ট্যাংকি সাফ
ট্যাংকি সাফ করতে ষাট টাকা চেয়েছিল মাগন। চল্লিশ টাকায় রফা হয়েছে।
তো মাগন, সেপটিক ট্যাংকির লোহার চাক্কি কোদাল মেরে খুলে বুরবকের মতো চেয়ে রইল। আই বাপ! হাউস ফুল!
হাউস ফুল না হলে ট্যাংকি সাফ করায় কোন আহাম্মক? কিন্তু মুশকিল হল, মাগনের আজ কোনও পার্টনার নেই। কাল হোলি গেছে, আজ রবিবার, মরদরা আজও সব চলাচল জমি ধরে নিয়ে পড়ে আছ। এ বাত ঠিক যে মুর্দার কানে-কানে টাকার কথা বললে মুর্দাও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে। কিন্তু মাতালরা তো মুর্দা নয়। আর তাদের উঠিয়েও কোনও লাভ নেই। টাকার লোভে কেউ হয়তো গার্দা সাফ করতে এসে ট্যাংকির মধ্যে পড়ে গজব হয়ে যাবে।
প্রথম ট্যাংকিতে ময়লা, দু-নম্বরে জল, তিন নম্বরেও জল। তিন নম্বরে পয়লা বালতি মেরে গান্ধা জল তুলে ড্রেনে ঝপাং করে ফেলে মাগন আপনমনে বলে–আই বাপ! হাউস ফুল! চালিশ টাকার তো স্রিফ পাসিনা চলে যাবে। ফিন ভিটামিন–উটামিন দিবে কৌন?
বারান্দা থেকে দত্তবাবু দেখছেন, হেঁকে বলছেন কী বলছিস রে ব্যাটা?
মাগন ঝপাং করে দুসরা বালতি মেরে মুখ তুলে এক গাল হেসে বলে–একটা বাংলা সাবুনের দাম দিবেন তো বড়বাবু? আর চায় পিনেকো পয়সা! আউর হোলির বখশিশ।
–ব্যাটা নাতজামাই এলেন।
–এমন সাফ করে দিব না। একদম বেডরুম।
–বকবক করিস না, হাত চালা। বেলা ভর তোর কাজ দেখতে দাঁড়িয়ে থাকবে কে? তিন নম্বর বালতি মেরে মাগন বলে গিয়ে আরাম করুন না, কুছ দেখতে হবে না। কাম পুরা করে পয়সা লিব।
দত্তবাবু স্টেটসম্যানটা খুলে পড়তে গিয়ে দেখলেন প্লাস পাওয়ারের চশমাটা চোখে নেই। চেঁচিয়ে বললেন, মুনমুন, আমার পড়ার চশমাটা দিয়ে যা তো।
বলে কাগজের বড় হেডিংগুলো দেখতে লাগলেন। মন দিতে পারলেন না। চল্লিশ টাকার কাজ হচ্ছে সামনে! দু-ঘণ্টা বড়জোর তিন ঘণ্টা কাজ করে ব্যাটা চল্লিশ চাক্কি ঝাঁক দিয়ে নিয়ে যাবে। রোজ একটা করে সেপটিক ট্যাংক যদি সাফ করে তবে মাসে কত রোজগার হয়?
ভাবতে গিয়ে ফোঁস করে একটা শ্বাস বেরিয়ে গেল। বারোশো টাকা।
দত্তবাবু খুব জোর হেঁকে বললেন–জোরসে চালা! জোরসে!
ট্যাংকির ভিতরে বকবক করছে জল। গহীন গান্ধা জল। ঝপাঝপ বালতি মারে মাগন আর বলে–চালাচ্ছে বাবা। বহুৎ গান্ধা বাবা, বহুৎ কাদো। চালিশ রুপিয়া স্রিফ পাসিনা মে গিয়া বাবা। ভিটামিন দিবে কৌন?
২.
মুনমুন সাজছে। সময় নেই।
ক’দিন আগেও চুলের গুছির গোড়ায় একটা গার্ডার বেঁধে বেরিয়ে পড়তে পারত। আজকাল আর তার জো নেই। যাদবপুরের জল এত খারাপ যে গত দু-বছরই চুল উঠে গিয়ে এই ক’টা হয়ে গেছে। এখন মাথায় হাত বোলালেও চুল উঠে আসে, একবার চিরুনি চালিয়ে আনলে উঠে আসা চুলের গোছা দিয়ে দড়ি পাকানো যায়। এখন বব করেছে। তবু চুলের পিছনে খাটতে কম হয় না। শুধু চুল? গায়ের রং মেটে হয়ে গেল। যে দেখে সে-ই বলে–ইস। কী কালো হয়ে গেছিস! কতবার বলেছে বাবাকে, এবার যাদবপুর ছাড়ো। আর নয়, এরপর মাথায় টাক পড়বে, গায়ের রং হয়ে যাবে টেলিফোনের মতো। পাত্রপক্ষ দেখতে এলে ভুল করে বলে উঠবে, হ্যালো!
সময় নেই। শুধু শাড়িটা পরা বাকি।
–ব্লাউজের হুকগুলো লাগিয়ে দিবি লক্ষ্মীটি? বলতে-বলতে গিয়ে সে হুস করে চুনুর সামনে পিছু হয়ে উবু হয়ে বসে পড়ে।
চুনুর মুখ দেখে তার মন বোঝা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে সে এইটে অভ্যেস করেছে। মুখে। একটা ভালোমানুষি, আর বড়-বড় চোখে ভাসানো দৃষ্টিতে সে চায় সব সময়ে। দিদিকে আসতে দেখেই চুনু একটা কাগজ লুকিয়ে ফেলল ফ্রকের ঘেরের নীচে।
–একক সংগীত তোর ভালো লাগে? বাব্বা! আড়াই ঘণ্টা ধরে একক গলার গান শুনতে শুনতে মাথা ধরে যায় না? –ইস, হুকগুলো সব চেপটে গেছে। লন্ড্রিতে দিয়েছিলি বুঝি ব্লাউজটা? আছড়ে কেচেছে, হুকের মাথাগুলো সব বসে গেছে।
মুনমুন অধৈৰ্য্য হয়ে বলে–তাড়াতাড়ি কর না।
–করছি তো! হুকগুলো ঘুরে ঢুকছে না যে! একটা সেফটিফিন দে, খুঁটে তুলি। মুনমুনের নতুন প্রেমিক এসে দাঁড়িয়ে থাকবে রবীন্দ্রসদনে। মুনমুন খুব ভালো জানে এও বেশিদিন টিকবে না। শেষপর্যন্ত কে যে পাবে তাকে তা কী এখনই বলা যায়। সতেরো বছর বয়সে কী করে বলবে, আসল লোকটা কে! এখনও কত জন লোক আছে, কত রোমাঞ্চ আছে, কত রহস্য ও ঘটনা! তবু এখনকার মতো এই প্রেমিকটিকেও সে উপেক্ষা করতে পারে না।
সব সময়েই একটু দেরি করে যাওয়া ভালো। তা বলে বেশি দেরিও নয়। তাতে উৎকণ্ঠার বদলে বিরক্তি এসে যায়। মুনমুনের একটা হিসেব আছে। সে হিসেব মতো একটু বেশিই দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সে এক ঝটকায় সরে এসে বলে–ছাড় তো! তোর কম নয়।
বলে সে নিজে নিজে ড্রেসিং টেবিলের দিকে পিছু ফিরে হাত পিছনে ঘুরিয়ে টপাটপ হুক লাগিয়ে ফেলে, বলে–কোথায় হুক চেপটে গেছে! আমার হাতে লাগল কী করে? মারব থাপ্পড়
চুনু ভাসা চোখে চেয়ে থাকে ভালোমানুষের মতো। যেন জানে না, হুক ঠিক ছিল। বলল –সুচিত্রার গান রোজ তো শুনছিস বাবা, রেডিয়োয়, গ্রামোফোনে, মাইকে। আর কত? ডাল-ভাত হয়ে গেছে।
–সুচিত্রা কখনও ডাল-ভাত হয়ে যায় না। আর হলেই কী? তুই রোজ ভাত খাস না? খারাপ লাগে? ভাত না পেলে তো কুরুক্ষেত্র করিস!
হঠাৎ কুঁকড়ে গিয়ে চুনু ফ্রক তুলে নাক চেপে ধরে রুদ্ধস্বরে বলে–এঃ মা! কী গন্ধ আসছে।
প্রচণ্ড সেন্ট মেখেছে মুনমুন। প্রথমে সে পায়নি, এখন পেল গন্ধটা। একটা ‘ওয়াক’ তুলে দৌড়ে গিয়ে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে এসে ‘উঃউঃ’ করে নাকে আঁচল চাপা দিয়ে বলল –সেপটিক ট্যাংক খুলেছে। শিগগির জানলা বন্ধ কর।
৩.
–একটা দড়ি দিবেন বড়বাবু? আব পানি নীচা হয়ে গেল, বালতিতে দড়ি লাগাতে হবে।
–ওঃ, দড়ির কথা আগে বলবি তো! দাঁড়া দেখি আছে কি না।
মাগন একগাল হেসে বলে বারো আনা পয়সা দিন তো লিয়ে আসি।
–পয়সা দিলে পাওয়া যায় সে জানি! চালাকি করিস না। দেখছি দাঁড়া।
দত্তবাবু চেঁচালেন কোথায় গেলে গো? এ ব্যাটা দড়ি চাইছে। আছে নাকি?
লীলাময়ী রান্নাঘরে নেই। খুঁজতে গিয়ে দত্তবাবু দেখেন, ফাঁকা রান্নাঘরে উনুনের ওপর ডাল ফুটছে! ডালের ফেনা উথলে উনুনের গায়ে পড়ে পড়ে ছ্যাঁক–ক–ছ্যাঁক–ক শব্দ উঠছে।
দত্তবাবু ফিরে দাঁড়াতেই অন্যায়ের দৃশ্যটি দেখতে পেলেন। দত্তবাবু তাঁর শ্বশুরমশাইকে ‘বাবা’ ডাকেন না বলে লীলাময়ীর বড় অভিমান। কিন্তু এ লোককে ‘বাবা’ ডাকা যায়? দত্তবাবু দেখতে পেলেন, ভিতরে দু-ঘরের মাঝখানকার প্যাসেজে তাঁর রোগা খুনখুনে বুড়ো শ্বশুরমশাই খুব গোপনে একটা গামছায় নাক ঝাড়ছেন।
শ্বশুরমশাইয়ের ভয়ে দত্তবাবু তাঁর পরিষ্কার গামছাখানা সবসময়ে লুকিয়ে রাখেন। কারণ শ্বশুরমশাইয়ের নিজের দু-খানা গামছা থাকা সত্বেও সে গামছায় তিনি নাক ঝাড়েন না বা পায়ের তলা মোছেন না। ও দুটো কাজের জন্য তিনি সব সময়েই অন্যের গামছা চুরি করেন। এখনও করছেন। আরও আছে। নিজের হাওয়াই চপ্পল থাকা সত্বেও পায়খানা যাওয়ার সময় শ্বশুরমশাই লুকিয়ে জামাইয়ের হাওয়াই দুটো পায়ে দিয়ে যান।
কার না রাগ হয়? কিন্তু মুখোমুখি চোটপাট করে কিছু বলাও যায় না। কুটুম মানুষ।
দত্তবাবু প্যাসেজটার মধ্যে এগিয়ে গিয়ে বললেন–গামছাটা আপনি পেলেন কোথায়?
‘বাবা’ ডাকেন না বলে যে শ্বশুরমশাই দত্তবাবুকে কম খাতির করেন তা নয়। বরং বেশিই করেন। বাবা ডাকেন না বলেই খাতির করেন। খাতিরের চেয়েও বেশি। ভয় পান।
বুড়োমানুষ ভয়ে হাঁ করে আছেন। আড়ষ্ট হাতে জামাইয়ের গামছা সামলে নিয়ে বললেন–এইখানেই ছিল। সরিয়ে রাখছি। দেখো, তোমার গামছায় যেন কেউ হাত না দেয়। কাউকে হাত দিতে দেবে না। আমিও সবাইকে বারণ করি, অধীরের গামছায় তোমরা কেউ…
দত্তবাবু মুখটা কুঁচকে সরে এলেন। গামছাটা আজ আর-একবার কাচিয়ে নিতে হবে। সরে আসতে-আসতেই শুনতে পেলেন, ‘হ্যাক’ করে থুতু ফেলার শব্দ। পিছনে আর তাকালেন না। তাকালে আর সারাদিন জল খাওয়া হবে না। প্যাসেজেই জলের কুঁজো রাখা। শ্বশুরমশাই সারাদিন বাড়ির সর্বত্র থুতু ফেলছেন। সর্বত্র।
লীলাময়ী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন বাইরের ঘরের দরজার পাশে। একটু গোপনীয়তার ভঙ্গি মাখানো তাঁর শরীর।
গোপনীয়তা বাহুল্যমাত্র। বাইরের ঘর থেকে যে আসছে তা শোনবার জন্য কান পাততে হয় না।
৪.
যতটা সুভদ্রাকে ততটা আর কোনও মেয়েমানুষকে ঘেন্না করে না অধীপ। গুয়ের পোকাও কী ওর চেয়ে ভালো নয়?
সুভদ্রা খাটে বসে আছে, সামনের দিকে জোড়া পা ছড়ানো, পিছনে হাতের ভর। মুখ সাদা, চোখ জ্বলছে। বলল –ন্যাকা–জানো না?
–তুমি বলতে পারলে? কোনও ভদ্রলোকের মেয়ে বলতে পারে ওকথা?
–নিজেরা কী? লোকে শুনলে থুতু দিয়ে যাবে গায়ে। ভদ্রলোকের মেয়ে! আমি ভদ্রলোকের মেয়ে না তো কী, তোমার মতো ইতরের বাচ্চা?
মেয়েমানুষকে মারা ভালো নয় অধীপ জানে। কিন্তু এই মুহূর্তে বুঝতে পারে, মারমারের মতো এমন নিরাময় আর কিছুতেই নেই। মারাই বোধহয় সবচেয়ে শান্তি। এক পা এগিয়ে সে শরীরে রিমঝিম রাগের নাচ শেষ কয়েক মুহূর্তের জন্য সহ্য করে প্রায় রুদ্ধস্বরে বলল –এই বজ্জাত মাগি! মুখ ঘষে দেব দেওয়ালে!
দাও না দাও! বলে চোখের পলকে উঠে আসে সুভদ্রা। একদম কাছে এসে চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলে–ছোটলোকের ইতরের গর্ভে যার জন্ম তার কাছে কী আশা করব? মারো!
অধীপ কথা বলতে পারে না। কাঁপে। স্ট্রোক হয়ে যাবে! পাগল হয়ে যাবে! ডিভোর্স…।
সুভদ্রা ধকধক করতে-করতে বলে–ন্যাকা! জানো না, তোমার শরীরে কীসের রক্ত! গুষ্টিসুদ্ধ। বদমাইশ তোমরা, জানো না? তোমার ওই আদরের লেংড়ি বোন চুনু কেন আমাকে বিয়ের পরদিনই বলেছিল–এই বউদি, তুমি কেন আমার দাদার সঙ্গে শোবে!
অধীপের এ কথাটা মাথায় ঢোকে কিন্তু সুভদ্রাই কথাটা বলতে–এটা যেন বিশ্বাস হয় না। তার সমস্ত বিশ্বাসের ভূমি থেকে কে যেন তাকে তুলে ছুঁড়ে দেয় অন্য একটা হীন আর ক্লিব জগতে। সে কাঁপতে-কাঁপতে কসাইয়ের গলায় বলে–কেন বলেছিল?
সুভদ্রা সে-কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে দিগবসনা আক্রোশে প্রায় নেচে উঠে বলে–সহ্য হবে কেন? আদরের দাদার সঙ্গে অন্য কেউ শোয় তাতে বুক জ্বলে যাবে না? ছিঃছিঃ! তোমরা লোকসমাজে মুখ দেখাও কী করে?
অধীপ হঠাৎ পাথরের মতো শান্ত হয়ে গেল! খুন করার আগে যেমন মানুষ কখনও-কখনও হয়। একটু বাদেই সুভদ্রা তার হাতে খুন হবে, সুতরাং সে নিশ্চিন্ত সিদ্ধান্তের পর ঠান্ডা গলাতেই বলল –তুমি নর্দমার পোকা।
–তা তো বলবেই। নিজেরাই কি না। শ্বশুর আমাকে ভালোবাসে বলে তোমার মা বলেনি, শ্বশুর বলেই কী, পুরুষ তো। যুবতী বউয়ের সঙ্গে অত মাখামাখি কীসের? তুমিও বলোনি, সুভ, তুমি বাবার সঙ্গে অত মেলামেশা কোরো না। বলোনি?
বলেছে। ঠিক কথা, মায়ের কাছে শুনে কারও এক সময়ে বিশ্বাস হয়েছিল, বাবার সঙ্গে সুভদ্রার অত স্নেহের সম্পর্কের মধ্যে কিছু একটা অসঙ্গতি আছে। বলেছে। কিন্তু মানুষের কি ভুল হয় না!
সুভদ্রা ঝোড়ো দ্রুতবেগে বলে–সন্দেহ করোনি নিজের বাবাকে? অমন মাতৃভক্তির কপালে ঝাঁটা। ডাইনি মুখে পোকা পড়ে মরবে, পচে গলে মরবে।
ঠিক এই সময়ে দুর্গন্ধটা আসে। বহু দিনকার জমানো মল, ময়লা, জলের প্রচণ্ড গ্যাস। ঘরটার বাতাস পলকে বিষিয়ে ওঠে। কিন্তু তারা দুজন গন্ধটাকে টেরই পায় না; কিংবা পেয়েও উপেক্ষা করতে পারে। কিংবা হয়তো তারা ঠিক এই মুহূর্তে দুর্গন্ধটাকে উপভোগই করে।
আশ্চর্যের বিষয়, অধীপ হাসল। অবশ্য এটা হাসি নয়। খুন করার আগে অভ্যস্ত খুনি কখনও সখনও এরকমই হাসে হয়তো।
তার পরেই সে চড়টা মারল। সুভদ্রা যে পাঁচ মাসের পোয়াতি তা মনে রইল না। লক্ষও করল যে তার দু-বছরের ছেলে দৃশ্যটা দেখছে।
৫.
–চালা! জোরসে চালা জলদি।
–হচ্ছে বাবা, হচ্ছে। পাম্প তো নেহি যে ভটভট করে গাদা খিচে লিবে!
দু-নম্বর ট্যাংকিতে ঘপ করে বালতি মারে মাগন। হাউস ফুল।
দত্তবাবু চেঁচিয়ে বলেন–এই ব্যাটা ময়লা ফেলার গর্ত করবি না?
–হ্যাঁ-হ্যাঁ, গোর্তো হোবে, গোর্তো ভি হোবে। এক বোতল শরাবের দাম দিবেন তো বড়বাবু?
–নালিতে ময়লা ফেলবি তো পয়সা কাটব। নালি আটকালে বাড়িওয়ালা পাঁচ কথা শোনাবে। খুব সাবধান।
–কোই চিন্তা নাই বড়বাবু। কাম পুরা করে পয়সা লিব।
প্লাস পাওয়ারের চশমাটা পরেও স্টেটসম্যানের খবরগুলো দেখতে পান না দত্তবাবু। পুরোটাই আবছা, অস্পষ্ট, হিজিবিজি এবং অর্থহীন। তবু মুখের সামনে কাগজটা ধরে রাখেন। মুখোশের মতো।
মুনমুনকে চিঠি দিয়েছিল বাড়িওয়ালার ছেলে মিলন। সেই চিঠি বাড়িওয়ালা রসিকবাবুর হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন দত্তবাবু। সেই থেকে গণ্ডগোলের শুরু। রসিকবাবুর স্ত্রী ওপরতলা থেকে পরিষ্কার শুনিয়ে দিলেন–এ হতেই পারে না। নষ্ট মেয়েটার পাল্লায় পড়ে মিলুও গোল্লায় যাচ্ছে। তুলে দাও।
দত্তবাবুর কিছু বলার দরকার হয়নি, লীলাময়ী নীচতলা থেকে গুষ্টি উদ্ধার করলেন ওঁদের। কয়েকদিন দত্তবাবু বুকের প্যালপিটিশনে কষ্ট পেলেন খুব। তাঁর খুব ইচ্ছে করে, যে বাড়িওয়ালার যুবক ছেলে নেই তার বাড়িতে উঠে যান। কিন্তু ইচ্ছে তো আর পক্ষিরাজ নয়।
এক বছর আগেকার সেই ঘটনা থেকেই অশান্তি চলছে। রান্না করতে-করতে মাঝখানে কলের জল বন্ধ হয়ে যায়। আঁচাতে গিয়ে বেসিনে জল পাওয়া যায় না। লীলাময়ী নীচে থেকে দাপিয়ে চেঁচান। আর দত্তবাবুর ঝি বাসন মেজে কলতলায় ছাই ফেলে এলে ওপর থেকেও দাপানো আর চেঁচানোর শব্দ হয়।
শ্বশুরমশাই বকের মতো পা ফেলে বাথরুমে যাচ্ছেন জল ঘাঁটতে। এ-বাড়ির জলকষ্টের মূলে এই লোকটার অবদান বড় কম নেই। সারাদিন জল ঘাঁটছে লোকটা। হাঁপানি আছে। সর্দির ধাত আছে। সারারাতের কাশি আছে। আর সেইসঙ্গে জল ঘাঁটাও আছে। জল ঘটুক, তাতে দত্তবাবুর আপত্তি নেই। তিনি শুধু শ্বশুরমশাইয়ের পায়ের চপ্পলটা লক্ষ করলেন। দত্তবাবুর চপ্পলের স্ট্র্যাপ নীল রঙের, শ্বশুরেরটা খয়েরি।
খয়েরি দেখে দত্তবাবু নিশ্চিন্ত হয়ে আবার স্টেটসম্যানের মুখোশ পরলেন, পরার দরকার ছিল। কারণ, লীলাময়ী আসছেন।
এসে একটা মুখ ভেঁড়া খাম দত্তবাবুর হাতে দিয়ে বললেন–এই সেই চিঠি?
–কীসের চিঠি?
–বউমার বাক্স থেকে বোধহয় চুনু নিয়েছিল।
–কেন?
–অন্যায় করেছে নিয়েছে। হয়তো লোভ সামলাতে পারেনি। এই নিয়েই অধীপের সঙ্গে ওই ঝগড়া।
দত্তবাবু চিঠিটা হাতে নিয়ে বললেন–কবেকার চিঠি?
–বিয়ের আগে অধীপ বউমাকে যেসব চিঠি লিখত তারই একটা। কী দরকার ছিল পুরোনো চিঠি জমিয়ে বুকে করে রাখবার? পুড়িয়ে ফেলা যেত না! ঘরে বয়েসের ননদরা, কোলের ছেলেও বড় হচ্ছে…
–তুমি চিঠিটা পড়েছ?
খুব দৃঢ় গলায় নয়। ঝংকার দিয়ে লীলাময়ী বললেন–পড়ব কেন?
–পড়োনি?
–ওপর–ওপর দেখেছি একটু। কী এমন কথা যার জন্য মাগির আঁতে ঘা পড়ল।…ওঃ, এই দুর্গন্ধের মধ্যে বসে আছ কী করে? তুমি মানুষ না কি?
দত্তবাবু বললেন–পড়ে ভালো করোনি।
–কেন? ভালো না করারই কী? তুমিও দ্যাখো না। বলে লীলাময়ী খাম থেকে চিঠিটা খুলে নিয়ে দত্তবাবুর হাতে দিয়ে বলে–পড়েই দ্যাখো।
–বউমা কী করছে?
–কাঁদছে, ঘরে দরজা দিয়ে।
–তুমি যাও।
লীলাময়ী চলে গেলে দত্তবাবু চিঠিটা খোলেন।…অশ্লীল, খুবই অশ্লীল চিঠিটা।
মন থেকে আজ কেমন জোর পাচ্ছেন না। মনের জোরের জন্য খানিকটা নৈতিকতা দরকার। হ্যাঁ, মর্যালিটি তা কি তাঁর আছে?
লীলাময়ী দুর্গন্ধের কথা বলে গেলেন। কিন্তু তিনি দুর্গন্ধ পাচ্ছিলেন না।
৬.
ডাক্তারকে খবর দেওয়া ছিল। সদর থেকে তাঁর হাঁক শোনা গেল এইমাত্ৰকই বউমা কোথায়?
বাইরের বারান্দাটাই এখন বসার ঘর। অধীপের বিয়ের পরই বাইরের ঘরটার দরকার হল। তখন বারান্দাটা প্লাইউড দিয়ে ঘিরে সোফা সেট পাততে হল।
লীলাময়ী প্রমাদ গুনলেন। বউমাকে দেখতে এসেছে। সর্বনাশ! তার বাঁ-গালে অধীপের পাঁচ আঙুলের দাগ ফুটে আছে এখনও, তার ওপর নাগাড়ে কাঁদছে। বাইরের লোকের সামনে বেরোবে না কিছুতেই। যদিও বা বেরোয় তো ডাক্তার সবই লক্ষ করবে।
উঠে গিয়ে তিনি ঘোমটা টেনে বললেন বসুন।
–বেশি বসবার উপায় নেই। চেম্বারে রুগি বসে আছে।
লীলাময়ী নিঃশব্দে গিয়ে দরজায় সামান্য শব্দ করে চাপা গলায় ডাকেন–বউমা! বউমা! ডাক্তারবাবু এসেছেন, দরজা খুলে দাও। ঠিকঠাক হয়ে নাও।
সুভদ্রা পাঁচ মাসের পোয়াতি। বড় ছেলে দুই পেরিয়েছে। সে হতে বড় কষ্ট গিয়েছিল। অধীপ তাই ঘনঘন ডাক্তার ডেকে চেক আপ করায়। কিন্তু অধীপটা রাগারাগি করে বেরিয়ে গেছে। অবস্থাটা সামাল দেবেন কীভাবে তা ভাবতে-ভাবতে লীলাময়ী গিয়ে চায়ের জল চাপান। চৌধুরি পারিবারিক ডাক্তার, তাঁর কাছে তেমন লজ্জা নেই। তবু তো লজ্জা! আজকালকার বউয়েরাও ভারী নির্লজ্জ। কথায়-কথায় পরপুরুষ ডাক্তারদের কাছে নিজেদের খুলে দেয়। ডাক্তাররা গোপন জায়গায় হাত দেয়, টিপ দিয়ে দেখে, অসভ্য সব প্রশ্ন করে। মাগো! লীলাময়ী মরে গেলেও পারবেন না। তাঁকে কয়েকবার লেডি ডাক্তাররা দেখেছিল। তাতেই কী লজ্জা!
শচীলাল ডাক্তারের গন্ধ পেয়েছেন। থুথু ফেলার জন্য তাঁর একটা টিনের কৌটো আছে। সেইটে গিয়ে গোপনে বেসিনে ধুচ্ছিলেন। জল ঘাঁটছেন টের পেলে মেয়ে আজকাল বড় বকে।
ডাক্তারের সাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি কৌটো রেখে বাইরের বারান্দায় এসে বসেই বললেন–বুঝলেন ডাক্তারবাবু, গত দু-বছর যাবৎ আমার পেটের কোনও গোলমাল নেই।
চৌধুরি হেসে বলেন বাঃ খুব ভালো।
–যা খাই সব হজম হয়। ইটের মতো শক্ত পায়খানা। আপনি আমাকে রোজ সকালে দুটো করে মুরগির ডিম খাওয়ার ব্যবস্থা দিয়ে যান।
–সে আমি বুঝব খন। শ্বাসের কষ্টটা কেমন আছে?
–এটাই যা একটু কষ্ট দেয়, আর সব ভালো।
লীলাময়ী চা নিয়ে এসে বাবাকে দেখে বড়-বড় চোখে তাকিয়ে বলেন–তোমার আবার কী?
শচীলাল একগাল হেসে চৌধুরিকে বলেন বুঝলেন ডাক্তারবাবু লীলা ভাবে আমি পেট খারাপের কথা লুকোই। কাল তাই প্যানের ওপর পায়খানা করে ডেকে দেখালাম। বল না লীলা ডাক্তারবাবুকে কেমন পায়খানা!
চৌধুরি বলেন–আচ্ছা, দেখা যাবে।
লীলাময়ীর মুখ ফেটে পড়ছে রাগে, চাপা গলায় শচীলালকে বলেন–এখন ঘরে যাও তো!
–চা করলি?
–তুমি এখন খাবে না চা। স্নান করো গে। একেবারে ভাত দেব।
–চালকুমড়ো পাতার পুর করবি না?
লীলাময়ীর হাত-পা নিশপিশ করে। গোপনে আবার এসে, বউমার ঘরের দরজা নাড়া দেন–শুনছ বউমা!
ঘরে ছেলেটা কাঁদছে অনেকক্ষণ ধরে। বাপ-মায়ের রুদ্রমূর্তি দেখেই শুরু করেছিল। তারপর থেকে ভ্যাবাচ্ছেই।
সুভদ্রার কান্না থেমেছে। গম্ভীর গলায় বলল –ডাক্তার বিদেয় করে দিন গে। আমি দেখাব। আর বিরক্ত করবেন না আমাকে।
ভারী অসহায় বোধ করেন লীলাময়ী। কী করবেন? চৌধুরি এসেছেই যখন, রুগি দেখুক আর দেখুক, ভিজিটের টাকাটা দিতেই হয়। কিন্তু অধীপ ভিজিটের টাকা রেখে যায়নি।
৭.
–ইসি ট্যাংকিমে আর কুছু নাই বড়বাবু।
–নেই মানে? ইয়ার্কি পেয়েছিস? ডান্ডা মার, মার ডান্ডা। দেখি কতখানি আছে।
মাগন বলে–হাঁ–হাঁ দেখে লিন।
ডান্ডা মারতেই সেটা ভচাক করে দু-হাত পুরু ময়লায় ডেবে গেল।
–ওই তো। এখনও অর্ধেক রয়ে গেছে। চালাকি করার আর জায়গা পাস না? চল্লিশ টাকা কি এমনি–এমনি দেব?
ডান্ডা তুলে ময়লার দাগ দেখিয়ে মাগন বলে–বাস এইটুকু তো সব ট্যাংকিতে থাকে। ট্যাংকি কি কখনও পুরা সাফা হয় বড়বাবু? কুছু তো থেকেই যায়। ই তো স্রিফ বালু আছে।
–বকবক না করে কাজ কর তো।
–হাঁ–হাঁ কাম তো করছে বড়বাবু।
দুনম্বর ট্যাংকিতে জলের নীচে ময়লা এখনও থকথক করছে। শক্ত মাল। বালতি মারলে ডোবে না। পা গর্তে ঢুকিয়ে চেপে বালতি ডোবায় মাগন। বলে বহোত পরেসান বাবা। একটা পুরানা জামা দিবেন তো বড়বাবু? ট্যাংকি বেডরুম বানিয়ে দিব।
লীলাময়ী আসছেন টের পেয়েই দত্তবাবু স্টেটসম্যানের মুখোশটা পরে নিলেন।
কিন্তু লীলাময়ী এলেনই। নাকে চাপা আঁচলের ফাঁক দিয়ে বললেন–চৌধুরি এসেছে। বউমা ডাক্তার দেখাবে না বলছে। কিন্তু ভিজিটটা তো দিতে হয়। অধীপ টাকা রেখে যায়নি।
বিরক্ত দত্তবাবু বলেন–আমার ব্যাগ থেকে নিয়ে দাও গে। অধীপ এলে চেয়ে রেখো।
–চাইব, কিন্তু সে দেবে কেন? তার বউকে তো আর দেখেনি।
–সেই তো ডেকেছে, আমরা তো কল দিইনি। রেসপনসিবিলিটি তার। লীলাময়ী নাকটা ছেড়ে একটু দম নিতে গিয়েই দুর্গন্ধে শিউরে উঠে ‘হ্যাক’ শব্দ করে আবার নাকে চাপা দিয়ে বলেন–বলছি কী, ভিজিট যখন দিচ্ছিই তখন আর মাগনা ছাড়ি কেন। প্রেসারটা দেখিয়ে নিই। বাবার বুকটাও পরীক্ষা করুক। তুমিও তো পরশুদিন মাথা ঘোরার কথা বলছিলে, দেখিয়ে নেবে নাকি?
ঠিক এই সময়ে ওপর থেকে রসিকবাবুর স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠে বলেন–এই জমাদার! নর্দমায় ময়লা ফেলছ যে বড়? নালি আটকে যাচ্ছে না? মাগন মুখ তুলে বলেন–নালি টেনে দিব মা। কাম পুরা করে পয়সা লিব।
–কেন, গর্ত করতে কী হয়? বলা হয়নি তোমাকে গর্ত খুঁড়তে? টাকা মাগনা আসে?
–হাঁ–হাঁ, গাজ্ঞা কী হোবে।
রসিকবাবুর স্ত্রী বেশ চেঁচিয়ে বলতে থাকেন–ছ’মাস আগে ট্যাংক পরিস্কার করানো হয়েছে, এর মধ্যেই যে কী করে ভরে যায় তা তো বুঝি না।
কথাটা গায়ে না মাখলেও হয়। কিন্তু লীলাময়ী মাখলেন।
–শুনলে?
দত্তবাবু স্টেটসম্যানের মুখোশ পরে ফেলেন। লীলাময়ী মুখটা সিলিং-এর দিকে তুলে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন–ময়লা কি শুধু আমাদের একার? ওপরতলায় বুঝি সব দেবতারা থাকেন, তাঁরা কেউ হাগেন মোতেন না? আর জমাদারের টাকার অর্ধেক তো আমাদেরও দিতে হবে। মাগনা কাজ হচ্ছে নাকি?
রসিকবাবুর স্ত্রী নাগাড়ে চালিয়ে যাচ্ছেন। সব কথা বোঝা যায় না। শুধু স্পষ্ট করে শুনিয়ে বললেন–ওই তো ছেলে ধরতে বিবি বেরিয়ে গেলেন। আর দোষ হল কি না আমার মিলনের! গুষ্টিসুদ্ধি তেড়ে এসেছিলেন ঝগড়া করতে। বলি, মেয়ে কোথায় যায়, কার সঙ্গে কীরকম ঢলাঢলি তার খবর রাখছে কে? সে বেলা তো চোখে তুলসীপাতা এঁটে থাকা হয়।
লীলাময়ী এখন আর দুর্গন্ধটা পাচ্ছেন না। নাকের কাপড় কখন খসে গেছে। বড়-বড় চোখে লীলাময়ী স্বামীর দিকে তাকান। মুখে কথা নেই।
দত্তবাবু এমন মুখের ভাবখানা করেন, যেন তাঁর মেয়ে বা তাঁর পরিবার নিয়ে কথা হচ্ছে না। এ যেন অন্য কারও কথা। প্রচণ্ড জিদবশত তিনি কাগজে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ দাঙ্গার খবর পড়তে থাকেন। একবর্ণও বুঝতে পারেন না।
একবার ভাবলেন ডাক্তার চৌধুরিকে প্রেসারটা দেখিয়ে নেবেন।
৮.
চুনুর একটা পা শুকনো কাঠি। একটা হাতও কমজোরি। বড় কষ্ট তার হাঁটাচলার। যে তাকে দেখে সে-ইদুঃখ পায়।
আর অন্যের এই দুঃখবোধটা খুব ভালো কাজে লাগাতে শিখে গেছে চুনু। জানলার কাছে একটা সাইকেল থেমে আছে। সাইকেলের ওপর শিবাজী।
–ডলিকে আমি নিজের চোখে দেখেছি পাম্প ছাড়তে। চুনু খুব ভালো মানুষের মতো বলে।
–কিন্তু আমার পিছনের চাকাটায় তো লিক বেরোল।
–লিক? তবে ঠিক সেফটিপিন ফুটিয়ে দিয়েছিল। তুমি তখন মান্তুদের বাড়িতে ক্যারাম খেলছ। খেলছিলে না?
–ক্যারাম?
–মিথ্যে কথা বোলোনা।
শিবাজী হেসে বললে–খেলছিলাম! তুমি ডলিকে বলেছ?
–না, মাইরি, কালীর দিব্যি।
–তবে বললে কে? ডলি জানল কী করে?
–বলব সত্যি কথা একটা? কিছু মনে করবে না তো?
–বলো না।
–মান্তু। ঠিক মান্তুই বলেছে। মান্তু আজকাল ইউনিভার্সিটির ঝিলে গিয়ে কার সঙ্গে বসে থাকে জানো? তপন।
–সেই বদমাশটা? গেলবারও আমাদের হাতে মার খেয়েছিল?…এই তোমার বাবা!
বলেই শিবাজী জানলার নীচে ডুব দেয়। পরক্ষণেই তার সাইকেলের ঘণ্টি দূরের রাস্তার দমকলের মতো ঘনঘন রি–রি–রিং রি–রি–রিং বাজতে থাকে।
চুনু আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়। তার মুখে কোনও অপরাধবোধ নেই। বউদির চিঠি চুরির জন্য মা তাকে বকেনি। আসলে বকতে সাহস পায়নি। বাবাও পাবে না।
দত্তবাবুও জানেন চুনুকে শাসন করার ক্ষমতা তাঁর নেই। কাউকেই শাসন করার ক্ষমতা নেই। এ-বাড়ির কেউই তাঁর কথা শোনে না।
–এ চিঠিটা চুরি করেছিস?
ঠান্ডা গলায় চুনু বলে–বেশ করেছি। একশো বার করব।
এই মেয়ের জন্যই দত্তবাবু আর লীলাময়ী গত পাঁচ বছর এক বিছানায় শুতে পারেননি। চুনু তখন থেকেই তার মাকে প্রায়ই বলত লজ্জা করে না তোমরা বুড়ো বয়সে একসঙ্গে শোও? কেন শোবে?
কী লজ্জা! সেই লজ্জায় লীলাময়ী দত্তবাবুকে বলেছিলেন–মেয়ে যখন চায় না তখন থাক না হয়।
দত্তবাবু গম্ভীর হয়েছিলেন। কিছু বলেননি। লীলাময়ীই আবার নিজে থেকে বলেন–ও তো জানে ওর সাধ আহ্লাদ মিটবে না! তাই বোধহয় হিংসে।
হবে। কিন্তু সেই আক্রোশটা দত্তবাবুর যায়নি এখনও। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন–কী বললি?
তাঁর চেহারাটা কেমন দেখাল কে জানে! হয়তো খুবই ভয়ঙ্কর! দত্তবাবু ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেলেন।
ভয় পায় না, তবে এখন পেল। পিছনে হাত নিয়ে জানলার গ্রিল চেপে ধরে তবু ত্যাড়া ঘাড়ে, চুনু বললে–গায়ে হাত দেবে না বলে দিচ্ছি! ইঃ তেজ দেখাতে এলেন! মুরোদ জানা আছে। কই, বউদিকে তো চোখ রাঙাতে পারো না, যখন মাকে যা তা বলে মুখের ওপর! তোমার উইকনেস।
জানি। বেশি তেজ দেখাতে এলে সবাইকে চেঁচিয়ে বলব।
দত্তবাবু অবশ হয়ে যান। ঘেমে যান। মুহূর্তের মধ্যে। মারবেন বলে হাত তুলেও ছিলেন। সেই হাত সজোরে নেমে ঝুলে পড়ল ফাঁসির মড়ার মতো।
আস্তে-আস্তে ফিরে এসে স্টেটসম্যানের মুখোশ পরলেন।
এই সেদিন অধীপ যখন বিয়ে করবে বলে মাকে গিয়ে ধরেছিল সেদিন লীলাময়ীর কাছে সব শুনে কী রাগটাই না করেছিলেন তিনি। ছেলে তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে। ঢুকেই বিয়ে। পার্মানেন্ট হ। মাইনে একটু ভদ্রগোছের হোক। নইলে তো হ্যাপা সামলাতে হবে বাপকেই।
কিন্তু দত্তবাবুর ইচ্ছেয় কিছু তো হয় না এ-বাড়িতে। যার যা ইচ্ছে তাই করে। অধীপেরও বিয়ে হল।
নতুন বউকে দেখে ভারী মুগ্ধ হয়ে গেলেন দত্তবাবু। বহুকাল এমন মিষ্টি মুখ দেখেননি। বউভাতের পরদিনই মাথাখানা বুকে টেনে বলেছিলেন–এখন তুমিই সংসারের কর্তী।
আত্মবিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন। কথাটা বলা ঠিক হয়নি। সেই থেকে সংসারে অশান্তির সূত্রপাত।
মনের মধ্যে পাপ আছে কি?
কে জানে বাবা! কে জানে! তবে পাপের চেয়েও লজ্জা অনেক বেশি।
শ্বশুরমশাই কী একটা পেছনে লুকিয়ে নিয়ে চুপিসাড়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছেন!
উঁকি মারলেন দত্তবাবু। দেখলেন, তাঁর নীল স্ট্র্যাপের হাওয়াই চপ্পল।
৯.
লীলাময়ী দুটো প্রেসারের বড়ি একসঙ্গে খেলেন। বেড়েছে।
একটা ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পেয়েছিলেন যেন একটু আগে। মনের ভুলও হতে পারে। তবে কান খাড়া রাখছেন।
শচীলাল স্নান সেরে এসে নিজেই আসন পেতে জল থালা আর নুন নিয়ে বসে পড়েছেন। ভিতরের বারান্দায়। ডাকছেন–লীলা, দিবি নাকি?
ঠিক এই মুহূর্তে লীলাময়ীর রাগ হল না। ক’দিন আগেও শচীলাল জামাইয়ের সঙ্গে ছাড়া খেতেন না। ভদ্রতাবোধ বরাবরই প্রবল। ইদানীং এইসব হচ্ছে। লীলাময়ী বললেন–বসে থাকো একটু। যাচ্ছি।
শচীলাল বসে থাকেন। দুর্গন্ধ পাচ্ছেন ঠিকই। গা করছেন না। বড় মেয়ে হিরন্ময়ী বলেছে, নিয়ে যাবে শিগগিরই। হিরন্ময়ীর অবস্থা ভালো, দু-বেলা মাছ হয়, মাঝে-মাঝেই পোলাও। কতকাল পোলাও খান না শচীলাল!
লীলাময়ী টের পান, সুভদ্রা দরজা খুলল। প্যাসেজ দিয়ে নাতিটার পায়ের আওয়াজ ধেয়ে আসছে, কচিগলার ডাক এলঠানু। ও ঠানু আমরা যাচ্ছি।
সুভদ্রা গর্জায়–এই! খবরদার যাবি না। গলা টিপে মেরে ফেলব তাহলে।
ছেলেটা ফিরে যায়। একটু কাঁদে কি? লীলাময়ী উঁকি মেরে দেখেন প্যাসেজ দিয়ে বাথরুমের দিকে গেল সুভদ্রা। ছেলের নড়া শক্ত হাতে ধরা। সাজগোজ সব হয়ে গেছে। যাওয়ার জায়গা বলতে বাপের বাড়ি। তা যাক। বাড়িটা জুড়োবে!
–লীলা দিবি? শচীলাল ডাকেন।
এবারে রাগেন লীলাময়ী! চাপা গর্জনে বলে–বড়দিরও আক্কেল দেখছি! কবে থেকে বাবাকে নিয়ে যাওয়ার কথা। সব যে যার স্বার্থ দেখছে। এই বুড়োর হ্যাপা যত আমাকেই সামলাতে হবে বরাবর? শরীর আমার বারো মাস খারাপ থাকে! স্বার্থপর, সব স্বার্থপর।
দ্রুত পায়ে বারান্দায় গিয়ে তিনি শচীলালের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন–কেন তোমার গুণধর ছেলে বাবাকে নিয়ে ক’দিন রাখতে পারে না? নাকি তাতে বউয়ের মাথা ধরার ব্যামো বাড়বে।
১০.
উঠোন কোমর পর্যন্ত গর্ত খুঁড়ে ফেলেছে মাগন। ঘামে জবজব করছে। পায়ে কাঁচের টুকরো ফুটেছে একটা। সেটা নখে টেনে তুলে ফেলল। কাটা জায়গাটা হাত দিয়ে ঘষে রক্ত লেপটে দিল।
–কী রে, দিন কাবার করবি নাকি?
–হচ্ছে বাবা, হচ্ছে। মাগন গর্ত থেকে উঠে এসে এক নম্বর ট্যাংকিতে বালতি নামিয়ে বলে –আভি দেখে লিন, সব সাফা।
রসিকবাবুর স্ত্রী ওপর থেকে এবং দত্তবাবু নীচে থেকে একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠেন–অনেক ময়লা রয়েছে এখনও!
মাগন হাসে। বলে–ময়লা তো আছে মালিক, কিন্তু উ তো সব শুখা মাল আছে। মালটা শক্তো হয়ে গেছে বড়বাবু, উঠবে নাহি।
–নাম ব্যাটা ট্যাংকে, নেমে কোদাল মেরে চেঁছে তোল। টাকা কি গাছে ফলে?
–হাঁ–হাঁ বাত তো ঠিক আছে বড়বাবু। লেকিন পাঁচ রুপেয়া বকশিশ দিয়ে দিবেন। চালিশ টাকার তো পাসিনা চলিয়ে যাচ্ছে। ভিটামিন দিবে কৌন?
মাগন ট্যাংকে নামে। গার্দা সব পাথরের মতো বসে গেছে। থকথক করছে পোকা, জল। বহোত গন্ধা। কোদালে ময়লা চাঁচতে–চাঁচতে মাগন আপনমনে বলে–কাম পুরা করে পয়সা লিব মালিক। বহোত গাদা বাবা, বহোত গন্ধা। সব গাদা সাফ থোড়াই হোবে বাবা। গার্দা কুছ জরুর থেকে যাবে মালিক! সব গাদা কখনও সাফা হয় না।