৯. পৃ মানে পৃথিবী

মহাকাশযানের বড় করিডোর ধরে মাঝারি ধরনের একটা ভাসমান যানে করে আমরা নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম। কয়দিনের মাঝে আমরাও শীতল ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে যাব, তার আগে শেষবার মহাকাশযানটা ঘুরে দেখছি। কিছুদিন আগেও অসংখ্য মানুষে পুরো এলাকাটা জনাকীর্ণ ছিল, এখন কেউ নেই। গ্রাউলের হাত থেকে কর্তৃত্ব সরিয়ে নিয়ে সাথে সাথে মহাকাশযানকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যে লোভকে পুঁজি করে মানুষকে অমানুষে রূপান্তরিত করা হয়েছিল সেউ লোভের সামগ্রীকে হঠাৎ করে সবার কাছে সহজলভ্য করে দেয়া হয়েছে। তখন রাতারাতি মহাকাশযানের বিচিত্র জটিল সেই নৃশংস অমানবিক জীবনটি পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে গেছে। মহাকাশচারীদের আবার শীতল ঘরে ফিরে যেতে বলা হয়েছে, কেউ প্রতিবাদ না করে স্বেচ্ছায় ফিরে গেছে। মহাকাশযানটিতে আবার সেই ভুতুড়ে নৈঃশব্দ নেমে এসছে। পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছানোর পর আবার সবাইকে জাগিয়ে তোলা হবে, প্রাণচাঞ্চল্যে আবার ভরপুর হয়ে উঠবে এই বিশাল মহাকাশযান।

পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষ নিয়ে গ্রাউল সবার কাছে মিথ্যে তথ্য দিয়ে। আসছিল। পৃথিবীর মানুষ নিজেদের মাঝে হানাহানি করছে সেটি সত্যি নয়। হানাহানি করার জন্যে পৃথিবীতে এখন কোনো মানুষ নেই। মানুষের স্বেচ্ছাচারিতায় সমস্ত পৃথিবী বাসের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল, প্রায় দুই হাজার বছর আগে শেষ মানুষটি পৃথিবী ছেড়ে গ্রহান্তরে পাড়ি দিয়েছে। এই দুই হাজার বছর প্রকৃতি নিজের হাতে পৃথিবীকে আবার মানুষের বাসের যোগ্য করে গড়ে তুলেছে। আবার সেখানে নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর সবুজ বনারণ্য গড়ে উঠেছে। আমরা সেখানে গিয়ে আবার নূতন করে মানব জীবন শুরু করব।

পৃথিবীর কথা ভাবতে ভাবতে আমি অন্যমনস্ক ভাবে বাইরে তাকিয়েছিলাম, লেন এসে আমার কাঁধে হাত রাখল। আমি তার দিকে ঘুরে তাকালাম, তার ঝকঝকে খাপ খোলা চেহারা দেখে আবার আমার বুকের ভেতর এক ধরণের বেদনা বোধ হতে থাকে। লেন নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী দেখছ?

না। কিছু না।

আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমরা বেঁচে আছি।

আমি হেসে বললাম, আসলে আমরা বেঁচে নেই। এই পুরো ব্যাপারটা আসলে মহামতি গ্রাউলের অত্যাশ্বর্য মস্তিষ্কের একটা স্বপ্ন দৃশ্য। এক্ষুনি তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে তখন–

লেন আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, দোহাই তোমার। গ্রাউলের কথা বল না।

সে কেমন আছে শুনবে না?

না, শুনতে চাই না।

বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। পুরোপুরি উন্মাদ—

লেন কাতর গলায় বলল,আমি শুনতে চাই না।

আমি লেনকে নিজের কাছে টেনে এনে বললাম, কেন শুনতে চাও না? কী আশ্চর্য শক্তিতে তুমি তাকে পরাস্ত করে পুরো মহাকাশযান আর তার হাজার হাজার মহাকাশচারীকে রক্ষা করেছ সেটা শুনবে না?

না। আমি শুনব না। আমি সব কিছু ভুলে যেতে চাই।

ঠিক তখন পিছনে কিছু একটা ভেঙে পড়ার শব্দ হল এবং সাথে সাথে একাধিক শিশুর উল্লাস ধ্বনি শোনা গেল। লেনের মুখে অধৈর্যের একটা ছায়া পড়ে, সে কাতর গলায় বলল, ঐ দেখ আবার শুরু করল ওরা! কী করি ওদের নিয়ে বল তো?

আমি হেসে বললাম, মানুষের এক সাথে একটি করে সন্তান থাকার কথা। সেই একটি সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে বাবা মায়ের কালো ঘাম ছুটে যায়। তোমার সন্তান হচ্ছে আটটি। এই সমস্যার কোন সমাধান নেই লেন। এর আগে কথা জানত না তখন তবু সামলে দেয়া যেত। এখন ওরা কথা শিখেছে ওদেরকে আর কোনভাবে সামলে নেয়া যাবে না। তুমি কিছুদিনে পাগল হয়ে যাবে লেন!

আমি একা কেন? তুমিও পাগল হয়ে যাবে।

হ্যাঁ। আমিও মনে হয় পাগল হয়ে যাব–

আমার কথা শেষ হবার আগেই শিশুগুলি হুঁটোপুটি করতে করতে আমাদের কাছে হাজির হল। তারা কয়েকজন মিলে একজনকে নিচে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে, যারা ফেলছে এবং যাকে ফেলছে সবারই একধরনের বিচিত্র উল্লাস হচ্ছে বলে মনে হয়। লেন বৃথাই তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে ওখানে?

খেলছি।

কী খেলছ?

খেলছি আমরা পৃ’তে গিয়েছি।

পু?

হ্যাঁ। পৃ মানে পৃথিবী!

 

আমি সাবধানে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। এই শিশুরা আমাদের জন্যে নতুন পৃথিবী গড়ে তুলবে। ভালবাসাময় আনন্দের একটা পৃথিবী।

নতুন পৃ।

———-