1 of 2

৩৫. সংসার

সংসার

আমার বড় সংসারের সাধ ছিল। ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির ছাদে ইট জড়ো করে ঘর বানাতাম, বসবার ঘর, শোবার ঘর, বারান্দা। আমার একটি পুতুলের খাট ছিল, ভারি সুন্দর। মা ওই খাটের তোশক-বালিশ এত চমৎকার বানিয়ে দিয়েছিলেন যে, মাঝে-মধ্যে ইচ্ছে করত হাত পা গুটিয়ে ছোট হয়ে ওই খাটের ওপর ঘুমিয়ে পড়ি। একবার আমাদের বাড়িতে ট্রাক ভর্তি ইট এসেছিল দেওয়াল উঁচু করবার জন্য। আমি আর আমার ছোটবোন সারা বিকেল ওই ইট ছাদে তুলতাম। তুলে ঘর বানাতাম। আমাদের বাড়িটি ছিল পুরনো জমিদার বাড়ি। জলছাদ চুঁয়ে বৃষ্টির জল নামত ঘরে। ফাটল সারাতে বাবা যখন ছাদে উঠে আমাদের ঘরবাড়ি দেখতেন—ইটগুলো আবার একটি একটি করে নামাতেন। আমরা তখন ঘরে বসে টের পেতাম আমাদের ছাদের সংসার ভেঙে যাচ্ছে। ছোটবোনটি দুঃখ করে বলত—এই বুঝি রান্নাঘরটি উঠিয়ে নিয়ে এল। এক একটি ইট ফেলার শব্দ শুনে আমিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতাম—না জানি আমার শোবার ঘরটি ভেঙে তছনছ।

এ রকম প্রায়ই ঘটত। আমরা নির্মাণ করি আর অভিভাবক এসে ভেঙে দেয়। একবার মনে আছে আমাদের খেলাঘর নানা আসবাবে, তৈজসে বড় সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। আমাদের বাড়ি ছিল হিন্দু পাড়ায়। তখন একাত্তর সাল। প্রতিবেশিরা ভারতে পালিয়ে গেছে। কেউ নেই, দরজায় শুধু একাকী একটি তালা। আমরা এক উঠোন থেকে আরেক উঠোনে খেলা করতে করতে প্রফুল্লদের উঠোন থেকে শঙ্খ, সিদ্ধেশ্বরীদের বারান্দা থেকে ঠাকুরঘরের বাটি, গ্লাস, সমাপ্তিদের কলতলা থেকে ভাঙা কাচ, লক্ষ্মীমূর্তি, পুরনো ব্যাটারি এত পেয়েছিলাম যে সব সাজিয়ে আমাদের খেলার ঘরকে বেশ মূল্যবান করে তুলেছিলাম।

একাত্তরে বাবা খুব কম উঠতেন ছাদে আর আমাদের স্কুল ছুটি, দিনে দুবেলা রান্না করছি, ইটের গুড়ো পিষে মসলা বানাচ্ছি, থালাবাসন একবার নামাচ্ছি, একবার ওঠাচ্ছি, তখন সংসার নিয়ে আমাদের দুবোনের চব্বিশ ঘণ্টা ব্যস্ততা। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন, যেদিন একটি উড়োজাহাজ আমাদের মাথার ওপর সাত চক্কর দিয়ে শহরের বড় হাসপাতালে বোমা ফেলে গেল, সেদিনই আমরা সবাই মোষের গাড়ি করে গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। গ্রামে বসে শহরের ছাদে ফেলে আসা সংসারটির জন্য বড় মন কাঁদত।

সংসারের সাধ আমার বহুদিনের। বড় হয়ে যখন সত্যিকার সংসার করতে চাইলাম, যখন আমার স্বপ্নকে অল্প অল্প করে পল্লবিত করলাম, তখন আমি বুঝিনি, যে মানুষটি আমার সঙ্গে ছিল সে ছিল মূলত প্রতারক। সে আমার স্বপ্নের একবিন্দু কিছু বোঝেনি। কেবল শরীর ভরে মেয়ে মানুষের মাংস চেয়েছে ব্যস।

কোনও পুরুষ আমাকে সংসার দেয়নি। দশটা পাঁচটা চাকরি করে আমি যে ঘরে এসে ঢুকি সে ঘর আমার ঘর। আমার নিজের হাতে গড়া আমার বসবার ঘর, শোবার ঘর, বারান্দা… ৷ কোনও প্রতারক পুরুষের কাছে সংসারের অপেক্ষায় আমি বসে থাকিনি। স্বপ্নের ভাঙন নিয়ে হাপিত্যেশ করিনি। কে বলে মেয়েরা পারে না একা বেঁচে থাকতে, একা দাঁড়াতে? আমার সর্বস্ব লুটে আমাকে নিঃস্ব করে যখন প্রতারক পুরুষেরা যে যার মত পালিয়ে গেছে কই আমি তো ধুলো ঝেড়ে ঠিক দাঁড়িয়েছি। আমি যে এই হাঁটছি, দৌড়োচ্ছি, সিঁড়ি ভেঙে উঠছি, নামছি আমার তো কই কোনও কষ্ট নেই। বরং এই ভেবে আনন্দ হয় যে, কোনও লম্পটের নাগালের মধ্যে থেকে আমি সেই জীবন যাপন করছি না যে জীবনে আমার দেবতা-পুরুষ গণিকা সম্ভোগ সেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ঘরে ফিরবে আর আমার উরুতে হাত রেখে স্বভাবদোষে বলে উঠবে ভালবাসি। আমাকে সেই জীবন যাপন করতে হচ্ছে না যে জীবনে গভীর রাত্তিরে মাতাল স্বামীকে নর্দমা থেকে তুলে আনতে হয়। যে জীবনে পিঠ পেতে রাখতে হয় কর্তার প্রহর গ্রহণ করবার জন্য।

ঘরে ফিরে আমি আমার মা’কে যখন জড়িয়ে ধরে গল্প করি সারাদিনের, তখন এই ছোট ঘরদুয়োরকেই স্বপ্ন মনে হয়, মনে হয় সেই আমাদের ময়মনসিংহের বাড়ির ছাদ থেকে আমার সবটুকু ভালবাসা তুলে পুরনো ঢাকার এক বাড়ির মধ্যে পুরেছি। আমার বাবা এখন আগের মত আমার ঘর ভেঙে দেন না। তাঁর বাড়ির ছাদে ইট চুরি করে কেউ এখন আর সংসার সাজায় না। বাবা খুব মনে মনে বুঝতেন আমার বড় সংসারের শখ। ছোটবেলায় বার বার আমার খেলার সংসার ভেঙে দেওয়ার সেই যমদূত-বাবা এখন আমার সত্যিকার সংসারের জন্য জিনিসপত্র, টাকাকড়ি এর-ওর হাতে পাঠিয়ে দেন। দেখে আমার বুক ফেটে যায়—বাবা হয়ত ভাঙনের কোনও কষ্ট আমাকে আর বুঝতে দিতে চান না।

বেশ বেঁচে আছি, একদিন হয়ত দেখব দেশের ওই পার কুতুবদিয়া কিংবা সাতক্ষীরায় বদলি হয়ে গেছি। এ তো আর এমন নয় যে সবকিছু ফেলে ছোটবেলার মত মোষের গাড়ি করে রাতের অন্ধকারে গোপনে শহর পেরিয়ে গ্রামে চলে যাব। বদলির আদেশ হলে পুরো সংসার মাথায় করে নিয়ে যেতে হবে—সে যত অরণ্য কিংবা পাহাড় হোক না কেন।

আমার বুদ্ধিবিদ্যা, ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্বকে আমি সবচেয়ে মূল্যবান মনে করি। আমার অহঙ্কারকে আমি কখনও তুচ্ছ করি না। আমার স্বপ্নকে ফুলচন্দন না পরাতে পারি, অসম্মান করি না। আমি যে পদক্ষেপ রচনা করি তা আমার নিজস্ব পদক্ষেপ। কারও নির্দেশিত বা প্রভাবিত পদক্ষেপ নয়। আমি যা ইচ্ছা করি তা আমার নিজস্ব ইচ্ছা, আমার স্কোপার্জিত স্বাধীনতা থেকে উৎপতিত ইচ্ছা।

শাস্ত্র এবং সমাজ আমাদের এমন শিক্ষাই দেয় যে নারীর কোনও স্বাধীনতা থাকতে নেই। কিন্তু সেই নারী অবশ্যই মানুষ হিসেবে সম্পূর্ণ নয় যে নারী মনে এবং শরীরে সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *