০৯. বিভীষিকার আবির্ভাব
শব্দটা সবাই শুনেছিল। স্তব্ধতা ভঙ্গ করল সীমা, মনে হল বাড়ির পাশের গাছটা থেকে কিছু যেন লাফিয়ে পড়ল ছাতের উপর– তাই না মা?
শ্রীময়ী মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, গাছের ডালপালার মধ্যে একটা শব্দ আমি শুনেছি।
হঠাৎ যেন কিছু মনে পড়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন শ্রীময়ী, হ্যাঁ রে সীমা, ছাদের দরজা বন্ধ করেছিলি তো?
সীমার মুখ সাদা হয়ে গেল, না, মা। ভুল হয়ে গেছে।
সর্বনাশ!
কিছু সর্বনাশ হয়নি, দরজাটা আমি বন্ধ করে দিয়ে আসছি, কাজল বলল, ছাতে ওঠার সিঁড়িটা দেখিয়ে দে সীমা।
সীমা উঠে দাঁড়িয়ে অগ্রসর হল, কিন্তু দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ভয়ার্ত চিৎকার করে ঘরের ভিতরে পিছিয়ে এল। পরক্ষণেই মক্ত দ্বারপথে দেখা দিল অতিকায় কালো বিড়ালের মতো একটা জানোয়ার–ব্ল্যাক জাগুয়ার শয়তান!
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই ভয়ানক জন্তুর দিকে তাকিয়ে রইল সীমা। শ্রীময়ীও চেয়ে ছিলেন জন্তুটার দিকে। শয়তান ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের ভিতরটা পর্যবেক্ষণ করল, তারপর তার জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল শ্রীময়ীর দিকে।
মা আর বোনকে আড়াল করে দাঁড়াল কাজল, তার ডানহাতের মুঠির মধ্যে চকচক করে উঠল একটা ছোটো আগ্নেয়াস্ত্র। পিস্তলটা জাগুয়ারের দিকে উঁচিয়ে ধরে কাজল বলল, জোসেফ। এখানে হামলা করে লাভ নেই! এখনই পিস্তলের গুলিতে তোমার মাথা ঝাঁঝরা করে দিতে পারি। জানি তোমাকে হত্যা করা সম্ভব নয়। তোমার প্রাণপাখি এই জান্তব আধার ছেড়ে আবার মনুষ্যদেহে আশ্রয় নেবে। কিন্তু আঘাতের যন্ত্রণা তুমি এড়িয়ে যেতে পারবে না। গুলিতে এই জস্তুটার মাথা ফুটো হয়ে গেলে ওই শরীরটার মধ্যেও তুমি থাকতে পারবে না।
জাগুয়ার নিঃশব্দে মুখব্যাদান করল! রক্তিম মুখ গহ্বরের ভিতর থেকে উঁকি দিল ঝকঝকে দাঁতের সারি।
কাজল অবিচলিত কণ্ঠে বলল, জোসেফ, তুমি অনেক টাকা পেয়েছ। আমার কাছে আর আশা করো না। এখান থেকে চলে যাও। নইলে গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হব।
জাগুয়ার নিঃশব্দে দন্তবিকাশ করল। কাজল বলল, আমায় ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। শোনো জোসেফ, আমায় না মেরে আমার মা-বোনকে তুমি ছুঁতে পারবে না। ওদের হত্যা করলেও আমায় তুমি আর ফিরে পাবে না। অতএব চলে যাও জোসেফ, এখান থেকে চলে যাও।
জাগুয়ার একবার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কাজলের মুখের দিকে চাইল, তারপর নিঃশব্দে ধীর পদক্ষেপে দরজার বাইরে অন্তর্ধান হল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই পাশের গাছটার উপর একটা গুরুভার বস্তুর ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ ভেসে এল। সকলেই বুঝল জন্তুটা ছাত থেকে ওই গাছটার উপরে লাফিয়ে পড়েছে– গাছের ডালপালার সঙ্গে শ্বাপদের দেহের সংঘাতেই পুর্বোক্ত শব্দের সৃষ্টি…।
একটা মোটর গাড়ি চালু করার শব্দ ভেসে এল রাস্তার উপর থেকে।
আপদ বিদায় হল, কাজল বলল, কিছু না দেখেও বলতে পারি ওই গাড়িটা চালাচ্ছে জোসেফ আর গাড়ির ভিতর মরণ-ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে শয়তান নামে ব্ল্যাক জাগুয়ার।… চল সীমা, সিঁড়ির দরজা বন্ধ করে আসি। অবশ্য এখন আর বিপদের ভয় নেই। তবু সাবধান হওয়া উচিত! আজকের রাত্রি পার হয়ে গেলে শত্রু আর আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। কাল দুপুরের মধ্যেই কলকাতা ছেড়ে আমরা সরে পড়ব।
কোথায় দাদা?
–এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে দুপুরের পর কেউ কলকাতায় থাকছি না। বাকি রাতটা মনে হচ্ছে কারোই ঘুম আসবে না, তবু চুপচাপ শুয়ে নিদ্রাদেবীর আরাধনা করতে হবে আর কিছু তো করার নেই।
.
পরিশিষ্ট
দুদিন পরের কথা। দার্জিলিং-এর একটা হোটেলে সকালবেলা ধুমায়মান চায়ের কাপ নিয়ে বসেছিল কাজল। পাশেই ছিলেন শ্রীময়ী। তার হাতেও গরম চায়ের কাপ।
হঠাৎ ঝড়ের মতো ঘরে প্রবেশ করল সীমা, একটা খবরের কাগজ কাজলের সামনে মেলে ধরে বিশেষ একটা জায়গায় আঙুল নির্দেশ করল, দেখছো দাদা?
শ্রীময়ী বলে উঠলেন, কিসের খবর?
কাগজটা টেনে নিয়ে জোরে জোরে পড়তে শুরু করল কাজল—
ইম্পিরিয়াল সার্কাস কোম্পানিতে একটি দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি একটা কালো জাগুয়ারের খেলা ওই সার্কাসে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অঞ্জন ঘোষ নামে একজন দুঃসাহসী খেলোয়াড় ওই কালো জাগুয়ারের খেলা দেখিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। গতকাল খাঁচার ভিতর ওই জন্তুটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। জন্তুটির দেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। আরও আশ্চর্যের বিষয় যে, জন্তুটার মৃত্যুর আগের দিন পূর্বোক্ত খেলোয়াড় অঞ্জন ঘোষ সার্কাসের মালিকের সঙ্গে দেখা করে সার্কাসের কাজে ইস্তফা দিয়ে গেছেন। তার বিদায় নেওয়ার আগে জন্তুটার দিকে কেউ নজর দেয়নি। তিনি চলে যাওয়ার পরে জন্তুটার খাওয়ার সময় যথারীতি মাংসের টুকরো ফেলে দেওয়া হয় খাঁচার মধ্যে। জন্তুটা ওই সময়ে শুয়ে বিশ্রাম করছিল। আরও বারো ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর একসময়ে খাদ্য-পরিবেশক এসে দেখল জন্তুটা সেইভাবেই শুয়ে আছে, মাংসের টুকরো সে স্পর্শও করেনি। সন্দেহ হওয়ায় তখনই একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি খাঁচার দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন এবং পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন জন্তুটার মৃত্যু হয়েছে।
শ্রীময়ী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, যাক, বাঁচা গেল। ভবিষ্যতে আশা করি আর উপদ্রব ঘটবে না।
কাজল হাসল, জীবন্ত প্রেতের মতো জোসেফ এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে মহানগরীর বুকে। আমি হাতছাড়া হয়েছি, কিন্তু জোসেফের মতো মানুষ কি নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকবে? প্রয়োজন বোধে নতুন আধার আবিষ্কার করে দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার ইচ্ছা কি ত্যাগ করবে? … যাক, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমরা বরং বর্তমানকেই উপভোগ করার চেষ্টা করি কী বলল মা?
শ্রীময়ী হাসলেন, সেই ভালো।
সীমার মুখেও হাসি ফুটল, হ্যাঁ, দাদা। আর কোনো ভয়ের কারণ আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া তোমার মতো ভাই কাছে থাকলে ভয় কী?