বৈকুণ্ঠ, এই বৈকুণ্ঠ।
রাতভর ঝড়ের মাতম, তার মধ্যে তমিজের বাপ নিজের ঘরে এসে ডাকে, বৈকুণ্ঠ। এই বৈকুণ্ঠ। এতো ডাকিচ্ছি, কানোত কথা ঢোকে না?-তমিজের বাপের হাঁকডাকের মধ্যেই তমিজের শূন্য ঘরের চালে কাঁঠালগাছের মাথাটা ভেঙে পড়লো মড়মড় করে। এখন তো বোঝাই যাচ্ছে, নিজের এতো সাধের খাজা কাঁঠালের গাছটার মাথা মটকে। দিয়ে তমিজের বাপ বৈকুণ্ঠের মরণের কথা জানান দিয়ে গিয়েছিলো। তা, এই আলামত দেখাতে বুড়াটা কুলসুমের কাছে আসে কেন? মরার পরেও মানুষটার আক্কেল হলো না। পাকুড়তলার চোরাবালি থেকে মুকুন্দ সাহার দোকান কী অনেকটা ঘাটা?
বাইরে শ্রাবণের মেঘপালানো আকাশ রোদ ঝাড়ে চড় চড় করে, ঘরে তাপ ঢোকে সেদিনকার ঝড়ে নেতিয়েপড়া চাল ফুড়ে; দরজা বন্ধ রেখেও রোদের আঁঝ সামলানো দায়। ভ্যাপসা গরমে কুলসুম না পারে বসতে, না পারে একটু শুয়ে থাকতে। এটার গন্ধ শোকে, ওটার গন্ধ শোকে। একটি গন্ধের অভাবে ঘরে তার খা খা করে : ঘরে চেরাগ। আলির খোয়াবনামা নাই। এই কেতাবের টানেই তো বৈকুণ্ঠ বারবার এসেছে তার। ঘরে। ও ফকির, দেখো তো তোমার বইখান দেখো। কী ব্যাপার?—কাল অনেক রাতে, দশটা হবি, না গো, এগারোটা, না, বারোটার কম লয়। চোখেত হামার নিন্দ আসলো ঝাপা। গাওখান চোকির উপরে ঠেকায় কেবল চোখ মুঞ্জিছি তো দেখি। বাঁশঝাড়ে ফকিরের ছাপরা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বাইরে থেকেই বৈকুণ্ঠ গতরাতে দেখা স্বপ্নের বৃত্তান্ত বলতে শুরু করলে মাটিতে রেখা টানার কাঠি-ধরা উঠিয়ে চেরাগ আলি তাকে থামায়, রাখ বাপু। বোস। পরে শুনিচ্ছি।
টাউন থেকে আসা এক অসহায় মানুষের জিনে-ধরা বৌয়ের কথা শুনতে চেরাগ আলি তখন ব্যস্ত। ডাক্তার কোবরাজ হাকিম বদ্যি ব্যামাক ব্যাটা খাওয়াছে, ফল হয় নাই। এখন আসিছে হামার কাছে। দেখি হামার মুনসি কী করবার পারে।
টাউনের খদ্দের পাওয়ার দাপটে, ডাক্তার কবিরাজের ব্যর্থতার সুখে ও বৈকুণ্ঠকে দেখার খুশিতে দাদাজানের গলায় তখন ভাত উথলাবার শব্দ। সেই রোগী না-কি রোগীর স্বামী বিদায় হওয়ার আগেই বৈকুণ্ঠের স্বপ্নের আদ্দেক কাহিনী বয়ান শেষ। ফকির একটা একটা সওয়াল করে আর বৈকুণ্ঠ নিজের স্বপ্ন বাড়াবার সুযোগ নেয় যোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা। বলতে বলতে সে ঘোরের মধ্যে পড়ে, মনে হয় স্বপ্নটা যেন সে। তখনি দেখছে। মাটিতে ফকিরের কঞ্চির রেখা একটা একটা বাড়ে, সেই সাথে লম্বা হয় বৈকুণ্ঠের স্বপ্নটা। আসলে তার ছিলো ফকিরের শোলোক শোনার বাই। শোলোক শুনলে তার স্বপ্নের গল্পও পাল্টে যেতো। শোলোক শুনে-শুনেই কি-না কে জানে, চেরাগ আলিকেও সে ঠাঁই দিয়েছে তার স্বপ্নের মধ্যে। চেরাগ আলি নাকি পাকুড়গাছের মগডালে বসে মুনসির পাণ্টিখান নিতে আবদার করছে আর মুনসি রাগ করার বদলে মিটিমিটি হাসছে। যে পাণ্টি উঁচিয়ে মুনসি শাসন করে গোটা কাৎলাহার বিল, বিলের গজার মাছ যার ইশারায় পায় ভেড়ার সুরত, সেই জিনিসে হাত দিলে মুনসি সহ্য করবে?-ফকির কি তা জানে না? আসলে জেনেও সে খুশি।-কেন-না, বৈকুণ্ঠের স্বপ্নে মুনসির হাসি পড়েছে তার এই পাকা দাড়িওয়ালা মুখের ওপর।-এই খুশিতে সে মাতোয়ারা। আর সন্ন্যাসীর ঘরের এই ছোঁড়াটাই বা কেমন? দাঁত-পড়া, পাকা দাড়ি মানুষটাকে পর্যন্ত স্বপ্নে দেখে, অথচ কৈ, কোনো স্বপ্নে তো কুলসুমকে কখনো সে দেখতে পায় নি তো! বৈকুণ্ঠের খোয়াব দেখার মুরোদ কুলসুমের জানা আছে। তার ছিলো জাতের ব্যারাম। এই বাড়িতে এসে আম খেয়েছে, মুড়ি খেয়েছে, গুড় পর্যন্ত খেয়েছে আঙুল চুষে চুষে।। কিন্তু মুখে পানি তোলে নি কোনোদিন। জাতের ব্যারাম থাকলে খোয়াব আর কদুর যাবে? দেখো না, কুলসুম তাকে চেরাগ আলির খোয়াবনামাটা নিতে সাধলো। অতো, বড়ো একটা সম্পত্তি, এর টানেই তো চেরাগ আলির কাছে সে আসতো, অথচ বইটা বৈকুণ্ঠ তাকে ফিরিয়ে দিলো। কেন, ওই বই নিতে তার অসুবিধাটা কী? খোয়াবনামা থাকলে কি ঐ মাকুচোষা হারামখোর মুকুন্দ সাহার দোকানঘর এঁটো হয়ে যায়? আসলে ভুলই হয়েছে। সেদিন জোর করেই ওই বই বৈকুণ্ঠের হাতের ভেতরে একেবারে খুঁজে দিলে ঠিক হতো। বৈকুণ্ঠের বিছানার সিথানে চেরাগ আলির বই থাকলে ডাকাতরা ঘরে ঢুকে তাকে কি এমনি করে জবাই করতে পারে?–ঝড়ের রাতে ঢুকে মানুষটাকে তারা জবাই করলো! জবাই করলো!—কুলসুমের চোখের পানি সরে যায়।
তমিজের বাপ এলেই মেঝেতে মেলা বালু ফেলে যায়, এই ঘরে তাই কুলসুমের চোখে বালি ঝির ঝির করে। কিন্তু এখন সব বালু গলে গলে যায় বৈকুণ্ঠের রক্তের ঝাপ্টায়। ঘর তার ভরে যায় রক্তের ধোঁয়ায়। কিছু দেখা যায় না। কুলসুম তখন হাতড়ে। হাতড়ে গিয়ে ঘরের দরজা খোলে।
রোদে তার চোখের লাল লাল ঢেউ মুছে গেলে কুলসুম শোনে, কয়টা শিঙি মাছ আনিছিলাম, রাখো। ফের দরজার আড়ালে গিয়ে কেরামত আলির হাত থেকে কলাগাছের বাকলের খলুইটা নিয়ে মেঝেতে রাখে। কেরামত আলি ফের বলে, ঘরত একলা থাকো। বেওয়া মেয়েছেলের কতো বিপদ হবার পারে।
কিন্তু কাল থেকে কুলসুম রাত্রে তো আর এখানে থাকে না। কয়েকদিন থেকে কালাম মাঝিও এমনি করেই তাকে বলেছিলো, বিধবা মেয়েমানুষ, বয়সও কম, একলা থাকলে ভালো ঠেকে না, মানুষে নানা কথা কয়। আর গতকাল দুপুরবেলা কালাম একবার কিছুক্ষণ তার সঙ্গে কথা বললো, তার পরপরই কালাম মাঝির বৌ আর বুধার বেটি একরকম জোর করেই নিয়ে গেলো তাকে, ঘর তো আর তার হাতছাড়া হচ্ছে না, দিনের বেলা না হয় এখানেই থাকবে। কিন্তু এই সোমত্ত মেয়েমানুষকে রাতে তারা একা থাকতে দিতে পারে না।
দুপুরে কালাম মাঝি কিন্তু খুব নরম হয়েই কথা বলেছে, তোমার সাথে হামার বিবাদ নাই। তুমি তমিজের বাপের বেওয়া, তার মাজারেত হামি প্রতি জুম্মার দিন মৌলবিক দিয়া জিয়ারত করাই। হামার সাথে দুষমনি করিছে তমিজ, এখনো করিচ্ছে। তা তমিজ তো তোমার বেটাও লয়। তোমাক দোষ দিমু কিসক? কিন্তু একটা কথা।-কী?–মানুষ কয়, তমিজ লিত্যি তোমার ঘরত আসে। ফেরারি আসামিক তুমি ঘরত আসবার দেও কোন সাহসে? থানা থাকা পুলিস আসলে তখন আমি সামলামু ক্যাংকা কর্যা?
কুলসুম অবাক হয়ে বলে, তমিজ? তমিজ তো আসে না।
এই মেয়েকে অবিশ্বাস করা মুশকিল। কিন্তু মাঝিপাড়ার মানুষের কাণ্ডকারখানায় কালাম মাঝি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। টাউন থেকে কতো কষ্ট করে মোহাজেরদের বরাদ্দ রিলিফ নিয়ে এলো কালাম। রিলিফের কাপড় নিতে কারো কিছুমাত্র আপত্তি দেখা গেলো না। অথচ দুধের টিন যেমন এনেছিলো তেমনি পড়ে রইলো। বুধা নিজের কানে শুনেছে, ওই শালা আবিতনের বাপ,-যে-বুড়া শাড়ি নিলো, লুঙি নিলো,-খুব রাষ্ট্র করে বেড়াচ্ছে, কালাম মাঝির ওই টিনের দুধ খেলে মরণ সুনিশ্চিত। যে কি-না নিজের আত্মীয়-স্বজনকে পুলিসের হাতে তুলে দিতে পারে, পুলিসের হাত থেকে ফস্কে যাওয়া মানুষগুলোর মুখে বিষ মেশানো দুধ তুলে দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব কী? তারপর ধরো, মাঝিপাড়ার চ্যাংড়াপ্যাংড়া যখন তখন বিলে জাল ফেলে। কালাম মাঝিকে দেখলেই জাল গুটিয়ে দৌড় দেয়, আবার আজকাল কেউ কেউ তাকে না দেখার ভান করে ধীরে সুস্থে মাছ ধরে। মানুষ মোতায়েন করে কালাম আর কতো সামলায়? আবার ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা তাকে দেখলেই একটু দূরে গিয়ে চিৎকার করে, আড় মাছে পাড় দেয়, বেলে মাছ এলে দেয়। এই কথা তো কালাম মাঝি শুনে আসছে ছছটো থেকে; পেঁকিশালে মেয়েরা ধান ভানতে ভানতে কতো কী বলতে বলতে এই শোলোকটাও গায়। কিন্তু এখন বিশেষ করে তাকে দেখে এটা একটু বদলে বলার মানে কী? তমিজের বাপের বাঘাড় মাছ কি এখন ভর করেছে মাঝিপাড়ার চ্যাংড়াপ্যাংড়ার জিভের ওপর?
আর তাদের বাপচাচাদের শয়তানি আর সহ্য করা যায় না। হাটে তার দোকানে মাঝিপাড়ার মানুষ সওদাপাতি তো করেই না, বরং দোকানের সামনে দিয়ে যেতে যেতে বলে, ওই দোকানের মাল ব্যামাক ভেজাল দেওয়া। তার নিজের বেটা টাউনের দারোগা, কিন্তু তাকে এসব কথা বললে গা করে না। তার কথা, কাদের মিয়াকে চটিয়ে সে কিছুই করতে পারবে না। এম এল এ আর মন্ত্রী মিনিস্টারের সঙ্গে তার দহরম মহরম, খুনের আসামীকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতাও তার আছে। মুকুন্দ সাহার দোকান দখলের ব্যাপারেও তহসেন তাকে কিছুই সাহায্য করলো না। তবে হ্যাঁ, বলেছিলো, হিন্দু প্রপার্টি তো, একবার কোনোমতে ওদের খেদাতে পারলে দখল কায়েম রাখার বন্দোবস্ত সে করবে। তা সেটুকু অবশ্য করছে। বৈকুণ্ঠ খুন হবার পরদিন বিকালেই আমতলির পুলিস এসে দোকানে তালা ঝুলিয়ে গেলো, তার একদিন পর তহসেনের কথাতেই তালা খুলেও দিলো। দোকান থেকে গণেশের মূর্তি টুর্তি সরিয়ে সাফসুতরো করে কালাম মিলাদ দিলো, তহসেন সেখানে ঠিকই ছিলো, আবার মিলাদের পর কাদেরের দোকানে গিয়ে গল্পও করলো কিছুক্ষণ। মাঝিপাড়ার মানুষ মিলাদে হাজির ছিলো খুব কম। তবে জিলাপি দেওয়ার সময় সব শালা ভিড় করে। কিন্তু জিলাপি খেতে খেতেই যা বলে গেছে বুধার কানে গেছে সবই; বুধা বলে, মামু, তমিজ ছাড়া ইগলান কথা শালাগোরে আর কেউ শিখায় নাই। কেরামত আলিও একদিন, হয়তো মুখ ফস্কেই বলে ফেলে, অনেক রাতে সে কুলসুমের ঘরে মানুষের কথাবার্তা শুনেছে। কালাম মাঝি সঙ্গে সঙ্গে ভুরু কোঁচকায়, তুমি রাত করা ওই ঘরত যাও?
জে না। ওইদিক দিয়া আসিচ্ছিলাম, তো শুনি তমিজের বাপের ঘরত মানুষ কতাবার্তা কচ্ছে।?
কেটা? কথা কচ্ছিলো কেটা? কী কথা হচ্ছিলো?
সরল গদ্যে তমিজের একটা কাহিনী বাধতে কেরামত তৈরী ছিলো, কিন্তু কী বললে আবার কী দোষ হয় ভেবে সে চেপে যায়। শুধু জানায়, না। হামি আর খাড়া হলাম না।
সেদিন দুপুরবেলা কুলসুমের কথা কালাম মাঝি অবিশ্বাস করে নি, তবে ফের জিগ্যেস করে, তুমি কল্যা তমিজ আসে না। তা হলে রাত কর্যা তুমি কথা কও কার সাথে মেলা মানুষ শুনিছে, এটি কথাবার্তা হয়।
কুলসুম সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, তমিজের বাপ আসে।
কালাম মাঝি কুলসুমের এরকম নির্বিকার জবাবে চমকে উঠে আশেপাশে তাকায়। সেঁক গিলে বলে, মরা মানুষ আসবার পারে? ইগলান কী কও?
আসে। রাত করা আসে।
সেদিনই কালাম মাঝি সাব্যস্ত করে রাতে এই মেয়েটিকে এই ঘরে একলা থাকতে দেওয়া যায় না। বৌকে ডেকে বলে, মরা হোক আর জেতা হোক, রাতত বেওয়া মেয়েছেলের ঘরত মানুষ আসে, এটা তো ভালো কথা লয়। তুমি ওর এটি থাকার বন্দোবস্ত করো। কুফা ঘর রাখা যাবি না।
কালাম মাঝির বৌ কুলসুমকে নিয়ে আসতে রাজি হয়, বরং একটু উৎসাহই দেখায় কিন্তু ওই ঘরের দখল নিতে তার আপত্তি আছে। এমনিতে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তারা একঘরে হয়ে পড়েছে, তমিজের বাপের ঘর কেড়ে নিলে মাঝিপাড়ার মানুষ খেপে যাবে, তমিজের বাপও চোরাবালির ভেতর থেকেই উৎপাত করতে পারে। কালাম মাঝি দেখা যাক, সেটা আমি বুঝমু। বললেও তহসেনের সৎ মা বোঝে, স্বামী তার হুঁশিয়ারিটা অন্তত আপাতত মেনে নিয়েছে।
তবে যে যাই বলুক, কেরামতের কিন্তু মনে হয়, তমিজই রাত করে কুলসুমের ঘরে আসে। যে রাতে কুলসুমের ঘরে সে কথাবার্তা শুনেছিলো তার পরদিন সকালে কুলসুমের সারা মুখে ছিলো খুশি খুশি আলো। সে হলো কবিমানুষ, যুবতীর চেহারা দেখে তার চাহিদা আর তৃপ্তি যদি বুঝতে না পারে তো এতোকাল শোলোক বাঁধলো কি বাল ছিড়তে? তমিজের বাপের কাছে কুলসুম সারাটা জীবন কী পেয়েছে। এখন সুদে আসলে তাই পুষিয়ে নিচ্ছে বুড়া হাবড়ার জোয়ান ছেলের কাছ থেকে। তারপর, তাকে দেখে। মাঝিপাড়ার ছোঁড়ারা তারই বাধা শোলোক বলে, মাঝি বিনা বিল আর জল বিনা মাছ/ নরস্পর্শ বিনা নারী পুষ্প বিনা গাছ। নিজের বাঁধা এইসব শোলোক শুনলে তার ভয় করে, শালা তমিজ ছাড়া মাঝিদের এভাবে চেতাবে আর কে? কুদুস মৌলবির মতো মানুষ পর্যন্ত কালাম মাঝির সামনেই একদিন বলে, আজ শিমুলতলার ঘাটেত মেলা কয়টা চ্যাংড়া একত্তর হছে। জাল লিয়া গেছে, সোগলি দেখি কেরামতের শোলোক কচ্ছে। শুনে কেরামতের গলা শুকিয়ে আসে। কালাম মাঝিকে চটিয়ে সে এখানে থাকতে পারবে না, মাঝি পাড়ার বাস উঠে গেলে কুলসুমকে পাবার সম্ভাবনা তার একেবারেই শেষ হয়ে যাবে। কুদুস মৌলবির দিকে না তাকিয়ে সে জবাবদিহি করে কালাম মাঝির কাছে, আরে উগলান শোলোক বাদ দিছি কোনদিন।
কিন্তু মুশকিল এই কালাম মাঝিকে নিয়েই। কুলসুমের সঙ্গে তার নিকার কথা তো না আর তোলেই না, বরং কেরামত প্রসঙ্গটি তুললেই কালাম এক্কেবারে খামোশ মেরে যায়। কুলসুমকে সম্পূর্ণ নিজের কাছে না পাওয়া পর্যন্ত কেরামত না পারে নতুন শোলোক বাঁধতে, না পারে তার পুরনো শোলোকগুলো সুর করে গাইতে। সুতরাং শিঙি মাছগুলো তার হাতে তুলে দিয়ে কেরামত না হয় নিজেই সরাসরি প্রস্তাব করবে। ঘরের চৌকাঠে বসে কেরামত খালি প্যাচাল পাড়ে, কুলসুম একা থাকলে লোকে নানা কথা বলবে আর তার নামে কোনো কুকথা কেরামত সহ্যই করতে পারে না। কুলসুম যদি তার সাথে নিকা বসে তো মানুষের মুখ বন্ধ করা যায়। কালাম মাঝিও তাদের এই বিয়ে সম্পূর্ণ অনুমোদন করে, এমন কি চোরাবালিতে গিয়ে কেরামত তমিজের বাপের দোয়াও নিয়ে এসেছে। কালাম মাঝি তাদের দুজনকে এই ঘরে থাকতেও দেবে, অন্তত কেরামত পরিবার নিয়ে বাস করলে কালাম এই ঘর থেকে তাদের উচ্ছেদ করবে না।
ঘর কি কালাম মাঝির বাপের? এতোক্ষণ পর মেয়েটির এই একটিমাত্র বাক্যে চমকে উঠলেও তার তেজে কেরামত মুগ্ধ হয়ে যায়। ঘর বন্দুক দিয়া তমিজের বাপ টাকা হাওলাত করিছিলো কালাম মাঝির কাছ থ্যাকা। তমিজ অ্যাসা টাকা ঘুরা দিলেই তো মিট্যা যায়। কুলসুমের জিভের ধার, ঠোঁটের জড়িয়েপড়া ও গুটিয়ে-নেওয়া এবং ভুরুর গেরো লাগানো ও গেরো ভোলা দেখতে দেখতে কেরামতের মুগ্ধতা দানা বেঁধে তাকে ঘোরের মধ্যে ফেলে; এক পলকের জন্যে হলেও তার ভুললা লাগে, সে কি জেগে আছে, না। স্বপ্ন দেখছে? ঘরের চিন্তা হামি কোনোদিন করি নাই। রোজগার করবার পারলে খাওয়া পরার অভাব কী? কালাম মাঝি তো তার দোকানের খাতা লেখার কাম একটা দিয়াই রাখিছে, আবার মুকুন্দ সাহার দোকানটাও তো এখন তারই হলো, সেটার খাতা লেখার কামও হামকই করা লাগবি। রোজগার হামার কম হবি না। তা ছাড়া টাউনের মানুষের মধ্যে তার গানের জনপ্রিয়তার বিষয়টিও সে মনে করিয়ে দেয় কুলসুমকে। কুলসুমকে বিয়ে করলে তার বাউন্ডালা জেবনটা সুস্থির হয়, হামি আবার গান বান্দিবার পারি।
দোকানের খাতার মধ্যেই তো গান বান্দা যায়, না? কুলসুমের কাছে কেরামতের বাধা গান আর দোকানের খাতা লেখার মধ্যে কোনো ফারাক নাই ভেবে কেরামত একটু আহত হয়। কবির দুঃখটা একটু সামলে নিয়ে সে বলে, কালাম মাঝির এটি না পোয় তো হামি তোমাক লিয়া টাউনেত বাসা লিমু। গানের বই লিখ্যা হামার যা রোজগার হবি, টাউনেত বাসা করা থাকবার পারমু।
টাউনে যেতে কুলসুমের আপত্তি নাই। কিন্তু সেখানে নাকি রাত্রেও আলো জ্বলে, সব জায়গায় লোকজন গিজগিজ করে, বেহায়া মেয়েরা রিকশায় করে টাউন ঘোরে।
টাউনেত যাবা? * একটু ভেবে কুলসুম বলে, তমিজের বাপ তো টাউনেত যাবি না। তাই তো টাউনের ঘাটাও চেনে না।
কেরামত আলি বড়ো দমে যায়। তার সঙ্গে বিয়ের পরেও কুলসুমের এই মরা মানুষ দেখার ব্যারাম যদি না সারে?
এই নিয়ে সে হয়তো কুলসুমকে কিছু বলতো, কিন্তু এর মধ্যে চলে আসে বুধার মেয়ে, ও চাচী, ঢেকিত দুইটা পাড় দিয়া তুমি ঘরত আসিছে, হামি একলা এখন কী করি, কও তো?
চল। বলে কেরামতের উপহার সিঙি মাছগুলো মাটির বড়ো মালসায় পানিতে জিইয়ে রেখে তার ওপর মাটির সরা চাপা দিয়ে দরজা আগলে রেখে চলে যায় কালাম মাঝির বাড়ি। আজ ভোর থেকে সেখানে ধান কোটার ধুম। বাড়ির জন্যে চাল তো লাগবেই, তহসেনের টাউনের বাসাবাড়ির জন্যে লাগবে এক মণ।।
কালাম মাঝির বৌটা মানুষ ভালো, কুলসুমকে খুব একটা খাটায় না। কুলসুমের টেকির পাড় ভালো, আবার সারাদিন পাড় দিয়েও হাপসে যায় না। আবার এই অছিলায় ওই বাড়িতে থাকলে দুপুরের খাওয়াটা পাওয়া যায়, ভাতের সঙ্গে মাছও জোটে। তহসেনের সৎ মা তাকে একটু পছন্দই করে। কিংবা মাঝিপাড়ায় স্বামীর অপরাধের ভারটা একটু কমাতে চায় তাকে খুশি করে। আবার অন্য ব্যাপারও থাকতে পারে। সেদিন সন্ধ্যাবেলা তাকে আড়ালে পেয়ে আস্তে করে বলে, কুলসুম, কেরামতের সাথে তুই লিকা বস। কেরামত মানুষ ভালো। তবু পুরুষমানষের মন, উলটাতে কতোক্ষণ? কিন্তু মনে হয় অন্য কোনো পুরুষমানুষ তার উদ্বেগের কারণ। আজ সকালে বলছিলো, কুলসুম, হামার ঘরের বারান্দাত না শুয়া তুই বুধার ঘরের সাথে থাকিস। ওটি বিছনা। পাতিস। কুলসুম ঠিক বুঝতে পারে না। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে সে তার বিছানার পাশে লম্বা একটি ছায়া দেখতে পেয়ে বরং খুশিই হয়েছিলো, তমিজের বাপ তবে এখানেও এসে হাজির হয়েছে। তহসেনের মাকে এই ঘটনা বলার কয়েক ঘণ্টা পর সে তার শোবার জায়গা বদলাতে বলে।
তমিজের বাপ আবার বুধার ঘরের বারান্দা ঠাহর করে যেতে পারবে তো?-কুলসুম একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে। তবে চেঁকিশালেই বিকালের দিকে হঠাৎ আস্তে করে গায়ে তার ঠাণ্ডা হাওয়া লাগলে মাথাটা সাফ হয়ে যায়। দুপুরে বুধার মেয়ের সঙ্গে এখানে আসার পরই এক পশলা বৃষ্টি হলো। তারপর শুরু হলো গুমোট, ভ্যাপসা গরম আর কাটে না। চেঁকিশালে সবাই ঘামছে দরদর করে ঘাম নাই খালি কুলসুমের শরীরে। তার গায়ে ফুরফুরে হাওয়া। এর মানে কী? এটা কি ফকিরের কাম? না। এই ভ্যাপসা গরমে হঠাৎ করে ঝিরঝিরে হাওয়া খেলাতে পারে এক মুনসি। কিন্তু তার হাওয়া আসে পাকুড়তলা থেকে, বিলের শিংমাগুর আর পাবদা ট্যাংরা আর খলশে পুঁটি আর রুই কাতলা, সাঁতরানো পানির ওপর ভাসতে ভাসতে সেই হাওয়ায় জমে হালকা মিষ্টি আঁশটে গন্ধ। আর আজ এই ফুরফুরে হাওয়ায় মিশেল রয়েছে জর্দার হালকা গন্ধ। দুটো গন্ধ এক হয়ে যাচ্ছে বলে কুলসুম এগুলোকে আলাদা করে ঠাহর করতে পাচ্ছে না। টেকির পিছাড়ির ওপর তার পা ধীর হয়ে আসে, বুধার মেয়ে বলে, ও চাচী, কী হলো তোমার? মনুয়া তো হামার হাতের উপরে পড়িচ্ছিলো। পেঁকির মুগুর হাতে পড়লে বুধার মেয়ের হাতটা ঘেঁচে যাবে না? বুধার ছোট্ট মেয়েটা ছড়া কাটে, আড় মাছে পাড় দেয়, বেলে মাছে এলে দেয়। শোলোক শুনতে শুনতে কুলসুমের মাথাটা ঘোরে, সেকি জর্দার গন্ধে, না বাঘাড়ের আঁশটে গন্ধে, না-কি শুধুই শিশুকণ্ঠের শোলোকের বোলে তা ধরতে না পেরে কুলসুম বলে, এখন থাক রে। একটু দম লেই।