‘কাঠবেড়ালির ল্যাজ নয় রে ওটা কাহার দাড়ি!’
যখন জ্ঞান হল তখন দেখি, আমি ডাক বাংলোর খাটে লম্বা হয়ে আছি। ঝাঁটু মাথার সামনে দাঁড়িয়ে আমায় হাওয়া করছে, ক্যাবলা পায়ের কাছে বসে মিটমিটে চোখে তাকিয়ে আছে আর পাশে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে টেনিদা ঘুঘুর মত বসে রয়েছে।
ঝাঁটুর হাতের পাখাটা খটাস করে আমার নাকে এসে লাগতেই আমি বললুম, উফ!
চেয়ার ছেড়ে টেনিদা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল : যাক, তা হলে এখনও তুই মারা যাসনি!
ক্যাবলা বললে, মারা যাবে কেন? হোড়াসে বেহুশ হয়ে গিয়েছিল। আমি তো বলেইছিলুম টেনিদা, ওর নাকে একটুখানি লঙ্কা পুড়িয়ে ধোঁয়া দাও—এক্ষুনি চাঙা হয়ে উঠবে।
টেনিদা বললে, আর লঙ্কা-পোড়া! যেমনভাবে দাঁত ছরকুটে পড়েছিল, দেখে তো মনে হচ্ছিল, পটলডাঙা থেকে এখানে এসেই বুঝি শেষ পর্যন্ত পটল তুলল।
মাঝখান থেকে ঝাঁটু বিচ্ছিরি রকমের আওয়াজ করে হেসে বললে, দাদাবাবু ডর খিয়েছিলেন!
ক্যাবলা বললে, যাঃ-যাঃ, তোকে আর ওস্তাদি করতে হবে না! এখন শিগগির এক পেয়ালা গরম দুধ নিয়ে আয় দেখি!
ঝাঁটু পাখা রেখে বেরিয়ে গেল।
আমি তখনও চোখে ধোঁয়া-ধোঁয়া দেখছি। ডান চোয়ালে অসম্ভব ব্যথা। এমন চড় হাঁকড়েছে যে, গোটাদুয়েক দাঁত বোধহয় নড়িয়েই দিয়েছে একেবারে। চড়ের মতো চড় একখানা! অঙ্কের মাস্টারের বিরাশি সিক্কার চাঁটি পর্যন্ত এর কাছে একেবারে সুগন্ধি তিন-নং পরিমল নস্যি। আমি পটলডাঙার রোগা ডিগডিগে প্যালারাম, পালাজ্বরে ভুগি, আর পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাই, এমন একখানা ভৌতিক চপেটাঘাতের পরেও আমার আত্মারাম কেন যে খাঁচাছাড়া হয়নি, সেইটেই আমি বুঝতে পারছিলুম না।
টেনিদা বললে, আচ্ছা পুঁটিমাছ, তুই হঠাৎ ডাক ছেড়ে অমন করে অজ্ঞান হয়ে গেলি কেন?
এ অবস্থাতেও পুঁটিমাছ শুনে আমার ভয়ানক রাগ হল, চোয়ালের ব্যথা-ট্যথা সব ভুলে গেলুম। ব্যাজার হয়ে বললুম, আমি পুঁটিমাছ আছি বেশ আছি, কিন্তু ওরকম একখানা বোম্বাই চড় খেলে তুমি ভেটকিমাছ হয়ে যেতে! কিংবা ট্যাপামাছ।
ক্যাবলা আশ্চর্য হয়ে বললে, চাঁটি আবার তোকে কে মারলে?
—ভূত!
টেনিদা বললে, ভূত! ভূতের আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। খামকা তোকে চাঁটি মারতে গেল? তাও সকালবেলায়? পাগল না পেট-খারাপ?
ক্যাবলা বললে, পেট-খারাপ। এদিকে ওই তো রোগা ডিগডিগে চেহারা, ওদিকে পৌঁছে অবধি সমানে মুরগি আর আণ্ডা চালাচ্ছে। অত সইবে কেন? পেট-গরম হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। ভূত-টুত সব বোগাস।
টেনিদা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলে, ঠিক। আমিও ওই কথাই বলতে যাচ্ছিলুম।
ডান চোয়ালটা চেপে ধরে আমি এবার বিছানার ওপরে উঠে বসলুম।
—তোমরা বিশ্বাস করছ না?
টেনিদা বললে, একদম না। ভূতে আর চাঁটি মারবার লোক পেলে না!
ক্যাবলা মাথা নাড়ল; বটেই তো। আমাদের লিডার টেনিদার অ্যাঁয়সা একখানা জুতসই গাল থাকতে তোর গালেই কিনা চাঁটি হাঁকড়াবে? ওতে লিডারের অপমান হয়—তা জানিস?
শুনে টেনিদা কটমট করে ক্যাবলার দিকে তাকাল।
—ঠাট্টা করছিস?
ক্যাবলা তিড়িং করে হাত-পাঁচেক দূরে সরে গেল। জিভ কেটে বললে, কী সর্বনাশ! তোমাকে ঠাট্টা। শেষে যে গাঁট্টা খেয়ে আমার গালপাট্টা উড়ে যাবে। আমি বলছিলুম কি, ভূত এসে হ্যান্ডশেকই করুক আর বক্সিংই জুড়ে দিক, লেকিন ওটা দলপতির সঙ্গে হওয়াটাই দস্তুর।
টেনিদার কথাটা ভালো লাগল না। মুখটাকে হালুয়ার মতো করে বললে, যা-যাঃ, বেশি ক্যাঁচোর-ম্যাচোর করিসনি। কিন্তু তোকেও বলে দিচ্ছি প্যালা, এ বেলা থেকে তোর ডিম খাওয়া একেবারে বন্ধ! স্রেফ কাঁচকলা দিয়ে গাঁদালের ঝোল, আর রাত্তিরে সাবু বার্লি। আজকে মুচ্ছাে গিয়েছিলি, দু-চারদিন পরে একেবারেই যে মারা যাবি!
আমি রেগে বললুম, ধ্যাত্তোর তোমার সাবুবার্লির নিকুচি করেছে! বলছি সত্যিই ভূতে চাঁটি মেরেছে, কিছুতেই বিশ্বাস করবে না।
ক্যাবলা বললে, বটে? টেনিদা বললে, থাম, আর চালিয়াতি করতে হবে না।
আমি আরও রেগে বললুম, চালিয়াতি করছি নাকি? তা হলে এখনও আমার ডান গালটা টনটন করবে কেন?
টেনিদা বললে, অমন করে। খামকাই তো লোকের দাঁত কনকন করে, মাথা বনবন করে, কান ভোঁ-ভোঁ করতে থাকে তাই বলে তাদের সকলকে ধরেই কি ভূতে ঠ্যাঙায় নাকি?
আমি এবারে মনে ভীষণ ব্যথা পেলুম। এত কষ্টেসৃষ্টে যদিই বা গালে একটা ভুতুড়ে চড় খেয়েছি, কিন্তু এই হতভাগারা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না। ওরা নিজেরা খেতে পায়নি কিনা, তাই বোধহয় ওদের মনে হিংসে হয়েছে।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললুম, কেন বিশ্বাস করছ না বলে তো? তোমরা তো গুটিগুটি . সামনে এগিয়ে গেলে। এর মধ্যে গোটাকয়েক বৈঁচি-টেচি খেয়ে আমি দেখলুম, ঝোপের
মধ্যে একটা কাঠবেড়ালির ল্যাজ নড়ছে। যেই সেটাকে খপ করে চেপে ধরেছি, অমনি
—অমনি কাঠবেড়ালি তোকে চড় মেরেছে?বলেই টেনিদা হা-হ্যা করে হাসতে লাগল। আবার ক্যাবলার নাক-মুখ দিয়ে শেয়ালের ঝগড়ার মতো খিকখিক করে কেমন একটা আওয়াজ বেরোতে শুরু করল।
এই দারুণ অপমানে আমার পেটের মধ্যে পালাজ্বরের পিলেটা নাচতে লাগল। আর সেই সঙ্গেই হঠাৎ নিজের ডানহাতের দিকে আমার চোখ পড়ল। আমার মুঠোর মধ্যে–
একরাশ শাদা শাদা রোঁয়া। সেই ল্যাজটারই খানিক ছিড়ে এসেছে নিশ্চয়।
সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে বললাম, এই দ্যাখো, এখনও কী লেগে রয়েছে আমার হাতে!
ক্যাবলা এক লাফে এগিয়ে এল সামনে। টেনিদা থাবা দিয়ে রোঁয়াগুলো তুলে নিলে আমার হাত থেকে।
তারপর টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : এ যে—এ যে—
ক্যাবলা আরও জোরে চেঁচিয়ে বললে, দাড়ি।
টেনিদা বললে, পাকা দাড়ি।
ক্যাবলা বললে, তাতে আবার পাটকিলে রঙ। তামাক-খাওয়া দাড়ি।
টেনিদা বললে, ভূতের দাড়ি!
ক্যাবলা বললে, তামাকখেকো ভূতের দাড়ি!
ভূতের দাড়ি! শুনে আর একবার আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়ার জো হল। কী সর্বনাশ করেছি কী! শেষে কি কাঠবেড়ালির ল্যাজ টানতে গিয়ে ভূতের দাড়ি ছিড়ে এনেছি? তাই অমন একখানা মোক্ষম চড় বসিয়েছে আমার গালে! কিন্তু একখানা চড়ের ওপর দিয়েই কি আমি পার পাব? হয়তো কত যত্নের দাড়ি, কত রাত-বিরেতে শ্যাওড়া গাছে বসে ওই দাড়ি চুমরে-চুমরে ভূতটা খাম্বাজরাগিণী গাইত! অবশ্য খাম্বাজ রাগিণী কাকে বলে আমার জানা নেই, তবে নাম শুনলেই মনে হয়, ও-সব রাগ-রাগিণী ভূতের গলাতেই খোলতাই হয় ভালো। আমি সেই সাধের দাড়ি ছিড়ে নিয়েছি, এখন মাঝরাতে এসে আমার মাথার চুলগুলো উপড়ে নিয়ে না যায়। ক্যাবলা আর টেনিদা দাড়ি নিয়ে গবেষণা করুক—আমি হাত-পা ছেড়ে আবার বিছানার ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়লুম।
ক্যাবলা দাড়িগুলো বেশ মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে বললে, কিন্তু টেনিদাভুতে কি তামাক খায়?
-কেন, খেতে দোষ কী?
—মানে ইয়ে কথা হল ক্যাবলা মাথা চুলকে বললে, লেকিন বাত এহি হ্যায়, ভূতে তো শুনেছি আগুন-টাগুন ছুঁতে পারে না—তাহলে তামাক খায় কী করে? তা ছাড়া আমার মনে হচ্ছে—এমনি পাকা, এমনি পাটকিলেরঙ-মাখানো দাড়ি যেন আমার চেনা, যেন এ-দাড়িটা কোথায় আমি দেখেছি।
ক্যাবলা আরও কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ দু-পাটি জুতো হাতে করে ঘরের মধ্যে ঝাঁটু এসে ঢুকল। টেনিদার মুখের সামনে জুতোজোড়া তুলে ধরে বললে, এই দেখুন দাদাবাবু
টেনিদা চেঁচিয়ে উঠে বললে, ব্যাটা কোথাকার গাড়ল রে! বলা হল প্যালার খাওয়ার জন্য দুধ আনতে, তুই আমার মুখের কাছে জুতোজাড়া এনে হাজির করলি? আমি কি ও-দুটো চিবোব নাকি বসে বসে?
ঝাঁটু বললে, রাম রাম! জুতো তো কুত্তা চিবোবে, আপনি কেন? আমি বলছিলাম, হাবুলবাবু কুথা গেল! জুতোটা বাহিরে পড়েছিল, হাবুলবাবুকে তো কোথাও দেখলম না। ফির জুতোর মধ্যে একটা চিঠি দেখলম, তাই নিয়ে এলম।
জুতোর মধ্যে চিঠি? আরে, তাই তো বটে। আমি জ্ঞান হওয়ার পরে তো সত্যিই এ-ঘরে হাবুল সেনকে দেখতে পাইনি!
ক্যাবলা বললে,তাই তো! জুতোর ভেতরে চিঠির মতো একটা কী রয়েছে যে! ব্যাপার কী, টেনিদা? হাবুলটাই বা গেল কোথায়?
টেনিদা ভাঁজ করা কাগজটা টেনে বের করে বললে, দাঁড়া না কাঁচকলা, আগে দেখি চিঠিটা।
কিন্তু চিঠির ওপর চোখ বুলোতেই—সে দুটো তড়াক করে একেবারে টেনিদার কপালে চড়ে গেল। বার-তিনেক খাবি খেয়ে টেনিদা বললে, ক্যাবলা রে, আমাদের বারোটা বেজে
গেল।
–বারোটা বেজে গেল। মানে?
—মানে—হাবুল গন।
—কোথায় গন?—আমি আর ক্যাবলা একসঙ্গেই চেঁচিয়ে উঠলাম : চিঠিতে কী আছে টেনিদা? কী লেখা ওতে?
ভাঙা গলায় টেনিদা বললে, তবে শোন, পড়ি।
চিঠিতে খেলা ছিল :
হাবুল সেনকে আমরা ভ্যানিশ করিলাম। যদি পত্রপাঠ চাঁটিবাঁটি তুলিয়া আজই কলিকাতায় রওনা হও, তবে যাওয়ার আগে অক্ষত শরীরে হাবুলকে ফেরত পাইবে। নতুবা পরে তোমাদের চার মূর্তিকেই আমরা ভ্যানিশ করিব—এবং চিরতরেই তাহা করিব। আগে হইতেই সাবধান করিয়া দিলাম, পরে দোষ দিতে পারিবে না।
ইতি—ঘচাং ফুঃ। দুর্ধর্ষ চৈনিক দস্যু।