৯. চার বুড়ো মিলে নদীর ধারে

চার বুড়ো মিলে নদীর ধারে একটা দড়ি ঝুলিয়ে বসে ছিল। দড়িটা টানটান হয়ে খরস্রোতের মধ্যে নেমে গেছে। দড়ির প্রান্তে গৌর। চারজন, অর্থাৎ কবরেজমশাই, ফকিরসাহেব, গোবিন্দ চোর আর সুবল বুড়ো দড়িটা মাঝে মাঝে টেনে দেখছে। না, এখনও গৌর দড়ি ছাড়েনি। এ-জায়গাটা বড় বিপজ্জনক। গৌর পারবে তো?

গৌর জলের তলায় নেমে ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল প্রথমে। উত্তাল স্রোতের জল প্রথমটায় অনেকখানি টেনে নিয়েছিল তাকে। দড়ি ধরে আবার সে জায়গামতো ফিরেছে। কিন্তু জলের নীচে নেমে ঘূর্ণি দেখে তার মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। ওরেব্বাস, একটু পা পিছলে পড়লেই সর্বনাশ। পাতালে টেনে নিয়ে যাবে।

কিন্তু কিছুই হল না। আশ্চর্য এই, জলের তলায় দীর্ঘক্ষণ দমবন্ধ করে থাকতেও তার কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। আর অন্ধকারেও সে বেশ দেখতে পাচ্ছিল।

ফাটলটা খুঁজে বের করতে তাকে বেশি বেগ পেতে হল না। ফাটলের মুখে পা দিয়ে সে দু’বার দড়িটা নাড়া দিয়ে ওপরে জানান দিল যে, সে নেমেছে।

আস্তে আস্তে সুড়ঙ্গ বেয়ে ওপরে উঠল সে। এখানে জল নেই। সে দম নিল। চারদিকে অনেকগুলো সুড়ঙ্গ গেছে। কোনটায় যাবে সে। কবচটা একবার স্পর্শ করতেই মাথাটা যেন পরিষ্কার হয়ে গেল। ওই তো সামনের পথ।

গৌর এগোতে লাগল। খুব ধীরে ধীরে এবং নিঃশব্দে। ভোর হতে আর দেরি নেই। ভোর হলেই কবচের ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং তাড়াতাড়ি করা দরকার। কিন্তু গৌর এটাও জানে, তাড়াতাড়ি করতে গেলে বিপদ বেশি।

সুড়ঙ্গটা চওড়া হচ্ছে। ক্রমে-ক্রমে একটা মস্ত হলঘরের চেহারা নিচ্ছে।

গৌর থমকে দাঁড়াল। অবাক হয়ে দেখল, পাতালে এক আশ্চর্য ঘর পাথর দিয়ে তৈরি। মাঝখানে একটা দীপ জ্বলছে।

কিন্তু ও কী? ওরা কারা? পাথরের অনেক তাক চারদিকে। প্রত্যেকটা তাকে একটা করে লম্বা কাঠের বাক্স। আর সেই সব বাক্স থেকে কঙ্কালসার, মস্ত মস্ত মাকড়সার মতো ওরা কারা নেমে আসছে? মানুষ? মানুষ কি এরকম হয়?

হঠাৎ একটা অমানুষিক তীব্র আর্তনাদে ঘরটা ভরে গেল। গৌরের সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করে উঠল সেই শব্দে। মৃতদেহগুলি একসঙ্গে তীব্র নাকিসুরে চিৎকার করতে লাগল! “মার! মার! শত্রু মার! মার! মার! আপদ মার! নির্বংশ হ! নরকে যা!”

চারদিক থেকে মৃতদেহগুলো এগিয়ে আসতে থাকে গৌরের দিকে, কেমন যেন কাঁকড়ার মতো, মাকড়সার মতো চলার ভঙ্গি। চোখ কোটরে, দাঁত বেরিয়ে আছে, হাড়গুলো থেকে চামড়া ঝুলে ঝুলে পড়ছে। বাসি, শুকনো, কবেকার মড়া! তবু আসছে, এগিয়ে আসছে!

গৌর প্রথমটায় নড়তে পারেনি ভয়ে। কিন্তু হঠাৎ যেন কে তাকে একটা ধাক্কা দিল। চনমন করে উঠল রক্ত। টাক থেকে কবচটা খুলে সে মুঠোয় নিল। তারপর খুব দুঃসাহসে ভর করে একটা লাফ মেরে সামনে যে মড়াটা পেল, সেটাকে সাপটে ধরল।

কিন্তু ধরতেই বেকুব বনে গেল গৌর। মড়াটা যেন ধুলোবালি দিয়ে গড়া। সে ছুঁতেই ঝুরঝুর ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে গেল মেঝেয়। চিহ্নমাত্র রইল না। এই আশ্চর্য কাণ্ড দেখে গৌর অবাক। কিন্তু অবাক হয়ে থেমে থাকার উপায় নেই। সময় আর খুব কমই আছে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কবচের খেলা শেষ হয়ে যাবে। গৌর আর-একটা মড়াকে ছুঁল। আর-একটা। ঝুরঝুরঝুরঝুর করে মৃতদেহগুলি ধুলোবালির মতো মিলিয়ে যেতে লাগল একে-একে।

শুধু দুটো মড়া একটু তফাতে রয়ে গেল। কাছে আসছিল না। গৌর লক্ষ করল, এ মড়া দুটো অন্যগুলোর মতো তেমন শুটকো নয়। চোখও কোটরগত নয়, চামড়াও ঝুলে পড়েনি। একটু রোগাভোগা মানুষের মতোই দেখতে। গৌর তাদের দিকে দু’পা এগোতেই মড়াদুটো চো-চাঁ দৌড়ে একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে পালাল। গৌর তাদের পিছু নিল না। মড়া মেরে আর লাভ কী? এখন তাড়াতাড়ি রাঘবের নাগাল পাওয়া দরকার।

কিন্তু কোথায় রাঘব? গৌর চারদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল। সময় কত হল তা বুঝতে পারছে না গৌর। কিন্তু ভোর হতে যে আর দেরি নেই, সেটা সে জানে। গৌর দৌড়োতে লাগল। একবার এই সুড়ঙ্গে ঢোকে, আবার ওই সুড়ঙ্গে ঢোকে। চারদিকে একটা গোলোকধাঁধা, এর মধ্যে রাঘব কোথায় লুকিয়ে আছে, তা কে বলবে!

ক্রমে ক্রমে ভারী হতাশ হয়ে পড়তে থাকে সে। একটু ভয়ও হয়। রাঘব তো সোজা লোক নয়। মাটির তলায় একটা ভ্যাপসা গরম আর সোঁদা গন্ধ। গৌরের ঘাম হতে থাকে, ক্লান্ত লাগে। তার চেয়েও বড় বিপদ, এতক্ষণ সে অন্ধকারেও বেশ দেখতে পাচ্ছিল। কবচেরই ১০২

গুণ হবে। কিন্তু এখন আস্তে-আস্তে চারদিকটা অন্ধকার হয়ে আসছে। গৌর বুঝল, কবচের তেজ নিঃশেষ হয়ে এল প্রায়। আর বেশিক্ষণ নয়।

গৌর সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা বাঁক ঘুরে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। সামনেই কিছু দূরে একটা পিদিম জ্বলছে। একটা ছায়া আড়ালে সরে গেল।

“কে ওখানে?” গৌর জিজ্ঞেস করে।

একটা গমগমে গলা বলে ওঠে, “এসো গৌর, আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।”

রাঘব! রাজা রাঘব! গৌর হাতের নিস্ফলা কবচটার দিকে একবার তাকাল।

রাঘবের গমগমে গলা বলে উঠল, “কবচের খেলা শেষ হয়ে গেছে গৌর। তোমার খেলাও। এগিয়ে এসো। পালাবার পথ নেই!”

গৌর আস্তে-আস্তে এগিয়ে গেল। পিদিমের আলোয় সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা চওড়া ঘর দেখতে পেল গৌর। রাঘবকে দেখা যাচ্ছিল না। গৌর ঘরটার মাঝামাঝি এসে দাঁড়াল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল, দেওয়ালে অনেক খাঁজ, অনেক কোটর।

দেওয়ালের একটা খাঁজের আড়াল থেকে কালান্তক যমের মতো বেরিয়ে এল রাজা রাঘব। দুটো চোখ ধকধক করে জ্বলছে। মুখটা গ্রানাইট পাথরের মতো কঠিন। পিদিমের আলোয় তার দীর্ঘ ছায়াটা ছাদে পৌঁছে গেছে।

গৌর রাঘবের চোখে চোখ রাখতেই কেমন যেন অবশ, নিথর হয়ে এল। হাত-পা সব যেন শিথিল। তার ফের হাঁটু গেড়ে বসতে ইচ্ছে করছিল রাঘবের সামনে। অস্ফুট কন্ঠে সে বলল, “হুজুর!”

রাঘব একটু হাসল। ডান হাতখানা আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তুলে বলল, “তুমি বাহাদুর ছেলে। কিন্তু বিপজ্জনক। একবার তোমাকে ক্ষমা করে ভুল করেছি। আর নয়। এগিয়ে এসো।”

“যে আজ্ঞে, হুজুর।” গৌর এগিয়ে যায়।

“মাথা নিচু করো ক্রীতদাস। ভয় নেই, তোমাকে আমি বেশি কষ্ট দিয়ে মারব না। গলাটা শুধু এক কোপে কেটে ফেলব।”

গৌরের ভারী আহ্লাদ হয়। সে একগাল হেসে বলে, “হুজুর খুশি হলেই আমার আনন্দ। কাটুন হুজুর। একবার শুধু মরার আগে যদি একটু পায়ের ধুলো পেতাম হুজুর।”

রাঘব ভ্রুকুটি করে বলে, “পায়ের ধুলো? ঠিক আছে ক্রীতদাস। নাও।”

গৌর যখন নিচু হয়ে রাঘবের পায়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে, তখন এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে সে থমকে হাঁ করে চেয়ে রইল। রাঘবের দু’ পায়ের ফাঁক দিয়ে পিছন দিকে অন্ধকারের মধ্যে সে দেখল, যে মড়া দুটো পালিয়ে গিয়েছিল, তারা ঘাপটি মেরে বসে জুলজুল করে তার দিকে চেয়ে আছে।

“কী হল গৌর?”

গৌর জবাব দিল না। মড়া দুটোর চোখ দিয়ে যে তীব্র রশ্মি ছুটে এল, তা যেন গৌরের গায়ে ছ্যাকার মতো লাগল। হঠাৎ যেন শরীরটা কেঁপে উঠল। মাথাটার ঝিমঝিমুনি ভাবটা কেটে গেল।

রাঘব তলোয়ারটা ধীরে-ধীরে ওপরে তুলছিল। কিন্তু আচমকাই গৌর তার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চোখের পলকে উলটে দিল রাঘবকে। দশাসই শরীরটা ধমাস করে যখন পড়ল, সমস্ত সুড়ঙ্গটা কেঁপে উঠল।

কিন্তু এত সহজে কাবু হওয়ার লোক তো রাঘব নয়। পড়তে না পড়তেই সে আবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু গৌর প্রস্তুত ছিল। কাবাডি খেলার সব কলাকৌশলই যেন তার শরীরে কিলবিল করছে। তলোয়ারসুদ্ধ রাজা রাঘবের হাতখানা ধরে সে এক মোচড়ে অস্ত্রটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তার শরীর রাগে, ঘেন্নায় নিশপিশ করছে। সম্মোহন কেটে গেছে। এখন হয় রাঘব, নয় সে।

রাঘব যে সাংঘাতিক শক্তিশালী পুরুষ, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার আসল শক্তি হল সম্মোহন। তার চোখের দিকে তাকালেই প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে বশ মেনে নেয়। সেই সম্মোহনের জাল কেটে বেরিয়ে এসেছে গৌর। রাঘবের গায়ে যত জোরই থাক, গৌরও তো ভেড়া নয়।

দুজনের তুমুল দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলতে লাগল। কখনও রাঘব তার গলা টিপে ধরে, কখনও গৌর তার কোমর ধরে পাঁচ মেরে ফেলে দেয়। কখনও রাঘব তার ঘাড়ে রদ্দা চালায়, কখনও গৌর তার ঠ্যাং ধরে উলটে ফেলে দেয়।

মড়া দুটো ঘাপটি মেরে বসে সবই দেখছিল। একজন মাথা নেড়ে বলল, “হচ্ছে না।”

আর-একজন বলল, “তা হলে মুষ্টিযোগ দিই?”

“দাও।”

তখন একজন মড়া খুব চিকন সুরে বলে উঠল, “রাঘবের চুলে আরশোলা।”

এই শুনে রাঘব বেখেয়ালে নিজের চুলে হাত দিল।

গৌর অবাক হয়ে দেখল, নিজের চুলে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাঘব চোখ উলটে গোঁ গোঁ আওয়াজ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

বেকুবের মতো কিছুক্ষণ রাঘবের দিকে চেয়ে রইল গৌর। তারপর তার নজর পড়ল, মড়া দুটোর ওপর। সেইরকম ঘাপটি মেরে বসে তাকে জুলজুল করে দেখছে।

“তবে রে? এবার তোদেরও ব্যবস্থা করছি!” বলে গৌর তাদের দিকে তেড়ে যেতেই মড়া দুটো ভয়ে সিটিয়ে গেল।

একটা মড়া বলে, “উঁহু উঁহু, ছুঁসনি রে হতভাগা! তফাত থাক। আমরা মড়া নই!”

“তবে কী?”

দাঁত খিঁচিয়ে মড়াটা বলল, “আমি ফটিক। তুই আমার নাতির নাতি। আমাদের দেবদেহ, ওই এঁটোকাঁটা নরদেহ নিয়ে আমাদের ছুঁলে মহাপাতক হবে।”

ফটিক! গৌর হাঁ হয়ে গেল।

মড়া দুটো উঠে দাঁড়িয়ে গা ঝাড়া দিল। ফটিক বলল, “সারাজীবন লড়াই করেও রাঘবকে কাবু করতে পারবি না। ক্রমে-ক্রমে তোকে হাফসে-হাফসে মেরে ফেলত। তাই মুষ্টিযোগটা কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছিলাম।”

গৌর অবাক হয়ে বলল, “মুষ্টিযোগ কী?”

“রাঘবের নিয়তি ওর চুলে। চুলে হাত দিলেই ওর পতন। তা এমনিতে কিছুতেই চুলে হাত দেওয়ার লোক নয় রাঘব। তোর সঙ্গে লড়াই করতে করতে যখন আনমনা হয়ে গিয়েছিল, তখনই কৌশলটা কাজে লাগালুম। এখন আমরা চলে যাচ্ছি। আর দেখা পাবি না।”

বলতে না বলতেই দুজন অন্ধকার একটা রন্ধ্রে ঢুকে সরে পড়ল। গৌর পিছন থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ফটিকদাদু, উনি কে?”

“যোগেশ্বরবাবা।”

.

হাউ, মাউ আর খাউকে দাদা বাড়ি থেকে তাড়িয়েছে। গৌরের এখন খুব খাতির বাড়িতে। গোরু চরাতে হয় না, তোক রাখা হয়েছে। বাসন-টাসন বউদিই মাজে। গৌর পেটভরে চারবেলা ভালমন্দ খায়।

কবরেজমশাই, ফকিরসাহেব, গোবিন্দ, সুবল, যে যার কাজকর্ম করে। সবই আগের মতো। নদীর ধারে দুপুরের দিকে একটা লম্বা লোক জমি চাষ করে হালগোরু নিয়ে। লোকটা কে, তা গাঁয়ের লোক খুব ভাল করে জানে না। শুধু জানে, লোকটাকে খানিকটা চাষের জমি আর বাস্তু দিয়েছেন কবরেজমশাই।

লোকটা আর কেউ নয়, রাজা রাঘব।