॥ ৯ ॥
কোনও একটা মামলার মাঝখানে ফেলুদাকে এত নিষ্কর্মা হয়ে পড়তে দেখিনি কখনও। আমরা পর পর দু’দিন লালমোহনবাবুকে নিয়ে লখ্নৌ শহর দেখিয়ে বেড়ালাম। আমি একবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফেলুদা, কী ব্যাপার বলতো? তুমি এত চুপচাপ বসে আছ কেন?’
ফেলুদা বলল, ‘অর্ধেক মামলার সমাধান হয়ে গেছে। বাকি অর্ধেক পুলিশের সাহায্য ছাড়া হবে না। আমি এর মধ্যে পাণ্ডের কাছ থেকে দু’বার ফোন পেয়েছি। মনে হয় পাকা খবর আর দু’দিনের মধ্যেই পেয়ে যাব।’
‘পুলিশের ব্যাপারটা কি সুকিয়াসের খুনের সঙ্গে জড়িত?’
‘ইয়েস’, বলল ফেলুদা।
‘আর হার চুরি?’
‘সেটা নিয়ে আর ভাববার কিছু নেই।’
‘আর সুকিয়াসের খুন সম্বন্ধে তোমার কি কোনও ধারণাই নেই?’
‘আছে, কিন্তু প্রমাণ চাই? সেই প্রমাণটা পুলিশ গুণ্ডাটাকে ধরতে পারলেই পেয়ে যাব। কে খুন করিয়েছে সে সম্বন্ধে আমার একটা পরিষ্কার ধারণা আছে।’
আরও একটা দিন এই ভাবে কেটে গেল। আমরা জটায়ুকে নিয়ে মিউজিয়াম দেখিয়ে আনলাম। এখন জটায়ুর লখ্নৌ দেখা শেষ বললেই চলে। আমাদের কলকাতায় ফিরতে আর দু’দিন বাকি আছে।
দুপুরবেলা ফেলুদা যে ফোনটা আশা করছিল সেটা এল। মিঃ পাণ্ডের কাছ থেকে। কথা বলার পর ওকে জিজ্ঞেস করতে ফেলুদা বলল, ‘কেস খতম্। ওরা গুণ্ডাটাকে ধরেছে। শম্ভু সিং বলে এক পাঞ্জাবী। সে আদালতে দোষ স্বীকার করেছে, আসল লোককে দেখিয়ে দেবে বলেছে। যে ছুরিটা দিয়ে খুনটা করা হয়েছিল সেটাও পাওয়া গেছে।’
‘তা হলে এখন কী হবে?’
‘রহস্য উদ্ঘাটন। আজ সন্ধ্যা সাতটায় জয়ন্ত বিশ্বাসের বাড়িতে।’
এর পর ফেলুদাকে পর পর অনেকগুলো ফোন করতে হল। প্রথমে অবশ্য জয়ন্তবাবুকে। ভদ্রলোক রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘বাকি সবাইকে তা হলে আপনিই খবর দিয়ে দিন। আপনি ত সকলের টেলিফোন নম্বরই জানেন।’
ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে পৌনে সাতটার সময় হেক্টর জয়ন্ত বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। ইনস্পেক্টর পাণ্ডেও এসে পড়লেন সাতটার পাঁচ মিনিট আগে—সঙ্গে দু’জন কনস্টেবল, আর আরেকটি লোক যার হাতে হাতকড়া। বুঝলাম সেই হচ্ছে খুনি গুণ্ডা।
সাতটা বেজে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সকলে এসে পড়ল। সকলে বলতে তালিকাটা দিয়ে দিই—জয়ন্তবাবুর বাড়ির পাঁচজন, সাল্ডান্হার বাড়ির দু’জন আর রতনলাল ব্যানার্জি। প্রশস্ত বৈঠকখানায় সকলে চেয়ার আর সোফাতে ছড়িয়ে বসলেন। রতনলাল আগেই প্রশ্ন করলেন, ‘হোয়াট ইজ দিস ফার্স?’ ফেলুদা বলল, ‘আপনি এটাকে প্রহসন বলে মনে করতে পারেন, কিন্তু আর সকলের কাছে ব্যাপারটা বোধহয় খুবই সিরিয়াস।’
‘হারটা পাওয়া গেছে কি?’ চাপা স্বরে প্রশ্ন করলেন সুনীলা দেবী।
‘যথাসময়েই তার উত্তর পাবেন’, বলল ফেলুদা। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত সকলের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ‘রহস্যের সমাধান হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এটা পুলিশের সাহায্য ছাড়া হত না। আমি আপনাদের এখন ঘটনাটা বলতে চাই। আশা করি আপনাদের মনে যে সমস্ত প্রশ্ন রয়েছে তার জবাবও আমার কথায় পেয়ে যাবেন।’
‘আই হোপ খুব বেশি সময় নেবেন না,’ বললেন রতনলাল ব্যানার্জি, ‘আমার একটা ডিনার আছে।’
‘যতটুকু দরকার তার এক মুহূর্ত বেশি নেব না’, বলল ফেলুদা।
সবাই চুপ।
‘তা হলে এবার শুরু করি?’
‘করুন’, বললেন জয়ন্তবাবু।
‘গোড়াতেই বলে রাখি যে এখানে দুটো তদন্তের ব্যাপার নিয়ে আমাদের কারবার। এক হল শকুন্তলা দেবীর হার চুরি, আর দ্বিতীয় হল মিঃ সুকিয়াসের মার্ডার।
‘এই তদন্তের ব্যাপারে আমি সকলকে জেরা করি। তার মধ্যে সকলেই যে সব সময় সত্যি কথা বলেছেন তা নয়। তাদের মিথ্যে কিছু ধরা পড়েছে অন্যের জেরাতে। কেউ কেউ কিছু কিছু জিনিস লুকোতে চেয়েছেন, কেউ কেউ আবার আমার প্রশ্নের জবাবই দেননি। হারের ব্যাপারে অনেককে সন্দেহ করা চলতে পারত। তার মধ্যে ছিলেন শ্রীমান প্রসেনজিৎ, যিনি ড্রাগের নেশা ধরেছেন এবং সে ড্রাগ কেনার জন্য তাঁর প্রায়ই টাকার দরকার হয়। সে টাকা তিনি এর-ওর কাছ থেকে ধার করেন এবং জুয়া খেলেও জোগাড় করেন। তারপর আরেকজনকে সন্দেহ করা চলতে পারে; তিনি হলেন সুদর্শন সোম। পরের আশ্রিত তিনি, অভাবী লোক, হয়তো সে অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি হারটা চুরি করেছিলেন। তা ছাড়া আছেন মিঃ সান্ডাল্হা। তাঁর দোকান ভালো চলছে না, তিনি নিজের অবস্থার উন্নতি করার জন্য হারটা চুরি করতে পারেন। এক জনের উপর সন্দেহ করার কোনও কারণ ছিল না, তিনি হলেন জয়ন্তবাবু। কারণ তাঁর জবানীতে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর ব্যবসা ভালোই চলছে, তাঁর টাকার কোনও অভাব নেই। কিন্তু আরেকজনের জবানীতে আমি শুনি যে তাঁর ব্যবসা মোটেই ভালো যাচ্ছে না, তিনি ফ্রাস্ট্রেশন বশতঃ তাঁর মদের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। অবিশ্যি এই জবানী থেকে কিছু প্রমাণ হয় না, এটা ভুলও হতে পারে।
‘এখানে সুকিয়াসের খুনের ব্যাপারে আমাকে আসতে হচ্ছে। তিনি যখন খুন হন তখন একটা চিঠি লিখছিলেন। চিঠিটা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং সেটা আমাকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি লেখার কারণ হল—তাঁকে হঠাৎ কানপুর চলে যেতে হচ্ছিল সেই সকালেই, তাই আমাকে তিনি কোয়েশ্চনিং-এর জন্য সময় দিতে পারছিলেন না। কিন্তু কানপুর যাবার আগেই তিনি খুন হন।
‘এই চিঠি থেকে আমি দুটো তথ্য জানতে পারি। এক হল এই যে শকুন্তলা দেবীর হারটা অবশেষে জয়ন্তবাবু তাঁকে বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলেন দু’ লাখ টাকায়। এই হারটা আর তিনদিনের মধ্যেই সুকিয়াসের হস্তগত হবার কথা ছিল, কিন্তু তার আগেই হারটা চুরি হয়ে যায়।
‘দ্বিতীয় তথ্য হল, এই ঘরে সমবেত সকলের মধ্যে একজন আছেন যিনি মিঃ সুকিয়াসের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার করেন দেড় মাস আগে। তিনি বলেছিলেন টাকাটা এক মাসের মধ্যে সুদসমেত ফেরত দিয়ে দেবেন, কিন্তু দেননি। সুকিয়াস তাঁকে অনেক অনুরোধ করেও টাকাটা আদায় করতে পারেননি। তখন তিনি বলেন আইনের আশ্রয় নেবেন। এইসব তথ্য আমার জেরায় প্রকাশ পেয়ে যেত বলেই তাঁকে খুন করা হয়। অবিশ্যি যিনি খুনটা করিয়েছিলেন তাঁর পক্ষে সুকিয়াসের চিঠির কথা জানার কোনও উপায় ছিল না, কারণ খুনের সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। যিনি উপস্থিত ছিলেন, অর্থাৎ এই ভদ্রলোকের অ্যাকমপ্লিস, তাকে পুলিশ ধরেছে এবং সে তার অপরাধ স্বীকার করেছে। আর এটাও সে বলেছে যে, যে তাকে এমপ্লয় করেছিল তাকে সে দেখিয়ে দেবে।’
ফেলুদা এবার পাণ্ডের দিকে ফিরল।
‘মিঃ পাণ্ডে—আপনি আপনার লোককে আনান তো।’
দু’জন কনস্টেবল গিয়ে শম্ভু সিংকে নিয়ে এল।
ফেলুদা বলল, ‘তোমাকে যে খুনটা করতে বলেছিল সে লোক কি এখানে রয়েছে?’
শম্ভু সিং এদিক ওদিক দেখে বলল, ‘হাঁ হুজুর।’
‘তাকে দেখাতে পারবে?’
‘ওই যে সেই লোক’, বলে একজন বিশেষ ব্যক্তির দিকে শম্ভু সিং তার হাতকড়া পরা দুটো হাত একসঙ্গে তুলে দেখাল।
সকলে অবাক হয়ে দেখল, যে রতনলাল ব্যানার্জির মুখ থেকে তাঁর পাইপটা খসে ঠক্কাস শব্দে মাটিতে পড়ল।
‘হোয়াট ননসেন্স ইজ দিস?’ বলে উঠলেন রতনলাল ব্যানার্জি।
ফেলুদা বলল, ‘আপনি ননসেন্সই বলুন, আর ফার্সই বলুন, ইয়োর গেম ইজ আপ, মিঃ ব্যানার্জি।’
সমস্ত ঘরে একটা থমথমে ভাব, তার মধ্যে ফেলুদা কথা বলে চলল।
‘আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, মিস্টার অ্যালবার্ট রতনলাল ব্যানার্জি। আপনার কীসের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা ধার করার প্রয়োজন হয়েছিল সেটা বলবেন কি?’
‘আই উইল নট’, এখনও তেজের সঙ্গে বললেন রতনলাল।
‘তা হলে আমিই বলি’, বলল ফেলুদা। ‘আপনি যা রোজগার করতেন তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ করতেন। সুকিয়াস লিখেছে আপনি বাঈজিদের পিছনে অঢেল টাকা ঢালতেন। আমরা যেদিন আপনার ঘরে গিয়েছিলাম সেদিন আতরের গন্ধ পেয়েছিলাম। আমার ধারণা আমরা আসার আগে আপনার ঘরে একজন বাঈজি ছিলেন, তাঁকে আপনি ভিতরে পাঠিয়ে দেন। আপনি নিজে আতর ব্যবহার করলে পার্টির দিনেও নিশ্চয়ই করতেন, কিন্তু সেদিন কোনও গন্ধ পাইনি। আমার মনে হয় আপনি আপনার পিতামহের স্বভাব পেয়েছিলেন। তাঁরও শেষ জীবনে অর্থাভাব হয়েছিল। আপনিও সেই একই কারণে সুকিয়াসের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।’
‘ও মাই গড!’ মাথা হেঁট করে রুদ্ধস্বরে বললেন রতনলাল। ‘আই অ্যাম ফিনিশ্ড।’
ইনস্পেক্টর পাণ্ডে ও একজন কনস্টেবল তাঁর দিকে এগিয়ে গেল।
ফেলুদা বলল, ‘আমার বক্তব্য অবিশ্যি এখনও শেষ হয়নি। এখনও একটা রহস্য উদ্ঘাটন হতে বাকি আছে, সেটা হল শকুন্তলা দেবীর কণ্ঠহার। সেটা জয়ন্তবাবু নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি, কারণ সেটা তার আগেই অন্য একজনের হাতে যায়।’
‘কার?’ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন সুনীলা দেবী।
‘এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই’, বলল ফেলুদা। ‘একটা ধারণা হয়েছিল যে সেদিন পার্টিতে যখন ফিল্মটা দেখানো হচ্ছিল সেই অন্ধকার অবস্থাতেই বুঝি কেউ গিয়ে হারটা নিয়ে আসে। কিন্তু আসলে ফিল্ম যখন চলে তখন পর্দা থেকে প্রতিফলিত আলোয় ঘর আর সম্পূর্ণ অন্ধকার থাকে না। আমি সেদিন প্রোজেক্টরের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার দৃষ্টি শুধু পর্দার দিকে ছিল না। ঘর থেকে কেউ বেরিয়ে গেলে আমি নিশ্চয় দেখতে পেতাম। কেউ বেরোয়নি। প্রসেনজিৎ দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সোফায় বসে আর ছবি চলার মধ্যে সুকিয়াস প্রবেশ করেন। ঘরে আর কোনও নড়াচড়া হয়নি।’
‘তা হলে?’ সুনীলা দেবী হতভম্ব।
‘তা হলে এই যে ছবি শুরু হবার আগেই হারটা সিন্দুক থেকে বার করে আনা হয়েছিল।’
‘সে ত হয়েইছিল,’ বললেন সুনীলা দেবী। ‘শীলা এনেছিল আপনাকে দেখানোর জন্য এবং শীলাই সেটা আবার তুলে রাখে।’
‘না। সেখানেই ভুল। শীলা হারটাকে আর সিন্দুকে তোলেনি। সে সেটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিল। এটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু কারণটা বুঝিনি। পরে রাত্রে সে সেটাকে একটা ফুলের টবে মাটির মধ্যে পুঁতে রাখে। এ কথা শীলা নিজে আমাকে বলেছে। এই যে সেই হার।’
ফেলুদা তার কোটের পকেট থেকে হারটা বার করে ঘরের মাঝখানে টেবিলের উপর রাখল। ঘরের সকলের মুখ থেকে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে এল।
সুনীলা দেবী বললেন, ‘কিন্তু…কিন্তু সে এরকম করল কেন?’
‘কারণ সে তার ঘর থেকে আপনার এবং আপনার স্বামীর মধ্যে কথোপকথন শুনে ফেলেছিল। তার শোবার ঘর ত আপনাদের শোবার ঘরের পাশেই এবং মাঝখানের দরজা খোলাই থাকে। মাঝরাত্রে তার ঘুম ভেঙে যায়। তখন আপনি আপনার স্বামীকে বলছিলেন যে হারটা আপনি সুকিয়াসকে বিক্রি করতে রাজি আছেন। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে অবিশ্যি আপনার অনেক সময় লেগেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে আপনি রাজি হয়েছিলেন সেটা ত ঠিক। এমন দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে তাই শীলা হারটা সরিয়ে রেখেছিল, এবং সে এটা করেছিল বলেই আজও হারটা আপনাদের কাছে রয়েছে এবং আশা করা যায় থাকবে। এমন জিনিস হাতছাড়া করাও একটা ক্রাইম।’
*
হোটেলে ফিরে এসে লালমোহনবাবু মাথা চুলকে বললেন, ‘মশাই, লাক্নাউ মানে ত ভাগ্য এখনই। তা এখানে ভাগ্যটা কার সেটা তো আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
ফেলুদা বলল, ‘কেন পারছেন না? ভাগ্য আপনার, কারণ আপনি আবার ফেলু মিত্তিরের একটা তারাবাজি দেখতে পেলেন বিনে পয়সায়।’
আমি বললাম, ‘তা ছাড়া সুনীলা দেবীদেরই ভাগ্য ভালো যে হারটা তাদেরই রয়ে গেল। থ্যাংকস্ টু মেরি শীলা।’
‘যা বলেছ তপেশ ভাই’, বললেন লালমোহনবাবু।
‘শীলার মতো মেয়ে বড় একটা দেখা যায় না—তাই না ফেলুবাবু?’
ফেলুদা বলল, ‘শকুন্তলা দেবীর হারটা যদি সত্যি করে কেউ কদর করে, সে হল মেরি শীলা বিশ্বাস।’
——
|| সমাপ্ত ||