৯-১০. বড় বিবির মহলে

বড় বিবির মহলে দুটো দিন বৃথাই গেলো বিনিদের। সকাল সন্ধ্যা দুবেলা গম্ভীর মুখো এক আরব এসে আরবি শেখায়, যে ভালো ইংরেজিও বলতে পারে। নুসরাত ওদের হাম্মাম খানায় নিয়ে গোসল করায়। দুপুরে তেহারি আর রাতে কাবাব রুটি খেতে দেয়। স্বাধীনতা বলতে বড় বিবির খাসমহল বাদে জোহরা খাতুনের বাকি মহল–এটুকু জায়গায় ওরা চলাফেরা করতে পারে।

এক মহল থেকে আরেক মহলের মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, যেখানে দাঁড়িয়ে নিচে ঘাসজমি আর ওপরে খানিকটা আকাশ দেখা যায়। মহলগুলোর সঙ্গে করিডোর দিয়ে যোগাযোগ আছে বটে, সেখানে পাহারা দেয় ভয়াল দর্শন কাফ্রিরা। ওদের চেহারা দেখলেই অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। শেখ আর বিবিরা ছাড়া আর কেউ ওই করিডোরে হাঁটতে পারে না।

গোটা প্রাসাদ একটা গোলাক ধাঁধার মতো মনে হয়েছে বিনির। ওরা প্রাসাদের কোন অংশে আছে, কোন দিক সামনে, কোন দিক পেছনে বোঝার কোনো উপায় নেই। যেদিকে তাকায় সেদিকেই শুধু পাথরের দেয়াল আর খিলান।

তৃতীয় দিন ঘটলো ওদের পরম প্রত্যাশিত ঘটনা। দুপুরে খাওয়ার পর বিবি আর বাদী নফররা সবাই ঘুমোয়। সেদিন ফাতিমারাও ঘুমোচ্ছিলো। বিনি কিছুক্ষণ শুয়েছিলো। বনির কথা ভাবতে গিয়ে ওর আর ঘুম এলো না। বিছানা থেকে উঠে একা হাঁটতে হাঁটতে মেজ বিবির মহলের কাছে এলো। বিচিত্র রঙের ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে, ছাদ থেকে ঝোলানো বিশাল সব বেলজিয়ান ঝাড় বাতি দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখে পড়লো মেজ বিবির মহলের মোটা থামের আড়াল থেকে ওরই বয়সী একটা মেয়ে লুকিয়ে ওকে দেখছে। মেয়েটার চোখ হালকা নীল, চুল সোনালি, দেখেই মনে হয় শেখদের কারো মেয়ে।

বিনি একটু এগিয়ে ইশারায় ওকে ডাকলো। আরব মেয়েটাও অবাক হয়ে বেরিয়ে এলো থামের আড়াল থেকে। বিনি ওকে ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি ইংরেজি বলতে পারো?

হ্যাঁ পারি। আমি আমেরিকান স্কুলে সিক্সথ গ্রেড-এ পড়ি।

বিনি হেসে নিজের নাম বলে মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করলো। মেয়েটা হেসে বললো, আমার নাম নাসরীন। তুমি এখানে কী করছো?

আমি বাংলাদেশের মেয়ে।

সেটা কোথায়?

ইন্ডিয়ার পাশে। তুমি ইন্ডিয়ার নাম শুনেছো?

শুনবো না কেন? আমি হিন্দি ছবি খুব পছন্দ করি। শাহরুখ খান আর মাধুরীকে আমার খুব ভালো লাগে।

আমিও হিন্দি ছবি খুব পছন্দ করি। শাহরুখ খান আর মাধুরী আমারও প্রিয়। তুমি কোন দেশের?

কোন দেশের কী বলছো? খিল খিল করে হেসে নাসরীন বললো, আমি শেখ আবদুল খালেকের মেয়ে। এটা আমার আম্মা খাদিজা খাতুনের মহল। তোমার বাবা মা নেই?

আমর সব আছে। বড় বিবিজির লোকরা আমাকে এখানে জোর করে ধরে এনেছে।

এখানে তো জোর করে কাউকে আনার নিয়ম নেই। নাসরীন গম্ভীর হয়ে বললো, তুমি সত্যি কথা বলছে তোতা?

আল্লার কসম বলছি নাসরীন। আমি যা বলছি এর এক বিন্দুও মিথ্যা নয়। এই বলে ওদের কীভাবে এখানে আনা হয়েছে নাসরীনকে সব বললো।

ওর কথা শুনে নাসরীন খুবই অবাক হলো–বড় বিবি সম্পর্কে অনেক খারাপ কথা শুনেছি। নফর বাদীদের ও মারধোর করে। ও যে এত খারাপ আমার জানা ছিলো না। দাঁড়াও আমার আম্মাকে বলি। তিনি আব্বাকে বলে তোমাকে দেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন।

বিনি আঁতকে উঠলো–প্লীজ তোমার আম্মা আব্বাকে বোলো না। তোমাকে আমি বিশ্বাস করে এ কথা বলেছি। তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙে দিও না।

তুমি নিশ্চয় এখানে চিরকাল থাকতে চাও না?

না চাই না। তবে এখান থেকে বেরোবার আগে আমার ভাই কোথায় আছে জানতে চাই। আমার সঙ্গে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ থেকে যেসব ছেলেমেয়েরা এসেছে। ওরা কোথায় আছে জানতে চাই।

নাসরীন একটু ভেবে বললো, আমার তিন নম্বর আম্মা আয়শা খাতুনেরও দাস বাজার থেকে ছেলে মেয়ে কেনার অভ্যাস আছে। আর আছে আমার চাচা শেখ জালাল। চাচার অনেক উট আছে রেস খেলার জন্য। চাচা রেস-এর জন্য বাচ্চা কেনে।

তোমার চাচা কোথায় থাকেন?

এখান থেকে বেশি দূর না। আমার এক চাচাতো ভাই ফয়সল আমার সঙ্গে পড়ে। ওকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে ওদের বাড়িতে তোমার ভাইকে আটকে রেখেছে কিনা।

তুমি অনেক দয়ালু নাসরীন। আমার আব্বু আম্মু নিশ্চয়ই তোমার জন্য দোয়া করবেন।

নাসরীন হেসে বললো, দোয়ার জন্য আমি তোমাকে সাহায্য করছি না। ওসব আমি বিশ্বাসও করি না। তোমার চেহারা দেখে মনে হয় আমি একটা ছোট মাধুরী দেখছি।

বিনি হেসে বললো, তোমাকে দেখে মনে হয় আকাশ থেকে বুঝি একটা পরি নেমে এসেছে।

নাসরীন কি বলতে যাবে হঠাৎ কিসের শব্দ শুনে ও চমকে উঠলো–শিগগির পালাও! কেউ আসছে এদিকে। কাল ঠিক এ সময়ে–বলে সাদা প্রজাপতির মতো উড়ে হারিয়ে গেলো ও।

বিনি দৌড়ে থামের আড়ালে সরে এলো। দেখলো নাসরীনদের মহলের এক বাদী বড় ট্রেতে করে ঢেকে কী যেন নিয়ে গেলো করিডোরের দিকে।

সন্ধ্যায় মাশকাতের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রঘুবীর সিং তাঁর বাড়িতে এক পার্টি দিয়েছিলেন। আমন্ত্রিত ছিলেন শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জাহেদ চৌধুরী আর পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হাসান গুল। পার্টিটা আসলে লোক দেখানো দিল্লী, ঢাকা আর ইসলামাবাদ থেকে কতগুলো সংবাদ পেয়ে তারা খুব চিন্তিত ছিলেন। তিন দেশের গোয়েন্দা বিভাগ থেকে তিনজন যুবকও এসেছে এই কাজে। বাংলাদেশের ইকবাল আগেই বলেছে কী ভাবে ওরা জানতে পেরেছে পাচার করা ছেলেমেয়েরা যে মাশকাত এসেছে। পাকিস্তানের এজাজ বললো, আজ সারাদিন আনি পোটে খোঁজ খবর নিয়েছি। তিন দিন আগে আল জেদ্দাহ শিপিং লাইন্স-এর যে জাহাজটা চিটাগাং থেকে বোম্বে, করাচী হয়ে এসেছে ওটা আজ ভোরে এডেন চলে গেছে।

ভারতের দীপক বললো, আমি এখানকার নিউজ এজেন্সিগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি। রয়টারের বুরো চীফ উটের রেস সম্পর্কে অনেক খবর জানে। বললো, মাশকাতের সবচেয়ে বড় রেস খেলনেওয়ালা হচ্ছে শেখ জালাল বিন মোত্তালিব। শহরের বাইরে মরুভূমির ভেতর ওর রেস খেলার মাঠ আছে। মাসে একবার হয় রেস। অন্য সব আরব দেশ থেকেও শেখরা আসে।

ভারতের রাষ্ট্রদূত রঘুবীর সিং বললেন, রয়টারের প্রতিনিধি আমাকে আগেও বলেছিলো। এদের পুলিসকে আমি জানিয়েছিলাম ব্যাপারটা। পুলিস চীফ আমাকে বললো ওরা খবর নিয়ে জেনেছে পশ্চিমা সাংবাদিকদের এসব বানানো রিপোর্ট। আজকাল উটের দৌড়ে মানুষের বাচ্চা ব্যবহার করা হয় না।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হাসান গুল নতুন এসেছেন। বললেন, আমি উটের রেসের কথা শুনেছি। কিন্তু বাচ্চা কীভাবে ব্যবহার করে এটা আমার বোধগম্য হয়নি।

ম্লান হেসে রঘুবীর সিং বললেন, ঈশ্বর না করুক–আমাকে যেন এমন দৃশ্য দেখতে না হয়। আমি পড়েছি বাচ্চাদের, ওরা উটের পেছনে বাঁধে। উট দৌড়োবার সময় বাচ্চারা উটের পেছনে বাড়ি খেয়ে কাঁদে। বাচ্চাদের কান্নায় উট ভয় পেয়ে জোরে দৈৗড়োয়। রেস শেষ হওয়ার আগেই হতভাগ্য বাচ্চাগুলো মারা যায়।

হাসান গুল শিউরে উঠে বললেন, মানুষ এত বর্বর হতে পারে?

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জাহেদ চৌধুরী তিক্ত হেসে বললেন, এরা র তো বুঝলাম। কিন্তু যারা আমাদের দেশ থেকে বাচ্চাদের চুরি করে নিয়ে শেখদের কাছে বিক্রি করছে তাদের আপনারা কী বলবেন? আমরা খবর পেয়েছি একাত্তরের যুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানের আমির দালালী করে হাজার হাজার মানুষ মেরেছে তাদের দলই এসব কাজ করছে।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বিব্রত গলায় বললেন, ওদের পাকিস্তানের সাধারণ মানুষরা ঘৃণা করে। আমাদের এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ওরা একটা সিটও পায়নি।

পাকিস্তানে ওরা হেরে গিয়ে বাংলাদেশকে ওদের ঘাঁটি বানাতে চাইছে।

বাংলাদেশের গোয়েন্দা ইকবাল আহমেদ বললো, স্যার আমরা রাজনৈতিক আলোচনা পরে করে এখন আমাদের অপারেশন সম্পর্কে কিছু কথা বলতে পারি।

হ্যাঁ ইকবাল, বলো তুমি কী ভেবেছো।

স্যার, কাল এখানে এসে কয়েক জায়গায় ঘুরে এটা আমার মনে হয়েছে এখানকার পুলিস খুবই করাপ্ট। ইন্টারপোল থেকে প্রেশার দেয়া না হলে এদের টনক নড়বে না। আমি কয়েকজন পশ্চিমা সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা শুধু সোর্স খুঁজছে কী ভাবে উটের রেসের বাচ্চাদের কাছে পৌঁছোনো যায় । আমি জানতে পেরেছি তিন দিন পরই শেখ জালালের রেস। যেভাবে হোক বাচ্চাগুলোকে এর আগেই উদ্ধার করতে হবে।

পাকিস্তানের গোয়েন্দা এজাজ খান বললো, এদের স্লেভ মার্কেটে আমি এক পাকিস্তানী খুঁজে পেয়েছি। ওকে টাকা দিতেই অনেক খবর দিয়েছে আমাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে–সে আমাকে সাতজন শেখের নাম দিয়েছে যারা স্লেভ মার্কেটের নিয়মিত খরিদ্দার। এদের ভেতর সবচেয়ে বড় খরিদ্দার হচ্ছে শেখ আবদুল জালাল বিন মোত্তালিব।

ভারতের দীপক বললো, আমাদের পিটিআইর গীতা শেরগিলকে বলেছি, কোনো ভাবে শেখ জালালের একটা সাক্ষাৎকার নিতে পারে কিনা। বলবে ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকা ওকে এর জন্য অ্যাসাইন করেছে । গীতা সুন্দরী আর শেখ জালালও ভারতীয় সুন্দরী পছন্দ করে। প্রতি মাসে নিজের জেট প্লেনে বোম্বে যায় রাত কাটাতে।

প্রৌঢ় রঘুবীর সিং বললেন, গত দুদিনে আমাদের তরুণ গোয়েন্দাদের কাজ খুবই সন্তোষজনক–এ কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে।

ইকবাল গম্ভীর হয়ে বললো, এক্সিলেন্সি, যতক্ষণ বাচ্চাদের উদ্ধার করতে না পারবো ততক্ষণ সন্তোষ প্রকাশের কোনও অবকাশ নেই।

রাত আটটার দিকে যখন লম্বামুখো ওদের খাবার খাইয়ে হাত টাত বেঁধে রেখে চলে গেছে তখন খুব সাবধানে দরজা খুলে বনিদের ঘরে ঢুকলো বারো তেরো বছরের এক আরব ছেলে। লম্বায় ওদের সবার চেয়ে বড়, টকটকে ফর্শা রঙ, চোখ দুটো গভীর নীল, চুল কোঁকড়া সোনালি, ঠোঁটে আঙুল চেপে ওদের চুপ থাকতে বললো। তারপর দরজাটা বন্ধ করে আসলামের কাছে বসে চাপা গলায় ইংরেজিতে জানতে চাইলো, তোমাদের এখানে বনি নামে কেউ আছে?

বনি অবাক হয়ে বললো, আমার নাম বনি। তুমি কে? আমার নাম জানলে কী ভাবে?

আমার নাম ফয়সল। মিষ্টি হেসে সুন্দর ছেলেটা বললো, আমার কাযিন নাসরীন আমাকে বিকেলে ফোন করে জানিয়েছে আমাদের বাসায় বনি নামের কোনো ছেলে আছে কি না। বনির বোন বিনি ওদের বাড়িতে আছে।

বনি উত্তেজিত হয়ে বললো, বিনি ভালো আছে?

হ্যাঁ ভালো আছে। ফয়সল বললো, নাসরীনের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ও বলেছে তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে তোমাদের দূতাবাসে পৌঁছে দিতে।

বনি বললো, তোমাকে ধন্যবাদ ফয়সল। আমি আসলাম, ইমরানদের এখানে রেখে কোথাও যাবো না।

ফয়সল বললো, সবাইকে এক সঙ্গে বের করা খুব মুশকিল হবে। তবু আমি চেষ্টা করবো। গত মাসেও আমি দুটো ছেলেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলাম।

আসলাম বললো, শুনেছি। সেজন্য দিন রাত আমাদের বেঁধে রাখা হয়।

বনি জানতে চাইলো আমরা–এখান থেকে বেরুবো কেমন করে?

ফয়সল একটু ভেবে বললো, দেখ, আমি শেখের ছেলে হলেও আঠারো বছর পর্যন্ত আমাদের প্রচণ্ড শাসনের ভেতর রাখা হয়। স্কুল আর বাড়ি ছাড়া একা কোথাও আমরা যেতে পারি না। স্কুলে আমেরিকান অ্যাম্বাসাডরের ছেলে ডেভিড আমার সঙ্গে পড়ে। আমার খুব ভালো বন্ধু। ওকে বলবো ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে। আমাদের আর্মির জেনারেলদের সঙ্গে ওর বাবার পরিচয় আছে। ডেভিড বলুক কিভাবে ওরা তোমাদের উদ্ধার করবে।

আর্মির দরকার কী? আমরা তো পুলিস স্টেশনে গিয়ে ওদের সাহায্য চাইতে পারি?

মাশকাতের পুলিসরা সব শেখদের চাকর। পুলিস চীফ রোজ এসে আব্বার সঙ্গে গল্প করে। আব্বার রেস খেলার সঙ্গীদের ভেতর সেও একজন।

তোমার আব্বা কি রোজ রেস খেলে?

না, মাসে একবার। রোজ খেলার জন্য এত বাচ্চা কোথায় পাবে?

যে সব বাচ্চাদের রেস খেলতে নেয় সবাইকে কী মেরে ফেলা হয়?

হ্যাঁ, সবাই মরে যায়।

তোমাদের দেশে আইন কানুন কি কিছুই নেই?

আইন তো আমার আব্বাদের মতো শেখরা তৈরি করে, তাদের রক্ষার জন্য। আর বাচ্চা আনে আফ্রিকা আর এশিয়ার গরিব দেশ থেকে, যাদের বাবা মা নেই, যারা খেতে পায় না।

আসলাম সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলো–আমরা কেউ গরিব নই। আমাদের বাবা মা সব আছে।

শেখদের বলা হয় তোমাদের রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে। না খেয়ে এমনিই মরে যেতে। কদিন খাইয়ে দাইয়ে তাজা করে রেস খেলানো হয়। তোমাদের দেশে কেউ কি এর প্রতিবাদ করে না?

জানি না করে কি না। আমি বড় হলে সব বন্ধ করে দেবো।

তুমি খুব ভালো ছেলে। আসলাম একটু হেসে বললো, বড় হতে এখনো তোমার অনেক দেরি। এখনকার মতো আমাদের পালাতে সাহায্য করো।

ফয়সল উঠে দাঁড়ালো–আমি কাল আসবো

.

১০.

পরদিন সকালে ইশকুলের ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই নাসরীন আর ডেভিডকে নিয়ে ফয়সল ছোট খাট একটা মিটিঙ সেরে ফেললো। নাসরীনকে ও রাতেই জানিয়েছে বনি যে ওদের বাড়িতে আছে। ডেভিডের কথা শুনে নাসরীন বলেছে, ঠিক আছে ডেভিডকে একটু আগে আসতে বলো ইশকুলে। আমরা ক্লাস শুরুর আগেই কথা বলবো।

পুরো ঘটনাটা ডেভিডকে জানিয়ে ফয়সল এই বলে কথা শেষ করলো, আমাদের এবং অন্য শেখদের বাড়িতে আটকে রাখা বিদেশী ছেলেমেয়েদের অবশ্যই উদ্ধার করতে হবে। আর এ কাজ দু দিনের মধ্যেই করতে হবে। পরশু উটের রেস।

হার্ডি সিক্স-এর মহা ভক্ত ডেভিড উত্তেজিত হয়ে বললো, বাবাকে এর মধ্যে আনার দরকার কী? আমরা তিনজন মিলে যদি একটা দল করি–ওদের উদ্ধার করা যাবে না?

নাসরীন ম্লান হেসে বললো, আমি যদি আরব শেখের মেয়ে না হয়ে তোমাদের দেশের কোনো সাধারণ মেয়েও হতাম তাহলে পারতাম। তুমি জানো না আমাদের কী রকমে কড়া শাসনের ভেতর রাখা হয়।

ফয়সল একই কথা বললো, ইশকুলের পর আমাকেও বাড়ি ফিরতে হয়। তোমার সঙ্গে কোথাও যাবো তার কোনো উপায় নেই।

এ নিয়ে ভেবো না। তোমরা নিজেদের বাড়িতে বসে কাজ করবে। আমরা তো টেলিফোন ব্যবহার করতে পারি। ছেলেমেয়েদের কোড ওয়ার্ড হবে কবুতর। আমরা কবুতর ওড়ানোর খেলা নিয়ে টেলিফোনে আলাপ করলে কেউ সন্দেহ করবে না।

তোমার বাবার সাহায্য দরকার ওদের দূতাবাসগুলোকে জানাবার জন্য। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে ঢুকে ওদের উদ্ধার করতে হলে আর্মির সাহায্য লাগবে।

শোন দূতাবাসেরও কোড ওয়ার্ড ঠিক করতে পারি। তিনটা দেশের ছেলেমেয়েই তো বেশি! ঠিক আছে ইণ্ডিয়ার দূতাবাসের কোড হবে আপেল গাছ, পাকিস্তানী দূতাবাসের কোড হবে খেজুর গাছ আর বাংলাদেশ হবে জলপাই গাছ।

নাসরীনের মাথায় এত সব কোড ওয়ার্ডের প্যাঁচ ঢুকলো না। শুকনো গলায় বললো, যাই করো না কেন ডেভিড, কোনো অবস্থায় এটা জানাজানি হওয়া ঠিক হবে না যে, আমরা ওদের পালাতে সাহায্য করেছি। তোমার কথা আলাদা। ফয়সল আর আমার ব্যাপারে বাড়ির কেউ জানতে পারলে কেটে দু টুকরো করে ফেলবে।

কাষ্ঠ হেসে ডেভিড বললো, ঠিক আছে নাসরীন! দলের লিডার হিসেবে আমি লক্ষ্য রাখবো তোমাদের কথা যেন কেউ জানতে না পারে। তোমাদের যা করার সেটা সবার চোখের আড়ালেই করবে।

ওদের ইশকুল ছুটি হয় বারোটায়। ঘরে ফিরে দুপুরের খাওয়া শেষ করে নাসরীন বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কতক্ষণে সবাই ঘুমোয়।

আড়াইটা নাগাদ নাসরীনের মনে হলো ওদের মহলটা একেবারে সুনসান হয়ে গেছে। পা টিপে টিপে ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

নি অধীর আগ্রহে থামের আড়ালে লুকিয়ে নাসরীনের জন্য অপেক্ষা করছিলো। ফাতিমাদের ও জানিয়েছে নাসরীনের সঙ্গে ওর পরিচয়ের কথা। ফাতিমারাও সেদিন দুপুরে ঘুমোয়নি। ওরাও অপেক্ষা করছিলো নাসরীনের সঙ্গে কথা বলে বিনি কখন ফেরে তার জন্য।

নাসরীনকে বারান্দায় দেখে বিনি আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। নাসরীন বললো, অনেকগুলো ভালো খবর আছে বিনি। প্রথম খবর হচ্ছে বনির সন্ধান পাওয়া গেছে। ওরা আছে ফয়সলদের বাড়িতে। দ্বিতীয় খবর হচ্ছে ফয়সল দায়িত্ব নিয়েছে বনিদের পালাবার সুযোগ করে দেয়ার। ওখানে অনেক বাচ্চা আছে। বনিদের সঙ্গে ও এ নিয়ে কথাও বলেছে। শেষ সুখবর হচ্ছে আজ রাতে আমি তোমাদের পালাবার ব্যবস্থা করে দেবো।

নাসরীনের কথা শুনে উত্তেজনায় বিনির বুকের ভেতর ধুপধুপ শব্দ হচ্ছিলো। তবে রাতে পালাবার আইডিয়াটা ওর ঠিক পছন্দ হলো না। বললো, তোমার সহযোগিতার জন্য অনেক ধন্যবাদ নাসরীন। কিন্তু রাতে কিভাবে পালাবো?

আমাদের ইশকুলের সিস্টার ইসাবেলার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি রাত দশটায় গাড়ি নিয়ে আমাদের বাড়ির পেছনের রাস্তায় অপেক্ষা করবেন। ওদিকে পাহারা কম থাকে। তিনি তোমাদের দূতাবাসে পৌঁছে দেবেন। তোমরা তৈরি থেকো। রাতে আমি আবার আসবো।

তুমি এ মহলে আসবে কী ভাবে?

প্রত্যেক মহলে কাজের লোকদের জন্যে পেছনে সিঁড়ি থাকে। আমি ঠিক দশটায় আসবো। রাত নয়টার পর আমাদের আম্মারা কেউ মহল থেকে বেরোয় না। এই বলে নাসরীন দ্রুত পায়ে সরে গেলো বারান্দা থেকে।

বিনি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে নাসরীনের সঙ্গে ওর যে কথা হয়েছে ফাতিমাদের সব খুলে বললো। ফাতিমা উত্তেজিত হয়ে বিনিকে জড়িয়ে ধরে বললো, বিনি তোমার জন্যই আমরা মুক্ত পৃথিবীর আলো বাতাস দেখতে পাবো।

আফজাল করুণ মুখে জানতে চাইলো, বিনি বাজী, ফয়সলদের বাড়িতে আমার বোন সীমা আছে?

নিশ্চয় আছে। ফয়সল বলেছে অনেক বাচ্চা আছে ওদের বাড়িতে।

সবাই পালাতে পারবে?

আমরা যদি এখান থেকে পালাতে পারি তাহলে অন্যরাও পারবে। না পারলে আমাদের সরকার আছে, দূতাবাস আছে। মনে সাহস আনো আফজাল।

রাতে খাবার দিতে এসে নুসরাত বাঁদী বললো, বেটিরা, তোমাদের জন্য সুখবর আছে। কাল থেকে তোমরা আলাদা ঘরে থাকবে, বড় বিবিজির খাস মহলে। এই ছোঁড়াটার ওপর বিবিজির নজর পড়েছে। বলে ফয়সলের গাল টিপে লাল করে দিয়ে ও চলে গেলো।

দিবা বললো, তার মানে আমরা যদি আজ রাতে পালাতে না পারি আর কোনো দিনই পারবো না।

ওরা সবাই জানে বড় বিবির খাস মহলে এত কড়া পাহারা যে, পিঁপড়ে পর্যন্ত পাহাড়াদারের নজর এড়িয়ে ঢুকতে পারবে না। নাকি শত শত কোটি টাকার হীরা জহরত আছে বড় বিবি জোহরা খাতুনের খাস মহলে। নিজের ছেলেমেয়ে নেই বলে দামী গহনা কেনা ওর বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব কথা ওরা শুনেছে নুসরাতের কাছ থেকে।

রাত ঠিক দশটায় নাসরীন এলো ওদেব কামরায়। ওর আব্বা আজ বড় বিবির মহলে থাকবেন। চাকর, বাদী পাহারাদার সব ওদিকে ব্যস্ত। বাদীরা যে রকম আলখাল্লার মতো পোশাক পরে নাসরীন ওরকম পোশাক পরে এসেছে। পোটলায় বেঁধে ওদের চার জনের জন্য একই রকম পোশাক এনেছে। সেগুলো বের করে বললো, তোমাদের পোষাকের ওপর ঝটপট পরে নাও। রাস্তায় বেরিয়ে খুলে ফেলো। মহলের বাদীদের রাস্তায় দেখলে লোকজনের সন্দেহ হতে পারে।

ফাতিমা পোশাক পরতে পরতে বললো, সন্দেহ হবে কেন? এটাই তো আমার কাছে নিরাপদ মনে হচ্ছে।

মহলের বাদীদের রাস্তায় বেরোনো বারণ। সংক্ষেপে জবাব দিলো নাসরীন।

বাঁদীদের পোষাক পরে দ্রুত পায়ে ওরা চারজন নাসরীনের পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পেছনের সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে একজন হাবসি পাহারাদারের পাল্লায় পড়েছিলো। পাহারাদার নিয়ম মতো জিজ্ঞেস করেছে–কে যায়?

ওর গম গমে গলা শুনে বিনিদের সবার হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গিয়েছিলো। নাসরীন সংক্ষেপে বললো, রসুলান বাদী।

ঠিক আছে যাও।

ফাতিমা লক্ষ্য করেছে পাহারাদারের আরবি বলার ঢং অন্যরকম। নাসরীনও ঠিক একই ঢংয়ে জবাব দিয়েছে।

পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে দুপাশে পাথরের দেয়ালের মাঝখান দিয়ে সরু একটা পথ দৌড়ে পেরিয়ে ওরা খিড়কি দরজায় এলো। চাপা উত্তেজিত গলায় নাসরীন বললো, ঝটপট পোশাক খুলে ফেলো।

বিনি পোশাক খুলেই নাসরীনকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তোমাকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা আমাদের জানা নেই। আমরা চিরকাল তোমার কথা মনে রাখবো।

নাসরীন বললো, আমি তোমাকে চিঠি লিখবো বিনি। এবার জলদী বেরোও।

দরজা খুলে ওদের একরকম ঠেলে বের করে নাসরীন দরজা লাগিয়ে দিলো। জনশূন্য রাস্তা! সিস্টার ইসাবেলা কিংবা তার গাড়ির কোনো পাত্তা নেই। দিবা ভয় পেয়ে ফিশ ফিশ করে বললো, নাসরীন কি মিথ্যে কথা বলেছে? কোথায় সিস্টার?

এখানে পঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। দৌড়াও। বলে সবার আগে দৌড় দিলো বিনি।

ওরা কোথায় যাচ্ছে কিছু না জেনেই বিনির পেছন পেছন দৌড়োচ্ছিলো। ভরসা এইটুকু, গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠলে লোকজনের দেখা পাওয়া যাবে। মাশকাতের সব লোক নিশ্চয় শেখদের মতো পাজী নয়।

গলির একটা মোড় পেরোতেই একজনের সঙ্গে ধাক্কা খেতে গিয়ে নিজেকে কোনো বকমে সামলে নিলো বিনি। তাকিয়ে দেখলো চশমা পরা গির্জার একজন নান। চেহারা দেখে মনে হয় লেবানিজ অথবা মিশরীয় হবেন। বিনি হাঁপাতে হাঁপাতে দ্রুত জিজ্ঞেস করলো, আনা ফি মাশকিলাত। উন সুর নী আনা তালাবতু রাজুলান মাহেরুন ফিল আংকেলিজিয়া।

সরি মাই চাইল্ড। অসহায় গলায় সিস্টার বললেন, আমি আরবী বলতে পারি না।

আপনি ইংরেজি বলতে পারেন? বিনি যেন হাতে চাঁদ পেলো।

ইজি মাই চাইল্ড। বলে ওর পিঠে হাত রেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন–তোমরা কি বিপদে পড়েছো?

আমরা সিস্টার ইসরাবেলাকে খুঁজছি। আপনি কি বলতে পারবেন কোথায় গেলে তাঁকে পাবো।

ওহ গড। আমি সিস্টার ইসাবেলা। তোমরাই কি শেখের বাড়িতে বন্দী ছিলে?

হ্যাঁ সিস্টার। আমার নাম বিনি। এরা ফাতেমা, দিবা আর আফজাল! বিনি ভেবেছিলো সিস্টার ইসাবেলা যখন আমেরিকান স্কুলে পড়ান তখন তিনিও নিশ্চয় আমেরিকান হবেন।

জলদি, এসো আমার সঙ্গে। কথা না বাড়িয়ে সিস্টার ইসাবেলা বিনি আর আফজালকে দুহাতে ধরে একরকম দৌড়ে গেলেন বড় রাস্তার দিকে।

সিস্টারের গাড়ি বড় রাস্তার ওপর রাখা ছিলো। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে সিস্টার বললেন, গলির ভেতর গাড়ি ঢোকাতে দিলো না পুলিস। জানোই তো শেখদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কত শক্তিশালী। ভাগ্যিস তোমাদের সঙ্গে দেখা হলো! নইলে আমাকে খুঁজতে গিয়ে কোন বিপদে পড়তে কে জানে!

বিনি বললো, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সিস্টার। আমাদের জন্য আপনি এত কষ্ট করলেন!

ধন্যবাদ দিতে হলে ডেভিডকে দিও। ও না বললে আমি কি জানতাম তোমরা এমন বিপদে পড়েছো!

ফাতিমা বললো, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি সিস্টার?

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায়। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে আজ সন্ধ্যায়। ওখানে পাকিস্তান আর ভারতের রাষ্ট্রদূতরাও থাকবেন।

বিনি জানতে চাইলো, শেখ জালালের বাড়িতে যারা বন্দী আছে তাদের কীভাবে উদ্ধার করা হবে?

আমার ধারণা এতক্ষণে তাদেরও উদ্ধার করা হয়েছে। তোমাদের দেশ থেকে দারুণ বুদ্ধিমান এক গোয়েন্দা এসেছে। তারই বুদ্ধিতে এসব হয়েছে।

মাশকাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাড়ির পেছনের বিরাট লনে তখন দারুণ হৈচৈ কাণ্ড! ইউরোপ আমেরিকার টেলিভিশন নেটওয়ার্কের লোকজন, সাংবাদিক, ফ্লাড লাইট আর ঘন ঘন ফ্লাশের আলোতে হুলস্থুল অবস্থা। শেখ জালাল আর তার দুই বন্ধুর বাড়ি থেকে এশিয়ার কয়েকটি দেশের আড়াইশ ছেলেমেয়ে উদ্ধার হয়েছে।

ছেলেমেয়েরা কোথায় আছে জানার পর ইন্টারপোলের অফিসারদের সঙ্গে বসে প্ল্যান করেছে ইকবাল, এজাজ আর দীপক। শেখ জালাল প্রচণ্ড ক্ষমতাবান লোক। তার গায়ে আঁচড় কাটার ক্ষমতা বাদশারও নেই। তিন গোয়েন্দা পরামর্শ করে বুদ্ধি বের করেছে কীভাবে শেখকে কিছু না বলে কাজ উদ্ধার করা যায়।

সন্ধ্যায় ইন্টারপোলের অফিসার শেখ জালালের সঙ্গে দেখা করে বলেছে, অনারেবল শেখ বোধহয় জানেন না, তার অগোচরে তারই কিছু বাংলাদেশী আর পাকিস্তানী কর্মচারী কী ভয়ানক এক ব্যবসা ফেঁদেছে!

তাই নাকি! অবাক হয়ে শেখ জানতে চেয়েছেন–কিসের ব্যবসা!

মানুষের বাচ্চা কেনা বেচার। এই কর্মচারীরা এমনই শয়তান এ কাজে শেখ জালালের সুনাম পর্যন্ত ওরা জড়িয়েছে। প্রাসাদের বিভিন্ন অংশে কিছু রক্ষীকে হাত করে ওরা বাচ্চাদের লুকিয়ে রেখেছে। শেখ জালাল যদি অনুমতি দেন এসব বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীদের গ্রেফতার করে বাচ্চাগুলো উদ্ধার করি!

শেখ জালাল নিজের সুনাম বাঁচাবার জন্য সঙ্গে সঙ্গে বললেন, নিশ্চয়ই অফিসার। বদমাশগুলোকে গ্রেফতার করে আমার হাতে তুলে দিন। ওদের আমি কঠিন সাজা দেবো। শিগগির বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করে আমার সম্মান রক্ষা করুন।

ওরা শুধু আপনার সম্মান নয়, শেখ আজিজ আর শেখ বশীরের সম্মানও এর সঙ্গে জড়িয়েছে।

ইন্টারপোলের অফিসার কী ইঙ্গিত করছে বুঝতে অসুবিধে হয়নি শেখ জালালের। বললেন, আমি এক্ষুণি শেখ বশীর আর শেখ আজিজকে জানিয়ে দিচ্ছি আপনাদের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য।

ফয়সল আগেই টেলিফোনে ডেভিডকে জানিয়ে রেখেছিলো কোন কবুতর কোন খোপে আছে। ওদের খুঁজে বের করতে এতটুকু বেগ পেতে হয়নি।

সিস্টার ইসাবেলার গাড়ি থেকে বিনিকে নামতে দেখে বনি ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, আপু, একটু আগে আব্ব, আম্মু আর বড় চাচীর সঙ্গে কথা বলেছি। ওরা আমাদের নিতে আসবে।

ফয়সলকে দেখে ছুটে এলো সীমা। ভাইয়া তুমি কোথায় ছিলে, বলে ওর সে কী কান্না। সিস্টার ইসাবেলা পকেট থেকে টফি বের করে ওর মুখে গুঁজে দিয়ে সেই কান্না থামালেন ।

একটু পরেই আমেরিকান পতাকা উড়িয়ে মস্ত লম্বা এক ইমপালা এসে থামলো পোর্টিকোর নিচে। বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতরা এগিয়ে গেলেন। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত টমাস মর্গান গাড়ি থেকে নেমে তিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, খবর না দিয়ে পার্টিতে যোগ দিচ্ছি বলে আশা করি কিছু মনে করবেন না। আমার ক্ষুদে শয়তানটার অত্যাচারে আসতে হলো।

গাড়ি থেকে ডেভিড আর ডেভিডের মা-ও নামলেন। মিসেস মর্গান বললেন, ক্ষুদে শয়তান কী করেছে সেটা না বললে ওঁরা বুঝবেন কেন?

ডেভিড বললো, মা, এটা টপ সিক্রেট, তোমাকে বলিনি!

মিসেস মর্গান আঁতকে ওঠার ভান করে বললেন, দুঃখিত, আমার একদম মনে ছিলো না।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী মিসেস চৌধুরী এগিয়ে এসে মিসেস মর্গানকে লনের দিকে নিয়ে গেলেন। টমাস মর্গান তিন রাষ্ট্রদূতকে বললেন, আসুন, আমরা এই ফাঁকে আলোচনা করে ঠিক করি এসব বর্বরতা চিরদিনের জন্য বন্ধ করার ক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি। সাংবাদিকরা সবাই এখানে আছে। ওরা নিশ্চয়ই জানতে চাইবে।

ডেভিড চারপাশে তাকিয়ে বনিকে বললো, কই এত কথা শুনলাম তোমার বোনের, বিনি কোথায়?

এই যে আমি। বিনি এগিয়ে এসে ডেভিডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললো, নাসরীনের কাছে আমি শুনেছি–তুমি আমাদের জন্য যা করেছে।

বিনি কথা শেষ করতে পারলো না। ডেভিড নিচু গলায়–যেন ষড়যন্ত্র করছে, এমনভাবে বললো, বিনি, আমরা কেউ কিছু করিনিঃ নাসরীন, ফয়সল, আমি কেউ না! অফিসিয়ালি ধন্যবাদ দাও সিস্টার ইসাবেলা আর তিন গোয়েন্দাকে।

বিনি মৃদু হেসে বললো, সিস্টার, আমি আপনার কেয়ারে আমাদের তিন নেপথ্য বন্ধুকে চিঠি লিখবো।

দিবা আর ফাতিমা এগিয়ে এসে বললো, তুমি একা কেন লিখবে? এত স্বার্থপর কেন তুমি? আমরা সবাই ডেভিডদের চিঠি লিখবো।

ডেভিড আঁতকে ওঠার ভান করলো তার মানে আড়াইশ চিঠি! সিস্টার, আমি পাগল হয়ে যাবো!

ডেভিডের কথা শুনে সবার সঙ্গে সিস্টার ইসাবেলাও গলা খুলে হাসলেন।