অতীশ দীপঙ্কর (৯৮২–১০৫৩) – জ্ঞানসাধক বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক
এই মহান জ্ঞানসাধক কিন্তু একান্তই আমাদের ঘরের মানুষ। তাঁর জন্মস্থান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে। ৯৮০ সালে, মতান্তরে ৯৮২ সালে এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কল্যাণশ্রী এবং মাতার নাম প্রভাবতী। অতীশ দীপঙ্করের পিতৃদত্ত নাম ‘আদিনাথ চন্দ্ৰগৰ্ভ’।
উনিশ বছর বয়সে দণ্ডপুরীর মহাসঙ্ঘিকাচার্য শীলরক্ষিতের কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন তিনি। প্রথমে নিজের মা ও পরে অবধূত জেতারির কাছে শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং বিহারের কৃষ্ণগিরি রাহুলের কাছে বৌদ্ধ গুহ্য মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধি লাভ করেন। এরপর ১০১১ খ্রিস্টাব্দে শতাধিক শিষ্য নিয়ে সুবর্ণ দ্বীপে গমন করেন। সেখানে বারো বছর বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে গবেষণা করার পর দেশে ফিরে আসেন। সে সময় তিনি বঙ্গদেশের রাজা মহিপালের অনুরোধে বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান অধ্যক্ষের পদগ্রহণ করেন।
মগধে অবস্থানকালে শুধু আধ্যাত্মিক সাধনা আর ধর্মীয় শাস্ত্রচর্চাতেই নিয়োজিত ছিলেন না, তিনি রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজেরও দায়িত্বে ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় সংকটেও অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন রাজা ন্যায়পাল দেবের প্রধান উপদেষ্টা। রাষ্ট্রীয় কার্যে তাঁর ছিল বিশেষ দক্ষতা।
এই সময় তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কার্যে দক্ষতার পাশাপাশি তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে নানা দিকে। মগধে অবস্থানকালেই তাঁকে তিব্বতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে তিব্বতরাজ হা-লামা বিক্রমশীলায় দূত প্রেরণ করেন।
তখন তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের খুব সংকটকাল চলছিল। একজন সুপণ্ডিত ও ধর্মীয় শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির অভাবে তখন তিব্বতে ধর্মের আদর্শ প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। চারদিকে দেখা দিয়েছিল ধর্মীয় অনাচার আর অনিয়ম। তিব্বতরাজ ভাবলেন অতীশ দীপঙ্করের মতো পণ্ডিত লোককে আনতে পারলে দেশে ধর্মচেতনার বিকাশ ঘটবে—দূর হবে সামাজিক অনিয়ম ও অনাচার।
কিন্তু হাতে প্রচুর কাজ থাকায় অতীশ দীপঙ্কর সেই সময় বিক্রমশীলা ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। অগত্যা তিব্বতরাজের দূত এদিকে ফিরে গেলেন।
এদিকে অতীশ দীপঙ্কর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করায় তিব্বতরাজ অসম্ভব খেপে যান। তিনি দীপঙ্করকে ছলে-বলে-কৌশলে হলেও তিব্বতে নেবার জন্য অপচেষ্টা শুরু করেন। ফলে তিনি নিজেই বেকায়দায় পড়ে যান। তাঁর দেশের ভেতরেই শুরু হয়ে যায় বিদ্রোহ। একদিন তিনি নিজেই বিদ্রোহী প্রজাদের হাতে নিহত হন।
এরপর তিব্বতের রাজা হন তাঁর পুত্র চ্যান-চাব। এই নতুন রাজা ছিলেন খুবই ভালো লোক। তিনি পিতার মতো উগ্র এবং হিংসুক ছিলেন না। তার আকাঙ্ক্ষা, অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে আসুন। দীপঙ্করের প্রতি তাঁরও ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। তাই তিনি তাঁর দেশের বর্তমান ধর্মীয় অবনতির কথা সবিনয়ে ব্যক্ত করে বিক্রমশীলায় পত্রসহযোগে আবারও দূত প্রেরণ করলেন।
এই সবিনয় অনুরোধ এবার আর প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না অতীশ দীপঙ্কর। তিনি তিব্বতে যেতে রাজি হয়ে গেলেন।
বিক্রমশীলায় যে-কাজগুলো তিনি হাতে নিয়েছিলেন তা শেষ করতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। ফলে তিনি দেড় বছর পরে তিব্বতে যাবেন বলে রাজদূতের কাছে প্রতিশ্রুতি দিলেন। রাজদূত এই শুভ সংবাদ নিয়ে ফিরে গেলেন নিজের দেশে।
অতীশ দীপঙ্কর তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। দেড় বছর পর তিনি সত্যি সত্যি বিক্রমশীলা ছেড়ে তিব্বত অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। তিনি ভারতের সমতল অঞ্চল ছেড়ে তুষার সমাচ্ছন্ন অভ্রভেদী হিমালয়ের দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম করে একদিন উপনীত হন তিব্বতের রাজদরবারে।
১০৪০ খ্রিস্টাব্দে অতীশ দীপঙ্কর যখন তিব্বতের গুজে নামক স্থানে উপস্থিত হওয়া মাত্রই দেখতে পেলেন বিশাল রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তিব্বতরাজ চ্যান-চাব স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছেন।
রাজার নির্দেশে রাজকীয় বাহিনীর সৈন্যরা তিব্বতীয়দের পবিত্র মন্ত্র এবং মণিপত্রে বৈদিকমন্ত্র আবৃত্তি করতে করতে মহান অতিথিকে সাদর ও রাজকীয় সংবর্ধনা জ্ঞপন করলেন। সাদর অভ্যর্থনা করে অতীশ দীপঙ্করকে নিয়ে আসা হয় রাজপ্রাসদে। সেখানে উপস্থিত হয়ে আবারও তাঁকে জানানো হয় আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা। তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে প্রদান করা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ হো-বো-জে অর্থাৎ ‘ভট্টারক’ উপাধি।
তিব্বতে গমনের দুবছর পর ১০৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি থোলিন রাজবিহারে উপস্থিত হন। সেই সময় তাঁর বয়স ৬১ বছর।
এরপর থেকেই তিনি তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে শুরু করেন। তিনি সারা তিব্বতের প্রধান প্রধান শহর, গ্রাম এবং পীঠস্থান ভ্রমণ করে ধর্মের প্রচার চালাতে থাকেন। তাঁর বিপুল পাণ্ডিত্য এবং অসাধারণ বাগ্মিতায় দেশের মানুষ মুগ্ধ হয়ে যায় এবং তারা তাদের হারানো ধর্মীয় বিশ্বাস ফিরে পেতে থাকে।
শুধু ধর্মপ্রচারই নয়, তিনি তিব্বতের রাজধানী লাসা সংলগ্ন ন্যাথাং-এ একটি বৃহৎ বৌদ্ধবিহারও প্রতিষ্ঠা করেন।
তিব্বতে যাওয়ার পথে নেপালের রাজা অনন্তকীর্তি তাঁকে সংবর্ধনা দান করেন। নেপালের রাজপুত্র পথপ্রভা তাঁর কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন। তিব্বতেও তিনি লাভ করেন রাজকীয় সম্মান। এখনও সেখানকার মঠের প্রাচীরে এই সংবর্ধনার দৃশ্য আঁকা আছে। বৌদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসা ও কারিগরিবিদ্যা সম্পর্কে তিব্বতীয় ভাষায় গ্রন্থ রচনা করে তিনি তিব্বতিদের কাছ থেকে সম্মানজনক ‘অতীশ’ উপাধি লাভ করেন।
তিব্বতে তিনি বহু প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথিও আবিষ্কার করেন এবং নিজের হাতে সেগুলোর প্রতিলিপি তৈরি করে বাংলাদেশে প্রেরণ করেন। তিনি বহু সংস্কৃত গ্রন্থ ভোট ভাষায় অনুবাদ করেন। এছাড়া নিজে ‘রত্নকরণ্ডোদ্ঘাট’, ‘বোধিপাঠ’, ‘প্রদীপপঞ্জিকা’, ‘বোধিপাঠ প্রদীপ’ প্রভৃতি গ্রন্থ এবং সম্রাট ন্যায়পালের উদ্দেশ্যে “বিমলরতুলেখ’ নামক পত্র রচনা করেন।
‘চৰ্য্যাসংগ্রহ প্রদীপ’ নামক গ্রন্থে অতীশ রচিত অনেকগুলো সংকীর্ত্তনের পদ পাওয়া যায়। তাঁর মূল সংস্কৃত রচনাগুলো বিলোপ হয়ে গেছে। তবে তিব্বতি ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে এগুলোর অস্তিত্ব টিকে আছে।
তিব্বতে আগে প্রায়ই বন্যা হতো। তিনিই ব্যক্তিগতভাবে এই বন্যার প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেন। তিব্বতিরা তাঁকে যে অর্থ দিয়েছিলেন, তাই দিয়ে তিনি নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে বন্যা প্রতিরোধ করেন।
ভারতের বিক্রমশীলা ছেড়ে অতীশ দীপঙ্কর যে তিব্বতে গিয়েছিলেন, সেখানেও তাঁর একটি শর্ত ছিল। তিনি বিক্রমশীলা ছেড়ে গিয়েছিলেন এই শর্তে যে, বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে তিনি তিব্বতে মাত্র তিন বছর থাকবেন। কাজ শেষ করেই আবার ফিরে আসবেন বিক্রমশীলায়।
কিন্তু অতীশ দীপঙ্করের পক্ষে এই শর্ত রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে তাঁর পক্ষে আর বিক্রমশীলায় ফেরা সম্ভব হয়নি। কারণ তিব্বতে গিয়ে তিনি সে-দেশের মানুষকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে, তিব্বতবাসীরা তাঁকে এমন শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন যে, এসব ছেড়ে তিনি দেশে ফিরতে পারেননি।
১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে, বাংলা কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থ তিথিতে ন্যাথাং বিহারেই তিনি পরলোকগমন করেন।
অতীশ দীপঙ্কর লামা ধর্মের প্রবর্তক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কখনও লামা উপাধি গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন সত্যিকারের জ্ঞানের সাধক।
১৯৭৮ সালে চীন থেকে তাঁর চিতাভষ্ম ঢাকায় এনে বৌদ্ধবিহারে স্থাপন করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার অতীশ দীপঙ্করের জন্মভূমি বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে তাঁর একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।