৯-১০. সন্ধেবেলা বুমবুমের খাটে

সন্ধেবেলা বুমবুমের খাটে বসে হিরে চুরির কেসের একটা নোট মতো বানাচ্ছিল টুপুর। মিতিনমাসি এবার তাকে কোনও কাজই দেয়নি, তবু প্রত্যেকের জবানবন্দি, কার সম্পর্কে টুপুরের কী ধারণা জন্মেছে, লিখছে সাজিয়ে গুছিয়ে। হঠাৎ কোনও নতুন পয়েন্ট মনে পড়লে যোগ করে নিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। যেমন এইমাত্ৰ স্মরণে এল, পিটার ডিসুজা একজন সাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও উইলের খবর টুপুরদের কাছে গোপন করে গিয়েছিলেন। মিসেস আরাকিয়েলও নিজে থেকে উইলের কথা ভাঙেননি। জেসমিন-নির্মলারাও নয়। ভুলটা ইচ্ছাকৃত? না অনিচ্ছাকৃত? টুপুরের মন্তব্যটা হয়তো কাজে লাগবে। না, তবু নোট থাকা ভাল। টুপুর দেখেছে বিবরণী বিশদ হলে মিতিনমাসির কাজে সুবিধে হয়। টুপুর নিজেও শিখতে পারে, তদন্তের কোন-কোন সূত্র দরকারি, কোনটাই বা নেহাত অদরকারি।

ঘরে বুমবুমও মজুত। কম্পিউটারে ভিডিও গেমস খেলছে এক মনে। মা বাড়ি নেই, দিদিও কম্পিউটারের দখল চাইছে না, বুমবুমের এ ভারী সুখের সময়। পরশু অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে, মঙ্গলবারই নতুন ক্লাস শুরু। ছুটির শেষ দুটো দিন যেন চুটিয়ে উপভোগ করছে বুমবুম।

পার্থ ফিরল সাড়ে আটটা নাগাদ। চৈত্রের গরমে থসথস করতে করতে। এসেই শাওয়ার চালিয়ে স্নান। তারপর পাউডার-টাউডার মেখে আয়েশ করে বসেছে সোফায়। খবরের কাগজ উলটোতে উলটোতে হাঁক পাড়ল, টুপুর…? আই টুপুর…?

কাগজ-কলম ফেলে দৌড়ে এল টুপুর, কী বলছ?

তোর মাতৃম্বসাটি গেলেন কোথায়?

কী জানি। দুপুরে মারকুইস স্ট্রিট থেকে ফিরেই নাকে-মুখে গুঁজে কোথায় বেরিয়ে গেল।

তোকে নিল না?

তাই তো দেখছি।

একাই হিরে উদ্ধারে গেল নাকি?

বুঝতে পারছি না।

এহ্, তোর মাসি এখনও তোকে এলেবেলেই ভাবে রে। তুই আর জাতে উঠলি না।

টুপুর হেসে ফেলল। পার্থমেসো তাকে রাগাতে চাইছে। হাসতে হাসতেই বলল, মাসি তার নিজের ডিউটি করছে, আমি আমার।

তোর কী ডিউটি শুনি?

রিপোর্ট তৈরি করা। কদ্দুর কী প্রোগ্রেস হল…।

আদৌ কিছু এগিয়েছে কী?

 জানতে চাও, এখনও পর্যন্ত কী করেছি? আনব লেখাটা?

ওরে বাবা, এখন ওটা পড়বি নাকি? পার্থ হাই তুলল, তার চেয়ে বরং দ্যাখ, খাবারদাবার কিছু আছে কি না।

উৎসাহে জল ঢেলে দিতেই টুপুর বিরস মুখভঙ্গি করে বলল, আরতিদি ইডলি-সম্বর বানিয়ে রেখে গিয়েছে। মাইক্রোওয়েভে গরম করে দেব?

সঙ্গে একমুঠো চানাচুরও দিস। আর চা।

 ইডলির সঙ্গে চানাচুর? কী কম্বিনেশন গো!

ভ্যারাইটি জীবনের মশলা রে। তুইও ট্রাই করে দেখতে পারিস।

নো চান্স। ওই বিদঘুটে মিক্সচার তুমিই খাও।

জলখাবার হাতে পেয়েই তুবড়ি ছোটাতে শুরু করেছে পার্থমেসো। আর্মেনিয়ানদের সম্পর্কে আরও কিছু জ্ঞান আহরণ করেছে, এখন ভাণ্ডার উজাড় করার পালা। সম্রাট আকবর নাকি এক আর্মেনিয়ানকে ছেলে হিসেবে দত্তক নিয়েছিলেন। আকবরের সাম্রাজ্যে প্রধান বিচারপতিও নাকি ছিলেন একজন আর্মেনিয়ান। বিচারপতির নাম ছিল আবদুল হাই। আকবরের সময় থেকেই দিল্লি, আগ্রা, পঞ্জাব, সর্বত্রই আর্মেনিয়ানরা আঁকিয়ে বসতে থাকে। একটা গির্জাও নাকি তারা বানিয়ে ফেলেছিল আগ্রায়, আকবর বেঁচে থাকাকালীন।

বক্তৃতার মাঝেই হঠাৎ মিতিনের প্রবেশ। পার্থর ডাকাডাকিতে সাড়া না দিয়ে থমথমে মুখে সটান ঢুকে গেল স্টাডিতে। বন্ধ করে দিয়েছে দরজা। টুপুর আর পার্থ মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কেস চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেলে এমনটাই করে মিতিন, তারা জানে।

রাতে অবশ্য মিতিন বেরিয়ে খেতে বসল একসঙ্গে। এলোমেলো কথা বলল দু-চারটে, কিন্তু কেসের ব্যাপারে আশ্চর্য রকম নীরব। অর্থাৎ কেস নিয়েই ভাবছে। এবং কেস সংক্রান্ত কোনও আলোচনাই এখন পছন্দ করবে না। আর সেরে ফের সেঁধিয়ে গেল নিজস্ব কুঠুরিতে। টুপুর যখন শুতে গেল, তখনও স্টাডির আলো নেবেনি।

সকালবেলা মিতিন কিন্তু একদম অন্য মেজাজে। নিজেই ব্যালকনির গাছে জল দিল, মাঝে-মাঝে গুনগুন গান গাইছে, আরতিকে আলুর পরোটা ভাজতে বলল, খুনসুটি করল বুমবুমের সঙ্গে।

টুপুরও গন্ধ পেয়ে গিয়েছে ওমনি। আলুর পরোটার প্লেট হাতে নিয়ে মাসিকে জিজ্ঞেস করল, কে মনে হচ্ছে সল্ভড?

ইয়েস। যবনিকা কম্পমান। মিতিনের মুখে বিচিত্ৰ হাসি, এবার পরদাটা তুলে দিলেই হয়।

কে নিয়েছে তা হলে হিরেটা?

সাসপেন্স।

বুঝেছি, বলবে না। টুপুর চোখ তেরচা করল, জিনিসটা পাওয়া যাবে তো? নাকি পাচার হয়ে গিয়েছে?

ঘরের মধ্যে ঘর, তার মধ্যে পচে মর। কী বুঝলি?

ধাঁধাটার জবাব তো মশারি। টুপুর ঘাড় চুলকোচ্ছে, একটু ঝেড়ে কাশো না মিতিনমাসি।

আর তো কয়েকটা ঘণ্টা। দমটাকে ধরে রাখ। মিতিন পার্থর দিকে তাকাল, তুমি কী করছ বিকেলে?

শব্দজব্দ করতে করতে পরোটা ছিঁড়ছিল পার্থ। তবে কান কিন্তু এদিকেই খাড়া। ঠোঁট উলটে বলল, ঠিক নেই। ভাবছি অ্যাকাডেমিতে একটা নাটক দেখতে যাব।

উছ। আমাদের সঙ্গে মারকুইস স্ট্রিট চলো।

 গিয়ে?

জোড়া নাটক দেখবে। উইথ ফাটাফাটি ক্লাইম্যাক্স। …উঁহুহু, চোখ বড়-বড় কোরো না। ঠিক চারটেয় শো। রোববার দুপুরে না ঘুমিয়ে তৈরি থেকো।

পাৰ্থর পরোটা বোঝাই গাল হাসিতে ভরে গেল, ও কে, ম্যাডাম টিকটিকি।

.

১০.

ড্রয়িংরুম আলো করে বসে আছে আট-নজন। মিসেস আরাকিয়েল তো আছেনই, জেসমিন, নির্মলা, হ্যারি, সুজান, ডিসুজারা বাপছেলে, কুরিয়েন কর্তাগিন্নি সকলেই হাজির। মিতিনরা ঢোকামাত্র হালকা একটা গুঞ্জন উঠেছিল, এখন এক অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করছে ঘরে।

পার্থ আর টুপুরকে দুদিকে নিয়ে মিতিন বসল বড় সোফাটায়। উৎসুক চোখগুলোতে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে কথা শুরু করেছে, দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, বাইশে ডিসেম্বরের রাতটা সম্পর্কে আপনারা কেউই সত্যি কথা বলেননি। অবশ্য মিসেস আরাকিয়েলকে আমি ধরছি না। কারণ, ওই রাতটা নিখুঁত স্মরণে রাখা আন্টির পক্ষে সম্ভব ছিল না। উনি আর মিস্টার পিটার ডিসুজা ছাড়া উপস্থিত প্রত্যেকেই সেদিন অত্যন্ত ন্যক্কারজনক কাজ করেছিলেন।

ইসাবেল বিড়বিড় করে বললেন, কী বলছ বাছা? সবাই মিলে হিরে চুরি করেছে?

উঁহু, তা কেন। মিতিন চিলতে হাসল, আমি বরং সেদিন রাতে কী কী ঘটেছিল, তার একটা ছবি তুলে ধরি। তা হলেই ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

বেশ তো, বলো শুনি!

মিস্টার আরাকিয়েলের ডেডবডি ঘিরে অনেকেই ছিলেন সেদিন। মিসেস কুরিয়েন আর সুজান ছাড়া এ ঘরের সব্বাই। রাত দুটোর সময়ে মিসেস আরাকিয়েলকে নিয়ে জেসমিন তার ঘরে গেল, মিস্টার পিটার ডিসুজাও নেমে গেলেন নীচে। আর তারপরেই শুরু হল এক আজব লুকোচুরি খেলা। অ্যালবার্টকে নিয়ে মিস্টার হ্যারি লাইব্রেরিরুমে এসে বসলেন। একটু পরে হ্যারি কফি বানাতে বললেন নির্মলাকে। যখন নিৰ্মলা কিচেনে, মিস্টার কুরিয়েন তখন ডেডবডির পাশে একা। মিস্টার আরাকিয়েল যে সিন্দুকের চাবি সর্বদাই কোমরে বেঁধে রাখতেন, এ সংবাদ কারওরই অজানা নয়। একা ঘরে মিস্টার কুরিয়েনের চোখ লোভে চকচক করে উঠল। তবু উনি ঠিক সাহস পাচ্ছিলেন না। কিন্তু হ্যারি আর অ্যালবার্ট ড্রয়িংরুমে উঠে যেতেই ঝটপট মিস্টার আরাকিয়েলের কোমর থেকে চাবিটা নিয়েই সিন্দুক…

অ্যালবার্ট চেঁচিয়ে উঠল, কুরিয়েন আঙ্কল এ তো ভাবাই যায় না।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। এমন অনেক কিছুই ঘটে, যা আমাদের কল্পনার অতীত। তবে তখন তো সবে খেলা শুরু হয়েছে। মিতিনের ঠোঁটে বাঁকা হাসি, মিস্টার কুরিয়েন বেশি সময় পাননি। নির্মলা কফি নিয়ে চলে এল কিনা। চাবিটা কোনও রকমে ডেডবডির কোমরে খুঁজে দিয়ে মিস্টার কুরিয়েন তখন প্রবল টেনশনে ভুগছেন। কোনও মতে কফি শেষ করে হুড়মুড়িয়ে পালালেন একতলায়।

জেসমিন উত্তেজিত স্বরে বলল, হিরে সমেত?

বলছি, বলছি। কুরিয়েন বেরিয়ে যেতেই নির্মলা ফাঁকা পেয়ে গেল ঘর। সে বড় সাবধানি মেয়ে, কফির কাপ নেওয়ার অছিলায় হ্যারি আর অ্যালবার্টকে দেখে এল। হ্যারি তখনও ফোন করছেন। এর পর কাপ কিচেনে নামিয়ে নিৰ্মলা গেল জেসমিনের ঘরে। আন্টি আর জেসমিন শুয়ে আছেন দেখে ভিতরবারান্দা দিয়ে মিসেস আরাকিয়েলের বেডরুমে ফিরল। তারপর যে-আঙ্কল তাকে হোম থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাঁরই ডেডবডির কোমর থেকে চাবি খুলে…।

নির্মলা? ইসাবেল আর্তনাদ করে উঠলেন, আমার নির্মলা ওই হীন কাজ করেছে?

লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয় আন্টি। নির্মলা হয়তো ভেবেছিল হিরেটা পেলে এক লাফে বড়লোক হয়ে যাবে। মিতিন তেরচা চোখে হ্যারি আর অ্যালবার্টকে দেখল, এমনটা কি এ ঘরের আর কেউ ভাবেননি? এই যে মিস্টার হ্যারি সিরিয়াস মুখ করে বসে আছেন… কিংবা ওই যে অ্যালবার্ট চোখ গোলগোল করে কথা শুনছেন… এঁরা কেউই তো সাধু নন।

হ্যারি কঠিন গলায় বলে উঠলেন, উলটোপালটা দোষারোপ করবেন না ম্যাডাম। আমি পছন্দ করি না।

থামুন। মিতিনেরও স্বর চড়েছে, নির্মলা থাকা অবস্থাতেই আপনারা ডেডবডির কাছে ফেরেননি?

তো?

নির্মলাকে শুতে যাওয়ার জন্য আপনি পীড়াপীড়ি করেননি? কিছুতেই নির্মলা উঠল না দেখে নানা গল্প শুরু করলেন। ঘণ্টাখানেক পর আবার কফির অর্ডার। এবার কফি দিয়ে নির্মলা আর বসতে পারল না, ভিতরে-ভিতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল তো। সে যেতেই আপনি ছটফট করতে লাগলেন, মতলব আঁটলেন ঘর থেকে অ্যালবার্টকে সরানোর।

ও, সেই জন্যই আমাকে সিগারেট আনতে বলেছিলেন? অ্যালবার্টের বিস্ময়মাখা গলা উড়ে এল, আমি নীচে যেতেই…।

হ্যাঁ, সময়টার উনি সদ্ব্যবহার করেছিলেন। নিজেকে কর্তব্যপরায়ণ বলে দাবি করেন বটে, তবে মৃত কাকার কোমর থেকে চাবি খুলতে তাঁর হাত কাঁপেনি। ওটাও বোধ হয় ওঁর কর্তব্য ছিল।

অ্যালবার্ট জোরে-জোরে মাথা নাড়ছে, খুব খারাপ কাজ… খুব বাজে কাজ করেছেন হ্যারি।

আপনি বেশি ফটরফটর করবেন না তো। আপনি নিজে কী, আঁ? মিতিনের স্বরে ধমক, হ্যারি ড্রয়িংরুমে ঘুমিয়ে পড়তেই আপনিও চান্স নেননি? মিস্টার আরাকিয়েলের মতো সজ্জন পিতৃতুল্য মানুষের কোমর থেকে চাবি খোলেননি আপনি? কেউ কোথাও নেই, সবাই ঘুমোচ্ছে… মওকা বুঝে সিন্দুক খুলে…।

জেসমিন তীক্ষ্মস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, জানতাম… জানতাম এ অ্যালের কুকীর্তি। সেদিন রাতে বজ্জাত ছেলেটাকে দেখেই বুঝেছিলাম পেটে কোনও বদমতলব আছে।

বদমতলব তো কারওর মনেই কম নেই ম্যাডাম জেসমিন। মিতিনের গলায় ব্যঙ্গের সুর, আপনিও যে শেষরাতে গাড়িবারান্দার ছাদ দিয়ে আঙ্কলের ঘরে এসে একই কুকর্মটি করলেন, তার পিছনে কি কোনও ভাল মতলব ছিল?

মিথ্যে কথা। আমি সকালের আগে আর ওই রুমে যাইনি।

 সাক্ষী কিন্তু আছে। নির্মলা কিন্তু দেখেছে আপনাকে।

 হতেই পারে না। নির্মলা তখন ঘুমোচ্ছিল। বলেই চমকে উঠেছে জেসমিন। চোখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখল একবার। তারপর মুখ ঢেকেছে দু হাতে। মাথা নাড়তে-নাড়তে বলল, বিশ্বাস করুন, সিন্দুক আমি খুলেছিলাম। কিন্তু হিরে তখন ওখানে ছিল না।

আপনাকে বিশ্বাস করা খুব শক্ত জেসমিন। তবে আপনার এই কথাটুকু অন্তত সত্যি। মিতিনের চোখে একটা হাসি খেলা করছে, আপনি যখন সিন্দুক খোলেন, হিরে তখন ভেলভেট বক্সে সত্যিই ছিল না। শুধু তাই নয়, অ্যালবার্ট, হ্যারি, নির্মলা, কুরিয়েন, যে যখনই খুলেছে… সকলের ভাগ্যেই ওই শূন্য বাক্সটি জুটেছে।

কী কাণ্ড, হিরে তা হলে গেল কোথায়? পিটার ডিসুজা আজ কানে শ্রবণযন্ত্র লাগিয়ে এসেছেন, প্রতিটি শব্দই শুনছেন মন দিয়ে। গমগমে গলায় বললেন, হিরে কি তা হলে ভ্যানিশ হয়ে গেল?

মোটেই না। হিরে হিরের জায়গাতেই আছে। মিস্টার আরাকিয়েল তাকে যথেষ্ট নিরাপদে রেখে গিয়েছেন। আই মিন, রেখে দিয়েছিলেন। ঘরের চোর-ডাকাত, বাইরের চোর-ডাকাত, কেউই যাতে হিরেটা লোপাট করতে না পারে। সিন্দুক ভাঙলেও নয়।

কোথায় রেখেছিলেন উনি? অনেকক্ষণ পর ইসাবেলের ক্ষীণ স্বর শোনা গেল, এই বাড়িতেই কি…?

হ্যাঁ আন্টি। হিরে আপনাদের বেডরুমেই আছে। মিতিন উঠে দাঁড়াল, আসুন, দেখাই।

হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো ও ঘরে চলেছে মিতিন। পিছনে মন্ত্ৰমুগ্ধ ইঁদুরের মত দঙ্গলটা। ঢুকেই মিতিন সোজা অ্যাকোয়ারিয়ামের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঝুঁকে জলে দেখছে কী যেন। মাথা নাড়ল দুদিকে। ঘুরেঘুরে এপাশ-পাশ থেকে ভাল করে দেখল মৎস্যাধারটিকে। কপালে টকটক আঙুল ঠুকছে। হঠাৎই টেবিলটা টেনে অ্যাকোয়ারিয়ামটাকে ঘুরিয়ে নিল পুরোপুরি। তারপর অ্যাকোয়ারিয়ামের তলায় হাত রেখে জোর হ্যাঁচকা টান।

অবাক কাণ্ড! পাতলা একটা চোরকুঠুরি বেরিয়ে এসেছে অ্যাকোয়ারিয়ামের নীচ থেকে। অনেকটা দেরাজের মতো।

দু ডজন চোখ একসঙ্গে আছড়ে পড়ল দেরাজে। মধ্যিখানে, গোল খোপে ওটা কী? হিরে না?

হ্যাঁ, হিরেই। বালি আর নুড়িতে অ্যাকোয়ারিয়ামের তলদেশ ঢাকা বলে দেরাজটার অস্তিত্ব বোঝার কোনও উপায়ই নেই। বালি সরিয়ে ফেললেও হিরে দেখা যাবে না, টিনের পাতের নীচে রয়েই যাবে চক্ষুর অগোচরে।

টুপুর বিমোহিত। কী অনুপম শোভা, আহা! হালকা সবুজ দ্যুতি ঠিকরে-ঠিকরে বেরোচ্ছে গা দিয়ে। সাধে কী দু কোটি টাকা দাম।

মহামূল্যবান রত্নটি খোপ থেকে তুলে ইসাবেলের হাতে দিল মিতিন। বলল, খুশি তো আন্টি?

ইসাবেলের চোখে জল। গদগদ গলায় বললেন, আমার আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না বাছা। আরাকিয়েল বংশের গৌরব তুমি আজ ফিরিয়ে দিলে। ঠিক বলছি না হ্যারি?

হ্যারিকে তেমন একটা আহ্লাদিত মনে হল না। আড়চোখে জেসমিনকে দেখে নিয়ে বলল, হিরে পাওয়া গিয়েছে… আমাকে বদনামের ভাগী হতে হল না… এটাই তো যথেষ্ট। তবে আরাকিয়েল বংশে এই হিরের মেয়াদ আর কদ্দিন? বড়জোর বিশ-পঁচিশ বছর। মানে যদ্দিন আপনি আছেন। তারপরই তো ভারদোনদের হাতে…। সেখান থেকে আবার হয়তো অন্য কোনও বংশে…।

না হ্যারি, না। ইসাবেল জোরে-জোরে মাথা নাড়লেন, আমি ঠিকই করে রেখেছি, হিরে আমি তোমাকে দিয়ে যাব। অবশ্য একটা শর্তে। কোনও কারণেই তোমরা এই হিরে বেচতে পারবে না।

সুজান জড়িয়ে ধরল ইসাবেলকে, থ্যাঙ্ক ইউ আন্টি। এই হিরে আমার ছেলে বা তার ছেলেও যাতে বেচতে না পারে, আমরা সেটা নিশ্চিত করে যাব।

একটা খুশি-খুশি বাতাবরণ তৈরি হয়েছে ঘরে। অপরাধের ভার লাঘব হতে সকলেই যেন বেশ পুলকিত। হঠাৎই অ্যালবার্ট প্রশ্ন করে বসল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব ম্যাডাম?

মিতিন ঘাড় বেঁকিয়ে তাকল, ইয়েস?

হিরে অ্যাকোয়ারিয়ামেই আছে, আপনি বুঝলেন কী করে?

ওটা তো বলা যাবে না ভাই। ট্রেড সিক্রেট। মিতিন মুচকি হাসল, ধরে নিন, আমি ম্যাজিক জানি।

অ্যালবার্ট কাঁধ ঝাঁকাল। পিটার হা হা হাসছেন। উচ্ছাসে ডগমগ ইসাবেল তো আগামী রোববার একটা ভোজই ঘোষণা করে ফেললেন। পার্টিতে বিশেষ অতিথি মিতিন, টুপুর আর পার্থ। বুমবুমকেও আনতে বললেন সঙ্গে। নেমন্তন্ন পেয়েই পাৰ্থ গোঁফে তা দিতে শুরু করেছে।

বিকেল গড়াচ্ছে সন্ধের দিকে। ইসাবেলের বাড়ি ফাঁকা হচ্ছিল ক্ৰমশ। হ্যারি আর সুজান গেলেন সবার শেষে। ইসাবেল এবার কাজের কথায় এলেন। মিতিনকে বললেন, জানি, তোমার ঋণ কখনও শোধ করতে পারব না। সম্মানদক্ষিণা হিসেবে যদি তোমায় এক লাখ টাকা দিই…?

মিতিন গম্ভীর মুখে বলল, আপত্তি নেই।

আর যদি দু লাখ দিই?

এ যে মেঘ না চাইতেই জল! টুপুর প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, তার আগেই মিতিন বলল, একটু বেশি হয়ে যাবে না কী? এক লাখই তো ঠিক আছে।

না। দু লাখই ঠিক। জেসমিনকে দিয়ে চেক-বই আনালেন ইসাবেল। কাঁপা-কাঁপা হাতে লিখে চেকটা বাড়িয়ে দিলেন মিতিনকে। ভেজা-ভেজা গলায় বললেন, তুমি জানো না, আমার কী উপকার করেছ। আমি যেন জীবনটাই ফিরে পেলাম। দ্যাখো না, এবার কেমন চটপট সুস্থ হয়ে উঠি।

ব্যাগে চেক রাখতে-রাখতে মিতিন একবার দেখল জেসমিনকে। একটু যেন উদাস জেসমিন। নখ দিয়ে নখ খুঁটছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নীরস গলায় মিতিন বলল, আপনার সুস্থ হওয়াটা কিন্তু হিরে ফেরত পাওয়ার উপর নির্ভর করছে না আন্টি।

কেন নয়? এখনই তো শরীরে অনেক জোর পাচ্ছি।

আবার দুর্বল হয়ে পড়বেন। সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপবে। বিছানা ছেড়ে আর উঠতেই পারবেন না। দৃষ্টিশক্তিও ক্ৰমে চলে যাবে। ঘা ফুটে-ফুটে বেরোবে গায়ে। কাশবেন, রক্তবমি হবে।

কী বলছ তুমি এসব?

একটুও বাড়িয়ে বলছি না। আপনি জেসমিনকে জিজ্ঞেস করুন।

জেসমিন যেন ইলেকট্রিক শক খেল সহসা। চমকে তাকিয়েছে। আমতা-আমতা করে বলল, আ-আ আমি কী করে জানব?

আপনিই তো জানবেন। মিতিনের গলা আচমকাই বরফের মতো ঠান্ডা, যে পিসি আপনাকে মায়ের স্নেহে বড় করে তুলেছেন, আপনি তাঁকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছেন…।

কী বলছেন আপনি? জেসমিন চিৎকার করে উঠল, আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?

মাথা খারাপ হয়েছে তো আপনার। টাকার লোভে। সম্পত্তির লোভে। পিসিকে দিয়ে তড়িঘড়ি উইলের প্রোবেট নেওয়ালেন। যাতে সমস্ত সম্পত্তি পিসির নামে আসে। তারপর শুরু হল আপনার খেল। পিসি কোনও উইল করার আগে তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করলেন মনে-মনে। আপনি জানতেন, পিসি আপনাকে পুরো সম্পত্তিটা দেবেন না। কিন্তু উইল না করে মারা গেলে আরাকিয়েলদের সব কিছুই আইনত আপনার হাতে চলে আসবে। তবে একটাই কাঁচা কাজ করে ফেলেছেন। হিরের লোভ ছাড়তে না পেরে আমার কাছে আসাটাই আপনার কাল হল। অবশ্য তার পিছনেও আপনার একটা নিজস্ব হিসেব ছিল। হিরে না পাওয়া গেলে রটিয়ে দিতেন, হিরের শোকেই পিসি মারা গিয়েছেন। আর মিললে হিরে হবে আপনার উপরি লাভ। মিতিনের স্বরে বিদ্রূপ ঝরে পড়ল, এখন যে আপনার দুকূলই গেল জেসমিন। হিরে যাবে হ্যারির ঘরে। আর সম্পত্তি-টম্পত্তির আশা শিকেয় তুলে আপনাকে যেতে হবে শ্ৰীঘরে।

জেসমিনের ফরসা সুন্দর মুখখানা বদলে গিয়েছে আমূল। রাগে গনগন করছে সে। তৰ্জনী উচিয়ে বিকৃত স্বরে বলল, এবার আপনি কাটুন তো। প্রলাপ শোনার আমাদের সময় নেই।

টুপুরকে হতবাক করে মিতিন ব্যাগ থেকে আধপোড়া লাল বাটি-মোমবাতিখানা বের করেছে। জেসমিনকে দেখিয়ে বলল, এই ক্যান্ডেলটা কিন্তু প্রলাপ নয়। এটা আমি পুলিশের জিন্মায় তুলে দিচ্ছি।

জোঁকের মুখে যেন নুন পড়ল। পলকে জেসমিনের মুখ শুকিয়ে আমসি। ঢোক গিলে বলল, কেন, পুলিশ কী করবে?

আর-একবার কেমিক্যাল টেস্ট করবে। যেমন আমি করিয়েছি। প্যারাফিনের সঙ্গে কতটা পারদ মিশিয়েছেন, পুলিশও একবার দেখুক।

ইসাবেল ধন্দ মাখা মুখে বললেন, মোমবাতিতে মার্কারি? কেন?

ওটা স্লো-পয়জনিংয়ের একটা টেকনিক। যে-যে উপসর্গগুলোর কথা বললাম, আস্তে আস্তে সবকটাই দেখা দেবে। তারপর এক বছরের মধ্যে ভিক্টিম পরপারে। মৃত্যুটা যে মার্কারির বিষেই ঘটল, কেউ আন্দাজও করতে পারবে না। ধ্যানের সময় স্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বিষ ঢুকছে… কী দুর্ধর্ষ আইডিয়া।

ইসাবেল স্তম্ভিত মুখে বসে। নির্মলা দরজায় দাঁড়িয়ে শুনছিল, তারও চোখ ক্ৰমশ বিস্ফারিত। ঘাড় ঝুলিয়ে ফেলেছে জেসমিন। আর টুঁ শব্দটি নেই।

মিতিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এবার আপনিই ঠিক করুন আন্টি, আপনার ভাইঝিকে কী শাস্তি দেবেন? পুলিশ? বাড়ি থেকে বিতাড়ন? নাকি এবারকার মতো ক্ষমা?

জানি না। কিচ্ছু জানি না। ইসাবেল ভেঙে পড়েছেন কান্নায়।

.

ট্যাক্সিতে বসে উশখুশ করছিল টুপুর। একরাশ প্রশ্ন ভিড় করেছে মাথায়, কোনটা ছেড়ে কোনটা করবে, ভেবে পাচ্ছে না।

মিতিন বুঝি পড়ে ফেলেছে টুপুরকে। মাথায় একটা আলগা চাটি মেরে বলল, ভোম্বল হয়ে গেলি কেন? এখনও নিশ্চয়ই ভেবে মরছিস অ্যাকোয়ারিয়ামটা কী করে আমার মগজে এল?

হ্যাঁ। টুপুর ঢকঢক ঘাড় নাড়ল, কী করে যে ধরলে?

বেশ ডিফিকাল্ট ছিল। চিন্তা করতে করতে কাল রাতে আমার ঘুম যায় আরকী! জব্বর একখানা শব্দজব্দ দিয়েছিলেন বটে মিস্টার আরাকিয়েল!

কোনটা শব্দজব্দ? কাল ডায়েরিতে যেটা দেখালে? গোল্ড তেরো হাজার পাঁচশো আটাত্তর?

ভুলভাবে বললি। গোল্ড ওয়ান থ্রি ফাইভ সেভেন এইট।

মানে?

গোল্ডের লাতিন নাম জানিস?

সামনের সিট থেকে পার্থ বলল, আমি জানি। অরাম।

কারেক্ট। এ ইউ আর ইউ এম। …এবার এমন একটা শব্দ তৈরি কর, যার প্রথম তৃতীয় পঞ্চম সপ্তম অষ্টম লেটার পাশাপাশি সাজালে অরাম হয়। ডিকশনারি ঘেঁটে দেখিস, একটাই ওয়ার্ড পাৰি। অ্যাকোয়ারিয়াম।

বেড়ে বার করেছ তো! লুকিয়ে-লুকিয়ে ক্রসওয়ার্ড সলভ করো নাকি?

পাৰ্থর তারিফে মিতিন ফিক করে হাসল, আজ্ঞে না, স্যার। ব্রেনটাকে জাস্ট একটু খেলালেই ধরে ফেলা যায়।

টুপুর মাথা নাড়ল, বুঝলাম। কিন্তু হিরে যে আদৌ সিন্দুকে ছিল না, এটা তুমি টের পেলে কীভাবে?

মিস্টার কুরিয়েনের সৌজন্যে। ভদ্রলোক যদি ফোনে কনফেস না করতেন, সিন্দুক উনি খুলেছিলেন… আর খুলে হিরে দেখেননি… তা হলে আমাকে আরও খানিক হাতড়াতে হত। সেই রাত্রের ক্রোনোলজি বলে, সিন্দুক খোলার প্রথম সুযোগটা পান কুরিয়েনই। ব্যস, এতেই তো দুয়ে-দুয়ে চার।

আর মোমে পারদ মেশানোটা? পার্থ প্রশ্ন ছুড়ল, ওরকম একটা প্যাঁচোয়া প্ল্যান তুমি আন্দাজ করলে কী করে?

ভেরি সিম্পল। …টুপুর, মনে পড়ছে জেসমিনের কারখানার পিছনে থার্মোমিটারের বাক্স পড়ে ছিল?

হ্যাঁ তো।

মার্কেট থেকে সরাসরি পারদ কিনত না জেসমিন, পাছে কেউ সন্দেহ করে। তার বদলে গুচ্ছ গুচ্ছ থার্মোমিটার থেকে মারকারি বের করে প্যারাফিনে মিশিয়ে দিত।

কী শয়তানি বুদ্ধি, বাব্বাহ! টুপুর চোখ ঘোরাল, তুমি যে কোন আক্কেলে জেসমিনকে ক্ষমা করে দিতে বললে। জেলখানাই ওর যোগ্য জায়গা।

না রে, জেসমিন তো জাত ক্রিমিনাল নয়। লোভের তাড়নায় দুর্বুদ্ধি চেপেছিল মাথায়। দুর্বুদ্ধি ঠেলেছে পাপের পথে। অনুশোচনা এলে নিশ্চয়ই শুধরে যাবে।

অনুশোচনা আসবে মনে হয়?

আশা করতে দোষ কী! মানুষই ভুল করে, মানুষই ভুল শুধরোয়। তা ছাড়া, যা ভয় দেখানো হয়েছে, হাসমিক ভারদোন এখন খুব চাপে থাকবে। একটাই শুধু ক্ষতি হল। ইসাবেল আন্টির বিশ্বাসটাই ভেঙে গেল। আর কখনও কি জেসমিনের উপর ভরসা করতে পারবেন?

কথাটা টুং করে বাজল টুপুরের বুকে। মনোমোহিনী হিরে ছাপিয়ে ইসাবেল আরাকিয়েলের অসহায় মুখখানা ভেসে উঠেছে চোখে। আহা রে, আপনজনরাও যে কেন মানুষকে এত দুঃখ দেয়। বোঝে না, ভালবাসা হিরের চেয়ে অনেক অনেক বেশি দামি।