৯৩তম অধ্যায়
শল্যকর্ত্তৃক দুর্য্যোধন সমীপে কৰ্ণবধ সংবাদদান
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর অর্জ্জুন সুতপুত্রকে নিহত করিলে মহারথ শল্য সৈন্যগণকে নিতান্ত নিপীড়িত নিরীক্ষণ করিয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে সেই ছিন্নধ্বজ ও ছিন্নপরিচ্ছদ রথ লইয়া ধাবমান হইলেন। রাজা দুৰ্য্যোধন সূতপুত্রকে অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও রথের সহিত নিহত অবলোকন করিয়া অপূর্ণনয়নে দীনভাবে বারংবার দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন অন্যান্য বীরগণ শরসমাচিত ও শোণিতলিপ্তগাত্রে সহসা অধঃস্থলিত দিবাকরের সদৃশ সূতপুত্রকে দর্শন করিবার মানসে তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিলেন। ঐ সময়ে স্বপক্ষীয় ও পরপক্ষীয় যোধগণ স্ব স্ব প্রকৃতি অনুসারে কেহ কেহ আহ্লাদিত, কেহ ভীত, কেহ শোকার্ত্ত ও কেহ বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। মহাবীর অর্জ্জুন বর্ম্ম, আভরণ, অম্বর ও আয়ুধ ছিন্নভিন্ন করিয়া সূতপুত্রকে নিপাতিত করিয়াছেন, শ্রবণ করিয়া কৌরবগণ নির্জন বনে গোয়ূথ যেমন বৃষভ নিহত হইলে পলায়ন করে, তদ্রূপ পলায়ন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন ভীষণ সিংহনাদে ও বাহ্বাস্ফোটনশব্দে রোদসী [অন্তরীক্ষ] পরিপুরিত করিয়া আপনার পুত্রগণকে বিভ্রাসিত করিয়া নৃত্য করিতে আরম্ভ করিলেন। সোমক ও সৃঞ্জয় প্রভৃতি ক্ষত্রিয়গণ মহা আহ্লাদে শঙ্খধ্বনি ও পরস্পর আলিঙ্গন করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর ধনঞ্জয় কেশরী যেমন হস্তীকে বিনাশ করে, তদ্রূপ কর্ণকে বিনাশ করিয়া বৈরভাব ও প্রতিজ্ঞা হইতে উত্তীর্ণ হইয়াছেন।
“অনন্তর মদ্ররাজ একান্ত বিমোহিতচিত্তে সেই ছিন্নধ্বজ রথ লইয়া দুৰ্য্যোধন-সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক বাষ্পগদগদবচনে কহিতে লাগিলেন, ‘হে মহারাজ! তোমার গিরিশিখরসদৃশ হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণ শত্রুসৈন্যগণ কর্ত্তৃক নিহত হইয়াছে। কর্ণার্জ্জুন সংগ্রামের ন্যায় ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আর কখনই উপস্থিত হয় নাই। মহাবীর কর্ণ প্রথমতঃ বাসুদেব ও অর্জ্জুন প্রভৃতি তোমার শত্রুগণকে নিপীড়িত করিয়াছিলেন। কিন্তু দৈব পাণ্ডবগণের পক্ষে নিতান্ত অনুকূল। এই নিমিত্তই তাঁহারা জীবিত রহিয়াছে আর আমরা বিনষ্ট হইতেছি। হে মহারাজ! কুবের, যম ও বাসবের ন্যায় প্রভাবসম্পন্ন শৌর্য্যশালী বিবিধগুণভূষিত অবধ্য ভূপালগুণ তোমার কার্য্যসংসাধনে উদ্যত হইয়া পাণ্ডবগণের বাহুবলে নিহত হইয়াছেন। অতএব এক্ষণে তুমি আর শোকাকুল হইও না। অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা অতিক্রম করা অতিশয় সুকঠিন। এক্ষণে আশ্বাসযুক্ত হও। সকল সময়ে কার্য্যসিদ্ধি হইবার সম্ভাবনা নাই। হে মহারাজ! রাজা দুর্য্যোধন মদ্ররাজের বাক্যশ্রবণে স্বীয় দুর্নীতি পৰ্যালোচনা করিয়া বিচেতনপ্রায় হইয়া দীনমনে বারংবার দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।”