সন্ধের পর আজও শেষ ডাউন গাড়ি ইস্টিশান ছেড়ে কু-ঝিক-ঝিক শব্দ তুলে চলে গেল। একটু বাদেই প্রতিপদের চাঁদ একগাল হাসি ছড়িয়ে আকাশে উঠে পড়ল। একপাল শেয়াল চেঁচিয়ে উঠল কোথায় যেন, আর সেই শব্দে পাড়ার কুকুরগুলো ধমক-ধামক শুরু করে দিল। আর হঠাৎ এ-সময়ে করুণ সুরে ডেকে উঠল ফেউ। সবাই জানে ফেউ হল বাঘের সঙ্গ।
ফেউয়ের ডাক মিলিয়ে যেতে না যেতেই ‘ঘ্রা-আ-ড়া-ড়া-ম ডাকে কেঁপে উঠল চারদিক। সেই শব্দে সন্ধেরাতেই লোকালয়ে নিশুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে। যে যার ঘরে বসে প্রাণভয়ে কাঁপে।
শহরের দক্ষিণ ধারে ভয়ংকর গোঁসাইবাগানের ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে নিঃশব্দে অকুতোভয়ে এগিয়ে চলেছেন কালী স্যার। কাঁধে জ্যাভেলিন। রাম কবিরাজ করালীবাবুর গায়ে একটা ভারি দুর্গন্ধ তেল মাখিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, শীতের রাতে ঠাণ্ডা জলে নামতে আর ভয় রইল না। এ ভারি দুষ্প্রাপ্য তেল। এটা মেখে দক্ষিণ মেরুতে গেলেও নিউমোনিয়া ধরবে না। তা, তেলটা বোধহয় ভালই হবে, কিন্তু ভারি বিশ্রী গন্ধ। কবিরাজমশাই করালীবাবুকে খানিকটা পাঁচনও খাইয়ে দিয়েছেন। সে পাঁচনটাও খেতে বিশ্রী। কিন্তু সেটা খাওয়ার পর থেকে মনটায় খুব ফুর্তি পাচ্ছেন করালীবাবু, আর মাথাটাও ঠাণ্ডা রয়েছে।
নিঃশব্দে সমুদ্রদিঘির ধারে এসে পৌঁছলেন করালী স্যার। একটা বাঁশঝোঁপের আড়ালে ছায়ায় দাঁড়িয়ে চারিদিকটা একটু হিসেব করে নিলেন। চারদিক ছমছম করছে। জ্যোৎস্নার মুখে যেন একটা ভুতুড়ে কুয়াশার ঠুলি। চারপাশে যেন ছায়া-ছায়া অশরীরী ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু ভয়-ভয় করল করালীবাবুর। মনে-মনে একটা রুটওভার করে ফেলতেই ভয়টা কেটে গেল। দিঘিটা সমুদ্রের মতোই বিশাল বটে। কিন্তু তাঁকে অতটা পার হতে হবে না। কবিরাজমশাইয়ের কথামতো ঠিক নিশানায় হেঁটে তিনি পশ্চিম দিকের ধারে চলে এসেছেন। এখান থেকে দক্ষিণের ঘাটে স্থলপথে যাওয়া আর নিরাপদ নয়। যেতে হবে জলে নেমে সাঁতরে। করালীবাবু হিসেব করে দেখলেন, এখান থেকে আগাগোড়া ডুব-সাঁতারে যেতে কম করে বিশ মিনিট লাগবে।
কিন্তু তাতে ঘাবড়ালেন না মোটই। শুধু জলে নামার আগে বাঁশঝোঁপের আড়ালে বসে মনে-মনে খুব শক্ত একটা ইকোয়েশন কষে ফেললেন।
তারপর জামা কাপড় খুলে শুধু একটা হাফপ্যান্ট-পরা অবস্থায় বাঁশঝোঁপের ছায়া থেকে সাপের মতো বুকে হেঁটে জ্যাভেলিন সমেত নিঃশব্দে জলে নেমে গেলেন করালীবাবু।
একটু শীত ছিল বটে, কিন্তু সে তেমন কিছু নয়। তবে অসুবিধে হচ্ছিল জলের তলাটা অন্ধকার বলে। কোনদিকে যাচ্ছেন, ঠিক নিশানায় এগোচ্ছেন কিনা তা বুঝতে পারছিলেন না। তবু নিঃশব্দে এগিয়ে চললেন। হঠাৎ টের পেলেন, তাঁর আশেপাশে খুব বড় বড় ডুবোজাহাজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আতঙ্কে হিম হয়ে গেল তাঁর গা। সর্বনাশ! শত্রুপক্ষের যে ডুবোজাহাজ আছে, তা তো জানা ছিল না! তাড়াতাড়ি ভেসে উঠলেন করালীবাবু। আকাশে চাঁদের দিকে চেয়ে দশ লক্ষ দশ হাজার দশকে তিন লক্ষ তিন হাজার তিন দিয়ে ভাগ করে ফেললেন মনে-মনে। মনটা ভাল হয়ে গেল। ভাল করে চারদিকে চেয়ে দেখলেন, দক্ষিণের ঘাটে যেতে এখনও বেশ খানিকটা পথ বাকি। জ্যাভেলিনটা বাগিয়ে ধরে আবার ডুব দিতেই ভুল ভাঙল। ডুবোজাহাজ বলে যেগুলোকে ভেবেছিলেন, সেগুলো আসলে সমুদ্রদিঘির বিখ্যাত কালবোশ, চিতল, বোয়াল, কাতলা আর পাকা রুই মাছ। এ-দিঘির মাছ কেউ ভয়ে ধরে না, তাই বহুঁকাল ধরে বেড়ে-বেড়ে মাছগুলোর চেহারা হয়েছে পেল্লায়, গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে।
আর একবার দম নিতে উঠে ফের ডুব দিতেই করালীবাবু এক্কেবারে মুখোমুখি দেখেন, এক বিকট মূর্তি বিশাল পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিকট দাঁত দেখিয়ে হাসছেও। করালীবাবু জ্যাভেলিন বাগিয়ে ধরে মনে-মনে আর একটা ইকোয়েশন করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভয়ে কিছু মনেই পড়ল না। বিকট মূর্তিটা জ্যাভেলিন বাগানো দেখেও ভয় খায়নি, হাত-পা ছড়িয়ে হাসছে। কিন্তু একটুও নড়েনি। করালীবাবু সাহস পেয়ে আর-একটু কাছে এগিয়ে দেখেন, ও হরি! এ যে সদ্য বিসর্জন-দেওয়া একটা কালীমূর্তি! এখনো কাঠামো থেকে মাটি বা রঙ খসেনি ভাল করে।
তিন নম্বর শ্বাস নিয়ে দম ধরে করালীবাবু দক্ষিণের ঘাট বরাবর পৌঁছে খুব সন্তর্পণে যেই আর-একবার শ্বাস নেওয়ার জন্য মাথা তুলেছেন অমনি খুব কাছেই বাজ-ডাকার মতো বাঘ ডাকল ‘ঘ্রা-ড়া-ড়া-ম্-ম্?”
সেই ডাকে খানিকটা অবশ হয়ে গিয়ে ডুব দিতে ভুলেই গেলেন করালীবাবু। খোলামেলা ঘাটের কাছে, জ্যোৎস্নায় বোকার মতো মাথা উঁচু করে রয়েছেন। হঠাৎ ঘাটের পৈঠায় এক বিশাল চেহারার মানুষের ছায়া দেখা গেল। লোকটা হুংকার দিয়ে বলে উঠল, “কে রে?”
করালীবাবু টুপ করে ডুব দিলেন। আসলে নিজের ইচ্ছেয় যে ডুব দিলেন তা নয়, মনে হল কে যেন তার ঠ্যাং ধরে জলের নীচে টেনে নিয়ে ছেড়ে দিল। ভাগ্যিস টানল! নইলে তাঁর শরীর এমন আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ডুব দেওয়ারও ক্ষমতা ছিল না।
জলের নীচে ছয় নম্বর ডুবো সিঁড়িটা খুঁজতে আরও কিছু সময় লাগত। কিন্তু মজা হল, করালীবাবু ডুববার সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন তাঁর হাতের জ্যাভেলিনটা ধরে খুব আস্তে তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটা ফাটলের মুখে ছেড়ে দিল।
কী হচ্ছে, ধরা পড়ে গেছেন কিনা, তা বুঝতে পারছিলেন না করালীবাবু। কিন্তু ভাববার সময় নেই। মনে মনে একটা সহজ ফ্যাক্টর কষে নিয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে কয়েক কদম হাঁটতেই একটা পথ পেলেন : এখানে জল কোমর-সমান। পথটা উঁচু হয়ে উঠে গেছে, ঘোর অন্ধকারেও হাতড়ে-হাতড়ে বুঝলেন।
খুব দূর থেকে একটা সোরগোলের আওয়াজ আসছে। ওরা কি তবে টের পেল?
সময় নেই। করালীবাবু জ্যাভেলিন হাতে অন্ধকারে পথটা বেয়ে উঠে গেলেন। নিখাদ অন্ধকার একটা সুড়ঙ্গ। পদে পদে নুড়ি পাথর, শ্যাওলা, ঘুমন্ত ব্যাঙ পায়ের নীচে টের পাচ্ছেন। একটা সাপকেও কি মাড়ালেন? কে জানে! তবে করালীবাবু এগিয়ে গেলেন ঠিকই। অন্ধকারে ক্যালকুলেশন চলে না বলে বারকয়েক আছাড়ও খেলেন। তবু এগোলেন। বেশি দূর যেতে হল না। পাঁচ-নম্বর আছাড়ের পর সোজা গিয়ে একটা দরজায় সজোরে ধাক্কা খেয়ে “বাবা রে” বলে বসে পড়লেন।
কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই। হাতড়ে দেখেন দরজার গায়ে পুরনো তালা ঝুলছে। এক মুহূর্ত চিন্তা না করে জ্যাভেলিনের ফলাটা তালার ভিতরে ঢুকিয়ে চাড় দিতেই মরচে-ধরা তালা হড়াক করে খুলে গেল।
ঘরের ভিতর কোনও আলো ছিল না, তবে অনেক ওপরের একটা বড় ঘুলঘুলি দিয়ে পুরো চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। আর চাঁদটা ঠিক টর্চের মতো ফোকাস ফেলেছে সোজা বুরুনের মুখের ওপর। করালীবাবু দেখেন, একটা চটের বিছানায় পাশাপাশি বুরুন আর ভুতুম শুয়ে ঘুমোচ্ছে। খুব শান্ত মুখ, মুখে একটু হাসি, তবে আবছা আলোতেও বোঝা যায়, ওরা খুব দুর্বল। একটুও নাড়াচাড়া বুঝি সইবে না। দু’দিনেই রোগা হয়ে গেছে ছেলে দুটো।
বুরুনকে একটা কথা বলতে হবে। রাম কবিরাজ কথাটা বারবার শিখিয়ে দিয়েছেন করালীবাবুকে। কিন্তু কথাটা এতই সামান্য, এতই ছেলেমানুষী যে, সে কথাটা বুরুনকে বলার কোনও মানেই হয় না। অথচ রামবাবু বারবার তাঁকে বলে দিয়েছেন যে, এই বাক্যটা নাকি বুরুনের পক্ষে মন্ত্রের মতো কাজ করবে। কবিরাজমশাই বিচক্ষণ মানুষ। তাঁর ওপরে কথাও চলে না।
কথাটা বলার জন্য করালীবাবু আস্তে আস্তে বুরুনের শিয়রের কাছে এগিয়ে গেলেন। হাঁটু গেড়ে বসলেন। খুবই সোজা কথা। কবিরাজমশাই বলে দিয়েছেন, একটু চেঁচিয়ে নামতার সুরে কথাটা বার কয়েক আওড়াতে হবে। কবিরাজমশাই বারবার জিগ্যেস করেছিলেন, “কথাটা মনে থাকবে তো কালীবাবু? ভুলে যাবেন না তো? যতই সামান্য শোনাক, এ-কথাটা কিন্তু বুরুনের বেঁচে থাকার পক্ষে খুব জরুরি।”
ফুঁ! তখন হেসেছিলেন করালীবাবু। এর চেয়ে কত শক্ত শক্ত কথা তার মনে থাকে। আর এ তো কোনও কথাই নয়। জলের মতো সোজা একটা বাক্য। নামতার সুরে বলতে হবে।
ঘরের বাইরে হঠাৎ খুব কাছেই আবার ‘ঘ্রা-ড়া-ড়া-ড়া-হু-উ-ম’ করে ডাক শোনা গেল, আর একটা ধীর ভারী পায়ের শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল।
সময় নেই, করালীবাবু বুরুনের কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব চেঁচিয়ে কথাটা বলতে গিয়েই বিস্ময়ে থ’ হয়ে গেলেন। কথাটা তাঁর একদম মনে নেই! বেমালুম ভুলে গেছেন।
‘ঘ্রা-ড়া-ড়া-ড়া-ড়া–হু-উ-ম! আবার ডাকল বাঘটা। এবার খুব কাছেই। পায়ের শব্দটাও এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে।
করালীবাবু নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলছেন রাগে। কথাটা কিছুতেই মনে পড়ছে না যে…হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা শব্দ ছিল…অঙ্ক…আর একটা যে কী যেন…তেরো…তেরো…হ্যাঁ…।
ওদিকে আর একটা দরজা। সেই দরজার লোহার হুড়কো খোলার শব্দ হচ্ছে।
করালীবাবুর হাতের খামচায় একগোছা চুল তাঁর মাথা থেকে উপড়ে এল। …তেরো..তেরো..তেরো… নামতার সুরে… বুরুন…বুরুন…বুরুন…
দরজার পাল্লাটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একটা মশালের হলুদ আলো দেখা দিল দরজার ফাঁকে। এক মস্ত চেহারার রক্তাম্বর-পরা লোক পাথরের মতো মুখে মশাল উঁচুতে তুলে ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। তার পিছনে বিশাল ডোরাকাটা কালো-হলুদ বাঘ।
করালীবাবুর অবশ হাত থেকে জ্যাভেলিনটা পড়ে গেল মেঝেয়। বিস্ময়ে হাঁ করে আছেন, মাথাটা ফাঁকা।
বাঘটা ডাকল–ঘ্র-ড়-ড়-অ…
কী সাংঘাতিক রক্ত-জল-করা ডাক!
করালীবাবু অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। যেতেনই, তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে পুরো বাক্যটা মনে পড়ে গেল।
সঙ্গে-সঙ্গে করালীবাবু পাঠশালার সদার-পোড়োর মতো বিকট সুরে চেঁচাতে লাগলেন, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি…”
পাথরের মতো বিশাল চেহারার লোকটা এগিয়ে আসতে-আসতে হুঙ্কার দিল, “মা! মা গো! নর-রক্ত চাস মা? শব-সাধনা চাস মা? আজ তোর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।”
করালীবাবু সব ভুলে গেছেন, নিজের নামটাও মনে নেই। কিন্তু তিনি একনাগাড়ে নিখুত নামতার সুরে প্রাণপণে বলেই চলেছেন, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো..”
“ঘ্রা-ড়া-ড়া-ড়া-হু-উ-ম্!”
“তারা! তারা! মা!”
“ঘ্রা-ড়া-ড়া-হু-উ-ম!” বলে আর একবার ডাক ছেড়ে বাঘটা বিদ্যুৎ-বেগে লাফিয়ে পড়ল সামনে।
করালীবাবু শুধু টের পেলেন যে, বাঘটা তাঁর প্যান্টের কোমর কামড়ে ধরে পুঁটিমাছের মতো মুখে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর সেই বিশাল লোকটা হুঙ্কার দিয়ে বলছে, “তারা! তারা!”
করালীবাবু বাঘের মুখ থেকে ঝুলে থেকেও প্রচণ্ড চেঁচিয়ে বলে যেতে লাগলেন, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি…”
.
ছোট্ট একটা খেলনা-অ্যারোপ্লেনে করে বুরুন আর ভুতুম চাঁদের রাজ্যে চলে এসেছে। ভারি সুন্দর সোনালি মাঠ এখানে। সোনালি গাছপালা, সোনা রঙের ঘাস, আকাশে সোনা-ছড়ানো আলো।
চাঁদের বুড়ি চরকা থামিয়ে তাদের জন্য পিঠে বানাতে বসেছে। বুরুন আর ভুতুম চলল ততক্ষণে কাছের ছোট একটা রুপোলি পাহাড়ের জলে স্নান করতে।
চারদিকে পাখি ডাকছে। ময়ূর উড়ে বেড়াচ্ছে। মেঘের ভেলায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। চারদিকে খেলা, ম্যাজিক, চড়ইভাতি, সাকাস, আইসক্রিম। পড়াশুনোর বালাই নেই, ইস্কুল-পাঠশালা নেই। শুধু মজা আর মজা!
ভুতুম বলল, “বুরুনদা, আমরা কিন্তু কোনও দিন ফিরে যাব না!”
“দুর! কে ফিরবে?”
বুরুন আর ভুতুম ম্যাজিক দেখল, সাকাস দেখল, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলল, আইসক্রিম খেতে খেতে গিয়ে ঝরনার জলে ইচ্ছেমতো স্নান করল, ঝরনার নীচে একটা সুন্দর পুকুরে সাঁতার কাটতে লাগল।
হঠাৎ বুরুন শুনতে পেল, এত আনন্দ আর অফুরন্ত মজার মধ্যে কে যেন হঠাৎ রসভঙ্গ করে বলে উঠল, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো?”
দপ করে যেন চারদিকের আনন্দের আলোটা নিবে গেল বুরুনের চোখে। মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। চারদিকে চেয়ে কথাটা কে বলল, সে তা খুঁজছিল। সন্দেহবশে একটা পাখিকে ঢিল মেরে তাড়িয়ে দিল বুরুন। কিন্তু তবু কে যেন আবার বলে উঠল, “বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো?”
ভারি রেগে গেল বুরুন। ভীষণ চেঁচিয়ে বলল, “ভাল হবে না বলছি!”
কিন্তু আবার আড়াল থেকে, আবডাল থেকে, বাতাস থেকে, আকাশ থেকে কথাটা আসতেই লাগল, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো!”
রাগে বুরুন দশখানা হয়ে গেল। এক লাফে ঝরনার জল থেকে উঠে বড় বড় ঢিল তুলে চারদিকে ছোঁড়ে আর চেঁচায়, “ভাল হবে না বলে দিচ্ছি! সব ভেঙে ফেলব! সব নষ্ট করে দেব!”
পায়ের নীচে মাটি বলে উঠল, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো!”
পাহাড় বলে ওঠে, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো।”
তারপর সমস্বরে গাছপালা, পাখি, নদী, জল, চাঁদ, মেঘ সবাই নামতার সুরে বলতে থাকে, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন তুমি অঙ্কে তেরো! বুরুন তুমি…”
রাগের চোটে বুরুন একটা গাছ উপড়ে নেয়! তারপর দুহাতে ধরে এলোপাতাড়ি চারদিকের সব কিছু ভাঙতে থাকে। আকাশ ভাঙে, পাহাড় ভাঙে, মাটি ভাঙে… ভাঙতে… ভাঙতে… ভাঙতে… চারদিকের সব ফাঁকা হয়ে যায়। …সব মিলিয়ে যায়।
পাতালঘরে আস্তে বুরুন চোখ মেলে তাকায়। তাকিয়েই বুঝতে পারে, তার ওপর এতক্ষণ যে স্বপ্নের ভার চাপানো ছিল, তা সরে গেছে!
তার কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বলে ওঠে, “বুরুন, এই প্রথম একজন নিজের শক্তিতে হাবুর মন্ত্র কেটে বেরিয়ে আসতে পারল। সাবাশ! হাবুর আর কোনও ক্ষমতাই রইল না। যেই মুহূর্তে হাবুর মন্ত্র তুমি কেটেছ, সেই মুহূর্তেই হাবুর সব শক্তি চলে গেছে।”
বুরুন বলল, “নিধিদা!”
কিন্তু নিধিরাম তখন কোথায়! পলকে বাতাসের বেগে সে ছুটে গেছে তার দলবলকে খবর দিতে।
সুড়ঙ্গ ধরে মশাল-হাতে হাবু উঠছিল ওপরে। সামনে ভয়াল বাঘ। বাঘের মুখে করালীবাবু ঝুলছেন। ঝুলতে ঝুলতে তখনও অস্ফুট স্বরে বলছেন “বুরুন, তুমি…”
হঠাৎ বাঘটা থেমে করালীবাবুকে যত্নের সঙ্গে মাটিতে শুইয়ে দিল। তারপর আস্তে-আস্তে ঘুরে হাবুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিশাল
হাঁ করে গম্ভীর স্বরে ডাকল, “ঘ্রা-ড়া-ড়া-হু-উ-ম!”
বাঘের দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে, জিভ দিয়ে নাল গড়াচ্ছে, গোঁফজোড়া কাঁটার মতো খাড়া হয়ে আছে।
আর সেই মুহূর্তে বাতাসে প্রচণ্ড কোলাহল করে ভূতেরা বলে উঠল, “হাবু, তুমি এবার মরো! হাবু, তুমি এবার মরো! হাবু, তুমি এবার মরো!” হুবহু করালীবাবুর নামতার সুর।
এক মুহূর্ত ‘থ’ হয়ে থেকে পরমুহূর্তেই হাবু বুঝতে পারল, তার মন্ত্র আর কাজ করছে না। যাদের সে বশ করে রেখেছিল এতকাল, তারা সব রুখে দাঁড়িয়েছে।
হাবুর জীবনে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। গদাই-দারোগার হাতে সে একবার বোকা বনেছিল বটে, কিন্তু তা বলে গদাই তার মন্ত্র কাটতে পারেনি। সাকাসের বাঘ ধরে এনে সাহসী গদাই তার পিঠে চেপে গোঁসাইবাগানে এমনভাবে দেখা দিয়েছিল যে, হাবু ভেবেছিল গদাই বুঝি বেজায় মন্ত্রসিদ্ধ গুণী লোক। ঘাবড়ে গিয়ে হাবু বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিল, তাই তার মন্ত্রতন্ত্র কাজ করেনি। কিন্তু তারপর জেলখানায় বসে গোপনে সে আরও চর্চা করে খুব ক্ষমতা নিয়ে ফিরেছে। কিন্তু সব গুলিয়ে গেল। আর কোনও জারিজুরি খাটবে না।
মুহূর্তের মধ্যে বুদ্ধি খাঁটিয়ে হাবু মশালটা বাঘের মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়ে পাশ কাটিয়ে চোঁ-চাঁ দৌড়তে লাগল। পিছনে তাড়া করে চলল ছ্যাঁকা-খাওয়া কালান্তক বাঘ। বাঘের পিছনে ভূতের পাল। আর তার পিছনে হাফপ্যান্ট-পরা মশাল হাতে করালী স্যার।
করালী স্যার তখনও চেঁচাচ্ছেন, “বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো…”
হাবু কিন্তু সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে যায়।
করালী স্যারের হাফপ্যান্ট-পরা করাল চেহারা আর বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো…’ চেঁচানি শুনেই বোধহয় বাঘটা জঙ্গলে পালিয়ে যায়। হাবু প্রাণভয়ে দৌড়ে গিয়ে একটা বাবলা গাছের শেকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। ভূতেরা যখন গিয়ে তার ঘাড় মটকানোর চেষ্টা করছে, তখন করালী স্যার “বুরুন, তুমি..” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে সেখানে হাজির হলেন। তাঁর গায়ে কবিরাজমশাই যে তেল মাখিয়ে দিয়েছিলেন, সেই তেলের গন্ধে অধিকাংশ ভূতই তফাতে গিয়ে ‘ওয়াক’ তুলতে লাগল, বাদবাকি ভূতেরা বুরুন তুমি..’ চেঁচানিকে নতুন কোনও মন্ত্র ভেবে ভয় খেয়ে সরে দাঁড়াল।
তাই বেঁচে গেল হাবু। তবে বেঁচে গিয়েও তার হেনস্থার আর শেষ রইল না। ইস্কুলের বুড়ো দফতরি রিটায়ার হয়ে দেশে চলে যাওয়ায় সে-জায়গায় হাবুকে বহাল করা হল।
হাবু এখন ইস্কুলের ঘণ্টা বাজায়, ক্লাসে ক্লাসে পরীক্ষা বা ছুটির নোটিস দিয়ে যায়। সেই হাবু আর নেই। চুপসে এতটুকু হয়ে গেছে। ভূত-প্রেতকে সাঙ্ঘাতিক ভয়, দিনরাত রাম-নাম জপ করে।
কবিরাজমশাইয়ের যা পসার হয়েছে, তা আর বলার নয়। সারাক্ষণ তাঁর দোকানে রুগির ভিড়। তবে লোকে বলে যে, তাঁর রুগিদের মধ্যে সবাই মানুষ নয়।
খেলাধূলা বা লেখাপড়ায় বুরুনকে আর নিধিরাম সাহায্য করে না। রাম কবিরাজ নিষেধ করে দিয়েছেন। তবে বুরুন নিজের চেষ্টাতেই খেলা ও পড়ায় বেশ উন্নতি করে ফেলেছে। তবে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষাতেও দেখা গেল যে, সে অঙ্কে সেই তেরোই পেয়েছে। অথচ একশ নম্বরের উত্তর নির্ভুল দিয়েছিল।
পরে অবশ্য খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, করালীবাবু স্যার ক্লাসের সব ছেলেকেই অঙ্কে ঢালাও তেরো নম্বর করে দিয়েছেন। কাউকে পাশ করাননি। ছেলেরা গিয়ে যখন তাঁকে ধরল, তখন তিনি একগাল হেসে সকলের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, “তেরো নম্বরটা খুব পাওয়ারফুল। বুঝলে! আমি এখন তেরো সংখ্যাটা নিয়ে খুব ভাবছি। ভেবে মনে হল, সকলেরই জীবনে অন্তত একবার অঙ্কে তেরো পাওয়াটা খুব দরকার।”