।। নয় ।। – ভয়ংকর রাত
পরের দিন প্রণবেশ সোজা লালবাজারে গিয়ে গত দু—দিনের ঘটনা জানিয়ে সন্ধের পর থেকে সারা রাত্তিরের জন্যে বাড়িতে পুলিশ পাহারা চাইল। লালবাজারের বড়োকর্তারা কিন্তু এবার খুব গুরুত্ব দিলেন না। তাঁদের বক্তব্য—গত কয়েক দিন সারারাত পুলিশ সল্টলেকের সমস্ত রাস্তা টহল দিয়েছে। জীবন্ত কঙ্কালের দর্শন পায়নি। হয় সবটাই এতদিন চোখের ভুল ছিল কিংবা সেটি অদৃশ্য হয়েছে।
প্রণবেশ সে কথা মানতে চায়নি। যাই হোক শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে ফের যদি রাত্তিরে ওইরকম হাঙ্গামা হয়, ফোন পেলেই সশস্ত্র পুলিশ—ভ্যান যাবে।
আজও সন্ধের আগেই প্রণবেশ চলে এল আমাদের বাড়ি। ও যেন বুঝেই নিয়েছে আমার ঘরে যতদিন না সুব্বা ঢুকতে পারছে ততদিন ও হাঙ্গামা চালিয়ে যাবে।
আজও রাত দশটার মধ্যে খাওয়া—দাওয়ার পর আমরা শুয়ে পড়লাম। নামেই শোওয়া— কারো চোখে ঘুম নেই।
রাত দুটো।
নিস্তব্ধ এ. জে. ব্লকের রাস্তাগুলো, দিনের বেলার ব্যস্ত কোলাহলমুখর বাস—টার্মিনাসটা এখন শ্মশানের মতো পরিত্যক্ত। জনশূন্য রাস্তার বুকে লাইটপোস্টের আলোগুলো যেন পাহারা দিচ্ছে।
হঠাৎ কানে এল কাছেই কোনো বাড়িতে কোনো বয়স্ক মানুষ যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কিছু পড়ছে। আজ যেন গলার স্বরটা গতকালের চেয়ে স্পষ্ট। কিন্তু কী পড়ছে ভালো করে বোঝা গেল না। তার পরেই দেখলাম রাস্তার আলোগুলো কাঁপছে। তারপরেই ধীরে ধীরে ভোল্টেজ ডাউন হয়ে এল। সেই সঙ্গে সেই গম্ভীর গলার পড়াটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
না, বই পড়া নয়। রীতিমতো মন্ত্র উচ্চারণ।—গচ্ছ—গচ্ছ—সংহারো—গচ্ছ—গচ্ছ—সংহারো—
মানেটা পরিষ্কার। কেউ যেন কাউকে আদেশ করছে—যাও—যাও বিনাশ করো—মেরে ফেলো।
তারপরেই শুনতে পেলাম সেই শব্দ খট—খট—খট—
জল্লাদ এগিয়ে আসছে আমাকে মারার জন্যে।
শব্দটা আগের মতোই আমাদের বাড়ির কাছে এসে থেমে গেল। আর তখনই কোথাও কিছু নেই আকাশটা ঘন মেঘে ছেয়ে গেল। কয়েকবার চোখ—ধাঁধানো বিদ্যুৎ চমকানি। তারপরেই উঠল প্রচণ্ড ঝড়। সঙ্গে সঙ্গে আমার স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন, আবার এসেছে—
ছুটে গেলাম পাশের ঘরে। সেই একই দৃশ্য, তবে আরও ভয়ংকর। চোখ দুটো ধক ধক করে জ্বলছে—মুখে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ। আজ যেন সে ঘরে টুকবেই।
আশ্চর্য এই ঝড়েও সে কাবু নয়।
এদিকে ঝড়ের দাপট ক্রমশই বাড়ছে। জানলা—দরজার শার্সিগুলো ঝনঝন করে উঠছে। প্রণবেশ চেঁচিয়ে উঠল, শিগগির টেবিল—চেয়ারগুলো দরজার কাছে নিয়ে এসো।
দরজাটা ঝড়ের ধাক্কায় তখন কাঁপছে। আমরা টেবিল—চেয়ার—আলনা যা পেলাম সব নিয়ে এসে দরজার গায়ে ঠেসে দিলাম। ওদিকে জানলাগুলোরও একই অবস্থা। সেখানেও ডেস্ক, ট্রাঙ্ক যেখানে যা ছিল এনে চেপে ধরলাম। তার পরেই শুরু হল ছাদের ওপর দাপাদাপি।
প্রণবেশ ছুটে গেল ফোন করতে। কিন্তু—হায় কপাল! লাইন ডেড।
ক্রমে রাত পুইয়ে গেল। ঝড় থেমে গেল। যাক আজও বেঁচে গেলাম। প্রণবেশ আবার ফোন করার চেষ্টা করল। লাইন বেঁচে উঠেছে। লালবাজার জানাল এখুনি ফোর্স যাচ্ছে।
প্রণবেশকে বললাম, এখন আর এসে কী হবে?
ভোর পাঁচটা।
লালবাজারের দুজন বড়োকর্তাকে নিয়ে আমরা আলোচনায় বসেছি। এভাবে তো দিনের পর দিন পারা যায় না। কিন্তু উপায় কী?
হঠাৎ আমার একটা কথা মনে হল বললাম, আমরা গ্রামেও দেখেছি কঙ্কালটাকে চালনা করে নেপালের সেই তান্ত্রিক। তার কাজ অনেকটা remote control—এর মতো। সুদূর হরিদেবপুরে নেপাল থেকে সে চলে এসেছিল। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে সে কঙ্কালটাকে জীবন্ত করে ছেড়ে দেয়। কাজেই সেই তান্ত্রিক কলকাতাতেও যে এসেছে তাতে সন্দেহ নেই। আর সে আছে আমাদের খুব কাছেই।
প্রণবেশ চমকে উঠে বলল, তুমি তো দারুণ পয়েন্ট বলেছ।
মনে করে দ্যাখো প্রণবেশ, গত রাত্রে মোটা গলায় সেই সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ—গচ্ছ—গচ্ছ—সংহারো।
এ সেই তান্ত্রিকেরই কাজ এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
প্রণবেশ বলল, কিন্তু তাকে খুঁজে পাব কোথায়?
বললাম, মাঠে—পথে সে বসে থাকবে না। নিশ্চয় কারো বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে। এই সেক্টরের প্রত্যেক বাড়ি খোঁজ করলে এখনও তাকে পাওয়া যাবে।
প্রণবেশ তখনই পুলিশ কর্তাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বেশি খুঁজতে হল না। উমেশ সান্যালের বাড়ির কাছে আসতেই ঘিয়ের গন্ধ পাওয়া গেল। যেন কেউ হোম করেছে। পুলিশ ঢুকে পড়ল। উমেশবাবু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, হ্যাঁ, একজন বড়ো সাধুকে তিনদিন হল তাঁর বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। ঠিক ছিল আজ তাঁর সঙ্গে বেনারসে মহাযোগে যাবেন। কিন্তু—
কিন্তু কী? কোথায় সেই সাধু?
ভোরবেলা উঠে তাঁকে আর দেখতে পাচ্ছি না।
প্রণবেশ বললে, তা হলে সে নিশ্চয় পালিয়েছে।
তখনই সব থানায় ফোন করে দেওয়া হল—পথে, স্টেশনে, গঙ্গার ঘাটে কোনো সাধুকে একলা দেখলেই তাকে যেন ধরা হয়।
বেলা দশটা।
তান্ত্রিক ধরা পড়েনি। হয়তো সে ট্রেনে চড়ে নেপালের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছে। অথবা অন্য সাধুদের দলে মিশে কাশী চলে গিয়েছে।
গত রাতের ঝড়ে একটা লাইট—পোস্টের তার ছিঁড়ে গিয়েছিল। ইলেকট্রিক মিস্ত্রিদের একজন পোস্টে উঠে সারাচ্ছিল। হঠাৎ আমাদের বাড়ির ছাদের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল।—আরে! ওটা কী?
ছাদে উঠে দেখা গেল—একটা ছোটোখাটো কঙ্কাল পড়ে আছে। এটা যে নেপালে সেই তান্ত্রিকের গুহায় আমরা দেখেছিলাম সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তান্ত্রিক অনেক দূরে চলে গেছে। রিমোট কন্ট্রোল আর চলবে না। এখন এটা শুধুই কঙ্কাল। এটাকে নিয়ে কী হবে?
পুলিশ বলল, দায়িত্ব আমাদের। ওটাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেওয়াই ভালো।
তাই হল। আমাদের উপস্থিতিতে কঙ্কালটাকে পুড়িয়ে তার ভস্ম গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল।
আশা করা যায় এতকাল পর তার গতি হবে। তান্ত্রিকও আর রিমোট কন্ট্রোল থেকে কঙ্কালকে চালনা করে কারো ক্ষতি করতে পারবে না।
১৯৯৮, শুকতারা শারদীয়া
—