৯৭তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের যুধিষ্ঠিরসমীপে কর্ণবধবার্ত্তা নিবেদন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এদিকে মহাত্মা বাসুদেব ধনঞ্জয়কে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! দেবরাজ যেমন বজ্ৰদ্বারা বৃত্রাসুরকে নিহত করিয়াছেন, তদ্রূপ তুমি শরনিকরে কর্ণকে নিপাতিত করিলে। অতঃপর মানবগণ কর্ণ ও বৃত্রাসুর-এই উভয়েরই বধোপাখ্যান কীৰ্ত্তন করিবে। এক্ষণে যশস্কর কর্ণবধ বৃত্তান্ত ধর্ম্মরাজকে নিবেদন করা আমাদের অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি বহুদিবসাবধি কর্ণবধে সচেষ্ট ছিলে, এক্ষণে এই ব্যাপার ধর্ম্মরাজকে বিজ্ঞাপিত করিয়া তাঁহার ঋণ পরিশোধ কর। পূর্ব্বে পুরুষপ্রধান যুধিষ্ঠির তোমাদিগের যুদ্ধ দর্শন করিতে আগমন করিয়াছিলেন, কিন্তু নিতান্ত শরবিদ্ধ হইয়াছিলেন বলিয়া সমরাঙ্গন হইতে স্বশিবিরে প্রস্থান করিয়াছেন।
“হে মহারাজ! যদুপুঙ্গব বাসুদেব এই কথা কহিলে মহাবীর ধনঞ্জয় যুধিষ্ঠিরসমীপে গমনের অভিপ্রায় প্রকাশ করিলেন। তখন দেবকীতনয় অর্জ্জুনের রথ পরিবর্তিত করিয়া সৈনিকদিগকে কহিলেন, ‘হে যোধগণ! তোমাদিগের মঙ্গল হউক, তোমরা সজ্জীভূত হইয়া শত্রুগণের অভিমুখে অবস্থান কর।‘ মহামতি বাসুদেব সৈন্যগণকে এইরূপ আদেশ করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন, যুধামন, বৃকোদর, সাত্যকি ও মাদ্রীপুত্রদ্বয়কে কহিলেন, ‘হে বীরগণ ! আমরা এক্ষণে ধর্ম্মরাজের নিকট অর্জ্জুনহস্তে কর্ণের নিধনবার্ত্তা প্রদান করিতে চলিলাম; যে পৰ্য্যন্ত প্রত্যাগত না হই, তাবৎকাল তোমরা সকলে সুসজ্জিত হইয়া যত্নসহকারে এই স্থানে অবস্থান কর।
“হে মহারাজ! মহাত্মা কৃষ্ণ এই কথা কহিলে শূরগণ তাঁহার বাক্যে সম্মত হইয়া তাহাকে গমনে অনুজ্ঞা করিলেন। তিনি পার্থসমভিব্যাহারে শিবিরে গমনপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে সুবর্ণময় উত্তম শয্যায় সন্দর্শন করিয়া তাঁহার চরণযুগল গ্রহণ করিলেন। অরাতিঘাতন মহাবাহু যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের হর্ষচিহ্নদর্শনে কর্ণকে নিহত বোধ করিয়া আনন্দাশ্রু পরিত্যাগ ও গাত্রোত্থানপূর্ব্বক বারংবার তাঁহাদিগকে আলিঙ্গন করিয়া কর্ণের নিধনবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। তখন বাসুদেব ও অর্জ্জুন ধর্ম্মরাজের সমীপে কর্ণের নিধনবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন করিলেন।
“অনন্তর মহাত্মা মধুসূদন ঈষৎ হাস্য করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, ‘হে মহারাজ! আজ সৌভাগ্যবশতঃ মহাবীর অর্জ্জুন, বৃকোদর, নকুল, সহদেব ও আপনি, আপনারা সকলে এই লোমহর্ষণ ভীষণ সংগ্রাম হইতে পরিত্রাণ পাইয়া কুশলী হইয়াছেন। অতঃপর সময়োচিত কার্য্যের অনুষ্ঠান করুন। আজ ভাগ্যক্রমে মহারথ কর্ণ নিপাতিত, আপনি বিজয়প্রাপ্ত ও আপনার সৌভাগ্য পরিবর্ধিত হইয়াছে। যে নরাধম দ্রৌপদীকে দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত দেখিয়া উপহাস করিয়াছিল, আজ পৃথিবী সেই সূতপুত্রের শোণিতপান করিতেছে। আপনার সেই শত্রু শরজালে বিভিন্নকলেবর হইয়া সমরশয্যায় শয়ন করিয়াছে। আপনি সমরাঙ্গনে গমনপূর্ব্বক তাহার দুর্দ্দশা সন্দর্শন করুন। আপনার রাজ্য নিষ্কণ্টক হইল। এক্ষণে আপনি আমাদিগের সহিত যত্নসহকারে এই অরাতিশূন্য পৃথিবী শাসন ও বিপুল সুখভোগ করুন।’
“হে মহারাজ! তখন ধর্ম্মনন্দন যুধিষ্ঠির হৃষিকেশের বাক্যশ্রবণে সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া কহিলেন, ‘হে দেবকীনন্দন! আজ আমার পরম সৌভাগ্য। তুমি সারথি হওয়াতে ধনঞ্জয় সূতপুত্রকে নিহত করিয়াছে। তোমার বুদ্ধিকৌশলেই সূতপুত্র নিহত হইয়াছে। অতএব উহা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে।’ ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির কেশবকে এই কথা বলিয়া তাঁহার অঙ্গদযুক্ত দক্ষিণবাহু ধারণপূর্ব্বক পুনরায় তাঁহাকে ও অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘হে বীরদ্বয়! আমি নারদের নিকট শুনিয়াছি এবং মহর্ষি বেদব্যাসও বারংবার বলিয়াছেন যে, তোমরা পুরাতন ঋষি মহাত্মা নর ও নারায়ণ। হে কৃষ্ণ! কেবল তোমার অনুগ্রহেই ধনঞ্জয় শত্রুগণের অভিমুখীন হইয়া তাহাদিগকে পরাস্ত করিয়াছে; কখনই সমরে বিমুখ হয় নাই। যখন তুমি অর্জ্জুনের সারথ্য স্বীকার করিয়াছ, তখন নিশ্চয়ই আমাদিগের জয়লাভ হইবে, কখনই পরাজয় হইবে না। হে গোবিন্দ! তোমার বুদ্ধিকৌশলে ভীষ্ম, দ্রোণ ও কর্ণ নিহত হওয়াতে মহাবীর কৃপ ও কৌরবপক্ষীয় অন্যান্য বীরগণও নিহত হইয়াছেন।
যুধিষ্ঠিরের যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণের মৃতদেহ দর্শন
“হে মহারাজ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এই কথা বলিয়া কৃষ্ণপুচ্ছ মনোবেগগামী শ্বেতাশ্বসমুদয়ে সংযোজিত কনকমণ্ডিত রথে আরোহণ করিয়া সৈন্যগণসমভিব্যাহারে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে প্রিয়বার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিয়া সমরভূমি সন্দর্শনার্থ যাত্রা করিলেন। পরে অবিলম্বে তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মহাবীর কর্ণ অসংখ্য শরে সমাচিত হইয়া কেশর-পরিবৃত কদম্বকুসুমের ন্যায় রণশয্যায় শয়ান রহিয়াছেন। সুগন্ধ তৈলযুক্ত সহস্র সহস্র কাঞ্চনময় দীপ তাঁহাকে উদ্ভাসিত করিতেছে। অর্জ্জুনের শরপাতে তাঁহার কবচ ছিন্নভিন্ন হইয়া গিয়াছে এবং তাঁহার পুত্রগণও সংগ্রামস্থলে নিহত ও নিপতিত রহিয়াছেন। তখন ধর্ম্মরাজ বারংবার কর্ণকে নিরীক্ষণ করিয়া সন্দেহভঞ্জন করিলেন এবং কৃষ্ণ অর্জ্জুনকে বারংবার প্রশংসা করিয়া বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে গোবিন্দ! তুমি সহায় ও রক্ষক হওয়াতেই আজ আমি ভ্রাতৃগণের সহিত রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইলাম। আজ দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন সূতপুত্রের নিধননিবন্ধন রাজ্য ও জীবিতে নিরাশ হইবে। আজ কেবল তোমার অনুগ্রহেই আমরা কৃতকাৰ্য্য হইলাম। আজ ভাগ্যক্রমে শত্রু নিপতিত হইল এবং ধনঞ্জয় ও তুমি—তোমরা উভয়েই বিজয়ী হইলে। আমাদিগের ত্রয়োদশ বৎসর অতি কষ্টে অতিবাহিত হইয়াছে; একদিনও নিদ্রা হয় নাই। আজ তোমার অনুগ্রহে নিদ্রাসুখ অনুভব করিব।’
কর্ণমরণশ্রবণে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীবিলাপ
“হে মহারাজ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এইরূপে জনার্দ্দন ও অর্জ্জুনকে ভূরি ভূরি প্রশংসা করিতে লাগিলেন। তিনি অর্জ্জুনশরে সূতপুত্রকে পুত্রগণের সহিত নিহত নিরীক্ষণ করিয়া আপনাকে পুনর্জাত [পুনর্জন্মপ্রাপ্ত] বলিয়া বোধ করিলেন। অনন্তর মহারথ নকুল, সহদেব, বৃকোদর, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী এবং পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ স্তুবার্থবাক্যে [স্তুতিযোগ্য] কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের প্রশংসা ও ধর্ম্মরাজের সংবর্দ্ধনা করিয়া মহা আহাদে স্ব স্ব শিবিরে প্রবিষ্ট হইলেন। হে মহারাজ! কেবল আপনার দুর্ম্মন্ত্রণাবশতঃই এরূপ লোমহর্ষকর মহাক্ষয় উপস্থিত হইয়াছে। এখন আর কেন বৃথা অনুতাপ করিতেছেন?”
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে জনমেজয়! অম্বিকাপুত্র ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের মুখে এইরূপ অমঙ্গলবার্ত্তা শ্রবণ করিবামাত্র জ্ঞানশূন্য হইয়া ছিন্নমূল বনস্পতির ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইলেন; দূরদর্শিনী গান্ধারীও ভূতলে নিপতিত হইয়া কর্ণের উদ্দেশে নানা প্রকার বিলাপ করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা বিদুর ও সঞ্জয় উভয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে ধারণ করিয়া আশ্বাস প্রদান করিতে লাগিলেন; কৌরবপত্নীগণও গান্ধারীকে উত্থাপিত করিলেন। চিন্তাকুলচিত্ত শোকসন্তপ্ত মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বিদুর ও সঞ্জয়কর্ত্তৃক সমাশ্বাসিত হইয়া দৈব ও ভবিতব্য সর্ব্বাপেক্ষা বলবান্ বিবেচনা করিয়া বিচেতনের ন্যায় তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন।
হে ভূপাল! যে ব্যক্তি মহাত্মা ধনঞ্জয় ও সূতপুত্রের সমরযজ্ঞের বৃত্তান্ত পাঠ শ্রবণ করেন, তাঁহার বিধিবিহিত যজ্ঞের অখণ্ড ফললাভ হয়। পণ্ডিতগণ অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, দিবাকর ও ভগবান বিষ্ণুকে যজ্ঞস্বরূপ বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। অতএব যে ব্যক্তি অসূয়াশূন্য হইয়া এই সমরযজ্ঞবৃত্তান্ত শ্রবণ বা পাঠ করেন, তিনি সুখী ও ভক্তিপরায়ণশ্রেষ্ঠ হইয়া থাকেন। মানবগণ ভক্তিপরায়ণ হইয়া নিরন্তর এই পবিত্র উৎকৃষ্ট সংহিতা পাঠ করিলে ধনধান্যসম্পন্ন, যশস্বী ও সমস্ত সুখলাভের অধিকারী হয় এবং ভগবান স্বয়ম্ভু, শম্ভ ও বিষ্ণু সতত তাহার উপর সন্তুষ্ট থাকেন। এই কর্ণপর্ব্ব পাঠ করিলে ব্রাহ্মণের বেদলাভ, ক্ষত্রিয়ের বল ও যুদ্ধে জয়লাভ হইয়া থাকে; বৈশ্যের প্রভূত ধনলাভ এবং শুদ্রের আরোগ্যলাভ হয়। এই পর্ব্বে সনাতন ভগবান্ নারায়ণের মাহাত্ম্য কীৰ্তিত হইয়াছে। অতএব যে ব্যক্তি এই কর্ণপৰ্ব পাঠ বা শ্রবণ করিবেন, তাঁহার সকল মনোরথ পূর্ণ হইবে সন্দেহ নাই। ব্যাসদেবের এই কথা কদাচ মিথ্যা হইবার নহে। এক বৎসর নিরন্তর সবৎসা ধেনু প্রদান করিলে যে পুণ্যলাভ হয়, এই কর্ণপর্ব্ব শ্রবণেও সেই পুণ্য হইয়া থাকে।
॥ কর্ণপর্ব্ব সম্পূর্ণ ॥