2 of 3

প্রচলিত নারীবিদ্বেষী শব্দ ও প্রবাদ

১.

আপনার স্ত্রী কী করেন? স্বামীকে প্রশ্ন করলে অথবা স্ত্রীকে প্রশ্ন করলে আপনি কী করেন— প্রায়ই একটি উত্তর পাওয়া যায়, উত্তরটি হল— হাউজওয়াইফ। বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায় গৃহবধূ। পেশা হিসেবে গৃহবধূ ঠিক কোন পর্যায়ের তা আমার এখনও বুঝে ওঠা হয়নি।

গৃহভৃত্যত্ব একধরনের পেশা। গৃহভৃত্য ও গৃহবধূকে পেশাজীবী হিসেবে আলাদা স্থান দেওয়া হয়, কিন্তু গৃহস্বামীকে নয়। গৃহস্বামীত্বকে কোনও পেশা বলে মনে করা হয় না। একজন বেকার গৃহস্বামীকে কখনও পেশার পরিচয় গৃহস্বামী দিতে হয় না। যদিও হাউজওয়াইফ-এর পেশা এদেশে বেশ জনপ্রিয়।

গৃহবধূ তাঁর পারিশ্রমিক পান শাড়ি, গহনা, দু’বেলা ভাত তরকারি ইত্যাদি। বিনিময়ে রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, কাপড় ধোয়া, বাচ্চা পালন, বাচ্চা পড়ানো ইত্যাদি কাজ করতে হয়। নিজের হাতে না করলেও অন্তত পরিচালনা তো করতেই হয়। ভৃত্যের কাজও প্রায় একই। ভৃত্য এবং ভার্যা শব্দের ব্যুত্পত্তিগত অর্থ যেহেতু এক, কাজের ধরনও তাই এক। তবে ভৃত্যের যেটুকু স্বাধীনতা আছে, ভার্যার তা নেই। ভৃত্য যখন তখন ঘর ছাড়তে পারে, ভার্যা পারে না। ভার্যার আছে একশ’ রকম শৃঙ্খল। ভৃত্যের আছে যখন যেখানে খুশি সেখানে যাবার অবাধ স্বাধীনতা, ভার্যার সামনে বৃত্ত আঁকা— পরাধীনতার, সীমিত চলাচলের।

‘স্বামী’ শব্দের অর্থ প্রভু, মনিব, মালিক, অধিপতি। আমাদের শিক্ষিত সচেতন মেয়েরা তাঁদের বিবাহিত বন্ধুকে অথবা বরকে ‘স্বামী’ বলতে কোনও দ্বিধা করেন না। তাঁরা নিঃসঙ্কোচে তাঁদের বরকে প্রভু, মনিব, মালিক বা অধিপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁরা কি জানেন না ‘স্বামী’ শব্দের আভিধানিক অর্থ? তারা যদি তা জানেনই তবে ‘স্বামী’ শব্দটি তাঁরা ব্যবহার করছেন কেন, যেখানে এই শব্দ ব্যবহার করবার অর্থ নিজেদের দাসী প্রমাণ করা! ‘স্বামী’র স্থলে এমন কোনও শব্দ তাঁদের ব্যবহার করা উচিত যে শব্দের অর্থ অন্তত প্রভু, মনিব বা মালিক নয়।

৩.

‘বিয়ে বসা’ এবং ‘বিয়ে করা’ দু’রকমের ক্রিয়া। ‘বিয়ে বসা’ মেয়ের বেলায় আর ‘বিয়ে করা’ ছেলের বেলায়। ছেলে করে, মেয়ে বসে। মেয়ে নিষ্ক্রিয় বসে থাকে আর ছেলেটি করে। ক্রিয়ার এই পার্থক্য ছেলেমেয়ের বিবাহিত জীবনেও প্রবল প্রভাব ফেলে। বৈষম্যের ব্যবস্থাগুলোও তাই বেশ ঘটা করে করা হয়। ছেলেরা ঘরের বার হবে, কাজ করবে, মজা করবে, খেলবে, দুলবে, হাসবে। আর মেয়েরা ঘরে বসে ছেলের প্রতীক্ষা করবে, ঘরে বসে কাঁদবে, গোঙাবে।

মেয়েরা, আমি দেখেছি, নিজেরাই ‘বিয়ে বসা’ শব্দদ্বয় সানন্দে ব্যবহার করে, শুনে আমি বিস্মিত হই। সচেতন এবং বুদ্ধিমতী মেয়েরা, যাঁরা নিজেদের ব্যক্তিত্বকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চায় না, তাঁরা কি ইচ্ছে করলেই ‘বিয়ে বসা’র মত অনর্থক শব্দকে নির্মূল করতে পারেন না, অন্তত করে নিশ্চয় দেখিয়ে দিতে পারেন যে তিনি করেছেন, খামোকা বসে থাকেননি।

ছেলেকে বিয়ে করানো হয়। মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়। এরকম হতে পারে না দুজনই দুজনকে বিয়ে করলো? চাইলেই হতে পারে। নারীবিদ্বেষী শব্দগুলোকে বিদেয় করার সময় কি এখনও আসেনি?

৩.

বাংলা ভাষায় একটি অত্যন্ত নোংরা শব্দের নাম ‘অসতী’। অসতী শব্দের অর্থ ব্যভিচারিণী, ভ্রষ্টা, কুলটা। অসতীর পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ যদি অসত্ ধরা হয় তবে অসতী শব্দের যা অর্থ, অসত্-এর কিন্তু সেই অর্থ হয় না। অসত্ শব্দের অর্থ মন্দ, অসাধু, সত্তাহীন, অবিদ্যমান। আসলে অসতী শব্দের কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই, যেমন সতী শব্দের নেই। সতী অসতী শব্দগুলো সে ফ মেয়েদের জন্য আলাদা করে রাখা। এইসব শব্দবাণে তাঁদের বিদ্ধ করবার জন্য। মেয়েরা যদি শব্দনিয়ন্তাদের চাতুর্য অনুধাবন করতে পারেন, তবে নিশ্চয় কোনও শব্দবাণেই তাঁরা আর আহত হবেন না।

৪.

‘অলক্ষ্মী’ও এমন শব্দ। অর্থ হচ্ছে দুর্ভাগ্যের দেবী, দুর্ভাগিনী বা দুর্ভাগ্যদায়িনী নারী। দুর্দশাগ্রস্ত হওয়াকে অলক্ষ্মীতে পাওয়া বলে। শ্রীহীনতা বা দারিদ্রকে অলক্ষ্মীর দশা বলে। অলক্ষ্মীরও কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। অলক্ষ্মী কেবল নারীর জন্য প্রযোজ্য। পুরুষের জন্য নয়। পুরুষেরা দুর্ভাগ্যের দেবতা হয় না, পুরুষের জন্য মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত হয় না, শ্রীহীনতা, দারিদ্র পুরুষের প্রতীক নয়।

৫.

‘পতিতা’ শব্দের অর্থ ভ্রষ্টা, কুলটা, কুচরিত্র, বেশ্যা। ‘পতিত’ শব্দের অর্থ ভ্রষ্ট, স্খলিত, অধোগত, দুর্দশাপ্রাপ্ত, পাপী। কিন্তু তবুও পতিতা যে অর্থে ব্যবহূত হয়, পতিত সেই অর্থে নয়। সমাজে পতিতার জন্য আলয় আছে, পতিতের জন্য নেই। মেয়েরা যারা নিজের সম্মান সম্পর্কে সচেতন, তারা ‘পতিত’ বলবার রীতি তৈরি করুন সেই পুরুষদের যারা পতিতাদের দিকে হাত বাড়ায়, যারা ব্যভিচারে অভ্যস্ত। আমার বিশ্বাস এদেশে পতিত খুঁজতে গেলে ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়ের’ অবস্থা হবে।

৬.

যেহেতু এখনও ভোগের বস্তু হিসেবে নারীর মূল্যায়ন হয়, যেহেতু ঘর ও উঠোনেই নারীকে বন্দী করা হয়, তাই গৃহ থেকে ‘রমণী’, অঙ্গন থেকে উদ্ভূত ‘অঙ্গনা’ শব্দ নিয়ে কারও কোনও আপত্তি দেখি না।

নারীকে আমি ভোগের বস্তু বলে ভাবি না, ‘মানুষ’ ভাবি। নারীর জন্য কোনও শৃঙ্খল আমি স্বীকার করি না— তাই নারীর নাম হিসেবে ব্যবহূত এই অশ্লীল গৃহিণী, রমণী, অঙ্গনা শব্দগুলো নিষিদ্ধ করতে বলি।

৭.

বাংলা ভাষায় ‘রক্ষিতা’ শব্দটি সংস্কৃত ‘রক্ষিত’ শব্দ থেকে এসেছে। এটি সাধারণত বিশেষ্য হিসেবেই বেশি ব্যবহূত হয়। শব্দটির অর্থ পালিত উপপত্নী। এই শব্দটির কোনও পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই। ‘রক্ষিত’-এর পুংলিঙ্গ শব্দ নয়। কারণ ‘রক্ষিত’ শব্দটি বিশেষণ, এর অর্থ রক্ষা করা-রাখা হয়েছে এমন অথবা পরিত্রাত, পালিত, গচ্ছিত। ‘রক্ষিত’ শব্দ দ্বারা ‘পালিত উপপতি’ বোঝায় না। যেমন বোঝায় ‘রক্ষিতা’ দ্বারা ‘পালিত উপপত্নী’।

‘রক্ষিত’ শব্দটির অর্থ পালিত উপপতি নয়, কারণ সমাজে উপপতি রাখবার নিয়ম চালু করা হয়নি অথবা চালু করতে দেওয়া হয়নি। সমাজে যা চালু হয়নি তা শব্দার্থে চালু হবে কেন! রক্ষিতা চালু আছে সব দেশেই। আরবের আমিররা নাকি সত্তর আশিটি করে রক্ষিতা রাখেন। এ দেশের বিত্তবান মুসলমানরাও রক্ষিতা পছন্দ করেন, কেউ গোপনে, কেউ প্রকাশ্যে এই ব্যবস্থার চর্চা করছেন। রক্ষিতা তো আছেই। চারদিকে রক্ষিতা। কিন্তু ‘রক্ষিত’ কেন নেই? ‘রক্ষিত’ শব্দটি আমি বিশেষ্য হিসেবে এবং রক্ষিতার পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করছি। আশা করছি এই শব্দটি অভিধানে এবং উচ্চারণে রক্ষিতার পুংপ্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহূত হবে, যার অর্থ হবে উপপতি। পালিত উপপতি। খুঁজলে কি ‘রক্ষিত’ পাওয়া যাবে না এই দেশে? অথবা অন্য দেশে? আমি জানি পাওয়া যাবে। বিত্তবান নারীরা সত্তর-আশিটা না হোক, একজন দুজন ‘রক্ষিত’ রাখবেন না, এ কেমন কথা! কেবল একতরফাভাবে বিত্তবান পুরুষেরাই এ কৃতিত্বের অধিকারী হবেন— এ কি মানা যায়? মানুষ তো মানুষকে দেখেই শেখে? নারী না হয় পুরুষের ‘রক্ষিতা’ রাখবার কায়দাকানুন শিখে নিজেই ‘রক্ষিত’ রাখলেন। নারীরও তো কৃতিত্ব দরকার। নারীরও তো বীরত্ব দরকার। পুরুষই কেবল একা ‘বীর’ হবে, একাই শৌর্য, তেজঃ, পরাক্রমের অধিকারী হবে? একাই ‘বীর্যবান’ হবে? ‘বিত্তবান নারী’ জগতে অনেক আছেন। তাঁরা ‘রক্ষিত’ রেখে অভিধানে ‘রক্ষিত’ শব্দটি যথার্থ অর্থে প্রচলন করবেন— এ আশা আমি করি। এ বিশ্বাস আমার আছে একদিন ঘরে ঘরে ‘রক্ষিত’ জন্মাবে।

আসলে আমি রক্ষিত/রক্ষিতা রাখার নিয়মটিই পছন্দ করি না। পুরুষতন্ত্র একটা নারীবিরোধী তন্ত্র। আমি চাই না নারীরা পুরুষতন্ত্রের অনুকরণ করে নারীতন্ত্র আনুক। আমি চাই নারী পুরুষ পরস্পরের প্রতি স্নেহ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিয়ে বাঁচুক। বন্ধুর মতো, সহযাত্রীর মতো, সহযোদ্ধার মতো। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনের পথ চলুক।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *