অদৃশ্য আততায়ী – হীরেন চট্টোপাধ্যায়
একেবারে আকস্মিকভাবে লোকটা গায়ের ওপর এসে পড়ল।
অনেক কষ্টে টাল সামলে কেটি বিশ্রী একটা শব্দ উচ্চারণ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু চোখ তুলে দেখল, লোকটা নেই।
লোকটা উধাও হয়ে গেছে মন্ত্রের মতো! কেটি যতদূর চোখ যায় বুলিয়ে নিল মুহূর্তের মধ্যে।
না, লোকটা নেই।
ফিরতে যাচ্ছিল, পায়ের কাছে দলা পাকানো একখণ্ড কাগজ দেখে থমকে দাঁড়াল। তুলে নিল কাগজটা। কাগজটা টানটান করে ফেলল। এই অস্পষ্ট সন্ধের আলোতেও লেখাগুলো আগুনের অক্ষরের মতো ফুটে উঠল চোখের সামনে।
‘তোমাকে কেউ একজন খুন করতে চায়। সে তোমার সঙ্গে এই ট্রেনেই আছে। সাবধান।’
নিজেকে ঠিক করে নিতে কেটির সেকেন্ড কয়েক লাগল। সমস্ত ব্যাপারটা সে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল।
ট্রেন বেশ খানিকটা লেট চলছে। এতক্ষণে বিলাসপুর এসে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যেরকম মনে হচ্ছে, রাত দশটার আগে তার কোনও সম্ভাবনা নেই।
সম্ভবত সিগন্যাল না পাওয়ায় এই ছোট্ট স্টেশনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে—স্টেশনের নামটাও কেটি দেখেনি। খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে অধৈর্য হয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়েছে।
সন্ধে এখন বেশ ঘন। প্ল্যাটফর্মে অনেকেই পায়চারি করছে, কিন্তু অস্পষ্ট আলোয় কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না। দূরে বাইরে যাওয়ার পথ।
ট্রেনটা ছেড়ে দেব!
কেটি একমুহূর্ত চিন্তা করল।
না, ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার কোনও মানে হয় না। যে-গুপ্ত আততায়ী ট্রেনে সমস্ত ক্ষণ তার ওপর নজর রেখেছে, সে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে—এ-কথা মনে করবার কোনও কারণ নেই। ট্রেনের মধ্যে তবু যেটুকু নিরাপত্তা আছে, এখানে তা-ও নেই, এখানে সবটুকুই অচেনা। তা ছাড়া, ট্রেন ছেড়ে দেওয়াটা সুবিধের হলে সেরকম স্পষ্ট নির্দেশ থাকত। তেমন করে কিছু বলা হয়নি। তার মানে, এই ট্রেনেই সকাল পর্যন্ত কেটিকে তার গুপ্তঘাতকের জন্যে প্রতীক্ষা করতে হবে।
যে-কাজে কেটি নেমেছে, তাতে মৃত্যুর ভয় প্রতি পদক্ষেপে, সে-ভয় করলে আজ দশ বছরের ওপর তার পক্ষে এখানে টিঁকে থাকা সম্ভব হত না। তবু, এই মুহূর্তে, কেটির কপাল ঘেমে উঠল, বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত শিরশিরে অনুভূতি। লোকটা কালকের গোটা রাত তাকে মারবার সুযোগ পেয়েছে—কিন্তু মারেনি। কেন? সুযোগ পায়নি? নাকি নাগপুর বা অন্য কোনও মাঝপথ থেকে উঠেছে ট্রেনে?
প্রশ্নগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল কেটি। শান্ত পায়ে এগিয়ে গেল নিজের ফার্স্ট ক্লাস রিজার্ভড কম্পার্টমেন্টের দিকে। যতদূর সম্ভব অবিচলিতভাবে নিজের সিটে ফিরে এল।
কম্পার্টমেন্টে এখন কেউ নেই। ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস থেকে ওঠার সময় এখানে যাত্রী ছিল সবসুদ্ধ পাঁচজন—কেটিকে নিয়ে। বাকি চারজনের নাম সে পড়ে নিয়েছিল স্টেশনেই। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আগরওয়ালা, কর্নেল সিনহা এবং কুলকার্নি। গত রাতটা ওরা পাঁচজনেই এখানে ছিল। দুপুরে নাগপুরে তিনজন নেমে গেছে, আছে কেবল কুলকার্নি। এখন অবশ্য কুলকার্নিও কম্পার্টমেন্টে নেই—কন্ডাকটিং গার্ডকেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
কেটি ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট ধরাল। চারিদিক একবার দেখে নিয়ে গ্যাস লাইটারের আগুন ছুঁইয়ে দিল কাগজের টুকরোটাতে। এসব ব্যাপারে কোনও ঝুঁকি নেওয়ার মানে হয় না।
সিগারেটে দু-একটা টান দিয়ে নিজেকে অনেকটা সুস্থ মনে হল কেটির। মিছিমিছি ভয় পাওয়ার কোনও অর্থ হয় না। বরং চিরকুটটায় যা লেখা ছিল তাই করতে হবে, সাবধানে থাকতে হবে। আজকের রাতটায় আর ঘুম হবে না। বাঁ-হাতটা পিছনে নিয়ে গিয়ে সুচারু নিতম্বের ওপর ছোট্ট অটোমেটিকটায় একবার ছুঁইয়ে নিল। এমন চমৎকার করে প্যাডের সঙ্গে সেট করা আছে যে, বাইরে থেকে সেটাকে চেনবার কোনও উপায় নেই। এই অস্ত্রটা সঙ্গে থাকতে কেটি কাউকে ভয় করে না।
অবশ্য এর চেয়ে বড় একটা অস্ত্র সবসময়ই তার সঙ্গে-সঙ্গে থাকে, সেটা কেটি নিজে। কথাটা মনে হতে একটা বাঁকা হাসি ওর মুখে খেলে গেল। কুড়ি বছরের পর থেকে বয়েসটাকে সে স্টিলের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছে। বয়স কত হল, এখন নিজেই ঠিক মনে করতে পারে না কেটি। কিন্তু কুড়ি বছরের সেই লাস্য, সেই মাদকতা, এখনও সে নিপুণভাবে ছড়িয়ে রেখেছে দেহে। এখনও পর্যন্ত এমন কোনও পুরুষ দেখেনি কেটি, যে তার চোখে-মুখের, সমগ্র দেহের, হিল্লোলিত আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারে। এই বিরাট প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিটির চোখেও সে প্রথম পরিচয়ে মুহূর্তের জন্যে আগুনের টুকরো ঝলসে উঠতে দেখেছিল। ‘তিনি’ বলেছিলেন, ‘তোমার শরীরে বোধহয় একইঞ্চিও সরলরেখা নেই, কী বলো? ফাইন! তুমি আমাদের কাজে লাগবে।’
কাজে কেটি লেগেছিল। প্রথমে ছোট-ছোট টুকরো-টুকরো কাজ। তারপর এখনকার মতো বিরাট ব্যাপার—অত্যন্ত চতুর লোক ছাড়া যে-কাজে কাউকে নির্ভর করা যায় না।
তার মানে ‘তিনি’ ওকে বিশ্বাস করেন, ওর ওপর নির্ভর করেন।
এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই এবারে কেটি একটু ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ফেলেছিল, বলেছিল, ‘আমি তো অনায়াসে প্লেনে যেতে পারি। কাস্টমস ধরতে পারে এমন কিছু তো নেই আমার সঙ্গে!’
‘তিনি’ দু-সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ‘প্লেনে গেলে সময় যে অনেক কম লাগে, সেটা বাচ্চাছেলেও বোঝে। তুমি আর কিছু বলবে?’
কেটি চুপ করে চলে আসছিল, তিনি বলেছিলেন, ‘শোনো, একটা কথা মনে করিয়ে দিই। এখানে প্রশ্ন করাটা রীতি বহির্ভূত। যাও!’
কথাগুলো মনে পড়তে কেটির মাথা ঝুঁকে পড়ছিল, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা নড়ে উঠল।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে কন্ডাকটিং গার্ড উঠে পড়ল ট্রেনে। কেটির দিকে একপলক তাকিয়ে সে এগিয়ে গেল নিজের জায়গায়।
ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়বার শেষ মুহূর্তে দরজায় প্রায় আছড়ে পড়ল কুলকার্নি।
একপলক তাকিয়েই চমকে উঠল কেটি।
কুলকার্নি হাঁপাচ্ছে। ওর চুলগুলো এলোমেলো। ঘর্মাক্ত মুখে কিছু চুল লেপটে রয়েছে। জামার হাতায়—।
হ্যাঁ, কেটি এখন মুখ ঘুরিয়েও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ছোট-ছোট দু-একটা রক্তের ছোপ।
কুলকার্নি ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে অবশ্য হাতটা আড়াল করেছিল, তবুও।
কেটির সামনে দিয়েই কুলকার্নি এগিয়ে গেল। ব্রিফকেস খুলে কিছু বার করল, শান্ত পায়ে চলে গেল টয়লেটে।
কেটির বুকের ভেতরটা ধকধক করছিল।
আশ্চর্য! এই লোকটার সঙ্গে সে একটা রাত কাটিয়েছে ট্রেনে। আরও একটা রাত তাকে কাটাতে হবে। অথচ এর সম্বন্ধে একবারও কিছু চিন্তা করেনি। অথচ লোকটা কী অদ্ভুত!
সমস্ত রাস্তা একটিও কথা বলেনি কারও সঙ্গে।
কেটি দু-একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখেছে—একবারও লোকটা তার প্রতি মনোযোগ দেয়নি। নিজের জায়গা ছেড়ে ওঠেনি পর্যন্ত—একখানা মোটা বই খুলে রেখেছে চোখের সামনে। গভীর মনোযোগ দিয়ে সমস্ত সময়টা কাটিয়েছে ওই বই নিয়ে, আর ক্রমাগত স্মোক করেছে। খাওয়ার সময় একবার শুধু উঠে গিয়েছিল ডাইনিং কারে। ওই পর্যন্তই। রাতে একবার ঘুম ভেঙে দেখেছিল কেটি, লোকটা বাঙ্ক পর্যন্ত ব্যবহার করেনি।’
কিন্তু কেন, কেন?
বই পড়াটা কি তাহলে ভান? ও কি কেটির ওপরই নজর রাখছে সর্বক্ষণ!
সন্দেহটা মাথায় আসতে ভয়ের বদলে একটু স্বস্তি পেল কেটি।
কুলকার্নিই যদি সেই অজানা ঘাতক হয়, তবে ভয়ের কিছু নেই। একসঙ্গে আরও এতখানি পথ—কম্পার্টমেন্টে অন্য কোনও যাত্রী নেই, এইরকম ছোট্ট একটা বিপদ কাটিয়ে ওঠার মতো বুদ্ধি ওর আছে। এখনও এতখানি বয়স নিশ্চয়ই হয়নি।
আর-একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছে, কুলকার্নি ফিরে এল।
শার্ট পালটে এসেছে, চেহারাও ফিটফাট—কে বলবে একটু আগে বিধ্বস্ত অবস্থায় প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠে এসেছে!
ইচ্ছে করেই লাইটারটা জ্বালল না কেটি, কয়েকবার খুটখাট শব্দ করে রেখে দিল। সোজাসুজি তাকাল লোকটার দিকে, ইংরেজিতে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, আমার লাইটারটা কাজ করছে না।’
‘শিয়োর!’ কুলকার্নি নিজের সুদৃশ্য লাইটার এগিয়ে দিয়েছিল ওকে।
সাধারণত এসব ক্ষেত্রে লাইটার জ্বেলে এগিয়ে ধরাটাই রীতি, কিন্তু কেটি তাতে বিচলিত হয়নি। সিগারেট জ্বেলে ধন্যবাদ দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল ওটা। আরও অনেকবার সিগারেট ধরাতে হবে, সুযোগ অনেক পাওয়া যাবে।
কুলকার্নি আগের মতোই পা ছড়িয়ে সেই মোটা বইখানা নিয়ে বসেছে। টুকরো কথা দিয়ে এখনও নতুন করে শুরু করা যায়, কিন্তু থাক। নিজেকে অত সস্তা করে লাভ নেই—সমস্ত রাতটা পড়ে আছে।
বাঙ্কে ফেলে রাখা চকচকে মলাটের হালকা উপন্যাসটা টেনে আনল কেটি। এটা চোখের সামনে রেখে দিলে অন্যমনস্ক ভাবটা চট করে নজরে পড়ে না।
কুলকার্নি লোকটাকে যত সহজ মনে করা গিয়েছিল, তা ও নয়। কিন্তু ভয় সেটা নয়। আসল কথা, চিরকুট লিখে যার সম্বন্ধে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে—ও সেই লোক তো!
যদি না হয়, তাহলেও পরিশ্রম ব্যর্থ হচ্ছে এরকম মনে করার কোনও কারণ নেই। লোকটার চেহারা অত্যন্ত শক্ত-সমর্থ। তেমন পরিস্থিতি হলে যাতে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা যায়, সে-ব্যবস্থাও ওকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া যাবে।
গাড়ির গতি শ্লথ হচ্ছিল। কী স্টেশন আসছে কে জানে।
বাইরে কিছু কলরব শোনা যাচ্ছে। কিছু ফেরিওলার হাঁকডাক। গার্ড দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কুলকার্নি তেমনি গভীর মনোযোগী।
গাড়ি ছাড়ল। গার্ড এখন নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছে।
কেটি জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। প্ল্যাটফর্মে লোক বেশি নেই, অন্তত শেষের দিকে।
আবছা আলোয় টুপি-পরা একটা লোকের দিকে চোখ পড়ল। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মতো।
হঠাৎ এদিকে তাকিয়ে লোকটির শরীর নড়ে উঠল। কেটি দেখতে পাচ্ছিল, সে দৌড়তে আরম্ভ করেছে—গাড়ি প্ল্যাটফর্ম ছাড়াবার আগেই উঠে পড়েছে পিছনের একটা কম্পার্টমেন্টে।
কেটির মাথার মধ্যে একটা শিরা দপদপ করছিল।
ফিরে তাকাল কুলকার্নির দিকে।
নীরব, নিস্পন্দ। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই ওর চেহারায়।
ব্যাপারটা যত সহজে চুকে যাবে ভেবেছিল তা হবে না, কেটি বুঝতে পারছিল।
ধীরে-ধীরে সে ফিরে আসছিল নিজের জায়গায়।
গার্ড এসে দাঁড়াল সামনে, ‘খেতে যাবেন, না পাঠিয়ে দিতে বলব?’
‘না, আমি যাচ্ছি।’
একটু ইতস্তত করেই বলে ফেলল কেটি। কুলকার্নি গিয়ে খেয়ে আসে, ও লক্ষ করেছে।
গার্ড কুলকার্নির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘একটু পরে।’ কুলকার্নির ভরাট স্বর ওর কানে এল।
আধঘণ্টাখানেক বই মুখে করে কাটাল কেটি। নাঃ, কুলকার্নি উঠবে বলে মনে হচ্ছে না।
এমনি করে বসেও থাকা যায় না। কেটি বই রেখে ডাইনিংয়ের দিকে এগোল।
ঘুরে আসতে বড় জোর কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। কিন্তু এসে কেটি কুলকার্নিকে দেখতে পেল না। অথচ কুলকার্নিকে দরকার ছিল, প্ল্যাটফর্মের সেই লোকটা—যদিও কেটি কনফার্মড নয়, কিন্তু ডাইনিংয়ে সে কেটির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিল।
আশ্চর্য! কোথায় গেল লোকটা! খাওয়ার ঘরে গেলে নিশ্চয়ই দেখা হত। তাহলে? টয়লেটে?
পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট—।
কেটি হালকা পায়ে উঠে গিয়ে টয়লেটটা দেখে এল। না, কেউ নেই সেখানে। ফেরবার জন্য সামনে ঘুরেই চমকে উঠেছে কেটি! আলোকিত করিডোর দিয়ে কে হঠাৎ মিলিয়ে গেল না?
কেটি চোখ মুছল। ওর হাসি পেল। মনের ভুল ছাড়া আর কী!
কেটি অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। উপায় নেই, কিছু করতে হলে এখনই করা দরকার। সুটকেস থেকে নাইটি বের করে ফেলল। মন থেকে ভয় দূর করে টয়লেটের দিকে এগোল।
ইচ্ছে করেই নিজেকে খানিকটা অসংবৃত করে তুলল কেটি। কোনও রিস্ক নেওয়া যায় না।
আয়নায় নিজের শরীরের অনেকখানি ও দেখতে পাচ্ছে। স্বচ্ছ নাইটিতে তার শরীরের বাঁকগুলো এখন অনেকখানি দৃশ্যমান। লোভনীয়।
সামান্য প্রসাধন সেরে ফিরে এল কেটি।
কুলকার্নি ফিরল তারও অন্তত পনেরো মিনিট পরে।
এবার আর সুযোগ নষ্ট করল না কেটি। অব্যর্থ একটুকরো হাসি উপহার দিয়ে বলল, ‘আপনি আমায় ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।’
‘আমি?’ কুলকার্নি নিজের সিটের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘কেন?’
‘ভাবলাম, আপনি অন্য কোনও কম্পার্টমেন্টে গেছেন—কোনও বন্ধুবান্ধবের কাছে।’
‘তাতে কী হল?’
‘আমি ভরসা পাচ্ছিলাম, অন্তত একজন এখানে আমার সঙ্গে আছে।’
কুলকার্নির মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। কিন্তু সেটা মিলিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে, বলল, ‘না, আমি এখানেই থাকব।’
‘ধন্যবাদ।’ কেটি দেরি না করে বলল, ‘আমরা অনেকক্ষণ একসঙ্গে এসেছি, পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পক্ষে অনেক দেরি হয়ে গেছে, কী বলুন?’
কুলকার্নি হাসল, বলল, ‘বোধহয় না। আমি জে. ডি কুলকার্নি।’
‘সরস্বতী ভোরা!’ কেটি রিজার্ভেশন লিস্টে নিজের যে-নাম ঝোলানো ছিল, অবলীলাক্রমে সেটা বলে ফেলল, ‘আপনি অনেকক্ষণ থেকে একটা বই পড়ছেন। কোনও উপন্যাস?’
‘না, আমি উপন্যাসের ভক্ত নই।’
‘তাহলে কী ওটা?’
‘এটা পৃথিবীর নানারকম পাখি সম্বন্ধে লেখা।’
‘ও, পাখি—’ কেটি একটা আকর্ষণীয় অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলল ‘কী দারুণ ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট। আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন?’
কুলকার্নি আবার হাসল ‘আসুন।’
সমস্ত কিছু নির্ভুলভাবে এগোচ্ছে। কেটি মনে-মনে হাসল।
একেবারে গা ঘেঁষে বসল কেটি। কুলকার্নির যদি বিন্দুমাত্র ঘ্রাণশক্তি থাকে, তাহলে এখন ও কেটির শরীর থেকে সেই মদির পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছে।
একটা পাখির ছবি দেখে কেটি আরও ঘন হয়ে বসল : ‘এটা কী পাখি?’
‘ব্লু থ্রোট। ইউরোপের পাহাড়ি অঞ্চলে থাকে।’
‘আর এটা?’ কেটি অনেকখানি ঝুঁকে পড়ল, ওর চওড়া-গলা নাইটি এখন প্রায় নাভিদেশ পর্যন্ত দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
‘মেরু অঞ্চলের পাখি, টার্ন।’
‘ইস, এটা’—বলবার সময় কেটির সমস্ত চুল ঝুঁকে পড়েছে সামনে, ওর আঙুলগুলো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছে কুলকার্নির বাহু।
বই ফেলে কুলকার্নি তাকাল কেটির দিকে। ওর চোখের দৃষ্টি এখন ঘন।
কেটির পিঠের ওপর হাত রাখল।
কেটি নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে। ওর চোখে আমন্ত্রণের দৃষ্টি।
কুলকার্নির হাত একবার খামচে ধরল কেটির পিঠ। গভীরভাবে টেনে নিয়ে এল ওর মুখটা নিজের কাছে।
কেটির মুখে এখন কুলকার্নির নিশ্বাস পড়ছে। কেটি চোখ বুজে ফেলেছে।
কিন্তু অকস্মাৎ ওকে সরিয়ে দিল কুলকার্নি। ওর নরম গাল টিপে বলল, ‘মিস ভোরা!’
কেটি বিস্মিত এবং আহত মুখে তাকাল ওর দিকে।
‘কিছু মনে করবেন না। আমি মেয়েদের খুব ভালোবাসি, বিশেষ করে আপনার মতো সুন্দরী মেয়ের সান্নিধ্য আমার কাছে একটা বিরাট আনন্দ, কিন্তু—’ কুলকার্নি সহজ ভঙ্গিতে বলছিল, ‘আপাতত আমার মাথার ওপর একটা দায়িত্ব আছে। দায়িত্ব নিয়ে আমি সেটা ভুলে যেতে ভালোবাসি না।’
কেটির বুকের ভেতরে কীসের শব্দ। বলল, ‘কীসের দায়িত্ব?’
‘দুঃখিত, আপনাকে আমি সেটা বলতে পারছি না।’
‘আমার চেয়েও সেটা বড়?’
‘এই মুহূর্তে।’
‘ও।’ কেটি সোজা হয়ে বসল : ‘ঠিক আছে। আমাকে মাপ করবেন।’
‘মাপ করার প্রশ্ন ওঠে না—’ কুলকার্নি বলল, ‘ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে—আজ রাতের মতো আমি অসহায়।’
শয়তান। মনে-মনে ফুঁসে উঠল কেটি। এখন আর কোনও সংশয় নেই।
আবার দেখা হবে!
কেটি সরে এল। আর দেখা হওয়া সম্ভব নয়, তুমি বা আমি—দুজনের একজনকে আজ রাতের মধ্যে সরে যেতেই হবে।
গার্ড কোথায় একবার দেখা দরকার।
কেটি উঠে পড়ল। করিডোর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
গার্ড বসে-বসে ঝিমোচ্ছে। মাথাটা হেলিয়ে দিয়েছে পিছনে। চমৎকার সুখ-নিদ্রা উপভোগ করছে।
এদিকেও একটা টয়লেট আছে। কেটি সেদিকে পা বাড়াল।
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। নাক উঁচু করে গন্ধ নিল। কোথা থেকে আসছে গন্ধটা! কেমন বিশ্রী আঁশটে গন্ধ একটা!
গন্ধের ব্যাপারে কেটির নাক খুব তীক্ষ্ন। একটু এগিয়ে র্যাক মতো একটা জায়গা। মাল-টাল থাকে বোধহয়। হ্যাঁ, এখান থেকেই গন্ধটা আসছে।
কিন্তু সেখানে কিছু নেই। বিরাট একটা বস্তা মুখ-বাঁধা অবস্থায় রয়েছে শুধু।
কী আছে ওখানে?
কেটি নিজেকে সামলাতে পারল না, এগিয়ে গেল। বস্তার মুখটা খুলতে লাগল লঘু হাতে। দড়িটা খোলার সঙ্গে-সঙ্গে—।
একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এসেছে ওর গলা থেকে!
ওর হাত-পা কাঁপছিল। চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক হয়ে পড়ছিল।
একটা নিস্প্রাণ দেহের মুণ্ডটা ঝুলে পড়েছে। চোখের মণি দুটো বেরিয়ে এসেছে। নাকের কাছে জমাট-বাঁধা রক্ত।
টলতে-টলতে ফিরতে যাচ্ছিল, গার্ড এসে দাঁড়িয়েছে পিছনে।
‘কী ব্যাপার, ম্যাডাম?’
‘একটা ডেডবডি।’
‘ডেডবডি!’ গার্ড একবার উঁকি দিল, তারপরই হঠাৎ ভারী এবং চাপা গলায় বলল, ‘তাই তো!’
‘রাস্তা ছাড়ুন, আমার খারাপ লাগছে।’
‘রাস্তা এখন একটাই—’ গার্ডের হাতে একটা রিভলভারের নল চকচক করছে, ‘এদিকে আসুন।’
‘ওদিকে তো টয়লেট।’
‘আমি জানি।’
‘ওদিকে আমি কেন যাব?’
‘আমার হাতে যে-অস্ত্রটা দেখছ, কেটি, এতে সাইলেন্সার ফিট করা আছে। মিছিমিছি কথা বাড়িয়ো না।’
কেটি! লোকটা তার নাম জানে। তাহলে—।
এক-পা এক-পা করে এগোচ্ছিল কেটি। পিঠে রিভলবারের ঠেকানো নল সে এখন অনুভব করতে পারছে। আশ্চর্য, এই লোকটা তাহলে—!
‘শয়তান!’ কেটি ফিসফিস করল, ‘তুমি তাহলে গার্ড নও?’
‘মোটেই না। গার্ড ওইখানে শুয়ে রয়েছে।’
‘তুমি?’
‘সে-কথা জেনে কী হবে? তোমার আয়ু তো মাত্র আর সেকেন্ড-কয়েক।’
‘শোনো—।’
‘খবরদার, সামনে ফিরো না। তাতে তোমার আয়ু বাড়বে না।’
‘কিন্তু, আমাকে তুমি মারবে কেন?’
‘কারণটা আমারও জানা নেই। কিন্তু মরতে তোমাকে হবেই। তুমি তৈরি হও।’
‘শোনো, প্লিজ, একবার আমাকে কয়েকটা কথা বলতে দাও।’
‘কোনও কথা নয়, তুমি তৈরি হও। তৈরি?’
‘প্লিজ—।’
‘এক, দুই—।’
ভয়ে কেটির সমস্ত শরীর কুঁকড়ে উঠেছিল। কোনও কথা ওর কানে যাচ্ছিল না। আতঙ্কে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কয়েক মুহূর্ত কোনও সংবেদন ছিল না শরীরে। সংবিৎ ফিরতে সে অবাক হল। সে এখনও বেঁচে আছে! পিছনে কীসের শব্দ!
মাথা ঘুরিয়ে কেটি বিস্মিত হয়ে গেল। লোকটাকে মাটিতে ফেলে তার বুকে একটা পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুলকার্নি। লোকটার রিভলভার ছিটকে পড়ে আছে দূরে।
‘শুনুন,’ কুলকার্নি হাঁপাচ্ছিল : ‘আপনাকে মিস ভোরা বলব, না কেটি, সেটা পরের প্রশ্ন। অনুগ্রহ করে আপনার অস্ত্রটা হাতে তুলে নিন। যতদূর জানি, আপনার লক্ষ্য বেশ ভালোই। লোকটাকে আপনি লক্ষ করুন, বাকি কাজ আমি করছি।’
কেটি নিমেষে অটোমেটিক হাতে তুলে নিল।
কুলকার্নি ক্ষিপ্র গতিতে পকেট থেকে শক্ত কর্ড বার করে লোকটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। মুখে একটা রুমাল গুঁজে মুখটাও বন্ধ করে দিল।
সমস্ত কাজ মিনিট-দুয়েকের মধ্যে সেরে বলল, ‘ব্যস, আপনার এবার ছুটি।’
‘লোকটা ওইভাবে থাকবে?’
‘কক্ষনও না।’ কুলকার্নি অবলীলাক্রমে ওকে কাঁধে ফেলে বলল, ‘আসল গার্ডকে যেখানে পাঠিয়েছে, সেটাই ওর সবচেয়ে ভালো জায়গা। আপনি ওর রিভলভারটা বাইরে ফেলে দিন। এসব জিনিস ধারেকাছে না থাকাই ভালো।’
কাজ সেরে ফিরে এসে কুলকার্নি বলল, ‘আমার দায়িত্বের ব্যাপারটা এখন বোধহয় বিশ্বাস করা চলে!’
‘ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘আপনি খুব সতর্ক মেয়ে—’ কুলকার্নি পকেট থেকে একটা কার্ড বার করল : ‘নাইন নট সেভন, ডব্লু ওয়াই এক্স বোম্বে।’
‘ধন্যবাদ।’
‘এখন আপনি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে পারেন। বাকি রাতটাও আমি এইভাবেই পাখির ছবি দেখে কাটিয়ে দেব।’
কেটির কপাল ভিজে উঠেছিল। এতক্ষণ পরে ওর ক্লান্ত লাগছিল। বাঙ্কের দিকে এগিয়ে বলল, ‘অনেক—অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘এটা অবশ্য সবটা আমার প্রাপ্য নয়। ঠিক আছে, গুড নাইট।’
‘গুড নাইট।’
কেটি নরম গদিতে নিজেকে ছেড়ে দিল।
হাওড়া স্টেশনে নেমে কুলকার্নি বলল, ‘একমিনিট। আমাদের কম্পার্টমেন্টের বন্ধু দুটির একটা ব্যবস্থা করি, না হলে পরে ঝামেলা হতে পারে।’
‘প্ল্যাটফর্মেও আমাদের লোক আছে?’
‘আছে।’
কথা বলে একমিনিটের মধ্যে ফিরে এল কুলকার্নি।
বাইরে গাড়ির নম্বর দেখে কাছে এসে কেটি বলল, ‘এবার আপনার দায়িত্ব শেষ, আপনি যেতে পারেন।’
‘আমার ওপর কিন্তু সেরকম অর্ডার নেই। আমি আপনার সঙ্গে যাব।’
‘বেশ তো, চলুন।’
গাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যেই মধ্য কলকাতার একটি ঠিকানায় গিয়ে উপস্থিত হল। ঢুকেই রিসেপশনে যে-মেয়েটি ছিল, তাকে কেটি তার কার্ড দেখাল।
মেয়েটি বলল, ‘উনি আপনার জন্যে ওয়েট করছেন, চলে যান।’ কিন্তু কুলকার্নিকে দেখে সে ভুরু কোঁচকাল, ‘ইনি?’
‘স্পেশাল অর্ডার আছে।’
মেয়েটি কোনও কথা না বলে ওদের রাস্তা দেখিয়ে দিল।
ঘরটা ছিমছাম। এয়ারকন্ডিশনড। যে-লোকটি টেবিলে মাথা নিচু করে বসেছিল, পায়ের শব্দে সে মাথা তুলেছে।
‘হ্যালো কেটি, সাকসেসফুল?’
‘ইয়েস স্যার।’ কেটি নিতম্বের পিছন থেকে পাকানো একটা কাগজ বার করে দিল।
কুলকার্নির দিকে চেয়ে লোকটির চোয়াল ভারী হয়ে উঠেছিল, কেটিই বলল, ‘নাইন নট সেভন। আমাকে রেসকিউ করেছেন।’
একটু গম্ভীর হয়ে লোকটি বলল, ‘থ্যাঙ্কস। কেটি, তুমি যেতে পারো।’
কেটি চলে যাওয়ার পর লোকটা সোজাসুজি তাকাল কুলকার্নির দিকে। বলল, ‘তুমি এখানে কেন?’
‘অর্ডার ছিল।’
‘অর্ডার কী ছিল, আমি জানি। কেটি ছাড়া আর কেউ আমাদের কলকাতার অফিস চিনুক, আমাদের বসের ইচ্ছে নয়। দেন, হু আর ইউ?’
কুলকার্নি চুপ।
‘আমি জানতে চাই, তুমি আমাদের শত্রু রোবস্টনের লোক, না টিকটিকি?’
কুলকার্নি এবারও চুপ।
‘চুপ করে থেকে লাভ নেই। আমার যে-হাতটা তুমি দেখতে পাচ্ছ না, সেখানে একটা তাজা অটোমেটিক ধরা রয়েছে। আমার কথার উত্তর দাও, হু আর ইউ?’
কুলকার্নির মুখে কয়েকটা রেখা শক্ত হয়ে উঠল। বলল, ‘আমার নাম মোহন চৌধুরী, লোকে আমায় ম্যাক বলে চেনে।’
‘ও, দ্যাট ডিভাইন রোগ।’ লোকটা দাঁতে-দাঁতে ঘষল : ‘তাহলে তুমি টিকটিকি!’
‘তোমাদের ভাষায়।’
‘স্টপ ইট। নাইন নট সেভন কোথায়?’
‘তাকে সন্ধে ছ’টা-সাতটা নাগাদ একটা ছোট্ট স্টেশনে বেশ যত্নে রেখে এসেছি।’
‘বাট হোয়াই?’
‘তোমাদের আড্ডার সন্ধান জানা আমার উদ্দেশ্য ছিল।’
‘সেই লোকটাকে জেরা করতে পারতে, এভাবে মৃত্যুর গুহায় মরতে এলে কেন?’
‘তাকে জেরা করে যে লাভ নেই, সে তুমিও জানো।’
‘রোবস্টনের লোক কোথায়?’
‘সে গার্ডকে খুন করে তার পোশাকে কেটিকে মারবার অপেক্ষায় ছিল, এখন বোধহয় সে লালবাজারে।’
লোকটা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘ওয়েল, তোমার বুদ্ধির এবং সাহসের প্রশংসা করতে আমি বাধ্য। কিন্তু এত কথা জানার পর তোমায় আর বাঁচিয়ে রাখা আমার পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বোধহয়, কী বলো?’
ম্যাক নিজের কর্তব্য ঠিক করছিল। ওর একটা পা ধীরে-ধীরে পৌঁছেছিল টেবিলের পায়ার কাছে। লোকটাকে বিভ্রান্ত করবার জন্য হঠাৎ প্যান্টের পকেটের দিকে হাত বাড়াল।
‘ব্যস, ব্যস—’ লোকটা ভুরু তুলে হাসল : ‘তোমার প্যান্টের পকেটে যে একটা ছোটখাট কিছু থাকতে পারে, সেটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আমার আছে। আর কয়েক সেকেন্ড যদি বাঁচতে চাও, হাতটা—।’
ম্যাকের পায়ের ধাক্কায় টেবিলটা আছড়ে পড়েছে সেই মুহূর্তে।
লোকটার হাত থেকে গুলিও ছুটেছে সঙ্গে-সঙ্গে। কিন্তু দ্বিতীয় গুলি করবার আগেই ম্যাকের ডান পা সেটিকে ছিটকে দিয়েছে মেঝেয়। এবং কলিংবেলে হাত পৌঁছবার চেষ্টা করে লোকটা বুঝেছে, সেটা একটি দৃঢ় মুষ্টিতে ধরা পড়েছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার হাতদুটো ম্যাক বেঁধে ফেলেছে কর্ড দিয়ে।
যে মুহূর্তে উঠে হাঁপাচ্ছে, দরজা খোলার শব্দ।
উদ্যত রাইফেল হাতে একে-একে চারজন কনস্টেবল সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
লোকটির বিহ্বল দৃষ্টির দিকে চেয়ে ম্যাক বলল, ‘তোমার আর একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল। লোকে বলে, কোয়ার্টার সেকেন্ডের মধ্যেই আমি মুভ করতে পারি। তা ছাড়া—।’
ম্যাক রুমাল খুঁজল। না পেয়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করল, লাইটার দিয়ে সেটিতে অগ্নিসংযোগ করে বলল, ‘তা ছাড়া, এত কাজ করে পুলিশকে আমি ফলো করতে বলব না, এটাই বা তুমি ভাবলে কী করে?’
লোকটা গজরাতে-গজরাতে বলল, ‘কেটি তোমার সঙ্গে ছিল।’
ম্যাক হাসল : ‘আফটার অল সে একটা মেয়েমানুষ। আমি তার সামনেই পুলিশকে বলে এসেছিলাম আমাদের ফলো করতে এবং বাড়ি ঘিরে ফেলতে। গুলির শব্দ শোনামাত্র যেন ওরা ভেতরে ঢোকে। আই শ্যুড বি ওবলাইজড—গুলিটা আমাকে খরচ করতে হয়নি।’
শুভেন্দু এসে গিয়েছিল। ম্যাক বলল, ‘দেন, শুভ, ইটস অল ইয়োর বিজনেস। তুই আমায় খবর এনে দিয়েছিলি। তখন আমি বলেছিলাম, এই গুপ্তচক্রের সন্ধান তোকে দেব। আশা করি, এরপর বোম্বাইয়ের ঘাঁটি বার করবার ব্যাপারে মহারাষ্ট্র পুলিশের সহযোগিতাই তোর পক্ষে যথেষ্ট হবে।’
‘অনেক ধন্যবাদ। এবার তোর ছুটি।’
‘বাঁচালি।’ ম্যাক বলল, ‘শুধু একটা আপশোস থেকে গেল।’
‘কী?’
‘আমি একটা বুদ্ধু—’ ম্যাক শুভেন্দুর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘যে-মেয়েটার সঙ্গে দুটো রাত কাটালাম, আই মিন কেটি—দ্যাট ডেম মেকস আ ফাইন কম্প্যানি—সুযোগটা আমার ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি।’
শুভেন্দু চিৎকার করে কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। প্রচণ্ড একটা গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘অ্যারেস্ট হিম।’
কাকে অবশ্য ঠিক বোঝা গেল না।
মাসিক রোমাঞ্চ
জানুয়ারি, ১৯৭৯