৯. দিন-দুই বাদে এক সকালে

দিন-দুই বাদে এক সকালে দুলালবাবু ল্যাবরেটরির এক কোণে ছোট একটা স্টোভে সেদ্ধভাত রান্না করছিলেন, এমন সময় জানলার বাইরে একটা লোক এসে দাঁড়াল। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, ন্যাড়া মাথায় সদ্য-গজানো খোঁচা-খোঁচা কাঁচাপাকা চুল, দু’খানা চোখ জ্বলজ্বল করছে।

লোকটা চাপা গলায় ডাকল, “দুলালবাবু!”

দুলালবাবু চমকে উঠে বললেন, “আজ্ঞে।”

লোকটা মাথা চুলকে বলল, “এসব কী হচ্ছে দুলালবাবু?”

“দুলালবাবু ভারি ভয় খেয়ে বললেন, “আজ্ঞে, সেদ্ধভাত রান্না করছি, কোনও অন্যায় করিনি তো!”

“আপনার মতো ওস্তাদ লোক সেদ্ধভাত রান্না করে শক্তির অপচয় করলে অন্যায় নয়?”

দুলালবাবু আরও ভয় খেয়ে বললেন, “আজ্ঞে, আপনাকে তো ঠিক চিনে উঠতে পারছি না।”

“চিনতে পারছেন না! বলেন কী দুলালবাবু? আমি যে আপনার শাগরেদ পাঁচু মোদক। দুজনে মিলে কত কী করলুম, সব ভুলে মেরে দিয়েছেন নাকি?”

দুলালবাবু ভারি অবাক হয়ে বললেন, “আমি কি কিছু করেছি পাঁচুবাবু?”

পাঁচু খুব খকখক করে হেসে বলে, “কত কী করলুম, আর আপনার মনে পড়ছে না? ভূত ধরা, সোনার দোকানে ডাকাতি করা, ভুবনবাবুর বাড়িতে চুরি, ক্রিকেট খেলা কত কী!”

দুলালবাবু কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, “চুরি! ডাকাতি! ক্রিকেট! ও বাবা, আমি যে জন্মেও ওসব কখনও করিনি, আপনি আর আমাকে ভয় দেখাবেন না আমি ভারি ভিতু লোক।”

পাঁচু হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “আপনি ভিতু লোক! হাসালেন মশাই। আপনি না ভূত ধরার ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন! আপনি দারোগাবাবুর কম হেনস্থা করে ছেড়েছেন? ভুবনবাবুর মতো ডাকসাইটে লোককে নাকের জলে চোখের জলে করে ছাড়েননি আপনি?”

দুলালবাবু অত্যন্ত আতঙ্কের চোখে পাঁচুর দিকে চেয়ে ছিলেন। হঠাৎ দু’হাতে কান ঢেকে বললেন, “ওসব কথা কানে শোনাও যে পাপ পাঁচুবাবু! শুনেই যে আমার ভয় করছে।”

পাঁচু হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, “সাধু সেজে লাভ নেই দুলালবাবু। আমি আপনাকে ভালই চিনেছি। তা সাধু সেজে কি নতুন কোনও প্যাঁচ কষছেন নাকি? আপনার মাথায় যা বুদ্ধি, হয়তো মিনমিনে সেজেই ঝপ করে একটা দাঁও মেরে ফেললেন। তা বলে পাঁচু মোদককে ভুলবেন না যেন!”

দুলালবাবু দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, “পাঁচু মোদক বলে কাউকে আমি চিনিই না। আর আমার মাথায় বেশি বুদ্ধিও নেই।আপনি বোধ হয় অন্য কোনও লোকের সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন।”

পাঁচু মাথা নেড়ে মিটমিট হেসে বলল, “কেন যে ছলনা করছেন দুলালবাবু? আমি তো আর আপনার শত্রু নই। একটা জন্ম ওস্তাদের কাছে শিখতে যা পারিনি, আপনি তা তিন দিনে শিখিয়ে দিয়েছেন। আপনার যা এলেম তার একশো ভাগের এক ভাগ পেলেও বর্তে যেতুম। একটা প্যাঁচ যে আপনি কষছেন তা খুব বুঝতে পারছি। শুধু এই গরিব শাগরেদকে দয়া করে ভুলবেন না যেন। আজ আমি যাচ্ছি দুলালবাবু, কিন্তু আমি আবার আসব।”

লোকটা চলে যাওয়ার পর দুলালবাবু ভারি দুশ্চিন্তায় পড়লেন। ভাত আজ আর তাঁর মুখে রুচল না। কয়েক গ্রাস কোনওরকমে খেয়ে আঁচিয়ে এসে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন। খুব ধীরে ধীরে তাঁর মনে পড়তে লাগল যে, মাঝখানে কয়েকটা দিন তিনি ঠিক নিজের মধ্যে নিজে ছিলেন না। কী সব যেন অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল।

ভাবতে-ভাবতে যতই তাঁর মনে পড়তে লাগল, ততই তাঁর গায়ে কাঁটা দিতে লাগল। তাঁর মতো নিরীহ লোক যে এসব করতে পারেন তা আজ তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ভয়ে তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করছে, জলতেষ্টা পাচ্ছে, ভারি দুর্বল বোধ করছেন।

উঠে দুলালবাবু কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। না, এখানে থাকা আর ঠিক হবে। লোকটা আবার যদি আসে তবে দুলালবাবু ভারি বিপদে পড়বেন। তাই তিনি নিজের বিছানাপত্র বাক্স-প্যাঁটরা গোছাতে লাগলেন তাড়াতাড়ি।

কিন্তু বেরোতে চাইলেন কি পারা যায়। দরজা খুতেই দেখলেন, সামনেই ভুবনবাবু দাঁড়িয়ে।

“আরে দুলালবাবু! এই দুপুরবেলা কোথায় চললেন?”

“আজ্ঞে, বাড়ি যাচ্ছি। এখানে ঠিক সুবিধে হচ্ছে না।”

“কেন, অসুবিধে কী? কাল থেকে বাচ্চারা আপনার কাছে হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিখবে বলে সব ঠিক করে রেখেছি, এসময়ে চলে গেলে চলবে কেন? আমি হয় আপনার বেতন ডবল করে দিচ্ছি।”

দুলালবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, “না, না, টাকার কথা হচ্ছে না। বিজ্ঞান শেখানোর মধ্যে যথেষ্ট আনন্দ আছে। তবে কিনা বড্ড উটকো লোকের উৎপাত।”

“না হয় দবোয়ান রেখে দিচ্ছি।”

দুলালবাবু ঘাড় চুলকোতে-চুলকোতে বললেন, “ইয়ে আমি লোকটাও বিশেষ সুবিধের নই। পাঁচু মোদক নামে একটা লোক এসে বলে গেল, আমি নাকি অনেক খারাপ খারাপ কাজ করেছি, চুরি-ডাকাতি মিথ্যে কথা কিছু বাদ নেই। সেই থেকে ভারি আত্মগ্লানি হচ্ছে। আমার আর লোকালয়ে মুখ দেখানোর উপায় নেই। ভাবছি কোনও নির্জন জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে থেকে বাকি জীবনটা কোনওরকমে কাটিয়ে দেব।”

ভুবনবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “কথাটা আপনি খারাপ বলেননি। কয়েকদিন যাবৎ আপনার নামে নানা অভিযোগ আমরাও শুনেছি। তবে সান্ত্বনার কথা এই যে, তখন আপনি তো আর আপনার মধ্যে ছিলেন না। একটা রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে আপনার শরীর ও মগজের বিধান পালটে গিয়েছিল। ওটা আমি ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছি না। আমি জানি, আপনি অতি সজ্জন লোক।”

“কিন্তু পাঁচু মোদক আমাকে শাসিয়ে গেছে সে নাকি আবার আসবে। বোধ হয় আমাকে দিয়ে আবার চুরি-ডাকাতি করানোর ইচ্ছে।”

ভুবনবাবু বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন, “বটে! দাঁড়ান, দেখছি। আপনি কোথাও যাবে না কিন্তু।”

ভুবনবাবু ছড়ি হাতে গটগট করে চলে গেলেন।

পাঁচু মোদক তার গোপন ডেরায় হতাশভাবে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল, গতিক তার সুবিধের ঠেকছে না। এই বুড়ো বয়সে সে আর ধান্দাবাজি করে পেট চালাতে পারছে না। দুলালবাবুর মতো গুণী লোককে পেয়ে তার ভারি সুবিধে হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দুলালবাবু যেন কেমনধারা হয়ে গেছেন। চোখে-মুখে আর সেই ঝলমলে ভাবখানা নেই, চোখে কেমন মরা মাছের ভাব। হলটা কী তা সে বুঝে উঠতে পারছে না।

চোখ বুজে খুব ভাবছিল পাঁচু। কিন্তু তার মাথাটা কোনও কাজের নয়। চিন্তা ভাবনা ভাল খেলে না। মাথাটায় দুটো ঠুসো মারল পাঁচু। একটু ঝাঁকুনি দিল। কাজ হল না।

চোখটা একটু পিটপিট করল পাঁচু। আচ্ছা, ভগবানের কাছে উপায় চাইলে হয় না? অনেক সময়ে তো ভগবান এসে হাজির হন, বলেন, “কী বর নেবে নাও।” এই বুড়ো বয়সে আর ধকল সয় না পাঁচুর। কটা দিন একটু আরামে কাটাতে পারলে হত।

পাঁচু চোখ বুজে বিড়বিড় করে ভগবানের কাছে খুব করে প্রার্থনা জানাতে লাগল।

খানিকক্ষণ বাদেই টের পেল, ভগবান এসেছেন। সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। তবে চোখ খুলল না পাঁচু। একগাল হেসে বলল, “এসে গেছেন? বাঃ, বেশ বেশ!”

ভগবান বেশ ভারিক্তি গলায় বললেন, “এলুম।”

পাঁচু চোখ না খুলেই মেঝের ওপর হাতড়ে হাতড়ে ভগবানের পা দু’খানাও পেয়ে গেল। পায়ের ধুলো নিয়ে আর মাথায় ঠেকিয়ে গদগদ স্বরে বলল, “বড্ড তাড়াতাড়িই চলে এলেন। অথচ শুনেছি, কত লোকে কত কক্সরত করে বেড়ায় ভগবানের জন্য। তা খবরটবর সব ভাল তো?”

“খবর সব ভাল। তা তোমার মতলবখানা কী?”

“আজ্ঞে, বড় টানাটানি চলছে। চুরি-জোচ্চুরিতে আর তেমন সুবিধে হচ্ছে। না। তাই ভাবলুম, একটা দুটো বর যদি দিয়ে দেন তো বাকি জীবনটা পায়ের ওপর পা দিয়ে কাটিয়ে দিই।”

“বটে! কিন্তু চোখ বুজে আছ কেন?”

“আজ্ঞে, আমি পাপী তাপী মানুষ, চোখ খুলতেই যদি পালিয়ে যান সেই ভয়ে।”

“আমি পালিয়ে যেতে আসিনি।”

ভারি অমায়িক হেসে পাঁচ বলল, “আজ্ঞে তা হলে কি চোখ খুলেই ফেলব। ভিরমি যাব না তো?”

“যেতেও পারো।” বলে ভগবান যেন মেঝের ওপর লাঠি ঠুকলেন।

চোখ খুলে ফেলল পাঁচু এবং ভারি অবাক হয়ে বলল, “এ কী?”

“এখন তা হলে ভগবানকে ডাকাডাকি হচ্ছে। তা এই ধর্মভাবটা আরও বছর ত্রিশেক আগে হলেই তো ভাল হত হে। তা শুনলুম, তুমি নাকি আমাদের দুলালবাবুকে চুরি-জোচ্চুরিতে নামাতে চাইছ! ঘাড়ে ক’টা মাথা তোমার, অ্যাঁ?”

পাঁচু মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, আমি যে আর কিছু জীবনে শিখিনি। আর দুলালবাবুও ভারি ওস্তাদ লোক।”

“বটে! ফের যদি আমাদের বাড়িতে ঢোকো বা দুলালবাবুকে ভাঙানোর চেষ্টা করো তা হলে কিন্তু—”

পাঁচু ভারি অভিমানী গলায় বলল, “সবাই তো আমাকে বকাঝকাই করে ভুবনবাবু। কিন্তু আমার যে উপায়টা কী হবে তা কেউ ভাবে না। বুড়ো বয়সে আমি এখন কী খাই, কী পরি, কে-ই বা আমাকে দেখে, অসুখ হলেই বা কী হবে কেউ ভেবে দেখে না। তা মারতে হয় দশ ঘা মারুন।

ভুবনবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, “তোমার ছেলেপুলে নেই?”

“কেউ নেই।”

“ইয়ে, তাহলে একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমার ল্যাবরেটরিতে একজন আগুপিছু করার লোক দরকার। খেতে পাবে, সঙ্গে কিছু হাতখরচাও। চুরি জোচ্চুরির দিকে ঝোঁক দেখলে কিন্তু—”

পাঁচু তাড়াতাড়ি নিজের নাক কান মলে বলল, “প্রাণ থাকতে আর ওসব নয়। আপনার বাড়িতে খ্যাঁটের বন্দোবস্তও বেশ ভাল। তবে আমার খোরাকটার কথা যদি মনে রাখেন-”

.

ভুবনবাবুর বাড়িতে এখন অখণ্ড শান্তি বিরাজ করছে। দুলালবাবু বাচ্চাদের হাতে কলমে বিজ্ঞান শেখাচ্ছেন। তাঁর কাজে পাঁচু নানারকম সাহায্য করে আর ফাঁক পেলেই খানিক ঘুমিয়ে নেয়। ভুবনবাবু রোজই আজকাল কিছু না কিছু আবিষ্কার করে ফেলছেন। রামলাল ভুবনবাবুর ধমক খাচ্ছেন রোজ। নন্দবাবু বিজ্ঞান ও কবিতার হাত থেকে রেহাই পেয়ে ভূতপ্রেত তন্ত্রমন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে ভারি ব্যস্ত আছেন। ভুতো এক ফাঁকে হেলমেটটা আবার যথাস্থানে রেখে এসেছে। ভূতেরাও আজকাল আর কোনও গণ্ডগোল করছে না।