অচলার প্রেম
এবারের নিবন্ধের নাম হওয়া উচিত ছিল ‘আবার পরকীয়া’ কিংবা ‘পরকীয়ার পরে’ অথবা অনুরূপ কিছু। এবারে আমাদের বিষয়বস্তু পরকীয়া প্রেম বা ব্যভিচার। জটিল বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে, তাই নামটাও জটিল হল।
আগে একটা কথা পরিষ্কার করে নিই। সব পরকীয়া ভালবাসাই কিন্তু ব্যভিচার নয়। পরকীয়া প্রেম অনেক সময়েই দূর থেকে, সে অধরা, অছোঁয়া নিতান্তই নিরামিষ। সত্যজিৎ রায়ের পিকুর মা অথবা লেডি চ্যাটারলির মতো নয়। নিরামিষ পরকীয়া প্রেম, যা কামগন্ধহীন, যার তুলনা শুধু নিকষিত হেম; সেই স্বপ্নময় ভালবাসা পৃথিবীর সমস্ত রোমান্টিক গল্প-উপন্যাস, মধুর কবিতা এবং সোনালি গানের মূল বিষয়বস্তু।
আমরা মোটা আলোচনায় যাচ্ছি না। বিষয়টি জটিল, আগে সরল বিলিতি গল্প বলে নিই।
প্যারিস শহরের এক রেস্তোরাঁয় বসে সকালে দুই বন্ধু খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চা খাচ্ছে। হঠাৎ এক বন্ধুর চোখ খবরের কাগজের এক জায়গায় পড়তে সে আঁতকিয়ে উঠল, সে অন্য বন্ধুকে দেখাল তারপর পড়ে শোনাল। ঘটনাটি সামান্য নয়, মাদাম দুভালের স্বামী মঁশিয়ে দুভাল গতকাল রাতে অতর্কিতে বাড়ি ফিরে এসে তাঁর স্ত্রীকে ঘরের মধ্যে এক অপরিচিত লোকের সঙ্গে দেখতে পান। মঁশিয়ে দুভাল কয়েকদিন আগে লন্ডনে গিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে ফেরার কথা ছিল তাই হয়তো দুভাল-পত্নীর এই অসতর্কতা।
সে যা হোক, দুভালসাহেব বাড়ি ফিরে সেই হতভাগ্য প্রেমিককে দড়ি দিয়ে জানলার গরাদের সঙ্গে বাঁধেন। তারপর নির্মমভাবে একঘণ্টা চাবুক মারেন এবং অবশেষে তাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে প্যারিস শহরের শীতের বরফজমা, কনকনে ঠান্ডায় রাস্তায় লাথি মেরে বাড়ির মধ্য থেকে বের করে দেন। পুলিশের গাড়ি দুর্ভাগ্যকে উদ্ধার করে রাস্তা থেকে তুলে অ্যামবুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। যে বন্ধুটি খবরের কাগজটি অন্য বন্ধুকে পড়ে শোনাচ্ছিল, সে বলল, ‘কী সাংঘাতিক। সামান্য অবৈধ প্রেমের জন্য এত লাঞ্ছনা ! কী সাংঘাতিক ব্যাপার।’ যে শুনছিল সেই দ্বিতীয় বন্ধুটি খবরটা শুনে অনেকক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, ‘এর চেয়ে আরও সাংঘাতিক হতে পারত।’
প্রথম বন্ধু বিস্মিত, ‘এর থেকে আর কী সাংঘাতিক হবে।’ দ্বিতীয় বন্ধুটি বলল, ‘কাল না হয়ে পরশুদিন হলেই আরও সাংঘাতিক হত। পরশুদিন রাতে যে আমি ছিলাম দুভালমেমের বাড়িতে, সেদিন যদি দুভাল ফিরত !’
দ্বিতীয় কথিকাটি বিপরীতমুখী। আগের গল্পের স্বামী মারমুখী। আর এ গল্পে ভীরু, ভালমানুষ স্বামী তাদের একজন যারা বউকে দখলে রাখতে পারে না, সাহেবরা যাদের শিং গজিয়েছে বলে উপহাস করে।
এক ব্যক্তির অফিসে খুব ক্লান্ত লাগছে। অথচ অফিস ছুটি হতে এখনও তিন-চার ঘণ্টা বাকি। এখন ভরদুপুর। তার সাহসের অভাব, অফিস থেকে পালাতে ভরসা করছে না। তার সহকর্মী তাকে বলল, ‘আরে, ভয়ের কী আছে ? আজ তো বড়সাহেব অফিসে নেই। খুব সাজগোজ করে, ভুরভুরে আতর মেখে বেরিয়েছে। কোথাও ফুর্তি করতে গেছে, সহজে ফিরবে না। তুমি বাড়ি চলে যাও, কেউ তোমাকে ধরবে না।’
ক্লান্ত কর্মচারীটি সংশয়াকুল চিত্তে গৃহপানে রওনা হল। তার বাড়ি কাছেই। পনেরো মিনিটের মধ্যে দেখা গেল সে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে অফিসে ফিরে আসছে। সে ফিরে এসে হাঁপাতে লাগল। একটু বিশ্রাম নেয়ার পরে তার পূর্ব পরামর্শদাতা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি এমন ভয় পেয়ে ফিরে এলে কেন ?’
কর্মচারীটি বলল, ‘তোমার পরামর্শ শুনে আজ আমি ঘোর বিপদে পড়েছিলাম।’
‘কী বিপদ ?’ কিছুই বুঝতে পারছে না পূর্ব পরামর্শদাতা।
‘কী বিপদ ?’অফিস কেটে চলে যাওয়া বন্ধুটি ব্যাখ্যা করে বলল, ‘চাকরি যেতে বসেছিল। আজ চাকরি খোয়াতাম। বড় সাহেবের কাছে অল্পের জন্য ধরা পড়িনি যে অফিস পালিয়েছিলাম।’
পরামর্শদাতা পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘তার মানে ?’
বন্ধুটি বললে, ‘তার মানে ?’ বাড়ি ফিরে শোয়ার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, হঠাৎ শুনি বউ কার সঙ্গে খুব হেসে হেসে কথা বলছে। জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখি বড়সাহেব আমার বিছানায় শুয়ে। ভাগ্যিস হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে যাইনি। তা হলেই ধরা পড়ে যেতাম। অফিস পালানো ধরতে পারলে সাহেব নিশ্চয়ই আমাকে বরখাস্ত করত। সেই ভয়েই তো এক ছুটে ফিরে এলাম অফিসে৷’
‘মানুষেরা যাকে বীরত্ব বলে, ঈশ্বর যাকে ব্যভিচার বলেন,’ লর্ড বায়রন ডন জুয়ানে লিখেছিলেন, ‘সেটা খুব বেশি সেই সব অঞ্চলে যেখানে আবহাওয়া উষ্ণ।’
উষ্ণ আবহাওয়ার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ভাল করেননি বায়রন, বরং আমাদের প্রাচ্যদেশীয়দের মনে হয় বায়রন সাহেবের শীতল শ্বেতাঙ্গ দেশগুলিতেই চিরদিন ব্যভিচার প্রবল ছিল এবং এখনও আছে।
বায়রন সাহেবের বেশ কিছুকাল আগে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার নামে এক নাট্যকার অত্যন্ত অনাসক্তভাবে পরকীয়া সম্পর্কে দু’-চার হাজার কথা লিখেছিলেন। শেক্সপিয়ারের মতো হৃদয়সন্ধানী মানুষকে অনাসক্ত বলছি এ কারণে যে তিনি নিজের সঙ্গে নিজেরই বিরোধ ঘটিয়েছেন।
‘বিনা কারণে বাড়াবাড়ি’ অর্থাৎ ‘মার্চ এডু (কিংবা এ্যডু অথবা অ্যাডু বা অ্যাডু) অ্যাবাউট নাথিং’ নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে নাট্যকার মহিলাদের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে মানা করেছেন, ‘কারণ পুরুষেরা চিরদিনের প্রতারক, তাদের এক পা সাগরে আরেক পা তটভূমিতে, পুরুষেরা কোনওদিন কোনও একটা কিছুতে স্থির নয়।’
চমৎকার ! চার শতাব্দী পরের এক অস্থিরচিত্ত পুরুষমানুষ হিসেবে এ না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু সেই মুহূর্তেই মহাকবির আটাশিতম সনেটের হিরের মতো উজ্জ্বল দুটি পঙ্ক্তি মনে পড়ছে। ‘আমার প্রেমিকা শপথ করেছে সবটাই তাঁর খাঁটি, বিশ্বাস করি; যদি জেনেছি মিথ্যাও বলে সে।’
ব্যর্থ অনুবাদে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের এতবড় সর্বনাশ এর আগে কেউ করেনি। অধিক মূর্খতা প্রকাশ করে লাভ নেই। বরং সরাসরি মাতৃভাষায় যাই।
মাতৃভাষা এবং শরৎচন্দ্র এবং এই নিবন্ধের শিরোনামায় চলে আসি৷ ‘অচলার প্রেম’ নামক একটি সত্য ঘটনামূলক কাহিনী দিয়ে পরকীয়ার আলোচনা পরবর্তী সংখ্যার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি।
এই গল্প এক প্রৌঢ় বাংলার অধ্যাপককে নিয়ে। তিনি একান্ত সরল এবং নীতিপরায়ণ। তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো দেখেন, তাদের নিত্যশুভার্থী।
তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্সের সিলেবাসে শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’ পাঠ্য ছিল। আমার নিজের পাঠ্যবিষয় অন্য থাকলেও গল্পটা আমি শুনেছিলাম বাংলার ছাত্রদের, বিশেষ করে কবি দেবতোষ বসুর কাছ থেকে।
ওই প্রৌঢ় অধ্যাপকই ছিলেন বাংলা বিভাগের প্রধান। তিনি নিজেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন ‘গৃহদাহ’ পড়ানোর।
প্রধান অধ্যাপক মহোদয় একবারও চিন্তা করে দেখেননি তাঁর নিরীহ এবং গোবেচারা দর্শন ছাত্রছাত্রীরা প্রায় প্রত্যেকেই এমন সব বিষয় জানে, এমন সব বিষয় পড়েছে যার কাছে সনাতনপন্থী শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’ নিতান্তই শিশুশিক্ষা কিংবা বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ।
অধ্যাপক মহোদয় ‘গৃহদাহ’ নিজের হাতে রাখলেন, কিন্তু কিছুতেই পড়াচ্ছেন না। তখন অনার্স দু’বছরের। তাঁর চিন্তা যে দু’বছরে ছেলেমেয়েগুলোর একটু বয়স বাড়বে, তারা একটু পরিণত হবে, তখন গৃহদাহের গূঢ় তত্ত্ব তাদের বোঝানো যাবে।
ফলে অনার্সের টেস্ট পরীক্ষা পর্যন্ত ‘গৃহদাহ’ পড়ানো হল না। তখনও প্রধান অধ্যাপকের যথেষ্ট মনোবল তৈরি হয়নি বইটি পড়ানোর মতো। তিনি মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকান আর মনে মনে অঙ্ক কযেন ছেলেমেয়েরা ‘গৃহদাহ’ পাঠের যোগ্য হল কি না। অবশেষে ছাত্রছাত্রীরাই তাঁকে চেপে ধরল, ‘স্যার, আমাদের আর কবে ‘গৃহদাহ’ পড়ানো হবে ?’ তখন অধ্যাপক টেস্ট পরীক্ষার পরে একদিন স্পেশ্যাল ক্লাসের বন্দোবস্ত করলেন শুধু শরৎচন্দ্রের ওই উপন্যাসটি পড়ানোর জন্য।
স্পেশাল ক্লাসের আরম্ভ হওয়ার কথা ছিল বেলা এগারোটায়। অধ্যাপক খুবই সময় সচেতন কিন্তু সেদিন প্রায় পৌনে বারোটা পর্যন্ত তাঁর দেখা নেই। ছাত্রছাত্রীরা যখন অধীর হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখা গেল গেট দিয়ে তিন ঢুকছেন। কিন্তু এ কোন তিনি ? যেন তাঁর গুরুদশা হয়েছে। একগাল না-কামানো দাড়ি, লাল চোখ, এলোমেলো চুল, ময়লা পাঞ্জাবি গায়ে, তাঁকে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। তিনি গুম হয়ে ক্লাসে এসে ঢুকলেন, কারও মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না। মিনিট পাঁচেক থম মেরে বসে থেকে তিনি বাষ্পাকুল কণ্ঠে বললেন, ‘না আমি পারলাম না। আমার পক্ষে সম্ভব নয় এ কাহিনী তোমাদের পড়ানোর’, বলতে বলতে তিনি দ্রুত পদে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন, শেষ মুহূর্তে দরজায় দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বললেন, ‘কিছুই বলতে পারলাম না, শুধু একটা কথা বলে যাচ্ছি তোমাদের। মনে রেখো অচলার প্রেম পবিত্র ছিল না, পবিত্র ছিল না।’