০৮.
অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজায় চাবি ঘুরিয়ে রাত দশটার কিছু পরে বিল ঢুকল। হাতে স্কচ হুইস্কির গ্লাস নিয়ে আমি তখন একমনে ভাবছিলাম।
তোড়ে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে সেই সঙ্গে সোঁ সোঁ বাদল হাওয়া বইছে। বিলের গায়ে ম্যাকিন্টস থেকে জল ঝরে পড়ছে দেখে আরেকটা গ্লাসে স্কচ ঢেলে এগিয়ে দিতেই সে খেঁকিয়ে উঠল।
খবরদার ডার্ক, এখন আমায় কোনও প্রশ্ন করবে না। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। আগে আমি পেট পুরে খাব, তারপর যা বলার বলব। তোমার টেবিলের মত একখানা বড়সড় জম্পেশ স্টেক না খেয়ে একটা কথাও আমি বলব না, চলো বেরোও।
অজানা নয় আমার বিলের স্বভাব। তাই ম্যাকিন্টস গায়ে চাপিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে তার পেছনে পেছনে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
মাত্র চল্লিশ মিনিটের মধ্যে সে একখানা বড় স্টেক সাবাড় করল। সেইসঙ্গে একরাশ ভাজা পেঁয়াজ আর ফ্রাই। উল্টো দিকে বসে কাঁকড়ার স্যালাড নাড়াচাড়া করতে করতে বললাম, আমায় দেবার মত কোনও খবর আছে?
এখনও আমার পেট ভরেনি। সে ওয়েটারকে একটা অ্যাপেল পাইয়ের অর্ডার দিল, এই রাক্ষসের সঙ্গে চলতে হলে ধৈর্য না ধরে উপায় নেই, তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম।
সত্যি বড্ড খিদে পেয়েছিল। শুধু একটা হটডগ খেয়ে আধঘণ্টা বৃষ্টির ভেতর বসে থেকেছি।
কোনও খবর আছে কিনা জানতে চাই।
নিশ্চয়ই আছে, অনেক খবর। শোন আজ সকাল এগারোটা থেকে অ্যাঞ্জেলার আস্তানার ওপর নজর রেখেছি। কিন্তু একবারের জন্যও তাকে চোখে পড়েনি। তারপর বেলা বারোটা নাগাদ মিসেস স্মেডলি ঝুড়ি হাতে বাজার করতে বেরোলেন। তারও দশ মিনিট পর বাড়ির ভেতর থেকে অ্যাঞ্জেলা বেরিয়ে বাগানে এল। তখন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে, তার ভেতর গাড়িতে বসে দেখলাম ও ভিনজতে ভিনজতে বাগানের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে আর নিজের মনে বক বক করছে। হঠাৎ দেখলাম ও রেগেমেগে কয়েকবার আকাশের দিকে তাক করে ঘুষি মারল। তারপর দুহাত মুঠো করে নিজের মাথায় কয়েকবার ঠুকল, মনে হল ওর মাথার গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। আরও কিছুক্ষণ ঐভাবে বক বক করতে করতে বাড়ির ভেতর ঢুকে দরজা এটে দিল।
আরও কিছুক্ষণ পরে মিসেস স্মেডলি ঝুড়ি হাতে নিয়ে বাজার করে ফিরলেন। দুঘণ্টা আর কিছু দেখতে পেলাম না। ঠিক দুঘন্টা পরে ঝামেলা শুরু হল। বাড়ির ভেতর থেকে মেয়ে মানুষের গলার আর্তনাদ ভেসে এল। সে আর্তনাদ শুনলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। আমি গাড়ি থেকে নেমে বসার ঘরের কাঁচের জানলায় উঁকি দিলাম। ভেতরে তখন রীতিমত নাটক শুরু হয়েছে। অ্যাঞ্জেলা হাতে একটা বড় বাঁকানো ছুরি নিয়ে মিসেস স্মেডলির দিকে পা টিপে টিপে এগোচ্ছে। আর তিনি এককোণে দাঁড়িয়ে ওকে শান্ত হতে বলছেন। হঠাৎ অ্যাঞ্জেলা চেঁচিয়ে উঠল, বেরো! কেলে কুত্তী! দূর হয়ে যা এখান থেকে। আমার টেরিকে এক্ষুণি চাই। মিসেস স্মেডলির চোখমুখ • খুব শান্ত দেখাচ্ছিল। তিনি দেয়ালের দিকে সেঁধিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এদিকে অ্যাঞ্জেলা ছুরি হাতে ওর খুব কাছাকাছি এসে পড়াতে আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না, ছুটে গিয়ে কলিং বেলের সঙ্গে শরীরটাকে চেপে ধরলাম। ঘণ্টার আওয়াজ শুনেই হয়ত অ্যাঞ্জেলার চিৎকার থেমে গেল। মিসেস স্মেডলি এসে দরজা খুলে দেন। দেখলাম তিনি ঘামছেন। আমি বললাম, মাপ করবেন, আমি রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকার তরফ থেকে আসছি, ভাবছিলাম…। কথা শেষ করার আগেই উনি আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। একটু অপেক্ষা করে আবার গিয়ে দাঁড়ালাম জানালার সামনে। এবার দেখলাম অ্যাঞ্জেলা বসে দুহাত মুঠো করে নিজের মাথায় মারছে আর হাতের ছুরিটা পড়ে আছে মেঝেয়। মিসেস স্মেডলি সেটা কুড়িয়ে রাখলেন। ফিরে অ্যাঞ্জেলাকে দুহাতে চেপে ধরলেন। ও বাধা দিতেই উনি এক থাপ্পড় কষালেন তার গালে আর তার চোটে ও জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল। তখন উনি তাকে পাঁজাকোলা করে পাশের ঘরে গেলেন, তারপর আর কিছু ঘটেনি। এই হল ঘটনা, ডার্ক। এখন বুঝেছি অ্যাঞ্জেলার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে হবে।
ও কি এইভাবে ভাইয়ের নাম ধরে চেঁচাচ্ছিল?
ঠিক তাই।
হ্যাংকের বাবা জোশ বলেছিল যে টেরি অর্থাৎ ভাই চলে যাবার পরই ওর জীবনে আঁধার নেমে এসেছিল। কিন্তু ভাইয়ের কি হয়েছিল? সে কোথায়? আমার মনে হচ্ছে রহস্যের জট ছাড়াতে পারে শুধু একজন, সে হল অ্যাঞ্জেলার ভাই টেরি।
খুব ভাল কথা, তবে কি করছ?
আমি মিসেস থরসেনের সঙ্গে কথা বলব। শুধু উনিই পারেন বলতে অ্যাঞ্জেলা সুস্থ কিনা। খাঁটি খবর দিতে পারে দুজন, জোশ স্মেডলি ও বৌ হান্না স্মেডলি। আমি দুঃখিত বিল, তোমার ফিরে গিয়ে আবার অ্যাঞ্জেলার বাড়ির ওপর নজর রাখতে হবে। আমি যাচ্ছি মিসেস থরসেনের কাছে দেখি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারি কিনা।
বিল বলল, বলছ যখন যাওয়া যাক। রেস্তোরাঁ থেকে বেরোচ্ছি এমন সময় বিল বলল, কতক্ষণ নজর রাখব–সারারাত?
ওখানেই ঘোরাফেরা করো বিল, আমি বললাম, দ্যাখো ভিতরে কি হচ্ছে। মিসেস থরসেনের সঙ্গে দেখা করে তোমার কাছে যাব। আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত ওখানে থেকো।
আমি আর বিল যার যার গাড়িতে থরসেনদের বাড়ির দিকে এগোলাম। গেট থেকে গজ দুয়েক দূরে গাড়ি পার্ক করলাম, আর বিল সরু পথ ধরে অ্যাঞ্জেলার বাড়ির কাছে গাড়ি পার্ক করল।
গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে এগোতে চোখে পড়ল গোটা থরসেন প্রাসাদ নিকষ আঁধারে ডুবে আছে। শুধু জোশ স্মেডলির ঘরে আলো জ্বলছে। বুঝলাম মিসেস থরসেন বাড়িতে নেই। রাত সাড়ে নটা বাজে হয়তো মিসেস থরসেন একটু পরেই ফিরে আসবেন। ইতস্ততঃ করে স্থির করলাম জোশের সঙ্গে কথা বলব।
চারবার কলিংবেল টেপবার পর জোশ সদর দরজা খুলল এবং প্রশ্ন করল, আপনি সেই বেসরকারী গোয়েন্দা মিঃ ওয়ালেস তাই না? কিন্তু মিসেস থরসেন এখন বাড়ি নেই।
মিসেস থরসেন নয় জোশ, আমি তোমার সঙ্গেই কিছু কথা বলতে এসেছি, বলে তার পাশ কেটে একরকম জোর করেই ভেতরে ঢুকলাম।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও জোশ তার ঘরে নিয়ে গেল। তার মুখ থেকে স্কচ হুইস্কির গন্ধ বেরোচ্ছে। ওর খাটের পাশে টেবিলের ওপর ছিল এক বোতল স্কচ হুইস্কি, তার পাশে গ্লাস।
আমি বললাম, নিশ্চয়ই শুনেছে যে তোমার ছেলে হ্যাংক আর বেঁচে নেই। তাকে খুন করে জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোশ বলল, শুনেছি মিঃ ওয়ালেস। আমি বহুবার তাকে সাবধান করেছিলাম কিন্তু সে শোনেনি, ও আমায় উপহাস করেছে। ভেবেছিল ওর দলের লোকেরা চিরকাল ওর দেখাশোনা করবে। যাক, ওর আত্মা শাস্তি পাক, বাপ হিসেবে এই কামনাই করে যাব।
জোশ, তুমি একবার আমায় বলেছিলে যে টেরি আর অ্যাঞ্জেলা একজন আরেকজনের খুব কাছাকাছি ছিল, কতটা কাছাকাছি ছিল তা আমায় খুলে বল।
আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ভাল করে ভেবে বল জোশ ওরা পরস্পরের কতটা কাছাকাছি ছিল।
অ্যাঞ্জেলা টেরিকে দেবতার মত ভক্তি করত। টেরি যখন গান বাজনার ঘরে গিয়ে পিয়ানো বাজাত সে সময় অ্যাঞ্জেলা দরজার বাইরে সিঁড়িতে বসে সেই বাজনা শুনতো। দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে জোশ গ্লাসের পানীয়ে চুমুক দিল, মিঃ টেরি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পরই অ্যাঞ্জেলার মেজাজ পুরোপুরি বিগড়ে গিয়েছিল। আমার বৌ ছাড়া আর কেউ ওকে সামলাতে পারত না।
জোশ আমার মনে হয় মিঃ থরসেনের খারাপ ব্যবহারে টেরি উত্যক্ত হয়ে উঠেছিল আর শেষকালে তিনি যে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন তা অ্যাঞ্জেলা মেনে নিতে পারেনি। সে মন থেকে ধরেই নিয়েছিল যে টেরি আবার ফিরে আসবে। তুমি কি আমার ধারণার সঙ্গে একমত?
জোশ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, অ্যাঞ্জেলার মনে তখন কি বাসা বেঁধেছিল তা আমি বলতে পারব না।
আমার মনে হয় অ্যাঞ্জেলা ইচ্ছে করেই ওর বাবা মিঃ থরসেনের সঙ্গে একদিন বিশ্রী ঝগড়া বাঁধিয়েছিল। যে ঝগড়া থেকে ওর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়, তারপর সেই অবস্থায় সে ওঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আর তারই ফলে টেবিলের কোণে মাথা ঠুকে গিয়ে উনি মারা যান।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও জোশের উত্তর না পেয়ে বললাম, আমার কথা নিশ্চয়ই তোমার কানে গিয়েছে জোশ। আমার মনে হচ্ছে ভাই যাতে বাড়ি ফিরে আসে সেই উদ্দেশ্যেই সে তার বাবাকে খুন করেছিল। সেই সময় কেউ নিশ্চয়ই তাকে দেখে ফেলেছিল আর সেই কারণেই সেই লোকটি তাকে ব্ল্যাকমেল করে চলেছে, যে টাকা অ্যাঞ্জেলা তোমার ছেলে হ্যাংকের হাতে প্রত্যেক মাসে দিত।
আপনার ধারণা ভুল মিঃ ওয়ালেস। হ্যাঁ, মিস অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে মিঃ থরসেনের একটা ঝগড়া খুব বিশ্রী ঝগড়া হয়েছিল, তার মৃত্যুর সময় একমাত্র আমিই তার পাশে ছিলাম। বাবা আর মেয়ের সে ঝগড়াও আমি নিজের কানে শুনেছি। আমি ভেতরে ঢোকার আগেই মিস অ্যাঞ্জেলা ওখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আমি ভেতরে ঢুকে দেখি হার্টে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মিঃ থরসেনের মুখ নীল হয়ে উঠেছে। এক হাতে বুক চেপে ধরে অন্য হাতে তিনি টেবিলের দেরাজ থেকে ওষুধের বড়িগুলোকে বের করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছেন, যে বড়িগুলো হার্ট অ্যাটাকের সময় উনি খেতেন। আমি ঘরের ভেতর ঢুকতেই উনি আমায় দেখতে পান। আমিই এগিয়ে এসে দেরাজের ভেতর থেকে বড়িগুলো সরিয়ে নিই।
কি বলছ তুমি জোশ?
ঠিকই বলছি মিঃ ওয়ালেস, তারপর ওষুধ না খেয়ে তিনি জ্ঞান হারান। আর পড়ে যাবার সময় টেবিলের কোণায় ওর মাথাটা ঠুকে যায়, তার ফলে রগে ক্ষত সৃষ্টি হয়। আমি কিন্তু ওকে একবারের জন্যও ছুঁয়েও দেখিনি। কিছুক্ষণের জন্য লাইব্রেরী থেকে চলে যাই, ফিরে দেখি উনি মারা গেছেন। আর…আর এইভাবে আমি ওকে খুন করেছিলাম।
ওর স্বীকারোক্তি শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, তারপর বললাম, তুমি যা বলছ তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে তুমিই মিঃ থরসেনকে খুন করেছিলে।
হ্যাঁ তাই, আমি ওকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দিয়েছিলাম।
কিন্তু কেন?
তাহলে এর আগের কয়েকটা ঘটনা আপনার জানা দরকার। প্রায় ত্রিশ বছর আমি মিঃ থরসেনের বাটফলারের কাজ করেছি। মিসেস ধরসেনের বিয়ের পর থেকেই আমি এখানে কাজে ঢুকেছিলাম। আমি খুব ভাল বাটলার ছিলাম। মিঃ থরসেন আমার কাজে খুব খুশি হতেন। তারপর আমার ছেলে হ্যাংকের জন্ম হল, তারপরেই শুরু হল ঝামেলা। হ্যাংক বড় হবার পর আমি মিঃ থরসেনকে বলে কয়ে বাগান দেখাশোনার কাজে ওকে লাগিয়ে দিই। মিঃ থরসেন ওকে সামান্য মাইনে দেবার ব্যবস্থা করলেন। বাগানের কাজে হ্যাংকের মনটাও বেশ বসে গেল। ভাবলাম ভবিষ্যতের একটা হিল্লে হল। তারপর মিস অ্যাঞ্জেলা ওর মাথাটি খেল। তার বয়স তখন মাত্র তের আর হ্যাংকের চব্বিশ। আমার ছেলে কিন্তু ততটা খারাপ ছিল না, কিন্তু কচি মেয়েদের পাল্লায় পড়লে যা হয় আর কি। মিস অ্যাঞ্জেলা ওর সঙ্গে এমন কিছু নোংরামি শুরু করল যা অশ্লীল। একদিন ব্যাপারটা মিসেস থরসেনের চোখে পড়ে যায়। তিনি মিঃ থরসেনকে বলেন, তাতে হ্যাংকের চাকরীযায়। হ্যাংকের স্বভাবও ততদিনে খারাপ হতে চলছিল, বদ বন্ধু জুটিয়ে নানারকম কুকাজে হাত পাকাচ্ছিল। কিছুদিনের মধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান দিল। বিচারে তার ছমাসের জেল হয়।
গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে সে আবার বলতে লাগল, তারপর আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার প্রায়ই ঝগড়া হতে লাগল ছেলেকে নিয়ে। সবসময় খিটিমিটিতে আমার মনের শান্তি ঘুচে গেল। আর সবকিছু ভোলার জন্য আমি মদ ধরলাম। একদিন মিঃ থরসেন আমায় ডেকে বললেন, আমি অনেকদিন তাদের কাজ করছি। তাই উনি ওর উইলে আমার নামে পাঁচ হাজার ডলার লিখে দেবেন। কথাটা শুনে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল। হ্যাংক জেল খেটে এসেও নানারকম অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে লাগল। তারপর মিঃ থরসেন টের পেলেন যে আমি ফাঁক পেলেই মদ খাই। উনি রেগে গিয়ে বললেন যে মাস শেষ হলেই যেন আমার মাহিনা নিয়ে কাজ ছেড়ে দিই। আর এও বললেন যে ওর উইল থেকে আমার নামটা কেটে দেবেন। ওর কথায় আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এই সুন্দর বাগান ঘেরা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই ঘটনার ঠিক দুদিনের মধ্যে হ্যাংক আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। ও আমায় বলল যে পাঁচ হাজার ডলার পেলে ও একটা নাইট ক্লাব চালু করতে পারে। আমি বললাম অতটাকা দেবার ক্ষমতা আমার নেই। হ্যাংক শুনে বলল যে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে পাঁচ হাজার ডলার সে যোগাড় করবে। ডাকাতি করে ধরা পড়লে ওর লম্বা মেয়াদের জেল হবে তাই ওকে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে বললাম। আর তখনই বুদ্ধিটা আমার মাথায় এল। আমি ঠিক করলাম যে মিঃ থরসেন হঠাৎ মারা গেলে আমার চাকরিটাও বজায় থাকবে আর উইল অনুযায়ী আমি তখন হ্যাংককে পাঁচ হাজার ডলার দিতে পারব। মিসেস থরসেন অন্ততঃ আমায় কাজ ছেড়ে যেতে বলবেন না। আর ঠিক তাই হল। হাতের নাগাল থেকে ওষুধ সরিয়ে নেবার ফলে মিঃ থরসেন মারা গেলেন আর আমিও পাঁচ হাজার ডলার পেয়ে হ্যাংককে দিয়ে দিলাম। আমার চাকরীও আগের মতই বহাল থাকল। আজ হ্যাংক খুন হওয়ায় মনে হচ্ছে কাজটা আমি ভাল করিনি। মিঃ থরসেনকে ঐভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেওয়া আমার ঠিক হয়নি। আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই। যত তাড়াতাড়ি আমি যেতে পারি ততই মঙ্গল।
জীবনে অনেক আঘাত খাওয়া এই বিধ্বস্ত মানুষটির জন্য আমার দুঃখ হচ্ছিল, চেয়ার থেকে উঠে বললাম, জোশ, করোনার মিঃ থরসেনের পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টে লিখেছিলেন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হওয়ায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওর মৃত্যু ঘটেছে। তুমি আমায় যা বলেছে তা কিন্তু মনে রাখিনি, রাখবনা। বিদায় জোশ, আর কোনদিন আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসব না।
গ্লাসের দিকে তাকিয়ে জোশ বসে রইল, বেরিয়ে আসার মুখে আমারও মনে হল সত্যিই এই হতভাগ্য প্রৌঢ়ের আর বেঁচে থাকার কোনও অর্থ হয় না, ঈশ্বর ওকে মুক্তি দিন। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে যেতে যেতে মনে হল হ্যাংকের মত এক অপদার্থ ছেলের জন্য পুত্র মেহান্ধ জোশকে শেষ পর্যন্ত তার মনিবকে খুন করতে হল। হ্যাঁ, এও একরকম খুন বৈকি।
গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিতে যাব এমন সময় একটা আওয়াজ শুনে হঠাৎ চমকে উঠলাম। একটা সাইরেনের আওয়াজ এগিয়ে আসছে, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটা অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে আমার পাশ কাটিয়ে সেই বাড়ির দিকে ঢুকে গেল যেখানে অ্যাঞ্জেলা মিসেস স্মেডলির সঙ্গে থাকে। ভ্যানের পেছন পেছন একটা গাড়ি ছুটে গেল, তার মধ্যে দুজন লোক বসে আছে। বিল ওখান থেকে সবকিছু নজর রাখছে জানি তাই আমি আর এগোলাম না। গাড়িতে বসে একটার পর একটা সিগারেট খেতে লাগলাম। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর একটা রোলস রয়েসও সেদিকে ছুটে গেল। দেখলাম গাড়ির পেছনের সিটে মিসেস থরসেন এলিয়ে বসে আছেন। আরও আধঘন্টা যেতে আবার সেই সাইরেনের শব্দ। অ্যাম্বুলেন্সটা এবার ফিরে যাচ্ছে তার পেছনে সেই গাড়িটা। আরোহীদের দূর থেকে দেখে ডাক্তার বলে মনে হল। মিসেস থরসেনকে নিয়ে সেই রোলস রয়েসখানা বেরিয়ে এসে থরসেন প্রাসাদের দিকে ছুটে গেল। এবার আমি অ্যাঞ্জেলার বাড়ির দিকে এগোলাম। বারবার হেডলাইট জ্বালিয়ে আর নিভিয়ে বিলকে আমার উপস্থিতির কথা জানাতে লাগলাম।
বাড়ির গেটের কাছে আসতেই দেখি বিল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত নাড়ছে। গাড়ি থামতেই ও দরজা খুলে পেছনের সীটে বসল। মুখ না ফিরিয়েই বললাম, যা যা ঘটেছে সব খুলে বল।
উত্তেজিত ভাবে বিল বলল, ঘটেছে অনেক কিছুই। ঠিক সময়মত এসে পৌঁছেছিলাম। মিসেস স্মেডলি বসার ঘরে চুপ করে বসেছিলেন। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে অ্যাঞ্জেলা ঘরে ঢুকল হাতে সেই ছুরিটা। ও পা টিপে টিপে স্মেডলির দিকে এগোতে লাগল। কিন্তু মিসেস স্মেডলি চিন্তায় এতই মগ্ন যে টেরই পায়নি। ভয়ঙ্কর হিংস্র দেখাচ্ছিল অ্যাঞ্জেলাকে। মিসেস স্মেডলি খুন হতে যাচ্ছে দেখে আমি ছটফটিয়ে উঠলাম। এমন সময় হঠাৎ মিসেস স্মেডলি বিপদের গন্ধ পেয়ে পেছন ফিরে তাকালেন তারপর একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়ে অ্যাঞ্জেলার হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিলেন আর এক ধাক্কা মেরে তাকে ছিটকে ফেলে দিলেন। তারপর দুহাতে তাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে তিনি শোবার ঘরে চলে গেলেন। মিনিট দশেক পর এ ঘরে ফিরে কাকে যেন টেলিফোন করলেন। অ্যাঞ্জেলার হাত পা বোধহয় তিনি বেঁধে রেখেছিলেন তাই ও চিৎকার করে বারবার বলল, টেরিকে ওর কাছে নিয়ে যেতে। তার কুড়ি মিনিট পর একটা অ্যাম্বুলেন্স এল…
জানি, তাদের আমি ঢুকতে দেখেছি। তারপর কি হল?
ওরা অ্যাঞ্জেলাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঢোকাল আর তখুনি মিসেস থরসেন এসে হাজির হলেন। তিনি ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বললেন। তারপর ওরা অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে চলে গেলেন। অ্যাম্বুলেন্স চলে যাবার পর মিসেস থরসেন ওর সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। কথাবার্তা শুনতে না পেলেও মিসেস খরসেনের চোখমুখ দেখে মনে হল তিনি মিসেস স্মেডলির ওপর খুব রেগে গেছেন। এরপর তিনি ব্যাগ থেকে দুটো পাঁচশো ডলার খুলে টেবিলের ওপর রেখে, মনে হয় ওকে কাজ ছেড়ে চলে যেতে বললেন।
আমারও তাই মনে হচ্ছে। ঠিক আছে বিল, তুমি গাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম করো আমি মিসেস স্মেডলির সঙ্গে কথা বলছি। মনে হচ্ছে আমরা ঠিক সময়েই এসেছি।
দরজা খোলাই ছিল। আমি পায়ে পায়ে সোজা শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। মিসেস স্মেডলি একটা আর্ম চেয়ারে বসেছিলেন, তিনি আমায় দেখে চিনতে পারলেন।
আপনি আবার এসেছেন? এবার কি মনে করে?
চেয়ারে বসে আমি বললাম, মিসেস থরসেন আপনাকে জবাব দিয়েছেন এটা কি ঠিক?
হ্যাঁ, আর এখান থেকে চলে যেতে পারলে আমার চাইতে বেশী খুশী আর কেউ হবে না। থরসেন পরিবার আমার সব সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে। এবার আমি আমার আত্মীয়দের কাছে ফিরে যাব। কুড়ি বছর পর আজ মুক্তি পেয়ে যে কি আনন্দ হচ্ছে কি বলব!
শুনে আমিও খুশি হলাম মিসেস স্মেডলি। যাবার আগে থরসেন পরিবারের লোকেদের সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর যদি দেন তো কৃতজ্ঞ থাকব। আচ্ছা, অ্যাঞ্জেলাকে এতদিন ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে কেন বলতে পারেন?
হ্যাঁ বলব, চলে যাবার আগে অন্ততঃ একজনকে সব কথা জানিয়ে যাওয়া দরকার। শুনুন মিঃ ওয়ালেস, আমাদের পরিবারে আমরা তিনবোন আর চার ভাই আছি। ওরা আমায় আনন্দের সঙ্গে থাকতে বলবে। আমাদের পরিবার খুব বড়। মিস অ্যাঞ্জেলার জন্যই এতদিন এখানে ছিলাম নয়ত কবে চলে যেতাম। অ্যাঞ্জেলা জন্মের পর থেকেই আমার কাছে বড় হয়েছে। ছেলেবেলা থেকেই ওর মধ্যে পাগলামির লক্ষণ দানা বেঁধেছিল আর তা জেনেই আমি ওকে সব কাজে সব ব্যাপারে সাহায্য করতাম। মিসেস থরসেন অর্থাৎ ওর মা ওর জন্য কিছুই করেন নি। মিস অ্যাঞ্জেলা ওর ভাই টেরিকে দেবতার মত ভক্তি করত। বড় হবার পর দিনরাত ওর পাশে ঘুর ঘুর করত। ফলে টেরি অ্যাঞ্জেলার ওপর খুব বিরক্ত হত। আমি অ্যাঞ্জেলাকে অনেকবার হুঁশিয়ার করেছি কিন্তু ও শোনেনি। অ্যাঞ্জেলার উৎপাতে বাজনার ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে তালা দিয়ে টেরি পিয়ানো বাজাত। অ্যাঞ্জেলা বাইরে বসেই ওর বাজনা শুনত। এরপর টেরির সঙ্গে ওর বাবা মিঃ থরসেনের খুব ঝগড়া হয়, তিনি তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। যাবার আগে টেরি বোনের কাছে বিদায় পর্যন্ত নেয়নি। ব্যাপারটায় অ্যাঞ্জেলা খুব ধাক্কা খায় তারপর থেকেই ওর পাগলামি বেড়ে যায়। ওকে সামলাতে আমার বেশ বেগ পেতে হত। তারপর মিঃ ধরসেন হঠাৎ মারা গেলেন। মারা যাবার আগে মোটা টাকা আর এই বাড়ি উনি অ্যাঞ্জেলার নামে উইল করে দিলেন। অ্যাঞ্জেলা তার বাবার মৃত্যুর পর উইল অনুযায়ী পাওনা টাকাকড়ি নিয়ে এখানে এসে উঠল। নিজের মাকে চিরকাল ঘেন্না করে। সারাদিন অ্যাঞ্জেলা কোন কাজে হাত দিত না শুধু নিজের মনে বিড় বিড় করে বকে যেত। মাঝে মাঝে মিসেস থরসেনকে সব বলে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। কিন্তু শুধু অ্যাঞ্জেলাই নয় মিসেস থরসেনকেও আমি পছন্দ করতাম না। অ্যাঞ্জেলার মন ভালো রাখার জন্য আমি ওকে বাগানের কাজকর্ম দেখাশোনা, নিদেন পক্ষে বাড়ির চারপাশে কিছু একটা দেখার কথা বলতাম কিন্তু ও কোন পাত্তাই দিত না। একদিন একটা লোক এসে ওর সঙ্গে দেখা করল।
রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে মিসেস স্মেডলি আবার বলতে লাগলো, সদর দরজা খোলাই ছিল তাই ঘণ্টা না বাজিয়ে লোকটা সোজা এই বসার ঘরে এসেছিল। আপনি এখন যে চেয়ারে বসেছেন সেখানে বসে সে অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে কথা শুরু করে। তখন আমি রান্নাঘরে রাতের ডিনার তৈরী করছিলাম। তার টুপি খুলতেই চোখে পড়ল তার মাথায় একটাও চুল নেই, ঠিক তরমুজের মত কামানো। তার ভুরুতেও চুল ছিল না তার ফলে তাকে ঠিক শয়তানের মত দেখাচ্ছিল। লোকটাকে আমার ভাল লাগেনি তাই রান্নাঘর থেকে বার বার বেরিয়ে তাদের কথা শুনছিলাম। হঠাৎ কানে এল লোকটা বলল, যে টেরি কোথায় আছে তা সে জানে। টেরির নাম.শুনে অ্যাঞ্জেলা লাফিয়ে ওঠে। বারবার চেঁচিয়ে জানতে চেয়েছিল টেরি কোথায় আছে। ঐ লোকটা তখন তাকে বলেছিল যে টেরি চায় না তার গোপন আস্তানার কথা সবাই জানুক। লোকটা এও বলল যে, টেরি পিয়ানো বাজিয়ে বেশ পয়সা কামাচ্ছে।
শয়তানটা বলল যে টেরির দুশমনরা যাতে তার কোন ক্ষতি করতে না পারে তাই সে সবসময় তার ওপর নজর রাখছে। আমি শুধু শুধু তাকে বাঁচাতে যাব কেন। তাই বলছি ভালোয় ভালোয় প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে ব্ল্যাক ক্যাসেট নাইট ক্লাবে গিয়ে দশ হাজার ডলার দিয়ে আসবে। যতদিন ঐ টাকা দেবে ততদিন কেউ তোমার ভাইয়ের একটা চুলও ছুঁতে পারবে না। কিন্তু টাকা দেওয়া বন্ধ করলে আমি আর তোমার ভাইকে বাঁচাতে পারবো না। তখন টেরির দুশমনরা এসে হাতুড়ি দিয়ে তার দুহাত ভেঙ্গে দেবে, সে আর জীবনে পিয়ানো বাজাতে পারবে না।
একটু থেমে দম নিয়ে মিসেস ডেলি বলতে লাগলেন, এ আজ থেকে দশ মাস আগের ঘটনা। মিস অ্যাঞ্জেলা লোকটির কথায় রাজী হল, লোকটা এও বলল যে অ্যাঞ্জেলার এক পুরোনো বন্ধু ঐ নাইট ক্লাবে থাকবে টাকাটা তার হাতে দিলেই চলবে। বুঝতেই পারছেন তার পুরোনো বন্ধুটি ছিল আমার হতভাগ্য ছেলে হ্যাংক। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব যাতে তাকে আর জন্মাতে না হয়। তা ঐ লোকটি চলে যাবার পর অ্যাঞ্জেলাকে আমি অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলাম, বললাম যে লোকটা বদ মতলব নিয়ে এসেছিল, সে নিজেই জানেনা টেরি কোথায় আছে। আসলে ভাওতা দিয়ে প্রত্যেক মাসে দশ হাজার ডলার রোজগার করাই তার উদ্দেশ্য। কিন্তু অ্যাঞ্জেলা তা কিছুতেই বুঝতে চাইল না। চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করতে লাগল, বারবার বলল টাকা না দিলে টেরির দুশমনরা হাতুড়ি দিয়ে তার দুহাত ভেঙ্গে দেবে তখন আর সে পিয়ানো বাজাতে পারবেনা। তারপর থেকে টানা দশ মাস এই খেলাই চলতে লাগল, প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে ব্যাঙ্ক থেকে দশ হাজার ডলার পেলে ও আমার অপদার্থ ছেলের হাতেই দিতে লাগল। মনে হয় টাকাটা এইভাবে দিয়ে ও মনে মনে শান্তি পায়। অন্ততঃ এর ফলে ওর পাগলামিটা কিছুটা কমল। আমার করার কিছুই ছিল না, সব দেখেশুনে তাই চুপ করে থাকতাম।
সেই ন্যাড়ামাথা লোকটা অল্প কিছুদিন পরে আবার এসে অ্যাঞ্জেলাকে বলল যে এক লাখ ডলার পেলে সে টেরির সঙ্গে অ্যাঞ্জেলার দেখা করিয়ে দিতে পারে। আর তার কয়েকদিন পর আপনি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মিঃ অকল্যান্ডকে বললেন যে এক ভদ্রমহিলা টেরির নামে এক লাখ ডলার উইল করে দিয়ে গেছেন, টেরি যতক্ষণ পর্যন্ত না টাকাটা দাবী করবে ততক্ষণ সেটা ব্যাঙ্কে পচবে। টেরিকে দেখবার জন্য অ্যাঞ্জেলা পাগলের মত হয়ে উঠেছিল, তাই সে স্থির করল যেভাবে হোক ব্যাঙ্ক থেকে ঐ একলাখ ডলার হাতাতে হবে। তখনই তার মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি এল। অ্যাঞ্জেলা জানত যে আপনি বা মিঃ অকল্যান্ড কেউই আগে টেরিকে দেখেননি। তাই টেরির বয়সী কোন ছেলেকে যদি টেরির মত সাজিয়ে ব্যাঙ্কে নিয়ে তাকেই নিখোঁজ ভাই বলে সনাক্ত করা যায় তাহলে মিঃ অকল্যান্ড ঐ একলাখ ডলার তাকে দিয়ে দেবেন। অ্যাঞ্জেলা তার মতলব হ্যাংককে খুলে বলতেই সে ঐ বয়েসী ছেলেকে এনে হাজির করল। তারপরের ঘটনা তো সবই জানেন। টাকাটা না পেয়ে যেদিন ব্যাঙ্ক থেকে ফিরল সেদিন তাকে মনে হয়েছিল এক হিংস্র চিতা বাঘিনী। ক্ষিদের সময় শিকার ফসকে যাওয়ায় সে ভয়ানক রেগে গেছে। আপনার উদ্দেশ্যে বারবার গালি দিতে দিতে বলল যে, আপনার নিশ্চয়ই কোন বান্ধবী আছে, হ্যাংকের সাহায্যে সে তার এমন ক্ষতি করবে যা আপনি চিরদিন মনে রাখবেন।
খানিকক্ষণ থেমে আবার বলতে লাগল, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল, ফিরল তিনচার ঘণ্টা বাদে। শুধু বলল হ্যাংক তার কথায় রাজী হয়েছে। পরদিন খবরের কাগজে আপনার বান্ধবীর কথা পড়ে আমার আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। আমি দুঃখিত মিঃ ওয়ালেস, কিন্তু অ্যাঞ্জেলার মাথার এখন ঠিক নেই। সে এখন বদ্ধ উন্মাদ।
আমার চোখের সামনে একটা পুরোনো দৃশ্য ভেসে উঠল। অ্যাসিডে ঝলসানো মুখ দুহাতে ঢেকে সুজি রাস্তার ওপর ছুটছে। একটা ভারী ট্রাকের চাকার নীচে তার দেহটা পিষে তেলে গেল।
তাহলে অ্যাঞ্জেলার এখন কি হবে?
অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে যে দুজন ডাক্তার এসেছিলেন তারা মিসেস থরসেনকে বললেন যে ওঁরা অ্যাঞ্জেলাকে পাগলা গারদে নিয়ে রাখবেন, আর তারা এও বললেন যে ওর মাথা আর এ জীবনে সুস্থ হবেনা। দিনরাত ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘরের ভেতর তালাবন্ধ করে ওকে রাখতে হবে। অর্থাৎ ধরেই নিতে হবে যে অ্যাঞ্জেলা বেঁচে নেই সে মৃত।
মিসেস স্মেডলি কোনরকম সাহায্যের প্রয়োজন হলে নিসংকোচে তা আমায় বলুন। আমার গাড়িতে করে আপনাকে আপনার আত্মীয়দের বাড়ি পৌঁছে দেব কি?
থাক, আমার আর সাহায্যের প্রয়োজন হবে না। আমি নিজেই আমার আত্মীয়ের বাড়ি যেতে পারব।
কয়েক মিনিট বাগানে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি থেমে গেছে, আবহাওয়াটা ভ্যাপসা হয়ে উঠেছে। হ্যাংক খুন হয়েছে। অ্যাঞ্জেলা পাগলা গারদে গেছে অর্থাৎ তিন দুশমনের মধ্যে দুজন ঘায়েল। আর বাকি আছে হুলা মিনস্কি। জো ওয়ালিনস্কির ডানহাত সেই ন্যাড়া মাথা শয়তান যাকে দেখলে সবাই ভয়ে আঁতকে উঠে। মিনস্কির গুলিতেই যে হ্যাংক মারা গেছে সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। নিশ্চয়ই জো ওয়ালিনস্কির কুমে হুলা তাকে খুন করেছে। আর হুলা মিনস্কিকে সরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমার মন কখনোই শান্ত হবে না। হ্যাঁ, তখনই আমার শোধ নেবার পালা শেষ হবে। প্রতিশোধ নিলেও আমার সুজিকে কি ফিরে পাব?
বিল গাড়িতে অপেক্ষা করছিল, আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, এবার বাড়ি চলো।
বাড়ি গিয়ে কফিতে চুমুক দিতে দিতে মিসেস স্মেডলির মুখ থেকে শোনা সব কথা বিলকে খুলে বললাম, শুধু মিঃ থরসেনকে স্মেডলি কিভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়েছিল সেকথা চেপে গেলাম। জোশকে কথা দিয়েছি এই ঘটনা আমি ছাড়া কেউ জানবেনা।
এখন মিনস্কিকে খতম করা ছাড়া আমার মাথায় আর কোনও পরিকল্পনাই নেই বিল, বলে আমি খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লাম, থাই স্যান্ড্রার সঙ্গে দেখা করতে হবে।
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে ঘুম এল না। শেষকালে স্লিপিং পিল খেয়ে একসময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাম।
সকালে উঠে স্নান সেরে জলখাবার খাচ্ছি এমন সময় বিল বলল, কে যেন টেলিফোনে কথা বলতে চায়।
হ্যালো, রিসিভার তুলে বললাম, আমি ডার্ক ওয়ালেস বলছি, আপনি কে?
আমি স্যাম বলছি মিঃ ওয়ালেস, উল্টোদিক থেকে চেনা গলা এল, নেপচুন রেস্তোরাঁ খালি। আলবানি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়, বলছে খুব দরকারী।
আল কোথায় স্যাম?
এখানে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে, বলছে আপনার জন্য ও অপেক্ষা করছে।
ওকে বলো কুড়ি মিনিটের ভেতর আমি যাচ্ছি। ফোন করার জন্য ধন্যবাদ, বলে রিসিভার রেখে দিলাম।
বিল তুমি বাড়িতেই থাকো, আমি আল বার্নির সঙ্গে দেখা করেই ফিরে আসছি।
ওকথা বললে শুনছিনা। বিল খেঁকিয়ে উঠল, বাড়িতে বসে থাকা পোযাবে না। আমিও যাবো, বসে থাকতে হয় গাড়িতে থাকব।
কাপ প্লেট টেবিলে রেখে বিলকে নিয়ে হাজির হলাম নেপচুন সরাইয়ে। বিলকে গাড়িতে রেখে ভেতরে ঢুকলাম। বানি এককোণে বসে পাউরুটি চিবোছিল, আমি চেয়ারে বসলাম।
খাবার খাবেন মি ওয়ালেস? বানি জানতে চাইল।
না, আমি ব্রেকফাস্ট সেরেই এসেছি অ্যাল, ইচ্ছে হলে একটা বীয়ার খেতে পার আমি দাম দিয়ে দেবো।
কেউ চাইলে আমি না বলি না মিঃ ওয়ালেস, বলেই বার্নি স্যামকে ইঙ্গিত করল, আর সে একপ্লেট সসেজ আর বীয়ার এনে তার সামনে রাখল।
একসঙ্গে সসেজ ও বীয়ার গলায় ঢালল বার্নি। তারপর গা এলিয়ে দিয়ে বলল, মিঃ ওয়ালেস, আমি কাউকে প্রশ্ন করিনা, সবসময় শুধু সব কথা শুনে যাই। মনে আছে নিশ্চয়ই যে আপনি টেরি জিগলার সম্পর্কে খোঁজখবর চাইছিলেন। ওর সম্পর্কে আপনার কৌতূহল আছে কি?
আছে অ্যাল, যা জানো আমায় বল।
অ্যাল বানি বলল, আপনাকে একটি লোকের সঙ্গে দেখা করতে হবে, তার নাম চাক সলস্কি। একসময় ও বেআইনী হিরোইন ও চরস ছেলেদের কাছে বিক্রী করত, তারপর মাফিয়ারা ওর বাজার নষ্ট করে নিজেরাই শুরু করে। আমি জেনেছি টেরি জিগলার ওর বন্ধু ছিল। সলঙ্কির টাকা দরকার। আমার মনে হয় কিছু ডলার দিলে:.চাক জিগলারের খবর দিতে পারে। দশনম্বর ক্ল্যাস আলির ছাদের চিলেকোঠায় চাক থাকে। এর চাইতে বেশী কিছু জানি না।
ধন্যবাদ অ্যাল, আমি ওয়ালেট বার করতেই সে আমার হাত চেপে ধরে বলল, মিঃ ওয়ালেস, আপনি আমার বন্ধু, বন্ধুর কাছ থেকে আমি টাকা নিই না।
গাড়িতে ফিরে বিলকে সব বলতেই সে বলল, ক্ল্যাস আলি? কাছেই, এই ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকারই সবচেয়ে পুরোনো বস্তি ওটা। ওখানে কোন বাড়িতে কেউ থাকে বলে মনে হয় না। যে কয়েকটা অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক আছে সেগুলো শীগগিরই ভেঙ্গে ফেলা হবে।
এসন খবর তুমি কোত্থেকে পেলে?
বিল হাসল, তোমার বার্নিই শুধু মাটিতে কান পেতে থাকে না, ডার্ক। আমিও তোমারই মত একজন গোয়েন্দা আর খবর বের করাই আমার কাজ তা ভুলে যেও না। গাড়িতে ওঠো, আমি ঠিক চালিয়ে নিয়ে গিয়ে তোমায় সেখানে পৌঁছে দেব।
অল্প কিছুক্ষণের ভেতরে বিল আমায় একটা পুরোনোবক্তির সামনে পৌঁছেদিল, গোটা চারেক পুরোনো পাঁচতলা বাড়ি এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ভেতরে একটি বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে বিল বলল, ঐ তোমার দশ নম্বর ক্ল্যাস আলি।
বাড়িটার প্রত্যেকটি তলার কাঁচের জানালাগুলো ভেঙ্গে পড়েছে, সদর দরজার পাল্লা ভেঙ্গে হেলে পড়েছে। একরাশ নোংরা আবর্জনা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম, বিল সঙ্গে এল। নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে দেখলাম, একতলা দোতলা তেতলা চারতলা সব খা খা করছে। কোথাও কেউ নেই।
ছাদে উঠে দেখি সামনে চিলেকোঠার দরজা ভেজানো। দরজার গায়ে টোকা দিতে লাগলাম কিন্তু ভেতরে কোন সাড়াশব্দ শোনা গেল না। অগত্যা বাধ্য হয়েই হাতল ধরে হ্যাঁচকা টান মারতেই ক্যাচ ক্যাচ শব্দে পান্না খুলে গেল। সাবধানে ভেতরে ঢুকলাম। বিল বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
আমি এর আগে পশ্চিম মিয়ামির বহু নিগ্রো বস্তি দেখেছি। কিন্তু এই গুদামঘরের তুলনায় সেগুলো স্বর্গ। ঘরের ভেতর একটা প্যাকিং কেসকে টেবিল বানানো হয়েছে। তার পাশে দুটো টুল, এককোণে একখানা ভাঙ্গা খাট। এঁটো খাবার দাবারের আবর্জনা আর খবরের কাগজের ভাই মেঝেতে পড়ে আছে। সে সবের গন্ধে আমার মাথা ঘুলিয়ে উঠল।
একটি লোক খাটের ওপর ময়লা চাদর পেতে ঘুমোচ্ছ। পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন। ভাল করে দেখলে বোঝা যায় বহুদিন তার ভাল খাওয়া জোটেনি। তার কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলে জট পড়েছে। ঘন দাড়ি গোঁফে মুখ ঢাকা পড়লেও তার বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি নয়। তার গায়ের দুর্গন্ধে বোঝা যায় অনেকদিন সে স্নান করেনি।
তার হাত ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম। অ্যাই চাক! ওঠো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
সে চোখ পিটপিট করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলল। আপনি কে? এখানে কি চান?
আমি তোমায় কিছু টাকা দিতে পারি কিন্তু তার বিনিময়ে আমার কিছু খবর চাই। বলে ওয়ালেট থেকে দুটো একশ ডলারের নোট দেখিয়ে বললাম, বল এ দুটো তোমার চাই?
বড় বড় চোখে সে নোট দুটোর দিকে এমনভাবে তাকাল যেন ফোর্ট নক্রের সরকারী সোনার বাঁট থরে থরে তার সামনে সাজানো।
হা, টাকার আমার বড় দরকার। বলতে বলতে সে তার নোংরা জট ধরা চুলে আঙ্গুল চালাতে লাগল।
বলেছি তো টাকা দেব কিন্তু তার বদলে আমার খবর চাই।
কি খবর চান?
তোমার মাথা ঠিক কাজ করছে তো? আমার সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দেবে তো?
চাক মাথা নীচু করে নোংরা মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝলাম সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছে। আমি সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাই কারণ ঘুমানো ছাড়া আমার আর কোন কাজ নেই। ঘুমোবার সময় ভাবি হয়তো এই আমার শেষ ঘুম, ঘুমের ভেতরেই আমার মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু তা আর হয় না। আবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে তবু আধমরা হয়ে আজও বেঁচে আছি। চাক আমায় খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল, কি খবর জানতে চান? আপনি কি পুলিশের লোক?
না, আমি এসেছি টেরি জিগলারের খোঁজে।
কেন? ওর খবর দিয়ে আপনার কি দরকার?
সে তোমার না জানলেও চলবে চাক। তুমি বলল দুশো ডলারের বদলে ওর খবর দেবে কিনা?
খবর পেয়ে টাকা না দিয়ে চলে যাবেন না তো?
একটা একশো ডলারের নোট তার কোলের ওপর দিয়ে বললাম, এবার বিশ্বাস হলো তো? খবর দিলে বাকিটা পাবে। এবার মুখ খোল।
এমনভাবে সে টাকাটার গায়ে হাত বোলাতে লাগল যেন সেটা একটা বাচ্চাদের খেলার পুতুল।
জানেন, গত তিনদিন ধরে আমার পেটে কিছু পড়েনি? খিদেয় আমার পেট জ্বলছে। আপনি বসুন। সব কথা বলব।
প্যাকিং বাক্সের ওপর আমি বসার সঙ্গে সঙ্গে চাক মুখ খুলল। সে এক বিচিত্র কাহিনী। ডেড এন্ড নাইট ক্লাবে টেরির সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধুত্বে পরিণত হয়। চাক আগে থেকেই চোরাই মাদক ওষুধের কারবার করত। চাকের নিজের ছিল হিরোইনের নেশা, তার সঙ্গে মেলামেশার ফলে টেরিও ঐ নেশার কবলে পড়ল। চাকের একটা মুশকিল ছিল। সহজেই মাল যোগাড় করতে পারত কিন্তু তা ভাল করে কাটাতে পারত না। টেরি বলল চিন্তা নেই। সে তার সব মাল কাটিয়ে দেবে। বিকেলের দিকে বেরিয়ে টেরি কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সব মাল বিক্রী করে দিত। নাইট ক্লাবে, তার বাজনার অনুরাগী কমবয়েসী ছেলেমেয়েদেরও অল্প সময়ের মধ্যে সে হিরোইনের খদ্দের বানিয়ে ফেলল। এইভাব্র চাক আর টেরির হিরোইন কেনা বেচার কারবার ফুলে ফেঁপে উঠল। এক বুড়ো চীনার কাছ থেকে চাক মাল কিনত আর টেরি সে মাল কাটাত।
আমার মেয়েমানুষের নেশা ছিল না। আমি ভাল খেয়ে পরে দিনরাত রাজার হালে থাকতে ভালবাসতাম। কিন্তু টেরি লিকা নামে এক বান্ধবী জুটিয়েছিল। ওরা দুজনে একই সঙ্গে থাকত। আমাদের কারবার দাঁড়িয়ে যাবার পরই শুরু হল আসল ঝামেলা। এক সোমবার সকালে আমি সেই বুড়ো চীনার কাছে মাল কিনতে গেছি। সেখানেই হুলা মিনস্কিকে দেখলাম। আপনি মিনস্কিকে চেনেন?
চিনি। তুমি বলে যাও।
মিনস্কি আমার যোগানদারের টেবিলে বসে আছে দেখে ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে গেল। সে আমায় কারবার গুটিয়ে ফেলার হুকুম দিল। আর বলল সে-ই স্থানীয় খদ্দেরদের মাল যোগাবে। এও বলল যে টেরি যেন হিরোইন বেচা ছেড়ে এখান থেকে চলে যায়।
আমি জানতাম হুলা মিনস্কি কি সাংঘাতিক লোক। তার কথামত না চললে ফল যে কি মারাত্মক হতে পারে তাও আমার জানা ছিল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এসে টেরিকে সব বললাম। কিন্তু ও বিশেষ পাত্তা দিল না। তবে সুটকেশ নিয়ে ও সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে চলে এল। এদিকে মালের অভাবে রোজগার বন্ধ। টাকাকড়ি যা জমিয়েছিলাম দুজনেই তার সব উড়িয়ে ফেলেছি। শেষকালে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে ঘরভাড়া দেবার পয়সাও রইল না। টেরিকে বললাম অন্য কোথাও গিয়ে নতুন করে কারবার শুরু করব কিন্তু ও তাতে রাজি হল না। মিনস্কির হুকুমকে সে একদম গুরুত্ব দিল না। টেরি বলল যে অন্তত পঞ্চাশজন বাঁধা খদ্দের সে হারাতে চায় না। আর সত্যিই অল্পদিনের ভেতর আর কয়েকজন চীনা যোগানদার সে জুটিয়ে ফেলল। তার কাছ থেকে মাল কিনে সে আবার আগের মত খদ্দেরদের কাছে বেচতে লাগল। আমি কিন্তু তখনই বিপদের গন্ধ পেলাম। বুঝলাম মিনস্কি চুপ করে থাকবেনা। তার হুকুমনা মানার জন্য সে টেরিকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। টেরির একার রোজগারের পয়সায় আমি ভাগ বসালাম না। দিনরাত ঘরে বসে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম।
দুজনে এক সপ্তাহ পর একদিন রাতে ঘরে বসে আছি। এমন সময় লাথি মেরে দরজা খুলে মিনস্কি তার দুই ষণ্ডামার্কা সাকরেদকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। আমি দুহাতে মুখ ঢেকে মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। তাই কি হল তা দেখতে পেলাম না। কিন্তু থেকে থেকে মট মট করে হাড়গোড় ভাঙ্গার শব্দ আর টেরির আর্তনাদ আমার কানে আসছিল। কিছুক্ষণ পর আমার পাঁজরে এক লাথি মেরে বলল, তুই আমার কথা শুনে কারবার ছেড়েছিস তাই তোকে প্রাণে মারলাম না। তোর আর প্রাণের ভয় নেই কিন্তু তোর বন্ধুকে আর ফিরে পাবি না। তাকে আমরা নিয়ে চললাম বলে দরজা খুলে সাকরেদদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি চোখ খুলে আর টেরিকে দেখতে পেলাম না। টেরি তখন কোথায় জানতে চান? মিনস্কি তার হাড়গোড় ভেঙ্গে আধমরা শরীরটা সিমেন্ট ভর্তি একটা বস্তায় পুরে মাঝ সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। টেরি আর কোনদিন ফিরে আসবে না। আমার হাতে তখন টাকাকড়ি নেই বাধ্য হয়েই এই ভাঙ্গা পোড়োবাড়িতে আশ্রয় নিলাম। এখানে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর দিন গোনা ছাড়া আমার আর কিছু চাইবার নেই।
আমার মনে কিন্তু চাকের জন্য সামান্যও সহানুভূতি জাগল না। যে পাষণ্ড কমবয়েসী ছেলেমেয়েদের কাছে হিরোইন বেচে পয়সা রোজগার করে তার এর চাইতেও বেশি শাস্তি হওয়া দরকার। আমি আরেকটা একশ ডলারের নোট তার বিছানায় রেখে সেই অন্ধকার গুদাম ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
বিল গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ওর সব কথা শুনেছি। সত্যি থরসেন পরিবারে এই দুই ভাইবোন দুটি রত্ন।
হতেই পারে। মিঃ থরসেন এবং তার স্ত্রী যখন কেউই আদর্শ অভিভাবক ছিলেন না।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর বিল বলল, হ্যাংক মরেছে। অ্যাঞ্জেলা পাগলা গারদে, টেরির মৃত্যু সংবাদ নিজেই শুনলে। তাহলে বাকি রইল শুধু মিনস্কি। তাই না?
হ্যাঁ, আর এও জেনো যে মিনস্কিকে খতম করাটা খুব সহজ হবে না। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্যান্ড্রার সঙ্গে আমার দেখা হবে। ও কিভাবে মিনস্কিকে খতম করতে চায়, আমি শুনতে চাই, তবে যা হবার আজ রাতের মধ্যেই হবে। বলে গাড়ি স্টার্ট করলাম।
.
স্যান্ড্রা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল থ্রি ক্র্যাব রেস্তোরাঁয়। দোতলার নির্দিষ্ট কেবিনে আমি ঢুকতেই সে বলল, আসুন ডার্ক আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি, বলেই সে ককটেলের বোতলের দিকে ইঙ্গিত করল।
এখন ওসব খাব না।
আজ স্যান্ড্রার পরনে ধপধপে রেশমী সাদা পোশাক। একরাশ ঘন কালো চুল তার ঘাড়ে, এক অদ্ভুত আর হিংস্র আনন্দে ঝলসে উঠছে তার চোখ দুটি। এরকম মূর্তিমতি সর্বনাশী কোন মেয়েকে দেখার সৌভাগ্য এর আগে আমার হয়নি।
নিজের গ্লাসে মাটিনি ঢালতে ঢালতে স্যান্ড্রা বলল, চুপ করে আছেন কেন? আমায় কি আপনার কিছুই বলার নেই? এখানে ডেকে আনলেন কেন?
গম্ভীর গলায় বললাম, স্যান্ড্র এবার থেকে ওয়ালিনস্কির মাসিক বরাদ্দের দশহাজার ডলার ঘাটতি পড়বে।
সে কি? কেন, কিভাবে?
অ্যাঞ্জেলা থরসেনকে যে পাগলা গারদে নেওয়া হয়েছে সে সব সংক্ষেপে বললাম। সব শুনে কঠিন হাসি হেসে স্যান্ড্রা বলল, তাহলে ওয়ালিনস্কি এবার সত্যিই মুশকিলে পড়বে। ওর ওপরওয়ালা মাফিয়া সর্দাররা ওকে খতম করে সে জায়গায় নতুন লোক বসাবে।
ওয়ালিনস্কির জন্য আমার মাথাব্যথা নেই। আমার দরকার হুলা মিনস্কিকে।
গম্ভীর ভাবে স্যান্ড্রা বলল, হ্যাঁ, ওকে আমি নিজের হাতে খুন করে বাবার খুনের বদলা নেব। কিন্তু লোকটা অসম্ভব ধূর্ত। বিপদের হাত থেকে বাঁচতে সবসময় দেহরক্ষী নিয়ে চলে। তবে আমিও কম যাই না। আমার কাছে একটা অটোমেটিক পিস্তল আছে। তাই দিয়ে আমি ওর বুক থেকে পেট পর্যন্ত গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেব।
কিন্তু এতো আত্মহত্যার সামিল হবে। ওর দেহরক্ষীরা তোমায় ছেড়ে দেবে ভেবেছো? মিনস্কি খুন হলে তার দেহরক্ষীরা তোমাকেও খুন করবে।
না ডার্ক, মিনস্কির দেহরক্ষীরাও আমার গায়ে হাত দেবার সাহস পাবেনা। দলের সবাই জানে যে আমি ওয়ালিনস্কির ডান হাত। ওয়ালিনস্কি নিউইয়র্কে গেছে। আগামীকাল রাতে ফিরবে। ফিরে যখন জানবে যে আমি হুলা মিনস্কিকে খুন করেছি তখন সে আমায় খুন করার হুকুম দেবে। কিন্তু তার আগে আমি তার নাগালের বাইরে চলে যাব। আমার জিনিসপত্র সব গোছগাছ করা হয়ে গেছে। মিনস্কিকে খতম করেই আমি কেটে পড়ব। আর কেউ আমায় খুঁজে পাবেনা। কাজেই আপনি আর আমার প্রাণের জন্য চিন্তা করবেন না। নিজের ব্যবস্থাটুকু করার মত ক্ষমতা আমার আছে। শুনুন ডার্ক, আপনি শুধু মিনস্কিকে দেখিয়ে দেবেন। আপনি তাকে একবার দেখেছেন কিন্তু আমি নিজের চোখে তাকে দেখিনি। নিরীহ লোকের গায়ে আমি গুলি ছুঁড়তে পারি না।
বেশ তাই হবে স্যান্ড্রা।
স্যান্ড্রা মুচকি হেসে বলল, আপনি তো হ্যাংকের নাইট ক্লাব বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। এখন ব্ল্যাকমেলের টাকা জমা পড়বে বুড়ো ফুঁ চায়ের রেস্তোরাঁয়। আগামীকাল মাসের পয়লা তারিখ। তাই আজ রাত তিনটেয় মিনস্কি সেখানে আসবে। আমি আমার গাড়িতে চেপে আগেই ওখানে চলে যাব। আপনিও দুটো নাগাদ যাবেন।
ঠিক আছে, দুটো নাগাদ আমি সেখানে পৌঁছে যাব তোমার পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নেবে এটাই আশা করছি।
গ্লাসে মার্টিনি ঢালতে ঢালতে ও বলল, আমার পরিকল্পনা সবসময় নির্ভুল হয়, ডার্ক। তাহলে রাত দুটোর মধ্যে আপনার সঙ্গে দেখা হবে। আমি মার্সিড়িজে চেপে আসব, রেস্তোরাঁর পাশেই গাড়ি রেখে আপনার জন্য অপেক্ষা করব। মিনস্কি এলে আপনি শুধু আমায় দেখিয়ে দেবেন। কেমন?
পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারো আমার ওপর। বলে নীচে নেমে এলাম। বিল গাড়ি স্টার্ট দিতেই বললাম, ফু চায়ের রেস্তোরাঁ চেনো?
চিনি। ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকার পুবদিকের শেষ বাড়িতে ঐ রেস্তোরাঁ। আগে ভালই চলত। কিন্তু ওর মালিক ফু চায়ের বয়স এখন নব্বইয়ের কাছাকাছি। ঠিকমত দেখাশোনা করতে না পারার ফলে খদ্দেরদের ভিড় অনেক কমে গেছে। কিন্তু ঐ রেস্তোরাঁর খোঁজ করছ কেন?
বিলকে সংক্ষেপে স্যান্ড্রার পরিকল্পনার কথা বললাম। ব্ল্যাকমেলের টাকা এখন ওখানেই জমা পড়ছে। আজ রাত দুটোয় আমরা ঐ রেস্তোরাঁর পাশে গাড়ি পার্ক করে অপেক্ষা করব। তিনটে নাগাদ মিনস্কি এসে পৌঁছলে আমি তাকে চিনিয়ে দেব, তারপর স্যাড়া নিজের হাতে তাকে খতম করবে। তুমি রিভলবার নিয়ে আসবে। সব কিছু যদি ভালোয় ভালোয় মিটে যায় তো চিন্তার কিছু নেই। যদি মা মেটে তাহলে দুপাশ থেকে গুলি ছুঁড়ে স্যান্ড্রাকে কভার করে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সে দায়িত্ব আমাদের দুজনের।
বিল বলল, স্যান্ড্রা যদি মিনস্কিকে খুন করে পালিয়ে যায় তাহলে কি আমরা কর্নেলের সঙ্গে দেখা করে আমাদের আগের চাকরীতে আবার যোগ দিতে পারব?
নিশ্চয়ই। মিনস্কি খুন হলে তুমি আর আমি দুজনেই আবার আমাদের চাকরীতে যোগ দেব।
চল খেয়ে নিই। বলে বিল লুসিনোর রেস্তোরাঁয় গাড়ি দাঁড় করাল। বড় চিংড়ি আর স্টেক দিয়ে আমরা ডিনার সারলাম। কফির অর্ডার দিয়ে বিল প্রশ্ন করল, স্যান্ড্রা যে মতলবটা এঁটেছে তাতে তোমার কাজ হবে বলে মনে হয়?
সিগারেট ধরিয়ে বললাম, মেয়েটা আর পাঁচজনের চাইতে আলাদা বিল, কাজ হবে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু যদি না হয়, যদি ওর গায়ে গুলি লাগে, তাহলে বাকি কাজটুকু আমিই সারবো। কিন্তু স্যান্ড্রা বলছে যে দেহরক্ষীরা ওকে গুলি করার সাহস পাবে না। সবই ওর ওপর নির্ভর করছে।
চলো, বাড়ি ফেরা যাক। হাতে এখনও পুরো তিনঘন্টা সময় আছে। এই ফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে।
ওয়াটার ফ্রন্টের পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় দেখলাম আগের সেই পুরোনো কনস্টেবলের বদলে দুজন নতুন কনস্টেবল পাহারা দিচ্ছে। দুজনেই বয়সে যুবক, মুখে কঠোর কর্তব্যনিষ্ঠার ছাপ। যাক, আমার উপদেশ মত লেপস্কি তাহলে সত্যিই এখানে নতুন লোক বসিয়েছে। এরা ইচ্ছে করলে অনায়াসে ওয়ালিনস্কির ব্ল্যাকমেলের কারবার একদিনে বন্ধ করে দিতে পারে।
বিল বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ল। রিভলবার দুটো পরিষ্কার করে গুলি ভরে আমিও কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নিলাম। দেড়টা বাজতে বিলকে তুলে গাড়ি চালিয়ে ওয়াটার ফ্রন্টে ফুঁ চায়ের রেস্তোরাঁ থেকে ত্রিশ গজ দূরে গাড়ি পার্ক করে স্যার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। গাড়িতে বসে দেখলাম বহুলোক রেস্তোরাঁয় ঢুকছে। তাদের মধ্যে কিউবান, চীনা, আমেরিককান সবজাতের লোক আছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তারা আবার বেরিয়ে আসছে। আমার বুঝতে বাকি রইল না যে এরা সবাই ব্ল্যাকমেলের শিকার।
একটা ছোট মার্সিডিজে চেপে দুটোর পর স্যান্ড্রা এলো। বিল ঐ যে স্যান্ড্রা এসেছে। তুমি এখানেই অপেক্ষা করো, আমি ওর কাছে যাচ্ছি। দরকার হলে এখান থেকে গুলি করে কভার করবে।
বিল প্রশ্ন করল, ডার্ক, যদি ঝামেলা হয় তাহলে গুলি করে সবকটাকে শেষ করব?
একশোবার, নইলে ওদের গুলিতে আমরাই শেষ হয়ে যাব।
গাড়ির দরজা খুলে স্যার পাশে বসলাম। অন্ধকারে ওকে ঠিক পাথরের মূর্তির মত দেখাচ্ছিল। হালকা দু একটা কথা বলে চুপ করে যেতে বুঝলাম ও কথা বলতে চাইছে না।
চুপচাপ বসে আধঘণ্টা কেটে গেল। আরও আধঘণ্টা পর তিনটে নাগাদ স্যান্ড্রা ফিসফিসিয়ে বলল, ঐ যে ওরা আসছে। একটা বড় ক্যাডিলাক এসে রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়াল। চারজন স্বাস্থ্যবান যুবক রিভলবার বাগিয়ে গাড়ি থেকে নামল। পেছনে নামল হুলা মিনস্কি। লম্বা চওড়া আর স্বাস্থ্যবান দেহরক্ষীদের মাঝখানে তাকে বেঁটে বামনের মত লাগছিল।
ঐ যে হুলা মিনস্কি। ঐ বাঁটকুল বেজন্মা বদমাশটাই তোমার বাবাকে খুন করেছিল। যা করবার তাড়াতাড়ি করে ফেল।
ধন্যবাদ ডার্ক, বলে গাড়ি থেকে নেমে স্যান্ড্রা মিনস্কির দিকে এগিয়ে গেল। গাড়ির দরজা বন্ধ হবার শব্দে তার চার দেহরক্ষী চমকে ফিরে তাকাল। কিন্তু স্যান্ড্রাকে দেখে তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
স্যান্ড্রা চাচাছোলা গলায় সেই শয়তানের নাম ধরে ডাকল, মিনস্কি? আমি স্যাড়া। জো ওয়ালিনস্কির কাছ থেকে একটা দরকারী খবর তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। বলতে বলতে স্যা রেস্তোরাঁর বারান্দায় আলোর নীচে মিনস্কির মুখোমুখি দাঁড়াল। আমি নিঃশব্দে গিয়ে গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে মিনস্কি আর চারজন দেহরক্ষীর ওপর নজর রাখলাম।
স্যান্ড্রার নাম শুনে মিনস্কির দেহরক্ষীরা সবাই পিছনে সরে গিয়েছিল। স্যান্ড্রার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একপলক দেখে মিনস্কি বলল, তুমিই স্যা? জো ওয়ালিনস্কির হঠাৎ আমাকে কি দরকার পড়ল?
রুক্ষ জোরালো গলায় স্যান্ড্রা বলল, উনি তোমার জন্য বিশেষ জরুরী খবর পাঠিয়েছেন।
তাতো বুঝলাম, কিন্তু খবরটা কোথায়?
ওটা এর ভেতরে রেখেছি। বলে স্যান্ড্রা তার ব্যাগটার জিপ খুলে ভেতরে হাত ঢোকাল। সে ব্যাগ খুলতে চার দেহরক্ষী আরও পিছিয়ে গেল। স্যান্ড্রার প্রত্যেকটি কথা বলার ভঙ্গি, তার পদক্ষেপ এত পেশাদার আর নিখুঁত যে মিনস্কি সন্দেহ করতেই পারল না। সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল স্যার দিকে। আর সেই ফাঁকে বিদ্যুতের বেগে স্যান্ড্রা অটোমেটিক পিস্তল বের করল। মিনস্কি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই পিস্তলের অনেকগুলো বুলেট বিধে গেল তার বুকে ও পেটে। নিদারুণ যন্ত্রণায় তার চোখমুখ কুঁচকে গেল দুহাতে পেট চেপেমিনস্কি মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ল
পুতুলের মত মিনস্কির দেহরক্ষীরা দাঁড়িয়ে রইল। পদমর্যাদায় স্যান্ড্রা মিনস্কির চাইতে বড়, হয়তো তাই পাল্টা গুলি চালাতে তারা সাহস পেল না।
স্যান্ড্রা ওপরওয়ালার মত মেজাজে তাদের বলল, শোন সবাই। ওয়ালিনস্কির ইচ্ছেতেই ওকে খতম করতে হল। এবার পুলিশ আসার আগে ওর লাশটা এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও।
আপনি যখন বলছেন তখন তাই করব মিস স্যান্ড্রা।
মিনস্কির মৃতদেহটার দিকে স্যান্ড্রা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে তারপর পেছন ফিরে কোন ব্যস্ততা না দেখিয়ে যেন নিতান্ত স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ঘটেছে এমনি ভাবে হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসল। ঠাণ্ডা মাথায় এই অনুষ্ঠানটি দেখে আমার মত ঝানু গোয়েন্দাও তাজ্জব হয়ে গেল।
স্যান্ড্রা বলল, দেখলেন তো ডার্ক। এবার পুলিশ আসার আগে এখান থেকে কেটে পড়ুন। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, তাহলে আপনার আর আমার দুজনেরই শোধবোধ হয়ে গেল। কেমন?
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
মার্সিডিজ গাড়ি স্টার্ট নিল। তার হাসিমাখা কথা কানে এল।
এই আমাদের শেষ দেখা ডার্ক। এরপর আর হয়তো কখনও দেখা হবে না।
হুশিয়ার স্যান্ড্রা মাফিয়ার হাত কিন্তু খুব লম্বা। যেখানেই যাও না কেন ওরা ঠিক তোমার পেছন পেছন ধাওয়া করবে।
আমার পা দুটো খুব লম্বা ডার্ক। আমি ওদের চেয়ে বেশি জোরে দৌড়তে পারি, বিদায়! বলেই নিমেষে মিলিয়ে গেল গাড়ি।
পুলিশের সাইরেনের আওয়াজ শোনা যেতেই মিনস্কির চার দেহরক্ষী তার মৃতদেহটা গাড়ির পেছনে ক্যারিয়ারে নিয়ে তুলল। আমার প্রয়োজন মিটেছে ভেবে দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বিল আগেই ভেতরে বসেছিল। সে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। অনেকগুলো গলি ঘুপচির ভেতর দিয়ে একসময় বড় রাস্তায় এসে পৌঁছলাম। এখন আমাদের লক্ষ্য সোজা বাড়ি।
অ্যাঞ্জেলা, হ্যাঙ্ক, মিনস্কি তিনজনেই তাদের পাওনা বুঝে পেয়েছে। শোধ নেবার মত আর কিছু এখন মাথায় আসছে না। কিন্তু সুজির কথা বহুদিন আমি ভেবে যাব এই শোধ নেওয়ার পরেও। জীবনীশক্তি আর উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ আমার সেই প্রিয়বান্ধবী, ভয়ঙ্কর মৃত্যু যাকে বরণ করতে পেরেছে। যাই করি না কেন, ওর শূন্যস্থান আর কেউ পূর্ণ করতে পারবে না।
বাড়ির সদর দরজা ভাল করে এটে আমি আর বিল দুজনে বসলাম। বাপরে! মেয়ে বটে একখানা। মিনস্কিকে খুন করার দৃশ্য ভোলার নয়। এমনভাবে এগিয়ে এসে গুলী ছুঁড়ল যেন এটা কোন ব্যাপারই নয়, ঠিক পেশাদার খুনীদের মত। চলো, এবার শুতে যাওয়া যাক।
বিল ঘড়ি দেখে বলল, পাঁচটা বাজে। ভাল করে ঘুমিয়ে উঠে সকালে ভারী ব্রেকফাস্ট খেয়ে তারপর আমরা কর্নেলের কাছে গিয়ে বলব, স্যার। আমরা বদলা নিয়েছি। আমাদের আবার কাজে। বহাল করুন।
ঠিক আছে বিল তাই হবে।
বিল কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ডার্ক, এবার দুঃখের পুরনো স্মৃতি ভুলে যাও। অতীতকে আঁকড়ে ধরে কেউ বাঁচতে পারেনা। সবাই ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বেঁচে থাকে। আগামীকাল সকালে আবার নতুন দিন শুরু হবে। নতুন জীবনও। চলো, আমরা শুতে যাই।
বড় মোড়াখাটের বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকেছে, সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম প্রতিশোধ নিতে পেরেছি। অ্যাঞ্জেলা পাগলা গারদে। হ্যাংক আর মিনস্কি দুজনেই খতম হয়েছে। পাশের বালিশে আদর করার মত আলতো হাতে বোলালাম। এই বালিশে সুজি মাথা রেখে কত রাত আরামে ঘুমিয়েছে।
কিছুতেই ঘুম আসছে না। সূর্যের সোনালী আলোয় ঘরটা ভরে উঠেছে।
ঠিকই বলেছে বিল। অতীতকে আঁকড়ে ধরে আমি বাঁচতে পারব না। আগামী কাল সকালে আবার নতুন দিন শুরু হবে, তার ঐ কথাটা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।
সুজির সেই বালিশের ওপর হাত রেখে ভাবতে ভাবতেই শেষকালে সত্যিই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।