আলিফ লাম মীম।
Alif-Lâm-Mîm. [These letters are one of the miracles of the Qur’ân and none but Allâh (Alone) knows their meanings].
الم
Alif-lam-meem
YUSUFALI: A.L.M.
PICKTHAL: Alif. Lam. Mim.
SHAKIR: Alif Lam Mim.
KHALIFA: A.L.M.
২৫। আলিফ্ লাম্ মিম্ -এই তিনটি অক্ষর সূরা বাকারা এবং আরও ৩, ২৯, ৩০, ৩১ এবং ৩২ এই সূরাগুলির (মোট সংখ্যা ৬) প্রারম্ভে স্থাপন করা হয়েছে। সূরা বাকারা এবং সূরা আল-ইমরানে একটা জাতির উত্থান-পতন, ভূত-ভবিষ্যত এবং তাদের সমগ্র ইতিহাস সম্বন্ধে বলা হয়েছে, আবার সেই সাথে নূতন জাগ্রত জাতি মুসলমানদের সামাজিক রীতিনীতি সম্বন্ধেও বলা হয়েছে। সূরা ২৯ এ ঠিক একইরকম যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। তবে এখানে জাতি হিসেবে না বলে প্রতিটি আত্মার জীবন-মৃত্যু, জয়-পরাজয়, অতীত-বর্তমান অর্থাৎ এই পৃথিবীতে মানব-আত্মার অস্তিত্বের পূর্ণ ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা ৩০ আমাদের বলে, আল্লাহ্ সকল শক্তির উৎস। সব কিছু তাঁর থেকে উৎপত্তি আবার তাঁর কাছেই সবকিছু ফিরে যাবে। সূরা ৩১ ও ৩২ শে ঐ কথাকেই পুনরায় সঞ্জিবীত করা হয়েছে।
নূতনভাবে, নূতন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে যে, এক আল্লাহ্ই হচ্ছেন সবকিছুর স্রষ্টা এবং একমাত্র তিনিই শেষ বিচারের মালিক। সূতরাং সে সব সূরা আলিফ্, লাম্, মিম্ এই তিন অক্ষর দ্বারা শুরু হয়েছে তাদের সবার মধ্যেই অন্তর্নিহিত ভাব এক। আর তা হচ্ছে জীবন ও মৃত্যুর রহস্য, সৃষ্টির আরম্ভ ও শেষের রহস্য এবং সব রহস্যের সমাধান এক স্রষ্টার কাছে বিদ্যমান। তিনিই প্রথম এবং তিনিই শেষ। এই অক্ষর তিনটি সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে, অনেক আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এর সবটাই অনুমান নির্ভর। প্রকৃত অর্থ জানেন একমাত্র আল্লাহ্। অনেকে মনে করেন এই অক্ষরগুলি প্রতীকধর্মী। সুতরাং এ সম্বন্ধে যুক্তি তর্কের অবকাশ নাই।
——————————–
সূরা বাকারা – ২
২৮৬ আয়াত, ৪০ রুকু, মাদানী
[দয়াময়,পরম করুণাময় আল্লাহ্র নামে]
ভূমিকা : প্রারম্ভিক সূরা ফাতেহায় ৭টি আয়াতকে কোরআন শরীফের সার সংক্ষেপ বলা যায়, ঠিক সে রকম এই সূরায় ২৮৬টি আয়াতে সমগ্র কোরআন শরীফের শিক্ষাকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
সার সংক্ষেপ : এই সূরায় –
১-২৯ আয়াতে গূঢ় অর্থসম্পন্ন উপদেশাবলীর মাধ্যমে তিন রকম লোকের কথা বলা হয়েছে এবং কিভাবে এই তিন শ্রেণীর লোক আল্লাহ্র উপদেশাবলী গ্রহণ করে সে সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। যারা আল্লাহ্র কাছে হেদায়েত প্রার্থনা করে অবশ্যই আল্লাহ্র বাণী তাদের পথ প্রদর্শন করে। যারা তাঁর বাণী প্রত্যাখ্যান করে তারা চক্ষুষ্মান হয়েও অন্ধ। তাদের আত্মায় সীল-মোহর দেয়া। মুনাফিকদের জন্য করুণা, কারণ তারা নিজেরাও প্রতারিত এবং অন্যকেও প্রতারিত করতে সর্বদা থাকে সচেষ্ট। সুন্দর উপমার সাহায্যে এই কথাটি প্রকাশ করা হয়েছে। বৃষ্টি ফসলের জমিকে ফুল-ফল-ফসলে ভরিয়ে তোলে। আবার সেই বৃষ্টিই আগাছায় ভর্তি জমিতে কাঁটাগাছের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সেরূপ বিশ্বাসী বা ঈমানদার লোকের জন্য আল্লাহ্র বাণী, তার ঈমানের ভীত আরও মজবুত করে, আবার সেই একই বাণী অবিশ্বাসীদের হৃদয়ের ব্যাধি বৃদ্ধি করে।
আয়াত ৩০-৩৯ এ বলা হয়েছে মানুষের সৃষ্টি সম্বন্ধে, বলা হয়েছে সৃষ্ট জগতে তার উচ্চে অধিষ্ঠান, তার পতন, পৃথিবীতে বিবর্তণের ধারায় তার পথ চলার নির্দেশ সম্বন্ধে।
আয়াত ৪০-৮৬ এ বলা হয়েছে ইসরাইলীদের সম্পর্কে। তাদের কিতাব, তাদের ঐতিহ্য, আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামত এবং কিভাবে তারা আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়েছিলো, উপমা ও সাধারণ কাহিনীর মাধ্যমে তা বর্ণনা করা হয়েছে।
আয়াত ৮৭-১২১ হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ) এর সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিভাবে তাঁরা অবাধ্য ও অবিশ্বাসী জনতার সাথে সংগ্রাম করেছিলেন। কিভাবে ঐশী কিতাব প্রাপ্ত লোকেরা তাদের নিজেদের কিতাবের বাণী অস্বীকার করেছিলো। কিভাবে তারা অহংকারের স্ফীত হয়ে হযরত মুহম্মদ (দঃ) কে অস্বীকার করেছিলো; যদিও তারা জানতো যে নবুয়তের ধারাবাহিকতায় তিনিই শেষ নবী।
আয়াত ১২২-১৪১। পিতা ইব্রাহীম (আঃ) এর সম্বন্ধে এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম একজন সতিক্যারের পূণ্যবান ইমাম ছিলেন। তিনি আরবে জন্ম গ্রহণকারী হযরত ইসমাঈলের বংশের পূর্বপুরুষ। আবার ইসরাইল সম্প্রদায়েরও পূর্বপুরুষ ছিলেন তিনি। তিনিই হযরত ইসমাঈল সহযোগে কাবা শরীফ নির্মাণ করেন এবং পরিশুদ্ধ করেন। এভাবেই তিনি সকলের জন্য একই ধর্মের অবতারণা করেন। আর তাঁর এই ধর্মের বিশ্বনন্দিত রূপই হচ্ছে ইসলাম।
আয়াত ১৪২-১৬৭। কা’বা শরীফ এখন বিশ্ব মানবের এবাদতের স্থান এবং বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতীক।
আয়াত ১৬৮-২৪২। এভাবেই বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা যার এক নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দু ও প্রতীক আছে – আর তা হচ্ছে কা’বা শরীফ। সারা মুসলিম জাহানের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম কানুনের প্রবর্তন করা হয়েছে। তাদের সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন সম্পর্কে নিয়ম-নীতি নির্দেশ দান করা হয়েছে। একথা দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে কোন ধর্ম নাই, কোনও পূণ্য নাই। পূণ্য আছে এক স্রষ্টায় বিশ্বাসে, জীবে দয়ায়, প্রার্থনায়, দানে এবং দুঃখ দুর্দশায় ধৈর্য্য ধারণের মধ্যে। সামাজিক জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে যেমন-খাদ্য, পানীয়, উপবাস, বিষয়-সম্পত্তির বন্টন, জিহাদ, মদ, জুয়া, এতিম এবং মেয়েদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কীয় নিয়ম কানুন ইত্যাদি সম্পর্কে নির্দেশ দান করা হয়েছে।
আয়াত ২৪৩-২৫৩। জিহাদকে যেনো ভুল বোঝা না হয়। জিহাদের প্রকৃতরূপকে বোঝানোর জন্য তালুত, গোলিয়াথ ডেভিডের ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছে। যুগে-যুগে, কালে-কালে নবী রাসূলদের পৃথিবীকে প্রেরণ করা হয়েছে মিথ্যার বিরুদ্ধে জেহাদ এবং সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য।
আয়াত ২৫৪-২৮৩। এই আয়াতসমূহে বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে সত্যিকারের গুণাবলী বা ধর্মাচারণ মুখের কথা নয়। সত্যিকারের ধর্ম নির্ভর করে-দয়া, মায়া, মহত্ব, স্রষ্টার প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি ও ভালোবাসার মধ্যে।
আয়াত ২৫৫। এই আয়াতটিতে আল্লাহ্র প্রকৃতি সম্বন্ধে বলা হয়েছে। আয়াতটিকে বলা হয় “আয়তাল কুরশী”। অর্থাৎ তিনি সেই বিশ্ব প্রতিপালক যার আসন ভূলোকে, দ্যুলোকে, সর্বত্র। যার উপস্থিতি বিশ্বব্যাপী।
আয়াত ২৮৪-২৮৬। এই সূরা শেষ করা হয়েছে এক স্রষ্টায় বিশ্বাস (Faith), তাঁর প্রতি আনুগত্য এবং ধর্মের ব্যাপারে ব্যক্তিগত দায় দায়িত্বের উপরে গুরুত্ব আরোপ করে।
কুরআন শরীফে সূরা বাকারা হচ্ছে সর্ববৃহৎ সূরা। ২৮২ নম্বর আয়াতটি হচ্ছে কুরআন শরীফের সর্ববৃহৎ আয়াত যা এই সূরাতে বিদ্যমান। আয়াত ৬৭-৭১ এ দেয়া উপমা অনুসারে গাভী নাম দেয়া হয়েছে। এই উপমায় দেখানো হয়েছে, যখন বিশ্বাসের ভিত থাকে দুর্বল, তখন আনুগত্য প্রকাশ করা হয় কষ্টসাধ্য। যখন বিশ্বাসের ভিতে চির ধরে মানুষ নানা অজুহাতে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। এমন কি যদিও তারা আক্ষরিক অর্থে, আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে স্রষ্টাকে মান্য করতে চেষ্টা করে কিন্তু তা হয় সম্পূর্ণ বাহ্যিক। যে বিশ্বাস, যে আনুগত্য আত্মার অন্তস্থল থেকে উৎসারিত নয় তা স্রষ্টার কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। এসব লোকেরা নিজেদের ধার্মিক বলে প্রচার করলেও এরা আত্মিক দিক থেকে মৃত। এদের আত্মা মমিতে পরিণত হয়ে যায়। তাদের আত্মম্ভরিতা, স্বার্থপরতা, স্বনির্ভরশীলতা তাদের করে তোলে অহংকারী। ফলে তারা বুঝতে অপারগ যে আত্মিক দিক থেকে তারা মৃত। কারণ স্রষ্টার যে করুণা যা বিশ্বজগতকে বেষ্টন করে আছে, যে অমিয়ধারাতে সারা সৃষ্টি অবগাহন করে ধন্য তারা তা বুঝতে অসমর্থ। স্রষ্টার অস্তিত্ব তারা অনুভব করতে অসমর্থ। জীবন বহমান-গতিশীল, কর্মচঞ্চল। হীন, নীচ, কর্দমাক্ত জীবন থেকে উর্ধ্বলোকে আরোহণের চেষ্টাই হচ্ছে জীবনের উদ্দেশ্য। এটাই হচ্ছে এই সূরার মূল ধারা। এ সূরা মদিনায় নাজেল হওয়া সূরাগুলির মধ্যে প্রধান সূরা।