৯-১১. ব্রেকফার্স্ট টেবিলে

০৯.

পরদিন ব্রেকফার্স্ট টেবিলে পাউরুটিতে মাখন মাখাতে মাখাতে মিতিন বলল, টুপুর, আজ দুপুরে তোকে আমার সঙ্গে বেরোতে হবে।

টুপুরের হৃৎপিণ্ড ছলাত করে উঠল, কোথায় যাব গো?

উত্তেজিত হোস না। গেলেই দেখতে পাবি।

 আবার কি বাসন্তী যাব আমরা?

না।

ব্যস, মিতিনের মুখে আর বাক্যিটি নেই। কচরকচর বাটার টোস্ট চিবিয়ে চায়ের কাপ হাতে সোজা বসার জায়গায়। অনিশ্চয় মজুমদারকে ধরেছে ফোনে। বারবার অনুরোধ করল, অনিশ্চয় যেন স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে অতি সত্বর ময়নাতদন্তের রিপোর্টটা সংগ্রহ করেন। সম্ভব হলে আজই। কথা শেষ করে রিসিভার নামিয়ে আঙুল বাজাচ্ছে টেবিলে। এই মুদ্রাটা টুপুরের চেনা। কোনও সিদ্ধান্ত নিতে দোলাচল থাকলে মিতিনমাসি এভাবেই টেবিলে আঙুল ঠুকে তবলা বাজায়।

আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে মিতিন বলল, না, থাক।

পার্থ বড় সোফায় বসে শব্দজব্দ করছিল। খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলেই প্রশ্ন করল, কী থাকবে?

বাসন্তী থানায় একটা ফোন করব কিনা ভাবছিলাম।

 টুপুর জিজ্ঞেস করল, তাদের সঙ্গে আবার কী দরকার?

ওসিকে বললে হত রতন হেনরি মণ্ডলকে একটা মেসেজ দিতে।

কী জানাবে?

যেন সে অতি অবশ্যই আমাকে আজ একবার ফোন করে। এখন অবশ্য মনে হচ্ছে তার আর প্রয়োজন নেই।

রতনকে মিতিনমাসির কী কাজে লাগতে পারে, ভেবে পেল না টুপুর। সত্যি, মাসির চিন্তার গতিপ্রকৃতি খুঁজে পাওয়া ভার। কাল রাতে হ্যারি পটার দেখতে দেখতে হঠাৎ ফোন লাগাল বাবাকে। তখনই দেবেশকাকুর টেলিফোন নম্বর চাই।

কথাও বলল দেবেশকাকুর সঙ্গে। ওই রাত পৌনে বারোটায়। দুজনে কী যে বাক্যালাপ হল কে জানে, ফোন রেখে দিয়ে মিতিনমাসির মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল। যাক গে, অত সাতপাঁচ ভেবে লাভ কী, মিতিনমাসি আজ অভিযানে টুপুরকে সঙ্গে নিচ্ছে এই না ঢের!

স্নান-খাওয়া সেরে কাঠফাটা দুপুরে বেরিয়ে পড়ল টুপুর আর মিতিন। সূর্য খাড়া মাথার উপর, চাঁদি ফেটে যাচ্ছে তাপে, মিতিনের এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই। আশমানি রং সালোয়ার কামিজ পরেছে, কাঁধে পেটমোটা ভ্যানিটি ব্যাগ, চোখে সানগ্লাস, মাথায় ছাতা। হাঁটছে গটগট।

ঢাকুরিয়া স্টেশনে এসে টুপুরকে দাঁড় করিয়ে রেখে দুখানা ট্রেনের টিকিট কেটে আনল মিতিন। ক্যানিং লোকাল ছেড়ে দিয়ে চড়ল ডায়মন্ডহারবারগামী গাড়িতে। হালকা হালকা ভিড়ের কামরায়।

ট্রেনে উঠে টুপুর ফের জিজ্ঞেস করল, এবার কি জানতে পারি আমরা কোথায় যাচ্ছি?

মল্লিকপুর।

নিশ্চয়ই ডক্টর সান্যালদের বাড়িতে?

 হ্যাঁ।

ওখানে কাকে পাবে?

দেখা যাক।

বিকেল বিকেল বেরোলে ভাল হত না? রোদ পড়ার পর?

 না। একদমই দেরি করা চলবে না। পাখি উড়ে যেতে পারে।

কে পাখি? কী পাখি?

ধীরে, বৎস, ধীরে, সময়কালে সব জানতে পারবে।

মিতিনের ঠোঁটে ফের তালাচাবি। ঢাকুরিয়া থেকে মল্লিকপুর মিনিটপঁচিশেকের পথ। সারাক্ষণ ট্রেনের বাইরে মেলে আছে চোখ। মল্লিকপুরে নেমে স্টেশন চত্বরের বাইরে এল। রিকশাস্ট্যান্ডে।

ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে স্ট্যান্ড প্রায় ফাঁকা। একটা মাত্র রিকশায় হুড তুলে সিটে বসে চুলছে এক বৃদ্ধ।

মিতিন সামনে এসে গলাখাঁকারি দিল, ও দাদা? যাবেন তো?

লোকটা ধড়মড় করে জেগেছে। চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলল, কোথায় যাবেন?

তেঁতুলতলা।

তেঁতুলতলা? ও নামে তো কোনও জায়গা নেই।

তেঁতুলগাছি?

 না, তেঁতুলিয়ার মোড় একটা আছে। অনেক দূর। আট টাকা ভাড়া।

চলুন। মনে হচ্ছে তেঁতুলিয়াই হবে।

স্টেশনবাজার ছেড়ে এগোল রিকশা। বড় রাস্তা ছেড়ে ঘুরল ডান দিকে। এঁকেবেঁকে এপাড়া ওপাড়া পেরিয়ে পাক্কা বারো মিনিট পর এক তেমাথার মোড়ে এসে থেমেছে।

ভাড়া মিটিয়ে এপাশ ওপাশ দেখল মিতিন। দোকানপাট আছে বটে, তবে গ্রীষ্মের দুপুরে সবই বন্ধ। একটা মাত্র চায়ের দোকানই যা খোলা। আধখানা ঝাঁপ ফেলে, উনুন নিভিয়ে, ভিতরের বেঞ্চিতে ঘুমাচ্ছে এক মাঝবয়সি মানুষ। মিতিন একটু ভাবল। তারপর নিচু হয়ে ঢুকল দোকানটায়।

ডাকল, ও মশাই? শুনছেন?

উঁ? বেজার মুখে চোখ খুলল লোকটা।

এখানে সান্যালদের বাড়ি কোথায় বলতে পারেন?

 কোন সান্যাল?

ওই যে লম্বামভো… দুভাই.. একজন বিজ্ঞানী, বিদেশে থাকতেন…

বুঝেছি। সোনাদা-রুপোদাদের বাড়ি। লোকটা গামছায় ঘাড় গলা মুছতে মুছতে উঠে বসেছে, আপনারা বুঝি সোনাদার কাছে এসেছেন?

হ্যাঁ মানে …, মিতিন চোখ থেকে সানগ্লাস খুলল, মানে একটা দরকার ছিল।

দেখা হবে কি? সোনাদা তো এখন শয্যাশায়ী।

কী হয়েছে?

বেশি নেশাটেসা করলে যা হয়। …শুনলাম তো, দিনকয়েক হল আর উঠতে নড়তেও পারছে না। কলকাতার এক বন্ধু এসে দেখাশোনা করছে। প্রায় রোজই তো ডাক্তার আসতে দেখি, আড়মোড়া ভেঙে কথাগুলো বলতে বলতে লোকটা হঠাৎ সচকিত। চোখ সরু করে একবার মিতিনকে দেখল, একবার টুপুরকে। সতর্ক গলায় বলল, কিন্তু আপনারা কে? সোনাদার আত্মীয়?

 মিতিন ঝটিতি বলে উঠল, আমি … ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যাল, মানে আপনাদের রুপোদার আন্ডারে কাজ করি। গবেষণা। উনি আমার হাত দিয়ে ভাইকে কিছু টাকা পাঠিয়েছেন।

ও, বুঝেছি। চিকিৎসার জন্য। তা রুপোদা এবার নিজে এল না কেন? ভাইয়ের অবস্থাটা স্বচক্ষে দেখে যেত।

কাজেকর্মে খুব ব্যস্ত। আমি কাছেই থাকি। সোনারপুরে। তাই…।

কাগজে তো রুপোদাকে নিয়ে খুব শোরগোল পড়েছিল দেখলাম। তিন-চার দিনের জন্য কোথায় যেন চলে গিয়েছিল রুপোদা…

উনি একটু কাজে গিয়েছিলেন। কাগজওয়ালারা বাড়িয়ে লিখেছিল।

আমরাও তো এখানে সেই আলোচনাই করছিলাম। খেয়েদেয়ে কাজ নেই, রুপোদার মতো ঠান্ডা মাথার মানুষ হঠাৎ কাজ ফেলে নিরুদ্দেশে যাবে!

তা আপনাদের সোনাদার বাড়িটা…?

সামনের গলি ধরে সোজ ঢুকে যান। ডাইনে প্রথম যে পুকুর পড়বে, তার পিছনে উঁচু পাঁচিলওয়ালা দোতলা বাড়ি।

ভাঙাভাঙা ইট ফেলা এবড়োখেবড়ো রাস্তা। টুপুর হাঁটতে হাঁটতে বলল, এটা কী রকম হল মিতিনমাসি? ডক্টর সান্যাল আমাদের মিথ্যে বললেন? ওঁর ভাই বাঙ্গালোরে যায়নি?

তাই তো দেখা যাচ্ছে।

আমার মনে হয়, পুলিশ বা মিডিয়ার কাছে নেশাখোর ভাইয়ের কথা বলতে চাননি। চাপা দেওয়ার জন্য বাঙ্গালোর টাঙ্গালোর বলে….

চটজলদি কোনও সিদ্ধান্তে আসিস না। এখন তাড়াতাড়ি চল।

গন্তব্যস্থলে পৌঁছোতে মিনিটতিনেক লাগল। চায়ের দোকানের লোকটা যাকে পুকুর বলেছিল, আদতে সেটা পানা বোঝাই এক এঁদো ডোবা। সান্যালবাড়িটিও অতি প্রাচীন। দশা অকহতব্য। প্লাস্টারটাস্টার তো কবেই খসে গিয়েছে, দেওয়ালে শ্যাওলার কালচে ছোপ, ছাদের আলসেতে শিকড় ছড়িয়েছে বট-অশ্বথের চারা। বাড়িটা কি ক্লাইভের আমলে তৈরি?

ভারী গেট ঠেলে মিতিন আর টুপুর ভিতরে এল। চারপাশের ফাঁকা জমিতে ঘাস-আগাছার জঙ্গল। নিৰ্ঘাত কস্মিনকালে পরিষ্কার করা হয় না। বাড়ি ঘিরে গোটাচারেক বড় গাছ এলোমেলো দাঁড়িয়ে। আম, কাঁঠাল, নিম। ঝাঁকড়া গাছগুলোর দৌলতে জায়গাটা বেশ ঠান্ডাঠান্ডা। ছায়া মাখা।

তিন ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে লাল মেঝের টানা বারান্দা! আট ফাটা। ধুলোয় ভরা। দুধারে দুখানা রোয়াকও আছে। লাল রঙেরই। ভাঙাভাঙা। বারান্দার মাঝামাঝি বাড়ির সদর দরজা। বন্ধ। খড়খড়িওয়ালা লম্বা লম্বা জানলাগুলোও খোলা নেই একটাও। না একতলায়, না দোতলায়।

মোটা কাঠের ধূসর দরজাখানার পাশে ডোরবেল খুঁজছিল মিতিন। আচমকাই খুলে গিয়েছে পাল্লা। দরজা জুড়ে দশাসই চেহারার এক লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। প্রায় ছফুটের কাছাকাছি লম্বা, একমাথা কোঁকড়া চুল, ধ্যাবড়া নাক, গায়ের রং আলকাতরাকেও লজ্জা দেয়। বয়স বছর পঁয়ত্রিশ।

ভারিক্কি স্বরে লোকটা বলল, কী চাই?

মিতিন ঠান্ডা গলায় বলল, আমরা সুধন্য সান্যালের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

সুধন্য ঘুমোচ্ছ। ওর শরীর ভাল নেই।

কী হয়েছে সুধন্যবাবুর?

বললাম তো, অসুস্থ।

কী অসুখ?

লোকটার দৃষ্টি রুক্ষ হল। নিরীক্ষণ করছে মিতিন-টুপুরকে। গলা আরও ভারী করে বলল, কোত্থেকে আসছেন বলুন তো?

বাসন্তী। ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যাল পাঠিয়েছেন।

মুহূর্তের জন্য যেন চমকাল লোকটা। কোনও একটা ধন্দেও পড়েছে মনে হল। পরক্ষণেই অবশ্য সামলে নিয়েছে নিজেকে। গলা ঝেড়ে বলল, দেখা করার অনুমতি নেই। ডাক্তারবাবুর বারণ।

আমরা ওঁকে ডিস্টার্ব করব না। জাস্ট দেখা করেই চলে যাব।

আঃ, কেন ঘ্যানর ঘ্যানর করছেন? বলছি তো হবে না। আপনারা আসুন।

বলেই লোকটা মুখের উপর দম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

টুপুর রাগরাগ মুখে বলল, আচ্ছা বেয়াদব লোক তো?

মিতিনের ঠোঁটে চোরা হাসি, চল, ফিরি। আমার যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। এবার আসল কাজে নামব।

দ্রুত পায়ে মোড়ে এসে টুপুররা দেখল, সবেধন নীলমণি সেই রিকশা এখনও দাঁড়িয়ে। উঠে সিটে বসতেই চা-দোকানের লোকটা বেরিয়ে এসেছে, কেমন দেখলেন সোনাদাকে?

মিতিন মুখটাকে করুণ করে বলল, ভাল নয়।

রুপোদাকে বলুন না, ভাইকে বাড়িতে ফেলে না রেখে ভাল হাসপাতালে দিয়ে দিক। অপোগণ্ড ভাইটার জন্য এত কিছু করেন, নয় এই দায়টুকুও নিলেন।

বলব।

মিতিনমাসির ব্যাপারস্যাপার আচার-আচরণ সব কেমন হেঁয়ালির মতো লাগছিল টুপুরের। তবে একটা জটিল কোনও ধাঁধা যে চলছে, তাতে কোনও দ্বিমত নেই। এবং তার সমাধানটাও মিতিনমাসি পেয়ে গিয়েছে।

স্টেশনে পৌঁছেও টুপুর এতাল-বেতাল ভাবছিল। ট্রেন আসতে দেরি হচ্ছে, প্ল্যাটফর্মের শেডের নীচে দাঁড়িয়ে আছে মিতিনমাসির সঙ্গে। এই তাতেপোড়া দুপুরেও ট্রেনযাত্রীর কমতি নেই, অনেকেই অপেক্ষা করছে ট্রেনের।

টুপুরের একটু তেষ্টা তেষ্টা পাচ্ছিল। এদিক-ওদিক কোনও ডাবওয়ালা আছে কিনা দেখতে গিয়ে হঠাৎই দৃষ্টি স্থির। প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্তে কে ও? ইতিউতি তাকায়? সান্যালবাড়ির সেই অভদ্ৰ লোকটা না? পলকের জন্য দর্শন দিয়েই সাঁত করে সরে গেল কোথায়! কোনও দোকানের আড়ালে ঘাপটি মারল কি?

মিতিনমাসির হাত চেপে ধরেছে টুপুর। অস্ফুটে বলল, ওদিকে দ্যাখো?

চোখে সানগ্লাস চড়ানো মিতিনের স্বর নির্বিকার, দেখেছি। আর ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাস না।

লোকটা কি আমাদের ফলো করে এল?

রোদ্দুরে নিশ্চয়ই বেড়াতে বেরোয়নি!

টুপুরের মুখে আর কথা ফুটছে না। ভিতরটা উত্তেজনায় টগবগ করছে। ষণ্ডামাকা লোকটার কী মতলব আছে রে বাবা? নীলাম্বর যদি সত্যিই খুন হয়ে থাকে, আর মল্লিকপুরের সান্যালবাড়ির সঙ্গে তার কোনও যোগসূত্র থাকে, তাহলে তো আরও সাবধান হওয়া উচিত মিতিনমাসির।

ট্রেন ঢুকছে। কামরায় ওঠার আগে তাকাব না তাকার না করেও টুপুরের চোখ ঘুরে গেল। সৰ্বনাশ, যা ভেবেছে তাই! লোকটা বেরিয়ে এসেছে আড়াল থেকে! ট্রেনে চড়তে গিয়েও কী ভেবে যেন উঠল না। দাঁড়িয়ে গিয়েছে দরজার সামনে। যাক নিশ্চিন্ত, এখনই এখনই তা হলে বিপদের আশঙ্কা নেই।

পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই মিতিনমাসি হাত ধরে টানল, নেমে পড়।

কেন?

 আবার মল্লিকপুরে ফিরব।

.

১০.

আবার সেই এঁদো ডোবা। আবার সেই ভারী গেট। আবার সেই জরাজীর্ণ সান্যালবাড়ি। সময়টাই শুধু দুপুর থেকে বিকেলের দিকে গড়িয়েছে, এই যা। উহুঁ, আরও একটা তফাত হয়েছে। একখানা মোটরবাইক দাঁড়িয়ে বাড়িটার ভিতরে। আমগাছতলায়।

এবার আর বারান্দায় উঠে ডোরবেল খুঁজল না মিতিন। গুমগুম ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়।

একতলার একটা জানলার খড়খড়ি ফাঁক হল। চেনা রুক্ষ গলা, কে?

আমরা। তখন এসেছিলাম।

আবার কী হল?

সুধন্যবাবুকে একটা জিনিস দেওয়ার ছিল।

দাঁড়ান। আসছি।

মিনিটদুয়েক পর দরজা খুলল। এখন আর লুঙ্গি-পাঞ্জাবি নয়, লোকটার পরনে ট্রাউজার আর টি-শার্ট। স্টেশন থেকে ফিরে এখনও পোশাক বদলায়নি। দুহাতে দরজা আগলে দাঁড়িয়েছে লোকটা। কর্কশ গলায় বলল, কী, দেবেনটা কী? বারবার এসে বিরক্ত করছেন কেন?

দাড়ান না একটু, দিচ্ছি। মিতিন ধীরেসুস্থে ভ্যানিটি ব্যাগের চেন খুলল। এবং তারপরই যে বস্তুটি বের করল, তার জন্য লোকটা কণামাত্র প্রস্তুত ছিল না। টুপুরও নয়।

আস্ত একখানা রিভলভার!

সেকেন্ডের মধ্যে সেফটি ক্যাচ খুলে মিতিন রিভলভারের নল ঢুকিয়ে দিয়েছে লোকটার নাকের ফুটোয়। তীক্ষ্ণ স্বরে হিসহিসিয়ে উঠল, এক চুল নড়লে গুলি চালিয়ে দেব।

আতঙ্কে চোখ প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে এল লোকটার। ঘড়ঘড় করছে গলা। ঘামছে দরদর।

রিভলভার দিয়েই লোকটাকে ঠেলল মিতিন, চলুন, ভিতরে চলুন। উহুঁ, ঘোরার চেষ্টা নয়। পিছন দিকেই হাঁটুন।

অগোছালো বসার ঘরের মাঝখানে এসে মিতিন পলকে চোখ বুলিয়ে নিল চারদিকে। জিজ্ঞেস করল, টেলিফোন কোথায়?

কাঁপতে কাঁপতে লোকটা বলল, দো-দো-দো-দোতলায়।

 টুপুর, আমার ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের কর তো।

মিতিনমাসির দাপট দেখে টুপুরের বুকেও বল এসে গিয়েছে সহসা। দ্রুত খুদে যন্ত্ৰখানা তুলে নিয়ে এগিয়ে দিয়েছে।

ওই এগিয়ে দেওয়া আর মিতিনের ঝলক ঘুরে তাকানো — দুইয়ের মধ্যে যেটুকু সময়, তার ফাঁকেই লোকটা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে মিতিনকে। হিংস্র বুনো ভল্লুকের মতো হাঁ হাঁ করে ধেয়ে এল সঙ্গেসঙ্গে।

পর মুহুর্তেই যা ঘটল, টুপুর জীবনেও ভুলবে না। কাঁধের ওড়না ফেলে দিয়ে ভল্ট খেয়ে উঠে দাঁড়াল মিতিনমাসি। বিদ্যুৎবেগে সরে সরে গেল খানিকটা। তারপর বিকট চিৎকার হেনে জোর এক লাফ। এবং লোকটার বুকে সপাটে জোড়া পায়ের লাথি। কী সাংঘাতিক জোর ওই পদাঘাতের, বাস! কাটা কলাগাছের মতো লোকটা ধরাশায়ী!

ত্বরিত গতিতে লোকটার বুকে হাঁটু চেপে মিতিনের রিভলভার এবার লোকটার রগে, কী, ট্রিগার টিপব?

লোকটা অসহায়ভাবে মাথা ঝাঁকাল, আমি কিছু জানি না। আমায় ছেড়ে দিন।

 কোনও চালাকি নয়। উঠে বসুন। ফোনে বাসন্তীতে কথা বলুন এখনই। আপনার বসের সঙ্গে।

কে কে কে..কে বস?

 ন্যাক সাজা হচ্ছে? যা যা বলছি, অবিকল সেই কথাগুলো বলবেন। একটা শব্দ এদিক-ওদিক হলে কিন্তু নীলাম্বরের চেয়েও বিচ্ছিরিভাবে মরতে হবে। আমি কিন্তু ঘিলু ছেতরে দেব।

কী কী কী কী বলব? লোকটা কাঁপছে।

বলছি। মন দিয়ে শুনুন। … বলবেন, হাওয়া খুব গরম। মেয়ে টিকটিকিটা সব আঁচ করে ফেলেছে। মাল আর এখানে রাখা সম্ভব নয়, আজই পাচার করা দরকার। আপনি যে করে হোক এখনই চলে আসুন। আমি আর-একবার বাইকে চেপে বাইরের হাওয়া দেখে আসছি। তেমন বুঝলে আপনাকে আবার ফোন করব।

অ্যা অ্যা অ্যা অ্যাত কথা …?

হ্যাঁ। গলা যেন একটুও না কাঁপে। বলতে পারলে নীলাম্বর হত্যায় রাজসাক্ষী হওয়ার সুযোগ মিলতে পারে। না পারলে আজই জীবনের ইতি। বলেই মিতিন ঘুরেছে টুপুরের দিকে, মোবাইলে সুমন্ত্ৰ সান্যালের নম্বরটা ধরতো। প্রথমে বাসন্তীর এস টি ডি কোড। জিরো থ্রি টু ওয়ান এইট থ্রি টু …

রিং বাজতেই টুপুর মোবাইল চেপেছে লোকটার কানে। বীরদর্পে বলল, নিন, কথা বলুন।

লোকটা কোনওক্রমে আওড়াচ্ছে শেখানো বাক্যগুলো। ওপারের মানুষটার স্বর চড়ছে ক্ৰমশ। প্রায় নিঃশব্দ ঘরে তার সংলাপও স্পষ্ট শোনা যায়। ডক্টর সান্যালের মতো সৌম্য শান্ত ভদ্রলোকের মুখে এ কী ভাষা? .. শয়তান মেয়ে টিকটিকিটাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের তলায় ফেলে দিসনি কেন? দাঁড়া, আজকের ঝামেলা মিটুক, ডিটেকটিভকেও আমি নীলাম্বর আর ডোবারম্যানটার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি! আসছি আমি। যত তাড়াতাড়ি পারি পৌঁছোচ্ছি।

মোবাইলের সুইচ অ করে দিল টুপুর।

মিতিন কড়া গলায় বলল, এবার উঠে দাঁড়ান। কোনও বেগড়াই না করে দোতলায় চলুন। যেখানে টেলিফোন আছে, সেখানে বসে থাকবেন চুপটি করে। আর আপনার বসের ফোন এলে ধরবেন।

লোকটা বুঝে গিয়েছে আর তার রক্ষা নেই। অগত্যা বেজার মুখে যন্ত্রচালিত রোবটের মতো উঠল সিঁড়ি বেয়ে। মিতিন অবশ্য রিভলভার ঠেকিয়ে রেখেছে তার শিরদাঁড়ায়। দোতলার বড় প্যাসেজে খানতিনেক ছেঁড়াখোঁড়া সোফা, মাঝে কাচের টেবিল। টেলিফোন টেবিলেই শোভা পাচ্ছিল। পপ করে সোফায় শরীর ছেড়ে দিল লোকটা হাঁপাচ্ছে।

রিভলভার উঁচিয়ে রেখে মিতিন বাঁকা সুরে জিজ্ঞেস করল, এবার বলুন, আপনাদের মালটা কোথায় রাখা আছে?

লোকটার গলায় আর স্বর নেই। চোখের ইশারায় বাঁ দিকের বন্ধ ঘরটা দেখাল।

মিতিন টুপুরকে বলল, যা, ও ঘরে উঁকি দিয়ে আয়। নয়ন সাৰ্থক হবে।

টুপুর উৎসুক পায়ে গিয়েছে ঘরের সামনে। ঠেলে দরজা খুলতেই দুচোখ বিস্ফারিত। এ কী দৃশ্য? এও কি সম্ভব?

ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যাল স্বয়ং ঘুমাচ্ছেন বিছানায়!

মল্লিকপুরে ফের এসে প্রথমে অনিশ্চয় মজুমদারকে ফোন করেছিল মিতিন। খোদ আই জি সাহেবের নির্দেশ পেয়ে স্থানীয় থানার ও সি দেরি করেননি, পৌনে পাঁচটার মধ্যে সদলবলে হাজির। একটা মুশকো শয়তানকে মিতিন একাই কবজা করেছে দেখে তার তো চোখ কপালে। পরক্ষণেই অবশ্য অনুযোগ জানালেন, এত বড় ঝুঁকি নেওয়া নাকি ঠিক হয়নি। পুলিশবাহিনীর জন্য মিতিনের অপেক্ষা করা উচিত ছিল। বাড়িতে বজ্জাতটার আরও সঙ্গীসাথীও তো থাকতে পারত। মিতিন আশঙ্কাটাকে হেসেই উড়িয়ে দিল। সান্যালবাড়িতে প্রথমবার এসেই সে বুঝে ফেলেছে, এখানে পাজি লোকটার কোনও দোসর নেই। বাসন্তী থেকে কর্তার হুকুম পেয়ে সে মোটরবাইক নিয়ে স্টেশন অবধি ছুটেছিল বটে, কিন্তু বাড়ি ফাঁকা বলেই বেচারা ট্রেনে উঠে মিতিনদের অনুসরণ করতে পারেনি। তাকে ফিরতে হয়েছে সান্যালবাড়ির গুহায়। তা ছাড়া চেহারা যতই জবরদস্ত হোক, মিতিনের ধারণা লোকটা আদতে রামভিতু।

টুপুর মনেমনে হাসছিল। মিতিনমাসির স্বভাবটাই এরকম। কখনওই নিজেকে জাহির করতে চায় না। সে তো দেখেছে, কীভাবে মিতিনমাসি কুংফুর দক্ষতায় অবলীলায় পটকে দিল লোকটাকে। থাক সে কাহিনী, শুনে ও সি সাহেব হয়ত ভিরমি খাবেন!

লোকটাকে পুলিশের হাতে সঁপে দিয়ে মিতিন এখন অনেকটা ঝাড়া হাত-পা। মোবাইলে বাড়িতে ফোন করল একবার। জেনে নিল বুমবুম কী করছে? পেট ভরে বুমথুমকে পাস্তা খাইয়ে দিতে বলল ভারতীকে। রাতের রান্না নিয়েও নির্দেশ দিল টুকিটাকি। তারপর উর্দিধারীদের খানিকটা আড়ালে আবড়ালে থাকতে বলে টুপুরকে নিয়ে সোজা মোড়ের চায়ের দোকানে।

সান্যালবাড়িতে পুলিশ দেখে দোকানে জল্পনাকল্পনা চলছিল জোর। দুপুরের লোকটা হাত-মুখ নেড়ে খদ্দেরদের বলছিল কী সব, মিতিনদের দেখে থমকে গেল। অবাক হয়ে বলল, একী, আপনারা তখন যাননি?

টুপুর বুঝল, দ্বিতীয়বার রিকশায় সোজা সান্যালবাড়ি চলে গিয়েছিল বলে দোকানদারটি তাদের খেয়াল করেনি। মিতিনের পাশে বেঞ্চিতে বসে বলল, না। দরকারে পড়ে ফিরতে হল।

টুপুরের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে মিতিন বলল, স্টেশনে গিয়ে বাসন্তীতে ফোন করেছিলাম। স্যার জানালেন, উনি আজই আপনাদের সোনাদাকে রিমুভ করতে আসবেন। তাই আমরাও রয়ে গেলাম। যদি স্যারের কাজে লাগি।

এক কৌতূহলী ভদ্রলোক চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু সান্যালবাড়িতে পুলিশ এসেছে কেন?

সোনাবাবুর বন্ধুটি নাকি সুবিধের নয়। মিতিন চোখ ঘোরাল, একটা কুকুর আর একটা মানুষকে মার্ডার করে এখানে ঘাপটি মেরে ছিল।

ছি ছি, কী সব বন্ধুর সঙ্গে মেশে সোনা! একেবারে অধঃপাতে গিয়েছে।

আর এই জন্যই তো সোনাদার এই হাল। অন্য এক খদ্দের বলল, সাধে কি বলে সৎ সঙ্গে স্বৰ্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ!

মিতিন প্রসঙ্গটায় আর ঢুকলই না। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবার হবে ভাই?

দোকানি শশব্যস্ত, ঘুগনি বানিয়েছি। টোস্ট-অমলেটও হতে পারে। কিংবা টিফিনকেক।

ঘুগনিই দিন দুপ্লেট। সঙ্গে দুটো লিকার চা। …কী রে টুপুর, আজ তোর একটু চা চলবে তো?

টুপুর লাজুক মুখে বলল, খাই একদিন।

অমলেটও নিতে পারিস সঙ্গে। পেটটা ভরা থাক। আরও ঘন্টা তিন-চার হয়তো এখানে কাটাতে হবে।

অতক্ষণ প্রতীক্ষা করতে হল না অবশ্য। সান্যালবাড়িতে ফিরে একতলার ঘরে বসে ও সি-কে ঘটনাটা আদ্যোপান্ত শোনাচ্ছিল মিতিন, পৌনে আটটা নাগাদ বাইরে গাড়ির শব্দ। অ্যাম্বাসাডর।

টুপুরের স্নায়ু টানটান। না জানি কী হয় এবার!

বাসন্তীর দীর্ঘদেহী মানুষটি দরজা ঠেলে ঢুকলেন ঘরে। সঙ্গেসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে মিতিন। দুহাত ছড়িয়ে বলল, ওয়েলকাম হোম সুধন্যবাবু। আপনার বাকি দুই চ্যালা কি গাড়িতে? তাদের বলে দিন, ভাড়া করা গাড়িটি আর লাগবে না। মহামান্য সরকারবাহাদুরের ব্লু মারিয়া আপনাদের পথ চেয়ে আছে।

.

১১.

বাসন্তীতে ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যালের বাড়ি আজ জমজমাট। মিতিন, পাৰ্থ, টুপুরের সঙ্গে বুমবুমও এসেছে। অনিশ্চয় মজুমদারও। রতন হেনরি মণ্ডল এখন দেখাশোনা করছে সুমন্ত্ৰ সান্যালের। বুমবুম তার লেজ ধরে সর্পগৃহ দেখতে গিয়েছিল। দৰ্শন সেরে সে ছুটে বেড়াচ্ছে গোটা কম্পাউন্ডে। আই জি সাহেবের আগমনবার্তা পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাসন্তী থানার ও সিও হাজির। মঙ্গলও আজ রয়েছে বাড়িতে।

ডক্টর সান্যাল এখন অনেকটাই সুস্থ। মল্লিকপুর থেকে উদ্ধার করে তাকে দিনকয়েকের জন্য রাখা হয়েছিল কলকাতার এক নার্সিং হোমে, বাসন্তী ফিরেছেন সবে পরশু। টানা আটনদিন কোকেন ইঞ্জেকশন পড়ার প্রতিক্রিয়া তাঁর স্নায়ু থেকে কেটেছে বটে, আচ্ছন্ন ভাবটাও আর নেই। তবে এখনও তিনি বেশ দুর্বল। হাঁটাচলা যতটুকু করছেন, রতনের কাঁধে ভর রেখে। তারই আন্তরিক আমন্ত্রণে আজ এই সমাগম।

বাইরের ঘরে বসে কথাবার্তা চলছিল। চা, মিষ্টি হয়ে গিয়েছে এক প্রস্থ, রতন দ্বিতীয় রাউন্ডে কফি দিয়ে গেল। কাপ হাতে নিয়ে অনিশ্চয় জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ম্যাডাম, শুধু রিগর মর্টিস সেট ইন করার টাইমের সূত্র ধরেই আপনি বুঝে ফেলেছিলেন নীলাম্বর খুন হয়েছে?

পার্থ বলে উঠল, সঙ্গে সাপের কামড়ের দাগগুলোও আছে। ইঞ্জেকশনের চিহ্ন আর সাপের দাঁতের দাগ নিশ্চয়ই এক রকম হবে না?

মিতিন বলল, হ্যাঁ, ওটাও একটা যুক্তি বটে। ক্ষতস্থানটাও আমার কেমন কেমন যেন লেগেছিল! পরে বই দেখে জানলাম, রাসেল ভাইপার, মানে চন্দ্রবোড়া, পুরো বিষ ঢাললে চামড়া সামান্য হলেও ছিঁড়ে যায়। নীলাম্বরের গোড়ালিতে দুটো বড় বড় ফুটো ছিল বটে, জায়গাটা ফুলেও গিয়েছিল, কিন্তু চামড়া ছিল ইনট্যাক্ট। এ ছাড়া কিন্তু ছোট দাগ, মানে বিষদাঁত ছাড়া বাকি দাঁতের কোনও চিহ্নই ছিল না। অবশ্য বাকি দাঁতের দাগ সবসময় যে পড়বেই তার কোনো মানে নেই।

মঙ্গল মন দিয়ে শুনছিল। ধরাধরা গলায় বলল, আমারও কিন্তু একটু একটু সংশয় জেগেছিল। মনে হচ্ছিল, সাপ পুরো ছোবল মারতে পারেনি। গরমকালে সাপের বিষ পাতলা থাকে। পুরো বিষ না ঢেলে থাকলে নীলু অত তাড়াতাড়ি মরে কী করে?

হুঁ। তবে এত সূক্ষ্ম জ্ঞান তখনও আমার ছিল না। আমি খুনের ব্যাপারে একশো ভাগ নিশ্চিত হয়েছিলাম অন্য একটা ব্যাপার থেকে। ডেডবডির পকেটে কোনও চাবি ছিল না।

অনিশ্চয় বিস্মিত স্বরে বললেন, মানে?

 ডক্টর সান্যালের বাড়ির গেট সবসময় তালাবন্ধ থাকে। নীলাম্বর রাতেই বেরোক, কি ভোরে, সে নিশ্চয়ই তালা খুলে বেরিয়েছে। অতএব চাবিটি তার পকেটেই থাকার কথা। ছিল কি?

ও সি বললেন, না। আমরা ডেডবডির পকেট ভালভাবে সার্চ করেছি। কিছু ছিল না। ডেডবডির আশেপাশেও কিছু পাওয়া যায়নি।

তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? নীলাম্বর তালা খুলে বেরোয়নি, অথচ বডি বাইরে পড়ে ছিল! খুন ছাড়া আর কী হতে পারে? এবং সেটা হয়েছে বাড়ির ভিতরেই। তারপর খুনি তালা খুলে বডি সরিয়েছে। তবে সত্যি বলতে কী, খুনের চেষ্টা আগের রাত্তিরেই হয়েছিল। একা সুধন্যই সাপের বিষ ইনজেক্ট করতে ঢুকেছিলেন নীলাম্বরের ঘরে। কিন্তু নীলাম্বর জেগে গিয়ে চোর এসেছে ভেবে হল্লাগুল্লা শুরু করায় সুধন্যর মতলবটি কেঁচে যায়। এদিকে নীলাম্বরকে বাঁচিয়ে রাখাও সুধন্যর পক্ষে বিপজ্জনক। যদি নীলাম্বর তাকে চিনে ফেলে? যে-উদ্দেশ্যে তাঁর সুমন্ত্রর বেশ ধারণ, নীলাম্বর উপস্থিত থাকলে তাতেও তো পদেপদে বিঘ্ন?

পার্থ বলল, আমার মনে হয় সুধন্য যে সুমন্ত্ৰ নন, এ ধারণা নীলাম্বরের মাথায় এসেছিল। আঁচ পেয়ে তাই তাকে তড়িঘড়ি …

হতেই পারে। মিতিন মাথা নাড়ল, হতে পারে সুধন্যর কোনও ফোনাফুনি শুনে ফেলেছিল নীলাম্বর। ওদিকে তখন অন্য একটা বখেড়াও এসে পড়েছে। পরদিন থেকে বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসার কথা। চোরের উপদ্ৰবের জন্য। তাই খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই চ্যালাচামুণ্ডাদের ডেকে নীলাম্বরকে নিকেশ করা হল। চ্যালাদের সাহায্যে ক্লোরোফর্মটোরোফর্ম দিয়ে আগেই অজ্ঞান করে মেপেজুপে ভেনাম পুশ। তারপর চ্যালাদের মাধ্যমেই বডি পাচার।

পার্থ বলল, কিন্তু শাগরেদরা এল কখন?

 বিকেল বা সন্ধেতে এলে নীলাম্বর নিশ্চয়ই তাদের দেখেছে। তবে সেটা নিশ্চিতভাবে জানা তো এখন আর সম্ভব নয়। মিতিন কফি শেষ করে কাপ নামাল, আমার ধারণা, নীলাম্বর তাদের বিকেল-সন্ধেতে দ্যাখেনি। কারণ তারা এসেছিল রাতে।

কী করে হয়? রাতে তো ফেরিঘাট বন্ধ থাকে?

রাস্তা হাজার একটা আছে মশাই। গোসাবা দিয়েও বাসন্তীতে আসা যায়। সেখানকার ফেরিঘাট এই বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। ওই ঘাটে সন্ধেয় এসে, জিরিয়েটিরিয়ে রাত বাড়লে হয়তো রওনা হয়েছে। সোনাখালি থেকে প্রাইভেট নৌকো ভাড়া নিয়ে, যেখানটা নীলাম্বর পড়ে ছিল, সেখানে এসে নামলেও জানছেই বা কে, দেখছেই বা কে! তারপর রজারকে মারার জন্য যেভাবে কম্পাউন্ডে ঢুকেছিল, সেভাবেই পাঁচিল টপকে গৃহে প্ৰবেশ।

হ্যাঁ। আমার রজারকে ওরাই মেরেছিল। ইজিচেয়ারে অর্ধশায়িত সুমন্ত্রর ক্ষীণ স্বর শোনা গেল, মল্লিকপুরে আমাকে ওরা ভয় দেখিয়ে বলত, রিভলভারে সাইলেন্সার লাগিয়ে মেরে রজারকে যেমন জলে ভাসিয়ে দিয়েছি, আপনাকেও সেভাবে…

পাষণ্ডের দল। পার্থ গজগজ করে উঠল, অনিশ্চয়বাবু, ওরা তো এখন পুলিশ হাজতে। রোজ ওদের একশো ঘা করে বেত মারা যায় না?

মিতিন বলল, আহা, বেচারাদের আর উপায়ই বা কী ছিল। রজারকে না সরালে সুমন্ত্ৰবাবুর জায়গায় সুধন্যবাবু ঢুকবেন কী করে। দুজনে যমজ ভাই ঠিকই, দেখতেও হুবহু এক। তবে মানুষ ধোঁকা খেতে পারে, কুকুর তো আসল লোক চিনতে এক সেকেন্ডও সময় নেবে না।

টুপুর বলল, সত্যি, যমজ ভাইদের চেহারায় এত মিল আমি জন্মে দেখিনি।

হয় রে, হয়। অনেক হয়। হয়তো একটু ডিফারেন্স থাকে। হয়তো হাইটে হাফ ইঞ্চি কম-বেশি, কিংবা ভুরু অন্যরকম। অথবা নাকে স্লাইট তফাত। পাশাপাশি দুজনকে একসঙ্গে না দেখলে ওটুকু ধরাই যাবে না।

আমাদের মধ্যেও আছে। সুমন্ত্র বললেন, চোখের মণিতে।

জানি। আপনার মণি কালো। আর আপনার ভাইয়ের চোখ কটা। সুধন্যবাবু কনট্যাক্ট লেন্স পরে সেটা সহজেই ম্যানেজ করেছিলেন।

পার্থ ভুরু কুঁচকোল, তুমি আইবলের ব্যাপারটা জানলে কী করে?

দেবেশ সেনের কল্যাণে। দেবেশবাবুর মুখে গল্প শুনে হঠাৎই রাতে মাথায় স্ট্রাইক করল, দুভাই বোধহয় যমজ। নইলে একজন যখন বি এসসি ফাইনাল ইয়ারে, অন্যজনের তখন মেডিক্যাল থার্ড ইয়ার? রাতে ফোন লাগাতেই রহস্য জলবৎ তরলং। চোখের কালারের ডিফারেন্সটাও জেনে গেলাম।

আর-একটা চিহ্নও ছিল আমাদের চেনার। সুমন্ত্র চোখ বুজলেন, আমার কাঁধে জড়ুল আছে, সোনার নেই।

অনিশ্চয় বললেন, আপনাদের মধ্যে আরও অনেক তফাত আছে ডক্টর সান্যাল। আপনাদের দুজনের ক্যারেক্টারটাই একদম আলাদা। আপনি সৎ, বিদ্বান, দেশপ্রেমিক। আর আপনার ভাই লোভী, শঠ, নেশাখোর। আপনার উপর তার টানও নেই। নইলে লোভে পড়ে আপনার সঙ্গে এই ভয়ংকর নিষ্ঠুর আচরণ করে!

 সোনা কিন্তু চিরকাল এমনটা ছিল না, জানেন আই জি সাহেব। সুমন্ত্র পূর্ণ চোখে তাকালেন। ভেজাভেজা স্বরে বললেন, ডাক্তারি পড়তে যাওয়াটাই ওর কাল হল। বিশ্বাস করুন, ওকে সুপথে আনার কম চেষ্টা করিনি। ওর জন্য আমার বাবা-মাও জ্বলেপুড়ে মরেছেন। বিদেশে থাকতেই এখানকার এক বন্ধুকে ধরেকরে বাঙ্গালোরে সোনার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। কোম্পানির টাকাপয়সা হাতিয়ে চম্পট দিল। এই বাসন্তীতে এসে আমি যখন কাজ শুরু করলাম, ওকে আবার সুযোগ দিলাম একটা। আমার সঙ্গেই থাকুক। পেটে মেডিক্যাল লাইনের বিদ্যে আছে তো, সাহায্য করুক আমার কাজে। কীসের কী! সে আমার সাপের বিষ কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বেচা শুরু করে দিল। কী দাম ওই সব বিষের! পাঁচ হাজার টাকা, ছহাজার টাকা ভরি। শুধু তাই নয়, বিষ চুরি হলে আমার গবেষণাও তো চৌপাট। বাধ্য হয়ে বললাম, তুই মল্লিকপুরেই ফিরে যা। মাস-মাস গিয়ে টাকা দিয়ে আসব, কিন্তু তুই আর বাসন্তীর ছায়া মাড়াস না। বুঝতে পারতাম, ভাইটার আরও ক্ষতি করলাম। কোনও কাজকর্ম না করেই হাতে টাকা পেয়ে প্ৰাণের সুখে নেশা করছে, আর চ্যালাচামুণ্ডা নিয়ে ফুর্তি করছে। মল্লিকপুরের বাড়িটা সারাতে টাকা দিলাম, সেই পয়সাও উবে গেল। আমার স্ত্রী তো ঘূর্ণাক্ষরেও এত সব কথা জানে না। ভাইকে আমিই প্রশ্রয় দিয়েছি জানলে সে যে কী অনৰ্থ করবে।

মিতিন জিজ্ঞেস করল, কিন্তু স্যার, আপনি যে ক্যান্সারের প্ৰতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলেছেন, এই খবরটি সুধন্যবাবু পেলেন কোত্থেকে?

আমি। আমি। আমিই দায়ী। সুমন্ত্ৰ বড়বড় শ্বাস ফেলছেন, এত বড় একটা সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছি, আপনজনের কাছে সেই আনন্দটুকু জানাব না? সোনা যে শুনে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, আমি বুঝব কী করে? কী স্পর্ধা। ভাবুন, সে আমাকে বলে কিনা, ফর্মুলাটা দিয়ে দে! বড় কোনও ওষুধ কোম্পানিতে মোটা টাকায় বেচে তুই আমি দুজনেই কোটিপতি বনে যাই! আমি রাজি হইনি বলেই ওর এই চণ্ডমূর্তি।

তা স্যার, আপনার কাছে মাসদুয়েক আগে যে তিনটে লোক এসেছিল, তারা কারা?

তারাই তো ওরা। সোনার তিন শাগরেদ। তখন এসে পরিচয় দিয়েছিল ওষুধ কোম্পানির অফিসার বলে। প্রথমে মিষ্টি কথায় লোভ দেখাল, তারপর সরাসরি শাসানি। সুমন্ত্ৰ যেন সামান্য উত্তেজিত, পরে বুঝলাম, সোনাই ওদের সাজিয়েগুজিয়ে পাঠিয়েছিল।

টুপুর বলল, তারপরই তো রজারকে সরিয়ে দিল। তাই না স্যার?

রজারকে হারিয়ে আমি প্রথমটা বড় বিহ্বল হয়ে পড়ি। সে আমায় বড় ভালবাসত। সুমন্ত্রর গলা প্রায় বুজে এল, তারপর হঠাৎই কেমন একটা ভয় এসে আমায় আঁকড়ে ধরল। রজারকে কে ইলোপ করল? কেন করল? ঘাবড়ে গিয়ে আই জি সাহেবকে তাই ফোন করেছিলাম। টের পাচ্ছিলাম, যে-কোনও সময় সোনা আমায় আরও কোনও মারাত্মক ফাঁদে ফেলতে পারে।

মিতিন বলল, এরপর কী হল আমি বলছি। আপনি যাদবপুরে সেমিনারে গিয়েছিলেন। হঠাৎ ফোন এল আপনার ভাইয়ের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ঠিক সেখানে সংবাদ আসেনি, সেমিনার থেকে গেস্টহাউজে গিয়ে আপনি যখন বিশ্রাম নিচ্ছেন, তখনই পেয়েছিলেন ফোনটা। আপনি ভালমানুষের মতো ছুটলেন মল্লিকপুর। এবং সেখানে গিয়ে বন্দি হয়ে গেলেন।

অনিশ্চয় জিজ্ঞেস করলেন, এ তথ্য আপনি পেলেন কোত্থেকে?

মিতিন বলল, সুধন্যবাবুই আমায় তথ্যটি জানতে সাহায্য করেছিলেন। প্রথমদিন তিনি বলে ফেলেন, কলকাতায় গেলে সাধারণত সি এস আই আর গেস্টহাউজে থাকেন। ঢাকুরিয়া লেকের ধারে। নিজেকে সুমন্ত্ৰ সান্যাল প্রতিপন্ন করার জন্যই হয়তো ওই বেস কথাটি তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আরও একটা ব্যাপারে তিনি সেদিন বেশ অসতর্ক ছিলেন। রজারকে বারবার কুকুর, কুকুর করছিলেন। এতে যে রজারের প্রতি যথেষ্ট অবহেলাই প্রকাশ পায়, সেটা তার খেয়াল ছিল না। সে যাই হোক, সুধন্যবাবুর কাছ থেকে ছোট একটা হিন্ট পেয়েই আমি লেকের ধারের গেস্টহাউজটিতে যাই। এবং রিসেপশনে ফোনের খবরটি জানতে পারি। আরও খবর পাই, পরদিন গেস্টহাউজে গিয়ে সুমন্ত্ৰবাবু নাকি নিজের ব্রিফকেসটি নিয়ে গিয়েছেন। অর্থাৎ সুমন্ত্ৰবাবুর ভাইয়ের বানানো ঘাটশিলার গল্পটিও মিথ্যে।

পার্থ বলল, তার মানে তখনই তুমি বুঝে গিয়েছিলে, সুধন্যবাবু সুমন্ত্ৰ সান্যাল সেজে বাসন্তীতে বসে আছেন?

না। গেস্টহাউজে তো গিয়েছিলাম আমি শনিবার। তখনও ভাবছি, ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যাল বুঝি দুমুখো মানুষ। তলেতলে কোনও অপকর্ম করে সাক্ষ্য লোপের জন্য নীলাম্বরকে খুন করিয়েছেন। কিন্তু কার্যকারণ সূত্র মিলছিল না। রজারের মৃত্যুটাই গোল পাকিয়ে দিচ্ছিল। ডক্টর সান্যাল রজারকে সরাবেন কেন? তা হলে কি মেঘের আড়ালে কোনও মেঘনাদ আছে? রবিবার দেবেশবাবুর মুখে ডক্টর সান্যালের ভাইয়ের গল্প শুনে ছবিটা অনেক পরিষ্কার হয়ে গেল। তারপর রাত্তিরবেলা ছবিটা তো একদম স্পষ্ট।

অনিশ্চয় বললেন, একটাই বাঁচোয়া, আপনি খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন। ডক্টর সান্যালকে আরও কটা দিন কবজায় রাখতে পারলে সুধন্য তাকে পুরোপুরি কোকেনে আসক্ত করে ফেলত। তারপর তিনি যখন নেশার জন্য ছটফট করতেন, কোকেনের সিরিঞ্জ মুখের সামনে নেড়ে পেট থেকে বার করে ফেলত ফর্মুলাটা।

না আই জি সাহেব, সেটি বোধহয় পারত না। সুমন্ত্ৰ মাথা দোলাচ্ছেন, প্রথমত, কাজটা আমার পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখনও একটা-দুটো সিঁড়ি পেরোতে হবে। পরীক্ষা হবে মানুষের শরীরের উপরে। এবং তারপরই এটিকে আমি প্রতিষেধক বলে দাবি করতে পারব। তবে কিছু একটা ঘটে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় যতটা এগিয়েছি তা আমি সিডি করে লুকিয়ে রেখেছি। মরে গেলেও ওই সিডি আমি সোনার হাতে তুলে দিতাম না। আর সোনাও সারাজীবন এ বাড়িতে মাথা খুঁড়ে সেটি খুঁজে পেত না।

মিতিন হেসে বলল, আমি কিন্তু স্যার অনুমান করতে পারছি ওটা কোথায় আছে।

সুমন্ত্ৰ কষ্ট করেও সোজা হয়ে বসলেন। দম নিয়ে বললেন, কোথায় বলুন তো?

ল্যাবরেটরিতে। আপনি যে নতুন এগজস্ট ফ্যান বসিয়েছেন, সেখানেই বোধহয় গোপন গর্ত করে রাখা আছে।

সুমন্ত্ৰ ফ্যালফ্যাল তাকালেন, কী করে বুঝলেন?

রজারকে হারানোর পরেই আপনার ঘড়ি সারানো, নতুন এগজস্ট ফ্যানের ব্যবস্থা, এবং মই কেনা— আইডিয়াটা পেয়েছেন মুঘল এ আজম-এর ক্যাসেট দেখে, তাই না স্যার? আকবর যেভাবে নর্তকী আনারকলিকে দেওয়ালে গেঁথে ফেলেছিলেন, সেভাবেই আপনিও আপনার আবিষ্কারকে …

না না, পুরো বন্ধ করিনি। এতক্ষণে সুমন্ত্রর ঠোঁটে অনাবিল হাসি, বক্স বানিয়েছি। উপরে সিমেন্টের ঢাকনাও আছে। দেখে অবশ্য কিছুই বোঝা যাবে না।

আবার তা হলে সিডিখানা বের করে নিন স্যার। কাজটা শেষ করে ফেলুন। গোটা পৃথিবীর মানুষ কিন্তু ক্যান্সারের প্রতিষেধকের আশায় দিন গুনছে।

দেখি, পারি কিনা। সুমন্ত্ৰ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, আমার ভাইটার যে কী হবে!

ঘরের বাতাস আরও যেন ভারী হয়ে গেল। বাইরেও আজ বড় গুমোট, মেঘ জমছে আকাশে। ডক্টর সান্যালের উদ্বেগটা যেন একটুক্ষণ পাক খেল ঘরে। তারপর বাইরের গুমোটে গিয়ে মিশে গেল।

সুমন্ত্রর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবার ফেরার পালা। বুমবুমকে ডেকে নিয়ে এগোতে শুরু করল সকলে। আগেআগে হাঁটছেন অনিশ্চয়, পাশে বাসন্তী থানার ও সি। পার্থ আর মিতিন তাদের পিছনে। সঙ্গে টুপুর, বুমবুম।

রাস্তায় এসে পাৰ্থ তারিফের সুরে বলল, না, কেসটা বেশ ইন্টারেস্টিংই ছিল।

অনিশ্চয় শুনতে পেয়েছেন কথাটা। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, একটা ব্যাপার আমায় খুব হন্ট করছে, জানেন। প্রায় একই সময়ে একই মায়ের পেটে জন্মে, দুই ভাই সম্পূর্ণ বিপরীত নেচারের হয় কী করে? এ যে দেখি হিন্দি ফিল্মের গল্প। এক ভাই ভিলেন হল, এক ভাই হিরো!

পার্থ বলল, পরিবেশ একটা ইম্পৰ্ট্যান্ট রোল প্লে করে, আই জি সাহেব। কুসঙ্গে পড়ে ক্রমশ অবনতি ঘটেছে সুধন্য সান্যালের শেষ পর্যন্ত সে একটি বিষধর সাপে পরিণত হয়েছে।

সাপ কী বলছেন? এ তো সাপের চেয়েও মারাত্মক।

 হুম। একমাত্র মানুষই বুঝি এত নিষ্ঠুর হতে পারে।

টুপুর ম্লান গলায় বলল, ডক্টর সান্যালের কথা ভাবলে আমার খুব খারাপ লাগছে।

অনিশ্চয় বললেন, অন্য অ্যাঙ্গল থেকেও ভাবুন। ডক্টর সান্যাল কীভাবে বেঁচে গেলেন। কাজ হাসিল হয়ে গেলে ভাইকে মেরে ফেলতে সুধন্যর মোটেই হাত কাঁপত না।

অথচ সব বুঝেও ডক্টর সান্যাল এখনও ওই ভাইয়ের জন্য মন খারাপ করছিলেন।

ও ঠিক হয়ে যাবে। কাজকর্মে আবার ড়ুবে গেলে সামলে যাবেন।

এসব ক্ষত কি আর সারে মজুমদারসাহেব? মিতিন এতক্ষণে মুখ খুলেছে, ভাইটিকে ডক্টর সান্যাল সত্যিই বড় ভালবাসেন। সেই ভাই তার সঙ্গে এরকম …।

এর পরও টান থাকলে সেটা কিন্তু অন্ধ ভালবাসা ম্যাডাম। ডক্টর সান্যালের মতো বিজ্ঞানীর কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না। অনিশ্চয় মৃদু হাসলেন, যাক গে যাক, আপনি এবার একটা প্রশ্নের জবাব দিন তো ম্যাডাম। সুমন্ত্ররূপী সুধন্য সেদিন রজারের বদলে কুকুর বলেছিল বলেই আপনি আন্দাজ করে ফেললেন ডাল মে কুছ কালা হ্যায়?

বললাম তো, ওটা কানে লেগেছিল। মিতিনের ঠোঁটে রহস্যের হাসি, সেদিন এ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় একটা জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছিলাম মনে আছে?

কী বলুন তো?

একটা লোকাল ট্রেনের টিকিট। ওই দিনেরই। মল্লিকপুর টু ক্যানিং। ডক্টর সান্যাল তো ফিরেছেন ঘাটশিলা থেকে, ওই টিকিটে তা হলে কে এল? অবশ্য পথচলতি কেউও ফেলে থাকতে পারে। কিন্তু সেটা তা হলে গেটের ভিতর পড়ে কী করে? এবং সেখান থেকেই আমার সন্দেহের শুরু। কেন যেন মনে হয়েছিল, মল্লিকপুরের টিকিট পড়ে থাকাটা কাকতালীয় নয়। বাড়িতেই কেউ এসেছিল। আসলে সুধন্যবাবুই বেখেয়ালে টিকিটটা ..

টুপুর মুগ্ধ চোখে মিতিনমাসিকে দেখছিল। চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল, সত্যি মিতিনমাসি, ইউ আর জিনিয়াস!