গোপালদের পাড়াটা শহরের এক প্রান্তে। একটু ঘিঞ্জি, নোংরা, গরিব পাড়া। গোপালদের বাড়িটাও বেশ পুরনো, একটু ভাঙাটাঙাও বটে। ভিতরের দিকে একখানা ঘরে গোপাল ঘোর জ্বরের মধ্যে শুয়ে ছিল। তার মা মাথায় জলপটি দিচ্ছে, পিসি আর ঠাকুমা বসে আছেন পাশে। বিভীষণ-চেহারার ঝিকু-সদার পায়চারি করছে ঘরে।
হরি ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, “গোপাল কেমন আছে?”
ঝিকু-সদার তার দিকে চেয়ে থমকে গেল, বলল, “ভাল নেই, মেলা ভুল বকছে। তোমার নামই কি হরি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“এসো, পাশের ঘরে এসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।” পাশের ঘরে হরিকে একটা মোড়ায় বসিয়ে মুখোমুখি আর-একটা মোড়ায় বসে ঝিকু বলল, “কাল রাতে সুড়ঙ্গের মধ্যে তুমি কী দেখেছ? কোনও মানুষকে?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে সে-কথা কে বলল?”
“পটল দাস। তার এখন মাথার ঠিক নেই।”
“হ্যাঁ, পটলদা কাল রাতে আমাকে আর-একটু হলেই মেরে ফেলেছিল।”
ঝিকু-সদার মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু বিশ্বাস করতে পারো, পটল খুনটুন কখনও করেনি, তার ধাতই সেরকম নয়। তবে কাল তোমার কথা শুনে তার মাথা বিগড়ে গিয়েছিল।”
হরি একটু অবাক হয়ে বলল, “এতে মাথা বিগড়োবার কী আছে, আমি বুঝতে পারছি না। সুড়ঙ্গের অনেকগুলো মুখ। সেগুলো একটা করে ঘরে গিয়ে শেষ হয়েছে। তেমনি একটা ঘরে আমি লোকটাকে দেখি।”
ঝিকুর চোখ ঝলসে উঠল। চাপা গলায় সে বলল, “লোকটা দেখতে মেন ছিল?”
“রোগা, ফর্সা, নীল চোখ।”
“সেই ঘরে কী ছিল?”
“একটা কাঠের বাক্স, একটা ডেকচেয়ার। আর তেমন কিছু নয়।” ঝিকু উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে করতে মাথা নেড়ে বলল, “নাঃ, অসম্ভব! এ হতেই পারে না! তুমি মিথ্যে কথা বলছ।”
হরি অবাক হয়ে বলল, “এতে মিথ্যে কথা বলার কী আছে?”
“ওই সুড়ঙ্গের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা আমি আর পটল তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কখনও ওরকম কিছু দেখিনি। তুমি ভুল দ্যাখোনি তো!”
হরি এবার একটু হেসে বিনীতভাবে বলল, “ভুল দেখাও সম্ভব। কিন্তু তার আগে বলুন, আপনারা কথাটা শুনে এরকম অবিশ্বাস করছেন কেন?”
ঝিকু অবাক হয়ে বলল, “তুমি কী দেখেছ তা কি এখনও বুঝতে পারছ? গোলঘরে নীল আলো, রোগা-ফসা একজন লোক বসে বাইবেল পড়ছে। সত্যিই বুঝতে পারছ না?”
“না। তবে এখন মনে হচ্ছে…।”
“হ্যাঁ। ঠিকই মনে হচ্ছে। সারা মোতিগঞ্জের লোক বহুকাল ধরে বহু ঘাম ঝরিয়ে, বহু মাথা খাঁটিয়ে যা বের করতে পারেনি, তুমি সেই পাগলা-সাহেবের কবর দেখেছ!”
এতক্ষণে হরির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। শরীরে একটা হিম স্রোত নেমে গেল।
হরি আর বসল না। পরে আসবে বলে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। বাইরে টুবলু তার জন্য অপেক্ষা করছিল। হরি তাকে বলল, “তোমাকে আর আমার সঙ্গে যেতে হবে না। তুমি বাড়ি যাও।”
টুবলু একটু হেসে মাথা নেড়ে চলে গেল।
.
হরি গোপালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকদূর হনহন করে হেঁটে গেল। তারপর রাস্তা জনহীন হয়ে গেলে সে চারদিকে চেয়ে টপ করে রাস্তা থেকে নেমে মাঠ আর জঙ্গলের ঘুরপথে ফিরে আসতে লাগল গোপালের বাড়ির দিকে। সন্ধে হয়ে এসেছে। গা-ঢাকা দেওয়ার সুবিধে খুব। ঝিকু-সদারের সঙ্গে কথা বলার সময় সে একটা ঘোড়ার ডাক শুনেছে।
গোপালদের বাড়ির পিছন দিকটায় খানিকটা পোড়ো জমি। চারদিকে কাঁটা ঝোঁপ। ঝোঁপের আড়ালে একটা টিনের ঘর। হরি খুব সাবধানে কাঁটা ঝোঁপের বেড়া টপকাল।
টিনের ঘরটায় তালা দেওয়া। কিন্তু ভিতরে ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে। খুব সন্তর্পণে হরি দরজাটা ঠেলে একুখানি ফাঁক করল। চোখ রেখে দেখল, ভিতরে একটা সাদা ঘোড়া পা দাপিয়ে মশা তাড়াচ্ছে।
হরি একটু হাসল। কাল বিকেলে তাকে আর টুবলুকে রাজর্ষি আর তার দলের হাত থেকে যে বাঁচিয়েছিল, সে যে সাহেব নয় এবং পাগলাও নয়, তাতে সন্দেহ নেই। রং-মাখা সাদা মুখটা এক ঝলক দেখে মনে রেখেছিল হরি। আর ঝিকু-সদারের মুখে সেই মুখের আদল দেখেই তার মনে হয়েছিল, পাগলা-সাহেব আসলে..
হরি ভাবতে ভাবতে নিজের বাসায় ফিরে এল।
ঝুমরি ফের একটা ছাতুর তাল দিয়ে গেল। আনমনে হরি সেটা যখন খাচ্ছিল তখন দরজার কাছে খুব বিনীতভাবে কে যেন কাসল একটু।
হরি চেয়ে দেখল, পটল দাস। চোখে মিটমিটে দৃষ্টি, মুখে অপরাধী হাসি।
হরি মুখটা গম্ভীর রেখে বলল, “কী খবর?”
পটল ঘরে ঢুকে উবু হয়ে হঠাৎ হরির দু’খানা পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বলল, “ব্রাহ্মণ মানুষ তুমি, বয়সে ছোট তো কী! আমায় মাফ করে দাও।”
হরি তাড়াতাড়ি পা টেনে নিয়ে বলল, “ওটা কী হচ্ছে!”
পটল দাস তার চাঁদরের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে বলল, “আমার মাথায় কাল শয়তানে ভর করেছিল। তোমার গলা টিপে ধরেছিলুম। কিন্তু যে-কোনও দিব্যি করে বলতে পারি, তোমাকে মারতুম না। ইচ্ছে ছিল, অজ্ঞান করে ফেলে কাঁধে করে নিয়ে তোমাকে গুম করে রাখব।”
“কেন বলো তো!”
পটল দাস ভেউ-ভেউ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর বলল, “বহুকাল আগে এক পাগলা-ফকির একটা অদ্ভুত কথা হাটে মাঠে বলে বেড়াত। ছুটেও নয়, হেঁটেও নয়, সাপের মতো…”
হরি বাকিটা পূরণ করে দিল, “কাছেও নয়, দূরেও নয়, গভীর কত। আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা। আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা।”
পটল চোখ বড় বড় করে বলল, “তুমি জানো?”
“জানি। হেডমাস্টারমশাই ছড়াটার কথা আমাকে বলেছিলেন।”
পটল দাস কিছুক্ষণ মুখ ঢেকে বসে থেকে ধরা গলায় বলল, “তোমার কাছে কিছু লুকোব না। পাগলা-সাহেবের ভূত ঘুরে বেড়ায় বলে লোকে বিশ্বাস করে। কিন্তু আসলে আজ অবধি আমি নিজে কখনও দেখিনি। কিন্তু…”
হরি ছাতুর শেষ দলাটা গিলে ফেলে বলল, “কিন্তু তোমরা কয়েকজন পাজি লোক পাগলা-সাহেব সেজে মাঝে-মাঝে দেখা দাও। লোকের মনে বিশ্বাস জন্মানোর জন্য।”
পটল দাস হরির মুখের দিকে চেয়ে অবাক গলায় বলল, “ তা হলে তুমি ধরতে পেরেছ? বাস্তবিকই তোমার খুব বৃদ্ধি। আমি তোমাকে প্রথমটায় বোকা ঠাউরেছিলুম।”
“কিন্তু তোমরা এটা কেন করো পটলদা?”
“মোতিগঞ্জের লোকেদের ভালর জন্যই। অন্যায় করলে, পাপ করলে পাগলা-সাহেব এসে হাজির হবেন। লোকে তাই খারাপ কাজ করার আগে একটু ভাববে। বিশ্বাস করো, আমাদের খারাপ মতলব কিছু ছিল না।”
“পাগলা-সাহেব কে সাজত?”
“কখনও ঝিকু, কখনও তার ছেলে গোপাল, আমিও সেজেছি। এক রকম মজাও ছিল খেলাটায়। কিন্তু কাল রাতে..,” বলে থেমে গেল পটল দাস। হাতখানা হরির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই দ্যাখো, রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।”
“কাল রাতে কী?”
“কাল রাতে যখন তোমার গলা টিপে ধরেছিলুম তখন যে-লোকটা সাদা ঘোড়ায় চেপে ছুটে এল, সে কিন্তু আমাদের কেউ নয়।”
একটু কাঁপা গলায় হরি বলল, “সে তা হলে কে পটলদা?”
পটল দাস জুলজুল করে হরির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “সেই কথাটাই জানতে এসেছিলুম তোমার কাছে। সে লোকটা কে? বুড়ো বয়স, চোখে ছানিও পড়েছে, কিন্তু তবু অন্ধকারে যেটুকু ঠাহর করতে পেরেছিলুম তা মনে করলে শরীর হিম হয়ে আসে।”
“তুমি কী দেখেছিলে?”
“একটা সাদা ঘোড়া ধেয়ে এল। তার ওপর সওয়ার এক লম্বাপানা রোগা সাহেব। চোখ দুটো জ্বলছিল ধকধক করে। সে আমাদের দিকে ছুটে এল, আমাদের ওপর দিয়েই ছুটে গেল, কিন্তু শুধু একটা ঝোড়ো বাতাস ছাড়া কিছুই টের পেলুম না। ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুট লাগালুম। হুমড়ি খেয়ে পড়লুম গিয়ে ওই ভাঙা পাঁচিলটার গায়ে। বহুকাল এরকম ভয় পাইনি।
“তারপর কী করলে?”
“কী করলুম, তা আর ঠিক মনে নেই। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলুম কিছুক্ষণ। এখনও আমার ধন্দ ভাবটা যায়নি। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি, সত্যিকারের পাগলা-সাহেবও ঘোড়ায় চেপে বেরোন বটে। আর তোমার ওপর তাঁর নজরও আছে। একটা কথা সত্যি করে বলবে? কাল সুড়ঙ্গের মধ্যে যা দেখেছিলে তা বানিয়ে বলোনি তো?”
“না পটলা, বানিয়ে বলার মতো বুদ্ধি আমার নেই।”
“ওরে বাবা! যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তোমার বড় বিপদ।”
“কেন, বিপদ কিসের?”
“পাঁচজনে জেনেও গেছে কিনা যে, তুমি কবরের হদিস পেয়েছ।”
“কে রটাল কথাটা?”
“ও কথা কি চাপা থাকে? যাকগে, এখন কথাটা হল, সেই কবরের হদিসটা তো দরকার।”
হরি হেসে বলল, “হদিস কিছু শক্তও নয়। চলো, দেখিয়ে দিচ্ছি।”
পটল সভয়ে চেয়ে বলল, “আমি! ও বাবা, আমি পাপী-তাপী মানুষ, পাগলা-সাহেব আমাকে ভস্ম করে ফেলবে। বরং আমি এখানে বসে থাকি। তুমি যাও গিয়ে জায়গাটা একবার দেখে একটু চিহ্ন রেখে এসো।”
হরি রাজি হল। পটল তাড়াতাড়ি টেবিলের ওপর চেয়ার তুলে ফেলল। মুখ-ঝাড়ুনি দিয়ে ছবিটাও সরিয়ে দিল। চাপা গলায় বলল, “জয় মা কালী।”
হরিবন্ধুর বুকটাও দুরদুর করছে। তবে কিনা পাগলা-সাহেব এ-পর্যন্ত তার উপকার ছাড়া অপকার তো কিছু করেনি! সে ধীরে-ধীরে সাহস সঞ্চয় করে সুড়ঙ্গে উঠে পড়ল।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে বাঁ দিকে ঠিক বিশ পা হাঁটল গুনে-গুনে। হঠাৎ এক ঝলক তীব্র টর্চের আলোয় ধাঁধিয়ে গেল তার চোখ। পরমুহূর্তেই লোহার মতো শক্ত দুটো হাত এসে দু’দিক থেকে তার দুটো হাত চেপে ধরল।
“কে? কে আপনারা?”
“চুপ, চেঁচিও না। চেঁচালে লাভও হবে না। চুপচাপ চলো, কবরটা আমাদের দেখিয়ে দাও।”
হরি লক্ষ করল, তাকে ঘিরে অন্তত আট-দশজন লোক। কারও মুখ দেখা যাচ্ছে না ভাল করে, কারণ টর্চের আলোটা সোজা তার চোখে এসে পড়েছে। সে বলল, “কী চান আপনারা?”
“বলেছি তো, কবরটা।”
“কবর! আমি কবরের কথা কিছু জানি না।”
একটা বেশ নিরুত্তাপ মোলায়েম কণ্ঠস্বর বলল, “আমরা সবই জানি হরি। আমাদের সঙ্গে চালাকির চেষ্টা কোরো না। কবরটা দেখিয়ে দাও, তোমাকে আমরা ছেড়ে দেব। কিছু পুরস্কারও দেওয়া হবে।”
“না দেখালে?”
“দুঃখের সঙ্গে এই সুড়ঙ্গে আমরা আর-একটা কবর খুঁড়ব, সে কবর তোমার। আর তোমার ওই চোর বন্ধুটিকে আমরা টুকরো-টুকরো করে শেয়াল শকুনকে খাওয়াব। আমাদের সঙ্গে সে চুড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিন্তু তার ব্যবস্থা পরে হবে। এখন কবরটা আমাদের আগে দরকার।”
“এতগুলো লোকের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনও আশাই নেই। হরি খুব দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। তারপর বলল, ঠিক আছে। আমার হাত ছেড়ে দিন, আর আপনারা আমার পিছনে আসুন।”
“হাত ছাড়া হবে না। আমাদের বোকা পাওনি।”
“হাত না ছাড়লে আমি রাস্তা গুলিয়ে ফেলব। খুব হিসেব কষে গুনে-গুনে পা ফেলতে হবে। হাত ধরা থাকলে সেটা সম্ভব নয়।”
আচমকাই দুটো হাত ছেড়ে দেওয়া হল হরির। মোলায়েম কণ্ঠস্বরটি বলল, “ছেড়ে দিলাম। কিন্তু মনে রেখো, তোমার দিকে তিনটে রিভলভার তাক করা আছে।”
হরি বিরক্তির সঙ্গে বলল, “বন্দুক-পিস্তল দিয়ে সব কাজ উদ্ধার হয়। টর্চটা নিবিয়ে ফেলুন, আমার অসুবিধে হচ্ছে।”
কী জানি কী ভেবে টর্চধারী হঠাৎ বাতিটা নিবিয়ে দিল। কিন্তু এমনভাবে আট-দশজন লোক হরিকে ঘিরে রইল যে, তাদের শ্বাস তার গায়ে লাগছিল, তাদের শরীরের উত্তাপও সে টের পাচ্ছিল।
যতদূর সম্ভব হিসেব কষে হরি যেখানে এসে দাঁড়াল, সেখানে নিরেট দেওয়াল। হরি একটু ভাবল। তার গোনায় কোনও ভুল হয়নি তো!
মোলায়েম কণ্ঠস্বর জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
“আবার সিঁড়ির গোড়া থেকে আসতে হবে। রাস্তাটা ভুল হয়েছে।”
“চালাকি ছাড়ো।”
হরি দৃঢ়স্বরে বলল, “আপনাদের জন্যই এমন হল। এবার আমাকে নিজের মনে কাজ করতে দিন। আপনারা তফাতে থাকুন।”
“বেশ ফন্দি।”
“ফন্দি মোটেই নয়। আপনারা ভালই জানেন, আজ পালাতে পারলেও কাল আমি ফের আপনাদের হাতে ধরা পড়ে যাব। আমি পালাব না। ভয় নেই, কিন্তু একটা কথা, কবরের মধ্যে পাগলা-সাহেব কিন্তু জেগেই বসে থাকেন।”
মৃদু একটু হাসির তরঙ্গ ছড়িয়ে গেল সকলের মধ্যে। মোলায়েম কণ্ঠস্বরটি বলল, “বেশ তো, একশো বছর আগেকার একটা মড়া যদি সত্যিই জেগে থাকতে পারে তবে তার একটা ইন্টারভিউ নেওয়া যাবে।”
আর একজন একটু স্তিমিত গলায় বলল, “পাগলা-সাহেব জেগে থাকবেন না। থাকলেও তাঁকে চিরদিনের মতো ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হবে।”
হরি একটু চমকে উঠল।
সিঁড়ির গোড়া থেকে হরি আবার পা গুনে-গুনে হাঁটতে লাগল। এবং কিছুক্ষণ পরে আবার গিয়ে ঠেকল নিরেট দেওয়ালে।
“এবার কী হল?”
“হরি মৃদু স্বরে বলল, “হচ্ছে না। গুলিয়ে ফেলছি।”
“নাকি চালাকি করছ?”
“তাতে লাভ কী? আবার দেখছি, ধৈর্য ধরুন।”
“ধরছি।”
হরি অন্তত দশবার চেষ্টা করল। একবারও কোনও রন্ধ্রপথ আবিষ্কার করতে পারল না। অথচ কাল রাতে…
চটাস করে তার গালে একটা চড় এসে এত জোরে ফেটে পড়ল যে, চোখে কিছুক্ষণ অন্ধকার দেখল হরি।
মোলায়েম গলা বলল, “হাঁটি-হাঁটি পা-এর খেলা এবার বন্ধ করো। আমরা সেই ছড়াটা জানি। ছুটেও না, হেঁটেও নয়, সাপের মতো। কাছেও নয়, দূরেও নয়, গভীর কত। আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা। আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা। ঠিক কিনা?”
হরি জবাব দিল না। গালে হাত বোলাতে বোলাতে মনে-মনে ফুসতে লাগল।
মোলায়েম গলা বলল, “আমরা ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। আমরা কাজে বিশ্বাসী। এই ছড়াটা একটা সঙ্কেত। আমরা যেখানে যেতে চাইছি সেখানে পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না। যেতে হবে সাপের মতো বুকে হেঁটে। আর জায়গাটা গভীরে, অর্থাৎ নিচু কোনও গর্ত বা পাতাল-ঘরে। সুতরাং
তোমার চালাকিটা খাটছে না।”
মাঝে-মাঝে টর্চের আলো জ্বলে উঠছে। সেই আলোর আভায় হরি লোকটাকে বুঝবার চেষ্টা করল। গলাটা যেমন নরম, চেহারাটা তত নয়। বেশ লম্বা-চওড়া শক্ত কাঠামোর চেহারা। দলের সবাই যে তাকে ভয় পায় তাতে সন্দেহ নেই। সে ছাড়া আর কেউ কোথাও কথা বলছে না।
মোলায়েম গলার স্বর শোনা গেল আবার, “কী, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে যে!”
“আমার কিছু মনে পড়ছে না।”
“ঠিক আছে, যখন মনে পড়বে তখন আমাদের ডেকো। ওরে, একে নিয়ে যা।”
সঙ্গে-সঙ্গে সাঁড়াশির মতো দুটো হাত এসে তার দুই বাহু ধরল। পিছন থেকে কে যেন তার মাথার ওপর দিয়ে একটা টুপির মতো জিনিস পরিয়ে সেটা টেনে নামিয়ে দিল গলা অবধি। মুখ-চোখ সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেল হরির। পিছমোড়া করে তার দু হাতে একটা হাতকড়া পরানো হল খট করে। তারপর তাকে টানতে টানতে কোথা থেকে যে কোথায় নিয়ে যেতে লাগল এরা তা বিন্দুমাত্র আন্দাজ করতে পারল না সে। সুড়ঙ্গটা যে ভয়ঙ্কর জটিল এবং পিঁপড়ের বাসার মতো অনেক ভাগে বিভক্ত, তা জানে হরি। এখানে হারিয়ে গেলে ফিরে আসা খুবই কঠিন।
অনেক সিঁড়ি ভেঙে নামতে হল তাকে। ডাইনে-বাঁয়ে অনেক পাক খেতে হল। মিনিট-দশেক বাদে একটা জায়গায় তাকে দাঁড় করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল হাত। তার কিছুক্ষণ পরেই একটা দরজায় তালা দেওয়ার শব্দ হল।
হাতকড়া দেওয়া হাত দুটো পায়ের তলা দিয়ে গলিয়ে সামনে এনে ফেলল হরি। মুখের ঢাকনাটা খুলে চারদিকে চাইল। অন্ধকারে যতটুকু বোঝা গেল, এটাও একটা নিচ্ছিদ্র গোল ঘর। গোলাকার ঘর এই সুড়ঙ্গে অনেকগুলো আছে বোধহয়।
হরি দরজাটা পরীক্ষা করে দেখল। খুবই মজবুত কাঠের দরজা। এ-দরজা ভেঙে হাতিও বেরোতে পারে কি না সন্দেহ। তা ছাড়া বেরিয়ে লাভই বা কী? ওপাশে ওরা বন্দুক-পিস্তল নিয়ে পাহারায় আছে।
হরি মেঝের ওপর চুপচাপ উবু হয়ে বসে রইল। আশপাশ দিয়ে ইঁদুর ৮০।
দৌড়চ্ছে। আরশোলা গায়ে বাইছে। মেঝে থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ আসছে নাকে। মাটির কত নীচে, কোন পাতালে তাকে আনা হয়েছে তা বুঝছে পারছিল না হরি। কত রাত হয়েছে তারও আন্দাজ নেই। ছাতুর তালটা কখন হজম হয়ে গেছে। এতক্ষণে ঝুমরি বোধহয় গরম ভাতের থালা এনে তাকে খুঁজছে।
হরি ক্লান্তিতে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে চোখ বুজল। কখন ঘুমিয়ে পড়ল, তা তার খেয়াল নেই।
ঘুম যখন ভাঙল, তখনও চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। এই পাতালঘরে কোনও বাইরের আলো তো আসতে পারে না। ভোর হল কি না কে জানে! বড়ড খিদে পেয়েছে হরির। তার চেয়েও বেশি পেয়েছে তেষ্টা।
খুব ভয়ে-ভয়ে হরি অনুচ্চ স্বরে ডাকল, “কেউ আছেন? আমার বড় জলতেষ্টা পেয়েছে।”
তার গলার স্বর গভীর ঘরটায় গমগম করে প্রতিধ্বনিত হল। একটু বাদে দরজা ধীরে-ধীরে খুলে গেল। মোলায়েম কণ্ঠস্বর বলল, “জল নেই।”
একথায় যেন জলতেষ্টা আরও বেড়ে গেল হরির। সে বলল, “আমার তো কোনও দোষ নেই। আমাকে আটকে রেখেছেন কেন?”
“শুনেছি পাগলা-সাহেব তোমাকে পছন্দ করে খুব। তোমার বিপদ দেখলে সাহেব নাকি কবরে থাকতে পারে না, উঠে আসে ঘোড়ায় চেপে। আমরা তার জন্যই অপেক্ষা করছি। তোমাকে নয়, আমরা পাগলা-সাহেবকেই চাই।”
“এই কথা আপনাকে কে বলল যে, পাগলা-সাহেব আমাকে পছন্দ করেন?”
“কেন, তোমার চোর বন্ধু পটল দাস।”
“তাকে কোথায় পেলেন?”
মোলায়েম গলা একটু হাসল। বলল, “পেতে অসুবিধে হয়নি। সে তো তোমার ঘরে বসে চাতকের মতো ঊর্ধ্বমুখ হয়ে তোমার জন্য প্রতীক্ষা করছিল। পিছন থেকে যখন আমার লোকেরা গিয়ে তাকে ধরে, তখন সে টু শব্দটিও করতে পারেনি।”
“পটলদা কোথায়?”
“আছে। তোমার পেয়ারের আরও লোকজনও এখন আমাদের কজায়। জগুরাম, তার বউ, দুটো বাচ্চা।”
হরি চমকে উঠে বলল, “তারা তো কিছু করেনি!”
“সেটা আমরা বুঝব।”
হরি হঠাৎ কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে একটা মেয়ের গোঙানি শুনতে পেল। সেইসঙ্গে দুটো কচি গলার ফোঁপানি। ওই কি ঝুমরি আর তার দুটো বাচ্চা? ভারী ঠাণ্ডা, ভাল মেয়ে ঝুমরি। তাকে কেন পাষণ্ডটা কষ্ট দিচ্ছে?
হরি কাতর গলায় বলল, “ওদের কেন ছেড়ে দিচ্ছেন না?”
“দেব। পাগলা-সাহেবের দেখা পেলেই দেব। আর যদি আজ রাতে পাগলা-সাহেবের হদিস না পাই তা হলে তোমাদের ঠিক এই অবস্থায় ফেলে রেখে আমরা চলে যাব। অবশ্য প্রত্যেকের কপালের মাঝখানে একটা করে পিস্তলের গুলি চালিয়ে…”
হরি শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি দাঁড়াল। বলল, “শুনুন, নিজের চেষ্টায় পাগলা-সাহেবের কবর কেউ খুঁজে পায়নি। আমি পেয়েছিলাম আকস্মিকভাবে।”
লোকটা কথাটা বিশ্বাস করল না। একটু ঝাঁঝের গলায় বলল, “আমরা কতদূর মরিয়া তা বোধহয় তুমি এখনও বুঝতে পারছ না। ঠিক আছে, এসো আমার সঙ্গে।”
লোকটা অন্ধকারে তার হাত ধরল। এরকম শক্তিমান হাত হরি আর দ্যাখেনি। আঙুল যেন ডাইস মেশিন।
পাশেই একটা ঘরের দরজা খুলে টর্চের আলো ফেলল লোকটা।
হরি দেখল, নোংরা ধুলোর ওপর মেঝেয় হাত-পা বাঁধা ঝুমরি পড়ে আছে। মুখে কাপড় গোঁজা। তার দু’পাশে দুটো বাচ্চা শুয়ে আছে। ঘুমের মধ্যেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে মাঝে-মাঝে।
“এসো, পাশের ঘরে দেখবে এসো,” বলে লোকটা দরজায় তালা দিল।
পাশের ঘরে মেঝের ওপর পড়ে আছে জগুরাম। তার হাত-পা বাঁধা নেই বটে, কিন্তু বাঁধনের আর দরকারও নেই। জগুরামের শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। বাঁ হাতটা এমনভাবে মোচড়ানো যে মনে হচ্ছে ভাঙা। জগুরামের জ্ঞান নেই।
মোলায়েম গলা বলল, “খুব ভাল লোক নয় এ। খামোখা আমাদের সঙ্গে গা-জোয়ারি দেখাতে গেল।”
“ইশ। হয়তো বাঁচবে না।”
“বেঁচে থাকার দরকারটাই বা কী? এসো, তোমার বীর-পটলদার দশাও একটু দ্যাখো।”
লোকটা আর-একটা ঘর খুলে আলো ফেলল।
হরি অবাক হয়ে দেখল, পটল দাসের দুটো হাত দুটো দড়িতে বাঁধা, সেই দুই দড়িতে ঘরের মাঝবরাবর মেঝে থেকে অন্তত সাত ফুট ওপরে শূন্যে ঝুলছে। কপালে মস্ত ফোলা ক্ষতচিহ্ন, এখনও রক্ত গড়িয়ে মুখ ভেসে যাচ্ছে। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার। খাস টানা এবং ফেলার ঘোরতর শব্দ হচ্ছে।
মোলায়েম কণ্ঠস্বর বলল, “কাল রাতে আমার দলের কয়েকজনকে আনাড়ি পেয়ে খুব ঘোল খাইয়েছিল। জানত না যে, ওস্তাদেরও ওস্তাদ আছে। একটু বেশি বীরত্ব দেখিয়ে ফেলেছিল বলেই এই শাস্তিটা ওকে দিতে হল।”
এতক্ষণ সহ্য করছিল হরি কোনওক্রমে। কিন্তু এই দৃশ্যটা দেখার পর তার মাথায় একটা রাগের আর দুঃখের পাগলা ঝড় উঠল। ঝুমরি, দুটো নিষ্পাপ বাচ্চা, সরল জগুরাম, পটলদা, এরা তো নিদোষ!
মোলায়েম গলা তার দিকে ফিরে বলল, “এদের তুলনায় তোমার প্রতি আমরা কিন্তু যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহারই করেছি। তাই না?”
রাগে দুঃখে হরির মুখে কথা ফুটল না।
মোলায়েম গলা বলল, “আরও দেখবে? এসো। এখানে অনেক ঘর আছে।”
লোকটা আর-একটা ঘর খুলে দিয়ে বলল, “এরা বাপব্যাটা তোমাদের উদ্ধার করতে এসেছিল।
হরি দেখল, মেঝেতে আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়ে পড়ে আছে ঝিকু-সদার। ঘরের এক কোণে মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে গোপাল। তার মাথায় এখনও ব্যাণ্ডেজ। জ্ঞান নেই কারও।
মোলায়েম গলা বলল, “এরা বাপব্যাটায় পাগলা-সাহেব সেজে সাদা ঘোড়ায় চেপে এতকাল ধরে লোককে বোকা বানিয়ে এসেছে। আমাদেরও বানিয়েছিল!”
হরি অস্ফুট গলায় শুধু বলল, “কিন্তু গোপালের যে জ্বর!”
“জানি। তবে জ্বর তো আর মরে যাওয়ার পর থাকবে না। তখন গা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।”
“কিন্তু আপনি এদের কেন মারবেন?”
“আমার কাছে মানুষ আর পিঁপড়েয় তফাত নেই। বাঁচিয়ে রাখলে অনেক ঝামেলা। শত্রুর গোড়া থেকে যাবে, সাক্ষী থেকে যাবে। আমি যখন যা করি তার চিহ্ন মুছে ফেলি। তবে যদি কবরটা দেখিয়ে দিতে পারো তা হলে অন্য কথা।”
“কী কথা?”
“কবরটার সন্ধান দিলে তোমাকে পুরস্কার দেব বলেছিলাম। আমি বাজে কথা বলি না। তুমি এদের প্রাণ পুরস্কার হিসেবে পেতে পারো।”
লোকটার দিকে অন্ধকারে হরি চেয়ে রইল। মুখটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু লোকটা মানুষ না দানব সে বিষয়ে সন্দেহ হতে লাগল হরির।
হঠাৎ তার মাথায় কী দুর্বুদ্ধি চাপল কে জানে, হরি তার হাতকড়া-পরা হাত দু’খানা তুলে আচমকা লোকটার কপালে বসিয়ে দিল।
অন্তত হরি ভেবেছিল তাই। কিন্তু অতিশয় ধূর্ত লোকটা কী করে যেন চোখের পলকে টের পেয়ে একটা হাত তুলে খপ করে হরির হাত ধরে ফেলল, যেভাবে সাপুড়ে বিষাক্ত সাপকে ধরে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই অন্ধকার আনাচকানাচ থেকে আট-দশজন লোক ছুটে এল।
হরির মাথার আগুনটা নিবল না। সে হাত নাড়তে না পেরে ডান পায়ে একটা লাথি ছুঁড়ল। লাথিটা শূন্যে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল।
তিন-চারজন লোক পিছন থেকে ধরল হরিকে।
হরি বুঝল, এই খুনিরা এরপর তাকে আর আস্ত রাখবে না। মরতেই যদি হয় তো লড়ে মরাই ভাল।
হরি আর বাছবিচার করল না। অন্ধকারে শিকলে বাঁধা হাত আর দু’খানা মুক্ত পা নিয়ে সে যথেচ্ছ চালাতে লাগল চারদিকে। অবশ্য চারদিক থেকে মারগুলোও ফিরে আসতে লাগল।
হরি মার খেতে-খেতেও হাতকড়া পরা হাত দুটো দিয়ে পট করে জড়িয়ে ধরল মোলায়েম কণ্ঠস্বরের গলাটা। তারপর সকলে মিলে একটা বিশাল মানুষের পিণ্ড পাকিয়ে গেল।
সেই পিণ্ডটা গড়াতে লাগল। গড়াতে লাগল। একটু ঢালু জমি না? গড়াতে গড়াতে ঢালু বেয়ে নেমে যেতে লাগল সবাই।
কে যেন চেঁচাল, “সামালকে!”
কিন্তু সামলানো যাচ্ছিল না। পিছল ঢালু বেয়ে তারা সকলে পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি অবস্থায় অসহায়ভাবে গড়িয়ে যেতে লাগল। অন্ধকার রন্ধ্রপথটা যে কতদূর গেছে!
ঝং করে বিকট একটা শব্দ হল।
কিসে এসে ঠেকল তারা?
ধীরে-ধীরে লোকগুলো উঠে বসল। চারদিকে তাকাতে লাগল। হরি নির্নিমেষ চেয়ে ছিল কাঠের চৌকো দরজাটার দিকে। দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। না, বেশি নয়। সামান্যই।
আর সেই ফাঁক দিয়ে এক অদ্ভুত নরম, মায়াবী নীল আলো এসে ভরে দিল সুড়ঙ্গ।
মোলায়েম গলা অবাক হয়ে বলল, “এ কী?”
হরিবন্ধু হতাশায় ভরা গলায় বলল, “কবর। পাগলা-সাহেবের কবর।”
দরজাটা ঝটাং করে খুলে দিল মোলায়েম গলার লোকটা।
নীচে সেই গোল ঘর। কাঠের বাক্স। একটা ডেকচেয়ার। সব যেন নীল আলোয় ডুবে আছে। ডেকচেয়ারে রোগ! লম্বা মানুষটা আজও শোওয়া। কোলে খোলা বাইবেল।
লোকটা খুব ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর ওপর দিকে চেয়ে গমগমে প্রতিধ্বনিত গলায় বলল, “তোমরা কিছু চাও? নেবে যিশুর এই চিহ্ন?”
গলা থেকে আশ্চর্য সুন্দর একটা সোনার ক্রস খুলে আনল লোকটা। ডান হাতে ক্রসটা উঁচু করে তুলে ধরল ওপর দিকে। এত দূর থেকেও দেখা যাচ্ছিল, হিরে বসানো ক্রসটায় যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
“এসো, ধীরে ধীরে নেমে এসো। আলোর সিঁড়ি পাতা আছে। এসো।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো একে-একে লোকগুলো নেমে যেতে লাগল।
হরি জানে, সিঁড়ি নেই। সিঁড়ি ছিল না। তবু লোকগুলো যেন ঠিক সিঁড়ি বেয়েই নেমে যেতে লাগল। কারও মুখে কথা নেই। মূক, বাক্যহারা, পলকহীন।
নীচের নীল ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত নীল আলোর সমুদ্র যেন। লোকগুলো নামছে, নামতে নামতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে নীলের মধ্যে। বুদ্বুদের মতো।
পাগলা-সাহেব একা ক্রসটা তুলে ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
কিন্তু কেউই শেষ অবধি তাঁর কাছে পৌঁছল না।
সাহেব ধীরে-ধীরে ক্রসটা আবার গলায় পরে নিলেন।
গমগমে কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “বিশ পা হেঁটে যাও পিছনে। রাস্তা পাবে। বিরক্ত কোরো না। আমি এখন বাইবেল পড়ছি।”
ভয়ে নয়, অদ্ভুত এক ভালবাসায় ভরে গেল হরির বুক। টপটপ করে চোখের জল পড়তে লাগল।
দরজাটা সাবধানে ভেজিয়ে দিয়ে হরি ফিরে আসতে লাগল। বিশ পা।
ঘটনার ছ’ মাস বাদের কথা। স্কুলের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল। হরিবন্ধু ফাস্ট।
খবরটা চাউর হতেই হেডস্যার ডেকে বললেন, “এইট-এ নয়, তোমাকে নাইন-এ তুলে দিচ্ছি, ডবল প্রোমোশন। যাও, মাস্টারমশাইদের প্রণাম করে এসো।”
ঝিকু-সদার তার সাদা ঘোড়াটা স্কুলেই নিয়ে এল। বলল, “এটা চড়েই আজ বাড়ি ফিরবে। এটা তোমাকে উপহার দিলুম।”
ঝুমরি বিকেলবেলায় আজ এত বড় একটা ছাতুর তাল মেখে আনল যে, বেড়াল ডিঙোতে পারে না। আর বলল, “রাতে তোমার জন্য ভোজবাড়ির রান্না হচ্ছে। বন্ধুদের ডাকো আজ নেমন্তন্নে। সবাইকে খাওয়াব।”
তা রাতে নেমন্তন্নে হুল্লোড় হল মন্দ নয়। শুধু পেটপুরে খেয়ে বিদায় নেওয়ার সময় পটল দাস একটু খিঁচিয়ে উঠে বলল, “এ-ছেলেটা লেখাপড়ায় ভাল হয়ে গোল্লায় গেল। বলি সেইসব কায়দাকানুন, বায়ুবন্ধন, প্যাঁচপয়জার শিখবে না?”
“শিখব পটলদা। তোমাকেও পড়াশুনো শেখাব।”
তার রেজাল্টের কথা জেনে বাবা খুশি হয়ে লিখলেন, “এবার তা হলে তোমাকে পুরনো স্কুলেই ফিরিয়ে আনব। আর কষ্ট করে মোতিগঞ্জে থাকতে হবে না।”
হরিবন্ধু তৎক্ষণাৎ জবাব লিখল, “পাশ না করে আমি মোতিগঞ্জ ছেড়ে কোথাও যাব না।”