নিশ্বাস নিয়ে গন্ধটাকে খুঁজতে গিয়ে চিকচিক করে উঠল চোখের তলা। এই নেশাটার কথা অরূপ জানে না।

—চলো, ভেতরে যাই। সুটকেস দুটো তুলে নিয়ে ভেতরে এগিয়ে যেতে লাগল অরূপ। তারপর কী ভেবে বলল—তুমি বরং দাঁড়াও। আমি দেখে আসি আগে বসার জায়গা পাওয়া যায় কিনা।

মনীষা মাথা নেড়ে তাকিয়ে থাকল সুটকেস দুটোর দিকে। নতুন। আজ সকালবেলা কিনেছে বর্ধমানের জামির স্টোর্স থেকে। নীলিমার বাড়িতে জমিয়ে রাখা শাড়ি, নেলপালিশ, সেন্ট, চপ্পল থেকে শুরু করে অরূপের জামাকাপড়, বই, গানের ক্যাসেট, ছোটো ক্যাসেট প্লেয়ার—সব ও দুটোর মধ্যে। তারপর বাস ধরে দুর্গাপুরে ম্যারেজ—রেজিস্টারের অফিস। তারপর শ্যামল নীলিমা দুলাল নিখিল শাশ্বতীদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া ঠাট্টাইয়ার্কি করতে কখন সময় গড়িয়ে গেছে আটটায় কারোই খেয়াল ছিল না। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল প্রায় সারাক্ষণ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল শাশ্বতী।

—মা এতক্ষণে পায়ে চটি গলিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু বলে আসিনি।

উঠে দাঁড়াল সবাই। সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া ট্রেনের সময়ও হয়ে এসেছে।

জিনিসপত্র নিয়ে স্টেশনের রিকশায় উঠে বসার পর যতদূর চোখ চলে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল মনীষা। কতদিন পর আবার দেখা হবে। যদি কোনোদিন আর দেখা না হয়? এতক্ষণে শ্যামল আর নীলিমা ঘুমিয়ে পড়েছে। শাশ্বতী হয়তো নিখিলকে দেখছে স্বপ্নে। দুলাল তার চিলেকোঠার ঘরের আলো নিবিয়ে বিছানায় উড়িয়ে নিয়ে এসেছে আরতিকে, কলকাতার বিডন স্ট্রিটে বিয়ে হয়ে যাওয়া স্বামীর পাশ থেকে। শুধু বর্ধমানে তাদের বাড়িটায় এখনও জেগে আছে বিকাশ তার মেয়ে মনীষার জন্য। আর বারবার ছিঁড়ে যাওয়া তন্দ্রার ভেতরে চোখের জল বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে অণিমার মুখ।

হঠাৎ চোখ তুলে তাকাল মনীষা। সেই দু—জন লোক। তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনীষা বুঝতে পারল অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে। কখন যে ওরা ট্রেনে চেপে বসেছে খেয়ালই করেনি মনীষা। মুখ ফিরিয়ে নিল। দেখতে পেল অরূপ ফিরে আসছে দু—হাতে সুটকেস নিয়ে। চোখে একরাশ বিরক্তি।

—কোনো জায়গা নেই। আন—রিজার্ভ কামরা। লোকজন থিকথিক করছে। এই সুটকেসের ওপর বসে রাত কাটিয়ে দিতে হবে। পারবে?

মনীষা মাথা নাড়ল।—পারব।

অরূপ সুটকেস দুটো পাশাপাশি রাখল অন্যদিকের দরজা ঘেঁষে।

—যতক্ষণ এদিকটায় স্টেশন না আসছে বসতে পারবে। চাইলে ঘুমাতেও পারো। আমি জেগে থাকব।

—পাহারা দেবে আমাকে? আলতো হেসে বলল মনীষা। তারপর কী মনে পড়ে যেতে আড়চোখে তাকিয়ে দেখল লোক দুটো তখনও তাকিয়ে আছে তার দিকে। পলক পড়ছে না। যেন মনীষার সবটাই দেখতে পাচ্ছে। অদ্ভুত তো! আঁচলটা জড়িয়ে নিল। তাকাল অরূপের দিকে। বুঝতে পারল অরূপও দেখেছে ওদের। কিন্তু লোক দুটোর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।

—জল খাবে?

মাথা নেড়ে না বলল মনীষা। বদলে যাচ্ছে ট্রেনের শব্দ। একটা ব্রিজের ওপর দিয়ে নদী পেরোচ্ছে ট্রেনটা। সব কিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে ভাবতে। যেন স্বপ্ন—দুঃস্বপ্নের মাঝখানের কোন সময় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। বাবার ‘না’ বলে চিৎকার করে ওঠা এখনও শুনতে পাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছে সাতাশ বছরের মনীষাকে জোর করে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেবার শব্দ, শুনতে পাচ্ছে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে মা—র কান্না, কল থেকে জল পড়ে বাথরুম ভেসে যাবার শব্দ, শুনতে পাচ্ছে অরূপের টেলিফোন বেজে চলার শব্দ। কেউ তুলছে না। তোলা বারণ। বন্ধ ঘরে চেয়ারে পা তুলে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে থাকতে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেদিন। ঘুম ভেঙেছিল দরজা দিয়ে খবরের কাগজ ঢুকে পড়ার শব্দে। আর তখনই মনীষা ঠিক করে নিয়েছিল কী করবে। অরূপের দিকে তাকাল। একটা সিগারেট ধরিয়েছে। আশ্চর্য সহজ মুখের মধ্যে সবচেয়ে গভীর দুটো চোখ। আর ওর হাতের দৈবে পাওয়া আঙুলগুলোর মতো সুন্দর কারও আঙুল দেখেনি মনীষা। ওই আশ্চর্য চোখ দুটোর জন্য, আঙুলগুলোর জন্য সবকিছু করতে পারে মনীষা। ঝরে যেতে পারে, মরে গিয়ে বেঁচে উঠতে পারে আবার। মনীষার নিজের চোখও কম সুন্দর নয়। ছোটোবেলায় বাবা ওর ঘুমে বুজে থাকা চোখের ওপর ঠোঁট রেখে আস্তে আস্তে গরম ফুঁ দিত আর হেসে চোখ মেলে মনীষা জড়িয়ে ধরত বাবার গলা। আজ পাঁচ বছর চশমা উঠেছে চোখে তবু নতুন কেউ তাকে দেখে এখনও প্রশংসা করে তার চোখের। কিন্তু অরূপের চোখের দিকে তাকালে মনে হয় সে সব কিছু নয়। আরও অনেক, অনেক সুন্দর অরূপের চোখ।

—কী ভাবছ?

মনীষা তাকায় অরূপের দিকে। বলে— কী ভাববো?

—ভাবছ কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে একটা বিয়ে হল আমাদের! লোকজন এল না! আমার টোপর পরা, তোমার বেনারসি পরে বসে থাকা হল না… এই সব, না?

অরূপের মধ্যে কোথাও এখনও আভাসে লুকিয়ে আছে এক গ্রাম্যতা। এটুকু মেনে নিয়েছে মনীষা। মাঝে মাঝে মজার লাগে। যেখানে—সেখানে চন্দবিন্দু বসিয়ে দেয়, যেখানে দরকার সেখানে দেয় না। চাঁদকে চাদ বলে, আরশোলাকে আঁরসুলা।

—আমার বয়স জানো না? এসব ভাবার বয়স আছে?

—তবে কী ভাবছ?

—ভাবছি দু—একদিন পর স্কুলে যখন সবাই শুনবে অঙ্কের দিদিমণি প্রেম করে পালিয়েছে ড্রিলের মাস্টারের সঙ্গে তখন মেয়েগুলোর মুখ কেমন হবে।

মনীষা আসলে এসব কিছুই ভাবছে না। ভাবছে অন্য একটা কথা। বাবার কথা। ভাবতে ভাবতে একটা রাগ উঠে আসছে শরীরের অনেক নীচে চাপা পড়ে থাকা অন্ধকার থেকে। বিকাশ চিরকাল চেয়েছে মনীষা ছোটো হয়ে থাক। সারাজীবন টিফিন কৌটো নিয়ে বেণী বেঁধে স্কুলে যাক। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শিখুক। শার্লক হোমস—এর বইয়ের জন্য বাবার কাছে বায়না করুক। আর মাঝে মাঝে বাবার আদর খাক। স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়তে পড়তে মনীষা ভাবত যখন কলেজে পড়বে তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। কলেজে গিয়ে ভাবত এমএ. পড়ার সময় বাবা বুঝবে সত্যিই বড়ো হয়েছে ও। বুঝবে মনীষার নিজেরও কিছু ইচ্ছে আছে, ভাবনা আছে জীবন সম্পর্কে। চাকরি করতে গিয়ে ভেবেছিল এবার বাবা বদলাবেই। আজ চার বছর স্কুলে পড়াচ্ছে মনীষা। কিন্তু বিকাশ বদলায়নি। বরং অসন্তুষ্ট হয়েছে ছোটোবেলার মতো জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারে না বলে। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায় বলে। বাড়িতে মনীষা ছাড়া আর কারও বিশেষ একটা ফোন আসে না বলে। আগে আগে অরূপের ফোন এলে ডেকে দিত। ইদানীং কিছু না বলে ফোন নিঃশব্দে নামিয়ে রেখে দেয়। অণিমাকেও কিছু বলে না। অরূপের সঙ্গে দেখা হবার পর বাড়ি ফিরে এলে মনীষার চোখের প্রশ্নের সামনে এমনভাবে তাকায় যেন কিছুই হয়নি। অরূপকে ঘেন্না করে বিকাশ। দামোদর পেরিয়ে রায়নার দিকে বাসে প্রায় ঘণ্টাখানেক গেলে অরূপদের কাঁচা গাঁথনির বাড়ি। পাঁচ ভাই, তিন বোন। বুড়ি মা। বর্ধমানের একটা মেসবাড়িতে আরও চারজনের সঙ্গে চৌকি পেতে শোয় আর স্কুলে এন.সি.সি. করার সুবাদে ছত্রিশ বছর বয়সে আটশো টাকা মাস মাইনেতে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত মেয়েদের ড্রিল শেখায়। বিকাশের পৃথিবী আলাদা। কিছুটা উঁচু পদের নিশ্চিন্ত সরকারি চাকরি, বাবার দেওয়া বাড়ি ও বিষয়—আশয়, মাঝে মাঝে সেতার বাজানো আর গোগ্রাসে থ্রিলার পড়তে পড়তে কাদা হয়ে গিয়ে তারস্বরে নাক ডাকা। ছোটোবেলায় মাঝে মাঝে সেই ঘুম ভেঙে গেলে মনীষা উঠে গিয়ে বাবার নাক চেপে ধরত। আসলে, বিকাশ কখনও অরূপের দিকে চেয়ে দেখেনি। অরূপের কথা শোনেনি। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নগুলোর খোঁজ পায়নি কোনোদিন।

—তুমি কী ভাবছ? মনীষা জিজ্ঞাসা করে।

—ভাবছি ভূপালে পৌঁছতে পৌঁছতে কাল বিকেল। ছোটোখাটো একটা হোটেল খুঁজে বের করতে হবে। তারপর হনিমুন, নতুন স্কুলে ড্রিল মাস্টারের চাকরি, তোমার চাকরি খোঁজা সব একসঙ্গে।

মনীষা হাসে। বলে—তুমি হিন্দি জানো? ওখানে তো ছেলেদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলতে হবে।

—যাতা হ্যায় খাতা হ্যায় পর্যন্ত পারি। তারপর চালিয়ে নেব। একটু থেমে বলে—পৌঁছে কিন্তু বাড়িতে সব জানিয়ে একটা চিঠি লিখে দিও। ওঁরা ঠিক বুঝবেন, মানে তোমার বাবা। কিছু করার তো নেই আর ওঁর। তুমি দেখো, আমরা আবার বর্ধমানে ফিরে আসব। ব্যাংক কলোনি বা তার ধারে কাছে কোথাও একটা ছোটো বাড়ি নেব। তোমার শার্লক হোমস আর আগাথা ক্রিস্টির বইগুলো সব সাজিয়ে রাখব। তুমি শুয়ে শুয়ে চোখ বুজে গান শুনবে, আমি তোমার জন্য পালংপাতা দিয়ে ডাল রান্না করব, কচুর লতি আর সরষে দিয়ে কুমড়োপাতায় ঘণ্ট করব, কুচি মাছের টক করব। জামাইষষ্ঠীর দিন কোঁচা ঝুলিয়ে ধুতি পরে ঘাড় উঁচু করে তোমার সঙ্গে তোমাদের বাড়ি যাব। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভেব না।

মনীষা বলে—আমি এসব ভাবছি তোমাকে কে বলল?

—তোমার চোখ।

চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকাল মনীষা। লোক দুটো নেই। মুখ ঝুঁকিয়ে কম্পার্টমেন্টের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল। দেখতে পেল না লোক দুটোকে। ট্রেনটা পাগলের মতো ছুটছে। দুলছে জানালাগুলো। দুলছে বাইরের ঘুরঘুট্টে অন্ধকারের ভেতরে মনীষার সাতাশটা বছর, তার ছোট্ট হলুদ ফ্রক, মা—র সিঁদুরের কৌটো, দাদুর বেতের ছড়ি আর বাবার হাতের আংটি।

—একটু ঘুমিয়ে নাও।

মনীষা বলল—ঘুম পাচ্ছে না। তুমি ঘুমোও। আমি পাহারা দিচ্ছি।

হেসে উঠল অরূপ। তারপর আস্তে আস্তে ওর মুখে অদ্ভুত একটা কষ্ট ফুটে উঠল।

মনীষা বলল—কী হল?

—আমি জানি না ঠিক করলাম কিনা। কেন যে এমন হল! তোমার বাবার কথা তো ভুল নয়। তোমাকে সত্যিই কি আমি কিছু দিতে পারি? কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতাম না। এটা সত্যি। তুমি বাঁচতে?

অরূপ দেখতে পেল মনীষা ঠোঁট নড়ে উঠল। কিন্তু কথাগুলো বেরিয়ে এসে অরূপের কান পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই এক ঝলকে চৌচির হয়ে ভেঙে পড়ল আকাশ পাতাল জল স্থল নিয়ে সমস্ত পৃথিবী। শূন্যে পাক খেয়ে উঠে গেল কামরাটা একটা বলের মতো। নীচে আছড়ে পড়ার সামান্য আগে অরূপ তার সমস্ত শরীর, হাত আর স্মৃতি বাড়িয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মনীষাকে, ঢেকে নিল মনীষার সবটুকু। আর তারপরই হাজার সমুদ্র একসঙ্গে গ্রাস করে নিল তার চেতনাকে। তার এক পল আগে মনীষা শুধু শুনতে পেল তার বাঁদিকে চশমার ফ্রেম খুট শব্দ করে ভেঙে পড়ে গেল। নাকি খুলে পড়ে গেল তার চোখ? তারপরের কোনো কিছুই আর জানে না মনীষা।

হাজার মানুষের হালকা চিৎকার কান্না চেঁচামেচি দৌড়াদৌড়ি ঘূর্ণির মতো ঘুরতে ঘুরতে এক সময় আছড়ে পড়ল মনীষার কানে। অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকাল। কিছুই মনে পড়ল না। কোথায় শুয়ে আছে ও? বাড়িতে? বাবার পাশে ছোটোবেলার ভোরগুলোর মতো গুড়িসুড়ি মেরে আর মুখে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বাবা গান গাইছে ‘তোমারও অসীমে…’? না কি এই সেদিনও যেমন মা—কে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল তেমনই শুয়ে আছে? কিন্তু সেই গন্ধটা তো নেই? তারপরই আস্তে আস্তে সব মনে পড়তে শুরু করল। মনে পড়ল ট্রেনের জানালার বাইরে মেঘের ভেতর দিয়ে চাঁদের ছুটে চলা। মনে পড়ল শূন্যে উঠে গিয়ে তাদের কামরাটার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে আছড়ে পড়া ভয়ংকর এক অন্ধকারে, মনে পড়ল দুটো হাতের তার শরীরকে জড়িয়ে ধরা। কার হাত? উঠে বসল মনীষা। অরূপ কোথায়? চারপাশে তাকিয়ে দেখল। অনেক দূরে আকাশে অদ্ভুত এক আলো, আস্তে আস্তে বাড়ছে। ভোর হচ্ছে। পেছনে তাকাল। চমকে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। গত রাতের সেই ট্রেনটা। ধনুকের মতো বেঁকে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে এদিক—ওদিক থেকে। কিন্তু অরূপ কোথায়?

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টের পেল ডান হাঁটুতে অসহ্য যন্ত্রণা। বুঝতে পারল পারবে না। চুপচাপ বসে থাকল মনীষা সেই নরকের মধ্যে। চারপাশে উলটে পড়ে আছে মানুষের শরীর। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে কাটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। রাশি রাশি জিনিস। মরা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাত—পা ছুড়ে কাঁদছে অল্পবয়সি এক মা। হঠাৎ মনে হল পেছনে ঠান্ডা কী যেন লাগছে। সরে বসতে গিয়ে দেখতে পেল সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে রক্ত ভেসে এসে তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সাপের মতো এঁকেবেঁকে। দূরে কিছু মানুষ দৌড়চ্ছে। কিছু মানুষ হাত ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করছে অন্য কিছু মানুষকে। কেউ কেউ এক—একটা শরীর তুলে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের চেনা মুখ। না পেয়ে ফেলে দিচ্ছে আবার। অরূপ ওদের মধ্যেই কোনো একজন নয়তো? ভয়ে কেঁপে উঠল মনীষা। আরও অনেকের মতো চিৎকার করে কেঁদে উঠতে চাইল। নাকের কাছে কী যেন লাগছে। হাত লাগিয়ে বুঝতে পারল নাকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে নীচে শুকিয়ে আছে রক্তের ডেলা। মাথা ঘুরে উঠল মনীষার। বুঝতে পারল গভীর গোপন কোনো ঘুম আস্তে আস্তে ঘিরে ফেলতে চাইছে তাকে। চোখ বুজে আসার আগে শুনতে পেল কে যেন তার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটছে। হাত তুলে সাড়া দেবার চেষ্টা করল। ডাকটা এগিয়ে আসছে আরও কাছে। অনেক কষ্টে মনীষা মুখটা সামান্য তুলতে পারল মাত্র। বুঝতে পারল অন্য একটা মুখ ঝুঁকে পড়ছে তার ওপর। নিশ্বাস এসে লাগছে ঠোঁটে। চেনা একঝাঁক আঙুল স্বপ্নের মতো ভেসে আসছে মুখের ওপর। প্রায় ছুঁয়ে ফেলছে তাকে। আর তাকিয়ে থাকতে পারল না মনীষা। ঘুম গিলে ফেলছে তাকে। ঘুমের ভেতর দেখতে পেল অদ্ভুত এক ঘুমন্ত রোদ্দুর। তার ভেতর সে, অরূপ আর তাদের বেঁচে থাকা।

মনীষার শরীরটাকে কোনোরকমে কাঁধে তুলে নিল অরূপ। পাশেই পড়েছিল দুটো সুটকেসের একটা। তুলে নিল অন্য হাতে। তারপর এলোপাতাড়ি ছুটতে শুরু করল। আলো অনেক বেড়েছে। ভোর হয়েছে সামান্য একটু আগে। ভোর যে আবার কোনোদিন দেখতে পাবে ভাবতেও পারেনি কাল, যখন প্রচণ্ড শব্দ করে ভেঙে পড়েছিল তাদের কামরাটা। ভালো করে ছুটতে পারছে না অরূপ। চারপাশে ছড়ানো ছিটোনো মানুষের শরীর, ছোটো—বড়ো নানান সুটকেস ব্যাগ জলের বোতল। সাবধানে পা ফেলে ফেলে দৌড়তে হচ্ছে। মাটিতে লুটয়ে থাকা একজন হাত এগিয়ে দিল অরূপকে দেখে। তাড়াতাড়ি সুটকেসটা নামিয়ে হাত বাড়িয়ে লোকটিকে উঠে বসতে সাহায্য করল। তারপর আবার দৌড়তে লাগল। যত তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাওয়া যায়। কনুইয়ের কাছে অনেকটা চিরে গেছে অরূপের। রক্ত পড়ছে এখনও। হাড় হিম করা একটা ব্যথা ঘাড় পর্যন্ত উঠে আসছে। কিন্তু ও কিছু না। শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকা মানুষদের মধ্যে সেও যে আছে এটা ভাবতেই অদ্ভুত ভালো লাগছে অরূপের। পেছন ফিরে দেখল বেশ খানিকটা দূরে ফেলে এসেছে সেই দুঃস্বপ্নের ট্রেন, মৃত মানুষের স্তূপ এবং তাদের এক নিমেষে হারিয়ে যাওয়া সুখ, দুঃখের স্মৃতিগুলো। কিন্তু মনীষা? বেঁচে আছে তো? নাকি ওর নিষ্প্রাণ শরীর নিয়ে ছুটছে অরূপ? ছ্যাঁত করে উঠল অরূপের বুক। দাঁড়িয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে মাটিতে নামাল মনীষাকে। শুইয়ে দিল। ভালো করে তাকিয়ে দেখল। গায়ে হাত দিল। কান নিয়ে এবং বুকের কাছে। শব্দ হচ্ছে। পকেট থেকে রুমালটা বের করে আস্তে আস্তে যত্ন করে মুছিয়ে দিল মনীষার মুখ।

অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চোখ মেলল মনীষা। তাকাল অরূপের দিকে। একটা নিশ্চিন্তের হাসির আভাস ফুটে উঠল তার মুখে। ফিসফিস করে বলল— তোমার কিছু হয়নি তো?

—না। তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে?

মাথা নাড়ল। না জানাল মনীষা।— তোমার?

—না।

—আজ কত তারিখ?

—তেইশ।

—কী বার?

—বুধবার। কথা বোলো না। একটু চুপচাপ শুয়ে থাকো। দেখবে অনেক ভালো লাগছে।

—আমি ভালো আছি। মনীষা হাত তুলে তার নাকের কাছে আনল। রক্ত লেগে আছে? নাকের নীচে?

—না।

—তুমি মুছিয়ে দিয়েছ, না? অদ্ভুতভাবে হাসল মনীষা।

দূর থেকে গাড়ি যাবার শব্দ ভেসে এল। উঠে দাঁড়াল অরূপ। প্রথমে মনে হল এক চিলতে একটা নদী। তারপর বুঝতে পারল সকালের আলো পড়ে রুপোর মতো চিকচিক করছে দূরের একটা পিচের রাস্তা। হাওয়ায় ভেসে এল ইঞ্জিনের শব্দ। দেখতে পেল একটা গাড়ি আস্তে আস্তে এসে থামল। সামান্য থেমে আবার চলে গেল। গাড়িটা বিন্দুর মতো অনেক দূরে মিলিয়ে গেলে মুখ ফিরিয়ে অরূপ তাকাল মাটিতে শুয়ে থাকা মনীষার দিকে। মনীষার চুল উড়ছে, আঁচলের দিকটা উড়ছে, পায়ের দিকের শাড়ি বেশ কিছুটা ওপরে উঠে গেছে। নামিয়ে দিতে গিয়েও থেমে গেল অরূপ। তাকিয়ে থাকল খোলা পা—র দিকে। চারদিকে শুধু হাওয়া আর হাওয়া। তার মাঝখানে চোখ বুজে শুয়ে আছে মনীষা। নাকি একটু ঘমিয়ে পড়েছে? হঠাৎ কেমন অন্যরকম লাগল মনীষাকে। ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারল চোখে চশমাটা নেই। কোথায় গেল চশমা? খুলে পড়ে গেছে কাল কোন অন্ধকারে, এখন আর পাওয়া যাবে না। ভূপালে পৌঁছে প্রথমেই মনীষার চশমা করাতে হবে। তারপর অন্য কাজ। এত কিছুর পরেও এখন ভালো লাগছে অরূপের। প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজে পেল। আঙুলটা আর একটু সরাতেই দেশলাইয়ের বাক্সটা। মনীষার পাশে বসে একটা সিগারেট ধরাল। মনে মনে হাসি পেল অরূপের। মরতে মরতে আশ্চর্যভাবে বেঁচে গিয়ে একটা আকাশছোঁয়া প্রান্তরের মধ্যে বসে সিগারেট টানছে সে, পাশে মনীষা। বেঁচে আছে সেও। বেঁচে গেছে তাদের স্বপ্নগুলো। বেঁচে গেছে তাদের মনে মনে এঁকে রাখা ঘর—গেরস্থালি। তাদের পরস্পরকে জড়িয়ে—মড়িয়ে বেঁচে থাকার অনেক অনেক দিন। কিন্তু ভূপালে পৌঁছবে কী করে? কতদূর এ জায়গাটা ভূপাল থেকে? জায়গাটার নামই বা কী? হঠাৎ অরূপের মনে হল কেউ দেখছে তাদের। মুখ ফিরিয়েই মুহূর্তের জন্য হিম হয়ে গেল তার শরীর। কাল রাতে দেখা ট্রেনের সেই দুটো লোক। তাকিয়ে আছে মনীষার খোলা পা—র দিকে। লোক দুটোর মুখময় শুকিয়ে আছে রক্ত। রক্ত তাদের জামাকাপড়ে। আস্তে আস্তে মুখ তুলে অরূপের দিকে তাকাল লোক দুটো। তারপর হেঁটে যেতে লাগল সামনে।

বেশ খানিকক্ষণ পরে মনীষা চোখ মেলে তাকাল। দেখল অরূপ চেয়ে আছে তার দিকে। কী গভীর আর উজ্জ্বল লাগছে তার চোখ দুটো। মাথার ওপর এগিয়ে আসছে সেই আঙুলগুলো। নড়ছে। আরাম লাগছে মনীষার। মনীষা হাসল।

অরূপ বলল— উঠতে পারবে? আমাকে ধরে ধরে হাঁটতে পারবে? ওই বড়ো রাস্তাটা পর্যন্ত? ওখান থেকে কিছু পাওয়া যেতে পারে। শহর—টহর কোথাও একটা পৌঁছনো দরকার। পারবে?

মনীষা বলল— পারব।

তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসল নিজেই। হাত বাড়িয়ে মনীষাকে উঠতে সাহায্য করল অরূপ। দাঁড় করিয়ে দু—হাত ছেড়ে দিল।

—সত্যি পারবে? অরূপ জিজ্ঞাসা করল।

—ভোরে মনে হচ্ছিল কোনোদিন আর হাঁটতে পারব না। হাঁটু দুটো যন্ত্রণায় ভেঙে যাচ্ছিল। এখন ব্যথাটা একদম নেই। হাঁটব? দেখবে?

মাথা নাড়ল অরূপ। দেখল সত্যিই মনীষা এক পা দু—পা করে হাঁটতে পারছে। সুটকেসটা এক হাতে তুলে নিল। অন্য হাত দিয়ে মনীষার কনুইয়ের ওপর শক্ত করে ধরল। বলল— চলো। না পারলে বলবে। কাঁধে নিয়ে নেব। এখানে তোমাকে কেউ দেখবে না।

মনীষা হাসল। বলল— নিয়েছিলে তো কাঁধে। ছুটছিলে। আমি বুঝতে পারছিলাম। কষ্ট হচ্ছিল তোমার, না?

—না। তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছিলাম। এক সময় মনে হচ্ছিল আর পাব না। তারপর তোমাকে দেখলাম। দেখলাম বেঁচে আছ। তখন মনে হচ্ছিল আমি সব করতে পারি।

আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল মনীষা আর অরূপ। বড়ো রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছতে প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেল। রোদ বেড়েছে। সামনে একটা গাছ দেখতে পেয়ে তার তলায় গিয়ে দাঁড়াল ওরা। দূর থেকে মাইকে একটা গান ভেসে আসছে। কান পেতে শুনে মনীষা বুঝতে পারল কোনো হিন্দি সিনেমার গান। সামনেই কোনো গ্রাম বা আধা শহর গোছের কিছু একটা আছে। কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল অরূপের দিকে। তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। যদি বাস বা গাড়ি কিছু আসে। যদি আর কোনোদিন দেখা না হত অরূপের সঙ্গে? যদি মরে যেত অরূপ আর শুধু বেঁচে থাকত ও? কী করত তাহলে? বর্ধমান ফিরে যেত একা একা? কিংবা যদি শুধুই অরূপ বেঁচে থাকত?

হঠাৎ দেখতে পেল ধুলোঝড়ের মতো ছুটে আসছে একটা ঘূর্ণি। অদ্ভুত একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে পারল ধুলো উড়িয়ে একটা বাস আসছে। কাছে এসে পড়েছে বাসটা। অরূপ হাত তুলে প্রবলভাবে নাড়তে লাগল বাসটাকে দাঁড় করানোর জন্য। আরও কাছে এলে দেখতে পেল বাসের ওপর লেখা আছে ভূপাল। যাচ্ছে, না আসছে ভূপাল থেকে? বাসটা ওদের দেখেছে। আস্তে আস্তে সামনে এসে দাঁড়াল।

ছুটে গিয়ে অরূপ জিজ্ঞাসা করল— ভূপাল?

বাসের কন্ডাক্টর বা খালাসির মতো কেউ মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল। নেমে সুটকেসটা তুলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে বাসের ছাদে উঠে গেল। বাঁধল একটা দড়ি দিয়ে আরও অনেক মালপত্রের সঙ্গে। অরূপ মনীষাকে ধরে বাসে ওঠাল। তারপর নিজেও উঠল। হঠাৎ কী দেখে মনীষা প্রায় মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ধরে ফেলল অরূপ। দেখল সেই লোক দুটো। বসে আছে বাসের ভেতর। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনীষার দিকে।

বাসটা ছুটছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে উড়ে যাচ্ছে। অরূপের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে মনীষা। বেলা শেষ হয়ে আসছে। আকাশে লাল আভা ফুটে উঠছে আস্তে আস্তে। ভূপাল পৌঁছতে অনেক রাত্রি হয়ে যাবে। সন্ধ্যার পর বাসটা একবার থেমেছিল একটু। চা ছাড়া আর কিছু খেতে চায়নি মনীষা। অরূপের অল্প অল্প খিদে পাচ্ছে এখন। ভূপালে পৌঁছে আগে একটা ছোটোখাটো হোটেল খুঁজে বের করতে হবে। পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন হওয়া চাই। মনীষার একটু পরিষ্কার পরিষ্কার বাতিক আছে। এই জামাকাপড় ছাড়তে না পারলে অরূপের নিজেরই ঘেন্না লাগছে। হোটেলে গিয়ে আগে ভালো করে স্নান করতে হবে। কী পরবে স্নান করে? ওর সুটকেসটা তো খুঁজে পায়নি কোথাও। ওতে সব ছিল।

কন্ডাক্টারকে আগেই বলে রেখেছিল অরূপ হোটেলের কথা। বাজারের সামনে আসতেই সে বলে উঠল— ইঁহা উতর যাইয়ে। ও সামনে হ্যায় হোটেল। বাঙ্গালি হোটেল।

বাস থামল। মনীষা উঠে পড়েছে। চারদিক তাকিয়ে দেখল। হঠাৎ মনে হল সেই লোক দুটো কোথায়? বাসের ভেতর কোথাও তো নেই লোক দুটো। লোক দুটোর কথা ভেবে অবাক লাগল মনীষার। তারপর নিজেই আস্তে আস্তে নামল বাস থেকে। জমজমাট করছে জায়গাটা। চারদিকে আলো। দোকান। লোকজন। ভালো করে তাকিয়ে মনে হল মুখগুলোর মধ্যে কোনো মায়া নেই, স্বপ্ন নেই।

ছাদ থেকে সুটকেস নামিয়ে আনতে ছুটে গেল কন্ডাক্টার। সুটকেসটা নিয়ে অরূপ দুটো টাকা দিল তাকে।

—সেলাম। কপালে হাত ঠুকল লোকটি। তারপর দৌড়ে উঠে পড়ল বাসে। হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে হাত চাপড়াতে লাগল বাসটার গায়ে। বাসটা চলে গেলে উলটো দিকে চোখ পড়ল— নিউ বেঙ্গল হোটেল। কন্ডাক্টারের বুদ্ধির মনে মনে তারিফ করল অরূপ। মনীষার দিকে তাকিয়ে বলল— চলো।

এটাচড বাথ দেড়শো। কমন একশো। মনীষার দিকে তাকিয়ে এটাচড বাথই নিল অরূপ। দুই—এক দিনের ব্যাপার। তারপর স্কুল থেকে একটা ঘর ঠিক করে দেবে বলেছে। কাল ঘুম থেকে উঠেই আগে স্কুল। তারপর মনীষার চশমার জন্য ডাক্তারের খোঁজ করা। তারপর শহরটা ঘুরে দেখা।

তিনতলার একটা ঘর। ঢুকে মন্দ লাগল না মনীষার। বাহুল্য নেই। একটা ডবলবেডের খাট। পাট করে চাদর পাতা। বালিশের ঢাকনাগুলো পরিষ্কার। একটা আলনা। একটা টেবিল আর চেয়ার। বাথরুমের দরজাটা খুলে দেখে নিল। সস্তার দুটো সাবান আর রং উঠে যাওয়া দুটো ধোয়া তোয়ালে। ঠিক আছে। অল্পবয়সি একটা বেয়ারা এসে জলভরতি কাচের জাগ আর দুটো গ্লাস দিয়ে গেল। দেখে মনে হল বাঙালি। মনীষার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। কাল কথা বলবে ছেলেটার সঙ্গে। জানলা দুটো খুলে দিল মনীষা। একঝলক হাওয়া এসে লাগল মুখে। শরীরের সমস্ত তন্তু দিয়ে মনীষা টেনে নিল সেই হাওয়া তার বুকে। তারপর তাকাল অরূপের দিকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরূপ। দু—চোখ জুড়ে মায়া। আরও যেন কিছু আছে সেই চাউনিতে। কী যেন চাইছে চোখ দুটো তার কাছে। কত যুগ ধরে এভাবে তাকিয়ে আছে অরূপ তার দিকে?

—চশমা ছাড়া তোমার চোখ আরও সুন্দর লাগছে। অরূপ বলল ফিস ফিস করে।

সব বুঝতে পারল মনীষা। কতকাল ধরে অপেক্ষা করে আছে মনীষা এই মুহূর্তের জন্য। অপেক্ষা করে আছে অরূপ। ঘেমে উঠেছে তার মুখ। অরূপ দেখল মনীষার উজ্জ্বল দুই চোখের চারপাশে, ঠোঁটের চারপাশে জমে উঠছে ঘাম।

খুট করে একটা শব্দ হল। আলো নিবিয়ে দিল অরূপ। তারপর এগিয়ে যেতে লাগল মনীষার দিকে। হঠাৎ মনে হল চাপা এক অন্ধকারের ভেতর দিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটছে সে। কিন্তু মনীষা কোথায়? ঠিক এই সময় তার হাত, হাতের আঙুল স্পর্শ করল মনীষার শরীর। অরূপ জড়িয়ে ধরল মনীষাকে। বুঝতে পারল মনীষাও জড়িয়ে ধরেছে তাকে। শুষে নিতে চাইছে দু—জন দু—জনার শরীর। অন্ধকারের মধ্যে আস্তে আস্তে অরূপের চোখের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল মনীষা। বাড়িয়ে দিল তার আঙুল। অরূপের ঠোঁটের ওপর দিয়ে, নাকের ওপর দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল মনীষার আঙুল। তারপর দুটো গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল। এগিয়ে যেতে লাগল সেই গর্ত দুটোর মধ্যে দিয়ে। এ কি, কোথায় অরূপের চোখ? চোখের জায়গায় হাড়হিম এক আঁধারের মধ্যে দিয়ে কোথায় চলেছে তার আঙুল? আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল মনীষা। ঝরে যেতে লাগল আসমুদ্র অন্ধকার, সেই ঘর, সময়।

অরূপের আঙুল উঠে এল মনীষার চোখের দিকে। তারপর দুটো গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল তার আঙুল। অরূপ বুঝতে পারল সব। বুঝতে পারল দুটো গর্তের মধ্যে দিয়ে এক অনন্ত জলরাশির ভেতর ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে দুটো আঙুল। অনেক অনেক দূরে মনীষার কান্না তবু ছুঁতে পারল অরূপ। কেন এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল সব? নাকি তারা এমনই ছিল চিরকাল? মনীষা কি কোনোদিনই মানুষী ছিল না? সেও কি মানুষ ছিল কোনোদিন? কিছু মনে পড়ল না অরূপের। মনীষারও মনে পড়ল না কোনোকিছু। শুধু অদ্ভুত এক হাওয়া এসে ঘিরে নিল তাদের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *