চিলেকোঠার সেপাই – ৪৭
ওসমানের ঘুমের আয়োজন করতে গিয়ে রাত্রে আনোয়ারের ঘুম হয় না। ওসমান যতোক্ষণ জেগে থাকে ততোক্ষণ তার কথাবার্তা কি চ্যাচামেচি চলে; ইঞ্জেকশন দিয়ে, ট্যাবলেট খাইয়ে তাকে ঘুম পাড়াতে হয়। তক্তপোষে ২ জনে কোনোভাবে থাকতে পারে বটে, কিন্তু ওসমান বড়ো ছড়িয়ে শোয়, আনোয়ার সারাটা রাত্রি প্রায় বসেই কাটায়। জুম্মনের আসার কোনো ঠিক নাই। পরশু একবার এসেছিলো, সারাটা দিন ওসমানের চ্যাচামেচি শুনলো খুব মনোযোগ দিয়ে, তারপর থেকে উধাও। সকালবেলা আনোয়ারের বড়ডো ঘুম পায়। ঘুমন্ত ওসমানের ঘরে তালা লাগিয়ে সে চলে যায় ওয়ারি। তখন সাড়ে ৭টা ৮টা হবে। ওদের বাড়ির বাইরে গেটের কাছে নালার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে রয়েছে করমালি।
করমালি? তুমি? আনোয়ার খুব অবাক হয়। সারারাতের ভোতা ধকলের পর এই বিস্ময় তাকে চাঙা করে তোলে।
আসসালামালেকুম। কেমন আছেন ভাইজান?
করমালির পায়ের ফোস্কাগুলো সব গলে গেছে, সেখানে এখন দগদগ করছে গোলাপি ঘা। করমালি নিশ্চয়ই পায়ের চিকিৎসা করতে এসেছে। আনোয়ারের ভালো লাগে। ওসমানকে সামলাতে সামলাতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন হলো শালার মার্শাল ল জারি হয়েছে। রাস্তায় বেরোলেই সেনাবাহিনীর অশিক্ষিত ও উদ্ধত জানোয়ারদের মুখ, ঘরে বসে এদের উদ্দেশে গালাগালি করা—আর ভালো লাগে না। অন্তত করমালিকে দেখে মনে হচ্ছে, এসব আর কাহাতক চলতে পারে? আনোয়ার গদগদ গলায় বলে, ‘তুমি কখন এসেছে?
করমালি ঢাকা পৌঁছেছে গতরাত্রে। রাত্রি কাটিয়েছে স্টেশনে। সকালবেলা বেরিয়ে ঘণ্টা দুয়েক ঘোরাঘুরি করে আনোয়ারদের বাড়ি খুঁজে পেয়েছে। ঠিকানা পেলো কোথায়?
করমালি, সারারাত স্টেশনে ছিলে? খুব কষ্ট হয়েছে, না?
কষ্ট হবে কেন? পাকা ঘর, মস্ত উঁচু ছাদ। শ’য়ে শ’য়ে লোক শুয়ে থাকে, ওরকম আরামের জায়গা করমালি চোখে দ্যাখেনি। এই বাড়িতে পৌঁছলে একটা কাজের লোক তাকে ধমক দিলে সে আনোয়ারের কথা বলে এবং গ্রামের পরিচয় দেয়। এরপর আনোয়ারের মা তার জন্যে নাশতা পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছে।
গ্রামের খবর কি? নাদু পরামাণিক কেমন আছে? নবেজউদ্দিন? বান্দু শেখ? করমালির বাপের শরীর কেমন? একটা প্রশ্নের পিঠে আরেকটা প্রশ্ন করে আনোয়ার, করমালি জবাব দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না।
জালাল মাস্টার সাহেবের খবর কি?
মাস্টার সায়েব ভাষণ দিয়া বেড়ায়। বৈরাগীর ভিটাত সপ্তায় সপ্তায় সভা হয়, জালাল মাস্টার আরম্ভ করলে আর কেউ ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পায় না। শুনে আনোয়ার হাসে। লোকটা কথা বলার চান্স পেলে থামতে চায় না। আজকাল সব বক্তৃতা আবার মাইকে হয়, জালাল মাস্টারকে আটকায় কে?
বৈরাগীর ভিটায় আজকাল খুব মিটিং হয়, না?
প্রায়ই। আফসার গাজী এদিক ওদিক বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছে। মার্শাল ল হওয়ার পর প্রথম দিকে চুপচাপ ছিলো, এখন ফের নতুন করে দ্বিগুণ বেগে শুরু হয়েছে।
আফসার গাজী বৈরাগীর ভিটায় আসে? মিটিং করে?
হ্যাঁ, বৈরাগীর ভিটা তো ধরতে গেলে তারই দখলে। তারই সভাত মাস্টার সায়েব লেকচার দেয়। আপনে পেপার পড়েন না? ঢাকার পেপারেও হামাগোরে ওটিকার সভার কথা ল্যাখে!
থাক, এসব অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ এখন বরং থাক। এখন করমালির পায়ের চিকিৎসাই প্রধান মনোযোগ লাভের যোগ্য।
করমালি, তোমাকে বোধহয় কিছুদিন থাকতে হবে। পায়ের যা অবস্থা মনে হয় সেরে উঠতে তোমার টাইম লাগবে।’
পাও হামার এমনি ভালো হয়া যাবো ভাইজান আগের চায়া কতো ভালো!
তবে করমালি ঢাকায় এসেছে কেন? কিন্তু জিগ্যেস করএত আনোয়ারের বাধোবাধো ঠেকে।
আপনার সাথে কথা আছে। আপনাক যাওয়া নাগবো।’
কোথায়?
হামাগোরে ওটি। সোগলি আপনাক যাবার কছে?
কেন?
করমালি এবার গ্রামের খবর জানায়। আফসার গাজী থানা পর্যায়ে বড়ো নেতা হতে চলেছে। মিটিঙে মিটিঙে তার চাচা খয়রার গাজীর নামে যা-তা বলে বেড়ায়, ওর চাচা হলো আইয়ুব খানের দালাল, বাঙালির শক্র। দালাল চাচার আধপোড়া বাড়ি ঘর দখল করার জন্যে আফসার হন্যে হয়ে উঠেছে। এদিকে এইসব কথা বলে, আবার বৈরাগীর ভিটায় গণআদালত বসিয়ে যারা এদের বিচার দাবী করেছিলো নানাভাবে তাদের সর্বনাশ করার চেষ্টা করছে। তার সঙ্গে সদাসর্বদা এক দঙ্গল কলেজের ছাত্র, তাদের খাওয়া দাওয়া সব তার বাড়িতে। গ্রামের লোক ভয়ে কাতর, এখন আনোয়ার গিয়ে যদি কিছু করতে পারে। ‘আপনে যদি গায়ের মানষের সাথে এ্যাঁনো কথাবার্তা কন, সাথে সাথে থাকেন তো আফসার গাজী এতো সাহস পায় না। গরিব গরবা চাষাভূষা মানুষ, মুরুখু মানুষ, বুঝলেন না? আপনে থাকলে হামরা হিরদয়ে বল পাই ভাইজান!
আলিবক্স কোথায়?
তাই তো হাজত খাটে। জেলই বুঝি হলো!
জেলে? কেন?
বগুড়া থাকা মিলিটারি অ্যাসা তাস ধর্যা নিয়া গেছে। মানুষ খুন করার মামলা দিছে। হোসেন আলি ফকিরকে মারা হলো না? হামার নামেও মামলা দিছে। হামি পলায়া বেড়াই। এখন আর ভয় করি না ভাইজান!
খুনের মামলার পলাতক আসামী তার ঘরে। আনোয়ারের সমস্ত শরীর দুলে ওঠে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বাইরের যাবতীয় দৃশ্য, ধ্বনি ও গন্ধ উত্তপ্ত হয়ে ভাপ ছাড়ে না, গ্রামে যাওয়াটা এখন অবশ্য কর্তব্য। এখানে থেকে তার লাভ কি? এইসব একঘেয়ে কালো পিচঢালা এবং এবড়োখেবড়ো খোয়া-ওঠা রাস্তা ও গলি, এইসব কালো থিকথিক-করা ড্রেন, ময়লা উপচে-পড়া ডাস্টবিন, রাস্তার ২পাশে উঁচু উঁচু দালান, এইসব ট্র্যাফিকজাম, রিকশা যেতে যেতে ট্রাকের গুতো খাওয়ার অবিরাম ভয়, তাদের বাড়ির মোটা মোটা দেওয়ালের ভেতর আম্মার অসুখী অসন্তষ্ট ও লোভী চেহারা, এইসব পথে ঘাটে রেস্টুরেন্টে বাখোয়াজি, ওসমানের উৎপাত,–নাঃ, আর কতো? গ্রামে আফসার গাজী কি করতে পারে যদি আনোয়ার একবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়? আলিবক্সকে ধরে নিয়ে গেছে।–তার কর্মীরা আছে, তাদের নিয়ে আনোয়ার কি রুখে দাঁড়াতে পারে না? পারবে না কেন?
যাবো! তোমার সঙ্গেই যাবো।
যাবেন? করমালির চাষাড়ে গলা আবেগে আটকে আসে, যাবেন ভাইজান? হামি গাওত খুব বড়ো গলা করা কয় আসছি, আনোয়ার ভাইজান আসবো। কালই না হয় মেলা করি!
যাত্রার দিন ধার্য করতে আনোয়ার ইতস্তত করে, না কাল নয়। তোমার চিকিৎসা চলুক। পা একটু সেরে না উঠলে কাজ করবে কি করে? আমারও একটু গুছিয়ে নেওয়া দরকার।
আলতাফের বড়োভাই মেডিক্যাল কলেজের এ্যাঁসোসিয়েট প্রফেসব। আলতাফকে দিয়ে ধরা হলো তাকে। মেডিক্যাল কলেজের আউটডোর কয়েকদিন চিকিৎসার পর করমালির পায়ের ঘা গোলাপি থেকে খয়েরি হয়, তাকে খুঁড়িয়ে হাটতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আগের চেয়ে তাড়াতাড়ি হাটতে পারে। এর মধ্যে আনোয়ারকে গ্রামে ফেরার জন্য তাগাদা দিতে শুরু করেছে। এতো তাড়াহুড়া করার আছেটা কি? গ্রামের চাষাভূষাদের এই ঘরমুখে স্বভাব আনোয়ার সহ্য করতে পারে না। এতো তাড়াতাড়ি গ্রামে গিয়ে তারা করবেটা কি? বৈশাখ পড়লো, করমালির বাড়িতে এখন খাবার কোথায়? অথচ দাখো, রাতদিন বাড়ি বাড়ি করে অস্থির। এদিকে দিনকে দিন ওসমানের অসুখ বেড়েই যাচ্ছে। ডাক্তার ভরসা দিয়েছিলো, গরম পড়তে শুরু করলে একটু কমবে। কোথায়? ওসমান একটু সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আনোয়ারকে অপেক্ষা করতেই হয়। করমালিকে একটা চাকরির সংস্থান করে দিতে পারলে সবদিক থেকে ভালো হতো। আনোয়ার অনেককে বলেও রেখেছে, বড়োভাইয়ের কোন বন্ধুর অফিসে একটা কাজ জুটে যেতে পারে। এই চাকরি পেলে ওর যাই—যাই ভাবটা কাটে। চাকরি না করে ওর উপায় কি? এই খোড়া পা দেখে ওকে জমি বর্গ দেবে কে? আবার ওসমানের ঘরে রাত্রে আজকাল করমালিই থাকে, ও থাকলে আনোয়ার বেশ নিশ্চিত। চাকরি পেলেও ও ওসমানের ঘরেই শোবে। আবার চাকরি পেলে খাওয়া দাওয়ার জন্য আনোয়ারের ওপরে নির্ভর করতে হবে না, এই গোয়ার গোবিন্দ মার্ক চাষা ছেলের অস্বস্তিটা তাহলে কাটে। আনোয়ার এসব বোঝে। সবচেয়ে বড় কথা, কয়েকদিন এখানে রেখে ওকে বেশ তৈরি করে নেওয়া যায়। শুধু সাহস থাকলে হয় না, সংগঠিত হতে হয়, রাজনীতি ভালো করে রপ্ত করা দরকার। একে দিয়ে তো ভোটের রাজনীতি করানো হচ্ছে না যে খালি হৈ হৈ করে বেড়ালেই চলবে। একে গড়ে তুলতে হবে, চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। আলিবক্সের সঙ্গে ছিল বটে, কিন্তু আলিবক্স এদের সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক চরিত্র অর্পণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিংবা আলিবক্স হয়তো চেষ্টাও করেনি। আনোয়ার করবে। করমালিকে ঢাকায় রেখে যদি সে যথার্থ রাজনৈতিক উপাদান হিসেবে তাকে মানুষ করতে পারে তো একটা কাজের মতো কাজ হয়।