৯৫তম অধ্যায়
দুর্য্যোধনের প্রতি শল্যের সাময়িক উপদেশ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সময় মদ্রদেশাধিপতি শল্য রাজা দুর্য্যোধনকে সৈন্যদিগকে বিনিবৰ্ত্তিত করিতে উদ্যত দেখিয়া ভীত ও বিমোহিতচিত্তে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে রাজ! ঐ দেখ, হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণে সমরাঙ্গন পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। কোন স্থানে মাতঙ্গগণ একেবারে শরভিন্নকলেবর, বিহুল ও গতাসু হইয়া বিদীর্ণ পাষাণ, বৃক্ষ ও ওষধিসম্পন্ন বজ্রবিদলিত অচলের ন্যায় নিপতিত হইয়াছে এবং উহাদিগের বর্ম্ম, চর্ম্ম, ঘণ্টা, অঙ্কুশ, তোমর ও ধ্বজসকল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত আছে। কোন স্থানে সুবর্ণজালপরিবেষ্টিত শোণিতলিপ্ত তুরঙ্গমগণ শরনির্ভিন্নদেহ, নিতান্ত নিপীড়িত ও নিপতিত হইয়া ঘন ঘন নিশ্বাস পরিত্যাগ ও অনবরত রুধির বমন করিতেছে। উহাদের মধ্যে কতিপয় বীর আর্ত্তস্বরে চীৎকার করিতেছে; কতকগুলি নেত্র পরিবর্তিত করিয়া রহিয়াছে এবং কতকগুলি ভূতল দংশন করিতেছে। রণস্থল বিশীর্ণদন্ত হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণে পরিপূর্ণ হইয়া বৈতরণীনদীর ন্যায় এবং সুবর্ণজালজড়িত যোধহীন অসংখ্য রথে সমাবৃত হইয়া জলদজালপরিবৃত শরঙ্কালীন নভোমণ্ডলের ন্যায় নিরীক্ষিত হইতেছে। ঐ সমস্ত রথের তূণীর, পতাকা, কেতু, অনুক, ত্রিবেণু, যোক্ত্র, চক্র, অক্ষ, ইষু ও যুগ ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত আছে। উহাদের নীড়সমুদয় ভগ্ন ও বন্ধনসকল ছিন্নভিন্ন হইয়া গিয়াছে। পূর্ব্বে মহাবেগগামী তুরঙ্গমগণ ঐ সকল রথ বহন করিত। কোন স্থানে স্খলিত বর্ম্ম, স্খলিতাভরণ, বস্ত্রহীন, আয়ুধবিহীন, উভয়পক্ষীয় চতুরঙ্গবল মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণ ও অর্জ্জুনের শরনিকরে ভিন্নকলেবর ও বিচেতন হইয়া রহিয়াছে, বীরগণ রজনীযোগে বিমলপ্রভাশালী নভোমণ্ডল পরিচ্যুত অতি প্রদীপ্ত গ্রহগণের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইয়া মুহুর্ম্মুহুঃ উচ্ছ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রশান্ত পাবকের ন্যায় নিরীক্ষিত হইতেছে। ঐ দেখ, কর্ণ ও অর্জ্জুনের বাহুনির্ম্মুক্ত শরনিকর হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণের দেহ ভেদপূর্ব্বক তাহাদিগকে বিনষ্ট করিয়া, উরগগণ যেমন আবাসগর্ত্তমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ নম্রমুখে ভূগর্ভে প্রবিষ্ট হইয়াছে। এক্ষণে কর্ণ ও অর্জ্জুনের শরনিকর এবং নিহত শরসমাচিত অশ্ব, গজ ও মনুষ্যদ্বারা রণস্থল নিতান্ত দুরভিগম্য হইয়াছে। ঐ দেখ, হেমপট্টমণ্ডিত পরিঘ, পরশু, শাণিত শূল, মুষল ও মুদ্গরসকল চতুরঙ্গবলের গতায়াতে চূর্ণিত হইয়া গিয়াছে। বিমলকোষনিষ্কাশিত অসি, সুবর্ণপট্টসংযত গদা, স্বর্ণপুঙ্খ শর, হেমবিভূষিত শরাসন, নিশিত ঋষ্টি, কনকদণ্ড-সমলঙ্কৃত বিকোষ প্রাস, ছত্র, চামর, ছিন্নপুঙ্খ বিচিত্র মাল্য, চিত্রকম্বল, পতাকা, বস্ত্র, ভূষণ, কিরীট, মুকুট, প্রবাল, মুক্তাসমলঙ্কৃত হার, পীতবর্ণ কেয়ুর, সুবর্ণসূত্র সমবেত নিষ্ক, নানাবিধ রত্ন এবং নরেন্দ্রগণের সুখোপভোগপরিবর্ধিত দেহ ও ইন্দ্রপ্রতিম মস্তকসকল নিপতিত রহিয়াছে। ভূপতিগণ বিবিধ ভোগ, মনোজ্ঞ সুখ ও পরিচ্ছদসমুদয় পরিত্যাগপূর্ব্বক লোকমধ্যে যশোবিস্তার ও ধৰ্মলাভ করিয়া লোকান্তরে প্রস্থান করিয়াছেন। অতএব হে মহারাজ! এক্ষণে সৈন্যগণ স্বেচ্ছানুসারে গমন করুক; তুমিও প্রতিনিবৃত্ত হইয়া স্বশিবিরে প্রবেশ কর। ঐ দেখ, ভগবান্ কমলিনীনায়ক অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইয়াছেন।
লোদনপরায়ণ দুৰ্য্যোধনাদির স্বশিবিরে গমন
“হে মহারাজ! শোকাকুলিতচিত্ত মদ্রদেশাধিপতি শল্য রাজা দুর্য্যোধনকে এই কথা বলিয়া মৌনাবলম্বন করিলেন। তখন দ্রোণাত্মজ প্রমুখ বীরগণ কুরুরাজকে দুঃখিতমনে অবিরল বাষ্পকুললোচনে ‘হা কর্ণ! হা কর্ণ!’ বলিয়া পরিতাপ করিতে দেখিয়া, তাঁহাকে বারংবার আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক মহাবীর অর্জ্জুনের যশপ্রভাবে সমুজ্জ্বল অতি প্রকাণ্ড ধ্বজদণ্ড বারংবার নিরীক্ষণ করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। সেই ভয়ঙ্কর কালে স্বর্গগমনে কৃতনিশ্চয় কৌরবগণ হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণের দেহ হইতে নিসৃত রুধির প্রবাহে সমাচ্ছন্ন সমরভূমিকে রক্তাম্বরধারিণী বিবিধ মাল্যবিভূষিতা, সুবর্ণলঙ্কারসম্পন্না সর্ব্বলোকগম্যা বারবিলাসিনীর ন্যায় অবলোকনপূর্ব্বক তথায় অবস্থান করিতে সমর্থ হইলেন না এবং কর্ণবধে অতিমাত্ৰ দুঃখিত হইয়া বারংবার ‘হা কর্ণ! হা কর্ণ!’ বলিয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া দিবাকরকে সন্ধ্যারাগলোহিত নিরীক্ষণপূর্ব্বক সত্বর শিবিরাভিমুখে ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! ঐ সময় অর্জ্জুনের শিলাশিত সুবর্ণপুঙ্খসম্পন্ন শরনিকরে সমাচিত মহাবীর সূতপুত্র মৃত্যুমুখে নিপতিত হইয়া অংশুমান্ মার্ত্তণ্ডমণ্ডলের ন্যায় নিরীক্ষিত হইতে লাগিলেন। অনন্তর ভক্তানুকম্পী ভগবান ভাস্কর করজালে কর্ণের রুধিরসিক্ত দেহস্পর্শে আরক্তকলেবর হইয়া স্নান করিবার নিমিত্তই যেন অপার সমুদ্রে গমন করিলেন। তখন সুরর্ষিগণ স্ব স্ব গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিতে লাগিলেন। অভ্যাগত ব্যক্তিগণ মহাবীর সূতপুত্র ও অর্জ্জুনের সেই ভীষণ যুদ্ধ দর্শনে বিস্মিত হইয়া তাঁহাদের প্রশংসা করিয়া স্ব স্ব স্থানে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন।
কর্ণবধে বিবিধ দুর্নিমিত্ত প্রাদুর্ভাব
“হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর কর্ণ রুধিরাক্তবস্ত্র, নিকৃত্তকবচ [ছিন্নকবচ] ও গতাসু হইয়াও কিছুমাত্র শোভাবিহীন হয়েন নাই। তাঁহার প্রদীপ্ত সূৰ্য্যসমপ্রভ ও তপ্তকাঞ্চনাভ মূৰ্ত্তিদর্শনে সকলেরই বোধ হইল যেন তিনি জীবিত রহিয়াছেন। সিংহ নিহত হইলেও যেমন অন্যান্য মৃগগণ তাঁহার দর্শনে শঙ্কিত হয়, তদ্রূপ সূতপুত্র নিহত হইলেও যোধগণ তাঁহাকে দর্শন করিয়া নিতান্ত ভীত হইল। তাঁহার মনোহর গ্রীবাসম্পন্ন সুন্দর মুখমণ্ডল পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। সেই বিবিধ ভূষণ বিভূষিত কনককেয়ুরধারী মহাবীর রণশয্যায় শয়ন করাতে বোধ হইল যেন শাখাপ্রশাখা পরিশোভিত বনস্পতি বিপাটিত হইয়াছে। হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর সূতপুত্র সুযুদ্ধে স্বীয় কীৰ্ত্তিসঞ্চয়পূর্ব্বক দিবাকর যেমন স্বীয় কিরণজালে সমস্ত জগৎ সন্তপ্ত করেন, তদ্রূপ শরজালে দশদিক, সমুদয় পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও তাঁহাদের সৈন্যগণকে সন্তপ্ত করিয়া, প্রজ্বলিত হুতাশন যেরূপ সলিলস্পর্শে নির্ব্বাপিত হয়, তদ্রূপ পুত্র ও বাহনগণের সহিত অর্জ্জুন শরে নিহত হইলেন। তিনি অথিগণের কল্পবৃক্ষস্বরূপ ছিলেন, তিনি যাচকদিগকে কখনই প্রত্যাখ্যান করিতেন না। সাধু ব্যক্তিরা যাঁহাকে সর্ব্বদা সৎপুরুষ বলিয়া গণনা করিতেন, যাঁহার সমস্ত সম্পত্তি ব্রাহ্মণসাৎ হইয়াছিল, যিনি ব্রাহ্মণের নিমিত্ত জীবনদানেও উদ্যত হইতেন, যিনি কামিনীগণের সতত প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং আপনার পুত্রগণ যাঁহাকে আশ্রয় করিয়া পাণ্ডবগণের সহিত বৈরাচরণে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, এক্ষণে কৌরবকুলের ধর্ম্মস্বরূপ সেই মহারথ কর্ণ অর্জ্জুনের সহিত দ্বৈরথযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া আপনার পুত্রগণের জয়াশা ও মঙ্গলের সহিত নিহত এবং পরমগতি প্রাপ্ত হইলেন।
“হে মহারাজ! মহারথ কর্ণ এইরূপে নিহত হইলে নদীসমুদয়ের বেগ রুদ্ধ হইল; দিবাকর অস্তগমন করিলেন; দিগ্বিদিক্ সকল ধূমাকীর্ণ ও প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল; প্রদীপ্ত মাৰ্ত্তণ্ডসদৃশ বুধগ্রহ তির্য্যগভাবে অভ্যুদিত হইলেন; নভোমণ্ডল যেন ভূতলে নিপতিত হইল; বসুন্ধরা গভীর ধ্বনি করিয়া কম্পিত হইয়া উঠিল; বায়ু প্রচণ্ডবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল; মহার্ণবসকল সংক্ষুব্ধ ও শব্দায়মান হইল; কাননের সহিত ভূধর সকল কম্পিত হইতে লাগিল; জীবসকল নিতান্ত ব্যথিত হইয়া উঠিল। বৃহস্পতি রোহিণীকে নিপীড়িত করিয়া চন্দ্র ও সূৰ্য্যসদৃশ শোভা ধারণ করিলেন; নভোমণ্ডল অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইল; অনলসদৃশ উল্কাসকল নিপতিত হইতে লাগিল এবং নিশাচরগণের আর আত্মাদের পরিসীমা রহিল না।।
কর্ণমরণে পাণ্ডবপক্ষে প্রসন্নতা
“হে মহারাজ! যৎকালে মহাবীর অর্জ্জুন ক্ষুরদ্বারা অধিরথনন্দনের মস্তকচ্ছেদন করেন, ঐ সময় সহসা অন্তরীক্ষে সুরগণ হাহাকার শব্দ করিয়াছিলেন। পূর্ব্বকালে পুরন্দর বৃত্রাসুরকে নিহত করিয়া যেমন প্রভাবশালী হইয়াছিলেন, তদ্রূপ এক্ষণে মহাত্মা অর্জ্জুনও মনুষ্য, দেব ও গন্ধর্ব্বগণের সম্মানিত সূতপুত্রকে নিপাতিত করিয়া মহাপ্রভাবশালী হইয়া উঠিলেন। অনন্তর পুরন্দরপরাক্রম অগ্নি ও দিবাকরের সদৃশ তেজস্বী; সুবর্ণ, হীরক, মণি, মুক্তা ও প্রবালে বিভূষিত পুরুষোত্তম কেশব ও অর্জ্জুন মেঘগম্ভীরনির্ঘোষ; তুষার, চন্দ্র, শঙ্খ ও স্ফটিকের ন্যায় শুভ্র ও ঐরাবর্ত্তসদৃশ পতাকাপরিশোভিত রথে আরোহণ করিয়া বিষ্ণু ও বাসবের ন্যায় নির্ভয়ে রণস্থলে বিচরণ করিতে লাগিলেন। হতাবশিষ্ট কৌরবগণ মহাবীর ধনঞ্জয়ের জ্যানিঃস্বন ও তলশব্দে হতপ্রভ ও শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইলেন। তখন মহাত্মা বাসুদেব ও অর্জ্জুন অরাতিগণের অন্তঃকরণে ভয় সঞ্চারিত করিয়া মহা আহ্লাদে সুবর্ণজাল জড়িত তুষারসবর্ণ মহাস্বন শঙ্খ গ্রহণপূর্ব্বক এককালে প্রধ্নাপিত করিতে লাগিলেন। পাঞ্চজন্য ও দেবদত্ত শঙ্খের ভীষণ শব্দে ভূমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও নভোমণ্ডল প্রতিধ্বনিত এবং নদী, ভূধর ও বনসমুদয় পরিপূরিত হইল। সেই গভীর নির্ঘোষশ্রবণে দুর্য্যোধনের সৈন্যগণ বিত্ৰাসিত ও যুধিষ্ঠির যৎপরোনাস্তি আনন্দিত হইলেন। কৌরবগণ সেই ভীষণ শঙ্খধ্বনি শ্রবণে মদ্ররাজ শল্য ও দুর্য্যোধনকে পরিত্যাগপূর্ব্বক দ্রুতবেগে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় জীবগণ সমবেত হইয়া সমরশোভী ধনঞ্জয় ও জনার্দ্দনের অভিনন্দন করিতে লাগিল। তৎকালে ঐ কর্ণ শরসমাচিত বীরদ্বয়কে অবলোকন করিয়া বোধ হইল যেন, চন্দ্র ও সূর্য গাঢ়ান্ধকার নাশ করিয়া অভূদিত হইয়াছেন। তখন সেই মহাবলপরাক্রান্ত বীরদ্বয় বিষ্ণু ও বাসবের ন্যায় সুহৃদগণে পরিবেষ্টিত হইয়া পরমপরিতুষ্ট হইলেন। মনুষ্য, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, দেবতা, মহর্ষি, চারণ ও মহোরগগণ তাঁহাদিগকে জয়াশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন। অনন্তর তাঁহারা যথানিয়মে পূজিত ও প্রশংসিত হইয়া, বলির নিধনান্তর বিষ্ণু ও বাসব যেরূপ পরিতুষ্ট হইয়াছিলেন, তদ্রূপ সবান্ধবে যারপরনাই আনন্দ অনুভব করিতে লাগিলেন।”