৯. দারোগার হাসি

নয় – দারোগার হাসি

দেখতে দেখতে গ্রামে হাটে বাজারে এবং খেতে খামারে মাঠেঘাটে আফতাব দারোগার হাসি কলেরার বীজের মতন ঝাঁকে ঝাঁকে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই চমকে ওঠে, আরে তাই তো, তাই—ই তো! গোরাং ডাক্তার বাঘ পুষেছিল, ঘরে আছে অঢেল মাংসের জোগান।

সোনাদানার এত লোভ ওই বুড়ো ডাক্তারটার যে বিধবা মেয়েকে হেরু ডাকাতের হাতে ধরিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি। এর মধ্যে অঢেল সঙ্গতি এবং যুক্তি আছে।

ক্রমে চরণ চৌকিদার একদা বলে, ‘বিন্নির চিকিচ্ছের সময় ওনার বাড়ি দেখেছিলুম বটে, হু, সিদিন চোখ দুটাকে বিশ্বেস করিনি।’

চাঁদঘড়ি খালাসিও বলে, ‘আমার ভি সন্দ হয়েছেল!’

প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ে। সেরাজুল হাজি, ঘটকঠাকুর বটতলার ময়রাবুড়ি, কে না দেখেছে হেরুর সঙ্গে স্বর্ণলতার হাসাহাসি ঢলাঢলি। কেউ কেউ শোওয়া—টোওয়াও দেখেছে। নির্বোধ হেরু ফাঁদে পড়েছিল ডাক্তারের—এমন সরল হাবাগোবা লোকটা রক্তপাগল ডাকাত হয়ে উঠেছিল! কী সর্বনাশা ডাক্তার, কী জঘন্য ছেনাল তার মেয়ে, নাকি মেয়েটার দোষ নেই—বাপের চাপে বাধ্য হয়ে পাপের বিছানায় শুতে যায়। তবে, পরে সেও সোনাদানার লোভে পড়েছিল বইকি! তা না হলে—ময়রাবুড়ি বলেছে, বিধবা আবার সোনার গয়না পরে দিনদুপুরে ঘরে বসে থাকে। অত সোনা পাবেই বা কোথায়? গোকর্ণের সবাই জানে, গোরাং ডাক্তার বাউণ্ডুলে হাভেতে লোক! ওখানে গিয়ে খুঁড়লে আরও ইতিহাস বেরোতে পারে।

 গোরাং ডাক্তারের ডিসপেনসারির ছোট্ট বারান্দায় এখন ফাটল আর ধুলো—নিকোন হয় না। দু—চারটে ছাগল বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে। নেড়ি কুকুরগুলো এসে ঘুমিয়ে যায়। দুপুরবেলা ন্যাংটো কিছু বাচ্চা এসে ধুলোর ভিতর থেকে ঘু ঘু পোকা বের করে—

ঘু ঘু রে ঘু ঘু রে

তোর মা ডেকেছে এক কাঠ চাল দোব

ওঠো রে।।

একটা কাঠি দিয়ে ধুলোর ভিতর ঘুরিয়ে—ঘুরিয়ে খুদে ধূসর রঙের পোকা বের করে হাতের তালুতে রাখে। এই পোকাগুলোর স্বভাব অদ্ভুত। অনবরত লাটিমের মতন ঘেরে। ওরা আরও সুর ধরে চ্যাঁচায়—

ঘু ঘু রে, ওঠ রে!

মা ডেকেছে বাবা ডেকেছে

ভাত খাবে তো ওঠ রে।।

পরক্ষণে কেউ সতর্কভাবে চোখ টেপে। সবাই থাকে কিছুক্ষণ। না, কোনো সাড়া নেই বাড়িটার। ভয়ঙ্কর স্তব্ধতা বাঁজাডাঙার মতন স্থির। তখন ফের তারা চ্যাঁচায়—ঘু ঘু রে!

ময়রাবুড়ি চোখ টিপে বলে, ‘প্যাঁচার মতন লুকিয়ে থাকে! রাত্তিরে ঠিক বেরোয়। না বেরিয়ে পারে? ঠাহর করে দেখো, পিঠে দুটি ডানা গজিয়েছে তখন। উড়ে যাচ্ছে রেললাইন ডিঙিয়ে। টিশিনের ছোটবাবুর সঙ্গে এখন গলাগলি ভাব। ছ্যা ছ্যা ছ্যা। বেশ্যার মরণ হয় না গা। আমি হলে এতক্ষণ লাইনে মাথা দিতুম।’

হান্টারসায়েবের চিঠিতে কোনো কাজ হয়ে থাকলে কমলাক্ষ মোক্তার প্রায় বিনি খরচায় কেসটা নিয়েছে। হেরম্ব ব্যানার্জি পুলিশের ইন্সপেক্টর—কিন্তু সুপার হচ্ছে ডগলাস—পাদরি সাইমনের ভক্ত। গোরাংবাবুর বাড়ি সোনাদানা পায়নি দারোগা, কিন্তু সাক্ষী আছে অনেক। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যও প্রচুর। তাতে পাদরির রাগ পড়েনি—এখন সে রাগ উসুল হবার সুসময় ছাড়তে রাজি নয়। তার কথা হল—পাপীকে শাস্তি দিতেই হবে।

এ সবের ফলে তো বটেই, উপরন্তু হেরু ডাকাত জেলার বিভীষিকা—তার মাথার মূল্য একশো টাকা ঘোষণা করেছিলেন কালেক্টার বাহাদুর। ইংরেজরা ভারতবর্ষে সুশাসনের জন্য প্রশংসিত। অতএব ডাকাতি ও খুনের অপরাধে হেরুর ফাঁসিও হতে পারে। সেই সঙ্গে গোরাং ডাক্তার তার মন্ত্রণাদাতা কিংবা ‘থানী’ (আশ্রয়দাতা) হওয়ায় তিনিও বেশ মোটা দণ্ড পাবার যোগ্য। দুজনের জামিনের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

 সেই সময় ফৌজদারি মামলার বিচার খুব দ্রুত চুকে যেত। শীতের মাঝামাঝি হেরুর যাবজ্জীবন আর গোরাংবাবুর ছ’বছর সশ্রম জেল হল। হান্টার খুব তদ্বির করেছিলেন, ফল হল না। এবার আপীল করতে চাইলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন তাঁর ট্রলির ওপর, কাটোয়া জংশনের কাছে, এসে পড়ল অতর্কিতে একটা সান্টিং এনজিন। হান্টার মারা গেলেন।

এতসব ঘটছে, আর স্বর্ণলতা দিব্যি হাত পা ছড়িয়ে বেঁচে থেকেছে। একেকটা ঋজু দীর্ঘ গাছ থাকে অরণ্যে, তার সুশোভনতায় আকৃষ্ট পাখিরা ডালপাতায় হেগে বিচিত্তির করে ফেলে, সাপও কোটরবাসী হয়—স্বর্ণলতা তাই।

মোটা ঠান্ডাঠান্ডা গরাদের ওপার থেকে বাবা তাকে বলেছেন, ‘হাসিমুখে থাকিস, মা। মাথা উঁচু করে চলিস। ঈশ্বর তো আছেনই, তবে নিজের ওপর যার ভরসা নেই—ঈশ্বর তার কী করবেন? ঘোড়াটার যত্নপাতি করবি। শাকসবজি ফলাবি ওঠানে। খিড়কির পুকুরে পোনা ছেড়ে দিলুম বর্ষায়। দেখবি, অ্যাদ্দিনে ডাগর হয়েছে। অভাব হলে মাঝে মাঝে বেচিস। আর আমার জন্যে মন খারাপ হলে বই পড়িস। আর স্বর্ণ, হোমিয়োপ্যাথিটাও শিখে নিস। বাংলা বই আছে দেখেছিস তো—মন দিয়ে পড়বি…হুঁ, স্বর্ণমা, মৌলুবি আসে না আর?’

‘একবার এসেছিলেন।’

‘শালা আমাকে দেখতে এল না।’

‘আসব—বলছিলেন।’

‘নেড়েটার এখন মরশুম—চাষিদের ফসল উঠছে।…হু স্বর্ণ, কেউ আমার প্রশংসা করে না? কেউ বলে না—আমি নির্দোষ?’

‘বলে।’

‘বলে? অ্যাঁ? কে বলে রে? কারা তারা?’

‘ছোট মাস্টারবাবু….’

‘ওকে দাদা বলিস। খুব ভালো ছেলে—মহৎপ্রাণ যুবক।’

‘বড় মাস্টারবাবুও বলে।’

‘জর্জ? জর্জও তাহলে বলে?’ গোরাংবাবু পাগলাঘোড়ার মতন লাফান।

‘বলে। বাবা, ওঁকে আমি বাংলা শেখাব—কথা হয়েছে। মাইনে পাব।’

‘বাঃ বাঃ! আমার কত সুখ হচ্ছে স্বর্ণ, আঃ—আমার…’

‘বাবা, হেরুর সঙ্গে দেখা করব। বকবে?’

‘স্বর্ণ, থাক।’

‘কেন—থাক কেন?’

‘স্বর্ণ—ও শালা পাথর, ও বাউরির পো একটা জন্তু। শালাকে ভেবেছিলুম একখানা আস্ত ভলক্যানো—ভিসুভিয়াস! তো হেরু একটা খেঁকশিয়াল। খেঁকশিয়ালের বাচ্চা! একটা—একটা ভেড়া! ছাগল শালা। থুঃ থুঃ!’

ফিরে এসে স্বর্ণ এতদিনে বদলায়।

বন্ধ ডিসপেনসারির দরজা খুলেছে। ঝাঁট আর নিকোন চলেছে যথারীতি। নকশিপাড় সাদা শাড়ি আনিয়েছে সুধাময়কে দিয়ে কাটোয়া থেকে। পায়ে চটি পরেছে। বাকসো থেকে দুগাছা রুলি বের করে হাতে পরেছে। খুব গম্ভীরমুখে সকালে শীতের রোদে বাবার মতন সে বসে থাকে চেয়ারে। বড় মাস্টার জর্জ এসে পড়া মুখস্থ করে—’আই সে, আমি বলি—ইউ সে, তুমি বলো—হি সে, সে বলে।’ শিশুর ভঙ্গিতে মধ্যবয়সি অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজটা পা দুলিয়ে উচ্চারণ করে—’ট্রি গাস, ট্রি ইজ গাস, গাস গাস গাস’।’

‘নো মাস্টার, নো। নট গাস—ঘাস ইজ গ্র্যাস। ট্রি মিনস গাছ।’

‘ঘাচ।’

‘গা—ছ—অ।’

‘গা—’

‘ছ—ছ।’

‘স—স।’

‘ফেট; আপনার দ্বারা কিস্যু হবে না!’

‘হোবে—হোবে। বোলো—ট্রি ইজ ঘ্যাচ…’

‘ঘ্যাচাংঘ্যাচ কাকে বলে ডু ইউ নো? থ্রোট কাটিং…’

‘হাঃ হাঃ হাঃ! নোবডি ক্যান ডু দ্যাট!’…

ছ’বছর—তার মানে একুশ শো নববই দিন। তাকে চব্বিশ দিয়ে গুণ করলে …উঃ। আমার বয়স ছ’বছর বাড়বে তখন। বাবা কি আরও ছ’বছর বাঁচবেন?

‘ও সায়েব, ইউ গো নাও। কাম আফটার—নুন।’

‘হোয়াট ম্যাটার?’

‘মাই মাইন্ড ইজ নট গুড!’

জর্জ আবার হাসে।…’দ্যাটস রাইট—বাট ইওর ইংলিশ ইজ নট গুড।’

বটতলায় এই সাতসকালে শুকনো পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বেলেছে। জড়োসড়ো স্ত্রীলোকগুলো—যারা গাড়িতে এসেছে—ওদিকে খালপুকুরে গিয়েছিল জৈবিক ব্যাপারে—তারা এখন কাঁপতে কাঁপতে রোদের দিকে আসছে। সবাই গোরা সায়েব দেখেই থমকায়। স্বর্ণর দিকেও তাকায়। ফিসফিস করে বলে কেউ, ‘ওঃ হো! ও মাসিমা, দ্যাখো দ্যাখো—এই সেই মেয়েটা।’

‘কোন মেয়েটা রে?’

‘কেন? গোরাং ডাক্তারের বিধবা মেয়ে—বাউরি ডাকাতের সঙ্গে যার নটা—ঘটা ছিল।’

‘মরণ! সক্কালে আবার ওই মুখ দেখে হাসছিস। তাকাসনে!’

‘গোরাদের সঙ্গেও কেমন ভাব দেখছ মাসিমা?’

‘হবে না! ওর মা—গোরাং ডাক্তারের মাগটাও যে তাই ছিল। আমরা সব জানি, বাবা। সেজন্যেই তো নিশিরেতে বিছানায় গলা টিপে মেরেছিল বউকে। কিন্তু মেয়ের বেলায় কী হল?’