রাজপাট – ২৫

২৫ 

পউষে পাষণ্ড শীত 
পড়ে প্রভুর গায়। 
উঠিতে বসিতে সীতার 
অর্ধেক রাত্রি যায়॥ 
পউষ মাসের রিত 
পড়এ শিশির। 
কৃষ্ণ বিনে চিত্ত মোর 
হইল চৌচির॥ 
হেমন্তের রিত বহে 
দীঘল যামিনী। 
কৃষ্ণ বিনে কীরূপে 
বঞ্চিমু অভাগিনী॥  

প্রচুর নদ-নদী ও খাল-বিল থাকায় এমনিতেই জেলা মুর্শিদাবাদে শীত পড়ে তাড়াতাড়ি এবং তীব্র হয়ে। আর পৌষের শীত যেন হাড় কামড়ে ধরে। এই শীতে গরিব মানুষ কাঁথাখানি সম্বল করে বাঁচে। আফসানার সম্বল একখানি জীর্ণ চাদর। সেই গায়ে দিয়ে রাত্রি তিনটেয় উঠে উনুনে আগুন দিল সে। চায়ের আয়োজন করল। পাঁচটা নাগাদ জোয়ার আসবে। তার মধ্যেই জাল নিয়ে, মাঝি-মাল্লা নিয়ে নদীতে নৌকা ভাসাবে আকবর আলি। তার আগে অন্তত দুটি ভাতে ভাত আর মাছ ভাজা বা কোনও ব্যঞ্জন না করে দিলেই নয়। 

শীতকালে সহজে মাছ পড়ে না জালে। মাছের মরশুম হল বর্ষা। বর্ষা মাছের প্রজনন এবং বংশবৃদ্ধির কাল। জেলেরা বিশ্বাস করে, মেঘ ডাকলে মাছের পেটে ডিম আসে। বিদ্যুৎ দ্বারা নিষিক্ত এই মৎস্যকুল বর্ষায় ঝাঁকে ঝাঁকে ফেরে। কিন্তু শীতে তাদের আকাল। জোয়ারের পুরো সময়টায় তাই জাল ভাসিয়ে চলা। যে ক’টা মাছ উঠবে সব মহাজন বা আড়তদারের লোককে বুঝিয়ে দিয়ে তবে ছুটি মেলে। ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে যাবে। মাঝখানে এসে যে জলপানি করবে লোকটা—তার সময় নেই। 

ঘরে ফিরে বিশ্রাম নিয়ে আবার দ্বিতীয় দফায় বেরুনো। দিনের দ্বিতীয় জোয়ারেও নৌকা ভাসাবে আকবর আলি। পরিশ্রম করে বটে সে। না করলে চলবেই বা কেন। মাথার ওপর দপ-দপ করছে এককাড়া ঋণ। পুরনো নৌকার তলা বসে গিয়েছিল। কবেকার এ নৌকা! নতুন নৌকা কেনার সামর্থ্য নেই। পোদ্দারবাবুর কাছ থেকে ঋণ দিয়ে নৌকা সারিয়েছিল আকবর আলি। এখন সে-নৌকায় দেখনাই হয়েছে নতুনের মতো। আকবর আলি কোনও কার্পণ্য করেনি এক্ষেত্রে। পুরো শাল কাঠে নৌকা গড়েছে। পুরু করে মাখিয়েছে আলকাতরা। সে বলে, জেলের সম্বল হল জাল আর নৌকা। তাকে যত্ন না করলে চলবে কেন! 

বর্ষায় জেলেপাড়ার সুখের মরশুম। ভাগীরথী তখন হাজার ইলিশে পরিপূর্ণ। জোয়ারের সময় ছানজাল নিয়ে বেরুবে সব আর রুপোলি ইলিশ তুলবে। কত দূরে দূরে চালান হয়ে যাবে সেইসব। আর শুধু ইলিশই বা কেন! জালে উঠে আসে রুই, কাতলা, মৃগেল, শিঙ্গি, মাগুর, কই, পুঁটি, বাটা, রাইখয়রা, শোল, কালবোস। যাদের নিজস্ব নৌকা আছে তাদের সুখের অন্ত নেই তখন। যাদের নেই তারাও মহাজনি নৌকায় কারবার করে ভাল উপার্জন করে। তবে প্রত্যেকদিন একই পরিমাণ মাছ উঠবে, তার কোনও মানে নেই। খানিক কপাল ভরসা করতেই হয় জেলেদের। 

এদিক দিয়ে আকবর আলি সকলের ঈর্ষার পাত্র। লোকে বলে সে জলের তলা অবধি দেখতে পায়। কারণ তার জাল খালি পড়ে না কখনও। এই বিচারে আফসানাও আকবর আলিকে বাহবা না দিয়ে পারে না। গভীর করে ভাবলে স্বামীর প্রতি ভালবাসায় বুক উপচে ওঠে তার। সে জানে কত দায়িত্ব নিয়েছে আকবর আলি। অতখানি ঋণ শোধার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করছে একাই। আব্বাজান বৃদ্ধ হয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর শ্বাসের টান আছে। তাঁকে জলে যেতে দেয় না তার স্বামী। আর ছোট ভাইটা হয়েছে নিষ্কর্মা। আফসানা মনে মনে গালি পাড়ে তাকে। এমন অকম্মা লোক সে কখনও দেখেনি। 

স্বামীর কথা ভেবে আফসানা নিজেও পরিশ্রম করে কম না। ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সারাদিন খাটে। সংসারের কাজের সঙ্গে সঙ্গে বিড়ি বাঁধে। সেও বাঁধে, তার শাশুড়িও। তবে শাশুড়ির বয়স হয়েছে। এখন আর হাতে তেমন তার নেই। চাপটা তার ওপরেই পড়ে বেশি। দুপুরে একটু গড়িয়ে নেবার জন্য শরীর ভেঙে পড়তে চায়। কিন্তু সে জোর করে। যতক্ষণ পারে, জেগে থাকে। ঘুমিয়ে পড়লেই বিড়ির সংখ্যা কমে যাবে। রোজগারও কমে যাবে। মূলত বিড়ির উপার্জনেই তাদের সংসার চলে। তা ছাড়া তার শ্বশুর মহম্মদ আলি এখনও খেপলা ফেলে, হাতজাল ছুঁড়ে কিছু কিছু মাছ ধরেন গঙ্গায়। সেগুলি গাঁয়ে বেচে দু-পয়সা আসে। সেও লাগে সংসারের কাজে। ভিটে সংলগ্ন বাগিচায় তিনি সবজি ফলান। সেও কম সহায় নয়। সংসারে লোক কম না। গোটা পেট পাঁচখানা। কুঁচো তিনটি। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজন লেগেই আছে। আকবর আলি যা রোজগার করে, তার সিংহভাগ যায় পোদ্দারের ঋণ শোধ করতে। বাকি কিছু সঞ্চয় থাকে। কিছু নানা প্রয়োজনে খরচ হয়। 

এ গ্রামের ডাকঘরে একটি তহবিল খুলেছে আকবর আলি। জেলেপাড়ায় যারা সরকারি সমিতির সদস্য, তাদের ছাড়া আর কারও এই সৌভাগ্য নেই। এই তহবিলের জন্য চাপা গর্ব আছে আফসানার। আকবর আলির খুব ইচ্ছে, টাকা জমিয়ে সে আরও একটা শাল কাঠের নৌকা কিনবে। বাবলা-খিরিশের নৌকায় তার মন ওঠে না। আর একখানা নৌকা হলে তাদের উপার্জন দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আকবর আলি স্বপ্ন দেখে। বলে—তখন তুমি, মা কেউ আর বিড়ি বাঁধবে না। ইস্। আঙুলগুলি কী হয়েছে! 

কালো ছোপ-ধরা আঙুলে সে চুমু খায়। আফসানা আহ্লাদে সেঁধিয়ে যেতে চায় আকবর আলির বুকে। লম্বা-চওড়া মানুষটা। ঘুমন্ত ছেলেমেয়েগুলির পাশ থেকে টপ করে তাকে বুকে তুলে নেয়। 

মোবারক আলি ছাড়া এ সংসারের প্রত্যেকেই তাদের শ্রম ও শক্তি খরচ করে চলেছে পরিবারের সুখ সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য। জেলেপাড়ার ঘরে ঘরেই এই চিত্র। এখানে অলস হয়ে থাকার উপায় কোথায়? উনুনের আগুনের দিকে চেয়ে মোবারক আলিকে গাল পাড়ে সে। মরার বাড়া গালি নেই। তাই বলে—মরলে হাড় জুড়োয়। সংসারের বোঝা। 

মোবারক আলিকে তার বাপ-মাই সংসারের বোঝা মনে করেন, আফসানা তো করবেই। স্বামীর কথা ভেবে তার মন দুঃখে ভরে যায়। আকবর আলি কতদিন দুঃখ করে বলেছে—ঘরে লোক থাকতে বাইরের লোক নিয়ে মাছ ধরতে যাই আমি। ও যদি যেত আমার সঙ্গে, ঘরের পয়সা ঘরেই থাকত। 

মহম্মদ আলি কতদিন বেগাত্যা করেছেন। রাগ করে চড়-চাপড় মেরেছেন। তবু মোবারক আলিকে কর্মমুখী করে তোলা যায়নি। কারওকে তার পরোয়া নেই। এমনকী মহম্মদ আলি রাগ করে বলেছেন—দেব একদিন বার করে। পেটে টান পড়লে বুঝবে বাছাধন কত ধানে কত চাল। 

আকবর আলি মাথা নেড়েছে। এ প্রস্তাবে সে সম্মত হয়নি। মানুষ হয় এমন আজব খাপছাড়া। সকলে কি আর এক সুরে বাজে? তার জন্য তাকে ঘরের বার করে দেওয়া সাজে না। হতে পারে কোনওদিন মোবারকের মতি ফিরল। অনেকের অধিক বয়সে দায়িত্বজ্ঞান আসে। তা ছাড়া বাপ-ভাই একত্র থাকলে লোকে মান্য করে। সহজে ক্ষতি করতে পারে না, এমনই মনে করে আকবর আলি। 

সবই চলছে ঠিকঠাক। কিন্তু বিড়ি বাঁধতে গিয়ে আফসানার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তামাকের বিষ আছে তো! আজকাল উঠতে-বসতে হাঁপ ধরে তার। সামান্য ঠান্ডা লাগতে না-লাগতেই জ্বর এসে যায়। তাদের মতো জেলে-ঘরে তুমুল জ্বর না আসা পর্যন্ত শুয়ে থাকাও যায় না। তার এই অসুস্থতা বাড়ির সকলকেই বিপদগ্রস্ত করে। সবচেয়ে ভয় করে তার নিজের। তার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেলে যদি আকবর আলি আবার নিকে করে। ওঃ! সতীনের যন্ত্রণা তার সইবে না। স্বামীর ভালবাসা ভাগাভাগি করতে পারবে না সে। 

এ পরিবারে সে সকলের ভালবাসা পেয়েছে। এ ভালবাসা এমনই যথাযথ, এমনই সুন্দর যে এর কোনও কম-বেশি তার চাই না। কথায় বলে— 

ভালবাসার এমনই গুণ 
পানের সঙ্গে যেমন চুন। 
কম হলে লাগে ঝাল 
বেশি হলে পোড়ে গাল ॥ 

গাল পোড়াতে চায় না সে। কারণ গালে পোড়া ধরলে সে-পোড়া কপালে পৌঁছতে কতক্ষণ। কিন্তু তাই বলে ঝাল আহ্বান করতে পারে না সে। 

তার শাশুড়ি তার জন্য গোপনে সতীধামের ঔষধ এনেছেন। সতীমায়ের ওষুধ নাকি অব্যর্থ। একটি কাঠিমতো। প্রতিদিন তাকেই ভিজিয়ে জল খেতে হবে। পনেরো দিন পর আবার আনতে হবে একটি নতুন কাঠি। সে নিয়ম করে খাচ্ছে ঈষৎ তেতো ওই জল। আর আশায় বুক বেঁধে আছে। সেও পেয়ে যাবে অব্যর্থ ফল। 

সারিয়ে-সুরিয়ে নেবার পর আকবর আলি নৌকাখানার নাম রেখেছে সিরাজ। নৌকাখানা আকবর আলির দুর্বলতম জায়গা হয়ে উঠেছে এখন। কারণ জীবিকার সহায়কমাত্র নয়। এই নৌকা তাকে দিয়েছে সম্মান। গত কয়েক বছর এই নৌকা নিয়েই বাইচে জিতেছে সে। চতুষ্কোনার নৌকাবাইচ মুর্শিদাবাদের মৎস্যজীবীদের কাছে বড় আকর্ষণ। বহু প্রাচীন এ প্রতিযোগিতা। চতুষ্কোনা থেকে শুরু করে দক্ষিণে এই নৌকা-দৌড় হয় পঞ্চগ্রামের শেষ সীমানা পর্যন্ত। আশ্বিনের এই খেলা দেখবার মতো হয়ে থাকে। 

মহম্মদ আলি কাজের মানুষ। আকবর আলি তাঁর গুণই পেয়েছে। তবে আকবর আলির মধ্যে আছে এক স্বপ্নিল পুরুষ। মহম্মদ আলি একেবারেই কেজো। সংসার আর ধর্মচর্চার বাইরে তাঁর অন্য বিষয়ে মন নেই। হতে পারে যৌবনে তিনিও ছিলেন এমনই স্বপ্নিল। সময় এবং অভিজ্ঞতা মানুষকে প্রৌঢ় করে। স্বপ্নরহিত করে। তবে তিনি যেমনই হোন—স্বপ্নময় বা নিঃস্বপ্ন, মানুষ তিনি ভাল তা মানে আফসানা। তা ছাড়া তাদের অধিকারে আছে একখণ্ড জমি— তার কৃতিত্ব সম্পূর্ণ মহম্মদ আলির। মেপে দেখলে কাঠা দশেকের কম হবে না। ভিটে ধরলে আরও বেশি। ভিটে ঘেঁষে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত সে জমি। আমবাগান শেষ হওয়ার পর জেলেপাড়া থেকে নদীর পাড় অনেকখানি চওড়া। এখানে নদীর অববাহিকা খানিক পশ্চিমে সরে গিয়ে আবার চতুষ্কোনার প্রান্তে পুবে বাঁক নিয়েছে। পাড় ভাঙছে এখন অল্প অল্প। আফসানা অনুমান করতে পারে, তাদের ভিটে পর্যন্ত পৌঁছতে নদীর সময় লাগবে আরও। তবু নদীপাড়ে গেলে আফসানার বুক কাঁপে। নদীর মতিগতি কে বুঝতে পারে! তলে তলে ভাঙন ধরে গেলে একদিন হঠাৎ ভুস করে নদীগর্ভে চলে যাবে জমি বাড়ি, গাছপালা। যদি হয় এমন? কী হবে? আফসানা দু’চোখ ভরে তাদের টালির চালের মেটে বাড়ি দেখে, দেখে সবজির ক্ষেত। তাদের ঘাটে বাঁধা সিরাজ নৌকা। তাদের সংসার, তাদের জীবন-যাপন—এই সবকিছুই সে ভালবাসে প্রাণপণ।

ভাতের মাড় ফেলতে ফেলতে সে উঠোনে গলা খাঁকারির শব্দ শুনতে পায়। শুনতে পায় মহম্মদ আলির শ্লেষ্মাজড়িত শ্বাস টানা। শীতকালে মানুষটার ঘুমের কষ্ট বাড়ে। সারারাত পিঠে বালিশ নিয়ে হাঁপায়। এমনিতেও বড় অল্প ঘুম মানুষটার। রাত-বিরেতে উঠে মাছ ধরতে যাবার অভ্যাস আজও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। তা ছাড়া প্রত্যহই, আকবর আলি যখন নৌকায় যায়, মহম্মদ আলিও তার সঙ্গে সঙ্গে নৌকা অবধি যান। প্রয়োজনীয় উপদেশ আদেশ দিতে থাকেন। আকবর আলির শুনে শুনে সব জানা হয়ে গেছে। তবুও সে ধৈর্য ধরে শোনে। বুড়ো হলে মানুষের কথা জমে ওঠে। জগৎসংসারকে সে তার আপন সংবাদ, আপন অভিজ্ঞতার ফসল দিয়ে যেতে চায়। দিন ফুরিয়ে আসে বলেই এই মহাবিশ্বের সঙ্গে তার কথা কওয়ার বিষয় বেড়ে ওঠে। একই বিষয়কে সে বহু বিষয় করে নেয় পুনরুক্তি মাধ্যমে। আকবর আলি জানে এসব বোঝে। কল্পনায় দেখতে পায়, তার ছেলে চলেছে এমনই জাল কাঁধে করে। আর সে চলেছে ছেলের পেছন পেছন কথা কইতে কইতে। তার বিরক্তি আসে না। বাবার অভিজ্ঞতাকে সে দাম দেয় ষোলো আনা। অতএব বুড়ো একটানা কথা বললেও, একই উপদেশের পুনরাবৃত্তি করলেও সে চুপ করে শোনে। তা ছাড়া একজন জেলের মূল্যবান সম্পদ তার ধৈর্য। খোদা এই ধৈর্য প্রত্যাশা করেন তাদের কাছে। প্রত্যাশা করেন বলেই সব দিন সবার জালে সমান মাছ ওঠে না। ভাগ্যের সেই বিচিত্র দান ও কার্পণ্যকে মেনে নিতে হয়। 

এ সমস্ত কথাই আফসানা তার স্বামীর কাছে শোনে। শুনে বুঝতে পারে। মহম্মদ আলির প্রতি তারও শ্রদ্ধা-ভক্তি কম নেই। এক গ্লাস গরম আদা-দেওয়া চা সে ধরিয়ে দিয়ে এল শ্বশুরের হাতে। মহম্মদ আলি ঘরঘরে গলায় বললেন—ভাত হল? 

—হ্যাঁ। 

—ভাল করে বেঁধে-ছেদে দাও। 

আফসানা ঘাড় কাত করে চলে যায়। এই বাক্যগুলি কিছু নতুন নয়। প্রথম প্রথম সে ক্ষুব্ধ হত। এসব বলার মানে কী? সে কি ঠিকমতো বেঁধে-ছেদে দিচ্ছে না? সে কি কর্তব্যে অবহেলা করছে? পরে ভুল ভেঙেছে তার। কিছু আকবর আলির কথায়। কিছু তার নিজের উপলব্ধিতে। মানুষটা এমন বলেন। বলতে ভালবাসেন। এই বলার মধ্যে কোনও সন্দেহ নেই। কোনও আদেশও নেই। এ যেন স্বাভাবিক বিবৃতির মতো। কিংবা এক প্রকার স্বীকৃতিও একে বলা চলে। যেন বয়ানটা আসলে এইরকম—তুমি বেশ বেঁধে-ছেদে দাও। আমরা জানি। তোমার কাছে আমাদের এই প্রত্যাশা চিরকালের। 

কিন্তু এই বাক্যে, এই ভাষায় তা বলা হয় না। বাংলার সমাজে বড় ছোটর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে শেখে না। তাদের কৃতজ্ঞতা নির্দেশবাক্যাবলী হয়েই ফোটে। সে শান্ত মনে ফিরে এসে উনুনের সামনে বসে। ঠিলাগুলি চেপে দেয় উনুনের মুখে। বাঁশের ফালি বা গাছের সরু ডালের ওপর গোবর চেপে রোদে শুকিয়ে বানানো জ্বালানি। শীতকালে সহজে শুকিয়ে নিতে পারা যায় বলে খুব কাজে লাগে। সে কড়ায় তেল দেয়। একটা কাতলা এনেছিলেন মহম্মদ আলি আগের দিন। ছোট কাতলা। তারই দুটো টুকরো সে রেখে দিয়েছিল স্বামীকে ভেজে দেবে বলে। বাইরের কনকনে ঠান্ডায় হাড় হিম হয়ে যাওয়া পরিস্থিতিতে উনুনের ধারে থাকতে ভাল লাগছে তার। একটি মালসায় কিছু অঙ্গার তুলল সে চিমটে দিয়ে এবং মালসা নিয়ে এসে বসিয়ে দিল মহম্মদ আলির সামনে। আহা! বুড়ো মানুষ। হেঁপো রুগি। সেঁকে নিক হিম হাত-পা। বুড়ো হলে এমনিই শরীরের তাপ কমে আসে। 

এক গ্লাস গরম চায়ে চুমুক দিতে ইচ্ছে করল তার নিজের। কিন্তু আকবর আলি উঠে চা না খাওয়া পর্যন্ত সে সংযত হয়ে থাকছে। একবারে একগামলা চা সিদ্ধ করে রেখেছে সে। রান্না শেষ হলে বসিয়ে রাখবে ধুনো আঁচে। যে যখন খাবে, নিয়ে নেবে। 

একবার সে ভাবে, গিয়ে আকবর আলিকে তুলে দেবে কি না। পরক্ষণেই তার মায়া হয়। এত পরিশ্রম করে মানুষটা। আর একটু ঘুমিয়ে নিক। সে পাকঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে আসে এবং আকাশের দিকে তাকায়। চারটে বাজতে দেরি আছে, আন্দাজ করে। উঠোনের ধারে ঝাঁকড়া কাঁঠাল গাছে লম্বা ঠ্যাং ঝুলিয়ে কারা দোল খায়। ডালপালার ফাঁকে পেঁচা উড়ে এসে বসে। গাছের ডাল-পাতা নড়ে। জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে ওৎ পেতে বসে থাকে ভাম, খাটাশ, উদ্বিড়াল। আফসানার গা ছম ছম করে। হতে পারে এখন একটা পিছপয়ের এসে বসেছে গাছের মগডালে। পিছপয়ের বড্ডই পুরুষলোভী হয়। সুন্দরী নারীর রূপ ধরে পুরুষকে ভোলায় তারা। সে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে। ঢোকার আগে বাগানের দিকে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়ায়। ছায়ামূর্তি অপসৃয়মাণ। কে চলেছে? কে যায়? কিছুক্ষণ দেখে তার ভয় কাটে। বুড়ো মহম্মদ আলি বদনা হাতে চলেছেন পাড়ের দিকে। দাওয়ায় মালসার আগুন দুর্বল হয়ে এসেছে। সে ঘরে ঢোকে। ঘুমন্ত আকবর আলির মুখের দিকে চেয়ে থাকে অপলক। ঘরের গাঢ় অন্ধকারেও আপন চোখের আলোয় সে ভরিয়ে দেয় আকবর আলির মুখ। ওই শরীর, ওই মুখ তার সবচেয়ে প্রিয়। রাত্তিরে ওই শরীরেই মানুষটা জড়িয়ে ধরে তাকে। বুকে মুখ গুঁজে শীতকে পরাস্ত করতে চায়। সে পৃথিবীর সকল সুখী স্ত্রীর মতোই আকবর আলির চুলে আঙুল বুলিয়ে দেয়। খসখসে দাড়ির ঘর্ষণে তার বুক কুটকুট করে। তবু সে স্বামীর মুখ ঠেলে সরিয়ে দেয় না। আকবর আলি তার গায়ে হাত বুলিয়ে কোমরের উচ্চকিত হাড়, পিঠের প্রস্ফুটিত দাবনা ও তীক্ষ্ণ কণ্ঠা অনুভব করে। মাঝে মাঝে চিন্তিত হয়ে বলে—আমার চাঁদপানা বিবি এমন রোগা হয়ে যাচ্ছে কেন? সে মনে মনে খোদাতালার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে খোদা, তুমি আমাকে যা দিয়েছ, তাই অনেক। এটুকু কেড়ে নিয়ো না। নদীর পাড়ের মতো ভেঙে দিয়ো না আমার কপাল। 

তখন আকবর আলি চোখ খুলল। আর সামনে আফসানাকে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হল। ধড়মড় করে উঠে বসল সে। দেরি হয়ে গেল নাকি? বালিশের পাশ থেকে হাতঘড়ি নিয়ে চোখের সামনে এনে দেখল সে। আফসানা এবার দৌড়ে পাকঘরে গেল। মাছ ভাজা বসিয়ে এসেছিল। তার এক পিঠে গাঢ় খয়েরি ছোপ ধরেছে। আর একটু দেরি হলেই পুড়ে যেত। সে মাছ উল্টে কড়া নামিয়ে চায়ের গামলা বসাল। দুটি গ্লাসে ঢালল চা। কেরোসিন কুপির আলোয় হাতগুলির দিকে চোখ গেল তার। বিয়ের পর এই হাত দেখে আকবর আলি পরির করতলের সঙ্গে তুলনা দিয়েছিল। তখন সে বিড়ি বাঁধত না। তাই হাত ছিল পরিষ্কার। আঃ! কবে সে এই বিড়ি বাঁধা থেকে মুক্তি পাবে! এটা নাকি স্বনির্ভরতা! সে শুনেছে—স্বনির্ভরতা। নিজের রোজগার নিজে করার ক্ষমতা। মাঝে মাঝে শহর থেকে মেয়েরা আসে। নানা কথা বলে যায়। এমনকী, এমনকী, স্বামীকে নিরোধ ব্যবহার করতে বলার জন্যও পরামর্শ দেয়। বলে— মেয়েদেরই জোর করতে হয়। না হলে পুরুষরা শোনে নাকি? ওরা তো চূড়ান্ত আরামই পেতে চাইবে। ওদের তো পেটে ধরতে হয় না বছর বছর। বীজ দিয়েই ওদের মুক্তি। যন্ত্রণা যখন মেয়েদের, তখন মেয়েদেরই সাবধান হতে হবে। 

ওঃ! সে যে কী লজ্জা! খালেদা, তার শাশুড়ি মেয়েগুলোকে একেবারে দেখতে পারেন না। তার খারাপ লাগে না। তারা যেন অন্য এক জগতের আভাস নিয়ে আসে। সে-জগত আফসানার জগতের মতো নয়। সে-জগতে কারও বিড়ি বাঁধতে হয় না। সে-জগতের নখে নেলপালিশ, হাতে কিতাব, আর, আর বিছানায়, হ্যাঁ, বিছানায় রাশি রাশি নিরোধ এবং স্বনির্ভরতা। 

আফসানা স্বনির্ভরতা চায় না। সে প্রাণ ভরে সংসারের কাজ করতে চায়। এখন যেন কাজে সে প্রাণ দিতে পারে না। উঠোনে ঝাড়ু পড়ল কি পড়ল না, দেওয়াল নিকোন হল কি হল না, কোনও মতে সারা হল রাঁধা-রসুই, আর শাশুড়ি-বউ বিড়ি বাঁধতে বসে গেল। বাচ্চাগুলি ধূলি-ধূসর হয়ে ঘুরে বেড়ায় সারা দিন। আর আফসানার মেয়ে কাজ্বল মা-ঠাকুরমার দেখাদেখি এসে বিড়ি বাঁধতে বসে। আফসানা জোর করে মেয়েকে তুলে দেয়। সে চায় না মেয়ের হাত এখনই কালো হয়ে যাক। আকবর আলি বলে—দাও। বসিয়ে দাও। রোজগার বাড়বে। 

সে প্রতিবাদ করে। বলে কী যে বলো! 

—কেন? বাচ্চাদের হাতে বিড়ি পাকে ভাল। সবক’টাকেই বসিয়ে দাও না। 

—ওদের এখন খেলার সময়। ওরা এখন কী রোজগার করবে? 

—এ তো আমিরের বউয়ের মতো কথা হল। আকবর আলির বউ না। আকবর বাদশার বউ। 

সে রাগ করে তখন। তার প্রাণেশ্বর আকবর আলিকেও সহ্য হতে চায় না। সংসারে টাকার প্রয়োজন তা তো মানেই সে। তার জন্য পরিশ্রমও কম করছে না। কিন্তু তাই বলে শিশুদের দিয়েও কেন উপার্জন করানো! গরিবের ঘরে শৈশব সংক্ষিপ্ত। আট-ন’ বছর হলেই জেলের ছেলে জাল ধরে হয় জাইলা, চাষার ছেলে হাল ধরে হয় হাইলা। আর মেয়েরা তো পাঁচ বৎসর বয়স থেকেই সংসারের কাজে ঢুকে যায়। তার ওপরে আবার বিড়ির ভার কি না চাপালেই নয়? 

আকবর আলি বলে—দেখ, রোজগার বাড়লে আমাদের সবার লাভ। আর একটা নৌকা হলে—ওঃ-জীবনটাই পাল্টে যাবে। তখন কি আর ওদের বিড়ি বাঁধতে বলব? বাইচ খেলাব তখন নতুন নৌকায়। তখন আমাকে হারাক তো কেউ। খবর জানো? 

—কী? 

—ভারত বিড়ি এবার বাইচের পুরস্কার দেবে। জিতলে প্রথম পুরস্কার দু’ হাজার টাকা। 

বাইচের প্রসঙ্গে পাগল হয়ে যায় লোকটা। কোনও কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। কিন্তু এমন স্বপ্নের নিকটে বসেও শিশুদের দিয়ে রোজগার করানো পছন্দ নয় আফসানার। তবু বেশি তর্ক করে না সে। বেশি তর্ক করা তার স্বভাবও নয়। 

বাইচের জন্য টাটকা নৌকার স্বপ্ন আকবর আলির। ক্ষয়ে যাওয়া বিবির থেকে সেই স্বপ্ন কম প্রিয় নয়। অতএব সে বাদানুবাদে যায় না। সে বাইচের কথা ভাবতে থাকে। শাশুড়ি খালেদার কাছেই সে শুনেছে বাইচের খেলা প্রচলনের গল্প। বুড়ির যে কত গল্প জানা আছে, তার লেখাজোখা নেই। যেমন গল্প জানেন, তেমন ছড়া জানেন, তেমন জানেন গান। গলায় সুর বিশেষ নেই। কিন্তু গেয়ে যাবেন একটানা। বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে ঝিমুনি এসে গেলে খালেদা কথা শুরু করেন। অনুরোধ করলে গান ধরেন যা প্রাণে চায়। শুনে শুনে আফসানার সংগ্রহও জমে উঠেছে বেশ। বাইচের গল্পটা খুব মনে ধরেছে তার। 

.

এক ছিল বিরাট নদী। ভাগীরথীর দশগুণ তার বিস্তার। সেই নদীর অপর পারে বসে এক গাজি তাঁর ভক্ত শিষ্যকে কাছে ডাকলেন। নদী তখন ভীষণা। উন্মত্তা। শিষ্য গাজির আহ্বানে সাড়া দিতে পারছে না। আকুল অস্থির হয়ে উঠেছে সে। যা হবার হবে, ভেবে সে গেল নদীর পাড়ে। একটি নৌকা নেই নদীতে। কে তাকে ওপারে নিয়ে যাবে! অনেক খোঁজখবর করে একটি ডিঙি পেল শিষ্য। তাতে চড়ে ভেসে পড়ল নদীতে। যতই সে ওপারের দিকে যাবার চেষ্টা করে, ততই স্ফীত হয়ে ওঠে নদী। নৌকা ডুবে যায় যায়। হঠাৎ চারপাশ থেকে ছুটে এল অনেক নৌকা। যার ডিঙি, সে-ও অপরের নৌকা ধরে ছুটে চলল ওই ছোট ডিঙি ও তার আরোহীকে রক্ষা করতে। গাজির নাম নিতে নিতে সব এগিয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে নদী শান্ত হয়ে এল। ভক্ত নদীর ওপারে পৌঁছল। সেখানে প্রশান্ত মুখ গাজি স্নেহপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে ভক্তের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শান্ত নদীতে তখন সারি সারি নৌকা। সকলের মন আনন্দে পরিপূর্ণ। এই অলীক আনন্দের উৎস কী তারা জানে না। আনন্দে একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলল তারা। এই পাল্লা দেওয়ার নেশা থেকেই বাইচের উৎপত্তি হল। 

এই বাইচের আছে হরেক গান। তবে হিন্দু আর মুসলমানের গানগুলি আলাদা। আফসানা দু’রকমই জেনেছে তার শাশুড়ির কাছে। মুসলমানের গান সে গুনগুনায়। কখনও হিন্দুর গানও। 

আল্লা আল্লা বলিয়া নাও
খোলো রে ভাই সগলি।
আল্লা বলিয়া নাও খোলো॥
ওরে, আল্লা বলো, নাও খোলো 
শয়তান যাবে দূরে। 
ওরে, যে কলমা পইড়া দেছে 
মহম্মদ রসুল রে! 
আরে, নাও যখন খুইল্যা দিলাম 
সবে গ্যালো না। 
হাসেন হোসেন ডাকদ্যা বলে 
আমরা যাব না রে 
ভাই সগল, আমরা যাব না॥ 

খাবার বাঁধা-ছাদা করে আকবর আলির হাতে তুলে দিল আফসানা। আকবর আলি নদীর দিকে গেল। মহম্মদ আলি গেলেন তার সঙ্গে সঙ্গে। হাতে কেরোসিনের কুপি। মাথার ওপর শীতের জমাট আকাশ। সূর্য ফুটতে দেরি আছে এখনও। আলো হলে তবে কাজে লাগবে এই ভাবনায় বিছানায় গড়িয়ে নিতে গেল আফসানা। খালেদা উঠলেই তাকে ডেকে নেবেন। যতক্ষণ না সে-ডাক আসে ততক্ষণ বিশ্রামের আশায় সে শুয়ে থাকল। তার গর্ভে সম্ভবত আরও এক প্রাণ। কারণ গত দু’মাস তার মাসিক হয়নি। এই বাচ্চা না এলে ভাল হত। তার শরীর আর বইতে পারছে না। অলস দেহবিস্তার করে সে স্বামী ও শ্বশুরের বাক্যালাপগুলি স্মরণ করতে থাকে। মহম্মদ আলি বলছিলেন —নৌকার ঋণ তাড়াতাড়ি শোধ করা লাগে। ঋণে সুদে তো দেনা বাড়ে দেখি। 

—তা লাগে। এই ঋণ শোধ হলে আর একখানা নৌকা কিনব। 

—আবার ঋণ নিবি? 

—অসুবিধা কী! দুইখান নৌকা হলে রোজগার তো বাড়বে। 

—এত কর্জ করা ভাল না। দুইখান নৌকা আমাদের ঘরে ঘোড়ারোগ বাপজান। তুমি বুঝমান ছেলে তুমি কেন অবুঝ স্বপন দেখবা? আমাদের জীবনে তো নিশ্চয় কিছু নাই। গঙ্গা কখন কারে টেনে নেয়। কর্জের বোঝা বেশি বাড়ানো ভাল না বাপ। 

তিনি বুঝিয়েছিলেন, দুটি নৌকা হলে তাদের নিয়মিত সারান-সুরোন আছে। তাতে ব্যয় কম হবে না। ঘরের এক লোক তো রোজগারের নামও নেয় না। অতএব নৌকা পড়শিদের ব্যবস্থা দিতে হবে। তারা যতন করবে কি? হয়তো চরা না দেখে-শুনে চালিয়ে দেবে। নৌকার তলা ফেঁসে যাবে। আয়ের চেয়ে ব্যয় অধিক হবে তখন। 

আকবর আলিরও আছে আপন যুক্তি। সে বলে, নৌকা হল আমানত। জেলের ঘরে আমানত আর কী। দরকার হলে একটা নৌকা বেচেও দেওয়া যাবে। 

আকবর আলি আফসানাকে বলেছিল, টাকা জমিয়ে নৌকা কিনবে। আবারও ঋণ নেবার পরিকল্পনা সে ব্যক্ত করেনি। হয়তো শেষ পর্যন্ত আকবর আলি আর ঋণ নেবে না, এমনই সে প্রত্যাশা করে। ঋণের দায়ে মানুষের ভিটেমাটি অবধি গেছে। এ সংবাদ তাদের অজানা নয়। সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে শীতের কুয়াশায় পরতে পরতে হালকা আলো। খালেদা ওঠেননি এখনও। তবু সে বেরিয়ে এল। বদনা নিয়ে বাগান পেরিয়ে নদীর পাড়ে যেতে থাকল। ঘোমটা টেনে পুবমুখী হয়ে বসে পড়ল নদীর কিনারে। কলস্বনা নদী ধুয়ে দিচ্ছে সকল মাটি, সকল আবর্জনা। হাড়কামড়ানো বাতাস তার চাদর ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে শরীরে। নিম্নভাগ অবশ হয়ে আসছে তার। বদনার জলে পায়ুধৌতি করতে গিয়ে মনে হচ্ছে আঙুলগুলো অসাড়। হঠাৎ ভয় করল তার। হঠাৎ পাড় খসে পড়ে যদি, সেও ভাঙামাটির সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাবে জলে। ভয়ে ভয়েই উঠে পড়ল সে। এখন এই ভয় তাদের নিত্যসঙ্গী হল। সে হাতে হাতে গঙ্গামাটি লাগিয়ে নদীর কিনারে গেল জল ছুঁতে। লোক চলাচলে এ জায়গা পাড় থেকে নেমে এসেছে সিঁড়ির ধাপের মতো। সে হাত ধোয়। মুখ প্রক্ষালন করে। নদীর ওপারে এখনও জমাট কুয়াশা। সে দূরে আকবর আলির নৌকা প্রত্যাশা করে। দেখা যায় না কিছুই। জোয়ারের ধারায় জলতল উঁচু হচ্ছে ক্রমশ। সে বুকের মধ্যে একাকী কথা বলে—আকবর আলি, এই আন্ধারে, এমুন কুয়াশায়, তুমি ক্যামনে ডিঙি বাইয়া যাও? 

মাটির ওপর আছড়ে পড়ে জল আর শব্দ তোলে ছলাৎ ছলাৎ। আফসানা তখন জালের সঙ্গে কথা বলে—আমার লিগ্যা মাছ ধইরা আইনো জাল। পাটা জাল! তুমার ছিঁড়া শরীল আমি সিলাই করিয়া দিমু। তুমি যত মাছ ধরবা তত আমার বাঁচন। আর বিড়ি বাঁধমু না আমি। 

লিপ-লিপ-লিপ, ছপাৎ, ছল ছল শব্দ করে চলে নদী। জল পাক খায়। আঘাত করে ভূমি।

আফসানা তখন স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘরে ফেরে। হাজার হাজার চকচকে রুপোলি মাছ সাপটে-সুপটে ধরে নিচ্ছে জাল। তার জন্য। শুধু তারই জন্য। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *