রাজপাট – ২০

২০

ভাদ্র গেল আশ্বিন আইল কার্তিকে দেয় সাড়া। 
অগ্রানেতে খ্যাতের পরে দ্যাখরে আমনছড়া!
আমন উঠে ঘরে ঘরে দুঃখ নাই আর।
আইস এবার যাবার বেলা চরণ বন্দি তার।
ওগো, সপ্তডিঙা মধুকরে যত ধান্য ধরে। 
এবার যেন সোনার ধানে আমার গোলা ভরে।
প্রথম অগ্রান মাসে নয়া হেউতি ধান। 
কেও কাটে কেও মারে কেও করে নবান!
যার ঘরে আছে অন্ন আঁধে বাড়ে খায়। 
যার ঘরে নাই অন্ন পরার মুখে চায়। 

ধান কাটা সারা হয়েছে। ভাল পরিমাণ ফসল হয়েছে এবার বলাই মণ্ডলের গৃহে। কিন্তু এই ফসল অন্যান্যবার যে-তৃপ্তি দেয়, এবার তা দিতে পারছে না। 

অঘ্রান শেষ হল। পৌষ পেরোলেই তাঁর জীবনে ভাঙনের ষোলোকলা পূর্ণ হবে। জমি মাপা হয়ে গেছে। চিহ্নায়নও বাকি থাকেনি। চতুষ্কোনা গ্রামে এ-কথা রটে গেছে যে, কানাই-বলাই ভাইয়েরা এবার পৃথগন্ন হবে। আইনসম্মত ভাগাভাগিই যা বাকি। তাও হয়ে যাবে যে-কোনও দিন। এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলাই মণ্ডলের ভাই কানাই মণ্ডল। আর এই বাড়ি ছেড়ে যাবার জন্য কানাই মণ্ডল দাবি করেছে পঁচিশ হাজার টাকা। বিনিময়ে সে ভিটেবাড়ির পূর্ণ ভোগস্বত্ব বলাই মণ্ডলকে ছেড়ে দেবে। 

কানাই মণ্ডল আর থাকবে না গ্রামে। নিজের হাতে সে চাষ করেনি কোনওকালে। এখন বহরমপুরে থেকে হয়তো সে বর্গা দিয়ে দেবে জমি। কিংবা বিক্রি করে দেবে। কী করবে সে বলাই মণ্ডল জানতে চাননি। তাঁর বুকের অর্ধেক জুড়ে রয়েছে যন্ত্রণা, অর্ধেক অভিমান। এতখানি করতে হল কানাইকে? এতখানি? 

একটি প্রশ্ন তাঁর মনে বড় হয়ে আছে। ওই ভাঙা পাড়ের সংলগ্ন আমবাগানের জন্য কানাইকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে চেয়েছিল কে? গাছ কেটে যদি কাঠ বিক্রি করে কানাই, তবে হাজার ত্রিশ টাকা পেতে পারে হয়তো। কিন্তু সত্যিই কি গাছগুলো কাটতে পারবে কানাই? 

লোভে ধরেছে কানাইকে। কাটতেও পারে। এবারের শস্যের ভাগও বলাই মণ্ডল আধাআধি দিয়ে দেবেন কানাইকে। অর্থে অথবা শস্যে। যা সে চায়। যাক। সব হিসেব চুকে-বুকে যাক। 

পুজোর তোড়জোড় চলছে। দরজায় আগ তোলার চিহ্ন দিয়েছেন মায়া। দুয়ারে আলপনা। অঘ্রানে বৃষ্টি হয়নি এবার এক ফোঁটাও। তাই আলিম্পনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে খুশির আভা। এ-মাসে বৃষ্টি বড় ক্ষতি করে। পোকা লেগে যায় গাছে গাছে। ফলন্ত ধান বৃষ্টির আঘাতে ঝরে ১৩২ 

পড়ে। কত বছর ধরে এইসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে মানুষ এবং ভবিষ্যতের মানুষকে সাবধান করে গেছে নানা ছড়ায় ও প্রবচনে। যেহেতু এই দেশ ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান এবং আজও, এই বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে পৌঁছেও সেই কৃষিব্যবস্থা প্রধানত বর্ষণ মুখাপেক্ষী, সুতরাং বর্ষা নিয়ে প্রবচন ছড়িয়ে আছে লোকজীবনের আনাচে-কানাচে। কিন্তু বর্ষা তাই বলে সারা বছর অভিপ্রেত নয়। চাষের পক্ষে সবচেয়ে ভাল শ্রাবণে অধিক বৃষ্টি, ভাদ্র শুখা। আশ্বিনে জমিতে ধরা থাকবে প্রয়োজনীয় জল এবং কার্তিক দেবে সামান্য বর্ষণ। এমন হলেই হতে পারে আদর্শ উৎপাদন। 

কর্কট ছরকট সিংহের শুখা। 
বন্যা কানে কান। 
বিনা বায়ে তুলা বর্ষে 
কোথা রাখবি ধান 

মৃদুমন্দ বৃষ্টি হোক কার্তিকে, কিন্তু অঘ্রানে যেন এতটুকুও না হয়। 

যদি বর্ষে আগনে 
রাজা যান মাগনে।
যদি বর্ষে পৌষে 
কড়ি হয় তুষে। 
যদি বর্ষে মাঘের শেষ 
ধন্যি রাজার পুণ্যি দেশ। 
যদি বর্ষে ফাগুনে
চিনা কাউন দ্বিগুণে। 

চাষের কাজ যারা করে, তারা মানে এই প্রবাদ। আজও মানে। জলাধার, বিজলি বাতি, ট্রাক্টর, টুলু পাম্প, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের সঙ্গে এই প্রবচনের কোনও বিরোধ নেই। এমনকী পূজা ও ব্রতপালনও হয় আগ্রহভরে। যেমন বলাই মণ্ডলের গৃহে এই ক্ষেত্রব্রত পালন। মায়া পালন করছেন এ ব্ৰত একা। সুমি মাকে ব্রতপালনে সাহায্য করছে। সে নিজে করে ইতুব্রত। ব্রতর জন্য ক’দিন ধরেই চলছে আয়োজন। তিলের ছাতু বানানো হয়েছে। ধান কাঠখোলায় ভেজে খই বানানো হয়েছে। মুড়ি-মুড়কি সবই তৈরি। মায়া অন্নাহার না করে আজ পূজান্তে শুধু দুধ ও খই খাবেন। 

গঙ্গামাটি দিয়ে বানানো হয়েছে একটি বড়-সড় কুমির। তার গায়ে দই ও হলুদমাখা মাষকলাইয়ের আস্তরণ। পূজার সকল আয়োজন সারা হলে মায়া ডাকছেন—তোমরা এস। বস এখানে। ক্ষেত্রব্রতের কথা শুনতে হয়। 

রানি আর কানাই গেছে বহরমপুরে। মায়া জানতে চেয়েছিলেন আজ না গেলে চলে কি না। চলে না। জানিয়েছে তারা। কানাই বলেছে—মানুষ পরিশ্রম করে। ফসল পায়। তার জন্য ব্রতকথা কেন? 

মায়া আভূমি প্রণত হলেন ক্ষেত্রদেবতার উদ্দেশে এবং ব্রতকথা শুরু করলেন। 

.

এক গরিব চাষির ছেলে। তার মা-বাপ নাই। সে মামাবাড়ি থাকে। মামা-মামি তারে ভালবাসে না। ছেলেটি খাটে সারাক্ষণ। সর্বদাই দা-কোদাল নিয়ে কাজ করে। এই না দেখে গ্রামবাসীরা তার নাম দিলে দা-কোদাল। সে ক্ষেত্রদেবতার বিশেষ ভক্ত। তারই পুণ্যে মামার ক্ষেতভরা ফসল। গোলাভরা ধান। গোয়ালভরা গাই। পালভরা মোষ। ঘরে দুধ, দই, ক্ষীর অনেক। কিন্তু মামি তাকে আধপেটা খেতে দেয়। ছেলেমানুষ। বিশেষ বুদ্ধি নাই। সে একদিন মামির কাছে দুধের সর খেতে চাইলে। মামি বললে, হতভাগা ছেলে! তোর জন্য কি আর ঘরে দুধের সর রাখতে পাব না? রয়-রোজগার নেই। সর খেতে চাওয়া? ভাগ এখান থেকে। 

দা-কোদালের দুঃখ হল। ক্ষেত্রদেবতা তার দুঃখে কাতর হয়ে ব্রাহ্মণের বেশে তার কাছে এলেন। বললেন, শোন। আর মামার গোলামি করিস না। মামাবাড়ি ত্যাগ করে ওই যে দূরে মাঠ দেখছিস, ওখানে কুঁড়ে বেঁধে থাক। নিজে নিজের চাষ-বাস কর। তোর দুঃখ দূর হবে। মনে শান্তি পাবি। 

দা-কোদাল তাই করলে। তারপর অগ্রহায়ণ মাসের এক শনিবারের সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলে, তার ক্ষেতে ধান তো নয়, যেন সোনা ফলে আছে। ক্ষেত্রদেবতার কৃপায় তার কুঁড়েঘর অট্টালিকা হয়ে গেল। 

এদিকে ভাগনে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীদেবী মামার সংসার ত্যাগ করলেন। তারা ভাতের কাঙাল হয়ে পড়ল। ক্ষেত্রদেবতাকে অধিক কেউ মান্য করত না। তাঁর কোপে দেশে দুর্ভিক্ষ ও জলকষ্ট দেখা দিল। দা-কোদাল এখন ধনী হলেও গরিবের প্রতি তার বড় দয়া। সে জলকষ্ট লাঘব করতে অনেক পুকুর কাটল। মজুরদের অন্ন দান করল। যত কাঙাল এল, কারওকে ফেরাল না। খেতে না পেয়ে মামা-মামিও একদিন তার অন্নসত্রে এল। তাদের চিনতে পেরে দা-কোদাল দুটি মজুরকে বললে—শীঘ্র যা। ওই পুরুষ আর স্ত্রীলোক দু’জনকে স্নান করিয়ে, নতুন কাপড় পরিয়ে, বাড়ির ভিতরে নিয়ে আয়। 

মামা-মামি ভয়ে অস্থির। ঘরে তিনজনের একই জায়গায় আহারের ব্যবস্থা হল। পঞ্চাশ ব্যঞ্জন ও সরু পরমান্নশালী ভাত দেখে মামা-মামির চক্ষুস্থির। এরপর দা-কোদালকে দেখে তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। দা-কোদাল তাদের সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করলে। তাদের সংসারের কর্তা করে দিলে। 

দা-কোদালের এখন খুব আদর-যত্ন। এটা খাও, ওটা খাও। মামি ভাগনেকে কেবল দু’বেলা দুধ দই ক্ষীর ছানা দুধের সর খাওয়াতে চায়। একদিন দা-কোদাল রহস্য করে বলে ফেলল—

সেই মামা সেই মামি পুকুর পাড়ে ঘর 
এখন কেন মামা-মামি দুধে এত সর? 

মামি শুনে লজ্জা পেলে। তারপর দা-কোদালের বিয়ে হল রাজকন্যার সঙ্গে। তারা ক্ষেত্রদেবতার ব্রত প্রচার করল দিকে দিকে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *