সদুঠাকুমার পিস্তল – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
পুজো শেষ হয়ে গিয়েছে। পার্কে-পার্কে লোকের ভিড় নেই, তবে এখনও নানারকম বিজ্ঞাপনের ছেঁড়া টুকরো কোনায়-কোনায় পড়ে আছে। ইন্সপেক্টর নাড়ুগোপাল শিকদারের পুজোর সময় খুব কাজ বেড়ে গিয়েছিল। কতকগুলো ছিনতাইবাজ ও দাঙ্গাবাজদের ধরে থানায় পুরে রাখতে হয়েছিল, খুব খাটনি গিয়েছে। নাড়ুগোপালের মনে হল বাইরে কোথাও কেউ থাকলে দু-চারদিনের জন্য ঘুরে আসা যেত। কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না। হোটেলে খরচ অনেক।
তার চেয়ে বরং সদুঠাকুমার কাছে গিয়ে ঘুরে আসা যাক। সদুঠাকুমা লিখেছিলেন তাঁর বাতটা এখন একটু কমেছে। কারণ বোধ হয় বর্ষাও কমেছে। নাড়ুগোপাল ভাবল, শনিবার বিকালে যাবে রবিবার সন্ধ্যায় ফিরবে। চব্বিশ ঘণ্টার ছুটিই বা মন্দ কী? শনিবার নাড়ুগোপাল যখন মথুরাপুরে সদুঠাকুমার বাড়ি গিয়ে পৌঁছল তখনও আকাশে অল্প-অল্প আলো আছে। বাড়ি ঢুকতে-ঢুকতে শুনল বসবার ঘর থেকে অনেক লোকের গলা পাওয়া যাচ্ছে। ঘরের ভিতর ঢুকে দেখল সবাই খুব উত্তেজিত। প্রায় সবাইকে চেনে, দু-চারটি নতুন মুখও আছে। ঘরে ঢুকতে চেঁচামেচির কারণ বোঝা গেল। সদুঠাকুমাকে ঘিরে একটা ছোট ভিড় আর চারদিকে সবাই চেঁচাচ্ছে। সদুঠাকুমা একটা টেবিলের সামনে বসে আছেন, হাতে একটা পিস্তল। নাড়ুগোপালকে দেখে বললেন, ‘কী রে নাড়ু এলি। এই দ্যাখ, আমার হাতে এটা কী।’
নাড়ুগোপাল দেখল পিস্তল, কিন্তু সাধারণ পিস্তল নয়, একটু ছোট গায়ে মুক্তোর কাজ করা।
ঠাকুমা বললেন, ‘দেখলি তো কত ছোট; মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগে চলে যায়। ধর, তুই অনেক গয়না-টয়না পরে নেমন্তন্ন-বাড়ি খেতে গেলি, তখন মনে হল এইটে ব্যাগের মধ্যে পুরে নিই, বলা তো যায় না,দরকার হতে পারে।’
নাড়ুগোপাল বলল, ‘ঢের হয়েছে ঠাকুমা। তুমি ভাবলে কী করে যে, আমি গয়না পরে নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি এটা সঙ্গে করে?’
সদুঠাকুমা বললেন, ‘নাড়ুগোপাল, তুই পুলিশে চাকরি করে বুদ্ধি একেবারে খুইয়ে বসে আছিস। আমি কি তোর কথা বলছি, আমার কথা বলছি। আমার কথাই ধর না। তোর ঠাকুরদার সাথে গয়না পরে নেমন্তন্ন খেতে যেতাম বছর-পঁচিশ আগে।’
নাড়ুগোপাল একবার পিস্তলটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল, বলল, ‘বেশ জিনিসটি, দেখবার মতো।’
ঠাকুমা যেন একটু রেগে গিয়ে বললেন, ‘না জেনে অত প্রশংসা করিস না। আসল ব্যাপার তো তুই কিছুই জানিস না। মাঝে-মাঝে যে গুলি ভিতরে আটকে যায়, বেরোয় না, তখন কী অবস্থা বল তো? তা ছাড়া এর গুলিও এ-দেশে পাওয়া যায় না ; ফ্রান্স থেকে আনাতে হয়। সে ভয়ানক হাঙ্গামা।’
একটি মেয়ে বলল, নাড়ুগোপাল তাকে আগে কখনও দেখেনি, ‘একটু ছুঁড়ে দেখাও না ঠাকুমা, তোমার হাতের টিপ কীরকম?’
ঠাকুমা বললেন, ‘ওই দ্যাখ্, তবু তো তুই বললি। আর সবাই ধরেই নিয়েছে আমি বোধ হয় গুলি ছুঁড়তেই জানি না, শুধু লোককে দেখাবার জন্য এটা বয়ে বেড়ানো। তবে যখন তোরা বলছিস, আজ আমার বাতটা কম আছে, খুব অসুবিধা হবে না। কী করে দেখাব, বাড়িতে তো আবার তাস নেই। কাতু, তোদের বাড়িতে তাস খেলা হয়?’
কাতু বললে, ‘দাদার বন্ধুরা এসে খেলে। তা হলে তাস নিয়ে আসি ঠাকুমা?’
কাতুর দাদা শ্ৰীমন্ত বলল, ‘আমি এনে দিচ্ছি।’
সদুঠাকুমা বললেন, ‘এ-প্যাকেটটা কিন্তু তুমি ফেরত পাবে না। আমি তোমায় নতুন একটা প্যাকেট কিনে দেব। দ্যাখো না, তোমার তাসের কী দশা হয়।’
কাতুর দাদা দরজা খুলেছিল কিন্তু বেরিয়ে গিয়ে তার বয়সী একটি ছেলেকে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকল, বলল, ‘কাতু, সমীর এসেছে। ও এখানে খেলা দেখুক।’
মনে হল কাতু খুশি হয়নি, অস্ফুটস্বরে বলল, ‘কী আপদ।’
সমীরের রং খুব ফরসা, কিন্তু তাকে দেখে মন খুশি হয় না। পরনে সরু প্যান্ট, কালো রঙের গুরু শার্ট, হাসলে অনেকটা দাঁত আর মাড়ি দেখা যায়, মনে হয় পান খাওয়ার অভ্যাস আছে। সমীর ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর ঠাকুমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এত ভিড় কিসের? ম্যাজিক হচ্ছে বুঝি?’
ঠাকুমা বললেন, ‘ম্যাজিকই হবে। একটু বোসো, এক্ষুণি দেখতে পাবে।’
পাঁচ-সাত মিনিট পরেই কাতুর দাদা তাস নিয়ে এল। সদুঠাকুমা বললেন, ‘একটা কাজ কর, চিঁড়েতনের টেক্কা নিয়ে একটা পিন দিয়ে ওই দেওয়ালের গায়ে আটকে দে। কত দূর হবে, পঁচিশ-তিরিশ ফুট তো?’
নাড়ুগোপাল বলল, ‘হ্যাঁ, তা হবে।’
ঠাকুমা বললেন, ‘কাতু, ওখানে কী করছিস, সরে দাঁড়া, আমার একটু জায়গার দরকার,’ এই বলে ডান হাত বাড়ালেন। কাতু পিস্তলটা এগিয়ে দিল। ঠাকুমা গুলি ছুঁড়লেন ; চিঁড়েতনের টেক্কা উড়ে গেল। ঠাকুমা যে সত্যি গুলি ছুঁড়ে টেক্কাটাকে মারতে পারবেন এ-কথা অনেকে ভাবেনি। ঘরে একটা অস্ফুট কোলাহল হল।
ঠাকুমা বললেন, ‘আরও মজা দেখবি? আর-একটা তাস দাও তো।’ কাতু আর-একটা তাস বার করে দিল। ঠাকুমা বললেন, ‘এ যে দেখছি হরতনের নওলা। পাঁচকড়ি দে-কে নিয়ে আবার টানাটানি কেন?’ ঘরে কোনও শব্দ হল না। ঠাকুমা বললেন, ‘এ কী, তোমরা পাঁচকড়ি দে-র বই পড়োনি! আজকাল চারদিকে বড় অশিক্ষার স্রোত ; নাড়ুগোপাল, তোমাকেও কি পুলিশ থেকে এসব বই পড়তে বলে না? যাক, এইবার তোমাদের খেলা দেখাই। হরতনের নওলা টাঙিয়েছ তো? এইবার দ্যাখো, ওপরের বাঁ দিক, মাঝখান আর ডান দিকের নিচেরটা উড়িয়ে দিচ্ছি।’ ঠাকুমা তিনবার পিস্তলের আওয়াজ করলেন, তাসে তিনটে ফুটো হয়ে গেল। ঠাকুমা বললেন, ‘তোরা কেউ লড়বি আমার সঙ্গে? আয়, পিস্তল দিচ্ছি। নাড়ুগোপাল, তুই আসবি নাকি?
নাড়ুগোপাল বলল, ‘না, ঠাকুমা, যদি হেরে যাই। তা ছাড়া তোমার গুলিও তো বেশি নেই। কিন্তু এই জিনিসটা তোমার কাছে এল কী করে বলো তো।’
ঠাকুমা বললেন, ‘কোন জিনিসটার কথা বলছিস? ও, ওই পিস্তলটা। ওর এক ইতিহাস আছে, তোকে বলছি। বছর-তিরিশেক আগে কর্তাকে একবার বিলাত যেতে হয়েছিল, ওঁদের বোর্ডের কী একটা মিটিং ছিল। যাবার সময় আমায় বললেন, তোমার জন্য কী আনব? আমি বললাম, ‘কী আবার আনবে, ও পোড়া দেশে আমাদের জন্যে কি কিছু পাওয়া যায়। তবে এমন কিছু এনো যা আমি ভাবতে পারব না। আসবার সময় উনি এই পিস্তলটা নিয়ে এলেন। আমার জন্য অবিশ্যি অনেক রকম জিনিস এনেছিলেন, তার সঙ্গে ওই পিস্তলটাও। আমি তো দেখে বললুম, ‘ওমা, এটা দিয়ে কী করব? এ তো আমি ছুঁড়তেও জানি না, চোর-ডাকাত এলে তাড়াতেও পারব না।’ উনিও ভাবেননি আমি এত তাড়াতাড়ি পিস্তল ছোঁড়ায় চৌকস হয়ে উঠব। হাতের টিপ তো দেখলি। এক সময় কুড়ি গজ দূর থেকে একটা দেশলাই কাঠির উপরের বারুদ উড়িয়ে দিতে পারতাম। একবার ভেবেছিলাম টুর্নামেন্টে গেলে কেমন হয় ; উনি রাজি হলেন না ; বললেন, ‘ঘরের মধ্যে পিস্তল ছুঁড়ছ এই ভাল, ময়দানে পিস্তল ছুঁড়ে কী হবে? তুমি কি এই করে বেড়াবে নাকি?’ বুঝলি তো, আমার আর চ্যাম্পিয়ন হওয়া হল না। তা হলে দেখতিস খেতাব-টেতাব পেয়ে গেছি।’
রান্না-খাওয়া চুকতে দশটা বাজল। খাবার আগে কাতু এসে ঠাকুমাকে একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে গেল। নাড়ুগোপাল বলল, ‘ওষুধে আপনার ভাল ঘুম হয় ঠাকুমা?’
ঠাকুমা বললেন, ‘সবসময় হয় কোথায় ভাই। কখনও-কখনও কেমন ঘুলিয়ে যায়।’
নাড়ুগোপাল বলল, ‘যাই ঠাকুমা। কিন্তু তুমি পিস্তলটা তুলে রাখো, বাইরে পড়ে রয়েছে।’
পরদিন বেলা করে নাড়ুগোপালের ঘুম ভাঙল। এর মধ্যেই বাড়িতে লোকজন আসতে শুরু করেছে। রবিবারের সকাল। পাড়ার লোকজন ঠাকুমার খোঁজ-খবর নিতে এসেছে।
ডাক্তারবাবু এলেন আর-একটু পরে। তখন কেউ ছিল না। তিনি আয়েস করে এক বাটি পায়েস খেলেন। রাত্তির থেকে রাখা ছিল। সদুঠাকুমাকে বললেন, ‘ভালই তো আছেন দেখছি ; বাতের ব্যথাটা নেই বললেই চলে। আর কোনও ওষুধের দরকার হবে না, শুধু ঘুমের বড়িটা চলুক।’ এই বলে আরও কিছুক্ষণ নাড়ুগোপালের সঙ্গে গল্প করে চলে গেলেন।
সন্ধ্যাবেলায় বড় কেউ এল না। মনে হল সবাই স্টেশনের কাছে সিনেমা দেখতে গিয়েছে। সেখানে দু’ সপ্তাহ ধরে ‘খুনি কৌন’ নামে একটা সিনেমা দেখানো হচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে এল। ঘরে ইলেকট্রিকের আলোর জোর নেই। সেই অল্প আলোতে ঠাকুমা একটা ভ্রমণকাহিনীর বই পড়ছিলেন। পড়তে-পড়তে ঘুম এসে গিয়েছিল ; হাত থেকে বই মেঝেতে পড়ে গেল। ঠাকুমা উঠে দেখলেন ঘড়িতে সাড়ে-দশটা বাজে, তার মানে অনেক রাত! একবার মনে হল ওষুধটা কি খাওয়া হয়েছে, এই মনে করতে-করতে একটা বড়ি খেলেন। শুতে যাবার আগে টেবিলের উপর একটা চিরকুট চোখে পড়ল, কাতুর হাতের লেখা ; ঠাকুমা, তুমি তো প্রায় ঘুমোচ্ছিলে, তোমাকে অল্প জাগিয়ে ওষুধ আর দুধ খাইয়ে গেলাম। তুমি ওষুধ খেয়ে বসে থেকো না। ঠাকুমা বুঝলেন তিনি দুটো ঘুমের বড়ি খেয়েছেন। যাক্, কী আর হবে, না হয় কাল একটু বেলা হবে উঠতে। ঠাকুমা চোখে-মুখে জল দিয়ে শুয়ে পড়লেন। শেষ রাত্রে জানালা খোলা থাকলে পায়ের কাছে কেমন শিরশির করে। এই ভাবতে-ভাবতে ঠাকুমার ঘুম এসে গেল। জানালা খোলাই থাকল। অনেক রাত্তিরে তখন ঠাকুমার চোখ ঘুমে জড়ানো, কিন্তু মনে হল কে যেন তাঁর ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেয়ে না পুরুষ বুঝতে পারলেন না। বেশি ঘুমের ওষুধ খেয়ে মাথাটা কেমন করছিল। মনে হল কে যেন এসে তাঁর বালিশের তলায় হাত দিল। ওখানে তাঁর চাবি থাকে। চাবি নিয়ে কী হবে? তাঁর বাক্সে তত বেশি টাকা নেই। মোটে সাঁইত্রিশ টাকা পঁয়তাল্লিশ পয়সা। কাল সকালে লোককে ব্যাঙ্কে পাঠাবেন ভেবেছিলেন। তিনি চোরের চিন্তাকে আমল দিলেন না।
দেরি করে ওঠা হল না। কেবল ভোর হয়েছে। ঠাকুমার ঘুম ভেঙে গেল। অর্ধেক ঘুমের মধ্যে তিনি শুনছিলেন কারা যেন বাইরে চেঁচামেচি করছে। মনে-মনে বিরক্ত হচ্ছিলেন। এমন সময় দরজায় ধাক্কা দিয়ে ‘ঠাকুমা ঠাকুমা!’ বলতে-বলতে কাতু ঠাকুমাকে জাগিয়ে দিল। ঠাকুমা বললেন, ‘কী হয়েছে রে কাতু, এত হল্লা করছিস কেন?’
কাতু বলল, ‘শিগগির এসো ঠাকুমা, সর্বনাশ হয়েছে। তোমার বাড়ির কাছে কাকে খুন করে গিয়েছে। তুমি তো দেখছি কাল দরজা বন্ধ করে শোওনি, ঠেলতেই দরজা খুলে গেল।’
ঠাকুমা বললেন, ‘বলিস কী!’ এই বলে ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। মনে হল রাত্তিরে ঘুম হয়নি, মাথা কেমন করছে। তিনি বললেন, ‘আমি চোখে জল দিয়ে আসি, তুই একটু দাঁড়া।’
পাঁচ মিনিট পরে কাতু ঠাকুমাক নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোল। বাড়ির কাছে নয় তবে বেশি দূর যেতে হল না। কয়েক পা যেতেই রাস্তার ধারে ছোট্ট বাঁশ গাছের ঝোপ। তার কাছে কয়েকটা মানকচুর গাছ, সেখানে পনেরো-কুড়িজন লোক কী যেন দেখছে। কে যেন শুয়ে আছে। কাছে যেতেই কাতু কেঁদে উঠল, ‘ও তো আমার দাদা।’
ঠাকুমা বললেন, ‘চুপ কর কাতু, কাঁদিস না।’
কাতু কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘এখন আমি মাকে গিয়ে কী বলব?’
ঠাকুমা মাটিতে বসে পড়লেন ; তারপর কাতুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘চুপ কর কাতু, ভেঙে পড়লে চলবে কেন? তোর মাকে যা বলবার আমি বলব।’ দূরে আর একটা দেহ পড়ে ছিল, সেটা মানুষের নয় কুকুরের, তবে সে মরেনি। কাতু আবার কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘দ্যাখো, ঠাকুমা, তোমার বাদামকে কী করেছে।’ বাদাম একপাশ ফিরে শুয়ে ছিল। মাটিতে অনেকটা রক্ত। মনে হল বাদাম কাউকে কামড়ে ধরেছিল, সহজে ছাড়তে চায়নি।
এর মধ্যে দুটো পুলিশের গাড়ি এসে গেল। তারা লোকজনদের হটিয়ে দিয়ে চারদিক খুঁজতে লাগল। খানিকক্ষণ পরে একজন বলল, ‘আর-কিছু পাওয়া যাবে না, খুনি কিছু ফেলে যায়নি মনে হচ্ছে, একটুকরো সুতোও নয়।’
পুলিশের অন্য আর-একজন বলল, ‘এই দিকে দেখ’, এই বলে হাত তুলে যেটা দেখাল সেটা একটা ছোট টেপরেকর্ডার। তার কাছেই আর-একটা চকচকে জিনিস, লোকটার চোখ এড়িয়ে গেল না, বলল, ‘এতক্ষণ পরে খুনির অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে।’ এই বলে হাত তুলে একটা জিনিস দেখাল। সবাই তাকিয়ে দেখল একটা ছোট পিস্তল। একজন বলল, ‘এইটা ঠাকুমার পিস্তল।’
সবাই একবার পিস্তলের দিকে তাকিয়ে ঠাকুমার দিকে তাকাল। ঠাকুমা একবার পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
দারোগাবাবু একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি একটু এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এটা কি আপনার?’
ঠাকুমা বললেন, ‘হ্যাঁ।’
দারোগাবাবু বললেন, ‘তা হলে আপনার সাথে তো একবার কথা বলতে হয়। আপনার বাড়ি তো কাছে, চলুন, সেখানেই যাই।’
ছোটদারোগাবাবুকে ডেকে বললেন, ‘মোহান্তি, দড়ি দিয়ে জায়গাটা ঘিরে রাখো, আর ভিড় সরিয়ে দাও। এত লোক কি এখানে তামাশা দেখতে এসেছে।’ তারপর কাতুকে নিয়ে ঠাকুমার বাড়ি ঢুকলেন। প্রথম প্রশ্ন তিনি করলেন কাতুকে। বললেন, ‘বলো তো মা, তুমি ঠিক চিনতে পেরেছ তোমার দাদা?’
কাতু কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘কাল তোমার দাদা বাড়িতে আসেননি?’
কাতু বলল, ‘হ্যাঁ, এসেছিল, কিন্তু আবার বেশি রাত্রে বেরিয়েছিল বাদামকে নিয়ে। বাদাম আমাদের বাড়ি এসেছিল নেমন্তন্ন খেতে। ঠাকুমার এখানে তো মাংস হয় না, কাল আমাদের বাড়ি মাংস হয়েছিল শুনে ঠাকুমা বললেন, বাদামকে নিয়ে যাস। অনেকদিন মাংস খায়নি, নেমন্তন্ন খেয়ে আসুক।’ এই বলে কাতু চোখ মুছতে লাগল।
দারোগাবাবু বললেন, ‘তুমি এবার দাদার বন্ধুদের কথা বলো।’ কাতু চুপ করে রইল।
দারোগাবাবু বললেন, ‘বলো না, এইতে তোমার দাদার আর কোনও ক্ষতি হতে পারবে না।’
কাতু একটু চুপ করে রইল, তারপর বলল, ‘বলছি। আমার দাদা বি·এ· পড়তে-পড়তেই কলেজ ছেড়ে দিল। মাকে বলত, একটা ব্যবসায় হাত দিয়েছি আমার এক বন্ধুর সঙ্গে। দেখো কত টাকা আনি। পরীক্ষা পাশ করে আর কী হবে? কাতু তো বি· এ· পাশ করে বসে আছে, চাকরি পাচ্ছে? মা কিছু বলতেন না। চুপ করে যেতেন।’
‘দাদার বন্ধুদের তুমি চিনতে?’
‘বিশেষ কাউকে নয়। তারা আসত না, দাদাই তাদের সঙ্গে দেখা করত কলকাতায় গিয়ে।’
‘দাদা বাড়িতে টাকাকড়ি কিছু দিত?’
‘মাঝে-মাঝে মা’র হাতে মোটা টাকা দিয়ে বলত, ব্যবসায় খুব লাভ হয়েছে। আবার চার-পাঁচ মাস হয়তো কিছুই না। একটি পয়সাও ঘরে আসত না।’
দারোগাবাবু একটু পরে বললেন, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব মা, কিছু মনে কোরো না। তোমাদের সংসার চলত কী করে?’
কাতু বলল, ‘সব সময় কি আর ভাল করে চলত। মা’র হাতে এখনও কিছু টাকা আছে, খুব টিপে-টিপে চালাতে হয়। আমার মাঝে-মাঝে ভয় হত—’ বলে কাতু চুপ করে গেল।
দারোগাবাবু বললেন, ‘কী ভয় হত?’
কাতু একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘পাছে দাদা কোনওদিন ঠাকুমার কাছে টাকা চেয়ে বসে।’
ঠাকুমা বললেন, ‘না, না, সেরকম কিছু হয়নি। আমার কাছে কখনও একটি পয়সার জন্য হাত, পাতেনি।’
ঠাকুমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বন্ধুদের তো তুই সবাইকে ভাল করে চিনিস না। কাল যে এসেছিল?’
কাতু বলল, ‘কে, সমীর সান্যাল? ও কয়েকবার বাড়িতে এসেছিল। ওকে আমি একটুও পছন্দ করতাম না। ও যখন হাসত আমার খুব ভয় করত। খুব পান খেত কচমচর করে। শার্টের সঙ্গে কখনও-কখনও সোনার বোতাম পরত। শুনেছি ওদের উত্তর বাংলায় বাড়ি ; জমিজমা বিস্তর। ওদের একটা চা-বাগান আছে। আমাদের বাড়ি একটা ছোট সুটকেস সঙ্গে করে এনেছিল, সেটা নিয়ে চলে গেছে।’
দারোগাবাবু বললেন, ‘টেপরেকর্ডার ঝোপের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে লক্ষ করে দেখেছিলে?’
কাতু বললে, ‘হ্যাঁ।’
‘চিনতে পেরেছিলে?’
কাতু বলল, ‘ওটা আমার দাদার।’
‘তোমার দাদার টেপরেকর্ডার ছাড়া আর কিসের শখ ছিল?’
কাতু বলল, ‘একসময় ক্যামেরায় ছবি তোলবার শখ ছিল। এখন আর হয় না। ছবি তোলার খরচ অনেক বেড়েছে।’ তারপর ঠাকুমার দিকে ফিরে দারোগামশাই বললেন, ‘ঠাকুমা, পিস্তলটা ভাল করে দেখেছেন? ওটা কার?’
ঠাকুমা বললেন, ‘আমার।’
‘অত দূর থেকে চিনলেন কী করে?’
‘আমার জিনিস আমি চিনব না। ওটা তো আর-পাঁচটা পিস্তলের মতো নয়। টাকা দিলেও ও-জিনিস এ-দেশে কিনতে পাওয়া যাবে না। ওর গায়ে কীসব কাজ করা দেখেছেন?’
দারোগাবাবু তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি ঘরের দরজা বন্ধ করে শোন না?’
ঠাকুমা বললেন, ‘হ্যাঁ, শুই তো, আর বন্ধ দরজার সামনে বাদাম পাহারা দিত। কাল অবিশ্যি বাদাম ছিল না।’
দারোগাবাবু কিছু না বলে দরজার কাছে গেলেন। পাড়াগাঁয়ের বাড়ির সাধারণ দরজা নয়, হুড়কো দিয়ে বন্ধ করতে হয় না। দরজা দুটো টেনে চাবি ঘোরাতে হয়। দারোগাবাবু চাবিকলের কাছে গিয়ে কাতুকে বললেন, ‘মা, একটা শক্ত দেখে সরু লোহার মতো কিছু দাও তো।’
দারোগাবাবু চাবিকল ভাল করে দেখলেন, তারপর কাঠিটা দিয়ে সাদা রঙের কীসব বার করলেন, বললেন, ‘হুঁ, মোম। কেউ এমনভাবে লাগিয়ে রেখেছে যে, চাবি ঘোরালেও দরজা বন্ধ হবে না! এর পর আরও দু-চারটে কথা জিজ্ঞেস করার পর বললেন, ‘এইবার আমি আসি, বিকেলে আবার আমাদের লোক আসবে। কলকাতা থেকে রিপোর্ট আসতে একটু দেরি হবে। কাতুকে আমি পৌঁছে দিচ্ছি। ঠাকুমা আপনি আর বাড়ি থেকে বেরোবেন না। লোকজন এসে আপনাকে বিরক্ত করতে পারে, সেজন্য আমি সাদা পোশাকের একজনকে বাইরে রেখে যাচ্ছি।’
বিকালের দিকে দারোগাবাবু আর এলেন না। ঠাকুমা শুনতে পেলেন কাতুর মা’র ঘন-ঘন ফিট হচ্ছে। ডাক্তারবাবু এসে বসে আছেন। ঠাকুমার মনে হল একবার যাবেন দেখতে, তারপর পুলিশের নিষেধের কথা মনে হওয়াতে আর বাড়ি থেকে বেরোলেন না। সন্ধ্যাবেলায় এস· পি· এলেন। এস· পি·-কে ঠাকুমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোনও খবর আছে নাকি এদিককার?’
এস· পি· বললেন, ‘না। তবে এটা যে খুন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। যে ছেলেটি খুন হয়েছে তার মা’র অবস্থার কথা শুনলাম। ভেরি স্যাড।’
ঠাকুমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি একবার যেতে পারি?’ এস· পি· বললেন, ‘গিয়ে আর কী হবে? যা করবার ডাক্তারবাবুই করছেন। আপনাকে তো একবার কলকাতায় যেতে হচ্ছে।’
ঠাকুমা বললেন, ‘কেন?’
এস· পি· বললেন, ‘আর কিছু নয়, আমাদের ইনভেস্টিগেশনে কিছু সুবিধা হবে, এই যা। তা ছাড়া রিপোর্টগুলো তো কলকাতায় আগে পাওয়া যাবে। আর আপত্তি করবেন না। দু-চারখানা কাপড়ও গুছিয়ে নিন, আসতে ক’দিন দেরি হতে পারে।’
ঠাকুমা একটু চুপ করে গেলেন। তারপর বললেন, ‘ওখানে আমার এক অল্পবয়সী বন্ধু আছে, পুলিশের ইন্সপেক্টর। তাকে একটা খবর দিতে হবে।’
এস· পি· বললেন, ‘কোন থানার সঙ্গে অ্যাটাচড আপনি জানেন?’
ঠাকুমা বললেন, ‘হ্যাঁ।’
এস· পি· বললেন, ‘তবে আর মুশকিল কী। গিয়েই টেলিফোন করে দেব। আপনি আর দেরি করবেন না, উঠুন।’
সৌদামিনী দেবী উঠলেন। একটা ছোট ব্যাগে কয়েকটা জামাকাপড়, টুকিটাকি গুছিয়ে নিলেন, তারপর এস· পি·-কে বললেন, ‘চলুন, অনেকদিন কলকাতায় যাইনি।’
নাড়ুগোপাল এই খবর পেল পরদিন আপিসে এসে। এস· পি· কথা রেখেছিলেন। ফোন করে তার আপিসে খবর দিয়েছিলেন। একটু বেলায় খবরের কাগজে বের হওয়া একটুকরো খবর তার চোখে পড়ল। তৃতীয় পৃষ্ঠার প্রথম কলমের শেষে খবরটি ছাপা হয়েছে। কলকাতা থেকে মাইল-পঁচিশেক দূরে মথুরাপুর গ্রামে খুন। জিনিসপত্র কিছু খোয়া গিয়েছে কি না জানা যায়নি, তবে মথুরাপুরের এক পিস্তল ঘটনাস্থল থেকে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছে। আমাদের সংবাদদাতা বলেন পুলিশ সেই পিস্তলটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এই খবরটিও নাড়ুগোপালকে বিচলিত করেছিল। পাশের টেবিলে রামবাবু একটা ফাইল দেখছিলেন আর পেন্সিল কাটার ছুরি দিয়ে নখ কাটছিলেন, বললেন, ‘কী ভায়া, অত মুষড়ে পড়েছ কেন? খারাপ কিছু খবর আছে নাকি?’
নাড়ুগোপাল তাঁকে কোনও উত্তর না দিয়ে একবার বড়বাবুর ঘরে গেল। বড়বাবু ঘরে একাই ছিলেন। ‘এসো নাড়ুগোপাল, আজকের খবরের কাগজ দেখেছ তো? তোমার ঠাকুমাকে অ্যারেস্ট করেছে নাকি? কোনও খবর পেলে?’
নাড়ুগোপাল বললে, ‘না, শুনেছি তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে।’
বড়বাবু বললেন, ‘তবে আর তুমি কী করবে বলো। চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। এ তো ওপরতলার কাজ, তবে তোমাকে নিয়ে গিয়ে লালবাজারে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি এ তোমার ভাগ্যি। আসল কথা কী ভায়া, ওরকম কাউকে হুট করে ঠাকুমা বলে যাওয়া-আসা করতে নেই। ধরো, তোমার এখন প্রমোশনের সময়, ফাইলে একটা আঁচড় পড়তে কতক্ষণ?’
নাড়ুগোপাল আর-কিছু না বলে ঘরে চলে এল। ঘরে এসে কেবলই মনে হতে লাগল বড়বাবু হয়তো কিছু ভেবে বলেননি, কিন্তু তাঁর কথা কাজে লাগতে পারে। একবার দত্তসাহেবের সঙ্গে দেখা করলে খারাপ তো কিছু হবে না। অনেকক্ষণ এরকম ভাববার পর শেষে পাঁচটার সময় আর থাকতে পারল না। থিয়েটার রোডে এসে দত্তসাহেবের ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছল। দরজার লোকটির হাতে কার্ড দিয়ে দিল ; কার্ডের পিছনে লিখে দিল ‘ব্যক্তিগত। একটু সময় দেবেন।’ দত্তসাহেব তাকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু এরকম আচমকা দেখা করতে চাওয়ায় একটু বিব্রত হয়েছেন মনে হল। রাগ করেছেন কি না বোঝা গেল না। দত্তসাহেবও নাড়ুগোপালের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলেন। তার চুল উসকো-খুসকো, মুখ দেখে মনে হল যেন হঠাৎ রোগা হয়ে গেছে। নাড়ুগোপাল খবরের কাগজের টুকরোটাকে দত্তসাহেবের সামনে তুলে ধরল। তিনি সেটা পড়ে বললেন, ‘এটা তোমার ব্যক্তিগত হল কী করে?’ এই বলে নাড়ুগোপালকে বলেন, ‘একটু চা খেয়ে নাও। কিছু খেয়েছ?’
নাড়ুগোপালের মনে পড়ল সমস্ত দিন কিছু খাওয়া হয়নি। তার চা খাওয়া শেষ হলে দত্তসাহেব বললেন, ‘এইবার তুমি আমাকে সব খুলে বলো। সৌদামিনী দেবীর সঙ্গে তোমার কবে থেকে পরিচয়, মথুরাপুরে কতদিন অন্তর তুমি যেতে, সেখানকার লোকজনের কথা সব আমাকে খুঁটিয়ে বলো। কোন্টা বেশি প্রয়োজন তা তোমার ভাববার দরকার নেই।’
নাড়ুগোপাল দত্তসাহেবকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল, তারপর বলল, ‘এখন আমাকে বলে দিন আমি কী করব।’
দত্তসাহেব বললেন, ‘তুমি কিছুই করবে না। কী করা যায়, আমিই ভেবে দেখব। তুমি, ধরো, শনিবার দিন বিকাল তিনটেয় আমার এখানে এসো, তোমাকে কিছু খবর দিতে পারব।’
দত্তসাহেব এর মধ্যে একদিন মথুরাপুরে ঘুরে এলেন। তাঁর ভায়রাভাই বর্ধমানে এস· পি·। ছুটিতে কলকাতায় এসেছিলেন। তাঁকে সঙ্গে নিলেন। তিনি খুব মাছ ধরতে ভালবাসেন। তাঁরা অনেকক্ষণ ছিপ ফেলে জলার ধারে বসে রইলেন। দু-চারটে মাছ ধরা দিল, তার বেশি নয়। এর মধ্যে থানায় খবর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, থানার বাবুরা এলেন। দত্তসাহেব তাঁর ভায়রাকে একটু চেঁচিয়ে বললেন, ‘এখানে তো একটা খুন হয়ে গিয়েছে। আমি আর নতুন করে কী বলব?’ তারপর ভায়রাভাইকে বললেন, ‘এরকম সুন্দর জায়গায় একজন আর একজনকে খুন করছে ভাবতে পারো?’
ভায়রাভাই বলল, ‘আমি সবই ভাবতে পারি। কী নিয়ে খুন হল?’
দত্তসাহেব বললেন, ‘ফেরবার সময় গাড়িতে বলব। আমার মাথার মধ্যে দু-একটা আইডিয়া এসেছে। তুমি যেমন মাছ ধরেছ সেরকম।’
দিন-তিনেক পরে বড়বাবু নাড়ুগোপালকে আপিসের ঘরে ডাকিয়ে বললেন, ‘ওহে নাড়ুগোপাল, তোমার মথুরাপুরের খুনের মামলার বোধ হয় আশকারা হতে চলেছে। তুমি একবার কাল বিকাল তিনটের সময় দত্তসাহেবের আপিসে যাবে। লালবাজার থেকে আর কিছু বলতে চাইল না, তবে আমার মনে হয় কালই হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।’
নাড়ুগোপাল কিছু বলল না। পরদিন তিনটার সময় থিয়েটার রোডে দত্তসাহেবের আপিসে গেল, দেখল ঠাকুমা ভিতরের ঘরে বসে আছেন। দত্তসাহেব ও লালবাজারের দু-চারজন বসে আছেন।
দত্তসাহেব বলনে, ‘এসো নাড়ুগোপাল, তোমার সামনে ব্যাপারটা পরিষ্কার করবার চেষ্টা করি। এই পিস্তলটা তুমি চেনো? সৌদামিনী দেবীর জিনিস এটা। কেমন সৌদামিনী দেবী, তাই না?’ সৌদামিনী দেবী অল্প ঘাড় নাড়লেন। তারপর টেপরেকর্ডারটা দেখিয়ে বললেন, ‘এটা নাড়ুগোপাল তুমি চেনো কি না জানি না, এটা কাত্যায়নীর দাদার। কাছেই ঝোপে পড়েছিল, কেউ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। এইটে চালালে অনেক কথা ধরা পড়বে। সমীর সান্যাল মনেও ভাবেনি তার মৃত্যুবাণ সঙ্গে করে নিয়ে ঘুরছিল। তার আগে একটা পরীক্ষার দরকার। সৌদামিনী দেবী, আপনি তো পিস্তল ছুঁড়তে জানেন, একটু দেখাবেন আপনার হাতের টিপ।’ সদুঠাকুমা চুপ করে রইলেন। ‘সেদিন কি উড়িয়ে দিয়েছিলেন চিঁড়েতনের টেক্কা? হরতনের নওলা? বেশ, আজও তাই হবে। দেখুন তো, সেদিন যতটা দূর থেকে গুলি ছুঁড়েছিলেন তাই হয়েছে কি না?’
সৌদামিনী দেবী ঘাড় নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ হয়েছে।
‘আপনারা, একটু সরে দাঁড়াবেন। সৌদামিনী দেবী, আমরা রেডি, আপনি ছুঁড়ুন।’
সৌদামিনী দেবী পিস্তলটা তাক করে গুলি ছুঁড়লেন। চিঁড়েতনের টেক্কা উড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে দত্তসাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ও কী করলেন? কোন্ হাতে গুলি ছুঁড়লেন?’
সৌদামিনী দেবী একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘কেন, যে হাতে গুলি ছুঁড়ি, বাঁ হাতে।’
‘সেদিনও কি তাই ছুঁড়েছিলেন?’
সৌদামিনী দেবী বললেন, ‘হ্যাঁ।’
‘সাক্ষীরা কিন্তু সে-কথা বলছে না। পিস্তলে একটা ডান হাতের ছাপ দেখছি।’
‘আমি ডান হাতে গুলি ছুঁড়তে পারি না, আগে পারতাম।’
‘কেন, ডান হাতে আপনার কী হয়েছে?’
সৌদামিনী দেবী বললেন, ‘আমার ডান হাতের তর্জনী, বুড়ো আঙুলের পাশের আঙুলের হাড় ভেঙে গেছে। একটা অ্যাকসিডেন্টে পড়েছিলাম বছর-কুড়ি আগে। এমনিতে সব ঠিক হয়ে গেল। সব কাজ করতে পারি, কিন্তু গুলি ছোঁড়ার সময় তর্জনী ব্যবহার করতে পারি না। প্রথমটা খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। কর্তাকে বললাম, পিস্তলই যদি না চালাতে পারলাম তবে আমার কী রইল। কর্তা বললেন, চিকিৎসা করে তো দেখলে, কিছু হল না। তুমি বাঁ হাতে বরং গুলি চালাতে শেখো। ভগবানের বোধ হয় তখন ইচ্ছা ছিল, খুব তাড়াতাড়ি বাঁ হাত চালাতে শিখলাম। এক-এক সময় মনে হত এইটে বোধ হয় ভগবানের আসল ইচ্ছা।’
ওখানে একজন পুলিশের ডাক্তার ছিলেন; তিনি এসে ডান হাতের আঙুলটা পরীক্ষা করে দেখলেন, বললেন, ‘আপনার ডান হাতের আঙুল তো ভাল করে ভাঁজ করতে পারেন না দেখতে পাচ্ছি। বাঁ হাতে কেমন গুলি চালান আর-একবার দেখতে ইচ্ছা করছে।’
সৌদামিনী দেবী বললেন, ‘একবার তো দেখালাম, যতবার বলবেন দেখাব।’
দত্তসাহেব বললেন, ‘আমাদের আর কোনও সন্দেহ নেই। কেসটা গুটিয়ে নিতে আমাদের আর হয়তো দু-চারদিন সময় লাগবে। তারপর সৌদামিনী দেবী আপনি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন। নাড়ুগোপাল, তুমিও তো সেদিন উপস্থিত ছিলে, লক্ষ্য করেছ উনি কোন্ হাতে গুলি ছুঁড়েছিলেন?’
নাড়ুগোপাল লজ্জিতভাবে বলল, ‘না সার, খেয়াল ছিল না। তবে শুনেছিলাম উনি কাত্যায়নীকে বলছেন, আর-একটু সরে দাঁড়াও, আমাকে একটু জায়গা দাও। তারপরে হয়তো পিস্তলটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিয়েছিলেন।’
দত্তসাহেব বললেন, ‘পিস্তলটায় ওঁর ডান হাতের ছাপ’। তার উপরে আর-একটা অন্য হাতের অস্পষ্ট ছাপও দেখতে পাচ্ছি। একজন রুমাল দিয়ে সম্ভবত ছাপগুলোকে মুছে ফেলবার চেষ্টা করেছিল, সবটা পারেনি। তার আগে এই টেপরেকর্ডারটা শুনুন।’ রেকর্ডারটা চালিয়ে দেওয়া হল। প্রথমে একটা ঘ্যাঁষঘেঁষে আওয়াজ, তারপর স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ আওয়াজ। কাত্যায়নীর দাদার গলা, ‘ওটা কী করছ সান্যাল? এ-পিস্তল তুমি পেলে কোথায়?’ তারপর সান্যালের গলা, ‘তা দিয়ে তোমার কোনও দরকার নেই।’
কাতুর দাদার গলা এবার শোনা গেল, ‘অবশ্য কাজ আছে। তুমি কি ভাবো তোমাদের দলের সব কাজ আমি পছন্দ করি। পিস্তলটা ফেরত দিয়ে দাও। যার পিস্তল তাকে ফেরত দাও। পিস্তলটা নিচ্ছ বটে, কিন্তু হজম করতে পারবে? তোমার হাতে তো হাতকড়া পড়বেই, আমাকেও মাঝে থেকে বিপদে ফেলবে। এই বাদাম, দেখিস যেন পালিয়ে না যায়।’
বাদামের গলা থেকে ঘড়ঘড় করে শব্দ হল, তারপর ঘ্যাঁক করে কী একটা কামড়ে ধরল। কাতুর দাদা বলল, ‘ভাল চাও তো পিস্তলটাও ফেরত দিয়ে দাও।’
সান্যাল বলল, ‘এই যে দিচ্ছি।’ তারপর একটা গুলির শব্দ। তারপর শোনা গেল, ‘কী কুকুর রে বাবা, আমার ডান হাতটা শেষ করে দিলে। তোকেও শেষ করছি।’ তারপরে আর একটা গুলির শব্দ ; কুকুরের অসহায় চিৎকার। দত্তসাহেব বললেন, ‘চিৎকার শুনে মনে হচ্ছে গুলিটা ঠিক জায়গায় লাগেনি। বাদাম এমনভাবে কামড়ে দিয়েছিল যে, পিস্তল ঠিকভাবে ধরতে পারেনি সান্যাল, পিস্তলটা কুড়িয়েও নিতে পারেনি। টেপরেকর্ডার ও রক্তমাখা রুমালটা পরের দিন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তবে সান্যাল যেখানেই পালিয়ে যাক ধরা পড়তে হবেই। পুলিশের কর্তাদের মধ্যে একজন বলল,‘মোটামুটি কেসটা তো বোঝা গেল সার। কিন্তু একজন যে মানুষ খুন করে পালিয়ে গেল সার, তার কী হবে।’
দত্তসাহেব একটু হেসে বললেন, ‘সরকার,তার অত নিশ্চিন্ত হবার কারণ নেই। তোমরাই তো বলো লং আর্মস অব দা ল। যেখানেই থাক অপরাধী ধরা পড়বেই।’
মিস্টার দত্তর এ-কথা কিন্তু ঠিক হয়নি। সান্যাল হাঁটাপথে দমনপুরের দিকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। দমনপুরের কাছে অনেক চা-বাগান। সেখানে ঢুকে গেলে আরও পুবে যাওয়া যেত। তাকে ধরে আনা কঠিন হত। কিন্তু ঘটনা অন্যরকম হয়ে গেল। দমনপুর পৌঁছবার একটা স্টেশন আগে সান্যাল ট্রেন থেকে নামল। ভাবল কিছু দূরে গিয়ে একটা সাইকেল-রিকশা নিলেই হবে। এসব রাস্তা তার জানা, অসুবিধা হবে না। রেললাইনের পাশে জঙ্গল ধরে এগোতে লাগল। সে জানত না যে, চার-পাঁচ কিলোমিটার লাইনে মেরামত হচ্ছিল। পুরনো লাইনের পাশে কয়েক গজ দূরে একটু সরিয়ে নতুন লাইন বসানো হচ্ছে। দুপুর থেকে সান্যাল রাস্তা হাঁটছে। দুপুরেও বিশেষ কিছু খাওয়া হয়নি, তার উপরে নেশা করেছিল। কোন্টা পুরনো লাইন কোন্টা নতুন লাইন খেয়াল ছিল না। তার মনে হচ্ছিল যেটা পুরনো লাইন যার মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলে না সেই লাইনে হাঁটছিল। বুঝতে পারেনি পিছন থেকে একটা মালগাড়ি আসছে। এসব লাইনে সব সময় মালগাড়িতে সার্চলাইট থাকে না, তেলের আলো জ্বলে। এখানেও তাই। মালগাড়ির এঞ্জিনের শব্দ তার কানে আসেনি। এলেও তার মনে হচ্ছিল পাশের লাইন দিয়ে যাচ্ছে। ভাল করে বোঝবার আগেই মালগাড়ির এঞ্জিন তাকে পিছন থেকে ধাক্কা মারল। তার হাতে একটা ছোট ব্যাগ ছিল, সেটা ঠিকরে লাইনের পাশে পড়ল। পরদিন পুলিশ এসে সেই ব্যাগের মধ্যে তার নাম-ঠিকানা খুঁজে বার করল।