৯. মাঝারি একটা চৌকোনা ঘর

বেশি বড় নয়, মাঝারি একটা চৌকোনা ঘর। পাথর দিয়ে তৈরি। পাথরের সিংহাসনে কালো পাথর দিয়ে তৈরি একটা দেড় হাত লম্বা বিষ্ণুমূর্তি। ভারী চমৎকার মূর্তিটার গঠন। তবে ময়লা পড়েছে বিস্তর।

অনু বলল, “বাঃ, কী সুন্দর!”

নবীন লোহার সিন্দুকটার কাছে গিয়ে দেখল, পুরনো তালা মরচে পড়ে ঝুরঝুরে হয়ে আছে। লাঠির একটা ঘায়ে তালাটা ভেঙে পড়ে গেল।

নবীন ডালা খুলে দেখল, ভিতরে সোনা ও রুপোর কয়েকটা বাসনকোসন রয়েছে। সন্দেহ নেই যে, ঠাকুরের ভোগের জন্যই

এই সব বাসন-কোসন।

ডালাটা আবার বন্ধ করে দিল নবীন।।

মন্দিরের চার দেওয়ালে চারটে দরজা। একটা ভেঙে তারা ঢুকেছে, আর তিনটে বন্ধ।

নবীন এক-এক করে চারটে দরজাই খুলে ফেলল। চার দিকে চারটে পথ গেছে। মহা সমস্যা। কোন পথে যাওয়া যায়?

বিলু বলল, “নবীনদা, এসো, ট করে ডিসিশন নিই।”

নবীন একটু চিন্তা করল, তার পর বলল, “এ-জায়গাটা মোটামুটি নিরাপদ। তোমরা ভাই-বোনে এখানেই বসে থাকো, আমি একটু দেখে আসি।”

কিন্তু এই প্রস্তাবে অনু আর বিল রাজি হল না। অনু বলল, “আমাদের আর বিশ্রামের দরকার নেই। আমরাও তোমার সঙ্গে যাব।”

“তা হলে এসো, এক যাত্রায় আর পৃথক ফলের দরকার কী?”

মস্ত প্রদীপটায় আর-একটু ঘি দিয়ে নবীন সেটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, “এই আলোই আমাদের এখন একমাত্র ভরসা।”

প্রথম দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে খানিক দূর এগিয়ে বোঝা গেল, মেটা নদীর দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। খানিক দূর এগিয়ে যেতেই দেখা গেল, পথটা আবার গিয়ে জলে ডুবে গেছে।

নবীন বলল, “এটাই হয়তো বড় ঝিলের তলা। সিদ্ধিনাথদা এই পথটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে এত দিন। চলো ফিরে যাই।”

তিনজন আবার মন্দিরে ফিরে এল। তার পর বিগ্রহের পিছন দিককার দেওয়ালের দরজাটা দিয়ে এগোতে লাগল। এই পথটা একটা সিঁড়ির মুখে গিয়ে শেষ হয়েছে। সরু একটা খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে ওপর দিকে।

নিঃশব্দে তিনজন ওপরে উঠতে লাগল। খানিক দূর উঠে একটা গলি পেল তারা। খুবই সঙ্কীর্ণ গলি। খানিক দূর গিয়ে আবার সরু সিঁড়ি।

উঠতে উঠতে এক জায়গায় থেমে যেতে হল। সামনে একটা নিরেট দরজা।

নবীন দরজাটা নাড়া দিল। কিন্তু এ-দরজাটা লোহার তৈরি। বেশ পুরু পাতের। সহজে নড়ল না। এমনও হতে পারে যে, ও পাশে তালা বা হুড়কো লাগানো আছে।

নবীন প্রদীপের আলোয় দরজাটার ওপর থেকে নীচ অবধি ভাল করে দেখল।

অনু বলল, “নবীনদা, এখানে দেওয়াল থেকে একটা শেকল ঝুলছে, টানব শেকলটা?”

নবীন করুণ গলায় বলল, “কিছু না করার চেয়ে কিছু করাই ভাল। টানো।”

অনু শেকলটা খুব টানল। প্রথমটায় কিছু হল না, তার পর কয়েকটা হ্যাঁচকা টান দিতেই দরজার ওপাশে একটা ঘং করে শব্দ হল। একটা হুড়কো বা কিছু যেন খুলে গেল।

এবার খুব সহজেই দরজাটা খুলে ফেলতে পারল নবীন। এবং ঘরে ঢুকে ভীষণ অবাক হয়ে গেল।

এ কি তার বাড়ির সেই পাতালঘর? তেমনই গোল আকারের?

প্রদীপের আলোয় নবীন আরও যা দেখল, তা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ঘরের মধ্যে সাতটা বড় বড় মাটির জালা মুখ-ঢাকা অবস্থায় দেওয়ালের সঙ্গে সার দিয়ে দাঁড় করানো। দেওয়ালে মরচে ধরা সড়কি, বল্লম, তলোয়ার ঝুলছে। চারটে গাদা বন্দুকও। মেঝেময় পুরু ধুলোর আস্তরণ।

নবীন হঠাৎ আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, “এ যে আমার সেই পাতালঘর!”

“কিসের পাতালঘর নবীনদা?” অনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

“আর চিন্তা নেই। আমরা আমাদের বাড়ির তলাকার পাতালঘরে পৌঁছে গেছি। এই ঘরে ঢুকবার অনেক চেষ্টা করেও পারিনি, আজ তোমাদের জন্যই পেরেছি।”

নবীন ব্যগ্র হাতে জালার মুখের ঢাকনা সরাতে লাগল। যা ভেবেছিল, তা-ই। জালার মধ্যে রাশি রাশি সোনাদানা, বেশির ভাগই মোহর আর গয়না।

“ইশ, নবীনদা, তুমি যে বড়লোক হয়ে গেলে?”

নবীন কেমন বিহ্বল হয়ে গিয়ে বলল, “বড়লোক! ঠা, তা এক রকম বলতে পারো।”

নবীন দেখল, ঘরের অন্য দিকে আর-একটা লোহার দরজা রয়েছে। এই দরজাটি তার বাড়িতে ঢোকার রাস্তা, সন্দেহ নেই। দেওয়াল থেকে একটা শেকল ঝুলছে।

নবীন শেকলটা টানল, প্রথমটায় কিছুতেই টানা যাচ্ছিল না, প্রাণপণে তাঁচকা টান মারতেই দরজার ভিতরে একটা গুপ্ত হুড়কো খুলে যাওয়ার শব্দ হল ঘটাং করে। তার পর এক-পাল্লার পুরু দরজাটা ভিতর দিকে টানতেই খুলে যেতে লাগল। অবশ্য বিস্তর শব্দ হল তেলহীন কবজায়।

দরজার ওপাশে সেই চেনা গলি। নবীন কত দিন এইখানে বসে দরজাটা খোলার উপায় চিন্তা করেছে।

আবেগে নবীনের চোখে জল এসে গেল। “কী হল নবীনদা? দাঁড়িয়ে ও রকম ভাবে চেয়ে আছ কেন?” অনু নরম গলায় জিজ্ঞেস করল।

নবীন চোখ মুছে বলল, “সে অনেক কথা। চলো, রাস্তা পাওয়া গেছে। তোমরাও এখন নিরাপদ। আমার সঙ্গে এসো।”

অনু আর বিলু কোনও কথা বলল না। নীরবে নবীনের পিছু-পিছু চলতে লাগল।

এবার নবীন তার চেনা জায়গায় এসে পড়েছে। সুতরাং পাতালঘর থেকে উঠে আসা কোনও সমস্যাই হল না।

নবীনের বাড়িতে এখন নিশুতি রাত। পিসি তার ঘরে ঘুমোচ্ছ। মহাদেব তার ঘরে।

এতক্ষণ বদ্ধ বাতাসে তাদের ততটা শীত করেনি। কিন্তু এখন বাইরে আসতেই খোলা হাওয়ায় ভেজা শরীরে প্রচণ্ড শীত করে তিনজনেই কেঁপে উঠল।

নবীন তার চাঁদর-টাদর যা পেল, তাই দিয়ে দুই ভাই-বোনকে বলল, “এগুলো গায়ে জড়িয়ে নাও। তার পর চলল, তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার এখন অনেক কাজ আছে।”

অনু সঙ্গে-সঙ্গে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কী কাজ নবীনদা?” নবীন ঠাণ্ডা গলায় বলল, “যে বদমাশরা আমাদের খুন করতে চেয়েছিল, এবার তাদের একটু তল্লাশ নিতে হবে।”

অনু সঙ্গে-সঙ্গে বলল, “আমিও যাব।”

নবীন মাথা নেড়ে বলল, “ তা হয় না। কাজটা খুব বিপজ্জনক। ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে তোমাদের আর নিয়ে যেতে পারব না।”

বিলু অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলল, “আমরাও তা হলে বাড়ি যাব।”

নবীন দেখল, মহা বিপদ। এরা দুই ভাই-বোন মোটেই ভিতু ধরনের নয়। বরং রীতিমতো শক্তপোক্ত এবং দারুণ সাহসী, যথেষ্ট বুদ্ধিও রাখে। তার চেয়েও বড় কথা, ভীষণ একগুঁয়ে। সহজে এদের হাত এড়ানো যাবে বলে মনে হয় না।

নবীন বলল, “ঠিক আছে। তোমাদের কথাই থাকবে। কিন্তু আজ রাতের মতো যথেষ্ট হয়েছে। তোমাদের দাদু আর ঠাকুমা ভীষণ দুশ্চিন্তা করছেন। এবার তোমরা বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করো। কাল রাতে আবার আমরা সুড়ঙ্গে নামব।”

অনু সন্দিহান হয়ে বলল, “আমাদের ফাঁকি দিচ্ছ না তো?”

“না।”

“তা হলে কথা দাও।”

“দিচ্ছি।”

নবীন দুই ভাই-বোনকে তাদের বাড়ি অবধি পৌঁছে দিল। ফটকে বচন দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দেখে দৌড়ে এসে বলল, “এসেছ? বাঁচা গেল। বাবুকে বলেছি, তোমরা যাত্রা দেখছ। বাবু আর গিন্নিমা তবু ঘুমোননি। ওপরতলায় বসে আছেন। তোমাদের এ কী দশা?”

নবীন বলল, “সে অনেক কথা বচন, পরে শুনো। খুব জোর বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছি। ওদের আগে নিয়ে গিয়ে শুকনো জামাকাপড় পরিয়ে কিছু খাওয়াও। কতবাবু যেন টের না পান। পরে আমি সব বুঝিয়ে বলব’খন তাঁকে।”

বচন মাথা নেড়ে বলল, “কোনও চিন্তা নেই।” নবীন নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এল।

নবীন বাড়ি ফিরে সোজা পাতালঘরে নেমে এল। সুড়ঙ্গের দরজাটা খুব আঁট করে বন্ধ করে দিল সে। তার পর অন্য দরজাটাও বন্ধ করে সে ওপরে উঠে এল। জামা-কাপড় পালটে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় কম্বল-মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল সে।

আচমকাই কানের কাছে একটা খুক’ শব্দ। তার পর কানে-কানে সেই পরিচিত ফিসফিস আওয়াজ। “বাপের ব্যাটার মতো একটা কাজ করলে বটে হে। ওই চতুর্ভুজের মন্দিরে আমি এক সময়ে পুজুরি ছিলুম।”

নবীন একটু রেগে গিয়ে বলল, “মেলা ফ্যাচফ্যাচ করবেন না তো! আপনি কোথাকার পুজুরি ছিলেন, তা জেনে আমার লাভটা কী? বিপদের সময় তো আপনার টিকিটিরও নাগাল পাওয়া গেল না। জলে-ডোবা সুড়ঙ্গের মধ্যে আমরা যখন মরতে বসেছিলাম, তখন কোথায় ছিলেন? এখন যে ভারী আহ্লাদ দেখাতে এসেছেন!”

কণ্ঠস্বরটা একটু নিবু নিবু হয়ে বলল, “সুড়ঙ্গের মধ্যে কি আর সাধে ঢুকিনি রে ভাই? তোমার ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠপুরুষ কালীচরণকে দেখলে না? ইয়া গোঁফ, অ্যাই গালপাট্টা, ইয়া বুকের ছাতি, হাতির পায়ের মতো প্রকাণ্ড হাত, থামের মতো পা নিয়ে সুড়ঙ্গের মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল।”

“কই, দেখিনি তো!”

“দ্যাখোনি যে ভালই করেছ, অশরীরী তো! তবে দেখলে মূর্ছা যেতে, তাকে দেখেই আমি মানে-মানে সরে পড়েছিলাম।”

“তাঁকে আপনার ভয় কী?”

“ও রে বাবা! সে অনেক কথা। চতুর্ভুজের মন্দির থেকে ওই কালীচরণই আমাকে তাড়িয়েছিল। দোষঘাট যে আমার ছিল না, তা নয়। চতুর্ভুজ স্বপ্নদেশ দিয়েছিলেন, নরবলি দিতে হবে। কালীচরণকে বলেও ছিলাম সেকথা। সে কানে তুলল না। বলল, তুমি আফিংয়ের ঘোরে কী সব আগডুম বাগড়ম দেখেছ, তাই বলেই কি তা মানতে হবে নাকি? কিন্তু আমার ভয় হল; স্বপ্নাদেশ না মানলে যদি মহা সর্বনাশ হয়ে যায়। তাই একটা গরিব বামুনের পাঁচ বছর বয়সের ছেলেকে চুরি করে আনি। পাতাল-মন্দিরের বাইরের কাকপক্ষীও টের পাবে না। কালীচরণও তখন ছিল না। কিন্তু কী বলব তোমায়, সেই পাঁচ বছরের ছেলের যে কী তেজ! এই হাত-পা ছিটকে বাঁধন প্রায় ছিঁড়ে ফেলে, কাছে গেলেই কামড়ে দিতে চায়। সে এক জ্বালাতন। শেষে অতিরিক্ত ছটফট করায় মাথা পাথরে টুকে রক্তপাত হল। খুত হলে তো আর বলি দেওয়া যায় না, সুতরাং দেরি হয়ে গেল। আর তা করতে গিয়ে কালীচরণ ফিরে এল। ওঃ কী মারটাই মেরেছিল আমায়! তিনটে দাঁত পড়ে গেল, একটা চোখ ফুলে ঢোল, হাড়গোড় আর আস্ত রাখেনি। ঘাড় ধরে বের করে দিল মন্দির থেকে। সেই থেকে গুণ্ডটাকে বড্ড ভয় খাই। তবে চতুর্ভুজের মন্দিরটার জন্য এখনও মনটা কেমন করে।”

নবীন বলল, “আপনি তো ভীষণ খারাপ লোক ছিলেন দেখছি।”

কুলদা চক্রবর্তীর ভূত ভারী দুঃখের সঙ্গে বলল, “সবাই বলত বটে কথাটা, আমি নাকি খারাপ লোক। এমনকী, আমার ব্রাহ্মণীও বলত, তুমি একটা পাষণ্ড। আমার বাবা বলত, তুই ব্রাহ্মণ বংশের কুলাঙ্গার। কিন্তু মুশকিল কী জানো, আমি নিজে কিন্তু কখনও টের পাইনি যে, আমি খুব একটা খারাপ লোক। নিজেকে আমার বরাবর বেশ ভাল লোক বলেই মনে হত।”

 “খারাপ লোকেরা নিজের খারাপটাকে যে দেখতে পায় না।”

“তাই হবে। কিন্তু আমি যদি তেমন খারাপ হতুম, তা হলে কি আর খোকা-খুকি দুটির বিপদের কথা জানিয়ে তোমাকে পথ দেখিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঠিক জায়গাটিতে নিয়ে যেতুম? ওরে বাবা, আমাকে লোকে যতটা খারাপ বলে জানে, আমি ততটা খারাপ নই।”

নবীন বলল, “এখনও আপনাকে আমার ভাল লোক বলে মনে হচ্ছে না।”

কুলদা চক্রবর্তীর ভূত ফোঁত করে একটা নাক ঝাড়ার শব্দ করে বলল, “এখন যে এসেছি, সেও তোমার ভাল করার জন্যই।”

“তাই নাকি? কী রকম শুনি?”

“যে সব খুনে-গুণ্ডা তোমাদের সুড়ঙ্গের মধ্যে ধাওয়া করেছিল, তারা সব উঠে এসেছে। তোমার খোঁজে এল বলে। যদি প্রাণ বাঁচাতে চাও তো পালাও, অন্তত এ-ঘরটায় আজ রাতে আর শুয়ো না, তাদের অবশ্য ধারণা যে, তুমি ডোবা সুড়ঙ্গের জলে বাচ্চা দুটো-সহ ডুবে মরেছ। তবু তারা দেখতে আসছে, যদি কোনও রকমে বেঁচে গিয়ে থাকো তাৈ নিকেশ করে যাবে।”

“ওরা কারা?”

“তা আমি জানি না বাপু! লোকের ধারণা, ভূত মানেই সর্বজ্ঞ। তাই কি হয় রে ভাই? সব জানলে ভূত থেকে কবে ভগবান হয়ে যেতুম।”

নবীন টের পেল, কুলদা চক্রবর্তীর ভূত গায়েব হয়ে গিয়েছে।

সে উঠে পড়ল। একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তার। বাড়িতে পিসি আর মহাদেব আছে। খুনেরা হয়তো তাদের কিছু করবে না। কিন্তু এত রাতে ঘুম থেকে তুলে তাদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়াও প্রায় অসম্ভব। অনু আর বিলুর খোঁজ ওরা করবে কি না, তা সে বুঝতে পারছিল না। তরে মনে হয়, তাকে না পেলে ওরা ধরেই নেবে যে, তার সঙ্গে অনু আর বিলুও ডুবে মারা গেছে।

বিছানার চাঁদরটা টান-টান করে রাখল নবীন, যাতে বোঝ না যায় যে, বিছানায় কেউ শুয়েছিল।

তার পর নিঃশব্দে পাতালঘরের দিকে নেমে গেল নবীন।

দরজাটা এমনভাবে বন্ধ করেছিল, যাতে বাইরে থেকে খোলা যায়। ঘরে ঢুকে দরজাটা ফের বন্ধ করে দিয়ে নবীন ভাবতে বসল, এখন কী করা যায়? যারা পিছু নিয়েছিল, তারা যে চাঁপাকুঞ্জের সুড়ঙ্গ এবং ভিতরকার গুপ্তধনের কথা জানে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। সশস্ত্র এবং নিষ্ঠুর প্রকৃতির এই লোকগুলোর বিরুদ্ধে নবীন কী করতে পারে?

নবীন কিছুক্ষণ ভাবল, এভাবে ইঁদুরের মতো গর্তে সেঁধিয়ে আত্মরক্ষা করা বেশিক্ষণ সম্ভব নয়। এভাবে বাঁচা যাবে না, বরং রহস্য উদঘাটনের চেষ্টাটাই বেশি নিরাপদ হবে।

নবীন জানে, খুনেরা যত বেপরোয়াই হোক, তারা এই শীতে জলে-ডোবা সুড়ঙ্গে কিছুতেই নামবার ঝুঁকি নেবে না। নবীনও নিত না। প্রাণের ভয়ে তারা ওই সাঙ্ঘাতিক কাজ করেছে। সুতরাং মন্দিরের সুড়ঙ্গ এখনও নিরাপদ।

নবীন সুড়ঙ্গের দরজা খুলে সরু সিঁড়ি ধরে নামতে লাগল। এ সবই তার পূর্বপুরুষেরা করে গেছেন। অনেক পরিশ্রম আর অনেক অর্থ ব্যয় করে তাঁরা তাঁদের ধনসম্পদ আর বিগ্রহকে রক্ষা করবার চেষ্টা করেছেন।

নবীন সিঁড়ির শেষে সরু গলিটা পেরিয়ে এসে ফের মন্দিরে ঢুকল। আর একটা দরজা এখনও দেখা হয়নি। ও দিকটায় কী আছে তা জানা দরকার।

নবীন মন্দিরের চতুর্থ দরজাটা দিয়ে আবার একটা গলিতে এসে দাঁড়াল। গলিটা ঢালু হয়ে খানিকটা নেমে গেছে। তার পর আবার ওপরে উঠেছে। তার পর খাড়া নেমে গেছে সোজা জলের মধ্যে।

ফের জল দেখে থমকে গেল নবীন। ভারী হতাশও হল। ফিরে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। রাস্তাটাকে ইচ্ছে করেই কি

এত দুর্গম করা হয়েছিল? নাকি প্রকৃতির নিয়মে রাস্তা ধসে গিয়ে এই অবস্থা হয়েছে, তা চট করে বুঝে ওঠা মুশকিল। নবীন গলির দু ধারের দেওয়াল ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল, কোনও ফাটল বা গুপ্তপথ আছে কি না। নেই।

নবীন ফিরেই আসছিল। হঠাৎ জলে একটা ঝটপট শব্দ হওয়ায় ফিরে দেখল, মস্ত একটা কাতলা মাছ অল্প জলে খেলা করছে। টর্চের আলো দেখে ফিরে চলে গেল।

কেমন যেন মনে হল নবীনের, মাছটার এই হঠাৎ আসা আর যাওয়ার মধ্যে কোনও একটা ইঙ্গিত আছে। তাকে কি জলে নামতেই বলছে কেউ?

প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় একবার জলে ভিজে কষ্ট পেতে হয়েছে। আবার ভিজলে নির্ঘাত নিউমোনিয়া। কিন্তু উপায়ই বা কী? জলের তলায় কী আছে না আছে, তা না জানলে এই জট খোলা যাবে?

নবীন তার গায়ের চাঁদর খুলে ফেলল। জুতো ছাড়ল, কী ভেবে টর্চটাও রেখে দিল। তার পর ধীরে-ধীরে বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে নেমে গেল।

ডুব না দিয়ে উপায় নেই। এখানেও সুড়ঙ্গটা সোজা জলে নেমে গেছে। কোথায় উঠেছে, কে জানে?

নবীন বুকভরে দম নিয়ে জলে ডুব দিল। তার পর প্রাণপণে সাঁতার দিতে লাগল।

এবার আর বেশি দূর যেতে হল না। হাত-দশেকও নয়, নবীন মাথা তুলতেই দেখল, মাথার ওপর ফাঁকা, দম নেওয়া যাচ্ছে।

নবীন ফিকে অন্ধকারে চার দিকে চেয়ে যা দেখল, তাতে তার চোখ স্থির। সে বড় ঝিলের মাঝ বরাবর জলে ভাসছে। তিন দিকে বিশাল ঝিল আর জঙ্গল, একধারে ঝিলের ধারের বাড়িটা ভুতুড়ে বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা-মাখা আবছা অন্ধকারে।

হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো নবীনের মনে পড়ে গেল, ওই বাড়িতে কবে যেন ভাড়াটে এসেছে বলে বলছিল সিদ্ধিনাথ? নতুন ভাড়াটে? তারা কারা?

নবীন নিঃশব্দে দ্রুত গতিতে ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল। তার পর সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল পৈঠায়।

একটা ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে গায়ের জামা-টামা খুলে যতদূর সম্ভব নিংড়ে নিল সে। গা-হাত-পা মুছে নিল নিজের ভেজা জামা-কাপড় দিয়েই। তার পর বাগানের গাছপালার আড়াল দিয়ে এগোতে লাগল বাড়িটার দিকে।

পুরনো ঝুরঝুরে বাড়ি। অন্ধকার, জনমনিষ্যি কেউ আছে বলে মনে হল না নবীনের। ১১০

সে পিছনের বারান্দায় উঠে সাবধানে দরজাগুলো একে-একে টেনে দেখল। সবই ভিতর থেকে বন্ধ। রাস্তার দিকে বাড়ির সদর। নবীন বাড়িটা ঘুরে সামনে চলে এল। একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে লক্ষ করে দেখল। কেউ আছে বলে মনে হল না। ভাড়াটেরা হয় বেরিয়ে গেছে, নয়তো ঘুমোচ্ছে। বাইরে কোনও পাহারা নেই।

নবীন ঝোঁপের আড়াল থেকে উঠে এক-পা এগোল, পিছনে সামান্য মড়মড় শব্দ…নবীন ফিরে তাকাতে যাচ্ছিল..হঠাৎ তার ঘাড়ে ভালুকের মতো কে যেন লাফিয়ে পড়ল।

প্রথম ধাক্কাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল নবীন।

দুটো লোহার মতো হাত তার ঘাড়টা শক্ত করে ধরে মুখটাকে ঠেসে রইল মাটিতে। নবীন দম নিতে পারছে না। প্রবল চাপে তার চোখ ফেটে জল এল।

ধীরে-ধীরে সাঁড়াশির মতো দুটো হাত আরও চেপে বসল ঘাড়ে। একটা হাঁটু চেপে রেখেছে তার কোমর।

নবীনের গায়ে যে জোর কম, তা নয়–তবে আচমকা এই আক্রমণে সে বড় বেকায়দায় পড়ে গেছে।

কানের কাছে আবার সেই ‘খুক’ শব্দ। একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলল, “ভাল খবর আছে হে। একটু আগে চাঁপাকুঞ্জের শ্মশানে কালীচরণের সঙ্গে দেখা, বুঝলে? দেখেই তো আমি তাড়াতাড়ি সটকে পড়ছিলাম। তা হঠাৎ হল কী, জানো? কালীচরণ এই দেড়শো কি পৌনে দু’শো বছর পর হঠাৎ আমার সঙ্গে কথা কইল। কী কইল জানো? কইল, “ওহে চখোত্তি, ওই নবীন ছোঁড়াটা একটু পাগলা বটে, কিন্তু আমার বংশের শিবরাত্তিরের সলতে, মনে হচ্ছে, বিপদে পড়বে, ওকে একটু দেখো।”

নবীনের ইচ্ছে হচ্ছিল, কুলদা চক্কোত্তির টিকিটা ধরে আচ্ছাসে নেড়ে দেয়। নবীনের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আর খিটকেলে ভূতটা বকবক করে যাচ্ছে।

কুলদা চক্রবর্তীর অবশ্য কোনও বৈলক্ষণ নেই। ফিসফিস করে বলল, “বুঝলে, এই এত বছর বাদে কালীচরণের রাগ কিছু পড়েছে বলেই মনে হয়! যদি ভগবান মুখ তুলে চান, তবে চাই কি, ফের পুরুতগিরিতে বহালও করতে পারে। তা সে কথা যাক গে, এই গুণ্ডাটা দেখছি তোমাকে বেশ পেড়ে ফেলেছে…ই, তোমার যে একেবারে ল্যাজে-গোবরে অবস্থা! তা একটা কাজ করো, বাঁ পা-টা ভাঁজ করে ওপরে তুলে ঘোড়া যেমন চাঁট মারে, তেমনি একখানা ঝাড়ো তো বাপু?”

নবীনের জ্ঞান ধীরে-ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। তবু একথাটা সে শুনল। বাঁ পা-টা তুলে চড়া করে একখানা গোড়ালির গুঁতো বসিয়ে দিতে পারল লোকটার পিঠে। উপুড় হয়ে পড়ে থেকে এর বেশি আর সম্ভবও নয়।

লাথিটা কষাতেই ঘাড়ের চাপটা অর্ধেক কমে গেল হঠাৎ। আর সেই সুযোগে নবীন একটা ঝটকা মেরে পিঠের ওপর থেকে লোকটাকে ছিটকে ফেলে মাটিতে একপাক গড়িয়ে গেল।

তার পর সে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল নোকটার ওপর। এরাই না তাদের তিনজনকে কুয়োর মধ্যে খুন করতে চেয়েছিল? এরাই না বোমা ছুঁড়ে মেরেছিল? দুটি শিশুকেও এই পাষণ্ডরা মায়া করেনি।

নবীনের গোটা পাঁচ-ছয় ঘুসি খেয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে গেল। নড়ল না।

নবীন উপুড় হয়ে লোকটাকে পরীক্ষা করে দেখল। কোমরের বেল্ট থেকে একটা টর্চ জ্বলছিল, সেটা খুলে নিয়ে নবীন লোকটার মুখে আলো ফেলল। অচেনা মুখ। তবে লোকটা যে শহরের, তাতে সন্দেহ নেই। পকেট-টকেটও হাতড়ে দেখল নবীন। না, কোনও অস্ত্র নেই। এমনকী, একটা লাঠিও না।

নবীন ধীর পায়ে বাড়ির বারান্দায় উঠল। একটা, দরজা টানতেই খুলে গেল ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ করে।

ভিতরে ঢুকে চার দিকে আলো ফেলল নবীন। সামনের বড় ঘরটায় কয়েকটা বাক্স-প্যাটরা রয়েছে। এখনও ভোলা হয়নি।

পরের ঘরটায় একটা পোর্টেবল র‍্যাকের ওপর দুটো মাইক্রোস্কোপ আর অনেকগুলো জার রয়েছে। কয়েকটা জাল-লাগানো কাঠের বাক্সও।

নবীন এ-ঘরটা পার হয়ে পরের ঘরটায় ঢুকতে গিয়ে ভিতরে অদ্ভুত একটা শব্দ শুনে সভয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে, কোনও বিচিত্র হিংস্র প্রাণীর আওয়াজ।

একটু বাদেই তার ভুল ভাঙল। কোনও হিংস্র প্রাণী নয়, দুটো ক্যাম্প-খাটের ওপর দুজন লোক অঘোরে ঘুমোচ্ছে আর তাদের নাক ওই রকম ভয়ঙ্করভাবে ডাকছে।

নবীন দু’জনের মুখেই টর্চের আলো ফেলল। শহরের লোক, ঘুমন্ত মুখ দেখে কিছু বোঝবারও উপায় নেই, এরা কেমন লোক। তবে এদের একজনকে সে চেনে। অভিজিৎ। সদাশিববাবু আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। এই লোকটাই ঘুরঘুর করছিল তার বাড়ির বাগানে।

হঠাৎ লোকটার নাকের আওয়াজ থেমে গেল। লোকটা চোখ মেলে তড়াক করে উঠে বসে বলল, “কে?”

নবীন টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে বলল, “ভয় নেই। আমার নাম নবীন।”

“ওঃ নবীনবাবু! এত রাতে কী ব্যাপার?”

“আমি জানতে চাই, আপনারা কারা?”

অভিজিৎ একটু বিরক্ত গলায় বলল, “এত রাতে ঘুম ভাঙিয়ে এটা কী ধরনের রসিকতা?”

“রসিকতা নয়। পরিচয় জিজ্ঞেস করার গুরুতর কারণ আছে। গত কয়েক ঘণ্টা যাবৎ কয়েকজন খুনে লোক বন্দুক-পিস্তল নিয়ে আমাকে তাড়া করছে। তারা আমাকে খুন করতে চায়। কিন্তু কেন চায় এবং তারা কারা, তা আমার জানা দরকার।”

অভিজিৎ একটু বিগলিত গলায় বলল, “তারা কারা, তা আমিই বা কী করে বলব? আপনার কি সন্দেহ যে, আমরাই আপনাকে খুন করার চেষ্টা করছিলাম?”

“কেটেরহাটে এমন কোনও লোককে আমি জানি না, যার কাছে বন্দুক-পিস্তল বা বোমা আছে।”

“কেন, সদাশিববাবুরই তো আছে।”

“তা আছে। তবে তাঁর বয়স আশির কাছাকাছি।”

অভিজিৎ উঠে একটা লণ্ঠন জ্বালল। তার পর নবীনের দিকে চেয়ে বলল, “আরে, আপনি যে শীতে কাঁপছেন! সবাঙ্গ ভেজা!”

“হ্যাঁ, আমি ঝিল থেকে একটু আগেই উঠে এসেছি।”

“আপনি কি পাগল? এই প্রচণ্ড শীতে ঝিলে নেমেছিলেন কেন?”

“সে কথা পরে। আপনাদের মতলব কী বলুন তো? আপনারা আসার পরেই কেন এ সব ঘটনা ঘটছে? সিদ্ধিনাথকে আপনারা তাড়াতে চেয়েছিলেন, না-পেরে তাকে মেরে যমের দক্ষিণ দোরে পৌঁছে দিয়েছেন। ভুজঙ্গের মাথা ফাটিয়েছেন, সদাশিবের দুটো ফুলের মতো নাতি-নাতনি আর আমাকে গুলি করে মারতে চেয়েছেন।”

অভিজিৎ এ সব কথার কোনও জবাব দিল না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমাদের কাছে বন্দুক একটা আছে বটে, কিন্তু সেটা ডাকাতের ভয়ে রাখতে হয়েছে। যদি বিশ্বাস না হয়, তবে নিজেই খুঁজে দেখতে পারেন। আমরা পোকা-মাকড় নিয়ে রিসার্চ করতে এসেছি। অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই। সিদ্ধিনাথ বা ভুজঙ্গকে কে মেরেছে, তাও আমরা জানি না। তবে গতকাল বিকেলে আমরা বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি, সদর দরজায় কে আঠা দিয়ে একটা কাগজ সেঁটে রেখে গেছে। আমরা কাগজটা খুলে রেখেছি। আপনিও দেখতে পারেন।”

এই বলে অভিজিৎ টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নবীনের হাতে দিল। নবীন দেখল, তাতে লেখা : চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এ-জায়গা ছেড়ে চলে না গেলে মরতে হবে।

নবীন কাগজটা অভিজিতের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আপনাদের একজন একটু আগে বাগানে আমাকে আক্রমণ করেছিল। আপনারা যদি ভাল লোকই হবেন, তা হলে গুণ্ডা পুষেছেন কেন? যে আমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল?”

অভিজিৎ একটু হেসে বলল, “আমাদের কাছে কিছু দামি যন্ত্রপাতি আছে। এ-জায়গাটা কেমন, তা তো জানি না। তাই আগ্রা পালা করে সারা রাত পাহারা দিই। সুহাস একটু মারকুটে বটে, কিন্তু খুনি নয়। আর আপনার সঙ্গে সে তো বিশেষ সুবিধেও করতে পারেনি দেখছি। তাকে কী অবস্থায় রেখে এসেছেন? মানুষটা আস্ত আছে তো?”

নবীন নিজের ঘাড়ে একটু হাত বুলিয়ে বলল, “আছে। শ্বাস পড়ছে, দেখে এসেছি। তবে জ্ঞান নেই।”

“তা হলে তার একটা ব্যবস্থা এখনই করতে হয়। বাগানে এভাবে পড়ে থাকলে ঠাণ্ডায় মরে যাবে।”

“চলুন, আমিও আপনাকে সাহায্য করছি।”

দু’জনে ধরাধরি করে সুহাসকে বাগান থেকে ঘরে নিয়ে এল। ‘অভিজিৎ তার চোখে জলের ঝাঁপটা দিতেই সে চোখ মেলে উঠে বসল। আর এই সব গণ্ডগোলে সুদর্শনও ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে।

অভিজিং করুণাভরে বলল, “আমাদের কাছে কিছু একট্রা জামাকাপড় আছে। আপনি পরতে পারেন। সুহাস আর আপনার ফিগার একই রকম।”

নবীন শীতে কাঁপতে কাঁপতে রাজি হয়ে পোশাক পরে নিল। চমৎকার নরম উলের তৈরি প্যান্ট আর নাইলনের জামার ওপর একটা গলাবন্ধ পুল-ওভার।

একটা স্টোভ জ্বেলে অভিজিৎ কফিও বানিয়ে ফেলল কয়েক মিনিটে। নবীনের অভ্যেস নেই। তবু গরম কফি খেয়ে শরীরটা বেশ তেতে উঠল তার।

অভিজিৎ বলল, “এবার বলুন, কী করতে চান?”

নবীন মাথা নেড়ে বলল, “বুঝতে পারছি না।”

“কিছু বদমাশ আপনার পেছনে লেগেছে। তাদের ঢিট করতে হবে, এই তো?”

নবীন মাথা নেড়ে বলল, “তা-ই। ঢিট না করলে তারা আমাকে যমের বাড়ি পাঠাবে।”

“সেটাই স্বাভাবিক। আগেই বলে রাখছি, আমরা এ সব কাজে অভ্যস্ত নই। আমরা বিজ্ঞানী। কিন্তু তবু আপনাকে সাহায্য করতে রাজি আছি।”

নবীন একটু ভাবল। এরা সত্যিই কেমন লোক, তা সে জানে। এরা যদি তারা নাও হয়ে থাকে, তাতেও কিছু যায়-আসে না। কিন্তু এরাও যদি খারাপ লোক হয়ে থাকে, তখন কী হবে?

তাই সে বলল, “আপনারা আমাদের অতিথি। আপনাদের বিপদে ফেলাটা কি ঠিক হবে?”

অভিজিৎ মৃদু হেসে বলল, “বিপদে আমাদের মাঝে-মাঝেই পড়তে হয়। মাঠঘাট-জঙ্গলে কাজ করলে বিপদ ঘটবেই। আর-একটা কথাও আছে, এ-লোকগুলো আজ আপনার পিছনে লেগেছে। কাল আমাদের পিছনেও লাগতে পারে। চলুন। আর দেরি করা ঠিক হবে না।”

.

অনু আর বিলু বাড়ি ফিরে এসে গরম জলে হাত-মুখ ধুয়ে জামা কাপড় পালটে এবং দুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু এত সব ঘটনার ফলে তাদের মাথা এত গরম হয়ে গেছে যে, কিছুতেই ঘুম এল না।

অনু ডাকল, “বিলু! ঘুমোলি?”

“না রে, দিদি।”

“আমার কী মনে হচ্ছে জানিস? নবীনদা আমাদের ফাঁকি দিয়ে ফের গুহায় নেমেছে।”

“তা হলে চল, যাবি?”

“যাব। ওঠ।”

দুই ভাই-বোন উঠে চটপট পোশাক পরে নিল। বাড়ি নিঃঝুম। কেউ জেগে নেই। কাজেই সকলের অজান্তে বেরিয়ে

পড়তে তাদের কোনও অসুবিধেই হবে না।

কিন্তু বেরোবার মুখেই হঠাৎ পথ আটকে সদাশিব এসে দাঁড়ালেন, “কোথায় যাচ্ছিস?”

.

ছ’জন লোক যখন নিঃশব্দে নবীনের বাড়ি ঢুকল, তখন রাত আরও গাঢ় হয়েছে। চার দিক ভীষণ নিস্তব্ধ।

ছ’জন লোকের হাতেই বন্দুক পিস্তল ইত্যাদি। সর্দার গোছের লোকটা একটু চাপা গলায় বলল, “দাঁড়িয়ে পড়। পালাতে না পারে।”

চোখের পলকে ছ’জন ছ’দিকে ছিটকে ছড়িয়ে পড়ল। সদারের হাতে একটা পিস্তল। নবীনের বাড়ির সদর দরজাটা সে একটা তারের সাহায্যে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে বাইরে থেকে খুলে ফেলল। তার পর ঢুকল নবীনের শোবার ঘরে।

তার পর টর্চ জ্বালল।

বিছানায় নবীন গভীর ঘুমে অচেতন। সর্দার একটু তৃপ্তির হাসি হাসল। ছোট্ট করে মৃদু একটা শিস দিল সে। বাইরে থেকে তার

আর দু’জন স্যাঙাত ছায়ায় মতো পাশে এসে দাঁড়াল।

সর্দার নবীনকে দেখিয়ে চাপা গলায় বলল, “জলে ডুবে মরেনি। তার মানে সুড়ঙ্গে জলের তলা দিয়ে রাস্তা আছে। আর সে-রাস্তা এ-বাড়িতে এসে উঠেছে। পাতালঘরে ঢোকার সন্ধান তা হলে পাওয়া গেছে। ওকে তোল।”

একজন গিয়ে নবীনের গা থেকে কম্বলটা ঝটকা মেরে সরিয়ে তার চুল টেনে তুলল।

নবীন আতঙ্কের গলায় বলল, “কী ব্যাপার? তোমরা কে?”

“কথায় কথা বাড়ে নবীনবাবু। আমাদের পাতালঘরে নিয়ে চলো। সময় বেশি নেই।”

“পাতালঘর?”

সর্দার মৃদু হেসে বলল, “সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, আমি জানি। বলে সর্দার তার অস্ত্রটা উলটে নিয়ে নবীনের হাতটা টেনে ধরে বলল, “পিস্তলের বাঁট দিয়ে তোমার কবজিটা ভেঙে দেব নবীনবাবু?”

ঠিক এই সময়ে সদারের ডান চোয়ালে একটা ঘুসি এসে পড়ল। আর, দুজন লোক লাফিয়ে পড়ল আর-দুজনের ঘাড়ে। নবীন বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সর্দারকে একটা ল্যাং মেরে ফেলে দিল।

প্রথম লড়াইটা নবীনরা এক রকম জিতেই গিয়েছিল। তিনজনই কুমড়ো-গড়াগড়ি। সংখ্যাতেও নবীনরা চারজন। কিন্তু সর্দার পড়ে গিয়েও একটা টানা লম্বা শিস দিল।

লড়াইয়ের মাঝখানেই আরও তিনজন লোক পিস্তল হাতে ঘরে এসে ঢুকল।

অভিজিৎ হাঁফানো গলায় বলল, “নবীনবাবু, সারেন্ডার করে দিন। নইলে সবাই মরব।”

নবীনও বুঝল, লড়ে লাভ নেই। সর্দার উঠে পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়ে বলল, “এবার চলো নবীনবাবু। পাতালঘরের দরজাটা খোলো। ওরে, এই তিনজন মর্কটকে অজ্ঞান করে রেখে যা।”

তিনটে পিস্তলের বাঁটের ঘায়ে অভিজিৎ, সুহাস আর সুদর্শন লুটিয়ে পড়ে গেল মেঝেয়। দু’জন ডাকাত তাদের পাহারা দিতে লাগল। চারজন নবীনকে নিয়ে পাতালঘরে নামল। নবীন দরজা খুলল। তাকে সামনে নিয়ে ঘরে ঢুকল চারজন।

‘সর্দার এগিয়ে গিয়ে জালার মুখগুলো খুলে ফেলল। তার পর বলল, “বাঃ। নবীনবাবু তো এখন বেশ বড়লোক দেখছি। অবশ্য এ সব ভোগ করা আর নবীনবাবুর কপালে হয়ে উঠবে না। ওরে কালু, সুড়ঙ্গে নিয়ে গিয়ে নবীনবাবুর ব্যবস্থা কর, যাতে আর কখনও মুখ দিয়ে শব্দ বার না হয়।”

দুটো পিস্তলের নল এগিয়ে এসে ঠেকল নবীনের বুকে।

“চলো।”

নবীনের মাথায় হঠাৎ আগুন জ্বলে গেল। অনেকক্ষণ ধরে সে।

সহ্য করছে। আর পারল না। বাঘের মতো একটা গর্জন ছেড়ে সে একজনের ওপর লাফিয়ে পড়ল। তার পর একটা খুব ঝটাপটি হতে লাগল। তার ওপর আরও দুজন এসে পড়ল। নবীন দু’ হাত এবং দু পা সমান তেজে চালিয়ে যেতে লাগল। কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলে যেতে থাকল, “চালাও, চালাও স্বয়ং কালীচরণ কতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার এলেম দেখছেন যে! খুশিও হচ্ছেন খুব। গোঁফে তা দিচ্ছেন আর হাসছেন।”

নবীনের গায়ে যেন বুনো জোর এল। সে প্রাণপণে লড়ে যেতে লাগল অন্ধকারে। তার মধ্যে দু বার দুটো পিস্তলের আওয়াজ হল।

তার পরই হঠাৎ একটা মস্ত টর্চ বাতির আলো এসে পড়ল ঘরে। দরজার কাছ থেকে সদাশিববাবুর গলা পাওয়া গেল, “খবরদার! সব স্থির হয়ে দাঁড়াও। নইলে সব কটাকে পুঁতে ফেলব।”

সদাশিব একা নন। সঙ্গে বচন, লেঠেল, রহিম শেখ, অনু, বিলু, আর অভিজিৎ। সদাশিবের হাতে বন্দুক।

চারজন ডাকাতের হাত থেকেই পিস্তল খসে পড়েছিল মারামারি করতে গিয়ে। সর্দার তার পিস্তলটার জন্য ঝাঁপ খেল বটে, কিন্তু রহিম শেখ বিদ্যুতের মতো লাঠিটা চালাতেই সর্দার চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল। ওপরে পাহারাদার দুই ডাকাতকে ঠিক এ রকম ভাবেই ঘায়েল করে এসেছে সে এই মাত্র।

.

মাঝরাতে গোপীনাথের পেটে কে যে কাতুকুতু দিল, কে জানে। গোপীনাথের ভারী কাতুকুতু। সে ঘুমের মধ্যেই খুব খিলখিল করে হাসতে-হাসতে উঠে বসল। কার এমন সাহস?

“কার এত বুকের পাটা যে, আমায় কাতুকুতু দিল!”

“আজ্ঞে, আমার। আমি নবীন। একটু আগে পাতালঘরে খুন হয়েছি। আমি নবীনের ভূত।”

“ওরে বাবা রে।”

“নরক জায়গাটা ভীষণ খারাপ, গোপীনাথবাবু। যা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও খারাপ। যে যমদূতেরা আমাকে ধরে। নিয়ে যাচ্ছে, তারা বলছে যে, সেখানে নাকি সারা গায়ে ছুঁচ ফুটিয়ে মানুষকে পিন কুশন বানিয়ে রাখা হয়। চোখের মধ্যে গরম সিসে ঢেলে দেয়..”

“বাবা গো!”

“আপনাকেও নরকেই যেতে হবে। বেশি দিন নেই। আপনার লোকেরা আমাকে খুন করেছে ঠিকই, কিন্তু তারা আপনাকে একটি মোহরও দেবে না। সব নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিচ্ছে দেখুন গে।”

“বটে! নিধিরামের এত সাহস! আমি বলে তাকে ভাল জেনে হাতরাশগড় থেকে আনালুম, আর তারই এই কীর্তি! দাঁড়াও, দেখাচ্ছি…”

গোপীনাথ উঠতে যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে হল, ঘরে আরও লোক ঢুকেছে। গোপীনাথ আলোটা বাড়িয়ে তাকাল।

সামনেই দারোগা। পিছনে আরও অনেক লোক। গোপীনাথ বলল, “ওরে বাবা।”

.

উপসংহার

গোপীনাথকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। তার ভাড়াটে গুণ্ডাদেরও।

নবীন যেসব সোনা-দানা পাতালঘর থেকে পেল, তার একটাও ১২২

সে নিজে নিল না। শুধু বাড়ির বার্বদে গোপীনাথের কাছে যে দেনা ছিল, সেটা শোধ করে দিল গোপীনাথের ছেলেকে। বাকি সোনা-দানা বেচে যে কয়েক লাখ টাকা পেল, তা দান করে দিল গরিব-দুঃখীদের। বলল, “আমার পূর্বপুরুষেরা অন্যেরটা লুঠ করে এনেছিলেন। আমি তাই অন্যকেই দান করে দিলাম।”

সদাশিববাবু শুনে বললেন, “হুঁ! নবীন ছোঁকরা খারাপ নয় জানি। তা বলে কালীনাথ: সুবিধের লোক ছিল না। তার চেয়ে আমার ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ…”

শুনে অনু আর বিলু হেসে খুন।