০৯. রাতের অতিথি

. রাতের অতিথি

বিল্ডিংয়ের দরজায় একটা বুড়ো মতন মানুষ পা ছড়িয়ে বসে আছে, তার দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় সে নেশাসক্ত। ঢুলুঢুলু চোখে সে আমাকে চলে যেতে দেখল, আমি লিফটের সামনে গিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখি সে তখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লিফটের সুইচে হাত দিতেই সে আমাকে হাত নেড়ে ডাকল, এই যে ভদ্রলোক, এই যে—

আমি তার দিকে এগিয়ে এলাম, কি হয়েছে?

তুমি আজকের খবরের কাগজ দেখেছ?

আমার বুক ধক করে ওঠে, কী বলতে চায় এই বুড়ো? মুখের চেহারা স্বাভাবিক রেখে বললাম, কেন, কী আছে খবরের কাগজে?

বুড়োটি গলা নামিয়ে বলল, তোমার ছবি ছাপা হয়েছে। তুমি নাকি পালাতে গিয়ে পুড়ে মারা গেছ! হলুদ দাঁত বের করে সে খিকখিক করে হাসে, ভালো ঘোল খাইয়েছ তুমি ব্যাটাদের! হা হা হা।

আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখলাম, কী সর্বনাশা ব্যাপার!

বুড়োটি ষড়যন্ত্রীদের মতো গলা নামিয়ে বলল, কাদের সাথে কাজ কর তুমি? কোকেনের দল? নাকি ভিচুরিয়াসের? আছে নাকি তোমার সাথে? দেবে একটু আমাকে?

আমি কী করব বুঝতে না পেরে চলে যাবার উদ্যোগ করতেই বুড়োটি খপ করে আমার হাত ধরে ফেলল, বলল, তুমি নিশ্চয়ই রবোটের দলের সাথে আছ, দেখে তো সেরকমই মনে হয় তুমি নিজে রবোট না তো আবার, খুব ভয় আমার রবোটকে!

আমি বুড়োর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ঝামেলা করো না বুড়ো, আমাকে যেতে হবে।

কত দেবে আমাকে বল, নাহয় পুলিসকে খবর দিয়ে দেব, হা হা হা। ময়লা দাঁত বের করে বুড়োটি আবার হাসা শুরু করে।

পুলিসকে এখনো খবর দাও নি তুমি?

না।

আমি পকেট থেকে একটা ছোট মুদ্রা বের করে বুড়োটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলি, ঐ যে টেলিফোন আছে, যাও, পুলিসকে ফোন করে দাও।

বুড়োটি মুদ্রাটা ভালো করে দেখে বলল, মোটে একটা দিলে? আরেকটা দাও।

ফোন করতে একটাই লাগে।

আহা-হা-হা, রাগ করছ কেন? আমি পুলিসকে কি সত্যি বলে দেব নাকি? তোমরা রৰােটের দলের সাথে কাজ করে গো কম্পিউটারের বারটা বাজাবে, আর আমি পুলিসকে বলে দেব? আমি কি এত নিমকহারাম? ক্রুগো কম্পিউটার কী করেছে জান?

কী করেছে?

আমার চেক আটকে দিয়েছে। আমি নাকি কোনো কাজ করি না, তাই আর নাকি চেক পাঠাবে না। শালা, আমি কি তোর বাপের গোলাম নাকি?

বুড়োটি খানিকক্ষণ কুৎসিত ভাষায় ক্রুগো কম্পিউটারকে গালি দিয়ে আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকায়, বিড়বিড় করে বলে, নাকি তুমি কোকেনের দলে আছ? দাও না একটু কোকেন।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে যাই, বুড়ো পেছন থেকে ডাকে, কয় তলায় থাক তুমি? তোমার রুম নাম্বার কত?

তেত্রিশ তলায়, সাত শ’ বার নাম্বার রুম।

সাত শ’ বার! মিখাইলের রুম, ভালো ছিল ছেলেটা, পয়সাকড়ি দিত আমাকে, খামোকা আর্মিতে নাম লেখাল, কোনদিন গুলি খেয়ে মরবে!

বুড়ো আপনমনে বিড়বিড় করতে থাকে, আমি লিফটে করে নিজের রুমের দিকে যাই। এই নেশাসক্ত বুড়ো যদি আমাকে চিনে ফেলতে পারে, তাহলে আর কতজন আমাকে চিনবে কে জানে। আমার মনের ভেতর একটা চাপা অশান্তি এসে ভর করে।

নূতন জায়গায় ঘুমাতে দেরি হয়, আজও তাই হল। তবে অ্যাপার্টমেন্টটা খারাপ নয়, একপাশ দিয়ে দূরে বিস্তীর্ণ শহর দেখা যায়। জানালা খুলে দিলে চমক্কার বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দেয়। জানালা খোলা রেখে শহরের শব্দ শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙল দরজার শব্দে, কেউ-একজন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।

আমি চমকে উঠে বসি, কে হতে পারে? আমি এখানে আছি খুব বেশি মানুষের জানার কথা নয়। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি কয়েকজন মানুষ, লম্বা কালো পোশাকে সারা শরীর ঢাকা।

পুলিস! আমি চমকে উঠে ভাবলাম, বুড়ো তাহলে সত্যি পুলিসকে খবর দিয়েছে। আবার দরজায় শব্দ হল, আমি তখন আবার দরজার ফাঁক দিয়ে তাকালাম। লোকগুলোকে দেখতে কিন্তু পুলিসের মতো মনে হল না, পুলিসের চেহারায় যে অহঙ্কারী আত্মবিশ্বাসের ছাপ থাকে, এদের তা নেই। এরা ভীতচকিত, তাড়া খাওয়া পশুর মতো উদ্ভ্রান্ত এদের চেহারা। এরা নিশ্চয়ই রবোট্রন।

আমি দরজা খুলে দিতেই লোকগুলো ঠেলে ঢুকে পড়ে, পেছনে দরজা বন্ধ করে দেয়। তিনজন পুরুষ, পেছনে একজন মেয়ে। মেয়ে না বলে কিশোরী বলা উচিত, অপূর্ব। সুন্দরী মেয়েটি।

পুরুষ তিনজনের একজন এগিয়ে এসে বলে, আমি ইলেন, একজন রবোট্রন। আপনি নিশ্চয়ই কিম জুরান। আপনার সাথে করমর্দন করতে পারছি না, আমার হাত দুটি একটু আগে উড়ে গেছে। লোকটি কালো পোশাকের ভেতর থেকে তার বিধ্বস্ত দু’টি হাত বের করে, সেখান থেকে স্টেনলেস স্টীলের কিছু যন্ত্রপাতি,কিছু তার, কিছু পোড়া প্লাস্টিক ঝুলে আছে।

অন্যেরা পোশাক খুলতেই দেখতে পাই তাদের সারা শরীর বড় বড় বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত। মানুষ হলে এদের একজনও বেঁচে থাকত না।

কমবয়সী দেখতে একজন বলল, আমরা দুঃখিত এত রাতে আপনাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্যে। কিন্তু আমাদের এখন খুব বিপদ, একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খুব দরকার। নীষা বলেছে এখানে আসতে।

আমি বললাম, এত বড় বিপদের সময় আমাকে বিরক্ত করা না-করা নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। আমি কি কিছু করতে পারি?

আমাদের আশ্রয় দিয়েই আপনি অনেক কিছু করেছেন। আপনার আপত্তি না থাকলে আমরা এখন নিজেদের একটু ঠিকঠাক করে নিই।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

রবোর্টুন গুলো টেবিলে নিজেদের টুকটাক যন্ত্রপাতি রেখে একজন আরেকজনের উপর ঝুঁকে পড়ে। শুধুমাত্র কিশোরী মেয়েটি একটা চেয়ারে নিজের হাতে মাথা রেখে বসে থাকে, মুখে কী গাঢ় বিষাদের ছায়া! মেয়েটি মানুষ নয়; যন্ত্র, কিন্তু তার মুখের গাঢ় বিষাদ আমাকে স্পর্শ করে, আমি বুকের ভেতর একটা যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকি।

মেয়েটি হঠাৎ সোজা হয়ে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি মানুষ?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।

আমার খুব মানুষ হতে ইচ্ছা করে।

কেন?

তাহলে এরকম পশুর মতো পালিয়ে বেড়াতে হত না।

আমি বললাম, আমি মানুষ, আমিও কিন্তু তোমাদের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

সত্যি?

হ্যাঁ।

কেন?

ইলেন নামের মধ্যবয়স্ক লোকটি বলল, সু, কাউকে তার ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করতে হয় না।

সু নামের মেয়েটি উদ্ধত গলায় বলল, কী হয় জিজ্ঞেস করলে? আমরা তো সব মারাই যাব, এখন এত নিয়ম-কানুন মানার দরকার কি?

ইলেন কঠোর গলায় বলল, কে বলেছে আমরা সবাই মারা যাব?

আমি জানি আমরা সবাই মারা যাব। মেয়েটি রুদ্ধ গলায় বলল, ইউরীর দলের সবাই মারা গেল না? রুটেকের দল ধরা পড়েছে, তারা কি এখন বেঁচে আছে? আমরা চারজন কোনোমতে পালিয়ে এসেছি। সুরা গেছে, কিরি গেছে, পল, টেরী আর লিমার কী খবর কে জানে! লুকাসের খবর কি এতক্ষণে জেনে যায় নি ক্রুগো কম্পিউটার? আর কে বাকি থাকল?

ইলেন এগিয়ে এসে কাটা হাত দিয়ে সুয়ের কাধ স্পর্শ করে বলল, আমরা আমাদের মিশনের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি সু। আর কয়েক ঘন্টা, তারপর আবার আমরা আমাদের আগের জীবন ফিরে পাব। আমাদের আর পালিয়ে বেড়াতে হবে না, রাতের অন্ধকারে রাস্তায় রাস্তায় ছুটতে হবে না। আবার আমরা মানুষের পাশাপাশি মানুষের বন্ধু হয়ে বেঁচে থাকতে পারব।

মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, তুমি শুধু শুধু আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছ। তুমি জান আমরা আসলে হেরে গেছি, আমরা ধরা পড়ে গেছি, আমরা আর কখনো গো কম্পিউটারকে পাল্টাতে পারব না, কখনো না, কখনো না—

ইলেন কাটা হাতটি মেয়েটির মাথায় রেখে বলল, এত আবেগপ্রবণ হলে চলে না সু, আমার কথা বিশ্বাস কর।

আমি সব জানি। যে-মানুষটার আমাদের ক্রুগো কম্পিউটারের গোপন সংখ্যা বের করে দেয়ার কথা ছিল, সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সে আমাদের সাহায্য করবে না।

তাতে কী আছে, ইলেন তাকে সান্ত্বনা দেয়, গোপন সংখ্যা না জানলে কি আর ক্রুগো কম্পিউটারকে আঘাত করা যায় না? আমরা বাইরে থেকে পুরো কম্পিউটার উড়িয়ে দেব–

আমি দু জনকে নিরিবিলি কথা বলতে দিয়ে ঘরের অন্যপাশে চলে এলাম। সেখানে কমবয়স্ক একজন রবোট্রন হাতে কী—একটা জিনিস লাগাচ্ছিল। আমি বললাম, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে পারি?

হ্যাঁ, অবশ্যি।

তোমাদের স্বাধীন জীবনের সাথে ক্রুগো কম্পিউটারের একটা সম্পর্ক আছে, সম্পর্কটা কী, বলবে আমাকে?

হ্যাঁ, বলব না কেন! আপনি তো আমাদেরই লোক। ক্রুগো কম্পিউটার যে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে সেটা সবাই জানে, কিন্তু ঠিক ভেতরের খবর খুব বেশি মানুষ জানে না। রবোট্রন তরুণটি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমাদের পৃথিবী শাসন করা হয় কেমন করে জানেন?

জানি। ক্রুগো কম্পিউটার যাবতীয় তথ্যাদি সংরক্ষণ করে, প্রয়োজনে সে তথ্য সরবরাহ করে সবোচ্চ কাউন্সিলকে। সবোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যরা যখন প্রয়োজন হয়। সিদ্ধান্ত নেন।

চমৎকার! সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য কত জন জানেন?

দশজন।

তাদের সম্পর্কে কিছু জানেন?

কিছু কিছু জানি। তাঁদের বেশিরভাগই বিজ্ঞানী। দু’ জন অর্থনীতিবিদ, দু’ জন দার্শনিক। একজন চিত্রশিল্পীও আছেন বলে শুনেছি। সবাই বয়স্ক, পঞ্চাশের উপর বয়স।

তারা কি মানুষ, না রবোট?

মানুষ। মানুষ ছাড়া আর কেউ সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য হতে পারে না।

তারা কী রকম মানুষ?

খুব চমৎকার মানুষ। আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, একজনকে আমি সামনাসামনি দেখেছিলাম, নাম ক্রিকি। পঞ্চম দাবা কনফারেন্সে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। বক্তৃতা দিতে দাড়িয়ে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের উপর কথা বলতে শুরু করলেন। একজন কর্মকর্তা তখন তার কানে কানে কী-একটা কথা বললেন, আর ক্রিকি তখন লজ্জায় টমেটোর মতো লাল হয়ে গেলেন। আমতা-আমতা করে বললেন, কী সাংঘাতিক ভুল হয়ে গেছে, আমি ভেবেছিলাম এটা নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের কনভেনশন। আমি এখন কী করি, দাবা সম্পর্কে আমি যে কিছুই জানি না! সে এক ভারি মজার দৃশ্য!

তরুণ রবোট্রনটি বলল, তারপর কী হল?

আমরা যারা দর্শক তারা হো-হো করে হেসে উঠলাম, তাই দেখে ক্রিকিও। হাসতে শুরু করলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, আমার দশ মিনিট কথা বলার কথা। এখনো সাত মিনিট আছে। যেহেতু আমি দাবা সম্পর্কে কিছুই জানি না, এই সাত মিনিট আমি ছড়া আবৃত্তি করে শোনাব। নিজের লেখা ছড়া। এরপর ক্রিকি ছড়া আবৃত্তি করতে শুরু করলেন।

কেমন ছিল ছড়াগুলো?

একটা দু’টা হাসির ছিল, কিন্তু বেশিরভাগই একেবারে ছেলেমানুষি। এরকম একজন আপনভোলা মানুষ যে সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য, ভাবা যায় না।

তরুণ রবোট্রনটি হঠাৎ তীব্র চোখে আমার দিকে তাকাল, বলল, আপনি সত্যি তাই মনে করেন?

আমি খানিকক্ষণ ভেবে বললাম, আমি দুঃখিত। কথাটি আমি ভেবে বলি নি।

আসলে ক্রুগো কম্পিউটার যদি যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের ভার নিয়ে নেয়, তখন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কোনো অসাধারণ মানূষের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন খাঁটি মানুষের–

তরুণ রবোনটি আমার কথাটি লুফে নেয়, হ্যাঁ, প্রয়োজন খাঁটি মানুষের। যে হৃদয়বান, যে অনুভূণি। তাই সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যদের সব সময়ে মানুষ হতে হয়, কোনো রটে তার সদস্য হতে পারে না। আমরা রবোট, আমরা আমাদের সমস্যা জানি। আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে যে আমাদের অনুভূতির একটা সীমা আছে, মানুষের অনুভূতির কোনো সীমা নেই। সত্যিকার মানুষের ধারেকাছে আমরা যেতে পারি না। তাই আমাদের সাথে মানুষের কোনো বিরোধ নেই, থাকতে পারে না।

তরুণটি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যরা যতদিন মানুষ ছিলেন, ততদিন তাঁরা আমাদের মানুষের পাশাপাশি থাকতে দিয়েছিলেন, বন্ধুর মতো।

আমি চমকে উঠে বললাম, মানে? সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যরা এখন কে?

এখন কেউ নেই। ক্রুগো কম্পিউটার একে একে সবাইকে সরিয়ে দিয়েছে, কাউন্সিলের সদস্যদের গত দশ বছরে একবারও প্রকাশ্যে দেখা যায় নি। এখন দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে ক্রুগো কম্পিউটার। আগে ক্রুগো কম্পিউটার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারত না, তার সে ক্ষমতা ছিল না। সিদ্ধান্ত নিত সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যরা। এখন সে নেয়, বাইরের লোকজন জানে না। যেখানে বিশাল এক ক্ষমতাশালী কম্পিউটার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, বাইরের লোকের পক্ষে সেখানে কিছু জানা। সম্ভবও নয়।

কী ভয়ানক! আমার বিশ্বাস হতে চায় না, কী সর্বনাশ!

হ্যাঁ। আমরা রবোটেরা এবং অল্প কিছু মানুষ মিলে চেষ্টা করেছিলাম ক্রুগো কম্পিউটারের ভেতরে প্রবেশ করে অবস্থার পরিবর্তন করতে। খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম আমরা। একজন মানুষের ক্রুগো কম্পিউটারের গোপন সংকেত বের করায় সাহায্য করার কথা ছিল, সেই মানুষটি রাজি হয় নি। সেটা নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছে, তার ভেতরে ক্রুগো কম্পিউটার ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে একেবারে উঠেপড়ে লেগেছে। আজ হঠাৎ করে আমাদের কয়েকটা দল ধরা পড়ে গেছে। আমাদের উপরেও একেবারে সাংঘাতিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, কোনোভাবে বেঁচে এসেছি। আমাদের অবস্থা বেশ শোচনীয়, সামলে উঠতে পারব কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

আমি কী-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় দরজায় আবার শব্দ হল।

মুহূর্তে ঘরে নীরবতা নেমে আসে, চোখের পলকে সবার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বের হয়ে আসে। কিশোরী মেয়েটি বিদ্যুৎগতিতে জানালার পাশে এগিয়ে যায়, নাইলনের দড়ি ঝুলিয়ে দেয় জানালা থেকে।

দরজায় আবার শব্দ হল, দ্বিধান্বিত শব্দ।

ইলেন আমাকে ইঙ্গিত করে দরজা খুলে দিতে। আমি দরজা ফাঁক করে উঁকি দিলাম, নেশাসক্ত বৃদ্ধটি উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দরজা খুলতেই সে বিড়বিড় করে বলল, পুলিস এসেছে।

পুলিস?

হ্যাঁ, একটা একটা করে রুম সার্চ করছে।

সত্যি?

হ্যাঁ, অনেক পুলিস, অনেক বড় বড় অস্ত্র। ভাবলাম তোমাকে বলে দিই। কথা বলতে বলতে সে ঘরে উঁকি দিয়ে সবাইকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দেখে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। শুকনো গলায় বলল,সর্বনাশ! এরা কারা? রবোট নাকি?

আমি কিছু বলার আগেই সে পিছিয়ে যায়, তারপর প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। রবোটকে তার ভারি ভয়।

আমি ঘরে এসে কিছু বলার আগেই সবাই বের হয়ে এল, তারা আমাদের কথাবার্তা শুনেছে। সময় বেশি নেই, সেটা বুঝতে কারো বাকি নেই। ইলেন চাপা গলায় বলল, লিফট দিয়ে নেমে যাও। দোতলায় থামবে, সেখান থেকে লাফিয়ে বের হতে হবে। পুলিসকে দেখামাত্র আক্রমণ করবে, তারা সম্ভবত আমাদের আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত নেই।

ইলেন ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের আশ্রয় দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। বিদায়।

আমি বললাম, আমি আপনাদের সাথে যাব।

তার প্রয়োজন নেই, পুলিস কখনো জানবে না আমরা আপনার এখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

সে জন্যে নয়। কী জন্যে? আপনি নিশ্চয়ই জানেন মানুষের নিরাপত্তা আমরা দিতে পারি না।

আমি হচ্ছি সেই মানুষটি, যার ক্রুগো কম্পিউটারের গোপন সংকেত বের করে দেয়ার কথা ছিল।

ওরা চমকে আমার দিকে তাকায়।

আমি গলার স্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম, আমি আগে রাজি হই নি, কারণ আমি সবকিছু জানতাম না। এখন জেনেছি, তাই মত পাল্টেছি। আপনারা রাজি থাকলে আমি আপনাদের সাহায্য করতে রাজি আছি।

সু নামের কিশোরী মেয়েটি ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। ইলেন তার ভাঙা হাত দিয়ে সুকে স্পর্শ করে বলল, সু, এখন ঠিক সময় নয়। কিম জুরানকে ছেড়ে দাও, আমাদের সাথে যেতে হলে তাঁর হয়তো কোনো ধরনের প্রস্তুতি দরকার।

আমি প্রস্তুত আছি,সময় নষ্ট করে লাভ নেই।

ইলেন মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আপনাকে যে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না।

আমি বললাম, তার প্রয়োজন হবে না। আমিও একাধিক ব্যাপারে আপনাদের কাছে ঋণী আছি, ঠিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি নি।

ইলেন বলল, চল, রওনা দিই। তোমরা নিশ্চয়ই জান, যে-কোনো মূল্যে কিম জুরানকে রক্ষা করতে হবে।

ছোট দলটি দ্রুতপায়ে এগোতে থাকে, তখন আমি দেখতে পাই বৃদ্ধ লোকটি করিডোরের শেষ মাথায় অতঙ্কিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহলের জন্যে সে ঠিক চলে যেতে পারছে না, আমাকে দেখে সে দ্রুতপায়ে আমার দিকে দৌড়ে আসে, ফিসফিস করে বলে, তোমরা কি লিফট দিয়ে নামবে?

হ্যাঁ।

আরো একটা গোপন পথ আছে, ইলেকট্রিক লাইন নেয়ার একটা টানেল, সেদিক দিয়ে নেমে যাও। সেখানে সিড়ি নেই, কিন্তু রবোটের কি সিঁড়ি লাগে?

আমি ইলেনকে বুড়োর গোপন পথের কথা বলতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

বুড়ো আমাদের নিয়ে যায়। লিফটের পাশেই একটা বন্ধ দরজা। একজন লাথি দিতেই সেটা খুলে গেল। নানা আকারের অসংখ্য ইলেকট্রিক তার সেদিক দিয়ে নেমে গেছে।

চমৎকার। দেরি নয়, নেমে যাও। কেউ-একজন আমাকে ধর, ইলেন চাপাস্বরে বলল, হাত না থাকায় একেবারে অকেজো হয়ে গেছি। কিম জুরানকে কে নিয়ে যাবে?

সু হাসিমুখে এগিয়ে আসে, আমি, আসুন কিম জুরান।

বুড়োটি আমার কনুই খামচে ধরে, ফিসফিস করে বলল, এরা সবাই রবোট?

হাঁ।

এই মেয়েটিও?

হ্যাঁ।

একটু ছুঁয়ে দেখি? দেখব গো মেয়ে?

সু খিলখিল করে হেসে উঠে হাত বাড়িয়ে দেয়, দেখ বুড়ো।

বুড়োটি ভয়ে ভয়ে তাকে একবার স্পর্শ করে। কনুইয়ে হাত বুলিয়ে সে একটা চিমটি কেটে বলল,ব্যথা পাও?

সু হাসি আটকে বলল, নাহ! ব্যথা পাব কেন?

আশ্চর্য! বুড়ো চোখ কপালে তুলে বলল, মোটেও ব্যথা পায় না। হঠাৎ সে গলা নামিয়ে ফেলল, তাড়াতাড়ি চলে যাও তোমরা। দেরি না হয়ে যায় আবার!

আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু মুদ্রা বের করে এনে তার হতে গুজে দিয়ে বললাম, বেশি নেই এখানে।

বুড়ো হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলে, আমি এখানেই থাকি। পরে এসে দিয়ে যেও। যত ইচ্ছা!